রেনুর পুতুল: পর্ব ২

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ১৭/০৬/২০১৮ - ৯:৩২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


রেনুর পুতুল


[ধারাবাহিক উপন্যাস]
আকাশলীনা নিধি, নজরুল ইসলাম দেলগীর

[প্রথম পর্ব]

২.

রাতে যখন বাবা মা বাড়ি ফেরে, তখনও জয়ার মন খারাপ। খাওয়ার টেবিলেও মন খারাপ। বাবা বারবার জিজ্ঞেস করে, মা বারবার জিজ্ঞেস করে, কিন্তু জয়া কিছু বলতে পারে না। কয়েকবার ভেবেছে বাবাকে সে রেনুর গল্পটা বলবে। কিন্তু যতোবারই বলবে বলে ভেবেছে ততোবারই তার কান্না পেয়েছে, বলতে পারেনি। রাতে খেতেও পারেনি ঠিকমতো। এমনকি টিভি দেখতেও তার ইচ্ছে করছিলো না। তার সবচেয়ে প্রিয় দূরন্ত টিভির ‘অরিগামি মিলস‘, যেটা সে কক্ষণো মিস করে না, আজ তার সেটা দেখতেও ভালো লাগলো না। সে চুপ করে বিছানায় শুয়ে পড়লো, রেনুর প্রচ্ছদ আঁকা বইটা কোলে নিয়ে। মা বাবা অনেক চেষ্টা করেও তার মন ভালো করতে না পেরে হতাশ হয়ে ফিরে গেলো।

সে রাতেই রেনু আরেকবার তার স্বপ্নে এলো। আবারো তাকে অনুরোধ করলো তার পুতুলটা খুঁজে দিতে। সারারাত জয়ার ঘুম হলো না। পরদিন সারাদিনও তার কেমন মন খারাপ করে কাটলো। সারাদিন সে উদাস হয়ে জানালার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে আকাশের তাকিয়ে থাকে। মায়া খালা সারাদিন ঘ্যানঘ্যান করলো, মাকে ফোনে বললো ’আমাগো আফামনির দুক্ষিতরোগ হইছে, তারে একটা বিয়া দিয়া দেন’। শুনে জয়ার মেজাজ অনেক খারাপ হয়ে গেলো, তবু কিছু বলতে ইচ্ছে করলো না।

বিকেলে বাড়িতে এসে হাজির আত্মীয় স্বজনরা। কোনো উপলক্ষ নেই। জয়ার ধারণা তার মন খারাপ দেখেই বাবা গোপনে এই আয়োজন করেছে। সবাই এলে আনন্দ হয় যদি? বড়দের চেয়ে ছোটদেরকেই দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। এসেছে জয়ার চাচাতো ভাই রাসেল। কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে। যে খুব বড় বড় ভাব করে থাকে সারাক্ষণ। আর জয়াদেরকে পিচ্চি বলে গাল টিপে দেয়। আর নানান অ্যাডভেঞ্চারের গল্প বলে। জয়াদের ধারণা এগুলো সব চাপাবাজী।

