নির্বাচনের চিঠি

হাসান মোরশেদ এর ছবি
লিখেছেন হাসান মোরশেদ (তারিখ: রবি, ৩১/০৫/২০০৯ - ৬:৪১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

জুনের চার তারিখে এখানে একই সাথে কাউন্টি কাউন্সিল এবং ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট নির্বাচন। কাউন্টি কাউন্সিল যুক্তরাজ্যের নিজস্ব নির্বাচন হলে ও অপরটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত ২৭টিদেশ জুড়ে, ভোটার সংখ্যা আনুমানিক ৩৭৫ মিলিয়ন,নির্বাচিত হবেন ৭৮ জন MEP(Member of European Parliamant)। এই ৭৮ জনের মধ্যে ১২জন হবেন যুক্তরাজ্য থেকে।

ইংল্যান্ড-স্কটল্যান্ড সীমান্তবর্তী একটা ছোট,খুব ছোট একটা শহরে আমি থাকি। ছয়মাইল দূরের আরেকটা শহরে কয়েক ঘর বাঙ্গালী থাকলে ও আমার শহরে আমিই সম্রাট :)। স্থানীয় হাসপাতালে বেশ কিছু ফিলিপাইনের নার্স আছে, কয়েকটা প্যালেষ্টাইনি ডাক্তার আছে, কেয়ার হোমসে কেরালার কিছু ছেলে-মেয়ে আছে এই যা।

ঐতিহ্যগত ভাবে উত্তরের এই তুলনামুলক দরিদ্র এলাকাগুলোতে লেবার পার্টির দাপট( অপরদিকে দক্ষিনের অভিজাত এলাকাগুলোতে কনজারভেটিভ এর)। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বর্তমান সাংসদ ব্রায়ান সিম্পসন এবারো লেবার থেকে প্রার্থী। ব্রায়ানের সাথে ব্যক্তিগত পরিচয় ও নেই। আমি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ভোটার কিনা সেটা নিশ্চিত ও নই। আমি বৃটিশ নাগরিক না। কিন্তু কমনওয়েলথ সদস্য দেশের নাগরিক হিসেবে যুক্তরাজ্যের ভোটার আমি, সেই হিসেবে বিগত জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে ভোট দিয়ে এসেছি ( নিজের দেশে অবশ্য ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়ে গেছি মন খারাপ )

কাউন্টি কাউন্সিলার ডেভিড সাওথওয়ার্ড এর সাথে ভালো সম্পর্ক। লাইব্রেরীতে, সুপারমার্কেটে, রেস্টুরেন্টে, পাব এ প্রায়ই দেখা হয়, তার অফুরন্ত সময়। তার এলাকায় আমি সংখ্যায় লঘিষ্ঠতম বলেই বোধহয় আলগা খাতির, অতিরিক্ত যত্ন-আত্তি করার একটা চেষ্টা আছে সবসময়।
এমনিতেই সে বিশিষ্টজন। গত বারো বছর থেকে নির্বাচিত কাউন্সিলার। শুধু তাই নয়, একজন এমবিই ( Memeber of British Emperor) ও সে। বাংলাদেশ সম্পর্কে তার প্রচুর জানাশোনা, এমনকি বাংলাদেশের রাজনীতির খোঁজখবর ও রাখে। প্রথম পরিচয়ের দিন জানিয়েছিলো ১৯৭১ যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তখন তরুন লেবার কর্মী হিসেবে সে লন্ডনে বাংলাদেশের পক্ষে মিছিল, শোভা-যাত্রা করেছে।

গত কয়েকদিন থেকে বিএনপি(British National Party)'র চিঠিপত্র পাচ্ছি দেদারসে। চিঠির বাক্স প্রতিদিন ভরে যাচ্ছে এদের ইশতেহার আর লিফলেটে। চরম বর্ণবাদী ও ডানপন্থী এই সংগঠনটিকে যুক্তরাজ্য সরকার নিয়ন্ত্রনে রাখে বেশ কৌশলে। নিষিদ্ধ নয় কিন্তু সরকারীভাবেই এদের রাজনীতিকে নিরুৎসাহিত করা হয়। যেমন বিএনপি যদি কোন রেস্টুরেন্টে সভা করে পুলিশ সভায় বাধা দেবেনা কিন্তু সভাশেষে রেষ্টুরেন্ট মালিকের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেবে বর্ণবাদে উৎসাহ যোগানোর অপরাধে :)।
স্থানীয় সরকারের কোথাও টুকটাক অংশীদারিত্ব, লন্ডনের কোন এক বারাকাউন্সিলের মেয়র( লন্ডন সিটির নয়, বারা কাউন্সিল আমাদের পৌরসভার ওয়ার্ডের মতো )- এছাড়া বিএনপির কোন সাফল্য নেই। জাতীয় সংসদে এদের কোন সদস্য নেই। গত নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোট 0.7% । চরম ইমিগ্রান্ট বিরোধী এই দলটির নির্বাচনী ভাষায় বেশ কিছু পরিবর্তন দেখছি।
ইমিগ্রেশন বিরোধীতা গতবছরগুলোতে একেবারেই হালে পানি পায়নি মিশ্র সংস্কৃতির এই দেশে। তাই এবার তারা সরাসরি ইমিগ্রেশন বন্ধের বদলে 'অবৈধ ইমিগ্রেশন নিয়ন্ত্রন' এর কথা বলছে। ইমিগ্রান্টদের বদলে এবার টার্গেট করেছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ধারনা'কে ।
লিফলেটে তথ্য-টথ্য দিয়ে প্রমান করছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পেছনে প্রতিবছর যুক্তরাজ্য কত হাজার মিলিয়ন ব্যয় করছে অপ্রয়োজনে, খামোখা এইসব খরচের কারনেই তো অর্থনীতির এই বেহাল অবস্থা, ব্রাইটনদের কাজ নাই-ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে লোকজন এসে ভরে যাচ্ছে( আগে এরা এশীয়ান ইমিগ্রান্টদের বিরোধীতা করতো বেশী), বৃটেন এর সকল সুযোগ সুবিধা বৃটিশরাই ভোগ করবে( আগে বলতো ইংল্যান্ড ফর ইংলিশ...)

