সন্ত্রাস যখন বিপর্যস্ত করছে

হাসান মোরশেদ এর ছবি
লিখেছেন হাসান মোরশেদ (তারিখ: রবি, ০১/০২/২০১৫ - ২:১২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমাদের একটা গাড়ী আছে। ছোট্ট, পুরনো গাড়ী। অনেক পুরনো।
নগরী হয়ে উঠলে ও 'আমাদের সিলেট' এখনো সেই মফস্বল শহর। দোকান, বাজার, শপিংমল, রেস্টুরেন্ট, আত্ম্বীয়স্বজনের বাসা, বাচ্চাদের স্কুল সব তো একেবারেই আশেপাশে। হ্যাঁ, আমার কাজের জায়গাটা শহরের একটু বাইরে। অফিসের গাড়ী আছে তো। সবমিলিয়ে ছোট্ট পুরনো গাড়ীটা চালানোই হয়না। এপার্টমেন্টের বেসমেন্ট অলস পড়ে থাকে। বেসমেন্ট পাশ ঘিরেই ব্যস্ত পাড়ার গলি। গাড়ীটা ঘুমিয়ে ছিলো গলির দিকে মুখ রেখে।

সেদিন লিফটে একসাথে উঠতে উঠতে পাশের ফ্ল্যাটের মুরব্বী পরামর্শ দিলেন গাড়ীটা রাস্তার দিকে না রেখে ভেতরের দিকে এনে রাখেন, যে দিনকাল- গেটের ভিতর দিয়ে যে কেউ গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিতে পারে অথবা একটা পেট্রোল বোমা!

সিলেট থেকে জাফলং এর দিকে যেতে যেতে হরিপুর বাজারে কাফনা নদীর উপর ছোট্ট ব্রীজ, সেই ব্রীজ পেরিয়ে আরেকটা ব্রীজ হরিসের পুল। তারপর আরো এগিয়ে গেলে সারীঘাট। গত চারবছরে কতো অসংখ্যবার এই রাস্তা ধরে গেলাম, ফিরে এলাম। প্রবল বৃষ্টিতে, পাহাড়ী ঢলে, শীতের শীর্ণতায় এইসব নদী, নদীর উপর সেতু। কতোদিন ভোরবেলা, মায়াবী বিকেলে, এমনকি মধ্যরাতে ও এই সড়কে ছুটেছি। এই এলাকায় কতো মানুষ চেনা হলো। অনেককে নামে চিনিনা, মুখ দেখে তবু পরিচিত মনে হয়। একদিন হয়তো গাড়ী থামিয়ে কারো থেকে মাছ কিনেছি, একদিন চা খেয়েছি, একদিন একজন ট্রাক ড্রাইভারের সাথে এমনি এমনিই কথা বলেছি। সেদিন, কয়েকদিন আগে- সারীঘাট থেকে বালু ভর্তি করে একজন ট্রাক নিয়ে ফিরছিলেন শহরের দিকে। হরতাল, অবরোধ এড়ানোর জন্য মাঝরাতের পর। বাঘের সড়ক আর হরিসের পুলের মাঝখানে পেট্রোল বোমা ছোঁড়া হলো তার ট্রাকে।
পুড়ে যাওয়া মানুষটা যন্ত্রনায় কাতরাতে কাতরাতে মারা গেলো দু একদিন আগে। জানিনা, এই মানুষটাকে আমি চিনি কিনা।

কোথায় কোথায় যেনো আগুনে পুড়ে মানুষ মরছিলো। একজন, দুজন, তিনজন, আটত্রিশজন। নোয়াখালী, রাজশাহী,ঢাকা- সিলেট থেকে বেশ দূরে দূরে। দুতিন দিন আগে এক ফেসবুক বন্ধুর স্ট্যাটাসে দেখি তার বোন জামাই পুড়ে মারা গেছেন। বিস্তারিত জানার সাহস হয়নি।
নদীর ঐপাড় দক্ষিন সুরমা। প্রায়ই তো যাই।দক্ষিন সুরমায় প্রায়ই বাসে আগুন লাগে, লাগানো হয়। কাল রাতে শুনলাম শহরের একেবারে কেন্দ্রে, সোবহানী ঘাটে আগুন লাগান হয়েছে যাত্রীবাহী বাসে ।

মৃত্তিক এবার স্কুলে যাচ্ছে। মৃত্তিক এখন তিনবছর ছয় মাস। জানুয়ারী মাস জুড়ে মাত্র কয়দিন স্কুলে যাওয়ার সুযোগ হলো হরতাল এড়িয়ে। এই কয়দিনের মধ্যেই স্কুল ফাঁকি দেয়ার নানা বাহানা শেখা হয়ে গেছে তার। পেটে ব্যথা, জ্বর জ্বর লাগছে, এমনেই ভাল্লাগছেনা। কালকে জোর করে ঘুম থেকে তোলার পর বলছে- যদি ওরা বোমা মারে!

শীতকাল বিদায় নিচ্ছে। শীতের মতো ধীর লয়ে সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়ছে। এই অরাজক কালে ও কেউ কেউ সুযোগ নেবে। আমি জানি, কেউ কেউ দেশ ছাড়বে। কাউকে কাউকে দেশ সত্যিই তাড়িয়ে দেবে। অনেকেই ভাববে- আহা যদি বৌ বাচ্চা নিয়ে কোথাও নিরাপদে চলে যাওয়া যেতো।
প্রতি সকাল বেলা নিজের গালে রেজার টানতে টানতে আয়নায় নিজেকে দেখি আর প্রবোধ দেই- নাহ, আমি সেই মানুষ না! প্রবোধ। প্রবোধ


মন্তব্য

মেঘলা মানুষ এর ছবি

সবার জন্য থাকুক একটা শান্ত, নিরাপদ দিনের নিশ্চয়তা।
মানুষ ছাড়া অন্য কোন প্রাণী তারই সমগোত্রীয় কাউকে পুড়িয়ে মারে -এমনটা শুনিনি।
মন খারাপ

এক লহমা এর ছবি

মন খারাপ

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।