ভাষাপোকা (১ম পর্ব)

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ২৩/০৭/২০১৭ - ১:৪৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ভাষাপোকা (১ম পর্ব)

রাজিব মাহমুদ

সারা রাত একটানা ঝরার পর ভোরের আগে আগে বৃষ্টিটা ধরে আসে। এটা বর্ষার বৃষ্টি না; তবে বর্ষার পূর্বসূচক হতে পারে। সৌম্যদের বাড়ির দক্ষিণের খালি প্লটটার চারপাশে ইটের বাউন্ডারি দেয়া। ওখানে সারা রাত ঘাসের গোড়ায় বৃষ্টির পানি জমতে জমতে এখন আগা ছাড়িয়েও ইঞ্চি খানেক উপরে উঠে গেছে পানির স্তর। ঘাসগুলো ভোরের এই ময়লা-চাদর আকাশের আলোয় অদৃশ্য হয়ে আছে। বেশ টলটলে একখন্ড একটা পুকুর হয়ে আছে পুরো জায়গাটা। রাতের সেই প্রথম প্রহর থেকেই ভেসে আসছে গ্যাঁ-গোঁ গ্যাঁ-গোঁ ব্যাঙের ডাক। রাত বাড়ার সাথে সাথে চারপাশের অন্য সব শব্দ কমতে থাকে; সেই শূণ্যতা দখল করে ব্যাঙদের এই কোরাস। এক অদ্ভুত কর্তৃত্বের সুর এই শব্দে-ছেয়ে ফেলে রাতের ঘুম-ক্লান্ত শরীর। এর সাথে যোগ হয়েছে হাল্কা বৃষ্টির ফিনফিনে শব্দ। সব মিলিয়ে এক ঘনঘোর ঐকতান-প্রকৃতির নিজস্ব এক এ্যাকোস্টিক কনসার্ট যেন বা। একটা ঘুটঘুটে বিলম্বিত ভোর অন্ধকারের দীর্ঘ ঘুম থেকে যেন খুব অনিচ্ছায় জেগে উঠছে। এই অনিচ্ছাটা মেঘদেরও আছে। শুধু আছে কী, একেবারে ষোল আনাই আছে। আর আকাশেরই বা নেই কে বলল? কাঁথার নীচের ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা মায়াময় ঘুমটা ছেড়ে ওঠার আলস্যটা তো বোঝাই যাচ্ছে। তবে কেষ্টা হয়ে যায় বেচারা ভোর, সব দোষ যেন তারই-কেননা সে যে সবার চোখের সামনে!

সৌম্য ওর ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। তার চোখে কেমন একটা ঘোলাটে ধ্যানমগ্নতা। মাঝে মাঝেই রাতে সৌম্য’র ঘুম আসে না । একটা দৈনিকের ক্রাইম রিপোর্টার সে। বাবা মারা যাওয়ার পর মা’কে নিয়ে নিজেদের বাড়িতেই থাকে। সংবাদ সংগ্রহে ছুটতে হয় বিভিন্ন জায়গায়। তখন খাওয়া-ঘুম কিছুরই ঠিক থাকে না। স্পেশাল এ্যাসাইনমেন্ট হলে তো কথাই নেই। তবে যেখানেই যখন রাতে থাকতে হয় সেখানেই জানালার কাছাকাছি বসে থাকাটা অভ্যাস হয়ে গেছে। কখনো কখনো গান শোনে বসে থাকার সময়। জিম মরিসন অথবা এডি র‍্যাবিট কিংবা বাংলা ব্যান্ড। ভোরের দিকে টের পায় যে ওর রাত-জাগা ইন্দ্রিয়গুলো ভয়ঙ্কর তীক্ষ্ম হয়ে উঠেছে; বোবা জীবের ভাষাও যেন পড়তে শিখে গেছে ওরা। সাথে একটা ঝিমঝিমে ক্লান্তিও থাকে সাথে। পুরো ব্যাপারটাকে করোটির ভেতরের আঁধারে জিইয়ে রাখে সকাল হওয়ার আগে আগে বিছানায় গলে পড়ার স্বাদু মুহূর্তটাকে উপূর্যপুরি পাওয়ার জন্য। আজও যেমনি আছে।