আর এসেছে সাদিয়া আপু। জয়ার খুব প্রিয় আপু। আগামী বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। বয়স খুব বেশি না হলেও সাদিয়া ভীষণ দূরন্ত। ছোটবেলা থেকেই স্কাউটিং করে, দূর দূরান্তে ক্যাম্প করতে যায়। নাচ, গান, আবৃত্তি, লেখা, আঁকা সবকিছুতেই সাদিয়া সমান পারদর্শী। শুধু কি তাই? খেলাধূলাতেও। স্কুলের ক্রিড়া প্রতিযোগিতায় দৌড়ে সবসময় প্রথম হয়। উঁচুলাফ, দূরলাফ সবকিছুতে বিজয়ী। বড় হয়ে গেছে তবু পাড়ার ছেলেদের সাথে সমানতালে ফুটবল ক্রিকেট খেলে। একটুও ভয় পায়না কোনোকিছুকে। জুডো কারাতেও জানে, কদিন পরেই নাকি ব্ল্যাকবেল্ট পাবে। একবার ইশকুল থেকে বাড়ি ফিরছিলো মায়ের সাথে, রাস্তায় কয়েকটা ছেলে কী যেন একটা বাজে কথা বলেছিলো। সাদিয়া একাই তিন তিনটা ছেলেকে রাস্তায় ফেলে এমন পিটিয়েছিলো যে কয়েকদিন তাদের হাসপাতালে থাকতে হয়েছিলো। সেই থেকে সাদিয়ার নাম হয়ে গেছে ডাকু সাদিয়া। এতোকিছুর পরেও সাদিয়ার রান্নার হাতও চমৎকার, বাড়িতে অনুষ্ঠান থাকলে সাদিয়া নতুন কোনো একটা খাবার রান্না করবেই। ইউটিউব দেখে দেখে বিশ্বের বিভিন্ন আঞ্চলিক রান্না শেখে আর রাঁধে। সাদিয়ার ঘরে একটা আলমিরা, পুরোটা ভর্তি শুধু পুরষ্কার আর পুরষ্কার। এর মধ্যে লেখাপড়াতেও সে খুব ভালো, কখনো দ্বিতীয় হয়নি, সবসময় প্রথম। কিন্তু সাদিয়াকে কেউ পড়ার বই পড়তেও দেখেনা কখনো। সারাদিন মুখ গুঁজে গল্পের বই পড়ে। জয়া কিছুতেই ভেবে পায় না একটা মানুষ এতো গুণবতী কিভাবে হয়? অসহ্য! একটুও না পড়ে কিভাবে প্রথম হয় সব পরীক্ষায়? সাদিয়া আপুকে জয়ার ঠিক মানুষ মনে হয় না, মনে হয় যেন ভিনগ্রহ থেকে উড়ে আসা কোনো প্রাণী। জয়ার খুব সখ সাদিয়ার মতো হবে সে বড় হয়ে। কিন্তু বড়ই সে কেবল হয়ে যাচ্ছে, সাদিয়ার মতো কিছুই হতে পারছে না। এই নিয়ে তার কিঞ্চিৎ কষ্ট আছে, সাদিয়ার প্রতি হিংসাও আছে। কিন্তু সেই হিংসা ভালোবাসার। সাদিয়া আপুর জন্য জয়া মরে যেতেও রাজী আছে।

আর এসেছে সাদিয়ার ছোটভাই নৈঋত। চতুর্থ শ্রেণীতে। সাদিয়াকে নকল করতে করতে তার দিন কাটে। সাদিয়ার মতো সে নাচতে চায়, গাইতে চায়, জুডো কারাতে ব্ল্যাকবেল্ট হতে চায়, এমনকি রান্নাও করতে চায়। কিন্তু প্রতিদিনই মনে হয় এতো কষ্ট জীবন নষ্ট। কালকে থেকে আবার শুরু করবে। সেই কালকে আর কখনো আসে না।

তো এই ভাই-বোন বাহিনী মিলে অনেক চেষ্টা করতে লাগলো জয়ার মন ভালো করতে। জয়া নিজেও চাচ্ছে তার মনটা যাতে ভালো হয়। যেন সে সবার সঙ্গে আনন্দ করতে পারে, বিশেষ করে সাদিয়া আপুর সঙ্গে গল্প করতে পারে। কিন্তু কিছুতেই সে মনটাকে ভালো করতে পারছে না। রেনুর কথা ভেবে ভেবে মন শুধু আরো বেশি খারাপই হচ্ছে। ইশ্, তারই বয়সী একটা মেয়ে, একদল সৈনিক তাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারছে! ভাবতেই জয়ার শরীর কেঁপে ওঠে। আর এই ব্যাপারটা সাদিয়া খেয়াল করে। সে জয়ার হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় বারান্দায়। কাচের দরোজা আটকে দেয়। তারপর বলে ’কী হয়েছে ঠিক করে বল, কোনো ছেলে বাজে কথা বলেছে?’
জয়া না সূচক মাথা নাড়ে।
’কেউ তোর সাথে এমন কিছু করেছে যে তুই খুব কষ্ট পেয়েছিস?’
জয়া আবারো না সূচক মাথা নাড়ে।
’এমন কিছু হয়েছে যা কাউকে বলতে পারছিস না? ভয়ে? আমাকে বল, আমি তো তোর বড়আপু হলেও বন্ধু তাই না?’
জয়া বলে ’না আপু, তেমন কিছু না’।
এবার সাদিয়া দুষ্টুমি করে বলে ’হুম... তাহলে তোর কী হয়েছে ঠিক করে বল তো? সিনেমার নায়ক নায়িকাদের মতো ব্যাপার?’
’ধ্যাৎ আপু, কী যে বলো, না কিছু না’।
’তাহলে আমাকে বল, বল আপুনি কেন তোর মন খারাপ?’

