কৃৎ-প্রত্যয়

হিমু এর ছবি
লিখেছেন হিমু (তারিখ: সোম, ১০/০৩/২০০৮ - ৭:৪৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

তারেক মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখে কাপগুলোকে। চীনামাটির পেয়ালা, ধবধবে সাদা, তার ওপর নীলের সরু কারুকাজ। ফ্যাকাসে, মলিন, মৃত সাদা রং নয়, কাপটি যেন তার ধবল রঙেই প্রাণ পেয়েছে একটি বলাকার মতো, আর নীল নকশী বলয়টি যেন তার কণ্ঠহার।

চারপাশে ঘুরঘুর করছে অন্যান্য ক্রেতারা। বিশাল জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠা বিক্রয়কেন্দ্র, ইকেয়া। ঘরের সব প্রয়োজনীয় জিনিস মেলে এখানে, ময়লা ফেলার টুকরি থেকে শুরু করে পুরো রান্নাঘর বা আস্ত শোবার ঘরের সরঞ্জাম। বিরাট সব শেলফে থরে থরে সাজানো এক একটা আইটেম। দামগুলো দেখে তারেক একটু দমে যায় শুধু, পৃথিবীর সব সুন্দর জিনিসগুলোর দাম এত বেশি কেন হবে? হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতেও মন সায় দেয় না তারেকের। কী লাভ? এ তো অন্যের রয়ে যাবে, তার নিজের হবে না!

তারেকের বউ মুনিরা চড়ুই পাখির মতো লাফিয়ে বেড়াচ্ছে এক একটা জিনিসের সামনে। সে মোটে পরশুদিন পা ফেলেছে এই দানবদের দেশে। তারেক আর মুনিরার বিয়ে হয়েছে প্রায় বছরখানেক আগে, ভিসার নানা শর্ত পূরণ করতে গিয়ে জার্মানীতে আসার আগে মুনিরা এক বছরের বিরহ উপহার দিয়েছে তারেককে। মুনিরার অবশ্য বক্তব্য উল্টোরকম, তারেক কেন এরকম পচা দেশে থাকে, যেখানে সে চাইলেই চলে আসতে পারেনি এক বছর আগে, এ নিয়ে তার অভিযোগের অন্ত ছিলো না এই একটা বছরে। একটা দিন বেচারীকে বিশ্রাম করতে দিয়েই বেরিয়ে পড়েছে তারেক। ইকেয়া থেকে হাত বোঝাই করে কেনাকাটা করে নিয়ে যাবে সে আজ। তাদের নতুন সংসার, হাত খুলে তারা দু'জন মিলে সাজাবে।

তারেক ডাক দেয়, "মুনিরা! দেখে যাও কাপগুলো।"

মুনিরা ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে ছুটে এলো। "কোনটা, কোনটা?"

তারেক আঙুল তুলে দেখায়। "এটা কেমন হয়?"

মুনিরা কাপটা হাতে নিয়ে দেখে। "এটা? এত বড় কাপ? না না না। আরো ছোট দরকার। এটা তো পুরো গোসল করার মগের মতো বড়ো! ... ঐ যে আরো ওপরে, ঐ যে হালকা সবুজের ওপর সাদার বর্ডার, ওটা দ্যাখো না!"

তারেক হাত বাড়িয়ে মুনিরার নাগালের বাইরে সাজানো কাপটা নামিয়ে আনে।

"কী লেখা এখানে?" মুনিরা পড়ার চেষ্টা করে।

"পড়ো দেখি, কেমন জার্মান শিখেছো এতদিন ধরে!" তারেক কপট গাম্ভীর্য নিয়ে প্রাইমারি স্কুলের মাস্টারদের ভঙ্গিতে বুকে হাত বাঁধে।

মুনিরা ঝাঁঝিয়ে ওঠে, "পারবো না! বিশ্রী একটা ভাষা!"

তারেক হাত বাড়িয়ে কাপের মধ্যে গোঁজা কার্ডটা পড়ে। "বারো পিস কাপ আর পিরিচ, ঊনিশ ইউরো পঁয়তাল্লিশ সেন্ট।"

মুনিরা মনমরা হয়ে বলে, "এত?"

তারেক হাসে। "মনে মনে আটানব্বই দিয়ে গুণ করছো নাকি? তাহলে কিন্তু চলতে ফিরতে বিপদে পড়বে।"

মুনিরা হাসে না। শুকনো মুখে বলে, "এই নীলটার দাম কতো দ্যাখো তো?"

তারেক নীল কাপটার শেলফের দিকে তাকায়। "এটাও বারো পিস, একুশ ইউরো।"

মুনিরা বলে, "তাহলে কি এই লাল সেটটা নিয়ে যাবো? এটা একটু সস্তা, ষোল ইউরো সত্তর সেন্ট, বারোটা।"

তারেক বলে, "বাহ, এই তো বেশ পড়তে পারছো ! যাক, তুমি কিছুটা শিক্ষিৎ তাহলে!"

