অমিয়র গল্প

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৬/১১/২০১৭ - ৪:৫৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এক.
বাসার ঠিক পেছনেই পাইন হিকরির একটা জঙ্গল। যখন বাতাস আসে, যখন হাওয়ার দমকে কেঁপে কেঁপে ওঠে বুড়ো থুড়থুড়ে গাছ গুলোর পাতা, তখন বড় ভয় লাগে, মনে হয় কারা যেন কেঁদে কেঁদে কথা বলছে। বাতাস না থাকলে আবার শুনশান চারিদিক। হঠাৎ হয়তো দুরের কোন গাছের ডালে ডানা মেলে ডেকে ওঠে একটি পাখি, কখনো বা ভয়ার্ত গলায় খ্যা খ্যা করতে করতে বেরিয়ে পড়ে কোন কাঠবিড়ালির ছানা। জংগলটার দিকে চোখ পড়লেই মনে হয় কী যেন একটা গুঁড়ি মেরে বসে রয়েছে গাছগুলোর আড়ালে।

পাড়ার অন্য ছেলেমেয়েরা যখন দল বেঁধে হৈ হৈ করতে করতে বাড়ির কাছের মেপল ক্রিক এলিমেন্টারি স্কুলে যায়, অমিয়েকে তখন একা একা ওই ভুতুড়ে জঙ্গলটার ধার ঘেঁষে হেঁটে যেতে হয় একটা বাস স্টপেজে। তাও জানালায় মা দাঁড়িয়ে থাকে বলে রক্ষা। খুব বেশি নয়, মাত্র মিনিট সাতেকের পথ, আর বাস স্টপেজটাও দেখা যায় ঘরের জানালা থেকেই। ওর স্কুলের নাম মাইকেল ক্র্যানি এলিমেন্টারি। জঙ্গল পেরিয়ে প্রায় তিরিশ মিনিটের পথ।

গত বছর ও ছিলো মেপল ক্রিকে। একদিন সকালে ওদের ক্লাস টিচার মিস ব্রুকস অমিয়কে বললেন স্কুলের কমনরুমে কে নাকি একজন ওর জন্য অপেক্ষা করছে। অমিয় ভেবেছিলো বুঝিবা মা এসেছে ওকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য। সেই খুশিতে করিডোর ধরে লাফাতে লাফাতে কমন রুমে গিয়ে দেখলো গোমড়া মুখো রাগী রাগী একজন মানুষ হাতে একতাড়া কাগজ নিয়ে বসে আছে। লোকটার মাথা জোড়া বিশাল টাক। অমিয় ভাবছিল কয়টা চুল তা গুণে দেখবে, কিন্তু তার আগেই লোকটা দারুণ বাজখাই গলায় বলে উঠলো,

“তোমার নাম অমিয় নীলাদ্রি?”

অমিয় জবাব দেবে কী, অমন গলা শুনে ভয়ে ওর বুক শুকিয়ে গিয়েছে। কোন মতে কেবল মাথা নাড়লো সে।

“আমি থিওডোর নোজওয়ার্দি। ডিস্ট্রিক্ট স্কুল বোর্ড থেকে আমাকে পাঠানো হয়েছে তোমাদের কয়েকজনকে পরখ করে দেখতে।”

অমিয়র নিশ্চয়ই বলা উচিৎ ছিল ‘আমি আপনার সাথে পরিচিত হয়ে খুব খুশি হয়েছি’ কিংবা এই জাতীয় একটা কিছু। কিন্তু লোকটার গলায় এমন একটা তাচ্ছিল্যের আভাস! চশমার নিচ দিয়ে তাকিয়ে রয়েছে যেন ও একটা মাকড়সা অথবা টিকটিকি। কিছুক্ষণ অমিয়র জবাবের জন্য অপেক্ষা করে লোকটা আবারও খেঁকিয়ে উঠলো,

“টেবিলের ওপরে কিছু ব্লক আছে। তোমার যা ইচ্ছে বানাও দেখি।”

হ্যাঁ, এই কাজটা ওর দারুণ পছন্দ। কী বানানো যায়, কী বানানো যায় ভাবতে ভাবতেই অমিয়র চোখের সামনে ভেসে উঠলো একটা ছবি। না না, এটা কিছুতেই বানানো যাবেনা। একদম ঠিক হবে না সেটি। তারপরও কেমন করে যেন সেই ছবিটিই তৈরি হয়ে গেলো! একটা মানুষের মুখ। বেশ নাদুস নুদুস একজন মানুষ, তার মাথা ভরা টাক, আর টাকের উপর সাতটি চুল।

কী কী যেন প্রশ্ন করেছিল লোকটা, অমিয়র ঠিকঠাক মনেও নেই। ওর তখন কেবলই ভয় হচ্ছিলো এই বুঝি প্রিন্সিপালকে বলে ওকে ডিটেনশনে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। ডিটেনশন অমিয়র ভারি অপছন্দের। প্রিন্সিপাল অ্যাঞ্জেলোটির কাছে ডিটেনশন মানেই জ্যানিটরের সাথে ঘুরে ঘুরে স্কুলের হলওয়ে পরিষ্কার করা। ব্যাপারটা অবশ্য অত খারাপ নয় যতটা অন্যেরা ভাবে। এই তো সেদিন একটা চকচকে নীল মার্বেল পেয়ে গিয়েছিলো সে। জর্জের চোখ এড়িয়ে পকেটে ঢুকিয়ে ফেলতে কোন অসুবিধাই হয়নি। গ্রেড থ্রির ছেলে সে, বুড়ো জর্জকে ফাঁকি দেওয়া কোন ব্যাপার! ডিটেনশনের খারাপ দিকটা হচ্ছে জর্জের বকবকানি। কেবলই উপদেশ দিতে থাকে। জর্জের সব ভাবনা লেখা পড়া নিয়ে। হাইস্কুল শেষ করেনি বলেই নাকি সে এখন স্কুলের জ্যানিটর।

ক্লাসে ফিরে আসার পর অমিয়র প্রাণের বন্ধু চেন ইউ জানতে চাইলো কী বলেছে ওকে লোকটা। একটু পরেই চেন ইউ এর পালা। অমিয় শুধু বলল ব্লক নিয়ে খেলার কথা।

চেন ইউ ফিরে আসতেই লাঞ্চের ঘণ্টা বেজে উঠলো। একটা কথা মা কিন্তু জানেনা। অমিয় লাঞ্চে কেবল দুইটা কামড় দেয়। মা যে কী! হয় সেই ঢেলঢেলে টার্কি স্যান্ডউইচ আর নইলে মিটবল দিয়ে পাস্তা, ইয়াক! এর চে অনেক ভালো বন্ধুদের সাথে খেলতে যাওয়া। সেদিন খেলতে খেলতে দারুণ ঝগড়া হয়ে গিয়েছিলো মিনের সাথে। মিন আর ভি দুই বোন, ওরা যমজ। খেলাটা ছিল হাইড এন্ড সিক। অমিয় ঠিক ঠিক মিনকে খুঁজে বের করেছে, কিন্তু খেলার শেষে মিন বলে বসলো ওটা নাকি ভি ছিলো! অমিয় নিশ্চিত জানে ওটা মিন। ভি’র কানের নিচে একটা ছোট্ট তিল আছে। কিন্তু বন্ধুরা কেউ ওর কথা বিশ্বাস করেনি। সেই থেকে ঝগড়া। অমিয়র এত্ত মন খারাপ হয়ে গেলো যে বাসায় এসে বাবা মা’কে বলতে ভুলেই গেল স্কুলের আর সব ঘটনা।

দুমাস পর একটা চিঠি এসেছিলো বাসায়, খামে বড় বড় করে অমিয়র নাম লেখা। অমিয়র পষ্ট মনে আছে চিঠি পড়ে মা’র চোখ দুটো কেমন গোল গোল হয়ে গিয়েছিলো।

“কী লিখেছে মা! কী লিখেছে?”

“আচ্ছা অমিয় তুই যে গিফটেড স্কুলে যাবার পরীক্ষা দিয়েছিস সেটা আমাকে বলিসনি কেন?”

“গিফটেড স্কুল কী মা? কিসের পরীক্ষা?”

“তোকে নতুন একটা স্কুলে যেতে হবে, বুঝলি?”

“কেন মা?”

“কারণ সেই স্কুলে সব বুদ্ধিমান ছেলে মেয়েরা পড়ে। ওদের গ্রেড অনেক ভালো”

“গ্রেড ভালো হলেই বুঝি বেশি বুদ্ধি হয়! এই যে আমাদের এরিক, ক্লাসের সবচে লাড্ডাগুড্ডা ছেলে, পড়া পাড়েনা, হোম ওয়ার্ক করেনা, কিন্তু মা তুমি কি জানো ওর কত বুদ্ধি! একবার হয়েছি কি…”

এটুকু বলেই থেমে যায় অমিয়।

“থেমে গেলি কেন, বল।”

“তোমাকে জানতে হবে না মা। বড়দের সব কিছু জানতে নেই।”

“বলতে ইচ্ছে না করলে বলিস না। কিন্তু তুই সেপ্টেম্বর থেকে মাইকেল ক্র্যানিতেই যাচ্ছিস, ব্যাস।”

“আমি যাবো না। কিছুতেই যাবো না। মেপল ক্রিকেই থাকবো মা।”

“সে তোর বাবা বাসায় ফিরলে তখন বোঝা যাবে, এখন তুই খা তো!”

অমিয় জানে বাবা কী বলবে। ওর চোখে পানি এসে গেলো। তার উপর মা দিয়েছে ব্রকোলি দিয়ে চিকেন, ইয়াক!

বাবার সাথে কথা বলতে না হলে বেশ হতো। সব চে ভালো হয় ঘুমিয়ে গেলে। ঘুম থেকে ওঠার আগেই তো বাবা অফিসে চলে যাবে। তারপর স্কুলে গিয়ে মিস ব্রুকসকে বলবে ও মাইকেল ক্র্যানিতে যেতে চায়না। মিস নিশ্চয়ই কিছু একটা ব্যাবস্থা করে ফেলবেন।

কিন্তু ঘুমায় কী করে! মা যে উইনিকে ধুয়ে শুকাতে দিয়েছে! উইনি অমিয়র কাডলি টয়, ওর পুরো নাম উইনি দা পু।

অমিয় খাওয়া শেষ না করেই উঠে গেলো। মা প্রথমে দেখেনি, যখন দেখেছে ততক্ষণে সে জামা পাল্টে দাঁত ব্রাশ করে কম্বল মুড়ে শুয়ে পড়েছে।

“এই যে দেখো, না খেয়েই চলে গেলো। অমিয়, নেমে আয় বলছি।”

কম্বলটা মাথার ওপরে তুলে দিয়ে শক্ত করে চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকে অমিয়।

কান্নাকাটি, রাগারাগি, ভাত খাবোনা, এসবের কোন কিছুতেই কোন কাজ হয়নি। সামারের ছুটির পর ফোঁপাতে ফোঁপাতে মাইকেল ক্র্যানিতে চলে গেলো অমিয়।

দুই.
ঝড়ের গতিতে চলেছে বাস। পরের তিনটে ব্লক থেকে কেউ উঠবে না। চার নম্বর ব্লকটা পেরিয়েই মেজর ম্যাকেঞ্জি স্টপেজ, এই দশ মিনিট কেবল অমিয় আর ড্রাইভার। ড্রাইভারের নাম মিসেস মার্থা। খুশি খুশি চেহারার গোলগাল একজন মানুষ। কথা বলেন খুব মিষ্টি করে। প্রতিদিন বাসে উঠতে উঠতে অমিয় ভাবে আজ হয়তো মিসেস মার্থার বকবকানি শুনতে হবেনা। কিন্তু তাই কি হয়! আজকেও হয়নি। গলির মোড় থেকে ডান দিকে বাঁক নিতে নিতেই মিসেস মার্থা বললেন,

“তারপর অমিয়, কী নাস্তা করেছো আজকে?”

মিসেস মার্থার ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে যে যার মতো একেক দিকে চলে গিয়েছে। বাড়িতে একা একা ভালো লাগে না বলে এই চাকরিটা নিয়েছেন তিনি। পাঁচ পাঁচটি বাচ্চা এক হাতে বড় করেছেন, আর সে কারণেই সম্ভবত খাওয়া ছাড়া অন্য কোন ভাবনাই তাঁর মাথায় আসেনা।

অমিয় ছোট্ট করে জবাব দেয়,

“ডিম।”

“আহা সে তো বুঝলাম। সেদ্ধ, ভাজি নাকি পোঁচ?”

“ডিম ভাজি।”

“কী দিয়ে খেলে?”

“রুটি।”

“ফ্রুট জুস খাওনি?”

“আমার ফ্রুট জুস ভালো লাগে না।”

“ভালো না লাগলেও খেতে হবে অমিয়। আমার মেঝ ছেলে কার্ল ছিল তোমার মতো। ফ্রুট জুস খেতে চাইতো না। আমি একটা লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে থেকে ওকে ফ্রুট জুস খাওয়াতাম। কার্ল এখন কী করে জানো?”

“কী করে?”

“একটা ফ্রুট জুস কোম্পানিতে চাকরি করে, হা হা হা। কার্লের একটা গল্প বলি শোন।”

“আচ্ছা।”

মিসেস মার্থা বলেই চলেন। অমিয়র সেদিকে মনোযোগ নেই, ওর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে অন্য চিন্তা। ফিজিট স্পিনারটা আনতে ভুলে গিয়েছে সে। আজকে আর রক্ষা নেই। ক্লাসের বুলি ম্যাথিউ বলে দিয়েছে ফিজিট স্পিনার না নিয়ে গেলে হকি খেলার সময় অমিয়র খবর করে ছাড়বে। কী কুক্ষণেই না সে বলে ফেলেছিল খেলনাটার কথা! শুধু কি বলেছে? ম্যাথিউ যখন দাবী করলো অমিয়র কথা সত্যি নয়, তখন ঘাড় বাঁকিয়ে ঠাস ঠাস করে বলে দিয়েছে স্কুলে নিয়ে আসবে আজ। এই খেলনাটা নতুন এসেছে, ক্লাসের অন্য কারো কাছে এখনও নেই। অমিয় সেদিন মা’কে অনেক পটিয়ে ‘টয়’জ আর আস’ থেকে একটা কিনেছে। কী সুন্দর নীল রঙ! তার মাঝে লাল হলুদের ছোপ ছোপ। ঘুরিয়ে মেঝেতে ছেড়ে দিলেই রংধনুর মতো জ্বলজ্বল করে।

মেজর ম্যাকেঞ্জি থেকে একগাদা ছেলেমেয়ে উঠলো বাসে। অমিয়র পাশে এসে বসেছে লিকলিকে একটা ছেলে। ওর নাম রিয়াড ব্যাকাস। রিয়াড কিংবা ব্যাকাস না বলে কেন যেন ওর পুরো নামটা ধরেই ডাকে সবাই। রিয়াড ব্যাকাস একজন কম্পিউটার উইজ। ওর একটা ইউটিউব চ্যানেল আছে, নাম ‘রিয়াড ব্যাকাস টু দ্যা ইনফিনিটি’। অমিয়র ইউ টিউব চ্যানেল তো দূরের কথা, ইউ টিউব দেখার জন্য একটা আই প্যাডও নেই। বাবা এসব পছন্দ করেন না।

রিয়াড ব্যাকাস চোখ থেকে চশমাটা সরিয়ে অমিয়কে একটা ধাক্কা দিয়ে বলল,

“ফিজিট স্পিনার টা কই?”

অমিয় ঢোক গিলে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,

“আনতে ভুলে গিয়েছি। ম্যাথিউ আজকে আমাকে পিটিয়ে সিধে করে দেবে।”

“হু, তোমার তো দেখছি দারুণ বিপদ! আমার চ্যানেলে একটা ভিডিও আছে, ‘হাউ টু ডিল উইথ আ বুলি’। তোমার তো আবার কোন ডিভাইস নেই, থাকলে একটা উপায় বের করতে পারতে।”

“তোমার আই প্যাড কই? ভিডিওটা দেখতাম একবার।”

“আমারটা ম্যাথিউ সেদিন কেড়ে নিয়ে গিয়েছে। বলেছে আজকে ফেরত দেবে।”
বলতে বলতেই ফিক করে হেসে দেয় রিয়াড ব্যাকাস, হেসে ফেলে অমিয়ও। পেছনের সিট থেকে সব কথা শুনছিল জর্ডি আর মারডিকা। ওরাও যোগ দেয় সে হাসিতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হাসির হুল্লোড়ে ফেটে পড়ে গোটা বাস। মিসেস মার্থা বাসের গতি কমিয়ে জানতে চাইলেন কী হয়েছে। মারডিকা ব্রেস লাগানো দাঁত বের করে খিল খিল করতে করতে বলে,

“রিয়াড ব্যাকাসের আই প্যাড কেড়ে নিয়ে গিয়েছে ম্যাথিউ। একটা ভিডিও দেখবে বলে। ভিডিওর নাম হি হি, হাউ টু হি হি হি, হাউ টু ডিল উইথ আ বুলি। হি হি হি হি”

হাসতে হাসতে স্টিয়ারিং থেকে হাত প্রায় ছুটে যাচ্ছিলো মিসেস মার্থার। কোনমতে সামলে নিয়ে বাস ঘোরাতেই তাঁর চোখ গোল গোল হয়ে গেলো। সামনের রাস্তায় থৈ থৈ করছে পানি। রাস্তার মাথায় পুলিশের দুটো গাড়ি আড়াআড়ি দাঁড়িয়ে।

বাস থামাতেই একজন পুলিশ অফিসার এগিয়ে এসে জানালার পাশে দাঁড়ালেন। মিসেস মার্থা গলা বাড়িয়ে জিগ্যেস করলেন,

“সুপ্রভাত অফিসার, কী হয়েছে?”

