ওম শান্তি-আস্ সালাম

হাসান মোরশেদ এর ছবি
লিখেছেন হাসান মোরশেদ (তারিখ: মঙ্গল, ৩১/০৩/২০০৯ - ৫:৪৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


বিচারের অযোগ্য ঘৃন্য সন্ত্রাসীদের পবিত্র আত্নার উদ্দেশ্যে ---- যেহেতু গ্রহণের কাল দূরীভূত , শান্তি সমাহত, মহামান্য রানীমাতা ও সম্মানিত রাজপুত্র আশ্বাস দিয়েছেন-- স্যানেটারী ন্যাপকিন ছাড়া আর কোথাও রক্তপাত হবেনা

---------------------------------------

[[1]]
কবি নীলাদ্্রি নীল যখন লাফিয়ে নামল ট্রলারের ছাদ থেকে, সূর্য তখনো ঢলে পড়েনি পশ্চিম আকাশে।

সেই ভোরবেলা ট্রলারে ওঠা। নদীর নাম কালনী। গ্রামের নাম সীতাহরণ। আহারে অত মোহক নাম কারা রেখেছিল। প্রায় সারা দিন ধরে আরো কত নদীর জল, কত গ্রাম, ছোট ছোট গঞ্জ । পুরোটা সময় ধরে নীলের ভাবনা জুড়ে টাপুর টুপুর ছন্দপাত।
...কবিতা ধরা দেয় না সহজে। সে বড় ছেনাল মাগী। জেলা শহর থেকে দু ঘন্টার স্থল, তারপর প্রাায় আট ঘন্টার জল দূরত্বে এখনো কবিতা আছে। স্বাধীনতার পর থেকে প্রতি বছর ওখানে সাহিত্য ও সাংসকৃতিক মেলা হয়, বসে বাউল গানের আসর।

এবার ওই গ্রাম থেকে দুটো ছেলে এল, নীলকে সাহিত্য মেলার অতিথি হতে হবে।

কবি নীলাদ্্রি নীল । বয়স যার 27-এর কোটায়। গাঁজায় যার পরম ভক্তি, কবিতায় প্রচন্ড ভাঙচুর। সে কবি অতিথি হয়ে গেল সীতাহরণ গ্রামের সাহিত্য মেলায়। সেখানেও কবি আছে। আর তারা নাকি নীলের কবিতাও পড়েছে:
'আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই ওই মানবীর তুমূল সহবাস ।'

আর তারা নাকি নীলের কবিতার ভক্ত। এই প্রথম এমন । শহরে তার কবিতার বোদ্ধা আছে, সমালোচক আছে, হিংসুক আছে, ভক্ত নেই।

সে গ্রামে বিদু্যৎ এসে গেছে, রাজনীতিও আছে, হিন্দি সিনেমার সুরও পৌঁছে গেছে, তবু স্কুলের মাঠে শহীদ মিনারটা আছে । মিনারের বেদি এখনো পতিতার রাত্রিবাস হয়ে ওঠেনি । একটা লাইব্রেরি আছে। রবী , নজরুল, মাইকেল, সুকান্ত এমনকি জীবনানন্দের ছবিও আছে।

আর আছে তনু। তনুশ্রী চক্রবতর্ী।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসর প্রাপ্ত গনিত শিক্ষক বাবু ঋষিকেশ চক্রবতর্ীর ছোট মেয়ে। স্থানীয় বালিকা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাস। তবু জীবানন্দের বোধ কবিতা সে আওড়ে যায় আশ্চর্য আবেগে । তনুদের বাড়ির উঠোনেই 'শহীদ জগৎ জ্যোতি গন গ্রন্থাগার' ।

জগৎ জ্যোতি --যে তার বড় দাদা ছিল । আর সে যুদ্ধে গিয়েছিল তনুর জন্মের বছর দশেক আগে । এখনো লোকের মুখে ফেরে তার বীরত্বগাথা। শেষ যুদ্ধে তাকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলা হয়েছিল। তবু নিজেকে সমর্পণ করেনি জগৎ জ্যোতি । বুকে গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়ার পর বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে তুলে নেওয়া হয়েছিল দু চোখ। ছুরি দিয়ে কেটে টুকরো টুকরো করে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল কালনীর জলে।

স্বাাধীনতার পর সবাই ভেবেছিল জগৎ জ্যোতি বীরশ্রেষ্ঠ উপাধি পাবে। সব উপাধি উপভোগ করল উর্দিওয়ালারা। আর স্বাাধীনতার 35 বছর পর শহীদের তালিকায় নেই জগৎ জ্যোতির নাম।

গন গ্রন্থাগারের এক কোনায় বসে এসব অহংকার, দীর্ঘশ্বাস শুনেছিল কবি নীলাদ্্রি নীল তনুশ্রী চক্রবতর্ীর মুখে। আর নীল প্রেমে পড়েছিল তনুশ্রীর। কবি সে তো প্রেমে পড়বেই, প্রেমে ডুববেই। না হলে সে উদ্ধার পাবে কেন কবিতার হাত ধরে?

