কার্বনের মায়াজাল - ২

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ১৬/০৬/২০১৯ - ১২:১৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কার্বনের মায়াজাল প্রবন্ধে গ্রাফিনের অভূতপূর্ব গুনাগুন আর অপার সম্ভাবনার কথা বর্ণনা করেছিলাম। স্বভাবতই প্রশ্ন আসতে পারে, ‘তাহলে গ্রাফিনে তৈরি বস্তুতে পৃথিবী কেন ছেয়ে যাচ্ছেনা?’ যৌক্তিক প্রশ্ন। উত্তর হল, এমন নিখুত আশ্চর্য বস্তু কি আর সহজে লাভ করা যায়! প্রাকৃতিকভাবে গ্রাফাইটে লুকিয়ে থাকা অসংখ্য গ্রাফিনস্তরকে আলাদাভাবে গবেষণাগারে তৈরি করা সম্ভব হলেও, সব গুনাগুন অক্ষুণ্ণ রেখে নিখুঁত ও অবিচ্ছিন্ন গ্রাফিন স্তর প্রস্তুত করা এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। গ্রাফিন তৈরির সময় প্রাকৃতিক কারনেই তাতে কিছু খুঁত বা ডিফেক্ট তৈরি হয়। খুঁত কিভাবে সৃষ্টি হয় সেটা বুঝতে হলে আগে কিভাবে গ্রাফিন প্রস্তুত করা হয় তা বর্ণনা করা প্রয়োজন।

বিশুদ্ধ গ্রাফিন প্রস্তুত করার কয়েকটা পদ্ধতি আছে। এর মাঝে ক্যামিকেল ভ্যাপার ডিপোজিশান একটা অন্যতম গ্রহনযোগ্য এবং জনপ্রিয় পদ্ধতি। এখনও পর্যন্ত দুইটি ধাতু, কপার আর নিকেল এর উপর ক্যামিকেল ভ্যাপার ডিপোজিশান এর মাধ্যমে সফল্ভাবে গ্রাফিন তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। কারন এরা দুইজনই গ্রাফিন তৈরির বিক্রিয়ায় নিয়ামক হিসাবে কাজ করে। স্বভাবগত কারনে কপার আর নিকেল এর উপর গ্রাফিন তৈরি হওয়ার ব্যাপারটা ভিন্ন ভিন্ন।

ক্যামিকেল ভ্যাপার ডিপোজিশান এ খুব উচ্চ তাপমাত্রায় (১০০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস) এবং নিম্ন চাপে (৫-৬ মিলিটর) কপারের উপর কার্বনের উৎস (যেকোন হাইড্রোকার্বন) গ্যাস প্রবাহিত করা হয়। উচ্চ তাপমাত্রায় হাইড্রোকার্বন ভেঙ্গে হাইড্রোজেন উড়ে যায় আর কার্বন কপারের মাঝে ব্যাপিত (ডিফিউস) হতে চায়। কপার আবার কার্বন কে খুব বেশি পছন্দ করেনা। তাই বাইরে দাড় করিয়ে রাখে, ভিতরে ঢুকতে দেয়না। কার্বন বাইরে থেকেই কপারের উপর গ্রাফিনের স্তর তৈরি করে। আস্তে আস্তে কপারের উন্মুক্ত শরীর গ্রাফিনের চাদরে ঢেকে যায়। যত কপার ঢেকে যেতে থাকে তত সে বিক্রিয়া সম্পন্ন হতে কম সাহায্য করতে পারে (নিয়ামক হিসাবে কাজ করার ক্ষমতা কমতে থাকে), এবং একসময় বিক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। ফলে কপারের উপর ১-২ স্তর গ্রাফিন সৃষ্টি হয়। গ্রাফিন রান্না শেষ। এই পুরো প্রক্রিয়াটা হয় বৈদ্যুতিক চুল্লির ভিতরে আর নিষ্ক্রিয় পরিবেশে (নাহলে উচ্চ তাপমাত্রায় কপারের অক্সাইড গঠিত হবার সম্ভবনা থাকে)। সবশেষে চুল্লিটাকে কক্ষতাপমাত্রায় ঠান্ডা করে গ্রাফিনের আবরন দেয়া ধাতব টুকরাটা বের করে আনা হয়।