“ওয়াটার মেইন ফেটে গিয়েছে ম্যাম। রাস্তা বন্ধ, আপনাকে ঘুরে যেতে হবে।”

“ঘুরে যাবো কীভাবে! স্কুলে যাবার তো একটাই রাস্তা।”

“কিন্তু যাবেন কেমন করে! মাঝখানের নিচু জায়গাটায় অনেক পানি জমে গিয়েছে। একটু পরেই মিস্ত্রিরা চলে আসবে ঠিক করতে। আপনি এখানেই একটা পাশে পার্ক করুন। আমি স্কুলে ফোন করে জানিয়ে দিচ্ছি বাসের দেরি হবে।”

মিসেস মার্থা দুই হাত দিয়ে গাল চেপে ড্রাইভিং সিটে বসে আছেন। বাসে সব সুদ্ধ আঠাশ জন বাচ্চা, তারা ইচ্ছে মতো চেঁচামেচি করছে। কোলাহল থামানোর জন্য কয়েকবার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। হট্টগোলে তার মাথা বনবন করছে, এদিকে মিস্ত্রিদের আসার কোন নাম নেই।

অমিয় আছে মহা আনন্দে। এতো বড় একটা ঘটনার পর ফিজিট স্পিনার নিয়ে কেউ মাথা ঘামাবে না আজকে, এমনকি ম্যাথিউও না। কিন্তু তার সেই আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হলো না। গল্প করতে করতেই বিপদটা টের পেলো সে। অমিয়র অস্বস্তি জর্ডির চোখ এড়ায়নি, এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে অমিয়র প্রতি এই মেয়েটির কিঞ্চিৎ দুর্বলতা রয়েছে। অমিয় যে বোঝে না তা নয়। ওরা আর কিছুদিন পরেই গ্রেড ফাইভে যাবে। আর টম সয়ার তো গ্রেড ফাইভেই ছিল, নাকি! মার্ক টোয়েনের এই বইটা যে সে কতবার পড়েছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। জর্ডি খুব উৎকণ্ঠা নিয়ে জিগ্যেস করলো,

“কী হয়েছে অমিয়?”

“কই কিছু না তো!”

“তুমি বললেই হলো? তোমার মুখটা কেমন শুকনো দেখাচ্ছে!”

ব্যাপারটা এখানেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অমিয় একটু নড়ে চড়ে বসায় রিয়াড ব্যাকাসের কেমন যেন খটকা লাগলো। সে অমিয়র কানে কানে বলল,

“কিছু একটা হয়েছে নিশ্চয়ই। আমাকে বলতে পারো, আমি কাউকে বলবো না। প্রমিস।”

ব্যাপার খুব গুরুতর। বাস ধরতে দেরি হয়ে যাচ্ছিলো বলে অমিয় সকাল বেলা বাথরুমে যেতে পারেনি। ভেবেছিলো স্কুলে পৌঁছেই সেরে নেবে। এমন তো কতোই হয়েছে। কিন্তু তখন কি সে জানতো যে এতক্ষণ বাসের ভেতরে বসে থাকতে হবে!

পেছনের সিটের দিকে একবার তাকিয়ে খুব নিচু গলায় অমিয় রিয়াড ব্যাকাসকে ওর সমস্যার কথা বলল। রিয়াড ব্যাকাস একটা বিশ্বাস ঘাতক। শুনেই লাফ দিয়ে সিটের উপরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ঘোষণা করলো,

“অমিয়র বড়টা পেয়েছে।”

এতো হট্টগোলের মধ্যে মিসেস মার্থা ভালো করে শুনতে পাননি। তিনি জিগ্যেস করলেন,

“কী ব্যাপার রিয়াড ব্যাকাস, তুমি সিটের উপরে দাঁড়িয়ে কেন?”

আঠাশ জন ছেলে মেয়ে একসাথে চিৎকার করে উঠলো,

“অমিয়র বড়টা পেয়েছে মিসেস মার্থা!”

রাগে দুঃখে অমিয়র চোখ ছলছল করছে। বাসের সবাই, এমনকি জর্ডি পর্যন্ত হেসে কুটি কুটি। মিসেস মার্থার হাসি পায়নি, তিনি খুব চিন্তায় পড়ে গিয়েছেন। অমিয়কে জিগ্যেস করলেন,

“একটু চেপে রাখতে পারবে না? মিস্ত্রিরা এক্ষুনি চলে আসবে।”

অমিয় মুখ খোলার আগেই আঠাশ জন বাচ্চা সমস্বরে জবাব দিলো,

“পারবে না মিসেস মার্থা।”

অমিয়ও শুধু ডান থেকে বামে আর বাম থেকে ডানে মাথা নাড়লো একবার। সে আসলে পারবে, কিন্তু এখন যেভাবেই হোক বন্ধুদের কাছ থেকে দুরে চলে যাওয়া প্রয়োজন।

মিসেস মার্থা ড্রাইভিং সিট থেকে উঠে দরজার দিকে যেতে যেতে বললেন,

“দাঁড়াও দেখি কী করা যায়।”

রিয়াড ব্যাকাসটা এমন ফাজিল! সে একগাল হেসে বললো,

“অমিয় দাঁড়াতেও পারবে না, হি হি হি।”

অমিয়ও মনে মনে ঠিক করে ফেলেছে রিয়াড ব্যাকাসের সাথে আর কোন দিন কথা বলবে না সে, পিংকি সয়ার।

কিছুক্ষণ পর ফিরে এলেন মিসেস মার্থা, সাথে একজন পুলিশ অফিসার। অফিসার হাসি হাসি মুখ করে বললেন,

“মিসেস মার্থা আমাকে বলেছেন একজনের নাকি সাহায্য প্রয়োজন। পুলিশের কাজই হচ্ছে সবাইকে সাহায্য করা। তোমাদের মধ্যে অমিয় কে?”

আঠাশ জোড়া আঙুল অমিয়কে দেখিয়ে বললো,

“ওই যে! ওই যে!”

“লেটস গো ইয়াং ম্যান! পাশের শপিংমলের ওয়াশ রুমে নিয়ে যাচ্ছি তোমাকে।”

মা সব সময় বলে দিয়েছে অচেনা কারও সাথে না যেতে। তা সে পুলিশই হোক আর যেই হোক। সে মিনমিন করে বললো,

“মিসেস মার্থা ছাড়া আর কারও সাথে যাবো না আমি।”

দীর্ঘদিনের চাকরির অভিজ্ঞতা থেকে অফিসার ডার্ক ম্যাটেন জানেন দুর্ধর্ষ অপরাধীকেও যুক্তি দিয়ে ঘায়েল করা সম্ভব, কিন্তু গ্রেড ফোরের একজন বাচ্চাকে নয়। মিসেস মার্থার দিকে তাকিয়ে বললেন,

“তাহলে এক কাজ করি, আমি অন্যদের সাথে বাসে বসে থাকি, আপনি বরং অমিয়কে নিয়ে যান।”

কিন্তু বাচ্চারা কেউ বাসে থাকতে রাজি নয়। সবাই বললো, অফিসার ডার্ক ম্যাটেন তো তাদের কাছেও অচেনা! আসলে ব্যাপার তা নয়। এমন অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হতে চায় না কেউ।

বাচ্চাদের নিয়ে চললেন মিসেস মার্থা। সামারের মাঝামাঝি একদল ছানাপোনা নিয়ে যেমন হেলেদুলে হেঁটে চলে মা হাঁস।

তিন.
মার্ক গেজলার একজন জাঁদরেল চোর। হাতযশ নিয়ে তার গর্বের শেষ নেই। সে কি আর আজকালকার ছেলে ছোকরাদের মতো ইউ টিউব দেখে শিখেছে! একাডেমী অফ থেফট অ্যান্ড বার্গলারিতে ছয় ছয়টি বছর সাধনা করার পর রীতিমতো পরীক্ষা দিয়ে পাওয়া বিদ্যা তার। সার্টিফিকেটে সাক্ষর করেছিলেন কিংবদন্তীদের কিংবদন্তি প্রফেসর সিড মেহেরজান।

তবে কিনা বীরদের মধ্যে যে সেরা বীর সেই একিলিসেরও তো একটা নরম গোড়ালি ছিলো।
মার্কের গেজলারেরও আছে। ছদ্মবেশে সে ভারি কাঁচা। থিসিসের ওই অংশটা সে প্রখ্যাত জাপানিজ চোর নিশিমারা ইউকোর আত্মজীবনী থেকে টুকে নিয়েছিলো। কেউ ধরতে পারেনি, এমনকি প্রফেসর সিড মেহেরজানও না।

আজকের ছদ্মবেশটা অবশ্য দুর্দান্ত হয়েছে। কানের লতিতে জড়ুলটা জুড়ে দেবার পর আয়নার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠেছিলো মার্ক। নিজেকে চিনতেই পারেনি সে।

শপিং মল খুলেছে সকাল নয়টায়। আর সাথে সাথেই কোত্থেকে যেন পিল পিল করে একগাদা মানুষ চলে এসেছে। এদের কি কোন কাজ কর্ম নেই? নাহ, দিন দিন অলস আর কর্মহীন মানুষের সংখ্যা আশঙ্কাজনক ভাবে বেড়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে কী হবে ভেবে ভেবে শিউরে উঠে মার্ক। আলসে মানুষের বিচিত্র সব শখ, আর কাজ না থাকা মানুষের নানান ধান্ধা। তাদের কেউ কেউ যে মার্কের লাইনেই চলে আসবে এটা বুঝতে সার্টিফিকেট লাগেনা।

মলের গেটের সাথে লাগোয়া দোকানটার নাম পিপলস জুয়েলার্স। দুইমাস ধরে দেখে শুনে মার্ক এটাকেই টার্গেট করেছে। দোকানে সবসুদ্ধ পাঁচ জন কর্মচারী। একজন থাকে ক্যাশে, একজন গেটের সামনে, বাকি তিনজন যার যার সেকশনে। এই তিনজনের একজন আবার বেজায় মোটা, ওর নাম শন। দোকানে একটানা বেশিক্ষণ থাকলে শনের দম বন্ধ হয়ে আসে। ঘড়ি ধরে একঘণ্টা পরপর সে বেরিয়ে যায় কিছুক্ষণে জন্য। এই সময়টাকেই কাজে লাগিয়েছে মার্ক। শন বেরিয়ে যেতেই খুব সাবধানে পকেট থেকে একটা জিনিস বের করে বের করে ঘষে দিয়েছে গয়না রাখার কাঁচের শেলফের উপর।

মার্ক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গয়না দেখছিল। পেছনে থপ থপ আওয়াজ শুনেই বুঝতে পারলো শন ফিরে এসেছে।

“কার জন্য চাই? বউ, মেয়ে, নাকি মা, নাকি তোমার গার্লফ্রেন্ড?”

মার্ক খুব সুবোধ গলায় জবাব দিলো,

“বাবার জন্য, অনেক দিন বাবাকে কিছু দেওয়া হয়নি। ভাবছি দামি একটা হিরের আংটি কিনবো।”

শন অবাক হয়ে তাকায়,

“বাহ! বাবার জন্য হিরে কিনতে কাউকে তো দেখাই যায়না আজকাল! দাঁড়াও তোমাকে ভালো ভালো কিছু আংটি দেখাই।”

এক হাত দিয়ে কাঁচের শেলফটা ধরে আরেক হাতে চাবি লাগিয়ে ড্রয়ার খুলে অনেকগুলো আংটি বের করে আনলো শন। মার্ক গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখতে থাকে একটার পর একটা।

হঠাৎ করেই শন লাফিয়ে উঠলো। তার চোখ ঠিকরে আসছে, হাপরের মতো উঠানামা করছে বুক। দেখতে দেখতে মুখ ভর্তি চাকা চাকা কী যেন উঠে ছড়িয়ে গেলো গলায়, কাঁধে, চোখের পাতায়। মেঝেতে পড়ে জ্ঞান হারাবার আগে কেবল বলতে পারলো,

“নাট অ্যালার্জি।”

মার্ক ততক্ষণে চিৎকার করে লোকজন জড়ো করে ফেলেছে। ক্যাশের লোকটা যে কিনা ম্যানাজারও, ফোন করে খবর দিয়েছে অ্যাম্বুলেন্সে। লোকটা জাপানি, বারবার মাথা নিচু করে মার্ককে ধন্যবাদ জানালো সাহায্যের জন্য। মার্কও খুব বিগলিত গলায় বললো,

“আরে এ তো আমার দায়িত্ব। শন খুব ভালো মানুষ, আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। আপনি কিচ্ছু ভাববেন না। অ্যাম্বুলেন্স না আসা পর্যন্ত আমি থাকছি।”

শনের অ্যালার্জির ব্যাপারটা খুব গোপন, এমনকি দোকানের ম্যানেজারও জানে না। অবশ্য গোপন কথা কীভাবে বের করে আনতে হয় সে বিদ্যে খুব ভালো করেই জানা আছে জোয়েনের। দু’মাস সময় পেলে সে একটা ম্যানিকুইনকেও কথা বলিয়ে ছাড়তে পারে, আর শন তো সেখানে হাসিখুশি একজন মানুষ। জোয়েন মার্কের সাইডকিক। এই মুহুর্তে সে পারকিং লটে একটা গাড়িতে বসে আছে।

শনকে এম্বুলেন্সে তুলে দিয়ে মার্ক খুশি খুশি মনে গেটের দিকে এগোয়, তার কাঁধে একটা ল্যাপটপ রাখার ব্যাগ।

বাইরে এসেই মার্ক হতভম্ব হয়ে গেলো, সামনেই দুটো পুলিশের গাড়ি। এ অবস্থায় পার্কিং লটে হেঁটে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবেনা। পা টিপে টিপে ফিরে গিয়ে সোজা ঢুকে পড়লো একটা ওয়াশরুমে। জোয়েনের সাথে কথা বলা প্রয়োজন।

“হ্যালো জোয়েন, বাইরে পুলিশ কেন? কী হয়েছে?”

“আর বোলো না, ওয়াটার মেইন ফেটে স্কুলের দিকে যাবার রাস্তা তলিয়ে গিয়েছে। পুলিশ এসেছে যাতে কোন অসুবিধা না হয় সেটা দেখতে। যাই বলো মার্ক, ক্যানাডার পুলিশ কিন্তু খুব চটপটে।”

“আরে রাখো তোমার চটপটে! এখন কী করবো সেটা বলো।”

“কী করবে মানে! কাজ শেষ হয়ে গেলে বেরিয়ে এসো। চুপচাপ ড্রাইভ করে চলে যাবো, কেউ টেরও পাবেনা।”

“তোমার মুণ্ডু। আমাকে পুলিশ ভালো করে চেনে, ছদ্মবেশ টদ্দবেশ থাকলেও কেমন করে যেন বুঝে ফেলে ব্যাটারা। আমি বরং ওয়াশ রুমেই থাকি। গেটের সামনে থেকে পুলিশ সরে গেলে আমাকে টেক্সট করে জানিও।”

আধঘণ্টা ধরে ওয়াশরুমের একটা খুপরিতে বসে আছে মার্ক। টেনশনের কারণে একবার ইয়েও করে ফেলেছে। বসে থাকতে থাকতে ঝিম ধরে গিয়েছে তার। হঠাৎ প্রচণ্ড হট্টগোলে চমকে উঠলো। একগাদা বাচ্চা এসে ঢুকেছে ওয়াশরুমে।

চার.
ক্লাস শুরু হয় ন’টা পনেরোতে, সাধারণত ন’টার মধ্যেই চলে আসে সব বাস। এখন ন’টা বেজে দশ মিনিট। অথচ নয় নয় ছয় ছয় নয় নম্বর বাসটার কোন খবর নেই। অফিসের জানালা দিয়ে বাস স্ট্যান্ডের দিকে তাকিয়ে ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে গেলেন কেনেথ নর্টন। সকাল থেকেই মনটা কেমন যেন কু ডাকছিলো, আজ আবার বুধবার!

বুধবার তাঁর দারুণ অপছন্দ। সমস্ত ঝামেলাগুলো কেন যেন ঠিক এই দিনটিতেই এসেই জড়ো হয়। সপ্তাহে আরও ছয়টি দিন রয়েছে, তারপরও বুধবারের প্রতি প্রকৃতির এমন পক্ষপাত ভীষণ অন্যায়। এই নিয়ে অনেক ভেবেছেন তিনি। ভাবতে ভাবতে তিরিশ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। মাথার ঘন কালো চুল সব পেকে আজ সাদা, চশমা ফেলে কন্টাক্ট লেন্স ধরেছেন সেও এগারো বছর হতে চললো। সমাধানটা আসি আসি করেও আসছে না। একগাদা আলুভাজা খেয়ে ফেলার পর গ্যাসের ধাক্কায় যেমন আইঢাই করে পেট, তেমনি ফুলে ফেঁপে ঢোল হয়ে থাকে তাঁর ভাবনারা। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে গেলে টেবিল ল্যাম্পের আলোয় রাত জেগে কাজ করেন, অংক কষে বোঝার চেষ্টা করেন বুধবারগুলো কেন এমন হয়। তিরিশ বছরে সে সমীকরণ না মিললেও জীবনের অন্যান্য সমীকরণগুলো কীভাবে যেন মিলে গিয়েছে ঠিকঠাক। কেনেথ নর্টন এখন মাইকেল ক্র্যানি এলিমেন্টারি স্কুলের প্রিন্সিপাল।

ন’টা পনেরোতে টেবিলে রাখা ফোনটা বেজে উঠলো। তিনি রিসিভার তুলে শান্ত ভঙ্গীতে বললেন,

“হ্যালো।”

“সুপ্রভাত প্রিন্সিপাল নর্টন”

“সুপ্রভাত, কে বলছেন?”

“ইয়র্ক রিজিওন পুলিশ ডিপার্টমেন্ট থেকে অফিসার ডার্ক ম্যাটেন।”

পুলিশ! প্রিন্সিপাল নর্টনের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে। এই সাত সকালে পুলিশের ফোন কেন?

“আপনার জন্য কী করতে পারি অফিসার ম্যাটেন?”

“জী, নয় নয় ছয় ছয় নয় নম্বর বাসটার আসতে একটু দেরি হবে। ওয়াটার মেইন ফেটে রাস্তায় পানি জমে গিয়েছে। পানি সরলেই চলে আসবে।”

“কতক্ষণ লাগবে পানি সরতে?”