ঘটনাটা ঘটে গেলো এই ক্লান্তি আর ঘুমের ক্রান্তিতে। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ক্লান্তিকর তর্কটা যাতে উঠতেই না পারে সেজন্যই হয়ত এই ক্ষণটুকুর সতর্ক নির্বাচন। শুরুটা এরকম: সৌম্য’র মনে হয় ওর মগজের ভেতর থেকে কেউ কথা বলছে। তবে এই কথা বলার শব্দটা বড় অদ্ভুত। চেনা ভাষাগুলোতে স্বর-ব্যঞ্জন ধ্বনির ঘনবদ্ধ যে বুনোট থাকে সেরকম কিছু নয়; এটা অনেকটা হাল্কা শিস আর গভীর ওঙ্কারের মিশ্রণে তৈরি হওয়া একটা ব্যাপার মনে হচ্ছে। শব্দের উৎস খুঁজতে ও চারপাশে তাকালে চোখে পড়ে না কিছুই। বরং শোনা যায় চাপা হাসির মত একটা শব্দ। চকিতে চারপাশে তাকিয়ে “কে?” বলে উঠতে চাইলেও সৌম্য’র গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বের হয়না।
আবার শোনা যায় সেই শিস আর ওঙ্কারের মিশ্রণ। যেন কেউ একজন বলে ওঠে, “আমি”। ও পরিষ্কার শোনে শব্দটা কিন্তু চেনা কোন মাধ্যমে নয়। একটা অস্পষ্ট ভয়ের শিহরণ চামড়া গলে শরীরের ভেতরে ঢুকে যায়। হাত-পা শক্ত হয়ে আসে, শ্বাসনালীর কাছে বাতাস যেন হঠাৎ-ই আটকে গেছে, দুলে ওঠে মাথার ভেতরটা। গলার কাঁপুনি সামলাতে সামলাতে একটা দৃঢ় ভাব ফোটানোর চেষ্টা করে সৌম্য জিজ্ঞেস করে, “আমি কে?”

“আমি ভাষা”

“ভা...ষা!!!”

“হ্যাঁ, ভাষা। অবাক হচ্ছো নাকি?”

সৌম্য কী বলবে বুঝে উঠতে পারে না। ওদিকে ভাষা বলে যায়-

“অবাক হচ্ছো নাকি ভয় পাচ্ছো?”

কয়েক সেকেন্ডের বিরতি দিয়ে ভাষা আবার বলে-

“অবশ্য তোমরা মানুষেরা তো এক ঈশ্বর ছাড়া বিমূর্ত কিছুতে বিশ্বাসই করোনা। মানে বিমূর্ত হলেও তার একটা মূর্ত শরীর চাই তোমাদের। তুমি চাইলে ভাষা’র পরে একটা ‘পোকা’ লাগিয়ে ডাকতে পার আমাকে।”

সৌম্য অনড় বসে থাকে। ও পরিষ্কার সবকিছু শুনতে ও বুঝতে পারছে কিন্তু কীভাবে পারছে সেটাই বুঝতে পারছে না।

“কি, পছন্দ হল না নামটা?” ভাষাপোকা জিজ্ঞেস করে।

সৌম্য ফিসফিস বা বিড় বিড় করে কী বলল বোঝা গেলনা।

“‘হ্যাঁ’ বললে নাকি ‘না’?

“উম্‌ম্‌ হ্যাঁ...না হয়েছে।”

“এর মানে কি ‘হ্যাঁ’ আর ‘না’ দু’টোই নাকি? যদি তাই হয়, তাহলে বলব ‘ওয়াও’। তুমি যে কোন একটা সম্ভাবনা নিয়ে গোঁড়া নও। দু’টোকেই চলতে দিচ্ছ পাশাপাশি। সবাই তোমার মত হলে তোমাদের মানুষদের সভ্যতা অন্য স্তরে চলে যেত। তোমাকে পছন্দ হয়েছে আমার। মনে হচ্ছে তোমাকে নির্বাচন করাটা বুদ্ধিমানের কাজ হয়েছে ”

“কীসের নির্বাচন?”

“মানুষদেরকে সাবধান করার সময় এসেছে। তারা বড্ড বাড়াবাড়ি শুরু করেছে। তোমাকে নির্বাচন করা হয়েছে সব মানুষের কাছে এই সাবধান বাণী পৌঁছে দেবার মাধ্যম হিসেবে।”

“কীসের বাড়াবাড়ি? কী বলছো এসব?”

“বলব আস্তে আস্তে। কেবল তো পরিচয় হলো।”

“আচ্ছা তাই নাকি? কিন্তু তুমি কোথা থেকে কথা বলছো?” সৌম্য জিজ্ঞেস করে।

“তোমার মগজের বাম পাশ থাকে। ‘অঙ্ক’ আর ‘যুক্তি’ আমার প্রতিবেশী।”

“আচ্ছা!!” এবার যেন সৌম্য একটু মজাই পেয়ে যায়।

“হ্যাঁ তাই।”

“কিন্তু তুমি আমার সাথে কী ভাষায় যোগাযোগ করছ?”

“কী ভাষা মানে? আমি নিজেই তো ভাষা”

“না মানে বাংলা যেমন একটা ভাষা...ইংরেজি একটা ভাষা...”

“ওগুলো তো আমার একেকটা কায়িক রূপ। আমি নিজে বিমূর্ত ”

“বিমূর্ত কিছুর আবার কায়িক রূপ থাকে নাকি?”

“থাকে না বলছো? তাহলে যাকে মানি’ বা বাংলায় ‘অর্থ’ বলছো সেটা তো একটা বিমূর্ত ব্যাপার, একটা কনসেপ্ট। আর এই কনসেপ্টের-ই বিভিন্ন দৃশ্যমান রূপ হল ‘টাকা’, ‘ডলার’, ‘ফ্রাঙ্ক’ ইত্যাদি”

“কিন্তু তুমি তো আমার সাথে কথা বলছো। তার মানে তুমি আছো...”