কবি নীলাদ্্রি নীল কোনো দিন হিসাব রাখেনি তার প্রেম আর পদ্যের!
আজ ভোরবেলা, বিদায়বেলা তনুশ্রী এক থোকা শিউলী ফুল দিয়েছিল কবিকে। এখনো সে ফুল কবিতার ব্যাগে, কবির আবেগে।
তনুশ্রীর সাথের এই কদিন গাঁজা ছোঁয়নি নীল। ব্যাগের কোনো এক কোনে পড়ে আছে যেমন ছিল তেমনি।
যখন প্রেমের মাঝে বহমান তখন গাঁজা ছোঁয় না নীল । গঞ্জিকা অথবা গণিকা যেকোনো একজন।

[[2]]
কালনীর ঢেউয়ে শেষবার হাত ভিজিয়ে নীল উঠে এল পাকা সড়কে। এখান থেকেই বাস ধরে যেতে হবে নিজের শহরে। ইট-পাটকেল, বস্তি-স্কাইলেট, কালো টাকা-কবিতার নোংরা জংলায়।

কিন্তু আজ এই সড়ক এত নির্জন কেন!
একটাও গাড়ি নেই। ...যাচ্ছে না ...আসছে না...। হরতাল নাকি?
একটু দূরে একটা জলপাই রঙের মিলিটারি ট্রাক। শহরের দিকে মুখ করা। যাবে নাকি ওদের কাছে?

না, তাকে যেতে হয় না।
কবির দিকে অস্ত্র তাক করে এগিয়ে আসে গোটা কয়েক জলপাই উর্দি।

কবি বিস্মিত, বিমোহিত!
সে তো গাঁজা ছোঁয়নি এত দিন। তবে কেন এই হ্যালুসিনেশন। সে তো জগৎ জ্যোতি নয়। এ তো নয় 1971। তাহলে?

কবিতারও অধিক জটিলতায় বিদ্ধ হয় কবি।
অতঃপর নিজ শহরে ফেরে কবি জলপাই ট্রাকের পাটাতন চিৎ হয়ে , গামছা বাঁধা চোখে --ভারী বুটের লাথি খেতে খেতে।

[[3]]
পায়চারি থামাতে পারছে না মেজর সালাউদ্দিন।

তিন দিন আগে হুঁট করে শুরু হয়ে গেল সন্ত্রাস নিমর্ূল অভিযান' । তাও যৌথ বাহিনীর নামে। কাজ করতে হচ্ছে থানার পুলিশ আর বিডিআরকে সাথে নিয়ে। দারোগা গুলো এক একটা চোর আর বিডিআর কমান্ডার গুলো সব স্মাগলার । এর চেয়ে মার্শাল ল' দিয়ে দিলেই তো ভালো হতো। গাধার কাজ! এই চিফটা একটা ভেওড়া । বাপের বেটা ছিল হু মু এরশাদ ।

মেজরের মেজাজ আরো খিঁচড়ে আছে তার টুআইসি ক্যাপ্টেন জোবায়েরের ওপর। রামছাগলের বাচ্চা! কদিন আগে সিভিল ড্রেসে মার্কেটে মেয়ে দেখতে গিয়ে থাপ্পড় খেয়েছিল সরকারি দলের এক ক্যাডারের হাতে। বাস্টার্ডটা গালে হাত বুলিয়ে ক্যান্টনমেন্টে ফিরে এসে তারপর ফিলড মার্শাল !ট্রুপ নিয়ে ধরে আনতে গেলো সেই ক্যাডারকে। কাজের কাজ কিচ্ছু হচ্ছে না।

এখন আবার ধরে নিয়ে এসেছে একটা পাগলকে। উস্কু খুস্কু চুল, ব্যাগের ভেতর গাঁজা আর কটা বই। এই পাগলটা নাকি কুখ্যাত আর্মস ডিলার। হতেও পারে। ব্লাডি সিভিলিয়ানদের কোনো বিশাস নেই। এর মধ্যে অবশ্য কয়েক ডিগ্রি দেওয়া হয়েছে।

নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। একটা বই তুলে নাড়াচাড়া করল মেজর। একটা মেয়ের ছবি- হাসি হাসি মুখ। বুকের কাছে হাত ভাঁজ করা। তবু বোঝা যাচ্ছে, সাইজ মন্দ না। এ শালা কি মেয়েছেলের ব্যবসাও করে নাকি?