“ঠিক বলতে পারছি না, মিস্ত্রিরা এখনও এসে পৌঁছায় নি। চিন্তার কোন কারণ নেই, বাচ্চারা নিরাপদেই আছে। মিসেস মার্থা ওদের নিয়ে বাসের ভেতরে অপেক্ষা করছেন।”

প্রিন্সিপাল নর্টন চিন্তিত। খুব দ্রুত কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে এখন। ঘণ্টা বাজিয়ে সেক্রেটারিকে ডাকলেন।

“এমা, নয় নয় ছয় ছয় নয় নম্বর বাসে কোন কোন ক্লাসের বাচ্চারা আসে জানো?”

“ফাইল না দেখে তো বলতে পারবো না প্রিন্সিপাল নর্টন।”

“আচ্ছা যাও, ফাইলটা নিয়ে এসো।”

এই মুহূর্তে অভিভাবকদের জানানো ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছেন না তিনি। আবার ঘণ্টা বাজিয়ে সেক্রেটারিকে ডাকলেন,

“এমা, আমি একটু বের হচ্ছি। এক ঘণ্টার মধ্যে বাস না এসে পৌঁছুলে অভিভাবকদের ফোন করে জানিয়ে দিও।”

প্রিন্সিপাল নর্টন ঠিক করেছেন ঘটনাস্থল থেকে ঘুরে আসবেন একবার, মাত্র দশ মিনিটের হাঁটা পথ। ডার্ক ম্যাটেনের কথায় খুব একটা স্বস্তি পান নি তিনি। আসলে বুধবারের কোন ভরসা নেই।

চেয়ার থেকে উঠতে গিয়ে কিছু একটায় বেঁধে পড়নের প্যান্ট টা ফড়ফড় করে ছিঁড়ে গেলো। ভাগ্যিস স্কুলের পাশেই তাঁর বাড়ি। বাসায় গিয়ে প্যান্ট বদলে নিতে নিতে একটু দেরি হয়ে যাবে এই যা। মনে মনে ভাগ্যকে একটা ধন্যবাদ দিয়ে দিলেন, অল্পের উপর দিয়ে গিয়েছে। আছড়ে পড়ে হাত পা ভেঙে যেতে পারতো। বুধবার বলে কথা!

ওদিকে পার্কিং লটে গাড়িতে বসে তখন আকাশ পাতাল ভাবছিল জোয়েন। নিউ ইয়র্ক থেকে টরন্টো পালিয়ে আসার পর এটাই তার প্রথম কাজ। মার্কের কথা নিউ ইয়র্কে থাকতেই শুনেছে সে, বিখ্যাত মানুষ কিনা। অবশ্য জোয়েনও খুব একটা ফেলনা কেউ নয়। জুটির মতো জুটি হয়েছে একটা। এখন ভালোয় ভালোয় এই এলাকা থেকে বেরুতে পারলেই সোজা মেক্সিকো। এভাবে ইঁদুরের মতো এক গর্ত থেকে আরেক গর্তে ছুটোছুটি আর নয়। জোয়েন ঠিক করে রেখেছে একটা ফার্ম হাউজ কিনে ফেলবে এবার, মেক্সিকোতে নাকি সব কিছুরই দাম কম।

তা দাম একটু বেশি হলেই বা কী? কম করে হলেও তিন মিলিয়ন ডলারের হিরে আছে দোকানে। অর্ধেক মার্কের, অর্ধেক তার। আধা আধি বখরায় মার্ক যে রাজি হয়ে যাবে এটা সে স্বপ্নেও ভাবে নি। কিছুটা নিজের খ্যাতি আর কতকটা ছদ্মবেশে মার্কের কুখ্যাতির উপর বাজি ধরেই পেড়ে ফেলেছিলো কথাটা। মার্ক গুণীর কদর জানে বটে! নিউ ইয়র্কের লোকেরা যে জোয়েনকে ক্যামেলিয়ন বলে, সে তো আর এমনি এমনি নয়! মার্ক শুধু শুধু ভয়ে পাচ্ছে। এমন ছদ্মবেশ বানিয়ে দিয়েছে জোয়েন যে পুলিশ কেন, স্বয়ং মার্কের মা এলেও তাকে চিনতে পারবে না।

ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ একটা সন্দেহ দানা বেঁধে উঠলো জোয়েনের মনে। মার্ক তাকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যায়নি তো! কিন্তু তাই বা কী করে সম্ভব? মল থেকে বের হবার এই একটাই গেট, আর সেখান থেকে এক মুহূর্তের জন্যও চোখ সরাবে, এমন বোকা সে নয়। দুর ছাই, আজে বাজে ভাবনা যতো!

কিন্তু ভাবনারা ভারি বিচ্ছিরি। একবার মাথায় ঢুকে পড়লে তাদের তাড়ানো ভীষণ মুশকিলের। জোয়েন মট মট করে দুহাতের আঙুলগুলো মটকে, চোখের সানগ্লাস কপালে তুলে, ডান চোখ গেটের দিকে রেখে বাম চোখে গাড়ির আয়নায় নিজেকে দেখার চেষ্টা করলো। দুঃসাধ্য চেষ্টা সন্দেহ নেই, তবে ভাবনা তাড়ানোর জন্য খারাপ না। কপালের নকল আঁচিলটা মনে হচ্ছে ভুল করে দেখেও ফেললো একবার। কিন্তু তাতে কি কোন লাভ হলো? ভাবনা রয়ে গিয়েছে ভাবনার জায়গায়। একবার গাড়ি থেকে নেমে দেখে আসবে নাকি? ধরা পড়ে যাবার ভয় তার নেই। এ শহরের পুলিশের খাতায় তার নাম থাকতে পারে, থাকতে পারে একটা দুটো ছবিও। কিন্তু সে ছবির সাথে তার আজকের চেহারা মেলায় সাধ্যি কার?

গাড়ি থেকে নেমে দু কদম এগিয়েছে কি এগোয়নি, দেখলো মার্ক আসছে। হনহন করে হেঁটে আসছে পারকিং লটের উল্টো দিক থেকে। কী আশ্চর্য, ব্যাটা বেরুলো কখন! কোন দিক দিয়ে?

অবশ্য যে দিক দিয়েই বের হোক, ফাঁকি দিয়ে পালায় নি। খুব সম্ভবত গাড়িটা কোথায় পার্ক করা সেটা ভুলে গিয়েছে। যা গিয়েছে বেচারার উপর দিয়ে!

জোয়েন গাড়ি থেকে কিছুটা পথ সামনে হেঁটে মার্কের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। কিন্তু ও তাকে দেখেছে বলে মনে হয় না।

পা টিপে টিপে মার্কের পেছনে গিয়ে ফিসফিস করে বললো জোয়েন,

“কোন কথা বোলো না, চুপচাপ আমার হাত ধরে ডান দিকে চলো। গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে রেখেছি।”

মার্ক কেমন যেন বিহ্বল দৃষ্টিতে জোয়েনের দিকে তাকায়। তারপর ধীরে, খুব ধীরে নড়ে ওঠে ওর ঠোঁট দুটো,

“আমার মনে হয় আপনি অন্য কারও সাথে আমাকে গুলিয়ে ফেলছেন।”

“হা হা হা, ভয় পেও না। ধরা পড়ে যাও নি। গলার স্বর পাল্টে কথা বলতে হবে না। এটা আমি, জোয়েন। পরচুলা খুলে গাড়িতে রেখে এসেছি। পুলিশ দেখে ফেলার আগেই তাড়াতাড়ি চলো, তোমার ব্যাগটা আমি ধরছি। কই, চলো!”

মার্ককে খুব বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে। দেখাকগে, টান দিয়ে মার্কের হাত থেকে ব্যাগটা ছিনিয়ে নিয়ে হন হন করে হাঁটতে লাগলো জোয়েন। মার্ক না এসে এখন যাবে কোথায়?

হাঁটার গতি আরও খানিকটা বাড়িয়ে দিলো সে। কিন্তু মার্ক পেছন পেছন না এসে কেন যেন উলটো দিকে ছুটে গেলো। থামবে কি থামবে না ভাবতে ভাবতেই জোয়েনের কানে ভেসে এলো একটা আর্তনাদ,

“চুরি, ছিনতাই, রাহাজানি! পুলিশ পুলিশ!”

কিছু একটা গোলমাল হয়েছে, কিন্তু তা নিয়ে ভাববার সময় এখন না। জোয়েন এক ছুটে গাড়িতে উঠেই সাই সাই করে স্পিড তুলে বেরিয়ে পড়ে পার্কিং লট থেকে। কোনমতে হাইওয়েতে একবার উঠতে পারলে তাকে আর ঠেকায় কে?

পাঁচ.
পুলিশের চাকরিতে কোন সুখ নেই। রাতদিন এর পেছনে ছোটো, তার পেছনে দৌড়াও, একটু যে দম ছেড়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবেন সে উপায় কি আর আছে? লোকে কত কিছু করে, কত জায়গায় যায়, কত তাদের জামার বাহার, চুলের সিঁথি, জুতার ফ্যাশন! আর তিনি? সেই যে কুড়ি বছর আগে একাডেমী থেকে পাশ করে দুই সেট ইউনিফর্ম নিয়ে চাকরিতে ঢুকেছিলেন তারপর কত শীত-বসন্ত-গ্রীষ্ম-বর্ষা চলে গেলো! পরিবর্তন বলতে কেবল বছর বছর কোমরের মাপ। মলের ভেতরে ‘হ্যাগার'স ড্রেস শার্ট’ দোকানটার সামনে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন অফিসার ডার্ক ম্যাটেন। নীল রঙের একটা শার্ট খুব মনে ধরেছে তাঁর। কিন্তু কী হবে কিনে! খাকির তলায় নীলও যা হলুদও তাই।

নিজেকে আজকাল মানুষ মানুষ মনে হয় না আর। ঘরে-বাইরে, বাজারে-রেস্টুরেন্টে, ছেলেরমেয়েদের স্কুল যেখানেই যান না কেন, পুলিশ পুলিশ সত্ত্বাটাই তাঁকে তাড়িয়ে বেড়ায় সারাক্ষণ। এই তো সেদিন, ছোট মেয়েটার জন্মদিনের কেক কাটার সময় কেউ তাঁকে খুঁজে পাচ্ছিলো না। বাড়িসুদ্ধ মানুষ হন্যে হয়ে খুঁজেছে- উপরতলা, নিচতলা, বেজমেন্ট, বাথরুম, রান্নাঘর, নাহ নেই, কোথাও নেই তিনি। এক গাদা অতিথির সামনে মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে ছিলো মেয়েটা।

আর তিনি ছিলেন বাড়ির পেছনের বড় রাস্তার মোড়ে। একটা ফ্লাশ লাইট নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন অতিথিদের কার কার গাড়িতে পার্কিং পারমিট আছে আর কার কার গাড়িতে নেই।

বাড়ি থেকে নাস্তা না করেই বেরিয়েছিলেন আজ। ভেবেছিলেন অফিসে যাবার পথে টোনি’জ গ্রিল এ একটা ঢু মারবেন। ওদের গ্রিল্ডচিজ-বেকন স্যান্ডউইচটা তাঁর খুব পছন্দের। তবে স্যান্ডউইচ ছাড়াও আরেকটা কারণ আছে। মার্ক গেজলারকে আজকাল টোনি’জ গ্রিল এ দেখা যায়। অনেকদিন হলো কাজকর্ম সব গুটিয়ে বসে আছে সে। তিনি জানেন এটি বড় একটা ঝড় শুরু হবার আগের থমথমে ভাব মাত্র। কখনো কখনো দুজনের চোখে চোখ পরে যায়। মার্ক হাসে, কারণ সে জানে ডার্ক ম্যাটেন কেন আসেন। ডার্ক ম্যাটেন হাসেন, কারণ তিনি বিশ্বাস করেন শুভশ্য শীঘ্রম। বেশ কিছুদিন ধরেই চলছে এই চোর-পুলিশ চোর-পুলিশ খেলা।

রাস্তা মোটামুটি খালিই ছিল। তাছাড়া পুলিশের গাড়ি দেখলে লোকে এমনিতেই সরে গিয়ে জায়গা করে দেয়। বেশ চলছিলেন অফিসার ম্যাটেন শিস দিয়ে দিয়ে। টোনি’জ গ্রিল থেকে মিনিট দশেক দুরে থাকতেই আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে একটা শব্দ হলো। প্রথমে ভেবেছিলেন কোন গাড়ির টায়ার ফেটেছে, তারপরই মনে হলো, গুলি কিংবা বোমা নয় তো, যা দিনকাল পড়েছে! অফিসে ফোন করে আরও পুলিশ পাঠাতে বলে গাড়ি থেকে নামতেই বেকুব বনে গেলেন তিনি। মল ঘেঁষে যে রাস্তাটা স্কুলের দিকে চলে গিয়েছে তার মাঝামাঝি একটা জায়গা দিয়ে গলগল করে পানি বেরুচ্ছে। শব্দটা যে পানির পাইপ ফেটে গিয়ে হয়েছে এটা তাঁর বুঝতে পারা উচিৎ ছিল।

রাগে দুঃখে মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে এখন। আর দু মিনিট পরে ফাটলে কী হতো! তিনিই বা কেন আগ বাড়িয়ে অফিসে রিপোর্ট করতে গেলেন? কতক্ষণ এখানে বসে থাকতে হয় কে জানে!

সিটি কর্পোরেশনের মিস্ত্রিরা কখন আসবে তার ঠিক নেই। সাথে আবার যোগ হয়েছে স্কুলের বাসটা। বাচ্চাটাও আর সময় পেলো না! অবশ্য বাচ্চাদের কীই বা দোষ। এসব ঠিক করতে হয় বাসায়। তাঁর বাড়িতে যেমন, সব কিছু একেবারে ঘড়ি ধরে কাঁটায় কাঁটায়, সে নাস্তাই হোক আর ইয়েই হোক। আসলে ডিসিপ্লিনের কোন বিকল্প নেই। পুলিশের চাকরির ভালো দিকও আছে।

দাঁড়িয়ে থেকে ঘুম পেয়ে যাচ্ছিলো, তাছাড়া খাওয়াও হয়নি এখন পর্যন্ত। অধীনস্তদের বাইরে রেখে মলের ভেতরে এসেছেন খাবার কিনতে। ‘হ্যাগার’স’ এর সামনে দাঁড়িয়ে তিন নম্বর দীর্ঘশ্বাসটা ছেড়ে একটা পা বাড়িয়েছেন কি বাড়ান নি, কোত্থেকে একটা লোক এসে হাউমাউ করে কী যেন বলতে শুরু করলো। একটু ধাতস্ত হয়ে তিনি বললেন,

“শান্ত হোন, বলুন কী করতে পারি আপনার জন্য?”

লোকটার হাহাকার বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেলো যেন। কষ্টে সৃষ্টে সে যা বলতে পারলো তার মানে হচ্ছে, কিছুক্ষণ আগে কেউ একজন তাঁর দোকান সাফ করে দিয়েছে।

অফিসার ম্যাটেন লোকটাকে প্রায় বগলদাবা করে ছুটতে ছুটতে প্রশ্ন করলেন,

“পুলিশে খবর দেয়া হয়েছে?”

বলেই মনে পড়লো তিনি নিজেই পুলিশ। কথাটা একটু ঘুরিয়ে আবার জিগ্যেস করলেন,

“নাইন ওয়ান ওয়ানে ফোন করেছেন?”

লোকটার আহাজারি খানিকটা কমে এসেছে। ছোট্ট করে জবাব দিলেন,

“না।”

“না মানে! একটা তিন বছরের বাচ্চাও জানে নাইন ওয়ান ওয়ানে ফোন করার কথা।”

“জী আমিও জানি। কিন্তু দোকানের সব গুলো ফোন এমনকি আমাদের
মোবাইলগুলোও নিয়ে গিয়েছে চোর।”

“মলের গার্ডরা কী করলো? অ্যালার্ম শুনে আসেনি কেউ?”

“অ্যালার্মটা কেন যেন বাজেনি!”

দোকানে ঢুকে মেঝের উপর ধুপ করে ছেড়ে দিলেন লোকটাকে।

“আপনাদের ম্যানেজারকে ডাকুন।”

“আমিই ম্যানেজার।”

“ও আচ্ছা! চলুন দেখি সি সি টিভিতে কী আছে”

ম্যানেজারের শূন্য দৃষ্টি দেখে অফিসার মাথা নেড়ে বললেন,

“ওগুলোও গিয়েছে?”

উত্তরের অপেক্ষা না করেই যোগাযোগ করলেন হেড কোয়ার্টারে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সাইরেনের আওয়াজ ভেসে এলো। আরও পুলিশ আসছে। অফিসার ম্যাটেন দোকানের সব কর্মচারীদের একজায়গায় ডেকে জড়ো করেছেন। ম্যানেজারকে জিগ্যেস করলেন,

“সবাই এসেছে?”

“জী না। একজন বাকি। কিন্তু তাকে তো পাওয়া যাবে না।”

“কেন, সে আজকে আসেনি?”

“আসবে না কেন! এসেছিলো, কিন্তু সে এখন হাসপাতালে।”

“হাসপাতালে! আচ্ছা কী হয়েছিলো ভালো করে বলুন তো? আমাকে জানতে হবে এটা চুরির মামলা না ডাকাতির।”

সব শুনে অফিসার ম্যাটেন থম মেরে গেলেন। তাঁর আর বুঝতে বাকি নেই এটা কার কাজ।

ম্যানেজারকে নিয়ে তিনি রওনা দিলেন থানার দিকে। পার্কিং লটে পা রাখতেই কানে ভেসে এলো গগনবিদারী একটা আর্তনাদ-

“চুরি, ছিনতাই, রাহাজানি! পুলিশ পুলিশ!”

অফিসার ম্যাটেন হতচকিত হয়ে বোঝার চেষ্টা করলেন শব্দটা কোন দিক থেকে আসছে।
বেশিক্ষণ খুঁজতে হলো না, উৎস নিজেই তাঁর কাছে এসে হাজির। কিন্তু সে মুখ খোলার আগেই আবার হাউমাউ করে চেঁচিয়ে উঠলেন ম্যানেজার।

“এই লোকটাই, এই লোকটাই অফিসার!”

“এই লোকটা কী?”