তখন জয়া বলে রেনুর কথা। আর যেই না রেনুর নামটা বলেছে অমনি রাসেল ভাইয়ের কণ্ঠ শোনা যায় ’রেণু? ফুলের রেনু? পরাগ রেনু?’ তারা তাকিয়ে দেখে কখন রাসেল ভাইয়া আর নৈঋত দরোজা একটু ফাঁক করে গোপনে তাদের কথা শুনছিলো তা তারা খেয়াল করেনি। সাদিয়া রাসেল ভাইয়াকে মারতে যায়। কিন্তু কোনোভাবে তাড়াতে পারে না। জয়ার এসব দিকে খেয়াল নেই। তার শুধু রেনুর কথা মনে পড়ছে। সে রেনুর গল্পটা বলে।

তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে প্রায়। দিনের আলো নিভে যাচ্ছে। সেই গোধূলী আলোয় দেখা যায় বারান্দায় বসা বিভিন্ন বয়সী ৪জন বালক বালিকার প্রত্যেকের চোখে জল। এমনকি যে রাসেল ভাইয়া ভীষণ দুষ্টু আর সারাক্ষণ তাদের সঙ্গে ফাজলামি করে, তার চোখেও কখন যে জল গড়িয়েছে তা সে নিজেও টের পায়নি। রেনুর গল্প শুনে সবাই কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। কেউ কোনো কথা বলতে পারে না। এই নিরবতা ভাঙে নৈঋতের কান্নার শব্দে। হুট করে সে ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে। বলে ’পাকিস্তানীরা পচা’।

তারপর আবারো সব চুপচাপ। সাদিয়া এক কাঁধে নৈঋতের মাথা আরেক কাঁধে জয়ার মাথা নিয়ে বসে আছে। দূরে অস্তমিত সূর্যটার দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ সে বলে ওঠে ’চল, পুতুলটা ওকে খুঁজে দেই।’
হঠাৎ করে একথা শুনে সবাই চমকে তাকায়। কেউ যেন বুঝতে পারেনি সাদিয়া কী বলেছে। নৈঋতের কান্নাও থেমে গেছে। সাদিয়া আবার বলে ’চল, আমরা রেনুকে পুতুলটা খুঁজে দেই’।

