ঘাতকের জন্যই শেষে সহানুভূতির চাদর?

হাসান মোরশেদ এর ছবি
লিখেছেন হাসান মোরশেদ (তারিখ: মঙ্গল, ৩০/১০/২০০৭ - ৯:২১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

.

গতবছর এই সময়টাতে অন্য ব্লগে রাজাকার,জামায়াত,যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এইসব নিয়ে তুমুল তর্কবিতর্ক ,লেখালেখি করতাম । এরকম এক লেখায় একজন বিশিষ্ট জামাতী মন্তব্য করেছিলেন যে- 'মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা ছিলো একটি মতাদর্শিক বিরোধীতা মাত্র । কেবল ইসলামপন্থীরাই নয় চীনাপন্থী বামরা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছিলেন ।'
আসলে এরকম আলোচনায় চীনপন্থী বামদের ও টেনে আনা হচ্ছে নিজের গা বাঁচানোর একটা কৌশল মাত্র । সে জামাতীকে পালটা প্রশন করেছিলাম-৭১ এ জামাত তথা ইসলামিক দলগুলোর ভূমিকা ও চীনপন্থী বামদের ভূমিকা কি আসলেই এক ছিলো? ইসলামিক দলগুলো মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক বিরোধীতার পাশাপাশি পাকবাহিনীকে সব ধরনের নৃশংসতাকে সমর্থন ও সহযোগীতা করেছিলো যার অসংখ্য প্রমান নথিবদ্ধ আছে । চীনপন্থী বামেরা ও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়নি,আদর্শিক বিরোধীতা করেছিল কিন্তু তারা ইসলামীক দলগুলোর মতো পাকবাহিনীকে সহযোগীতা করেছিলো তেমন কোন প্রমান কি আছে?
বলাবাহুল্য সেই জামাতী 'পরে উত্তর দেবো' বলে কেটে পড়েছিলো ।

জামাত সহ এইসব ইসলামীদলগুলোকে রাজনৈতিক মতবিরোধীতা জনিত কোন উদারতা দেখানোর সুযোগ আসলে নেই । ৭১ এর ভুমিকার জন্য এদের স্রেফ ঠান্ডামাথার ভয়ংকর খুনী হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে । গনহত্যা সংক্রান্ত জাতিসংঘ ঘোষনায় উল্লেখিত ধারা অনুযায়ী জামাত সরাসরিই গনহত্যায় অভিযুক্ত হয় । জাতিসংঘ ঘোষনাতেই বলা আছে,রাজনৈতিক কারনে গনহত্যা সংঘটিত হলে ও গনহত্যার অপরাধ রাজনৈতিক অপরাধ বলে বিবেচিত হবেনা । [ধারা ৭] ।

সমস্যা হলো বাংলাদেশের কিছু অতিবুদ্ধিজীবি যারা যে কোনো প্রসংগে নিজেকে অন্যদের থেকে আলাদা বর্গের হিসেবে তুলে ধরতে চান তারা বেশ কৌশলে ৭১ এর ঘাতকদালালদের ভূমিকার বিকল্পপাঠ প্রচার করতে চান । এই মহামান্যরা নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি বলেই দাবী করেন কিন্তু অতি উদারতার তকমা এঁটে পুর্বপাঠের পুনরালোচনা করেন,'ইতিহাস বিজয়ীদের দ্বারা লিখিত'-এ জাতীয় তত্বকথা ঝেঁড়ে ঘাতক দালালদের জন্য জায়গা তৈরী করেন । কিছুদিন আগে এরকম একটা আলোচনা দেখেছিলাম কোথাও-'রাজাকারের সন্তানদের ঘৃনা করা উচিত না অনুচিত?'
এইসব ইন্টেলেকচুয়াল মকারী আমার কাছে চুড়ান্ত ইতরামী মনে হয় । আমার বাপকে অন্যায় ভাবে হত্যা করলো,হত্যার বিচার হলোনা,বাপের খুনী ক্ষমতায় এলো,খুনীর সাথে খুনীর ছেলেও এখন লাফায়-আমি বাপের হত্যার বিচার করতে পারিনি,আমি দুর্বল,কিন্তু আমি মনে মনে সেই খুনী,সেই খুনীর বংশকে ঘৃনা করি ।
আমার ঘৃনা করার অধিকারটুকু ও থাকবেনা? আমি ঘৃনা করলেও আপনি বলবেন আমি আক্রমনাত্নক,খুনী আর খুনীর বংশ আক্রান্ত?