“এই লোকটাই চোর, এই লোকটাই ছিল শনের সাথে। আর কোন লোক, কোন খদ্দের তখন ছিল না। অবশ্য শন অজ্ঞান হয়ে যাবার পর মেলা লোকজন জমে গিয়েছিলো, আসে পাশের দোকানের কর্মচারীরা, অ্যাম্বুলেন্সের মেডিক, নার্স…।”

“আহ, থামুন তো। আর বলতে হবে না।”

উৎস পালিয়ে যাবার কোন চেষ্টাই করেনি। এমনকি পিছমোড়া করে যখন হাতকড়া পড়ালেন, তখনো না। অফিসার ম্যাটেন উৎফুল্ল গলায় বললেন,

“ছদ্মবেশটার প্রশংসা না করে পারছি না মার্ক! তোমার যে এ বিদ্যে ছিলো তা তো জানতাম না! কী, কথা বলছো না যে? ধরা পরে লজ্জা লাগছে বুঝি? আচ্ছা কথা বলতে হবেনা। নীরব থাকার অধিকার তোমার আছে। আমি আইনের লোক, হু হু। আইনের বাইরে কিছুই করবো না।”

কী যেন একটা তবু শুনলেন তিনি, খুব অস্পষ্ট। মাথা ঘুরিয়ে জিগ্যেস করলেন,

“কিছু বললে নাকি?”

“বু—ধ—বা—র।”

তারপরেই জ্ঞান হারালো তাঁর বন্দী।

ছয়.
মাইকেল ক্র্যানি স্কুলটা পচা। তারচে পচা এই স্কুলের ছেলেমেয়েগুলো। অমিয়কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে যে যার মতো হুড়মুড় করে ঢুকে পড়েছে ওয়াশরুমে। অমিয় যেতে যেতে সবগুলো খুপরি দখল। একটা খুপরিতে আগে থেকেই কেউ একজন ঢুকে বসে আছে। তারও বের হবার কোন লক্ষণ নেই। সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে কী হতে যাচ্ছে এখন। এরা যতক্ষণ পারে তাকে আটকে রাখবে। রিয়াড ব্যাকাস অমিয়র সাথে দাঁড়িয়ে, মনে হচ্ছে পুরো ঘটনাটার জন্য সে খুবই দুঃখিত। তার কারণেই তো সবাই জেনে গেলো, তাইনা! সে অমিয়র কাঁধে হাত রেখে নরম গলায় বলল,

“সরি অমিয়। আমার এমনটা করা ঠিক হয়নি।”

অমিয় মুখ শক্ত করে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো।

রিয়াড ব্যাকাস হঠাৎ খুব উৎফুল্ল গলায় বলে উঠলো,

“আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে।”

“কী আইডিয়া?”

“তুমি মেয়েদের ওয়াশরুমে যাও।”

রিয়াড ব্যাকাস একটা আস্ত শয়তান। ইচ্ছে করেই জোরে জোরে বলেছে যাতে সবাই শুনতে পায়। এবং সবাই শুনেছে। ভেতর থেকে খিল খিল করতে করতে সবাই বলে ওঠে,

“তুমি মেয়েদের ওয়াশরুমে যাও অমিয়।”

তারা বলেই চলে।

অমিয় রেগে গিয়ে লোকটা যে খুপরিতে বসে আছে তার দরজায় হাত দিয়ে দুম দুম করে আঘাত করলো।

এমনিতেই বাচ্চাদের চেঁচামেচিতে কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে, তার উপর দরজায় দুম দুম। মার্কের পিত্তি জলে গেলো। কিন্তু কিছু করার নেই। ‘চৌর্যবৃত্তির নান্দনিকতা’ ক্লাসের প্রথম দিনই প্রফেসর রামিয়া জাহান বলেছিলেন, আর যাই কর বাচ্চাদের কাছ থেকে দুরে থেকো। এরা দেখতে বোগেনভিলিয়ার জ্বলজ্বলে হলে কী হবে ভেতরে ভেতরে একেকটা দোদুল্যমান শিম্পাঞ্জি। একজন কেবল আমতা আমতা করে জিগ্যেস করেছিলো ভুল করে বাচ্চাদের মুখোমুখি হয়ে গেলে কী করতে হবে। প্রফেসর রামিয়া জাহান তাকে ক্লাস থেকে বের করে দিয়েছিলেন। এখন মনে হচ্ছে জবাবটা জেনে রাখা প্রয়োজন ছিল।

চেঁচামেচি চলছেই, আর ওই বিচ্ছু ছেলেটা, অমিয় না কী যেন নাম, সেও সমানে ধাক্কা দিয়ে চলেছে দরজায়। রাগে দুঃখে মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে মার্কের। নিজের চুল হলে হয়তো ছিঁড়েও ফেলতো কয়েকটা। কিন্তু এই পরচুলাটা অনেক যত্ন নিয়ে বানিয়েছে জোয়েন। আর দেখতেও ভারি সুন্দর, কী সুন্দর মানিয়েছে তাকে!

পরচুলার কথা পরে ভাবা যাবে। এখন এখান থেকে বের হওয়া দরকার। মুশকিল হচ্ছে, শপিং মলে বাচ্চারা কখনো একা আসে না। তাদের ল্যাজ ধরে আসে বাবা-মা-চাচা-চাচি-খালা-খালু-মামা-মামিরা। দশ বারোটা বাচ্চা মানে নিদেন পক্ষে পনেরো বিশ জন অভিভাবক অপেক্ষা করছে বাইরে। মার্ক চায় না এতোগুলো মানুষ একসাথে তাকে দেখুক।

এদিকে হাতে বেশি সময়ও নেই। পার্কিং লটে জোয়েন অপেক্ষা করছে। এতক্ষণ হয়ে গেলো একটা টেক্সটও পাঠায় নি। ওর কোন বিপদ টিপদ হয়নি তো আবার! যা আছে কপালে, বরং বেরিয়েয়ই যাবে সে। মলে এতক্ষণে অনেক লোকজন চলে এসেছে নিশ্চয়ই। পিপলস জুয়েলার্সের সামনে দিয়ে যাবার সময় মুখ আড়াল করে ভিড়ে মিশে গেলেই হলো।

অমিয় দরজা ধরে দাঁড়িয়ে ছিলো। হঠাৎ করে দরজা খুলতেই হুমড়ি খেয়ে পড়লো লোকটার উপর। সামলে নিয়ে চোখ তুলে তাকাতেই যেন জমে গেলো সে। ওর বন্ধুদের অবস্থাও একই। কারও মুখে কোন সাড়া নেই।

প্রিন্সিপাল নর্টন কোন দিকে না তাকিয়েই হন হন করে হেঁটে বেরিয়ে গেলেন। অমিয় আর সাতপাঁচ না ভেবে ঢুকে পড়লো ভেতরে। বাইরে থেকে ভেসে এলো রিয়াড ব্যাকাসের গলা,

“প্রিন্সিপাল নর্টন কিন্তু হাত না ধুয়েই চলে গেলেন, ইয়াক!”

ভেতর থেকে জবাব দিলো অমিয়,

“নিজের কথা ভাবো রিয়াড ব্যাকাস। প্রিন্সিপাল শুনেছেন তোমরা কেমন জ্বালিয়েছ আমাকে। স্কুলে যাও না আজকে! তোমাদের সবাইকে ধুয়ে দেবেন।”

অনেকক্ষণ পর এই প্রথম একটু ভালো লাগতে শুরু করেছে অমিয়র।

কোন রকম ঝুটঝামেলা ছাড়াই পার্কিং লটে পৌঁছে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো মার্ক। কিন্তু কোথায় জোয়েন! সেই সাদা গাড়িটাই বা গেলো কই? এমন খোলা জায়গায় বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকাটা ঠিক হচ্ছে না। একটা ট্যাক্সি পেলে ভালো হতো। কিন্তু সকালের ব্যাস্ততা কেটে যাওয়ার পর ট্যাক্সি গুলো কোথায় যেন লুকিয়ে পড়ে। মার্ক ব্যাগটা বুকের সাথে চেপে ধরে সাবধানে পা বাড়ালো রাস্তার দিকে। রাস্তা পেরুলেই একটা বাসস্ট্যান্ড। ট্যাক্সির চেয়ে বাস অনেক বেশি নিরাপদ।

জোয়েন না বলেছিলো রাস্তাটা তলিয়ে গিয়েছে! আশেপাশে তাকিয়ে পানির কোন চিহ্নই দেখছে না মার্ক। কেমন যেন গোলমেলে লাগছে সব। একটা স্কুলবাস থেমে আছে বাসস্ট্যান্ডের সামনে। ভালোই হলো, এটার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা যাবে। ওহ, ওই যে, একশ ছিয়ানব্বই নম্বর বাসটা আসছে।

স্কুল বাসের আড়াল থেকে বেরিয়ে বাসস্ট্যান্ডের দিকে ঝুঁকতে গিয়েই আচমকা হট্টগোলে চমকে উঠলো মার্ক। ওয়াশরুমের সেই বিচ্ছু ছেলেগুলো! সাথে যোগ হয়েছে বাচ্চা বাচ্চা কিছু মেয়ে। আর তাদের পেছন পেছন আসছে দশাসই চেহারার এক মহিলা। মহিলার চোখে চোখ পড়তেই চিৎকার দিয়ে উঠলো সে,

“গুড মর্নিং প্রিন্সিপাল নর্টন। আপনি নিজেই চলে এসেছেন পুলিশের ফোন পেয়ে। অনেক অনেক ধন্যবাদ।”

বাচ্চাকাচ্চা গুলোও চেঁচামেচি থামিয়ে সমস্বরে তাকে ‘গুড মর্নিং প্রিন্সিপাল নর্টন’ বলে উঠলো।

আরে, এরা তাকে স্কুলের প্রিন্সিপাল ভাবছে নাকি! এতোগুলো মানুষের নিশ্চয়ই ভুল হতে পারেনা। নাহ জোয়েনের এলেমে আছে বটে, শেষটায় তাকে বাচ্চাদের স্কুলের প্রিন্সিপাল বানিয়ে ছেড়েছে! কিছু একটা নিশ্চয়ই বলা উচিৎ এখন। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে প্রিন্সিপালদের গলার আওয়াজ কেমন হয় এটা তার কিছুতেই মনে পড়ছে না। সম্ভবত ভারি, নইলে বাচ্চারা কথা শুনবে কেন?

মার্ক যথা সম্ভব গলার স্বর ভারি করে জবাব দিলো।

“গুড মর্নিং। চলি তাহলে, স্কুলে দেখা হবে।”

মার্ক চলে যাবার জন্য পা বাড়াতেই মিসেস মার্থা খুব উদ্বেগ নিয়ে বললেন,

“গলার স্বরটা এমন শোনাচ্ছে কেন, ঠাণ্ডা বাঁধিয়ে বসে আছেন বুঝি? অবশ্য আজকের বাতাসটাও কেমন ভেজা ভেজা, কাল রাতে অনেক বৃষ্টি হয়েছে কিনা। আপনার আর হেঁটে কাজ নেই। চলুন আমাদের সাথে বাসে, বাচ্চারাও খুব খুশি হবে।

বাচ্চাদের ব্যাপার স্যাপার বোঝা কঠিন। ভয় পাবে কী, সবাই গোল হয়ে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে চেঁচাতে শুরু করলো,

“প্লীজ প্রিন্সিপাল নর্টন, প্লি——ই—ই—জ ডোন্ট সে নো টু মিসেস মার্থা।”

কিছু বুঝে ওঠার আগেই মার্ক নিজেকে আবিষ্কার করলো বাসের ভেতরে।

প্রফেসর রামিয়া জাহান বলেছিলেন বাচ্চাদের কাছ থেকে দুরে থাকতে, আর সে কিনা একদল বাচ্চাকাচ্চার সাথে একটা হলুদ বাসে! খুব দ্রুত একটা বুদ্ধি বের করা দরকার। বড় ধরনের বিপদে জড়িয়ে যাচ্ছে সে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই বাস পৌঁছে গেলো স্কুলে। পার্কিং লটটা একেবারে ফাঁকা, স্কুলে ক্লাস চলছে পুরোদমে।

হই হই করতে করতে নেমে গেলো বাচ্চারা। মিসেস মার্থা মার্কের দিকে তাকিয়ে বললেন,

“একটা দিনই গেলো প্রিন্সপাল নর্টন। আমি তাহলে চলি, আপনিও গিয়ে স্কুল সামাল দিন।”

বিকট শব্দে খক খক করে কিছুক্ষণ কেশে মার্ক জবাব দিলো,

“আমার শরীরটা ভালো লাগছে না। আমি বরং বাসেই বসে থাকি। আপনি দয়া করে আমার অফিসে গিয়ে খবর দিন কেউ যাতে আমার জন্য ওষুধ নিয়ে আসে। একটু শীত শীতও লাগছে। যাবার আগে বাসের হিটারটা কি ছেড়ে দিয়ে যেতে পারেন?”

“নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই।”

মিসেস মার্থা বাসে স্টার্ট দিয়ে হিটার ছেড়ে নেমে গেলেন। যেইনা তিনি স্কুলে ঢুকেছেন, অমনি মার্ক এক লাফে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসেই এক্সেলেটর চেপে দিলো। হা হা হা, এবার তাকে পায় কে? ফুর্তিতে একটা শিস দিতে যাবে, অমনি পেছন থেকে রিনরিনে গলায় কে যেন বলে উঠলো,

“এক্সকিউজ মি প্রিন্সিপাল নর্টন, আমরা কোথায় যাচ্ছি?”

আরেক্টু হলেই সামনে থেকে আসা একটা সাইকেলকে প্রায় উড়িয়ে দিয়েছিলো মার্ক। একেবারে পেছনের সিটে একটা ছেলে বসে আছে! তার গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়া সেই বিচ্ছুটা। ড্রাইভিং সিট থেকে পেছনের সিটটা যথেষ্ট দুরেই। কিন্তু অতটা নয় যতটা হলে বলা যায় সে বাচ্চাটার কাছ থেকে দুরে রয়েছে।

সাত.

চোরদের অনেক কায়দা কানুন থাকে, কিন্তু তারা যে চাইলেই অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটা অফিসার ম্যাটেনের জানা ছিলোনা। তিনি বুঝে উঠতে পারছেন না কী করবেন। হাসপাতালে নেওয়া যায়, কিন্তু এতোগুলো নার্স আর ডাক্তারের ভিড়ে ঝামেলা বাড়বে বই কমবে না। চোরদের আজকাল বাড় বেড়েছে অনেক। দেখা যাবে উল্টো তার নামেই একটা মামলা ঠুকে দিয়েছে। যদিও তিনি কোনরকম জোর খাটান নি, তীব্র ইচ্ছে থাকলেও মার্কের বাঁ হাতটা মুচড়ে দেন নি, এমনকি একটা মৃদু আঘাতেরও কোন চিহ্ন নেই ওর শরীরে। তবু বলা যায়না, ছদ্মবেশের তলাতেই হয়তো লুকিয়ে রেখেছে কোন ক্ষত চিহ্ন! থাকুক আপাতত হাজতের ভেতরে, জ্ঞান ফিরলে ওর উকিলকে সামনে রেখেই ব্যাটার আসল চেহারা ফিরিয়ে আনবেন।

কেবল একটা খটকা কোনভাবেই মন থেকে দুর করতে পারছেন না তিনি। মার্ক নিজেই এসে কেন ধরা দিলো! যেখানে তার পালিয়ে যাবার কথা, সেটা না করে কেন সে চিৎকার করে পুলিশ ডাকছিলো! তাছাড়া চোরাই হিরের একটা দানাও মার্কের কাছে পাওয়া যায়নি। কেউ ওকে চুরি করতে দেখেনি, সি সি টিভির সাহায্যও পাওয়া যাচ্ছে না। ছদ্মবেশ কেন নিয়েছে সে প্রশ্ন করেও কোন লাভ নেই, এদেশে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছের মূল্য আছে। তার উপর আজকে আবার হ্যালোউইন, মানুষজন বিচিত্র সব পোশাক আর কস্টিউম পড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেলো সব। মার্ক একা নয়, তার দোসর আছে একটা! হিরেগুলো সেই স্যাঙাৎ এর কাছেই।

নিজের বুদ্ধিতে মুগ্ধ হয়ে গেলেন অফিসার ম্যাটেন। স্যান্ডউইচে একটা কামড় দিয়ে মার্কের দিকে তাকিয়ে মৃদু মৃদু হাসলেন খানিকক্ষণ। জ্ঞান ফিরলে ব্যাটাকে ভালো করে একটা রগড়ানি দিতে হবে। পুলিশেরও কায়দা কানুন আছে, হু হু।

এমন সময় ফোন বেজে উঠলো। নাহ, শান্তি মতো একটু খাওয়াও যাবেনা দেখছি। স্যান্ডউইচটা প্লেটে রেখে রাশভারী গলায় বললেন,

“হ্যালো?”

“হ্যালো, আমি মাইকেল ক্র্যানি স্কুল থেকে বলছি। আমার নাম এমা, স্কুলের সেক্রেটারি।”

“জী বলুন কী করতে পারি?”

“আমাদের স্কুলের একটা বাস হারিয়ে গিয়েছে। বাসের নম্বর নয় নয় ছয় ছয় নয়।”

“মিসেস মার্থা যেটা চালান?”

“জী, ওটার কথাই বলছি।”

“হা হা হা, হারিয়ে যায়নি মিস এমা। রাস্তায় আটকে ছিলো, স্কুলের প্রিন্সিপালকে তো আমি জানিয়েছি! চিন্তা করবেন না, শিগগিরি পৌঁছে যাবে। বাচ্চারা ওয়াশরুমে গিয়েছিলো কিনা, সেই জন্যই হয়তো একটু দেরি হচ্ছে। আপনি বরং প্রিন্সিপাল নর্টনকে ফোনটা দিন।”

“সেখানেই তো সমস্যা অফিসার ম্যাটেন। তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।”

“খুঁজে পাওয়া যাবেনা কেন? তিনি তো আর ক্লাস ফোরের একটা বাচ্চা নন!”

“ইয়ে মানে, ক্লাস ফোরের একটা বাচ্চাও হারিয়ে গিয়েছে।”

“থামুন থামুন, আমাকে ব্যাপারটা ভালো করে বুঝতে দিন। আপনি বলছেন, নয় নয় ছয় ছয় নয় নম্বর বাসটা হারিয়ে গিয়েছে, তাই তো?”

“জী।”
“ক্লাস ফোরের একটা বাচ্চাও হারিয়ে গিয়েছে?”