পুতুলটা যে সত্যি সত্যি খুঁজে দেওয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে সে সম্ভাবনার কথাই আগে জয়ার মাথায় আসেনি। এবার সে অসম্ভবের দৃষ্টিতে তাকায় সাদিয়ার দিকে। রাসেলও হতবাক হয়ে গেছে। সাদিয়া সেই চোখের দৃষ্টি বুঝতে পারে। এবার আরো দৃঢ়কণ্ঠে বলে ’নিশ্চয়ই রেনুর গ্রাম খুঁজে বের করা যাবে, বীর মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি খুঁজে পেতেও অসুবিধা হবে না। আর গর্তটা নিশ্চয়ই বাড়ির আশেপাশেই আছে। হয়তো এখন আর গর্ত নেই, হয়তো সেখানে ঘর হয়েছে। তবু খুঁজে দেখতে অসুবিধে কোথায়?’
রাসেল বলে ’হুহ্, পাগলের সুখ মনে মনে। তিপ্পান্ন বচ্ছর আগের জিনিস এখন তারা মাটি খুঁইড়া বাইর করবো। হে হে হে হে’।
জয়া: অবশ্যই বের করবো। হাজার বছর আগে হারিয়ে যাওয়া সভ্যতা যদি খুঁজে বের করা যায় তাহলে রেনুর পুতুল খুঁজে পাওয়া যাবে না কেন? অবশ্যই যাবে। আর রাসেল ভাইয়া, মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিলো আজ থেকে ছেচল্লিশ বছর আগে, তিপ্পান্ন বছর আগে না।
রাসেল: ঐ হইলো, একই কথা...
জয়া: না একই কথা না। ইতিহাস আর বানানো গল্প এক না।
রাসেল: হইছে হইছে, ৪৬ হোক বা ৫৩, সেই পুতুল এখন আর পাওয়া যাবে? এটা কি গুপ্তধন? যদি গর্তের ভিতরে থাকেও, মাটির সাথে এতদিনে মিশে গেছে না?
জয়া: না, প্লাস্টিকের পুতুল। শত বছরেও মাটির সাথে মিশবে না।
রাসেল: তা হইলো, কিন্তু এতদিন কি আর সেটা আছে?
সাদিয়া: খেলতে নামার আগেই যদি ’জিততে তো পারবো না’ বলে খেলতেই না নামি, তাহলে হবে? চেষ্টা করতে দোষ কী? একটা অ্যাডভেঞ্চার হোক।
নৈঋত: হোক, একটা অ্যাডভেঞ্চার হোক।
রাসেল: হুহ্, বাটুল দি গ্রেট নৈঋত যাবে অ্যাডভেঞ্চারে। আর তোরা... খুব যে অ্যাডভেঞ্চার করছিস, বাড়ি থেকে বের হতে দেবে?
সাদিয়া: সে নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না।
রাসেল: আর দিলেই বা, একা একা তোরা দু’টো মেয়ে গ্রামে যাবি?
সাদিয়া: তোর অতটুকু সাহস না থাকতে পারে, আমাদের আছে। তাই না জয়া?
জয়া কিছু বলে না।
রাসেল: হুহ্, ভূতে ধরবে। সাপে কামড়াবে।
নৈঋত: ভূতকে আমি গলাটিপে মেরে ফেলবো। আর সাপকে আমি কামড়ে দেবো।
সাদিয়া: এই তো, আমাদের নৈঋত বীর থাকতে আর ভয় কিসের?
জয়া: আপু, আমরা কি সত্যিই যাবো? পুতুলটাকে উদ্ধার করতে পারবো?
সাদিয়া: পুতুল উদ্ধার করতে পারবো কি না তা জানি না, কিন্তু আমরা সেই খোঁজ করবো, আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। রেনুকে অন্তত এটুকু তো বলতে পারবো যে আমরা ওর পুতুলটা খুঁজে বের করতে চেষ্টা করেছিলাম?
রাসেল: তোদের মাথায় বুঝেছিস, ছিট আছে। এই পুতুল ধর তোরা উদ্ধার করলি, তাতে লাভটা কী হবে? রেনু না ফেনু...
এটুকু বলার সঙ্গে সঙ্গেই জয়া আর সাদিয়া রাসেলের দিকে কড়া চোখে তাকায়। আর তাদের এভাবে তাকাতে দেখে নৈঋত ভাবে তারও নিশ্চয়ই এভাবে তাকানো উচিত, নইলে যদি তাকে দল থেকে বের করে দেয়? তাই সেও ঐরকম কড়া চোখে রাসেল ভাইয়ার দিকে তাকায়। রাসেল তখন আমতা আমতা করে বলে ’না মানে বলছিলাম রেনু আরকি... পুতুল উদ্ধার হলেও রেনু তো আর তা পাবে না, সে তো কবেই মরে ফুট্টুস...’
সাদিয়া এবার বিরক্ত চোখে রাসেলের দিকে তাকায়। জয়া বলে ’আমার বয়সি একটা মেয়ে, ঠিক আমার বয়সি। সেই মেয়েটা পুতুল নিয়ে খেলতো সারাদিন। একদল সৈনিক এসে তাকে মেরে ফেললো, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে?’ বলে জয়া এবার হাউমাউ করে কেঁদে দেয়।

কাল থেকেই এই কান্নাটা তার বুকে চেপে ছিলো, কিন্তু শব্দ করে কাঁদতে পারছিলো না। এবার সাদিয়া আপুর বুকে মুখ লুকিয়ে কেঁদে ফেলে। সেই কান্নার শব্দ পেয়ে ছুটে আসে আদনান আর সোমা। উদ্বিগ্ন তারা। কিন্তু সাদিয়ার ইশারায় চুপ থাকে। সাদিয়ার প্রতি সব গুরুজনের প্রবল আস্থা আছে, তাই তারা সরে যায়।

কিছুক্ষণ কান্নাকাটির পর সিদ্ধান্ত হয় যে কালকেই তারা খুঁজতে বের হবে রেনুর পুতুল।


মন্তব্য

সোহেল ইমাম এর ছবি

বাহ্ !! এই পর্বটাও খুব সুন্দর লাগলো। চলুক লেখা। চলুক

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

আয়নামতি এর ছবি

চলুক
রেনুর পুতুলের খোঁজে জয়া সাদিয়া আমাদের কোথায় নিয়ে যায় দেখা যাক।

এক লহমা এর ছবি

সাথে আছি।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।