মুনিরা কোন দ্বিধা না করেই কিল মারে তারেকের বাহুতে।

"লাল রঙের কাপে চা দিলে খাবে কেউ?" তারেক ছোট সাইজের আরেকটা নীল সেট উল্টেপাল্টে দ্যাখে। হালকা সবুজ রঙের কাপটা তার পছন্দ হয়নি। নীল কাপটার মধ্যে নকশাটা তার খুব মনে ধরেছে। মুনিরাও জানে, নীল রং তারেকের খুব পছন্দ। তাদের শোবার ঘরের পর্দাগুলো নীল, বিছানার চাদর, বালিশের ওয়াড়, কম্বলের খোল, সব নীল।

"অনেক দাম পড়ে যাবে না?" মুনিরা কিন্তু-কিন্তু মুখ করে বলে।

"উঁহু। ঠিকই আছে।" তারেক আশ্বস্ত করে মুনিরাকে। "চলো, ভাগেনে রাখি সেটটা।"

কাগজের শক্ত মোড়কে রাখা কাপ আর পিরিচগুলোকে যত্ন করে ট্রলিতে সাজাতে শুরু করে মুনিরা। ট্রলিতে আরো দেখা যাচ্ছে একটা সসপ্যান, বড় দুটো ডেগচি, একটা কাঁচের জগ, একটা কাঠের খুন্তির সেট।

"কেমন লাগছে এখানটা?" তারেক হাসিমুখে জিজ্ঞেস করে মুনিরাকে।

"দারুণ!" উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে মুনিরা। "ইচ্ছা করছে সবকিছু কিনে নিয়ে যাই!"

তারেক হাসে। ইকেয়ার ভেতরটা এত সুন্দর করে সাজানো, কোন কিছুর দরকার না থাকলেও কিনে ফেলতে ইচ্ছা করে। মাঝে মাঝে বাড়িতে ইকেয়ার বিজ্ঞাপন দিয়ে যায় ওদের লোকজন, ঝকঝকে মসৃণ কাগজে দামী ছাপা একেকটা ছবির বই, তাতে সুন্দর সুন্দর জিনিসের ছবি আর দাম। সেই বইয়ের ঘরগুলো দেখলে তারেকের মন খারাপ হয়। তাকে আরো অনেক পথ পেরোতে হবে ওরকম একটা ঘরের জন্য।

মুনিরা আবারও তুরতুর করতে থাকে বিভিন্ন শেলফের সামনে গিয়ে। কোন কিছু পছন্দ হলে সেটা উল্টেপাল্টে দেখে সে ঝুঁকে পড়ে শেলফের গায়ে লেখা দাম পড়ার চেষ্টা করে। তারেক নিজে যেদিন প্রথম ইকেয়াতে এসেছিলো, সেদিনের কথা মনে করার চেষ্টা করে। মুনিরার মতোই ভালো লেগেছিলো তার। অবশ্য তখন তার একার প্রয়োজনটুকু মেটানোর জন্যেই যা কিছু কেনাকাটা করার ছিলো, তখনও তার কোন আয় নেই, অনিশ্চিত একটা জীবন সামনে, দেশ থেকে সঙ্গে করে আনা সামান্য টাকার একটা অংশ দিয়ে রান্নাবান্নার জিনিস কিনেছিলো তারেক। বেছে বেছে সবচেয়ে সস্তা জিনিসটা কিনেছিলো তখন। ঢাউস খাবার প্লেট, ঠনঠনে সসপ্যান, সবচেয়ে সস্তা কম্বলের খোল। তারেকের হঠাৎ খুব ভালো লাগে আজকের এই দিনটা। তার নতুন করে সাজানোর সময় এসেছে সবকিছু, সেই সঙ্গতিও এখন তার আছে। সেই প্রথমবারের মতো ইকেয়ার শেলফগুলোর সামনে মনমরা হয়ে ঘুরে বেড়াতে হবে না তাকে আর মুনিরাকে, সবচেয়ে সস্তা জিনিসটা কিনে নিজেকে অকারণ প্রবোধ দিতে হবে না। তারেক টের পায়, সে খুব হাসছে, সুখী একজন মানুষের মতো। তার ইচ্ছা করে এখনই, এই মূহুর্তে কিছুদূরে দাঁড়িয়ে ডালের চামচের দাম পড়তে থাকা মুনিরাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে।

মুনিরা ডালের চামচটা রাখে ট্রলিতে। "এটার দাম ভালো, নব্বই সেন্ট!"

তারেক বলে, "নিউ মার্কেটে কতো হবে, বলো দেখি?"

