প্রবাসে দৈবের বশে ০২০

হিমু এর ছবি
লিখেছেন হিমু (তারিখ: শুক্র, ২৩/১১/২০০৭ - ৯:৪৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


অবশেষে শেষ হলো সেমিনার।

বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে কাসলার সিম্পোজিয়ুম, নবায়নযোগ্য শক্তি নিয়ে সাম্প্রতিক গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হচ্ছে। কাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ইনস্টিটিউট ইজেট গোটা ইয়োরোপেই বেশ সমাদৃত, জার্মানিতে তো বটেই। বড় বড় নবায়নযোগ্য শক্তি শিল্পোদ্যোক্তারা গবেষকদের সাম্প্রতিক সংযোজন সম্পর্কে জানতে এসেছেন, পাশাপাশি গবেষণার জন্যেও আলাদা তাগাদা দেয়া হবে।

ওদিকে আমার সেমিনার নিয়ে বিষম দৌড়ের ওপর ছিলাম। এই সেমিনারের উদ্দেশ্য হচ্ছে নবায়নযোগ্য শক্তির ক্ষেত্রে কাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের স্বকপোলকল্পিত উদ্যোগকে সহায়তা করা। সেমিনারের অধ্যক্ষ ডাকসাইটে প্রফেসর য়ুর্গেন শ্মিড স্বভাবসুলভ মৃদু কণ্ঠে জানালেন, পোলাপানকে পাশ করার পর দুনিয়াতে একা ছেড়ে দেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ না। তাকে বিভিন্ন রাস্তা দেখানোও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তব্য। একজন প্রকৌশলী নিজে কোন উদ্যোগ নিতে গেলে শুরুতেই বিরাট হোঁচট খেতে পারে, কারণ হয়তো ব্যবসা সম্পর্কে তার কিছুই জানা নেই। ওদিকে সেন্ট গালেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের ছাত্ররা হয়তো ব্যবসা সম্পর্কে খুবই ভালো জানে, কিন্তু প্রযুক্তির সাম্প্রতিক বাস্তবতা সম্পর্কে তাদের ব্যবহারিক জ্ঞান খুব কম। কাজেই এই সেমিনারের মাধ্যমে এই দুই পক্ষের দূরত্ব কমিয়ে আনার একটা চেষ্টা করা হচ্ছে। একদল প্রকৌশলী একটা নতুন আইডিয়া উপস্থাপন করবেন, একদল ব্যবসায় প্রশাসক সেই আইডিয়ার বাণিজ্যিক উপযোগিতা যাচাই করে একটা বিজনেস মডেল দাঁড় করাবেন, এ-ই ছিলো আড়াই দিনের সেমিনারের মূল কাজ।

আমার আইডিয়া নিয়ে প্রাথমিক উপস্থাপন মোটামুটি ভালোই হয়েছিলো, গতকাল চারজন সুইস মোটামুটি ছাই দিয়ে ধরলো আমাকে আইডিয়ার আগাপাস্তলা বোঝার জন্যে, মার্কেটিং ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে তিনজন আর ফিনান্স থেকে একজন। আমার প্রস্তুতি ভালোই ছিলো, নানা প্যাঁচঘোঁচ গলিঘুঁপচি নিয়ে আলোচনা শেষে তারা ঝড়ের বেগে একটা কাঠামো দাঁড় করিয়ে ফেললো। আজ সকালে সেটার ওপর শেষ দফা উপস্থাপন হলো, মনটা ভালো, কারণ বেশ মসৃণভাবে শেষ হয়েছে জিনিসটা। প্রথম যেদিন প্রফেসর শ্মিডের সামনে উপস্থাপন করেছিলাম, শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তির কারণে একটু গুলিয়ে ফেলেছিলাম, তিনি বেশ সুন্দরভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে এমন উপস্থাপন নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট নন, আরো ভালো কিছু চান। আজকে দেখলাম তিনি সব কিছু শেষ হবার পর এসে জানালেন, ভালো হয়েছে।