অন্য আরেক উদাহরন দেখেছিলাম যেখানে রাজাকারদের অসহায় ও আক্রান্ত বলে দ্বিতীয়বিশ্বযুদ্ধ পুর্ব জার্মানের ইহুদীদের সাথে তুলনা করা হয়েছে । তুলনা এই অর্থে যে, সেই সময়ের ইহুদীরা জার্মানে ঘৃন্য ছিলো-ওদেরকে জার্মানের দুর্দশার জন্য দায়ী করা হতো । মুলতঃ এই ঘৃনা থেকেই বিশ্বযুদ্ধকালীন 'হলোকাষ্ট' ।
তো এই তুলনায় রাজাকার জামাতের ভুমিকা আক্রান্ত ইহুদীদের মতো হয় কি করে? ৭১ এর হলোকাষ্ট এর শিকার কে? রাজাকার রা আক্রমনকারী না আক্রান্ত?

এরকম আরেক অতিমানবতাবোধে আমি বিরক্তি বোধ করি । আটকে পড়া পাকিস্তানী । এদেশে জন্ম নেয়া আটকে পড়া পাকিস্তানীদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়ার জন্য অনেকেরই মানবতাবোধ উপচে উঠে । আমার হয়না । কারন আমি ভুলতে পারিনা এই আটকেপড়া পাকিস্তানীরা '৭১ এর ঢাকার অন্যতম জল্লাদ । পিতৃভূমি পাকিস্তান নিচ্ছেনা বলেই বাংলাদেশী হবার জন্য এতো বায়না তাদের ।
বিহারী কিংবা রোহিংগাদের মানবাধিকার নিয়ে কেউ সোচচার হলে আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে-নিজ দেশের আদিবাসীকে যখন তাড়িয়ে দাও,নিজদেশের সংখ্যালঘুকে যখন ভিটেমাটি ছাড়া করো তখন কোথায় থাকে এই বিবেক,এই মানবতাবোধ?
আসল সত্য তো অন্যখানে । বিহারী ও মুসলমান,রোহিংগা ও মুসলমান-হোকনা ভিনদেশী,হোকনা পুর্বপুরুষের ঘাতক,তবু ধর্মে তো মুসলমান । সহানুভূতি তো থাকবেই ।

আমি আগামীদিনের বিকল্পপাঠের দৃশ্য কল্পনা করি । একদল ইন্টেলেকচুয়াল মকার,অতিবুদ্ধিজীবি,শৃগালের মতো ধুর্ত ছদ্মবেশী মানবতাবাদীরা ঘাতকদের জন্য সহানুভূতি সৃষ্টির গল্পগাঁথা তৈরী করবে ।


মন্তব্য

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

বামরা যতোটা না মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করছিলো তারচেয়ে বেশি আসলে তারা মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব নিয়া প্রশ্ন তুলছিলো। আওয়ামীলীগের নেতৃত্ব তারা মাইনা নিতে চায়নাই বা তারা ভাবতো স্বাধীন বাংলাদেশ চালানোর মতো যোগ্য আওয়ামী নেতৃত্বের নাই আসলে।
মুক্তিযুদ্ধকালে তো সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বে বরিশালে একটা সরকারও গঠন করা হইছিলো বইলা শুনি।
আবার কমরেড আব্দুল হক সরাসরিই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করছে। ভূট্টোরে চিঠিও দিছিলেন তিনি।
আবার মেজর জলিল কর্ণেল তাহেররা কিন্তু আওয়ামীলীগের সাথে থাইকাই তাদের আদর্শ বাস্তবায়ন করতে চাইছিলেন।

তবে বামরা তাদের ৭১এর ভূমিকা যে ঠিক ছিলোনা তা অনেকাংশই স্বীকার করেন। আর জামাতীরা প্রস্তুতি নেয় নিজেদেরকে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব দেওনের।

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

হাসান মোরশেদ এর ছবি

বামদের কে জাস্টিফাই করার ও কোনো সুযোগ নেই আসলে । মাওলান ভাসানীর অনেক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত আমার পছন্দের নয় কিন্তু তাঁর '৭১ এর ভূমিকাকে আমি শ্রদ্ধা করি । চীনের বন্ধু হিসেবে আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলনে তার স্বতস্ফুর্ত্তা ছিলোনা কিন্তু ৭১ এ তিনি দ্বিধা করেননি । তার তুলনায় অনেক তরুন নেতৃত্ব তিনি মেনে নিয়েছিলেন । এতো হত্যা,এতো নৃশংসতা দেখে চীনপন্থী সলিডারিটি বাদ দিয়ে মাওলানা বিনাশর্তেই প্রবাসী সরকারে যোগ দিয়েছিলেন । অপরদিকে এইসব বামেরা? ঘরে আগুন লাগ্লে আগুন নেভানোটাই জরুরী,আগুন নিভলে পরে ডাকাত চলে আসবে এই ভয়ে যারা হাত পা গুটিয়ে বসে থাকে,তাদেরকে কি বলা যায়?