“জী।”

“প্রিন্সিপাল নর্টনও হারিয়ে গিয়েছেন!”

“ঠিক হারিয়ে গিয়েছেন বলবো না।”

“কী বলবেন তাহলে?”

“মিসেস মার্থা বাস নিয়ে স্কুলে এসেছিলেন বটে। বাচ্চাদের সাথে প্রিন্সিপাল নর্টনও ছিলেন। সবাই নেমে যাবার পর তিনি মিসেস মার্থাকে অফিসে পাঠালেন তাঁর জন্য ওষুধ আনতে।”

“তারপর?”

“মিসেস মার্থা অফিসের ভেতরে ঢুকতেই প্রিন্সিপাল নর্টন বাসটা নিয়ে চলে গেলেন। আমি পুরো ব্যাপারটা অফিসের জানালা দিয়ে দেখেছি। ভেবেছিলাম তিনি হয়তো বাসটা গেটের সামনে থেকে সরিয়ে রাখছেন। কিন্তু তা নয়, খুব জোরে চালিয়ে ডান দিকে মোড় নিয়ে বড় রাস্তা ধরে কোথায় যে চলে গেলেন! অনেকবার ফোন করেছি, কিন্তু তিনি ফোন ধরছেন না।”

“বলনে কী! আর বাচ্চাটা হারালো কখন?”

“বাচ্চাটা বাস থেকে নামেনি।”

“হুম। বাবা-মা কে খবর দিয়েছেন?”

“এখনো দেই নি, ভাবলাম আগে আপনাদের জানাই।”

“ঠিক করেছেন, এসব কাজ পুলিশের হাতে ছেড়ে দেয়াই ভালো।”

বলতে বলতেই ভীষণ গম্ভীর হয়ে গেলো অফিসার ম্যাটেনের গলার স্বর। যা ভেবেছিলেন তাই, মার্ক আর নর্টন একজন আরেকজনের দোসর, পার্টনারস ইন ক্রাইম। দারুণ একটা পরিকল্পনা সাজিয়েছে মার্ক, চুরির মাল নর্টনকে গছিয়ে দিয়ে নিজে ধরা দিয়েছে পুলিশের হাতে। এদিকে পুলিশ তাকে নিয়ে ব্যাস্ত, আর ওদিকে নর্টন হিরে নিয়ে স্কুল বাসে করে হাওয়া। সাথে একটা বাচ্চাকে রেখেছে বিপদে পড়লে দর কষাকষির জন্য। এতক্ষণে কতদূর চলে গিয়েছে কে জানে!

মিস এমাকে বলে দিলেন থানায় চলে আসতে, পিপলস জুয়েলার্সের ম্যানেজারও চলে আসবে যে কোন সময়। অধীনস্ত ক’জনকে পাঠিয়েছেন ওয়ালমার্ট থেকে বরফকুঁচি কিনে আনতে। ঠাণ্ডা পানিতে ভিজিয়ে জ্ঞান ফেরাবেন মার্কের।

নর্টন পালাতে পারবে না। সবখানে খবর পাঠিয়ে দিয়েছেন তিনি, সব গুলো প্রধান সড়কে, হাইওয়েতে পুলিশ নজর রাখবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আকাশে উড়বে তিনটি হেলিকপ্টার। কালো পিচের রাস্তায় একটা হলুদ স্কুল বাস খুঁজে পাওয়া স্রেফ সময়ের ব্যাপার।

কেবল একটা কারণেই খুব চিন্তা লাগছে তাঁর। বাচ্চাটার ভারি বিপদ। কী যেন নাম, ও হ্যাঁ, অমিয় নীলাদ্রি। মিস এমা বলার সাথে সাথেই লিখে নিয়েছিলেন। নামটা একটু অন্য রকম, প্রতিদিন শোনা যায় এমন নয়। আরে, এই তো সেই ছেলে যাকে সাহায্য করার জন্য মিসেস মার্থা তাঁকে অণুরোধ করেছিলেন! তখন খুব বড় গলায় তিনি বলেছিলেন পুলিশের কাজই হচ্ছে মানুষকে সাহায্য করা।

অফিসার ম্যাটেনের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। হিরে চুলোয় যাক, আগে অমিয়কে নিরাপদে পৌঁছে দিতে হবে ওর বাবা-মা’র কাছে। ইউনিফর্মটা ঠিকঠাক করে নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়ালেন। মনটা কেন যেন কিছুতেই শান্ত হচ্ছেনা। এতো বছর ধরে চাকরি করছেন, কতো চোর-গুণ্ডা-বদমাশকে ধরে চালান দিয়েছেন কোর্টে, সব রুটিন মাফিক, চাকরিতে বলা আছে তাই। ঠাণ্ডা মাথায় পালন করে গিয়েছেন একটার পর একটা দায়িত্ব। আজকে তাঁর এমন লাগছে কেন! সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো এমন উথাল পাতাল রাগ ফুঁসে উঠছে কোথা থেকে? হাজতের পাশ দিয়ে যেতে যেতে মনে হলো মার্ককে তুলে একটা আছাড় দিতে পারলে খুব আরাম পেতেন। ভাগ্যিস হাতের কাছে চাবিটা নেই। তারপরও উত্তেজনা সামাল দিতে না পেরে ধরাম করে একটা লাথি কষিয়ে দিলেন গরাদের শিকে। ঝনঝন করে কেঁপে উঠলো হাজতের দরজা। উল্টো প্রতিক্রিয়ায় ছিটকে পড়ে যেতে যেতে সামলে নিলেন কোনমতে। লাথিটা কষিয়ে খুব ভালো লেগেছে তাঁর। নিজেকে কেমন যেন মানুষ মানুষ মনে হচ্ছে আবার।

আট.

কেন যে স্কুলগুলো সব আবাসিক এলাকায় বানায়! একটু পরপর হয় ট্রাফিক লাইট, নাহয় স্টপ সাইন, নইলে স্পিড ব্রেকার। জোরে ড্রাইভ করার কোন উপায়ই নেই। ঘণ্টায় তিরিশ কিলোমিটার স্পিডে গাড়ি চালিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে জোয়েন। এভাবে চলতে থাকলে হাইওয়েতে উঠতে উঠতে ঘুমিয়ে না যায়! কোথাও থেমে একটু কফি কিনতে পারলে ভালো হতো। সামনে আবারও একটা লাল বাতি, ধীরে ধীরে স্পিড কমিয়ে সিগন্যালে এসে দাঁড়ালো জোয়েন।
পাশের সিটে মার্কের ব্যাগটা রাখা, একেবারে ফুলেফেপে আছে। উফ, কী দাওই না মেরেছে তারা! প্রাণটা আঁকুপাঁকু করছে ব্যাগ খুলে গয়নাগুলো একনজর দেখতে। দশ বছর আগের জোয়েন হলে তাইই করতো। কিন্তু নিউ ইয়র্কের জীবন তাকে শিখিয়েছে সব সময় মনের কথা শুনতে নেই। আর মিনিট দশেক পরেই তো হাইওয়ে। মনের ইচ্ছে আপাতত মনেই থাকুক। হ্যামিল্টনে পৌঁছে কফিতে চুমুক দিতে দিতেই না হয় ব্যাগটা খোলা যাবে।

সবুজ বাতিটা জ্বলতেই বিচ্ছিরি শব্দ করে ব্যাগের ভেতর থেকে একটা ফোন বেজে উঠলো। জোয়েন তখন ডান পা টা ব্রেক থেকে সরিয়ে এক্সেলেটরের উপর এনেছে কেবল। আচমকা শব্দে চমকে উঠায় পায়ের চাপটা প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশিই পরে গেলো। ভাগ্যিস সামনে আর কোন গাড়ি নেই! কোনমতে সামলে নিয়ে ব্যাগটার দিকে তাকালো সে, ব্যাগের ভেতর ফোন রাখে কেউ! ফোন হচ্ছে চোরদের লাইফ লাইন, থাকবে পকেটে। মার্কের ফোন ওর পকেটেই থাকার কথা, এটা নির্ঘাত গয়নার দোকান থেকে লোপাট করে আনা। বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে গেলো জোয়েনের। দোকান ভর্তি হিরে আর একটা ফোনের লোভ সামলাতে পারলো না মার্ক, ছিঃ!

বাজুকগে ফোন, না ধরলেই হলো। কয়েকটা রিং হয়ে কেটে যাবে নিশ্চয়ই। গাড়ি চালানোয় মন দেয় সে, সামনেই হাইওয়েতে ওঠার রাস্তা। জোয়েনে ওঠেও পড়েছিলো প্রায়। কিন্তু ফোনটা আবারও বেজে উঠায় দিশা হারিয়ে ভুল পথে চলে গেলো সে। পরের এক্সিটটা কোথায় কে জানে! সাথে একটা জি পি এস থাকলে কোন ভাবনা ছিল না। এখন ইউ টার্ন নিয়ে ফিরে আসতে আসতে আরও অন্তত দশটা মিনিট নষ্ট। ফোনটারও কোন থামাথামি নেই, কেটে গেলেই আবার আসছে, অসহ্য। ইউটার্ন পরে নেয়া যাবে, আগে নিরিবিলি কোন গলিতে ঢুকে ফোনটা থামানো দরকার। এদিক ওদিক ভালো করে দেখে একটা গলিতে ঢুকে গাড়ি থামিয়ে পাশের সিট থেকে ব্যাগটা টেনে নিজের দিকে আনলো জোয়েন। উফ, কী ভীষণ ভারি! নিদেন পক্ষে পাঁচ ছয় কেজি তো হবেই। পার্কিং লটে ওজনটা টের পায় নি। উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে ব্যাগটা খুললো সে।

এখানে এখন হেমন্তের কাল, রঙ ধরার সময়। গলির রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা সারি সারি মেপল গাছে আগুন লেগে গিয়েছে যেন। যেদিকে দুচোখ যায় কেবল লাল আর লাল। তার চেয়েও লাল দেখাচ্ছে জোয়েনের মুখ। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না সে। ব্যাগের ভেতরে তাড়া তাড়া কাগজ, ভারি ভারি কয়েকটা বই আর একটা ফোন। ইচ্ছে করছে রাস্তায় আছাড় মেরে পায়ের তলায় পিষে দেয় পিড়িং পিড়িং করে বেজে চলা ফোনটাকে। অনেক কষ্টে রাগ সামলে সুইচ টিপে ফোনটা বন্ধ করে ভাবতে বসলো জোয়েন।

মার্ক তাঁকে ধোঁকা দিয়েছে। মূল্যহীন একতাড়া কাগজ ধরিয়ে দিয়ে সটকে পড়েছে হিরে নিয়ে। এতক্ষণে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গিয়েছে নিশ্চয়ই। কী ভেবেছে মার্ক, পালিয়ে রক্ষা পাবে? প্রাণ থাকতে জোয়েন তাকে ছেড়ে দেবে না। ভাবতে ভাবতেই হাতে ধরে রাখা ফোনটার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠে সে। আরে তাই তো! জানালা খুলে ফোনটা রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে এক ধাক্কায় শূন্য থেকে ষাট কিলোমিটারে তুলে ফেললো গাড়ির গতি। কিছুদূর গিয়েই চোখ পড়লো ব্যাগে। ঘ্যাঁচ করে ব্রেক ধরে গাড়ি থামিয়ে ব্যাগটাও ছুঁড়ে ফেলল রাস্তায়। সিগনালের কাছে পৌঁছে তার মনে হলো বোমাটা গাড়ির ভেতরেও থাকতে পারে। তাইই হবে, নইলে গাড়িতে উঠেনি কেন মার্ক! মাঝ রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে কোন মতে দরজা খুলে নিজের হাতব্যাগটা নিয়ে বেরিয়েই দিলো দৌড়। নাক ঘেঁষে সাঁই করে চলে গেলো একটা ট্রাক। জোয়েনের সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। কোনমতে রাস্তাটা পেরিয়ে চলে যাবে যতদূর সম্ভব। গোল্লায় যাক হিরে, চুলোয় যাক মেক্সিকোর ফার্ম হাউজ। আপাতত প্রাণে বেঁচে নিউ ইয়র্কে ফিরতে পারলে হয়। প্রথমেই একটা ওয়াশরুমে ঢুকে চেহারা পাল্টে নিতে হবে। লোকে যে তাকে ক্যামেলিয়ন ডাকে সেকি আর এমনি এমনি!

মিস এমা তখন গাড়িতে তেল ভরে পাম্প থেকে বের হচ্ছিলো। হঠাৎ একজন পুলিশ ছুটে এসে দরজা খুলে ঢুকেই বলল,

“একদম কথা বলবে না, চালাতে থাকো।”

কোন মতে ঢোক গিলে জিগ্যেস করলো সে,

“কোন দিকে?”

“ ট্রেন স্টেশনে, আর একটা কথাও নয়।”

ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়লো এমার। পুলিশের কাজ কারবারই আলাদা। একটা প্রশ্ন করার জন্য প্রাণ আইঢাই করছে তার। কিন্তু পুলিশের হুকুম বলে কথা, চুপ করে থাকাই ভালো। চলতে শুরু করলো সে। স্টেশন এখান থেকে মাত্র তিন মিনিটের পথ।

নয়.

অমিয়’র মা ফারহানা ইসলাম একটা সোফায় হেলান দিয়ে ভাবছিলেন কী করে কাটাবেন দিনটা। সোম মঙ্গল দুদিন জ্বর নিয়েই অফিস করেছিলেন। মঙ্গলবার দুপুর থেকে হঠাৎ এমন কাশি শুরু হলো যে ডীন হার্বার্থ ডেকে নিয়ে কড়া করে বলে দিয়েছেন সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারে কাছে না আসতে। কপালও এমন, সে রাতেই কিনা জ্বর সেরে গেলো! সকাল থেকে কাশিটাও আর নেই। ছুটি নিয়ে দারুণ বিপাকে পড়ে গিয়েছেন এখন। এমনিতে অসুখ বিসুখ তাঁর খুব একটা হয় না। অমিয়র বাবা আবার উল্টো, একটা হাঁচি দিলেই কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েন। একটু যে রাগ করবেন সে উপায়ও নেই। সত্যি সত্যি লোকটার ধাঁই ধাঁই করে জ্বর উঠে যায়। তারপর তিন চার দিন হাঁসের মতো প্যাকপ্যাকে গলা নিয় কোঁ কোঁ করেন, সূপের বাটিতে তিন চুমুক দিয়েই বাচ্চাদের মতো গোঁ ধরে বলতে থাকেন আর খাবেন না।

বাগানের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লেন ফারহানা ইসলাম। শীত আসি আসি করছে, এইসময়ে বাগানে কোন কাজ থাকেনা। রান্না করার কথা ভাবলেন একবার, পরক্ষনেই মনে পড়ে গেলো তাঁর জ্বর আসতেই বাবা ছেলে হই হই করতে করতে রেস্টুরেন্ট থেকে একগাদা খাবার কিনে নিয়ে এসেছে। অর্ধেকের বেশি এখনো ফ্রিজে পড়ে। একটা সময় ছিলো যখন অবসরে গান শুনতেন, কিংবা একটা গল্পের বই নিয়ে বসে যেতেন। আজকাল অবসর এতো কম মেলে যে পুরনো অভ্যাসগুলো সব হারিয়ে গিয়েছে।

তাঁর খুব দেশের কথা মনে পড়ছে। ঢাকায় থাকলে এখন মা’র কাছে চলে যেতেন, মেঝ বোনটাকে বলতেন অফিস থেকে ছুটি নিয়ে চলে আসতে। তারপর দু বোন মিলে মা’র সাথে গল্প করে কাটিয়ে দেওয়া যেতো সারা দিন। ছোট বোনটা এই শহরেই থাকে কিন্তু সেও এখন অফিসে, বান্ধবীরা ব্যাস্ত যার যার অফিস আর সংসার নিয়ে। বিশাল এই শহরে দিনের বেলায় যাবার মতো কোন জায়গা ফারহানা ইসলামের নেই।

শপিং মলে যেতে তাঁর ভালো লাগে না। বাকি থাকে হলে গিয়ে সিনেমা দেখা, কিন্তু মুভি শুরু হয় বেলা দুটোর পর, ওদিকে বিকেল পাঁচটায় অমিয়র ডে কেয়ার ছুটি। মুভি দেখে ফিরে আসতে আসতে দেরি হয়ে যাবে। একবার ভাবলেন অফিসে না গিয়ে চুপি চুপি সোজা ল্যাবে চলে যাবেন। না হয় একটা চেয়ারে বসে বসে ছাত্রছাত্রীদের কাজই দেখবেন। কিন্তু ডীন হার্বার্থ খুব রাগী মানুষ। আর বয়সটাও তাঁর এমন যে তরুণ শিক্ষকদের ধুয়ে দিতে তাঁর খুব একটা বাঁধেনা।

কিছুক্ষণ মন মরা হয়ে বসে থাকার পর সোফা থেকে উঠে পুরনো একটা অ্যালবাম বের করলেন শেলফ থেকে। এই একটা কাজ সারাদিন ধরে করা যায়। প্রথম পাতাতেই তুলতুলে একটা বাচ্চার ছবি, ছেলেটা অমিয়। জন্মানোর পাঁচ মিনিট পরে তোলা। কী ছোট্ট ছোট্ট হাত, ছোট্ট ছোট্ট পা! এক মাথা চুল, আর ঘাড়ের দিকে বড় বড় লোম, ঠিক যেন একটা বনমানুষের বাচ্চা। ছবিটার উপর হাত রেখে ফারহানা ইসলামের চোখ ভিজে ওঠে। কবে কখন এতো বড় হয়ে গেলো ছেলেটা!

স্মৃতির পাতায় হারিয়ে গিয়েছিলেন, খেয়ালই করেননি ফোনটা কতক্ষণ ধরে বেজে চলেছে। হঠাৎ টের পেয়ে কানের কাছে নিয়ে বললেন,

“হ্যালো?”

ওপাশ থেকে রাশভারী একটা কণ্ঠ জবাব দিলো,

“হ্যালো, ডক্টর ইসলাম বলছেন?”

“জী বলছি। জানতে পারি কার সাথে কথা বলছি আমি?”

