একরাতে আমি এবং...

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ২০/১০/২০০৭ - ২:১৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ইদানিং বেশ গরম পড়েছে। অবশ্য পড়বেই বা না কেন? জুন মাসে একটু গরম না পড়লে কী আর চলে। স্কুলে থাকতে সেই বছরের শুরুতেই অপেক্ষায় থাকতাম কবে আসবে জুন মাস আর মিলবে গ্রীষ্মকালীন দীর্ঘ ছুটি। আর ছুটি মানেইতো খেলাধূলার অফুরন্ত সুযোগ। সোডিয়াম বাতির বর্ণচোরা আলোয় অনেকটা অনাহুতের মতই মনের পর্দায় ভেসে ওঠা শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিকে আজ আর প্রশ্রয় দিতে ইচ্ছে হলো না। নস্টালজিক হতে সব সময়তো আর ভালো লাগে না, তাই ভাবনার গতিকে অন্য আর কোন‌ দিকে গলিয়ে দেওয়া যায় তাই ভাবছি। বাতাস না থাকায় পথপার্শ্বস্থ দেবদারু গাছের পাতাগুলো কেমন যেন স্থির হয়ে আছে। দশ-পনের গজ দূরেই সুদীপদা'র পোষা বিল্টু - যাকে অনেকের দেখাদেখি আমিও বেশ কয়েকদিন আদর করে পাউরুটি কিনে খাইয়েছিলাম - সে আর তার আরেক সঙ্গী মিলে টানা সুরে প্রচণ্ড শব্দে আর্তনাদ করছে আমার আসার দিকেই মুখ করে। কোন‌ কারণে ভেতরটা হঠাৎ অস্থির হয়ে উঠছে তা নিজের কাছেই স্পষ্ট নয়। দ্রুত পায়ে কয়েক মুহূর্তেই ওদের একেবারে কাছাকাছি চলে এলাম। ইতোমধ্যেই ওদের আরো সঙ্গী-সাথী যোগ দেওয়ার ফলে সংখ্যা বেড়ে দুই থেকে দাঁড়ালো পাঁচ-এ। কাছ ঘেঁষে দাঁড়াতেই এবার বিল্টুরা সবাই গলা ছেড়ে অনবরত একই রকম টানা স্বরে সুর মেলালো। ওদের স্বরের তীব্রতা থেকে বাঁচবার জন্য দু'হাতে কান চেপে ধরলাম। আমি যতই চেপে ধরছি আর ওরা ততই ওদের গলার স্কেল আরো উঁচুতে উঠাতে লাগলো। বিষয়টাকে একটু বোঝার জন্য ওদের আর্তনাদকে উপেক্ষা করে হাত সরিয়ে নিলাম। ডাকার কোন বিরাম না টেনেই বিল্টুর নেতৃত্বে ওরা এগুতে লাগলো ডান দিকের কৃষ্ণচূড়ার পাশ দিয়ে। পিছু নিলাম ওদের। বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর লেকের একপাড়ে একটা হিজল গাছের গোড়ায় এসে ওরা থামল। আমিও। বুঝতে পারছি না এখানে কী এমন আছে যে ওরা আমাকে পথ দেখিয়ে দেখিয়ে এতোদূর অবধি নিয়ে এলো বা আমি নিজেই চলে এলাম। ভাবনার রেশ শেষ না হতেই হঠাৎ কোত্থেকে যেন তীব্র নীলচে আলোর ঝলকানি পড়ল চোখে। আলোর ঝলকানিতে চারপাশের সব কিছুই যেন চোখের সামনে মুহূর্তেই পাল্টে গেল। মাত্র কয়েক সেকেন্ড আগে লেকের পাড়ে এসে থামলেও এখন মনে হলো আমি দাঁড়িয়ে আছি গাছ-গাছালি ভরা কোন এক পাহাড়ী জনপদে। দৃশ্যপটের এমন আকস্মিক পরিবর্তনে শরীর দিয়ে ঘাম বের হতে লাগল। এই অদ্ভুত আলোকময় পরিবেশে আসার পরপরই কোন এক রহস্যজনক কারণে বিল্টুদের লম্বা-টানা সুরের আর্তনাদ একেবারেই থেমে গেছে। ওরা এখন সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ানো-যেন কাউকে অভ্যর্থণা জানানোর জন্য অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করছে। কিছুক্ষণ পর সত্যি সত্যিই ওদের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে পর পিনন পড়া উজ্জ্বল বর্ণা মাঝারি গড়নের এক নারী এসে হাজির হলেন আমার থেকে মাত্র কয়েক হাত দূরে। তার মঙ্গোলয়েড চেহারার দু'চোখের দিকে তাকাতেই বুকের ভেতরটা কেমন যেন একটা মোচড় দিয়ে উঠল। এমন প্রত্যয়ী ও তেজস্বী চাহনী আগে খুব একটা দেখিনি। আমি কয়েক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। নারীটিও কোন কথা না বলে স্থির দাঁড়িয়ে, কিন্তু তার চোখের চাহনি মোটেও স্থির নয়, কেমন এক অস্থিরতায় অবিরাম কী যেন বলে যাচ্ছে যার কোন অর্থই আমি ঠিকঠাক পাঠ করতে পারছি না। তার অমন চাহনির সামনে নিজেকে কেমন অসহায় আর অপরাধী-অপরাধী মনে হচ্ছে। যাকে এর আগে কোথাও দেখেছি বলেও আমি নিশ্চিত নই আর অন্যায় করাতো দূরের কথা, সেরকম একজন মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে তাহলে আমার এমন কেন লাগছে তা বোধগম্য হচ্ছে না। কয়েক মিনিটের স্থিরতার পর হুট করেই নীলচে আলোর পতন ঘটলো। এবার অন্ধকার! ঘন কালো অন্ধকার! অন্ধকারে দৃষ্টি শক্তি কিছুটা ধাতস্থ হয়ে এলে আমি খুঁজতে লাগলাম পিনন পড়া নারী, বিল্টু আর তার সাথীদের। কিন্তু নেই, কোত্থাও কেউ নেই। আচমকা এমন পরিবর্তনে কিঞ্চিত ভয় যে পেলাম না তা নয়। বাতাসটা এখন মনে হচ্ছে একেবারেই যেন থেমে গেছে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছি আর মনে মনে সাহস ধরে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছি এর শেষ দেখার জন্য। অন্ধকারের মধ্যে আবারো বিল্টু আর তার সাথীদের সেই টানা সুরের আর্তনাদ কানে এলো। চোখ ফেরালাম চারিদিকে, না, ওদের দেখতে পেলাম না। অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ খেয়াল করি টানা সুরের আর্তনাদকে আস্তে আস্তে ফিঁকে করে দিয়ে অন্য আরো কিসের শব্দ যেন শৃঙ্খলিত ছন্দ মেনে মেনে দ্রুতগতিতে নিকট থেকে নিকটবর্তী হচ্ছে। শব্দটা কিসের তা দ্রুতই চিনতে পারলাম। মনে হলো আমার থেকে কয়েক হাত দূরে এসে শৃঙ্খলিত ছন্দের শব্দটা তার গন্তব্য খুঁজে পেয়ে থেমে পড়ল। দু'হাতে নিজের চোখ দুটো কচলে নিলাম যদি কিছু দেখা যায় এই আশায়। কিন্তু না কিছুই দেখা যাচ্ছে না, তবে বুঝতে পারছি কিছু একটা ঘটতে চলেছে। কতগুলো কর্কশ কণ্ঠের নির্দেশ এবং তারপরই ঘরের দরজা ভেঙ্গে ফেলার মতন আওয়াজ। প্রলয় শব্দের বিপরীতে ভিনভাষায় ভয়ার্ত কন্ঠের কিছু অস্ফুট কথা! সাথে টানা হেঁচড়ার শব্দ! এরকম চললো আরো কিছুক্ষণ। অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না বলে কান দুটো আপনা থেকেই বেশ সজাগ হয়ে উঠেছে। টানাহেঁচড়ার শব্দের পরপরই অন্ধকারে হুট করে একটা টর্চের আলো জ্বলেই সাথে সাথে আবার নিভে গেলো। আর এটা এতোই দ্রুততার সাথে ঘটলো যে টর্চের আলোয় আমি কেবলমাত্র জলপাই রঙের কিছু আর ভয়ার্ত দুটো নিষ্পাপ চোখ দেখতে পেলাম। ভয়ার্ত দু'টো চোখ আর জলপাই রঙ! আর কিছুই দেখতে পেলাম না। আর কিছুই না। টর্চের আলো! জলপাই রঙ! ভয়ার্ত চাহনি! যেন মুহূর্তেই আঁধারে মিলিয়ে গেলো।

