একোরিয়াম

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ২২/০৭/২০১৫ - ৫:১০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

"কই যাচ্ছিস?"
শাহেদের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বেরিয়ে গেল মুহিত। টুটুল ভাইয়ের রুম থেকে ঝড়ের মত বেরোতে দেখে শাহেদ আঁচ করেছিল যে কিছু একটা কান্ড হয়েছে।শুধু সেই না,আশেপাশের কিউবিকলের সবাই অবাক হয়ে মুহিতের দিকে তাকিয়েছিল।যেভাবে দড়াম করে ম্যানেজারের রুমের দরজা বন্ধ করে মুহিত বেরিয়েছিল, অবাক না হওয়াটাই হত অবাক করা ব্যাপার।যাহোক সবাই কিছুক্ষন মুখ চাওয়াচাওয়ি করে নিজের কাজ মন দিলেও শাহেদ সেটা পারলোনা।হাজার হলেও মুহিত তার শুধু কলিগ না,বন্ধুও বটে।সেই কলেজ থেকে সে এই পাগলাকে চেনে।আজকে সে টুটুল ভাইয়ের সাথে কি অনর্থ করেছে সেটা না জেনে তাই শান্তি নেই।সুতরাং খানিক ভেবে সেও মুহিতের খোঁজে বেরিয়ে গেল।

নীচে নেমে গলির মুখে যেয়ে শাহেদ দেখল তার ধারনা ঠিক।জলিলের টং দোকানে দাঁড়িয়ে মুহিত বাটারবন খাচ্ছে। খাচ্ছে না বলে,হামলে পড়েছে বলাটা বেশি যথার্থ হবে।
-"তোর ভাবেসাবে মনে হচ্ছে,টুটুল ভাইয়ের কানের লতি কামড়াচ্ছিস"
অন্যসময়ে শাহেদের এই রসিকতায় মুহিত খ্যাক খ্যাক করে হাসত। আজ না হেসে বরং চোখ পাকিয়ে তাকাল।
ওর রক্তচক্ষুকে পাত্তা না দিয়ে শাহেদ বলল -"আরে ফোঁসফোঁস না করে কি হয়েছে সেটা তো বলবি"
-"কিছু না"
-"সামনের মাসে ইয়ারলি ইভালুয়েশন আর তুমি আজকে বসের মুখের উপর দরজা বন্ধ করে চলে আসছ,আবার বলছ কিছুনা।ফাতরামির আর জায়গা পাওনা?"
-"এই তুই গেলি? ওই হারামি টুটুল আর তার ইভালুয়েশনের আমি গুল্লি মারি"।মুহিত অবশ্য গুল্লি নয় অন্য কিছু "মারার" কথা বলছিল,শালীনতার খাতিরে সেটা আর লেখা গেলনা
- "যা খুশি মার, কিন্তু কি হয়েছে সেটা আগে বল?"
-"এবার কিন্তু তুই লাথি খাবি,বললাম না কিছু হয় নাই?"-মুখ শক্ত করে মুহিত বলে।

শাহেদ বুঝল এভাবে আজকে হবেনা,অন্য কিছু করতে হবে।
-"দোস্ত, চল চাইনিজে যাই,অনেক দিন চায়না কিচেনে যাইনা।টেনশন নিস না,বিল আমি দিবো"
-"খাবো না, বাটারবন খেলাম মাত্র,ক্ষিদে মরে গেছে"।
-"আরে হেঁটে যাব, এই ঠাঠা রোদের মধ্যে দশ মিনিট হাঁটলে আবার ক্ষিদে পাবে।একান্তই না পেলে তুই শুধু স্যুপ খাবি, সমস্যা কি?"
এতক্ষণে মুহিতকে কিছুটা আগ্রহী মনে হয়।ঋষি দূর্বাসার তপস্যা ভাঙ্গাতে অপ্সরা মেনকার দরকার পড়েছিল।দুর্বাসার জায়গায় মুহিত থাকলে মেনকা-টেনকায় কুলাত না,এক বাটি "থাই স্যুপ থিক" দরকার পড়ত।
-"কি ব্যাপার,খাওয়ানোর জন্য এত জোর করছিস কেন, বিয়ে ঠিক হল নাকি তোর? শর্মিকে পটিয়ে ফেললি নাকি?"- এবার মুহিত পালটা প্রশ্ন করে।

শর্মি ফাইন্যান্স ডিপার্টমেন্টে কাজ করে,তাকে 'মিস অফিস' বলা যেতে পারে। ওদের বয়সী অবিবাহিত ছেলেগুলো তো বটেই, বুড়োহাবড়া গুলো পর্যন্ত শর্মি আশেপাশে থাকলে থাকলে কারনে-অকারনে নানান রকম রসিকতা করার চেষ্টা করে। কেউই যদিও পাত্তা পায় না।
-"আরে নাহ এসব শর্মিদেরকে উপরওয়ালা বানিয়েছে বিদেশপার্টি কিংবা ব্যাবসায়ী নাহয় আর্মিদের জন্য।তোর আমার জন্য বরাদ্দ হচ্ছে সারদিন ফ্যাচর ফ্যাচর করা কোন শাকচুন্নি"।