“হ্যাঁ আছি কিন্তু তুমি থাকা বলতে যা বোঝ সে অর্থে নেই। অর্থাৎ থাকা মানেই দৃশ্যমানতা নয়”

“তুমি কি সত্যিই অদৃশ্য নাকি লুকিয়ে আছো কোথাও?”

“এখানেই তোমাদের মানুষদের সমস্যা। তোমরা দৃশ্যমান বস্তু ছাড়া কিছু বোঝ না। অথচ নিজেরা বড় বড় সব অদৃশ্য ব্যাপার সৃষ্টি করে বসে আছো।”

“কীরকম?”

“ধরো তোমাদের চিত্রকলা। এটা তো দৃশ্যমান কিছু না।

“মানে কী? চিত্রকলা মানে চিত্রের কলা অর্থাৎ দেখার একটা ভঙ্গি বা কৌশল। না-ই যদি দেখা গেলো তো দেখার ভঙ্গির প্রশ্ন আসছে কোত্থেকে?

“আদতে ব্যাপারটা সেরকম নয় একেবারেই।”

“তাহলে কীরকম?”

“দেখা তো যায় শুধু ঐ ক্যানভাস আর রং যেগুলো দিয়ে কিছু বিমূর্ত ‘ভাব’ বা ‘আবেগ’কে বন্দী করার চেষ্টা করা হয়েছে। ভাব আর আবেগ তো অদৃশ্য। ওগুলো তুমি দেখবে কী করে?”

সৌম্য হতবুদ্ধি হয়ে যায়। ব্যাপারটা এভাবে সে কখনো ভেবে দেখেনি।

“তুমি নিজেই ভেবে দেখো। ব্যাপারটা এরকম-ই নয় কি?”

সৌম্য তবুও চুপ। ও এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না যে ও কারও সাথে কথা বলছে। বরং মনে হচ্ছে ওর নিজেরই একটা সত্ত্বা আরেকটা সত্ত্বার সাথে বলছে।

ওদিকে ভাষাপোকা বলে যায়-

“যেমন ধরো তোমাদের ভাষাবিজ্ঞানীরা তো মনে করেন যে ভাষা শুধুই ‘ফর্ম’ বা ‘খোলস’। এর ভেতরে কোন সাব্‌সটেন্স বা পদার্থ নেই। কী হাস্যকর কথা! সাব্‌সটেন্স ছাড়া ফর্ম থাকে না-কি?

এখানে খানিকক্ষণের বিরতি। তারপর আবার-

“তোমরা মানুষেরা আমাকে যে কতভাবে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করলা এই পর্যন্ত ...আমি নাকি লিখিত অক্ষর, আমি নাকি শ্রুত ধ্বনি...আমি নাকি মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম...অর্থাৎ সেই পুরনো ব্যাপার...আমি ফর্ম...আমার ভেতরটা ফাঁপা...কোন সাব্‌সটেন্স নেই। আরে বাবা তাই যদি হত, তাহলে আমি তোমার সাথে কথা বলছি কীভাবে? তুমি তো আমাকে দেখতে পাচ্ছো না। আমি শুধু ফর্ম হলে তো তোমার আমাকে দেখতে পাওয়ার কথা ছিল”

এ পর্যায়ে সৌম্য হঠাৎ-ই প্রচণ্ড রেগে যায় সৌম্য, বলে-

“তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না কারণ তুমি আমার মনের কল্পনা। ভাষাপোকা টোকা বলে কিছু নেই। সারা রাত জেগে থাকার কারণে আমি এসব উল্টাপাল্টা ভাবছি। জেগে উঠেই দেখব সব স্বাভাবিক।”

শব্দ করে হাসে ভাষাপোকা, তবে সেটা স্পষ্টতই বিরক্তির হাসি-

“এখন মনে হচ্ছে তোমাকে নির্বাচন করা ভুল হয়েছে। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম তুমি অন্য মানুষদের থেকে আলাদা। যেমন বলেছিলাম যে তুমি দু’টো সম্ভাবনাকেই দেখে ওঠো। কিন্তু এখন দেখছি আমার ধারণা ভুল। তুমিও অন্য মানুষদের মতই। তোমাদের ব্যাখ্যার মধ্যে যা ধরা দেয় না তোমরা সেটাকে ভুল প্রমাণের জন্য উঠে পড়ে লেগে যাও। ওটাকে মিথ্যা প্রমাণ করে নিজেদের বুদ্ধির জয় ঘোষণা তোমাদের করতেই হবে। যাই হোক। ভালো থেকো। হয়ত আবারো কথা হবে কিংবা হবে না। বিদায়! (চলবে)

ছবি: 
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন

মন্তব্য

মেঘলা মানুষ এর ছবি

গল্প ভালু, ছবিটা পঁচা।

শুভেচ্ছা হাসি

রাজিব মাহমুদ এর ছবি

শুধু পঁচা না, একেবারে জঘন্য ছবি। আপলোডের পরপরই এই জঘন্যতা পুরোপুরি দৃষ্টিগোচর হয়েছে। পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

রাজিব মাহমুদ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।