উইন্সটন চার্চিল এর ছবি দিয়ে পোষ্টার ছাপানো UKIP( UK Independent party) এর কথাবার্তা ও একই রকম দেখছি। অর্থনৈতিক দুরবস্থা সুযোগে দেশপ্রেম, জাতি প্রেমের ধোঁয়া তুলে কিছু ভোট বাগিয়ে নেয়া, সম্ভব হলে কাউন্টি কাউন্সিলের দু একটা সিট দখল করা।

ডেভিড সাউথওয়ার্ড এর সাথে কথা হচ্ছিল দু'দিন আগে। নির্বাচন নিয়ে তাকে বেশ চিন্তিত দেখে জিজ্ঞেস করলাম- তার এলাকায় লেবারদের বিশাল ভোট ব্যাংক থাকা স্বত্বে ও সে এতো দুশ্চিন্তা করছে কেনো? জানালো- অর্থনৈতিক দূরবস্থা মোকাবেলায় সরকারে পলিসি সাধারন মানুষদের কাজে আসেনি, এই শোধ এবার নির্বাচনে তুলবে মানুষ। আর এই এলাকা নিয়ে সে বিশেষভাবে চিন্তিত কারন লেবার না জিতলে বিএনপি জিতবে। আমি একই সাথে অবাক এবং আতংকিত হলাম। এখানে বর্ণবাদের ছিটেফোঁটা ও আমি দেখিনি কোনদিন, এত চমৎকার বন্ধু বৎসল মানুষজন এদেশের অন্য কোথাও আছে কিনা জানা নেই আমার। সাউথওয়ার্ড বললো- লেবারের একজন বিদ্রোহী প্রার্থী স্বতন্ত্র নির্বাচন করায় কোর ভোট ভাগ হয়ে যাবে আর একটা ভয়ংকর প্রবণতা দেখা যাচ্ছে- ভোট ব্যাংকের যারা লেবারের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে তারা কনজারভেটিভে ভিড়ছেনা বরং সরাসরি চলে যাচ্ছে বিএনপি শিবিরে, অনেকটা এরকম যে নষ্ট হবো যখন ভালো করেই হই :(।
ওকে আরেকটা বিষয় জিজ্ঞেস করলাম- বিএনপির লিফলেটে দেখলাম তারা ধর্মীয় প্রচারনা চালাচ্ছে যে 'খ্রীষ্টানদের উচিত বিএনপি'কে ভোট দেয়া'। নির্বাচনে ধর্মীয় অনুভূতির ব্যবহার রোধে ওদের কৌশল কি?

সাউথওয়ার্ড হেসে বললো- দুদিন পরে স্থানীয় পত্রিকা খুলে দেখো, কৌশলটা ধরতে পারবে।

আজকে বেশ আগ্রহ নিয়েই স্থানীয় পত্রিকা খুললাম। প্রথম পাতায় বিশাল বিজ্ঞপ্তি স্থানীয় খ্রীষ্টান মিশনের পক্ষ থেকে। মিশন ভুক্ত সকলকে অবগত করা হয়েছে- ৪ তারিখের নির্বাচনে তারা যেনো যাকে খুশী তাকে ভোট দেয় কিন্তু বিএনপি'কে নয়। মিশনের ফাদার বাইবেলের কোন কোন আয়াত উদ্বৃত করে তার ধর্মপ্রাণ সারথীদের জানাচ্ছেন- প্রভূ যীশু ও তার দুর্দিনে অভিবাসী হয়েছিলেন, অভিবাসী হয়েছিলেন সাধূ পীতর। সুতরাং অভিবাসনের বিরোধীতা করে যে বিএনপি তারা কোনভাবেই ইশ্বরপুত্রের আদর্শ ধারন করেনা বরং তারা লুসিফারের চেলা। কোন ধর্মপ্রাণ খ্রীষ্টানের কর্তব্য নয় বিএনপি'কে ভোট দেয়া বরং সক্রিয়ভাবে বিএনপির বিরোধী পক্ষকে নির্বাচিত করা ঈমানী দায়িত্ব হাসি

ডেভিড সাউথওয়ার্ডের সেই কৌশলী হাসির মাজেজা ধরতে পারলাম। ব্যাটা এইবার ও জিতবে। জিতুক। ৪ তারিখে আমার ভোট ওকেই দেবো হাসি


মন্তব্য

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

গুড লাক, ডেভিড সাওথওয়ার্ড !!! হাসি

নিবিড় এর ছবি

হাসি


মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।