সুইসরা বেশ স্নব হয় নানা ব্যাপারে, আমার অন্য তিন আরব সহকর্মীর সাথে যারা গ্রুপ করেছে তারা দেখলাম তাদের আইডিয়াটা নিয়ে বেশ হাসাহাসি করলো। অপমানিত হতে কে-ই বা আর ভালোবাসে, ফিলিস্তিন, তিউনিসিয়া আর জর্দানের তিন তরুণ মুখ কালো করে কর্তব্যকর্ম করে গেলো। উপস্থাপন শেষে ওদের গিয়ে সান্ত্বনা দিলাম, বেচারারা খুবই মন খারাপ করেছে এমন অনাকাঙ্খিত সারকাজমের শিকার হয়ে।

তবে সুইস দলের কয়েকজন যাবার আগে এসে আরো খোঁজখবর নিয়ে গেলো আমার আইডিয়া নিয়ে ভবিষ্যত চিন্তার। আমার গ্রুপের সদস্যরা বেশ সিরিয়াস কিসিমের লোক, ফিনান্সের ফাবিয়ান অল্প কথায় কিছু টিপস দিলো আমাকে, ছোকরার মাথা দারুণ সাফ।

গতকাল সকালে আবার গোটা দলের সাথে এক্সকারশনে গিয়েছিলাম কাসেলের অন্যতম এক ইলেকট্রনিকস ইন্ডাস্ট্রিতে। ইন্ডাস্ট্রির প্রতিষ্ঠাতা এককালে কাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ে নবায়নযোগ্য শক্তি গবেষণায় গবেষণা সহকারী হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন, ১৯৮১ সালে তাঁরা তিন সহকর্মী ও বন্ধু মিলে সেই ইন্ডাস্ট্রির গোড়াপত্তন করেন। এখন সেই ইন্ডাস্ট্রি ইনভার্টার নির্মাতা হিসেবে দারুণ সফল। কাসেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং এই ইন্ডাস্ট্রি একে অপরকে গবেষণা বিষয়ে সহায়তা করে লাভবান হচ্ছে। ইন্ডাস্ট্রির নির্বাচিত কিছু অংশ ঘুরে দেখার পর প্রতিষ্ঠাতা এসে উপস্থিত হলেন, ছাত্রদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে। তাঁর কথা শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিলো, বাংলাদেশে শিল্পোদ্যোক্তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারস্থ হলে অনেক লাভবান হতেন। উদ্ভাবনের কোন বিকল্প নেই, জানালেন হের ক্রামার, আর উদ্ভাবন নিয়ে দেরি করলে পস্তাতে হবে। আমি শুনি আর দীর্ঘশ্বাস ফেলি। হায় বাংলাদেশের শিল্পোদ্যোক্তা, হায় আমার প্রিয় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়।

এই সেমিনার করতে গিয়ে যা শিখলাম, তা হচ্ছে, পূর্বপ্রস্তুতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। আমার উপস্থাপন আমি সব মিলিয়ে চারবার চর্চা করেছি, শিক্ষকদের কাছে তিনবার আর আমার পড়শী লম্বু জামুয়েলের কাছে একবার। পাশাপাশি SWOT বিশ্লেষণ করে দুর্বল জায়গাগুলোর জন্য জবাব তৈরি করে রেখেছিলাম। আমার আরব সহকর্মীদের অবস্থা দেখে বুঝেছি, পূর্বপ্রস্তুতির বিকল্প হচ্ছে হাস্যাস্পদ হওয়া। কোন কিছু ঠিকমতো বোঝাতে না পেরে কারো দাঁত ক্যালানো দেখার মতো বিড়ম্বনা আর হয় না।

জানি না অনাগত উপস্থাপনগুলির জন্য এমন সময় পাবো কি না, কিন্তু দেখানোর মতো বত্রিশ দাঁতের পাটির যে অভাব হবে না এই দেশে, এটা বুঝলাম। আমার সহপাঠীদের দেখেছি, কেউ কোন উপস্থাপন করতে গিয়ে ফেঁসে গেলে তাকে একটু টোকা দিয়ে ছেড়ে দিতে, খুব একটা প্যাঁচে কেউ কাউকে ফেলে না। কিন্তু সহপাঠীদের সামনে জীবনে খুব বেশিবার কোন কিছু উপস্থাপন করতে হয় না, নানা দেশের নানা রুচির মানুষের সামনেই হয়তো হাজিরা দিতে হবে বার বার।


মন্তব্য

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

পুলসিরাত তাইলে আপাতত পার!