“আমার নাম ডার্ক ম্যাটেন। অফিসার ইন চার্জ, মেপল স্টেশন, ইয়র্ক রিজিওনাল পুলিশ ডিপার্টমেন্ট।”

“শুভ অপরাহ্ণ অফিসার ম্যাটেন, বলুন কী করতে পারি আপনার জন্য?”

“ডক্টর ইসলাম, আমি আপনার বাসার সামনেই দাঁড়িয়ে আছি। দয়া করে দরজাটা একটু খুলুন। ”

ফারহানা ইসলাম বুঝতে পারছেন না দিন দুপুরে পুলিশ কেন তাঁর বাড়িতে!

অফিসার ম্যাটেন ঘরে ঢুকে মাথার টুপিটা নামিয়ে বললেন,

“কিছুক্ষণ আগে অমিয়র স্কুল থেকে একটা ফোন এসেছে। ওকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।”

ফারহানা ইসলামের মাথাটা ঘুরে উঠলো। হাত দিয়ে সোফার হাতলটা খামচে ধরে কোনমতে বললেন,

“আমি আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না অফিসার। খুঁজে পাওয়া যাবে না কেন? আমার চোখের সামনেই তো বাসে উঠলো।”

“আমরা যতদূর জানি ও বাসেই আছে, প্রিন্সিপাল নর্টনও আছেন সাথে। কিন্তু বাসটা যে কোথায় সেটাই কেউ জানে না। আমরা সাধ্যমত চেষ্টা করছি, সবগুলো রাস্তায় কড়া নজরদারি চলছে।”

অফিসার ম্যাটেনের কথাগুলো কানে গেলেও ঠিক ধরতে পারছেন না ফারহানা ইসলাম। মনে হচ্ছে যেন জ্বরের ঘোরে রয়েছেন।

“অমিয়র বাবার ফোনটা বন্ধ। আমদের সাথে যোগাযোগ করতে বলে মেসেজ রেখে দিয়েছি।”

“সম্ভবত মিটিঙে আছে। আচ্ছা, প্রিন্সিপাল নর্টনের কথা কী যেন বলছিলেন!”

অফিসার ম্যাটেন জানালেন এমা তাঁকে কী বলেছে। কেবল মার্কের সাথে নর্টনের যোগাযোগের ব্যাপারটা গোপন রাখলেন তিনি। এমনিতেই ভেঙে পড়েছেন ভদ্রমহিলা, এটা শুনলে হয়তো জ্ঞান হারাবেন।

পুলিশ চলে যাবার কিছুক্ষণ পর অমিয়র বাবার ফোনটা এলো। ফোন ধরেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন ফারহানা ইসলাম।

দশ.
জীবনে কত বড় বড় সমস্যারই না সমাধান করেছে মার্ক। কতবার পালিয়ে এসেছে পুলিশের নাকের ডগা থেকে। কোনকিছুকেই কখনো অসম্ভব বলে মনে হয়নি। অথচ একটা ছোটো বাচ্চার এইটুকুন একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে তাঁর এখন নেই নেই অবস্থা। ইচ্ছে ছিলো বাসটা সুবিধামতো কোনো জায়গায় ফেলে রেখে মানুষের ভিড়ে মিশে যাবে। সে পরিকল্পনা পুরোপুরি ভেস্তে গিয়েছে। বাচ্চাটার বয়স আরেকটু কম হলে হয়তো ভুজুং ভাজুং দিয়ে রাস্তায় নামিয়ে দেওয়া যেতো। বরং ভয় দেখালে কাজ হতে পারে। কিন্তু ড্রাইভিং সিটে বসে সেটা সম্ভব না। আগে বাসটা থামাতে হবে, তারপর কাছে গিয়ে পকেট থেকে পিস্তল বের করে কঠিন কঠিন কিছু কথা বলতে হবে। এক্ষেত্রে অনেকগুলো সমস্যা দেখা দিতে পারে। প্রথমত স্কুলের এতো কাছে বাস থামানো ঝুঁকিপূর্ণ। দ্বিতীয়ত, পিস্তলটা আসল না। বারো ডলার দিয়ে ওয়ালমার্ট থেকে কিনেছিলো গতকাল। কে জানে বাচ্চাটার কাছে হয়তো এই রকমেরই একটা খেলনা পিস্তল রয়েছে। আর যদি সে না বোঝে এটা খেলনা, তাহলেও কি শান্তি আছে? ভয় পেয়ে অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। তারচে বরং থাকুক কিছুক্ষণ, চলতে চলতেই ভাবা যাবে কী করা যায়। আপাতত একটা কিছু বলা দরকার। খক খক করে খানিকটা কেশে নিয়ে ভারি গলায় মার্ক জবাব দিলো,

“আমরা একটা স্টাডি ট্যুরে যাচ্ছি।”

রামিয়া জাহান ক্লাসে একবার বলেছিলেন মিথ্যে বলা নাকি একটা আর্ট। মিথ্যে বলতে হয় ছবি আঁকার ঢঙ্গে। পুরো ছবিটা মনের মধ্যে ভালো করে ভেবে নিয়ে তুলির আলতো আঁচড়ে একটু একটু করে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলতে হয় সেই ছবি। কথাটার অর্থ তখন পুরোপুরি বোঝেনি মার্ক।

অমিয় খুব অবাক হয়ে বললো,

“আমরা তো গত সপ্তাতেই স্টাডি ট্যুরে গিয়েছি। পরেরটা তো সেই ক্রিসমাসের আগ দিয়ে!”

মার্কের ঘাম ছুটে গেলো উপযুক্ত একটা জবাব খুঁজে পেতে। আমতা আমতা করে বললো,

“তা গিয়েছো, তবে এটা নতুন। স্কুলের ক্যালেন্ডারে নেই।”

“ও আচ্ছা, কোথায় যাচ্ছি?”

“মিউজিয়ামে।”

“কোন মিউজিয়ামে?”

কী মুশকিল, মিউজিয়াম একটার বেশি আছে নাকি শহরে! একটু ভেবে নিয়ে বললো মার্ক,

“সায়েন্স মিউজিয়ামে।”

“কিন্তু সায়েন্স মিউজিয়ামে তো যায় গ্রেড থ্রির ছেলেমেয়েরা! গ্রেড ফোরে উঠলে যেতে হয় ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে।”

হিস্ট্রিতে মার্ক বরাবরই ভালো। ইতিহাস না জানলে বড় চোর হওয়া যায় না। এ শহরের কোন পাড়ায় কী আছে, কোন ব্যাংকের ভল্ট কে বানিয়েছে, কোন দোকানে কী বিক্রি হয়, সব ইতিহাস তার নখদর্পণে। কিন্তু ন্যাচারাল হিস্ট্রি আবার কী জিনিস! প্রকৃতি ট্রকৃতির ব্যাপার হবে বোধ হয়। মার্ক বুদ্ধি করে জবাব দিলো,

“আমরা সেখানেই যাচ্ছি, আসলে ওদের পার্কে একটা সায়েন্টিফিক এক্সপেরিমেন্ট হবে কিনা। সায়েন্স আর নেচার একসাথেই দেখা হয়ে যাবে।”

“অন্যরা তো নেমে গেলো, ওরা আসবে না?”

“ওরাও আসবে। অনেক অনেক স্কুল থেকে বাচ্চারা আসছে তো, আমরা তাই আগে আগে যাচ্ছি যাতে ভালো জায়গাটা আমাদের স্কুলই পায়।”

বলতে বলতেই পার্কটা চোখে পড়লো মার্কের। ওই তো প্রকৃতি! এখানেই নেমে পড়া যাক। তারপর ছেলেটাকে গাছপালার আড়ালে কোন একটা জায়গায় ফেলে রেখে সটকে পড়তে আর কী লাগে! তবে বাসটা পার্কের পাশে রাখা চলবে না। লোকজন সন্দেহ করতে পারে। মার্ক আরও খানিকটা এগিয়ে প্রায় ভেঙে যাওয়া একটা চার্চের সামনে বাস থামালো।

“চলো তাহলে নামা যাক, ইয়ে কী যেন নাম তোমার?”

“অমিয়। কিন্তু এটাতো একটা ভাঙা চার্চ। মিউজিয়াম কোথায়?”

“সেখানে অনেক ভিড়, এতো বড় একটা বাস রাখার জায়গা পাওয়া যাবেনা। আমরা এখান থেকে হেঁটে যাবো। পার্কটা পেরুলেই মিউজিয়াম।”

অমিয় তার ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে পারছে না। প্রিন্সিপাল নর্টনের হাত ধরে হেঁটে হেঁটে মিউজিয়ামে যাচ্ছে সে! এই কথা শোনার পর স্কুলের কোন বুলি আর তাকে ঘাঁটানোর সাহস পাবে না কোনোদিন।

পার্কের গেটে এসে মার্ক একটু থামলো। ভেতরে মানুষজন হাঁটাহাঁটি করছে, কারও কারও সাথে কুকুরও আছে। বাচ্চাটাকে এখানে রেখে পালানো মুশকিল। পেছন থেকে ডাকাডাকি করলে ফিরে না গিয়ে উপায় নেই। যতটা সম্ভব ভেতর দিকে ঢুকে যেতে হবে। এমন একটা জায়গায়, যেখানে কেউ নেই।

হেঁটে যাবার রাস্তাটা ইট দিয়ে বাঁধানো, ঠিক যেন উইজার্ড অফ ওজের সেই ইয়েলো ব্রিক রোড। কিছুদূর গিয়ে বাঁধানো রাস্তা ছেড়ে মেঠো পথে নেমে গেলো মার্ক। দেখে শুনে পা ফেলতে হচ্ছে, কাল রাতের বৃষ্টিতে জায়গায় জায়গায় পানি জমে থকথকে হয়ে আছে। প্রায় মিনিট কুড়ি হেঁটে শুনশান একটা জায়গায় পৌছুলো ওরা। গাছগুলো এখনে অনেক বড় আর উঁচুউঁচু, পাতার ফাঁক দিয়ে যেটুকু রোদ আসছে তাতে আলো নয়, যেন অন্ধকারটাই চোখে পড়ে বেশি। অমিয়র একটু একটু ভয় লাগছে।

মার্ক চারিদিকে ভালো করে তাকিয়ে নিশ্চিন্ত মনে মাথা নাড়লো। এর চেয়ে ভালো জায়গা আর হয় না। এখন স্রেফ ছেলেটাকে রেখে যেদিক থেকে এসেছে তার উল্টো দিক দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া। কিন্তু ছেলেটা যেভাবে হাত আঁকড়ে ধরে রেখেছে!

ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ হাত ছেড়ে দিয়ে অমিয় বলে উঠলো,

“প্রিন্সিপাল নর্টন, ওদিকটায় দেখুন একবার!”

মাথা তুলে তাকাতেই হতভম্ব হয়ে গেলো মার্ক। একটা বাচ্চা মেয়ে স্কিপিং রোপ নিয়ে একা একা খেলছে। পাশেই পড়ে আছে একটা কাঠের পুতুল। মেয়েটার মাথা ভর্তি কালো রেশমের মতো নরম নরম চুল, লাল হলুদ ফিতের দুটি বিনুনি নেমে এসেছে কপালের দুপাশ দিয়ে। ঘন সবুজ গাছেদের ভিড়ে মেয়েটিকে দেখে মনে হচ্ছে একটা ফুল ফুটে আছে যেন।

এতো ভারি বিপদ হলো! বাচ্চা যখন আছে, তখন বাবা মা আছে নিশ্চয়ই কাছে পিঠে। কে জানে একটা গোটা পিকনিক পার্টিই রয়েছে কিনা!

মেয়েটাও দেখেছে ওদের। খেলা থামিয়ে কাছে এসে অমিয়র দিকে তাকিয়ে বললো,

“আমার নাম পুলপু, তোমরা কারা?”

অমিয় এক গাল হেসে জবাব দিলো,

“আমি অমিয়, ইনি আমাদের স্কুলের প্রিন্সিপাল, প্রিন্সিপাল নর্টন।”

“প্রিন্সিপাল! সেটা আবার কী?”

অমিয় অবাক হয়ে তাকায়, মেয়েটা প্রিন্সপাল মানে জানে না!

“আমাদের স্কুলের সবচে বড় টিচার ইনি। সব টিচারদের বস।”

মেয়েটা মাথা নেড়ে বললো,

“ও বুঝতে পেরেছি। আমি আগে কখনো স্কুলে যাইনি তো! আমাদের গ্রামের কেউই যায় নি। চার্চের ফাদার জোর করে ধরে নিয়ে না এলে আমিও কি যেতাম?”

অমিয় আবারও অবাক হয়।

“জোর করে ধরে আনবে কেন? তুমি বুঝি খুব দুষ্টু?”

মেয়েটি ফিক করে হেসে দিয়ে বললো,

“আমাকে দেখে কি তোমার দুষ্টু মনে হচ্ছে?”

অমিয় মাথা নাড়লো।

“আমাদের গ্রামে কেউ স্কুলে যায় না। স্কুল থাকলে তো যাবে! একদিন ইয়া লম্বা একটা মানুষ সাথে করে কিছু মুশকো মুশকো লোক নিয়ে এসে আমার বাবাকে বললো সব বাচ্চাদের তার সাথে দিয়ে দিতে হবে। আমার বাবার নাম চীফ আতলিন, আমরা ক্রি নেশনের মানুষ। বাবা তো কিছুতেই দেবেন না। ওরা জোর করে সব বাচ্চাদের ধরে এনে ওই চার্চটায় আটকে রাখলো।”

“পার্কের বাইরে যে চার্চটা?”

“হু। ওই লম্বা মানুষটাকে সবাই বলে ফাদার, চার্চের বস। তারপর সবার মাথায় তেল ঢেলে কানে কানে কী কী যেন বলেছিল সে। পরে জেনেছি ওটাকে বলে ব্যাপ্টাইজ করা। সে যে কী জিনিস তা অবশ্য আমি জানিনা। ভীষণ মোটা একটা মহিলা যাকে সবাই সিস্টার বলে ডাকে সে বলেছিলো আমাদের নাকি সভ্য বানানো হচ্ছে। আচ্ছা তুমি কি জানো সভ্য বানানো মানে কী?”

“নাহ, তারপর কী হলো?”

“আসার সময় মা আমার কানে কানে বলে দিয়েছিলেন তিন চাঁদ পরে আমি যেন পালিয়ে এই জঙ্গলটায় চলে আসি। বাবা দলবল নিয়ে আসবেন আমাকে ফিরিয়ে নিতে।”

“তুমি পালিয়ে এসেছো!”

“তবে আর বলছি কী? আমার বাবা এই চলে আসলেন বলে।”

মার্ক বাকরুদ্ধ হয়ে পুলপু আর অমিয়র কথা শুনছিলো। এই এলাকার ক্রিদের কথা সে জানে। আশেপাশের দু’শ কিলোমিটারের মধ্যে যা আছে সব কিছুর মালিক একদিন ছিলো এই ক্রি নেশনের মানুষেরা। কিন্তু সেতো প্রায় সত্তুর আশি বছর আগের কথা! ক্রিদের কেউই আর এই তল্লাটে নেই, সবগুলোকে ঝেটিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে ইন্ডিয়ান রিজার্ভে। আর যে চার্চের কথা বলছে মেয়েটি সেটিতে এখন বাদুড় আর শেয়াল ছাড়া কেউ থাকে কিনা সন্দেহ।

আজকালকার বাচ্চা-কাচ্চাদের নিয়ে এই এক যন্ত্রণা। যা খুশি বানিয়ে বানিয়ে বলতে থাকে। বলছে বলুক, মার্কের জানা দরকার ওর সাথে আর কে কে আছে এখানে। সে পুলপুর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে বললো,

“খুকি চল তোমাকে তোমার বাবা মা’র কাছে পৌঁছে দেই। এই জঙ্গলে এভাবে একা একা খেলা করা ভালো না। তোমরা তো পিকনিক করতে এসেছো, তাইনা?”

পুলপু কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,

“তোমার কানে ওটা কি? দেখে মনে হচ্ছে কান থেকে একটা লেজ গজিয়েছে। লেজটা নকল, কেউ একজন বানিয়ে দিয়েছে।”

মার্ক প্রথমে বুঝতে পারেনি। জোয়েনের বানিয়ে দেওয়া জড়ুলটার কথা সে ভুলেই গিয়েছিলো। মনে হতেই কানে হাত দিয়ে হেসে বললো,

“কানের লেজ, হা হা হা। ভালোই বলেছো খুকি। এটাকে বলে জড়ুল। নকল হতে যাবে কেন! আমি যখন তোমার মতো এই এতোটুকু ছিলাম তখন থেকেই আছে।”

অমিয় খুব ধীরে ধীরে মাথা তুলে জড়ুলটার দিকে তাকায়। সত্যি সত্যি একটা লেজের মতোই তো লাগছে! এতদিন এটা চোখে পড়েনি কেন! ইস কতো ভালো একটা নাম দিতে পারতো সে। এই যেমন ওদের অংকের টিচার মিস্টার পেট্রোপোলাস, তার ঠোঁট গুলো একদম হাঁসের মতো। রিয়াড ব্যাকাস তাই নাম দিয়েছে মিস্টার প্লাটিপাস। লিটারেসি টিচার মিসেস ডেভিডোভিচের আবার দারুণ লম্বা নাক। সবাই বলে মিসেস পিনোকিও। প্রিন্সিপাল নর্টনের কী নাম দেওয়া যায় ভাবতে ভাবতেই ওর মনে পড়ে গেলো, নাম তো একটা আছে! বাচ্চারা তো বটেই, টিচাররাও আড়ালে আবডালে বলেন মিস্টার ওয়েডনেসডে। আর ঠিক তখনই অমিয়র মনে পড়লো ওদের স্কুলে বুধবারে কোন ট্রিপ বা অনুষ্ঠান হয় না। প্রিন্সিপাল নর্টন এদিনটাতে স্রেফ চুপটি করে তাঁর অফিসে বসে থাকেন। তাঁর কানে কোন জড়ুল নেই। এই লোকটা ওদের প্রিন্সিপাল না।

এগারো.