কিছুক্ষণ পরে আবারো টানাহেঁচড়ার শব্দ আর মেয়েলি কন্ঠের 'দাদা!... দাদা!...' আর্তচিৎকার ! এবার কোন আলো নেই, শুধুই অন্ধকার! কয়েক মুহূর্ত পরেই অন্ধকার, টানাহেঁচড়া, চিৎকার সমস্ত কিছুকে বিদীর্ণ করে অবিরত গুলির আওয়াজ। গুলি মনে হচ্ছে আমার দু'কানের পাশ দিয়ে অবিরাম ছুটে ছুটে যাচ্ছে। হঠাৎ পানিতে কারো ঝাপিয়ে পড়ার শব্দ! আর সাথে সাথেই দ্বিগুণ বেগে গুলির শব্দ ! প্রচন্ড ভয়ে আমি মাটিতে বসে পড়লাম। দু'হাত দিয়ে কান সজোরে চেপে ধরেছি। গুলির শব্দ যেন থামতেই চাইছে না। সমস্ত কিছুকে ঝাঁঝড়া করে দিয়ে গুলি চলছে, চলছেই, চলছেই ...। ভয়ার্ত চিৎকার আর গুলির শব্দে আমি আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলাম না। বুকের ভেতর আটকে রাখা কান্না বেরিয়ে এলো প্রচণ্ড ঠমকে। আমিও চিৎকার করছি! আর অন্ধকারের দিকে ছুটছি! কিছুই নাগালে পাচ্ছি না তবুও ছুটছি, 'দাদা!...দাদা!...' চিৎকার যেদিক থেকে আসছে সেদিকে, প্রাণপণে ছুটছি যেদিক থেকে গুলির শব্দ আসছে সেদিকেই ...!

'তোমাকে বাঁচাতে পারিনি...বাঁচতে দেইনি...বাঁচাতে পারিনি...তোমাকে বাঁচতে দেইনি...ক্ষমা করো আমাদের...।'

'বাবাজি এইহানে হুইয়া হুইয়া বিড়বিড় কইরা কী সব কইতাছেন?'

মফিজ চাচার হাতের উষ্ণ স্পর্শ আর কথা শুনে আমি চোখ মেলে তাকালাম। দেখি আমি চাচার চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে শোয়া আর চাচা বসা আমার মাথার পাশে । শরীরে প্রচন্ড ক্লান্তিবোধ নিয়ে চাচাকে শুধু জিজ্ঞেস করলাম-

'চাচা আজ কত তারিখ ? জুন মাসের ১২ তারিখ তো ?'

'হ, তয় কী অইছে ?'

চাচার কথার কোন উত্তর না দিয়েই আমি উঠে আস্তে আস্তে পা বাড়ালাম- আমার গন্তব্যের দিকে।

জুয়েল বিন জহির
নারায়ণগঞ্জ।


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।