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

ব্যাপারটা এখানেও হয় তবে সুইসদের মত না। এরা ভাল না লাগলে ততটা ঘাটায়না। "তোমারটা কিছুই হয়নি"-এ জাতীয় ভাবও দেখায়না। এদের প্রকাশটা পজেটিভ। পরামর্শের মধ্যে দিয়েই বুঝিয়ে দেবে তোমার আরো কাজ বাকি।

সম্প্রতি আমার বন্ধু বন থেকে টরন্টোতে এসেছিল একটা সেমিনারে। কানাডিয়ানদের সৌজন্যবোধ আর তার প্রকাশ নিয়ে সেতো মহা খুশি। এ থেকে জার্মানদের সম্পর্কে কিছুটা আঁচ করতে পারি। সুইসদের সম্পর্কে কোন ধারনাই ছিলনা। ধন্যবাদ হিমুকে।

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- বুয়েটের সঙ্গে কোন উদ্যোক্তার সম্পর্ক আছে কিনা জানি না তবে আইইউটির সঙ্গে গাজীপুরেই কোথায় যেন একটা পাওয়ার ইন্ডাস্ট্রীর কোলাবোরেশন আছে। একদম নিবিড় না হলেও সম্পর্কটা বোধকরি অনেক কাজে দেয় দুই পক্ষকেই।

বাংলাদেশের গোয়ামোটা উদ্যোক্তাদের ফেইলার কিছুটা হলেও দূর করতে পারস কিনা দেখ চেষ্টা করে।
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>

সবজান্তা এর ছবি

প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সেমিস্টারে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হল, প্রস্তুতি ছাড়া প্রেজেন্টেশন করবার। ৪- বিট কম্পুটারের প্রেজেন্টেশন পুরা পেচিয়ে ফেলেছিলাম !

ওই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে, প্রস্তুতি সহকারে ডি এস পি এর প্রেজেন্টেশন করলাম। এবার অনেক আরামে করা গেল। আসলেই, প্রস্তুতি না থাকলে ভারি লজ্জা।

প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে কারো সংযোগ আছে কিনা যানি না, আই ট্রিপল ই র স্টাডি টুর এর বেশ কিছু জায়গায় গিয়েছিলাম, এনার্জি প্যাক সহ।

আসলেই অনেক কিছু শেখার বাকি আছে এখন !
----------------------------------------------------
অলমিতি বিস্তারেণ

junayed এর ছবি

বাংলাদেশের শিল্পউদ্যোক্তাদের নাক যারপর নাই রকমের উচা।
উনাদের ধারনা টেকা দিলে কত্ত আইডিয়া পাওয়া যায়।
হিমু ভাই আশা করেন উনারা যাবেন বিশ্ববিদ্যালয়ে?

হিমু এর ছবি

এই ধারণার সাথে আমিও একমত। টাকা দিলে আইডিয়ার অভাব হবে না। তবে আইডিয়ার জন্য টাকা খরচের জায়গা হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়কে বেছে নেয়া উচিত। এতে করে বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন গবেষণার সুযোগ বাড়ে, ছাত্ররা গবেষণার কাজে সংযুক্ত হতে পারে, জ্ঞানের সাথে প্রয়োগের সমন্বয় বাড়ে। পাতার পর পাতা শিখে পরীক্ষার হলে উগড়ে দিয়ে এসে বসে থাকলে প্রকৌশলবিদ্যা পড়ার কোন মানে হয় না।