আকাশে দু-দুটো সূর্য। একটা হলুদ, আরেকটা ডিমের কুসুমের মতো টকটকে লাল। লাল সূর্যটা আয়তনে হলদের দ্বিগুণ হলেও তার তীব্রতা কম। সূর্য দুটির আলোয় পায়ের তলার ধু ধু বালুতে ছায়া পড়েছে তাঁর, দুটি ছায়া, একটি ডানে আরেকটি বাম দিকে। আশেপাশে যেদিকে চোখ যায় কেবল বালু আর বালু। এই মরুভূমিতে তিনি আর তাঁর দুটো ছায়া ছাড়া আর কিছু নেই।

কোথায় যেন একটা শব্দ হচ্ছে। অনেক উঁচু থেকে পাথরের উপর ক্রমাগত পানি পড়তে থাকলে যেমন শোনায় তেমন। তেষ্টায় বুক ফেটে যাচ্ছে, শব্দের উৎস অনুমান করে এক পা বাড়াতেই আকাশ থেকে ধুপ করে কী যেন একটা পড়লো তাঁর সামনে। কাছে গিয়ে দেখলেন একটা বাস্কেট বল। বলের উপরের দিকটায় সার বেঁধে তিন জোড়া চোখ। সেই চোখে না আছে আছে ভুরু, না আছে পাতা।

বলটা দুটো ড্রপ খেয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে বললো,

“হ্যালো?”

তিনি কাঁপা কাঁপা গলায় প্রশ্ন করলেন,

“কে তুমি? কী তুমি”

“হা হা হা।”

ভারি বিচ্ছিরি সে হাসি। সভয়ে দুপা পিছিয়ে গিয়ে আবারও প্রশ্ন করলেন,

“আমি কোথায়?”

“মধ্যাহ্নে”

“এর অর্থ কী!।”

“এর মানে অপরাহ্ণ আসন্ন প্রায়। তারপর সন্ধ্যা, সবশেষে অন্ধকার। সে ভারি মজার সময়, তোমার ছায়া দুটো মিলিয়ে যাবে। হা হা হা”

কী অদ্ভুত সব কথা! প্রশ্নের উত্তরে হেঁয়ালি কেবল। অন্য কোন প্রশ্ন করা যাক।

“তোমার নাম কী?”

“বুধবার।”

বলেই বলটা গড়িয়ে গড়িয়ে তাঁর দিকে ছুটে এলো।

প্রিসিপাল নর্টন প্রাণপণে দৌড়ুচ্ছেন, সামনে একটা বিশাল খাদ, লাফ দিয়ে পেরুনো অসম্ভব। যা হয় হবে ভেবে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে লাফ দিতেই, কী আশ্চর্য! শরীরটা যেন গ্যাস বেলুনের মতো হালকা হয়ে গেলো, তিনি উড়ছেন! নিচে বাস্কেটবলটা ড্রপ খেতে শুরু করেছে, একটু একটু করে বাড়ছে তার পাল্লা। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁকে ছুঁয়ে ফেলবে নিশ্চিত। তিনি পাখির ডানার মতো দু হাত ঝাঁপিয়ে আরও খানিকটা উঁচুতে উঠে গেলেন। কিন্তু বুধবার ছাড়ার পাত্র নয়, সেও এগিয়ে আসছে লাফিয়ে লাফিয়ে। আবার উপরে উঠার চেষ্টা করতেই কিছু একটায় মাথাটা আটকে গেলো। জিনিসটা ভীষণ গরম। চোখ তুলে তাকিয়ে চমকে উঠলেন, একটা সূর্যকে ছুঁয়ে ফেলেছেন তিনি!

সূর্যটা ভারি অদ্ভুত, কী একটা যেন আছে ভেতরে। সূর্যে ফিউশন চলে এ কথাটা তাঁর অজানা নয়। ভেতরের ওই লম্বা মতন জিনিসটাই কি তবে নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকটর! রিঅ্যাকটরটা অর্ধস্বচ্ছ, চওড়া হয়ে নেমে গিয়েছে নিচের দিকে, শেষ প্রান্তে একটা সোনালি সোনালি সুতো।

বালতিতে পানি ভরা শেষ হয়েছে কিনা খবর নিতে এসে আগুন ঝরা দৃষ্টিতে ডার্ক ম্যাটেন তাকালেন মেঝেতে শুয়ে থাকা মার্কের দিকে। জ্ঞান এখনো ফেরেনি। বরফ পানির ছোঁয়া পেলে বাপ বাপ করে ফিরবে।

একটু মনে হয় নড়েচড়ে উঠলো মার্ক! বিড়বিড় করে কিছু একটা বলছে সে। বোঝার জন্য কাছে যেতেই মার্ক হঠাৎ একটা লাফ দিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে পড়লো। ওর দু হাত দু দিকে প্রসারিত, পাখির ডানার মতো ঝটপট করছে, চোখ দুটো এখনো বন্ধ। সাথে সাথে কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে কোমরে গোঁজা লাঠিটা শক্ত করে চেপে ধরলেন ডার্ক ম্যাটেন। মার্ককে বিশ্বাস নেই। ততক্ষণে আরেকটা আরেকটা লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো মার্ক। ছাঁদ থেকে ঝোলানো বাতি দুটোর একটায় গিয়ে ঠেকেছে ওর মাথা।

“আরে আরে করো কী! পরচুলাটা পুড়িয়ে ফেলার ফন্দি এঁটেছো নাকি?” দৌড়ে গিয়ে বাতিগুলো বন্ধ করে দিলেন ডার্ক ম্যাটেন। পরচুলা না থাকলে পিপলস জুয়েলার্সের ম্যানেজারের পক্ষে ওকে শনাক্ত করা মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে।

হঠাৎ করেই অন্ধকার হয়ে গেলো চারিদিক। প্রিন্সিপাল নর্টন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে। রাত নেমে এসেছে। অপরাহ্ণ, বিকেল, সন্ধ্যা না পেরিয়েই! একটা কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছেন তিনি। চোখ মেলে দেখলেন সামনে একটা লোক দাঁড়িয়ে, চেনা চেনা লাগছে কিন্তু মনে করতে পারছেন না কোথায় দেখেছেন। টলমল পায়ে খানিকটা এগিয়ে জিগ্যেস করলেন,

“বলটা কোথায়?”

ডার্ক ম্যাটেনের ইচ্ছে করছিলো বালতি থেকে এক মগ পানি নিয়ে ছুঁড়ে ফেলেন মার্কের মুখে। অনেক কষ্টে সে ইচ্ছে দমন করে বললেন,

“কিসের বল?”

“আমার পেছনে ড্রপ খেতে খেতে দৌড়ে আসছিলো, ওর নাম বুধবার।”

আবার সেই বুধবার! ডার্ক ম্যাটেন বুঝতে পারছেন না মার্ক পাগল হয়ে গিয়েছে নাকি রসিকতা করছে। খুব কড়া গলায় একটা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন এমন সময় বাইরে থেকে একটা হট্টগোল ভেসে এলো তাঁর কানে। হাজতের দরজায় তালা লাগাতে লাগাতে কেবল বললেন,

“ফিরে এসে তোমার বুধবার ছোটাচ্ছি আমি।”

বারো.

মিস এমা গাড়িতে স্টার্ট দিতেই একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো জোয়েন। ট্রেন স্টেশনটা কতদূর কে জানে! তবে যত দুরেই হোক, পায়ে হেঁটে কিংবা বাসে চেপে যেতে হচ্ছে না। পুলিশ দেখলেই মানুষের সমস্ত প্রশ্ন যেন উথলে ওঠে, কারও ঠিকানার দরকার, কারও মানিব্যাগ হারিয়েছে, কেউ কেউ আবার একেবারে কাঁধে হাত দিয়ে সেলফি তোলার জন্য দাঁড়িয়ে পড়ে। এই মুহূর্তে মানুষ জনের সাথে যতটা সম্ভব কম কথাবার্তা হওয়াই ভালো। ভাগ্যিস গাড়িটা জুটে গিয়েছে, আর মেয়েটাও কেমন বোকা বোকা, সুড়সুড় করে রাজি হয়ে গেলো। রাজি না হলে পিস্তল দেখাতে হতো। পিস্তলটার কথা মনে পড়তেই জোয়েনের হাসি পেয়ে গেলো। আগের দিন মার্ক হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলো,

“ওয়ালমার্ট থেকে কিনে আনলাম। বারো ডলার করে দাম একেকটার। দেখতে মন্দ না, কী বলো?”

“কিন্তু এটা তো খেলনা পিস্তল!”

“দেশটা ক্যানাডা জোয়েন, এখানে ভালো মানুষেরা থাকে। আমেরিকার মতো চোর ছ্যাঁচোরে ভরা নয় যে সবাই পিস্তল কিনতে দোকানে দোকানে ছুটবে। তাছাড়া সাধারণ দোকানে এসব বিক্রি করাও নিষেধ।”

“অসাধারণ দোকানেই যেতে!”

“মাথা খারাপ! আইডি দেখাও, এই ফর্মে সাইন কর, সেই প্রশ্নের জবাব দাও, সে অনেক ঝামেলা!”

ভাগ্যিস পিস্তল দেখাতে হয়নি। খেলনা বন্দুক হাতে আত্মবিশ্বাসটা ঠিক সেভাবে আসেনা। রাস্তা থেকে চোখ সরিয়ে জামার ভেতরে রাখা পিস্তলটার দিকে একটু তাকিয়েছে কি তাকায় নি জোয়েন, গাড়িটা ঘ্যাঁচ করে মোড় নিয়ে হঠাৎ থেমে গেলো। মিস এমা সিট বেল্ট খুলতে খুলতে বললো,

“পুলিশ স্টেশনে চলে এসেছি অফিসার।”

পুলিশ স্টেশন! মেয়েটাকে বলেছিলো ট্রেন স্টেশনে যেতে, আর সে কিনা শুনলো পুলিশ স্টেশন! পার্কিং লটে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে একটার পর একটা পুলিশের গাড়ি। পুরো এলাকাটা গিজ গিজ করছে ইউনিফর্ম পড়া মানুষজন দিয়ে। ক্যানাডা চোর ছ্যাঁচোরের দেশ না হলে এতো পুলিশ কী করছে এখানে! কোনভাবেই গাড়ি থেকে নেমে পড়া যাবেনা এখন। হাসি হাসি মুখ নিয়ে এমার দিকে তাকিয়ে বললো জোয়েন,

“অনেক ধন্যবাদ মিস। তুমি এগোও আমি তোমার গাড়িটা অফিসের স্পটে পার্ক করে আসছি। ভিজিটরস স্পটগুলো খালি নেই দেখতেই পাচ্ছো।”

বিষয়টা এমাও লক্ষ্য করেছে। ভেবেছিলো অফিসারকে নামিয়ে দিয়ে অন্য কোথাও গাড়ি রেখে হেঁটে ফিরে আসবে। কৃতজ্ঞতায় মন ভরে গেলো তার।

এমা গাড়ি থেকে নেমে অফিসের দিকে এগোতেই ড্রাইভিং সিটে বসে পড়লো জোয়েন। বিশাল একটা ফাঁড়ার মধ্যখানে রয়েছে সে, ভালোয় ভালোয় বেরুতে পারলে হয়।

এক্সেলেটরে চাপ দিয়েছে কি দেয় নি, জানালার কাছে এসে টোকা দিলো একজন পুলিশ। ভয়ে ভয়ে কাঁচ নামিয়ে জোয়েন বললো,

“কী ব্যাপার?”

“প্লাটুন ছেড়ে এখানে কী করছো? তাড়াতাড়ি নেমে এসো, সার্চ পার্টির জন্য লোক লাগবে।”

“আমি গাড়িটা পার্ক করেই আসছি।”

“কোথায় পার্ক করবে শুনি? এখানে কোন জায়গা কি আর আছে? শহরের সব পুলিশ এসে জড়ো হয়েছে আজ। তুমি নেমে যাও, আমি তোমার গাড়িটা পেছন দিকে রেখে আসছি।”

জীবনে কখনো কখনো একটা সময় আসে যখন মানুষকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এটা সেরকম একটা সময়। জোয়েনের সামনে দুটো বিকল্প, নেমে অফিসের দিকে যাওয়া। তারপর সুযোগ বুঝে কেটে পড়া। অথবা যা আছে ভাগ্যে বলে এক্সেলেটার চেপে ধরা। দুটোতেই সমান ঝুঁকি। জোয়েন দ্বিতীয়টা বেছে নিলো।

তাড়াহুড়ায় লক্ষ্য করেনি উল্টো দিক থেকে একটা মাইক্রোবাস আসছে। সোজা গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লো সেই মাইক্রবাসের গায়ে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশটা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলেও দুর থেকে ব্যাপারটা লক্ষ্য করে ছুটে এলো মিস এমা। তার নতুন কেনা গাড়িটার সামনের দিকটা থেঁতলে গিয়েছে একেবারে।

কেমন করে যে অক্ষত অবস্থায় বেরুলো জোয়েন সেটা একটা রহস্য। বেরিয়েই দিলো দৌড়, ততক্ষণে বেরিয়ে এসেছে মাইক্রো বাসের চালক। মুখোমুখি হবার আগ পর্যন্ত কেউ কাউকে লক্ষ্য করেনি তারা।

হট্টগোল শুনে অফিস থেকে বেরিয়ে এসে ডার্ক ম্যাটেন দেখলেন দুজন মানুষ পার্কিং লটে চিতপটাং হয়ে কোঁকাচ্ছে। এঁদের একজন পুলিশ। আরেকজন পিপলস জুয়েলার্সের ম্যানেজার। সাত আট ফিট দুরে একটা মাইক্রোবাস, তার লেজের কাছে আধ ভাঙা একটা গাড়ি।

“হা করে দাঁড়িয়ে দেখছো কি সবাই? ওদের তুলে ধর, দেখো আঘাত-টাঘাত পেয়েছে নাকি। আর গাড়ি দুটোকে এখান থেকে সরানোর ব্যাবস্থা কর।”

মিস এমা একটু এগিয়ে এসে বললো,

“গুড আফটারনুন অফিসার ম্যাটেন, আমার নাম এমা।”

“গুড আফটারনুন এমা, আপনি অফিসে গিয়ে বসুন। আমি এদিকটা একটু সামলে আসছি।”

“জী মানে, ওই থেঁতলে যাওয়া গাড়িটা আমার।”

“আপনার মানে! আপনি মাইক্রোবাসে ধাক্কা দিয়েছেন?”

কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশটা এবার মুখ খুললো,

“না না, ইনি ধাক্কা দিতে যাবেন কেন! ধাক্কা তো দিয়েছে মাটিতে পড়ে থাকা ওই পুলিশ।”

ডার্ক ম্যাটেন বিভ্রান্ত হয়ে এমার দিকে তাকালেন,

“মিস এমা, আপনার সাথে কথা বলতে গেলেই কেন যেন সব গুলিয়ে যায়। ঠিক সেই স্কুলের ব্যাপারটার মতো। ভালো করে আমার প্রশ্ন গুলো শুনে তারপর জবাব দেবেন।।”

“নিশ্চয়ই অফিসার ম্যাটেন।”

“গাড়িটা আপনার, তাইতো?”

“জী তাই।”

“কিন্তু মাইক্রোবাসে ধাক্কা মেরেছেন উনি?”

“জী হ্যাঁ।”

“আপনি তখন কোথায় ছিলেন?”

“আপনার অফিসের দরজায়।”

“আপনার গাড়িতে উনি কেমন করে গেলেন?”

“আমার কাছে লিফট চাইলেন, আমি যেহেতু এখানেই আসছিলাম, তাই রাজি হয়ে গেলাম।”

কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশটা ডার্ক ম্যাটেনের কানে কানে কী যেন এসে বললো।

তিনি জোয়েনের কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে বিস্মিত গলায় বিড়বিড় করে বললেন,

“নিউ ইয়র্কের পুলিশ কী করছে এখানে! সবাইকে নিয়ে আমার অফিসে চলো।”

অফিসে ঢোকার মুখেই হাজতটা। সেদিকে চোখ পড়তেই মিস এমা চেঁচিয়ে উঠলো,

“প্রিন্সিপাল নর্টন!”

জোয়েন খেঁকিয়ে উঠলো,

“মার্ক! ইউ ব্লাডি ফুল!”

পিপলস জুয়েলার্সের ম্যানেজার উত্তেজনায় ইংরেজি ভুলে জাপানি ভাষায় কী বলল কে জানে, এক দুটা শব্দ ইংরেজি হলেও হতে পারে। সেই কিংকর্তব্যবিমুঢ় পুলিশটা পকেট থেকে নোটবুক বের করে দ্রুত নোট নিতে থাকে,

“হাগিহারা মিশিজুকি হক্কই, থিফো থিফো। কাঁচাসুশি নিরুআতা বারুগুলারু………!"
প্রিন্সিপাল নর্টন বালতি থেকে মগে করে একটু পানি তুলেছিলেন খাবেন বলে। এতো মানুষের চিৎকারে চমকে গিয়ে হাত থেকে মগটা পড়ে গেলো। মগের ঝনঝনানি থামার পর আরেকটা শব্দ হলো ধুপ করে, এবারে পড়েছেন প্রিন্সিপাল নর্টন। আবার জ্ঞান হারিয়েছেন তিনি।

তেরো.

অমিয় দৌড়ে মার্কের কাছ থেকে সরে পুলপুর পাশে গিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,

“এই লোকটা আমাদের প্রিন্সিপাল না, এই লোকটা দুষ্টু। আমাকেও তোমার মতো ধরে এনেছে।”

মার্ক বুঝতে পারলো সে ধরা পড়ে গিয়েছে। ভাগ্যিস ছেলেটা চেঁচিয়ে উঠেনি। মেয়েটার সাথের লোকজন শুনতে পেলে বিপদ হতো। একটা ক্রুর হাসি ফুটে উঠলো তার মুখে। পকেট থেকে পিস্তলটা বের করে বরফ শীতল গলায় বললো,

“খবরদার! আর একটা কথা বলবে না কেউ। অমিয়, তোমার জামা খুলে মেয়েটাকে ভালো করে বাঁধো। মুখটাও বেঁধে দেবে।”

অমিয় মাটির দিকে তাকিয়ে মুখ গোঁজ করে বললো,

“পারবো না।”

“না মানে! দেখতে পাচ্ছো না আমার হাতে এটা কী?”

“একটা পিস্তল”

“ভয় লাগছে না তোমার?”