চিত্রঃ ক্যামিকেল ভ্যাপার ডিপোজিশান পদ্ধতিতে গ্রাফিন তৈরি হচ্ছে।

এদিকে নিকেলের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা উল্টো। নিকেল কার্বনের বন্ধু। উচ্চ তাপমাত্রায় হাইড্রোকার্বন ভেঙ্গে কার্বন নিকেলের ভিতর ব্যাপিত হতে চাইলে, নিকেল দুয়ার খুলে দেয়। ফলে হুড়মুড় করে কার্বন ভিতরে ঢুকে যায়। পরে যখন ঠান্ডা করা হয় তখন নিকেল ভিতরে ঢুকে যাওয়া কার্বনকে বাইরের পৃষ্ঠে বের করে দেয়। হুড়মুড় করে ঢূকে পরা কার্বন হুড়মুড় করে বেরিয়ে যায় আর উপরের পৃষ্ঠে ৫-৮ স্তর গ্রাফিন তৈরি করে। গ্রাফিন এতই পাতলা যে ৫-৮ স্তরও খালি চোখে দেখা যায়না। সহজ ভাষায় এই হল মোটামুটিভাবে গ্রাফিন তৈরির গল্প। কপার/নিকেল ছাড়া অন্যান্য ধাতুর উপর গ্রাফিন তৈরি করতে গেলে নানা যন্ত্রনা দেখা দেয়। কেউ কেউ অত উচ্চ তাপমাত্রা সহ্য করতে পারেনা (যেমনঃ ম্যাগনেসিয়াম), কেউ কেউ নিয়ামক হিসাবে কাজই করতে চায়না, কেউ কেউ আবার কার্বনকে খুব বেশি ভালোবাসে (যেমনঃ লোহা)। তাই এত বেশি কার্বন ভিতরে ব্যাপিত হয় যে ঠান্ডা হওয়ার সময় তা বেরিয়ে আসে আর গ্রাফিনের বদলে মোটা কার্বনের ছাইয়ের মত স্তর তৈরি করে ফেলে। তাই প্রথমে কপার বা নিকেলে গ্রাফিন তৈরি করা হয়, তারপর কপার বা নিকেলকে অন্য রাসায়নিকের সাথে বিক্রিয়া করিয়ে দ্রবীভূত করে ফেলা হয় আর গ্রাফিন স্তরটাকে আলতো করে উঠিয়ে যেখানে চাই সেখানে ব্যাবহার করা হয়।

এবার আসা যাক গ্রাফিনে খুঁত কোথা থেকে আসে। আগের প্রবন্ধে দেখানো হয়েছে যে গ্রাফিনের গঠন ষড়ভূজাকৃতির। গ্রাফিন তৈরির সময় আপনা আপনি কিছু খুঁত সৃষ্টি হয় যেমন কোন কোন জায়গায় পঞ্চভূজ কিংবা সপ্তভূজ হয়ে যায়। একে বলে পয়েন্ট ডিফেক্ট।

ধরা যাক কপারের উপর গ্রাফিন তৈরি হচ্ছে। এই কপারের উপরের স্তরে যেইসব জায়গায় শক্তির আধিক্য (হাই এনার্জি ইন্টেন্সিটি সাইট) বেশি গ্রাফিন সেখান থেকে তৈরি হয়ে আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে। ফলে গ্রাফিনের নিউক্লিয়াস একসাথে অনেক জায়গা থেকে সৃষ্টি হওয়া শুরু হয়। কল্পনা করুন যে ৫০-৬০ টা গ্রাফিনের দ্বীপ তৈরি হচ্ছে এবং দ্বীপগুলি আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে। একসময় এসে এক দ্বীপের কিনারা আরেক দ্বীপের কিনারার সাথে মিশে যায়। ফলে গ্রাফিন দ্বীপের সীমারেখা (গ্রেইন বাউন্ডারি) তৈরি হয়। এই সীমারেখা গুলিও গ্রাফিনের খুঁত।

গ্রাফিন যেই ধাতুর উপর সৃষ্টি হতে থাকে তার তাপ প্রসারন সহগ আর গ্রাফিনের তাপ প্রসারণ সহগ সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই ভিন্নতার কারনে গ্রাফিন কুঁচকে যায়। ধরুন একটা কম্বলের উপর চাদর দিয়ে ঢাকা। কম্বলটা কোন কারনে প্রসারিত হয়ে গেল। আর চাদরটা একই রকম থাকল কিংবা সংকুচিত হয়ে গেল। তাহলে চাদরের মাঝে ভাঁজ পরাটাই তো স্বাভাবিক। এই ভাঁজগুলিও গ্রাফিনের খুঁত।

