একজন কবির চলে যাওয়া ।। উচচারনগুলো বড় বেশী শোকের

হাসান মোরশেদ এর ছবি
লিখেছেন হাসান মোরশেদ (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৫/১১/২০০৭ - ৭:৫১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

.
কবি মমিনুল মউজদিন মারা গেছেন ।
সকাল বেলা ইনবক্সে এক বন্ধুর পাঠানো মেইলে জানলাম । বিস্তারিত কিছু নয় । ছোট্ট মেইল । মউজদিন মারা গেছেন সড়ক দুর্ঘটনায়,সপরিবারে ।
অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে গেলে চিরতরে,বেঁচে যেতাম । বেঁচে উঠা হয়না আমার । স্বজনেরা,কাছের মানুষ,দূরের মানুষেরা যাদের কাছের বলে জানতাম তাদের মৃত্যুর খবর শুনতে শুনতে,মরতে মরতে বেঁচে আছি ।
২০০৪ এর এক বিষন্ন বিকেলে যেদিন দেশ ছাড়ি,সিলেট এয়ারপোর্ট থেকে জিএমজির ছোট্ট বিমানে চড়েছি ঢাকার পথে । পার্শ্বযাত্রীর সাথে পরিচয় হয়,তিনি ও লন্ডনগামী । মৌলভীবাজার বাড়ী জেনে কথা বাড়াই । নিপু ভাইকে চেনেন কিনা জিজ্ঞেস করি । গল্পকার,কবি আকমল হোসেন নিপুকে চেনেন সেই প্রবাসী ভদ্রলোক । তার কাছেই শুনি আমার প্রবাস যাত্রার প্রথম মৃত্যু সংবাদ । নিপু ভাইয়ের স্ত্রী সবুজ ভাবী মারা গেছেন সেইদিন ।
যেনো সেইদিন থেকে মৃত্যু সংবাদ আমার পিছু ছাড়েনা । চলে গেলো তরুন শিল্পী শাহ আলম,চলে গেলো আড্ডার শেকড় স্বপন,গেলেন কিশওয়ার,গেলেন জুয়েল ভাই ।
গেলেন মউজদিন । কবি মমিনুল মউজদিন ।

কেউ চেনেন হাছনরাজার পৌপুত্র হিসেবে,কেউ শহর সুনামগঞ্জের জোছনাপ্রিয় শহরপিতা হিসেবে,কেউ শুধু কবি-কবি মউজদিন ।
তার নাম শুনেছি ছোটবেলাতেই । বড়মামার বন্ধু । দেখা হয়নি । কবি মউজদিনের সাথে প্রথম দেখা দেশের বাইরে-মেঘ পাহাড়ের দেশ শিলং এ । ২০০০ সালে শিলং এ পড়ি । দেশ থেকে কেউ মেঘালয়,চেরাপুঞ্জি দেখতে গেলে উপযাজক হয়ে গাইড হই । আড্ডা মারি পম্পাদির বাসায় । পম্পাদি সুনামগঞ্জের মেয়ে,বিয়ে হয়েছে শিলং এ । সুনামগঞ্জের হাওড়ের মতোই আদিগন্ত প্রানময়ী । শিলং এ পড়তে যাওয়া সকল সিলেটী-নন সিলেটী ছেলেমেয়েদের ঠিকানা পম্পাদি ।
এক বিকেলে তার ফোন । দেশ থেকে অথিথি এসেছেন । অতিথি দর্শনে গিয়ে কবিকে দেখা । পরিচয় দেয়া । তার কবিতা পাঠ ।পম্পাদির গান । পরদিন শহর শিলং,চেরাপুঞ্জি বেড়াতে যাওয়া । আমি সহযাত্রী । মেঘপাহাড়ের বুক চিরে চিরে যেতে যেতে সেইদিন সারাদিন তার সাথে টুক টাক কথাবার্তা,তর্ক । কবিতার সাথে আমার তখন জোরজবরদস্তি । সবাই কবিতা লিখে,আমি লিখবোনা । কবিদের আমি উপহাস করি । কোন কবি যেনো বলেছিলেন যারা কবিতা লিখতে জানেনা তারা গদ্য লিখে । আমি বলি তার উল্টোটা । গদ্য লিখার সাহস যাদের নেই তারাই কবিতা লিখে নিজেকে আড়াল করে । কবি মউজদিন হাসেন । স্বভাবসুলভ নীচু কন্ঠে বলেনঃ কবিতা আসবে দিন ফেরাতে পারবেনা!