“লাগছে। খুব ভয় লাগছে। আমি মা’র কাছে যেতে চাই।”

“তাহলে আমার কথা শোনো। পুলপুকে বাঁধো।”

“কিন্তু আমি যে গিঁট দিতে পারিনা! বিশ্বাস না হলে আমার জুতার দিকে তাকিয়ে দেখো, কোন ফিতে নেই। গিঁট দিতে শিখি নি বলে মা আমাকে ভেলক্রো স্ট্র্যাপের জুতা কিনে দেয়।”

আজকালকার বাচ্চাদের হয়েছে কী! ননীর পুতুল একেকটা। মার্ক পিস্তলটা পুলপুর দিকে ঘুরিয়ে বললো,

“এই খুকি, তুমি গিঁট দিতে পারো?”

পুলপু মাথা নেড়ে ছোট্ট করে বললো,

“পারি।”

“তাহলে বাঁধো এটাকে। আর বাঁধার সময় শিখিয়ে দাও কীভাবে গিঁট দিতে হয়।”

খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতে থাকে মার্ক, যেন খুব উঁচু দরের একটা রসিকতা করে ফেলেছে।

পুলপু এগিয়ে এসে অমিয়কে আড়াল করে মার্কের চোখের দিকে তাকালো। মার্ক মনে মনে প্রমাদ গোনে, মেয়েটা কি বুঝে ফেলেছে এটা নকল পিস্তল! পুলপু একটা আঙুল মার্কের দিকে তুলে খুব ধীরে ধীরে অনেকটা সুর করে গান গাওয়ার ঢঙে বললো,

“তোমার কানের জড়ুলটা নকল। তোমার মাথার চুলটা নকল। তোমার গোঁফটা নকল। এগুলো বানিয়ে দিয়েছে জোয়েন নামের মেয়েটা। তোমার নাম মার্ক গেজলার। জোয়েনের কাছেও এরকম একটা পিস্তল আছে। দুটোই নকল।”

মার্কের নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছে না। এই পুঁচকে মেয়েটা এতো কিছু জানলো কী করে! পুলপু বলেই চলে,

“তুমি একটা চোর। তোমার ব্যাগ ভর্তি হিরে। হিরে গুলো চুরি করে আনা। অমিয়কে তুমি ধরে এনেছো, ঠিক যেমন করে আমাকে ধরে এনেছিলো ফাদার আর তার লোকজন।”

মার্কের কেন যেন খুব ভয় লাগছে। ব্যাগটা বুকের সাথে চেপে ধরে ভাবলো দৌড় দেবে কিনা। কিন্তু মেয়েটার কাছে কিছু লুকোনো যায়না!

পুলপু বলে চলে,

“দৌড়ে পালানোর কথা ভাবছো! আমিও ভেবেছিলাম, কিন্তু পারিনি। ডান দিকে একবার তাকাও তো মার্ক।”

তাকাবেনা তাকাবেনা করেও তাকিয়ে ফেললো মার্ক। জঙ্গলটা কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে।

সেখানে আবছা আবছা একটা গ্রামের ছবি। ছবিটা জীবন্ত। গ্রামের একদিকে অনেকগুলো লং হাউজ, আরেকদিকে ধুধু মাঠ। মাঠের শেষ প্রান্তে একটা ধুলোর ঝড়। মার্ক আর অমিয় বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকে। ভেসে আসে পুলপুর স্বর,

“এই গ্রামটা আমাদের। মাথায় বাজপাখির পালক গোঁজা টুপি পরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার নাম চীফ আতলিন, আমার বাবা। আর ওই যে আমার মা, একটা লাল টুকটুকে জামা গায়ে, মা’র হাতে আমার কাঠের পুতুলটা। মাঠের ওদিক থেকে ধুলোর ঝড় উড়িয়ে আসছে ফাদার আর তার লোকজন। তোমরা গাড়ির শব্দ শুনতে পাচ্ছো না!”

একটা গুনগুণ আওয়াজ বেশ কিছুক্ষণ ধরেই শুনতে পাচ্ছিলো মার্ক। ধুলোর ঝড় ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে পুরনো দিনের এক, দুই, তিন, চারটে ফোর্ড কোম্পানির ট্রাক।

“ট্রাক থেকে লাফ দিয়ে যে লোকটা নামলো, সেই লোকটাই ফাদার। ঠিক তোমার মতো লম্বা মার্ক। তোমার মতো চোর। দেখো, ওরা আমার বাবার সাথে কথা বলছে। আমার মা হাউমাউ করে কাঁদছেন। ওই যে আমি, মায়ের পায়ের সাথে লেপ্টে দাঁড়িয়ে। দেখো দেখো, ওরা আমার বাবাকে মারছে, মা আমাকে নিয়ে ছুটছেন, ছুটছে সবাই। তুমি পালাতে চাও তাইনা মার্ক?”

মার্কের গলা শুকিয়ে গিয়েছে। কোনমতে মাথা নেড়ে বললো,

“হ্যাঁ”

“কিন্তু কেমন করে পালাবে? তিন চাঁদ তো পেরিয়ে গিয়েছে সেই কবে। চীফ আতলিন লোকজন নিয়ে রওনা দিয়েছেন, তাঁদের ফাঁকি দিয়ে তুমি পালাবে কোথায়! ঘোড়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছো? শুনতে পাচ্ছোনা কারা যেন কেঁদে কেঁদে কথা বলছে?”

মার্ক কোন জবাব দেয় না।

“ঘোড়ায় করে চীফ আতলিন আসছেন আমাকে ফিরিয়ে নিতে। আমার মায়ের কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছো তুমি, শুনতে পাচ্ছো ধরে আনা সব বাচ্চাদের মায়েদের কান্না। এই কান্নার দেয়াল পেরিয়ে কেমন করে পালাবে তুমি!”

মার্ক তবু চেষ্টা করলো। কয়েক পা দৌড়ে যেতেই দারুণ জোরে কোথায় যেন ধাক্কা খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো সবুজ ঘাসে। একবার তার বাম হাতটা নড়ে উঠলো কেবল, তারপর পড়ে রইলো নিশ্চল হয়ে।

অমিয়র মুখ হা হয়ে গিয়েছে। সে একটা ঢোক গিলে গোল গোল চোখে পুলপুর দিকে তাকিয়ে বললো,

“তুমি ম্যাজিক জানো, তাই না পুলপু!”

পুলপু অপূর্ব সুন্দর একটা হাসি দিয়ে মাথা নেড়ে বললো,

“কেন, তুমি জানোনা বুঝি?”

“নাহ, বাবাকে বলেছিলাম কিনে দিতে কিন্তু তিনি দেননি।”

“আরেকবার বলে দেখো। আর শোন, আমার কথা কাউকে বোলো না যেন অমিয়। চার্চের ফাদার জানতে পারলে আবার আমাকে ধরে নিয়ে যাবেন। তিন চাঁদ তো পেরিয়ে গিয়েছে সেই কবে। আমার বাবা নিশ্চয়ই খুব কাছাকাছি চলে এসেছেন। আমি কান পাতলেই তাঁর ঘোড়ার আওয়াজ শুনতে পাই, শুনতে পাই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন আমার মা।”

“আমি কাউকে বলবো না। এমনকি জর্ডিকেও না, প্রমিস।”

“এই জর্ডিটা আবার কে!”

“আছে, তোমাকে জানতে হবেনা।”

“আচ্ছা বোলোনা। তবে আমি কিন্তু মনের কথা জানতে পারি। তুমি তো দেখেছো।”

“তুমি খুব দুষ্টু পুলপু।”

“হি হি হি। সে যাই হোক। চল তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিই। এই ব্যাগটা সাথে করে নিয়ে যাও। মার্ককে নিয়ে ভেবোনা। পার্কের বাইরে যে ছোট্ট ব্রিজটা আছে তাঁর তলায় খুঁজলেই ওকে পাওয়া যাবে।”

পাইন হিকরির বুনো পথ ধরে হেঁটে চলেছে দুটি শিশু। কোত্থেকে যেন একটা দমকা বাতাস এসে নাড়িয়ে দিয়ে গেলো গাছের পাতা। অদ্ভুত একটা শব্দ হচ্ছে চারিদিকে, যেন একদল মানুষের গলার শব্দ। মানুষগুলো খুব খুশি আজ।

জঙ্গলটা ধীরে ধীরে পাতলা হয়ে আসছে, গাছের ফাঁক দিয়ে কিছু বাড়ি দেখা যাচ্ছে এখন। একটা বাড়ির জানালা চোখে পড়তেই চমকে উঠলো অমিয়। এটাতো ওদের সেই বাড়িটা! জানালায় মা দাঁড়িয়ে, মা’র শরীরটা থেকে থেকে কেঁপে উঠছে, মা’র মাথাটা বাবার কাঁধে এলানো। মা কাঁদছেন কেন? পুলপুর হাত ছাড়িয়ে অমিয় এক দৌড়ে বেরিয়ে এলো জঙ্গল থেকে। চিৎকার দিয়ে বললো,

“মা, মা আমি এসেছি।”

তারপর পেছন ফিরে পুলপুকে একবার হাত দেখিয়েই দিলো ছুট।

পরিশিষ্টঃ

অমিয়র এই অ্যাডভেঞ্চারের কথা খুব বেশি কেউ জানেনি। চোরাই হিরে সহ মার্ক গেজলারের ধরা পড়ার খবর পত্রিকায় ঘটা করে ছাপা হলেও সেখানে অমিয়র নাম ছিলোনা। এদেশের পত্রিকায় ছোটো বাচ্চাদের নাম পরিচয় ধরে খবর ছাপানোর রেওয়াজ নেই। পিপলস জুয়েলার্স অমিয়কে দারুণ একটা পুরস্কার দিয়েছে। কী পুরস্কার জানতে চাইলে বাবা বলেছেন টাকা, অনেক টাকা। বাবাটা একদম ভালো না। টাকাটা ওর ইউনিভার্সিটির জন্য তুলে রেখেছেন। ইউনিভার্সিটি যেতে যেতে অমিয় কত্ত বড় হয়ে যাবে! তখন কি আর গাদা গাদা ক্যান্ডি পেতে ভালো লাগবে ওর! অবশ্য মা বলেছে এবারের জন্মদিনে ওকে একটা আইপ্যাড কিনে দেবে। রিয়াড ব্যাকাস টু দা ইনফিনিটির সবগুলো ভিডিও দেখে ফেলবে সে।

প্রিন্সিপাল নর্টনের নতুন নাম হয়েছে মিস্টার বাস্কেটবল। কোন এক বিচিত্র কারণে স্কুলের বাস্কেটবল কোর্টে তাঁকে আর দেখা যায় না আজকাল।

পুলপুর কথা অমিয় কাউকে বলেনি। আরও কয়েক বছর পর অমিয় যখন গ্রেড নাইনে উঠবে তখন জানতে পারবে কী ভীষণ অন্যায়ই না করা হয়েছিলো ক্রি নেশনের মানুষগুলোর সাথে। মায়ের কোল, বাবার বুক, ভাইয়ের কাঁধ, বোনের আঁচল থেকে ছিনিয়ে আনা হয়েছিলো পুলপুর মতো বাচ্চাদের। রাখা হয়েছিলো রেসিডেন্সিয়াল স্কুল নামের একটা কুৎসিত জায়গায়। ওরা কোনোদিন ফিরে যেতে পারেনি। ক্যানাডার হর্তাকর্তারা মনে করতেন পুলপুরা অসভ্য, তাই গায়ের জোরে সভ্য বানাতে চেয়েছিলেন। কত যে শিশু মরে গিয়েছিলো অনাদরে! আর যারা বেঁচে আছে? তারা এখন অনেক বড়। তাদের মনের কোনে কেঁদে চলা শিশু মন আজও অপেক্ষা করে চীফ আতলিনের। তিনি আসবেন, তাঁর ঘোড়ার পায়ের শব্দ শোনা যায়।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাগ্যিস প্রকাশিত হয়নি। আরও কিছু কাজ করে নিতে পারলাম। দয়া করে পুরনোটা মুছে দেবেন।

--মোখলেস হোসেন।

মন মাঝি এর ছবি

খাইছে! এটা গল্প না উপন্যাস?! হাসি

****************************************

অতিথি লেখক এর ছবি

উপন্যাস না বলার পেছনে দুটো কারণ রয়েছে মন মাঝি। প্রথম কারণ ভয়, যদি লোকে উপন্যাসের সংজ্ঞা জানতে চায়! দ্বিতীয় কারণও ভয়। এই ফেসবুক স্ট্যাটাসের যুগে মানুষ গল্পই পড়তে চায় না, সেখানে উপন্যাস বলে সব সম্ভাবনা শেষ করে দেই আর কি! আপনি বরং সময় নিয়ে পড়ে জানান আপনার কী মনে হয়।

----মোখলেস হোসেন

সোহেল ইমাম এর ছবি

দারুন গল্প। গল্পের পেল্লাই সাইজ দেখে প্রথমটা ঘাবড়ে ছিলাম, পরে মনে হলো পড়ার পর যদি নিচে দেখি “চলবে” লেখা আর গল্পটা যদি কোন দিনই শেষ না হয়। জানটা চমকে গেলো। কিন্তু শেষ হলো নিজের না মোখলেস ভাইয়ের পিঠ চাপড়াবো তাই ভাবছি। চমৎকার হয়েছে গল্পটা। গুরু গুরু

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ সোহেল ইমাম। পুরোটা একসাথে পোস্ট করার একটা সমস্যা আছে। দীর্ঘ লেখা, তাও আবার অজ্ঞাতকুলশীল কারও, লোকে পড়তে চায় না। তবে একসাথে পোস্ট করে আমার ভালো লেগেছে।

----মোখলেস হোসেন।

দেবদ্যুতি এর ছবি

সারাদিন ধরে অফিস-বাসার ফাঁকে টুক টুক করে শেষ করলাম গল্পটা। প্রথমে ভাবলাম একরকম, পড়তে পড়তে দেখি আরে না, এ অন্য জিনিস! খুব ভালো হয়েছে গল্প। অমিয় নীলাদ্রি নামটা কী সুন্দর!

...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ দেবদ্যুতি। অমিয়কে পড়ে শুনিয়েছি। কিছু কিছু জায়গায় তীব্র আপত্তি জানালেও শেষমেশ বললো গল্পটা ওর ভালোই লেগেছে।

----
মোখলেস হোসেন

হাতুড়ি এর ছবি

খুব সুন্দর গল্প মোখলেস ভাই, সময় নিয়ে ধীরে ধীরে পড়লাম। আপনার "ফসল বিলাসী হাওয়া" কবে আসবে?

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ হাতুড়ি। ফসল বিলাসী হাওয়া লিখতে শুরু করেছি আবার। তবে সচলে দেবো কিনা বুঝতে পারছি না। অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে লেখাটা। ব্লগে বড় লেখা লোকে পড়ে না, যদি না সেটা বড় লেখকের হয়।

---মোখলেস হোসেন

হাতুড়ি এর ছবি

এটা কী বললেন মোখলেস ভাই-- সচলে দিবেন না? তাহলে পড়ব কীভাবে?

সাহিত্য জ্ঞান আমার খুবই কম, তবু্ও যেটুকু বুঝেছি, সেটা হল, আপনার ফসল বিলাসী হাওয়া একটি উপন্যাস, আর সাধারনত উপন্যাস বড়ই হয় (যদিও উপন্যাস ছোটোও হতে পারে বা গল্পও বড় হতে পারে)।
আবারও বলছি, সাহিত্য জ্ঞান আমার খুবই কম, (এমনকি অনভ্যাসের কারনে এখন দেখি বাংলা কিছু লিখতে গেলে প্রচুর বানানও ভুল করে ফেলি), তবুও বলি (ভেবে নিয়েন না আবার যে তেল দিচ্ছি), আপনার ফসল বিলাসী হাওয়া আমার কাছে অসাধারন লেগেছে। আপনি যেভাবে অপেক্ষা আর প্রতীক্ষার পার্থক্য করেছেন, বা এরকম অনেক কিছুই লিখেছেন, পড়তে গিয়ে এমন তন্ময় হয়ে গিয়েছিলাম, মনে হচ্ছিল যে আমি যেন উপন্যাসের একটা চরিত্র হয়ে উঠেছি, আমি যেন চোখ বন্ধ করে সব দেখছি।

জানি আপনি ব্যস্ত মানুষ, একটা লিখা হল একটা সৃষ্টি-- আর সৃষ্টিতে কষ্ট থাকবেই। তারপরেও অনুরোধ করি (নিজে যেহেতু লিখতে পারি না), উপন্যাসটা শেষ করুন আর সচলে দিন।
ভাল থাকবেন, শুভেচ্ছা নিবেন, আর অমিয়কে ভালবাসা জানাবেন।

অতিথি লেখক এর ছবি

সত্যি সত্যি দারুণ অনুপ্রাণিত বোধ করছি। আশা করি কিছুদিনের মধ্যেই লেখাটার বেশ বড়সড় একটা কিস্তি সচলে দিতে পারবো।

---মোখলেস হোসেন।

এক লহমা এর ছবি

উপভোগ করেছি ভাল মত।
ক্রীদের পরিবর্ত্তে পার্বত্য এলাকার হটিয়ে দেওয়া মানুষদের বসিয়ে নিলে, দেশজ পটভূমিতেই ভাল চলচ্চিত্র হয়ে ওঠার উপাদান রয়েছে এই গল্পে। সচলের চলচ্চিত্র সংপৃক্তরা নজর করলে বেশ হয়।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখার পরিসর দেখে বিরক্ত হয়ে যাননি বলে অনেক ধন্যবাদ এক লহমা। লিখতে ভালো লাগে বলেই লিখি। আপনারা পড়লে আরও ভালো লাগে।

--মোখলেস হোসেন

অতিথি লেখক এর ছবি

পাঠককে ধরে কোত্থেকে কোথায় নিয়ে যান ভাই, কিসের সাথে কি জোড়া দেন। পড়ি আর অবাক হই। অনেক শুভেচ্ছা।
-ইকরাম ফরিদ চৌধুরী হাততালি হাততালি হাততালি হাততালি

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ ইকরাম ফরিদ চৌধুরী। আপনি পড়েছেন জেনে খুশি হলাম।

---মোখলেস হোসেন

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।