কথাটা শাহেদ বিস্তর হতাশার সাথে বলল বটে কিন্তু চাপা খুশি আটকাতে পারল না। শর্মি প্রসংগ উঠলেই শাহেদ এ জাতীয় কথা বলে কিন্তু ঠোঁট আর চোখের কোণের হাসি লুকাতে পারেনা।

জগতের যেকোন দুই তরুন বন্ধুর মাঝে যত হাই ভোল্টেজ আলোচনাই হোক না কেন,মাঝখানে কোন তরুনীর প্রসংগ আসলে ভোল্টেজ কমে যেতে বাধ্য।সুতরাং মিনিট বিশেক পরে শাহেদ আর মুহিতকে চায়না কিচেনে বসে অর্ডার দিতে দেখা গেল। স্যুপ আর মেইন ডিশ আসতে সময় লাগবে, তাই পেপসিতে চুমুক দিয়ে শাহেদ আবার জিজ্ঞেস করলঃ
-"এবার বল কাহিনী কি?"
-"আর বলিস না, টুটুল ভাই আমার ক্রেডিট মেরে দিয়েছে"।
সম্বোধন 'হারামী' থেকে 'ভাই' তে নেমে আসায় বোঝা গেল যে এসির বাতাস আর ঠান্ডা পেপসির কল্যানে মুহিতের মেজাজ কিছুটা ঠান্ডা হয়েছে।এবার সে মুখ খুলবে।
-"কিন্তু কিভাবে?" শাহেদ আবার জিজ্ঞেস করে।
-"আমদের একটা প্রজেক্ট আছে সামনে,ওখানে ব্যান্ডউইডথ বাঁচানোর একটা আইডিয়া উনাকে দিয়েছিলাম।উনি প্রথমে পাত্তা দেননি।নানা রকম ফাঁকফোকর বের করার চেষ্টা করলেন।গত এক সপ্তাহে নিজের সব কাজ শেষ করে,রাত জেগে এক্সট্রা খেটে একটা ফুলপ্রুফ আইডিয়া দাঁড়া করলাম,একেবারে খুঁটিনাটি ডিটেল সহ।উনি তখন আমাকে বললেন এটা নাকি কিছুই হয় নাই"
-"সেটা উনি বলতেই পারেন,তোর আইডিয়া পছন্দ হতেই হবে এমন কোন আইন আছে নাকি?"
-"আরে গাধা, পছন্দ না করলে তো কোন সমস্যা ছিলনা।ওই শুয়োর আসলে আইডিয়াটা পছন্দ করেছে,তারপর সেটাকে কয়েকটা স্লাইডে ফেলে রংচং মাখিয়ে নিজের নামে ডেনিসের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে"।

এতক্ষণে কাহিনী একটু পরিষ্কার হতে থাকে, ডেনিস হচ্ছে ওদের কোম্পানির টেকনিকাল হেড,জাতে ব্রিটিশ।
-"এবং ডেনিস সেটা পছন্দ করেছে, তাই তো?" নিশ্চিত হবার জন্য শাহেদ প্রশ্ন করে।
-"আবার জিগায়।শুধু কি পছন্দ?উচ্ছসিত প্রশংসা করে পুরো ডিপার্টমেন্টের কাছে মেইল পাঠিয়ে বলেছে আমরা সবাই যেন উনার মত ক্রিয়েটিভ হতে চেষ্টা করি।"
-"এটা নিয়েই আজকে টুটুল ভাইয়ের সাথে কথা বলতে গিয়েছিলি? কি বলে ব্যাটা?"
-"বলে যে শুধু আইডিয়ায় নাকি কিছু হয় না, সে যে অনেক রকম প্রশ্ন করেছিল সেখান থেকেই নাকি প্ল্যানটা দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া সে যে স্লাইডগুলো বানিয়েছে সেটাই নাকি আসল।পুরো জিনিসটাকে 'প্রেজেন্টেবল' ফর্মে এ নিয়ে আসাতেই নাকি আসল কৃতিত্ব! এইসব আলতু ফালতু কথাবার্তা।"
-"বুঝলাম,তোর মেজাজ খারাপ হওয়া স্বাভাবিক;কিন্তু বসের সাথে লাগতে যাওয়ার তো কোন মানে নেই। মাঝখান দিয়ে তোকে তো এখন খারাপ রেটিং দিবে।"
-"ওর রেটিং এর খেতা পুড়ি, করলাম না আর এই চাকরি।আজকেই রিজাইন দিয়ে লাথি মেরে বেরিয়ে যাব।"
-"তাই নাকি?তোর জন্য আরেকটা চাকরি নিয়ে কে বসে আছে?মাস শেষে বাড়িতে টাকা পাঠাতে হবে, মনে আছে?"
-"একটা কিছু ম্যানেজ হয়ে যাবে"
-"ফাও কথা বলিস না,এত সোজা না।আর আরেকটা চাকরি যদি পেয়েও যাস সেখানের বসও যে ফেরেশতা হবে কে বলেছে?"
-"ফেরেশতা চাই না,মানুষ হলেই চলবে"
-"ঐ হল, মানুষ বস যে পাবিই সেই গ্যারান্টি কে দিচ্ছে?"
শাহেদ এবার ওকে বোঝানোর জন্য বন্ধুবান্ধব আর কলিগদের মুখে শোনা নানা রকম 'বস সমাচার' বয়ান শুরু করল।