তার সাথে শেষ দেখা আরো বছর দুয়েক পরে । ভারত থেকে ফিরে চাকরীতে ঢুকেছি । তখন তথ্যপ্রযুক্তির জোরালো হাওয়া । শহর সুনামগঞ্জে কি এক সেমিনার তথ্যপ্রযুক্তির । মউজদিন প্রধান অতিথি । আমি ও আমন্ত্রিত অতিথি । মঞ্চে বসে কথা হলো টুকটাক । সেমিনার শেষে তাঁর বাড়ীতে যাওয়ার জন্য বললেন । সময় ছিলোনা হাতে । সেখান থেকেই বিদায় নেয়া ।

হায়,একটা মানুষ । আর কোনদিন দেখা হবেনা ।
হায়,কবি । আর কোনদিন কবিতা লেখা হবেনা ।


(লীলেন ভাই,আহমেদুর রশীদ,নজমুল আলবাব-আপনাদের কারো কাছে মউজদিনের কবিতা থাকলে,পোষ্ট করবেন কি?)


মন্তব্য

মুজিব মেহদী এর ছবি

'তোমার চেতনা দ্রোহী
ভ্রাতৃদ্রোহ দেশদ্রোহ মিশে আছে
তোমার লোহিত কণিকায়।
আজন্ম অগ্নি সাথে তোমার বসবাস
সংঘাত তোমার যেন নিত্য সহচর
অকস্মাৎ ঝাঁপ দাও পথের প্লাবনে
জোয়ারে উদ্দাম আর ভাটার বিষণ্ন
জলে জলে তোলো ঢেউ পরক্ষণে আত্মঘাতী
ডুব দাও জলের ভিতর
জলপ্রিয় হে যুবক, তোমার ভিতরে এত
ভাঙনের পতনের শব্দ শুনি কেন!'

অংশত কেমন মানুষ তুমি, মমিনুল মউজদীন (শুভেন্দু ইমাম সম্পাদিত 'পাঠকৃতি', জানুয়ারি ২০০০ থেকে)

কবির এমনতর মৃত্যু আমি চাই না, চাই না কোনো মানুষের।

...................................................................
অসংখ্য 'নেই'-এর ভিড় ঠেলে
জ্বলজ্যান্ত 'আছে' খুঁজে পাওয়া হলো আসল ফকিরি

... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
কচুরিপানার নিচে জেগে থাকে ক্রন্দনশীলা সব নদী

হাসান মোরশেদ এর ছবি

কৃতজ্ঞতা মুজিব মেহেদী ।
আরো থাকলে শেয়ার করুন ।
-----------------------------------------
'প্রিয়তম পাতাগুলো ঝরে যাবে মনে ও রাখবেনা
আমি কে ছিলাম,কি ছিলাম--কেন আমি
সংসারী না হয়ে খুব রাগ করে হয়েছি সন্ন্যাসী
হয়েছি হিরন দাহ,হয়েছি বিজন ব্যথা,হয়েছি আগুন'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

নজমুল আলবাব এর ছবি

এখন অফিসে। নতুন অফিসে কোন বই আনা হয়নি। রাতে বাসা থেকে চেস্টা করব। তোমার এই লেখাটা পড়ার আগেই আমি একটা লিখে ফেলেছিলাম। যথারিতি কাঠখোট্টা। পোস্ট করার পর আর ভাল লাগছেনা।

ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

বিবাগিনী এর ছবি

‌‌মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল।আল্লাহ উনাদের সবার আত্নাকে শান্তি দিন।ভাললাগে না কিছু।
::একাকিত্বের বিলাস আমার অনেকদিনের সাধ::

‌‌::একাকিত্বের বিলাস আমার অনেকদিনের সাধ::

তীরন্দাজ এর ছবি

ওনার নাম শুনিনি। বিদেশের জীবনের এটাই সমস্যা

ওনার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।

**********************************
যাহা বলিব সত্য বলিব

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

অমিত আহমেদ এর ছবি

কবির জন্য আমার শ্রদ্ধা!


ব্লগস্পট | ফেসবুক | ইমেইল

রেজওয়ান এর ছবি

কি আশ্চর্য এই মানুষটাকে আগে চিনতাম না। আজকে এটি পড়েই মন খারাপ হলো। আরও জানলাম:

"পূর্নিমার রাতে একটা শহরে চাদ দেখার উতসব হত, সারা শহরের বাতিগুলো নিভে যেত, এমনকি স্ট্রীটলাইটগুলোও, তারপর ওই শহরের চেয়ারম্যান সবাইকে নিয়ে চাদ দেখতেন। এটা কোন উপন্যাসের কাহিনী নয়, বাস্তব।
কতজনের স্বাদ ছিল এক পুর্নিমা রাতে সুনামগন্জ গিয়ে চাদের আলো দেখার,আমার নিজেরও। কোথাও কোন আলো থাকবে না, একদল জোছনাবিলাসী জোছনা উপভোগ করবে নেতৃত্ব দেবেন স্বয়ং পৌরচেয়ারম্যান, সে সুযোগ আর রইল না।
ভালমানুষরা বেশীদিন বেচে থাকেন না, তাদের প্রতি প্রকৃতি বড় কৃপন। চলে গেছেন মমিনুলমউজদীন...হাসন রাজার পোপৌত্র...টানা তিনবারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান আজ ১৫ নভেম্বর ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের সড়াইলে এক সড়ক দুর্ঘটনায় ম্ত্রী-পুত্র সহ ইন্তেকাল করেছেন। (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন)"

http://www.somewhereinblog.net/blog/rontychowdhuryblog/28745819

শ্রদ্ধা ও প্রার্থনা রইল।

পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?

নব্য এর ছবি

বিদেশের মাটিতে বেশীর ভাগ দিনই আমার মন খারাপ থাকে। কোনো কারণ ছাড়াই! তাই ভয়ে কাউকে বলতে-ও পারিনা যে আমার মনটা ভীষণ খারাপ। সবার একটাই প্রশ্ন, 'কারণ ছাড়া আবার কারো মন খারাপ হয়!' আমার কেনো জানি হয়।
আজকের দিনটা কেটেছে 'মন খারাপ-ও না, আবার ভাল-ও না' এই রকম অবস্থায়। কিন্তু কবির খবরটা পড়ে আবার মন খারাপ অবস্থা। কবির আত্মার শান্তি কামনা করি।

মাশীদ এর ছবি

মনটা খারাপ হয়ে গেল।
আপনাদের চেনা-জানা অনেক মানুষ খুব দ্রুত চলে গেল কেন যেন।
কবি এবং তাঁর পরিবারের সবার আত্মার শান্তি কামনা করছি।


ভাল আছি, ভাল থেকো।


ভাল আছি, ভাল থেকো।

হাসান মোরশেদ এর ছবি

আমি এখনো থ্যাতাভোঁতা হয়ে আছি ।
ভাল্লাগছেনা ।
-----------------------------------------
'জলপ্রিয় হে যুবক, তোমার ভিতরে এত
ভাঙনের পতনের শব্দ শুনি কেন!'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

ঝরাপাতা এর ছবি

শুধু স্মৃতিগুলোই আঁকড়ে ধরে কাটাতে হয় সারাজীবন। কবির আত্মার শান্তি কামণা করছি।


রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।