এই খুঁতগুলি যত বেশি হয়, গ্রাফিনের আদর্শ ধর্মগুলির বিচ্যুতি দেখা দেয়। কোন কোন ক্ষেত্রে এমনও হয় যে উল্টো যে উপকারের আশায় গ্রাফিনের আবরণ দেয়া হয়েছিল, উল্টো অপকার হয়। তাই এই খুঁতগুলো নিয়ন্ত্রনের জন্য গবেষকরা কাজ করে যাচ্ছেন। অনেকটা সফলও হয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ ২০১১ থেকে ২০১২ সালের প্রথম দিকের গ্রাফিন নিয়ে প্রকাশিত বিজ্ঞান পত্রিকাগুলি ঘাটলে দেখা যায় মরিচারোধে গ্রাফিনের আবরণ কোন কাজের জিনিস না। সুতরাং মরিচারোধে গ্রাফিনের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। একই বছর (২০১২) মাঝামাঝি সময়ে প্রকাশিত প্রবন্ধে দেখানো হয়েছে গ্রাফিনের আবরণ প্রায় ১০০ গুন মরিচা প্রতিরোধী। খুঁত দূর করার একটা উপায় হল ক্যামিকেল ভ্যাপার ডিপোজিশান এর তাপমাত্রা, চাপ হাইড্রোকার্বন এর প্রবাহমাত্রা কম বেশি করে সবচেয়ে উপযোগী অবস্থা বের করা। আরও অনেক উপায় আছে এবং গবেষণা হচ্ছে, যা সময়সাপেক্ষ। তাই খুঁত হীন গ্রাফিন তৈরিটাই একটা বড় চ্যালেঞ্জ। যেইদিন এই সমস্যা দূর হয়ে যাবে, সেইদিন হয়ত এই প্রযুক্তি অনেক দ্রুত এগিয়ে যাবে। অনিশ্চিত কিছুতে কেউ টাকা ঢালতে চায়না কিনা! নিশ্চিত সফলতার গন্ধ পেলে ইলেক্ট্রনিক্স কোম্পানিগুলি তখন ঝাপিয়ে পড়বে। আজকে যেসব বিজ্ঞানীরা গ্রাফিনের নিন্দা করছেন, তারাই হয়ত একদিন গ্রাফিনের আবরণ দেয়া শার্ট পরে বসে থাকবেন। যেই শার্টের যেকোন যায়গায় হয়ত ছুঁয়ে দিলে মোবাইলের পর্দা ভেসে উঠবে। সেই পর্দা থেকে উনি টুইট করবেন, “আগেই বলেছিলাম, গ্রাফিনের মত জিনিস হয়না!”

-সৌখিন


মন্তব্য

এক লহমা এর ছবি

“আগেই বলেছিলাম, গ্রাফিনের মত জিনিস হয়না!” চলুক হাসি

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক

অবনীল এর ছবি

ভালো লেগেছে। আগের পর্বের লিংকটা দিয়ে দিলে ভালো হতো।

___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ। সেটা কিভাবে দেয়া যায় প্রক্রিয়াটা একটু যদি বলতেন ভালো হত।

সৌখিন  এর ছবি

খুজে পেয়েছি

অতিথি লেখক এর ছবি

কেমিক্যাল ভ্যাপার ডিপোজিশন হয়তো গবেষণাপর্যায়ে মোটামুটি কার্যকর পদ্ধতি হতে পারে, কিন্তু বৃহৎ বাণিজ্যিক উৎপাদনের জন্য পদ্ধতিটিকে মোটেও কাজের জিনিস বলে মনে হচ্ছে না। পয়েন্ট ডিফেক্ট, গ্রেইন বাউন্ডারি সৃষ্টি, Rugae তৈরি হওয়া - এর কোনটাই এই পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। নিখুঁত গ্রাফিন তৈরির গবেষণাটি হয়তো এভাবে না করে অন্য এক বা একাধিক দৃষ্টিকোন থেকে বিবেচনা করা প্রয়োজন। হয়তো খুব সহজ একটা সমাধান আমাদের বিবেচনায় এখনো আসছে না। তবে চেষ্টা চালিয়ে গেলে কোন কিছুই অসম্ভব না। কে জানে একদিন হয়তো কোন মেশিনের একদিক দিয়ে গ্রাফাইট ঢোকালে অন্য দিক দিয়ে গ্রাফিনের ফাইন চাদর বের হয়ে আসবে।

আরিফ

সৌখিন  এর ছবি

ক্যামিকেল ভ্যাপার ডিপোজিশানেও খুঁত নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব। ওইটা নিয়ে আরেকটা পর্ব লিখতে হবে। আপাতত একটু ছোট উদাহরন দেই।

১। গ্রাফিন তৈরি শুরু হয় কপার/নিকেলের গ্রেইন বাউন্ডারি থেকে। তাই হাইড্রোকারবন প্রবাহের আগে যদি খানিকক্ষণ এনিলিং করে নেয়া হয়, তাহলে কপারের গ্রেইন বড় হয়ে বাউন্ডারির সংখ্যা কমে যায়। তখন উপরে গ্রফিন তৈরির সময় আগের চেয়ে কম সংখ্যক স্থান থেকে গ্রাফিন তৈরি শুরু হয়, ফলে গ্রাফিনের বাউন্ডারিও কম হবে।

২। নিষ্ক্রিয় পরিবেশ সৃষ্টির সময় হাইড্রোজেন আর আরগন মিক্সচারের পরিবর্তে খালি আরগন প্রবাহিত করলে ভাঁজ কম পরে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।