তবে কোন অর্থেই এই বামদের জামাতীদের কাতারে ফেলা যায়না । অনেক জায়গায় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে বামদের সংঘর্ষ হয়েছে ,পাক বাহিনীর সাথেও হয়েছে । পাক আর্মির বর্বরতায় সহযোগীতা করার কোন অভিযোগ শোনা যায়নি ।

জামাত ও ৭১ এর ইসলামী দলগুলো সিম্পলি ক্রিমিনাল । রাজনৈতিক আদর্শে হত্যা,ধর্ষন,বর্বরতাকে সমর্থন ও সহযোগীতা জানালে সেটা আর রাজনীতি থাকেনা । এদেরকে ক্রিমিনাল হিসাবেই ট্রিট করতে হবে ।
-----------------------------------
মানুষ এখনো বালক,এখনো কেবলি সম্ভাবনা
ফুরোয়নি তার আয়ু

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

নিরিখ বান্ধিলাম দুই নয়নে ......
সহজ সরল ভাষায় স্পষ্ট উচ্চারণ! অসাধারণ!!

অমি রহমান পিয়াল এর ছবি

ডান দিকের তারাটায় কার্সর রাখতেই ভেসে উঠল অসাধারণ! ক্লিক করা ছাড়া আর কিইবা করতে পারতাম


তোর জন্য আকাশ থেকে পেজা
এক টুকরো মেঘ এনেছি ভেজা
বৃষ্টি করে এক্ষুনি দে তুই
বৃষ্টি দিয়ে ছাদ বানিয়ে শুই


তোর জন্য আকাশ থেকে পেজা
এক টুকরো মেঘ এনেছি ভেজা
বৃষ্টি করে এক্ষুনি দে তুই
বৃষ্টি দিয়ে ছাদ বানিয়ে শুই

হাসান মোরশেদ এর ছবি

কৃতজ্ঞতা ।
ভুলে যাওয়াটা ভুল হবে যে বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ডের প্ল্যানিং ওএক্সিকিউশন এ যারা ছিলো তারা ও উঠতি বুদ্ধিজীবি ছিলো । আশরাফ,মইন রা পত্রিকায় চাকরী করতো-কবিতা ও লিখতো ।
-----------------------------------
মানুষ এখনো বালক,এখনো কেবলি সম্ভাবনা
ফুরোয়নি তার আয়ু

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

অরূপের বুড়ো আঙুলটা কপি করে দিতে চাই এখানে। পার্লাম না।
বরং শব্দেই বলি, ছবি ছাড়া।

বিহারী ও মুসলমান,রোহিংগা ও মুসলমান-হোকনা ভিনদেশী,হোকনা পুর্বপুরুষের ঘাতক,তবু ধর্মে তো মুসলমান । সহানুভূতি তো থাকবেই।

উপরের উদ্ধৃতিটা বড় যন্ত্রণায় ফেলে দেয়। এখানে ভোটের রাজনীতিও আছে। ধর্মের রাজনীতিও আছে।
-----------------------------------------------
খড়বিচালি জোগাড় করি, ঘর বানাবো আসমানে

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

আজকে মুজাহীদ জামাতীদেরকে ঘৃণা জানাইতে গিয়া দুইটা বিষয় উইঠা আসছে... বঙ্গবন্ধু আর বাম।
আমার মনে হয় আমরা আপাতত এইসব বন্ধ রাখতে পারি... কারন এইসবরে জামাতীরা নিজেদের স্বার্থে ইউজ করে।
আমরা একাট্টা হই আসলে মুজাহীদ নিজামী গো: আজম গংদের বিরুদ্ধেই। তৎপরে বাকি ফয়সালা। আগে জানোয়ার খেদাই।

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

তারেক এর ছবি

একদল ইন্টেলেকচুয়াল মকার,অতিবুদ্ধিজীবি,শৃগালের মতো ধুর্ত ছদ্মবেশী মানবতাবাদীরা ঘাতকদের জন্য সহানুভূতি সৃষ্টির গল্পগাঁথা তৈরী করবে ।

এখনি করছে, মোরশেদ ভাই। ধর্ম নিয়ে রাজনীতির পুঁজ জমতে জমতে এখন গ্যংগ্রিন হয়ে গেছে। এই দূষিত স্ফীতি কেটে ফেলতে হবে, এখনই এবং সবাই মিলে।
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

সবজান্তা এর ছবি

এই লেখায় যেই ছবিটা ব্যবহার করা হয়েছে, সেইটা সহ আরো যেইসব কার্টুনচিত্র গুলি আছে ঘাতক দালাল বিরোধী ( এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে থাকা ছবি গুলি ) , ইন্টারনেটে কোথায় পাওয়া যেতে পারে ?

আমি খুঁজেছিলাম মাঝে কিন্তু পাই নি।
---------------------------------------------------------
অলমিতি বিস্তারেণ

অতিথি লেখক এর ছবি

তারেক ভাই আপনার সাথে একমত । কোন প্রকার সহানুভূতি দেখানো একেবারে ভুল হবে এদের জন্য। এই গ্যংগ্রিনটা এখনি ফেলে না দিলে ভবিষ্যতে নিজেরই বাচাঁ দায় হবে ।ধন্যবাদ হাসান মোরশেদ ভাই আপনার লেখার জন্য।
রবিন

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।