আমাদের দেশে উদ্ভাবননির্ভর উৎপাদন নেই বললেই চলে। যাদের হাতে টাকা ছিলো তাঁরা তৈরি পোশাক ব্যবসা বেছে নিয়েছেন হুড়মুড় করে, যে শিল্পের পেছনে ভারি যন্ত্রাংশ সমস্তটাই আসে দেশের বাইরে থেকে (চীন, কোরিয়া, তুরস্ক, জার্মানি ...), এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট উদ্ভাবনের ব্যাপারটিও বেদখল হয়ে যায়। উদ্ভাবিত প্রযুক্তিও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে শিল্পায়নের মুখ দেখে না। ফলে শিল্পের সাথে গবেষণার দূরত্ব ক্রমশ বাড়তেই থাকে।

আমরা সব ক্ষেত্রে ক্রমশ খুচরা ক্রেতায় পরিণত হচ্ছি। সব ক্ষেত্রেই আমরা লাইনে দাঁড়ানো দুই পয়সার খরিদ্দার। মুদিদের হাতে পড়ে শেষ হয়ে যাই শুধু।


হাঁটুপানির জলদস্যু

মাশীদ এর ছবি

তোর প্রেজেন্টেশান ভাল হওয়ার জন্য শুভ কামনা।
বুয়েটে আমাদের ডিপার্টমেন্টে বেশ কিছু প্রেজেন্টেশান ফেস করতে হয়েছিল। পরে মাস্টার্সের সময় দেখেছি সেগুলোর অভিজ্ঞতা বেশ কাজে এসেছে। তোদের ডিপার্টমেন্টের ৯৯ ব্যাচের একটা ছেলে এসেছিল সিঙ্গাপুরে। ওকে দেখেছিলাম সেখানে ওর প্রথম প্রেজেন্টেশান নিয়ে খুবই চিন্তিত। ওর থেকে শুনেছিলাম যে বুয়েটে ওদের কোন প্রেজেন্টেশান করতে হয়নি। খুব অবাক হয়েছিলাম শুনে। আসলেই কি তাই? তোরা কি বুয়েটে কোন প্রেজেন্টেশান করিসনি?


ভাল আছি, ভাল থেকো।


ভাল আছি, ভাল থেকো।

হিমু এর ছবি
বিবাগিনী এর ছবি

হায়রে বুয়েটের প্রেজেন্টেশন রে!মনে করায় দিলা গুরু!
হিমু ভাইয়া বেস্ট অফ লাক।

‌‌::একাকিত্বের বিলাস আমার অনেকদিনের সাধ::

দুর্দান্ত এর ছবি

হিমু ভাই কি specifically বায়ুশক্তি নিয়া কাজ করতাসেন? তাইলে দুইটা কথা ছিল। কিসুদিন আগে চামে একটা ইমেইল মারসিলাম, পাইসিলেন?

হিমু এর ছবি

আমি এখনো সবকিছুর অ-আ-ক-খ শেখার পর্যায়ে আছি। তবে বায়ুশক্তির ওপর ফোকাস কিছুটা বেশিই এই প্রোগ্রামে।


হাঁটুপানির জলদস্যু

দ্রোহী এর ছবি

মঙ্লবার থেকে পরীক্ষা শুরু। একটা প্রেজেন্টেশন দিতে হবে সকাল নয়টা তিরিশে - ১৫ মিনিটের প্রেজেন্টেশন। পুরো কোর্সের ৪৫% নাম্বার এই একটা প্রেজেন্টেশনের উপর নির্ভর করছে। কোর্সটিতে আমার এখনো "এ" আছে, তবে প্রেজেন্টেশনের পর "সি" হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া য়ায় না।


কি মাঝি? ডরাইলা?

হিমু এর ছবি

সকালে বেশি করে মিষ্টি জিনিস খান। কফি আর চকোলেট খাওয়া যাবে না। প্রেজেন্টেশন গড়গড়িয়ে পার হয়ে যাবে।


হাঁটুপানির জলদস্যু

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।