মুহিতের সেদিকে মন নেই, সে এক মনে স্যুপ খাচ্ছে আর সামনের টেবিলের পাশে রাখা মাঝারি সাইজের একোরিয়ামের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। একোরিইয়ামে সাধারনত নানান রঙের মাছ থাকে,এখানেও আছে।ব্যাতিক্রম হচ্ছে দশ বারোটা মাছের মাঝে ছোট্ট একটা কাছিমও দেখা যাচ্ছে। কাছিমের পিঠের ছোট্ট খোলের খাঁজে বোধহয় শেওলা বা মাছের খাবার কিছু একটা জমে আছে।একটা রুপালি রঙের বড় মাছ সেটা ঠুকরে খাবার চেষ্টা করছে।কাছিমটা কিছুটা বিরক্ত হয়ে সেখান থেকে সরে নীচে নেমে গেল।মিনিট খানেক পর মাছটা আবার সেখানে গিয়ে হাজির। আবারো বিরক্ত হয়ে কাছিমটা ডানে সরে এসে একোরিয়ামের ভেতরেই পাতা আর গাছের ডাল দিয়ে বানানো জঙ্গলামত একটা জায়গায় এসে লুকায়।লাভ হয় না, মিনিট খানিক পর রুপালি মাছটা ওকে ঠিকই খুঁজে বের করে। কাছিমটা এরপর বামে,তারপরে উপরে,তারও পরে নীচে যায় কিন্তু একোরিয়ামের কাঁচের দেয়াল সে আর পেরোতে পারেনা, মাছটাকেও খসাতে পারেনা...

ঘন্টা খানেক পর বসের রুমে ঢুকে মুহিত মাথা নীঁচু করে সরি বলে।টুটুল ভাই কোন কথা না বলে ল্যাপ্টপের বোতাম টেপাটেপি করতে থাকেন। মিনিট পাঁচেক দাঁড় করিয়ে রেখে শেষে বললেনঃ
-"তোমার এটিচুড খুবই আনপ্রফেশনাল,আমি লিবারেল মানুষ বলে এবারে তেমন কিছু করলাম না।শুধু ওয়ার্নিং দিলাম, বুঝতেই পারছ রেটিং এ সেটার ইফেক্ট থাকবে,এখন যেতে পার"।
মুহিত যখন বেরিয়ে যাচ্ছিল,তখন আবার বললেন-
-"হুট করে কিছু করবেনা,অলওয়েজ লুক এট দা বিগ পিকচার"
কোন কথা না বলে নিঃশব্দে দরজা ভেজিয়ে বেরিয়ে এল মুহিত।কথা বাড়িয়ে লাভ কি? একোরিয়ামের ভেতরের কাছিম জীবন নেহায়েত মন্দ নয়, অন্তত 'বিগ পিকচারে'!

-গগন শিরীষ


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক

দেবদ্যুতি

গগন শিরীষ  এর ছবি

ধন্যবাদ দেবদ্যূতি!

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখা উত্তম হয়েছে। চলুক আমরা যারা কর্পোরেট কামলাগিরি করছি তাঁরা আসলেই একেকটা কাছিমের মতই। মন খারাপ

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

গগন শিরীষ  এর ছবি

এক্কেবারে! জীবন থেকে নেয়া!

অতিথি লেখক এর ছবি

একোরিয়াম ই বটে। ভালো লাগলো।
----------------------------
ইচ্ছে মত লিখি
http://icchemotolikhi.blogspot.in/

গগন শিরীষ  এর ছবি

পড়ার জন্য ধন্যবাদ!

মরুদ্যান এর ছবি

চলুক

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে

গগন শিরীষ  এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

গৌতম হালদার এর ছবি

দ্যা আনএভয়েডাবল কর্পোরেট রিয়ালিটি। থাঙ্কস আ লট ফর গিভিং আস সাচ আ ন্যাচারাল গল্প।

গগন শিরীষ  এর ছবি

থ্যাংক ইয়ু টু ফর ইয়োর কাইন্ড মন্তব্য হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।