দ্্রুত এর একটা ব্যবস্থা করতে হবে। মেয়েটার ছবি দেখে মেজরের ক্ষিধে পেয়ে গেছে। বেডরুমে যেতে হবে নিশ্চিত ।

রক্তাক্ত, অর্ধচেতন কবির চুলের মুঠোয় আবার টান পড়ে, কানের কাছে আবার কর্কশ চিৎকার --'বল শালা, তোর অস্ত্র শস্ত্র কই?'

আর মুহূর্তে সে কবি বিমূর্ত হয়ে যায়। জলপাই লাথিতে ফেটে যাওয়া ঠোঁটের কোনে অম্লান হাসি। দুই উরু ফাঁক করে সে দেখায় তার সাহসী অস্ত্র ।

আর তৎক্ষনাৎ শান্তি স্থাপনের প্রয়োজনে, সন্ত্রাস নিমর্ূলের লক্ষ্যে - কবির সেই অস্ত্রে ভারী বুটের লাথি চালায়- জাতির শেষ ভরসা , জনগণের অতন্ত্র প্রহরী জলপাই রাক্ষস।

ভুল পাতা ঠোঁটে নিয়ে ভুল আকাশে উড়ে যায় পিকাসোর পাখি!

ফুটনোট:
-------
1। কবিতার লাইন দুটো কবি বন্ধু অজর্ুন মান্না'র
2। ছবিটি র স্বত্বআরেক শিল্পী বন্ধু জিয়াউল পলাশের ।
3 । শহীদ জগতজ্যোতি--- সুনামগঞ্জ অঞ্চলের এক শহীদ মুক্তিসেনার নাম । জগতজ্যোতিকে সত্যিই টুকরো টুকরো ভাসিয়ে দেয়া হয়েছিল নদীর জলে । তার লাশ আর খুঁজে পাওয়া যায়নি


মন্তব্য

জেবতিক রাজিব হক এর ছবি

গল্পে সমকালীন অনেক ঘটনাই যেন মূর্ত হয়ে ওঠে।

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

জানি না, কোথায় মুগ্ধতার ব্যাখ্যা খুঁজবো - অর্জুন মান্নার কবিতায় নাকি মোরশেদ ভাইয়ের গল্পে?
কতোদিন হলো, দুই নাকি আড়াই বছর আগে পড়া এ গল্প...। কী করে ছুঁয়ে যায় সন্তর্পনে...

দুর্দান্ত এর ছবি

"ভুল পাতা ঠোঁটে নিয়ে ভুল আকাশে উড়ে যায় পিকাসোর পাখি!"

লেখাটি ভাল লেগেছে।
জিয়াউল পলাশের ছবিটি দেখা যাচ্ছে না।

টুম-সোল [অতিথি] এর ছবি

আমরা তো ব্লাডি সিভিলিয়ান, মানুষ হবনা কোনদিন। জলপাই উর্দিদের মার খাবো আর ভালোভালো কথা বলব তাদের নিয়ে এটাই আমাদের কাজ, আমাদের পবিত্র দায়িত্ত।

অসাধারণ লেখা।

হাসান মোরশেদ এর ছবি

এই লেখা বহু পুরনো । অন্য ব্লগে ছিল পলাশের ছবি সহ ।
সচলায়তনের শুরুতে পুরনো সব লেখা আর্কাইভ করা হয়েছিল । জগতজ্যোতির পোষ্টে লিংক দিতে গিয়ে এর পুনরুত্থান । পুরনো লেখা বলে প্রথম পাতায় দেইনি ।
তবু যারা পড়লেন তাদের ধন্যবাদ ।

আমাদের দুঃসময় গুলো আসলে তেমন বদলায়নি কিছুই ।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

অতিথি লেখক এর ছবি

গল্পটি মনে গেঁথে গিয়েছিলো যেদিন প্রথম পড়েছিলাম কোন এক সাময়িকীতে সেদিনই, পত্রিকার নাম ঠিক মনে পড়ছে না আজ আর। জানতাম আপনার ব্লগে আছে। অর্জুনদা বলেছিলেন।

'আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই ওই মানবীর তুমূল সহবাস ।'

কবিতাটি তখন প্রায় মুখস্থ করে ফেলেছিলাম। ভেবেছিলাম ওটা লেখকেরই লেখা। পরে জেনেছি অর্জুনদা'র।
আর একটি লাইন কেন যেন মনে ছিল বিশেষভাবে এতোদিন পরও :
শহরে তার কবিতার বোদ্ধা আছে, সমালোচক আছে, হিংসুক আছে, ভক্ত নেই।

গল্পটি আমার অনেক ভাল লেগেছে। আবার কখনও পড়বো ভাবিনি।
জুয়েইরিযাহ মউ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।