মুনিরা কিছুক্ষণ ভাবে। "উমমমম, কতো আর, চল্লিশ টাকা, খুব বেশি হলে?"

তারেক হাসে মিটিমিটি। "তুমি কখনো নিউ মার্কেট থেকে ডালের চামচ কিনেছো?"

মুনিরা মাথা নেড়ে হাসে। "না তো! যা লাগে আব্বা নাহলে আম্মা গিয়ে কিনে এনেছে সব সময়। আমি নিউ মার্কেট থেকে শুধু চুড়ি কিনি!"

তারেক হাসে। নিউ মার্কেটে মেয়েদের সাথে গিয়ে কোন কিছু কেনাকাটা করার বড় হ্যাপা। মেয়েরা যেমন সবকিছু খুঁটিয়ে দেখে একটা কিছু পছন্দ করে প্রচুর দরদাম করে কিনতে পারে, সেটা ছেলেরা পারে না বলেই তার বিশ্বাস।

"তোমার উচিত ছিলো আম্মাকে নিয়ে একবার নিউ মার্কেটে গিয়ে ডালের চামচ কেনা।" তারেক হাসে নিজের মায়ের কথা মনে করে। কেনাকাটা করতে তারেকের মা বেশ ভালোবাসেন। তাঁর পছন্দ সংসারের টুকিটাকি জিনিস। সবচেয়ে ভালো জিনিসটা সম্ভাব্য সবচেয়ে কম দামে কিনে আনবেন, এটাই তাঁর কেনাকাটার লক্ষ্য। তারেক যখন কলেজে পড়ে, তখন একবার মায়ের সাথে নিউ মার্কেটে গিয়েছিলো, দশ মিনিট দরাদরি করে একটা ডাল ঘুঁটুনির দাম কুড়ি টাকা থেকে পনেরো টাকায় নামিয়ে তারেকের মা খুব খুশি হয়েছিলেন। তারেক অবশ্য মোচড়ামুচড়ি করছিলো, তারেকের মা সাফ বকে দিয়েছিলেন তাকে সবার সামনে, "তর তাড়াহুড়া থাকলে তুই যাগা। জিনিসপত্র কিনার সময় প্যাটপ্যাট করবি না!" তারেক অনেক পরে ধরতে পেরেছে, এই দামাদামিটা করতেই তার মা ভালোবাসেন।

"কেন?" মুনিরা দ্বিতীয়বারের মতো প্রশ্ন করে। তারেক স্মৃতিচারণে ডুবে ছিলো বলে খেয়াল করেনি, বাহুতে খোঁচা খেয়ে সে আবার ফিরে আসে ইকেয়ার রান্নাবান্নার সরঞ্জামের বিভাগে।

"কী কেন?"

"মায়ের সাথে নিউ মার্কেটে গিয়ে কিনলে কী হতো?" মুনিরা প্রশ্ন করে বিশদভাবে।

"ওহ ... নাহ, তাহলে ডালের চামচ তিরিশ টাকায় কিনতে পারতে। আম্মাকে ঠকায় এমন দোকানী ভূভারতে নেই।"

"এখানে আসলে মা তাহলে মজা পাবেন না একদম।" মুনিরা হাসে। "এখানে সব কিছুর ফিক্সড প্রাইস।"

তারেক ভাবে, তার মা কখনো জার্মানীতে এলে ইকেয়াতে ঘুরিয়ে দেখাতে হবে। এতো চমৎকার একটা কেনাকাটার জায়গা দেখলে তিনি মুগ্ধ হবেন নিশ্চয়ই। ঢাকায় নিশ্চয়ই এমন একটা জায়গা আজও খোলেনি, যেখানে বিশাল ছাদের নিচে ঘরভর্তি শুধু বিভিন্ন জিনিস শেলফে বোঝাই করা, কোন দোকানী নেই, দামাদামি হাঁকাহাঁকির প্রয়োজন নেই, শুধু তুলে ট্রলিতে রাখো আর দাম মিটিয়ে বেরিয়ে পড়ো।

"তুমি নাকি কেনাকাটার সময় মা-কে খুব জ্বালাতন করো?" মুনিরা প্রশ্ন করলো।

"আমি? আমি কিভাবে জ্বালাতন করবো?" তারেক ন্যাকা সাজে।

"তুমি নাকি শুধু হুড়োহুড়ি করো। খালি নাকি জলদি জলদি করতে বলো?"

তারেক হাসে। দেশে থাকতে কেনাকাটার কাজটায় সে বরাবরই ফাঁকি দিয়ে এসেছে। ওটা তার ভাই বা বোন বা মা বরাবর করেন। কখনোসখনো মায়ের সাথে তারেককে যেতে হয়েছে, দোকানে গিয়ে কেনাকাটা করতে তার হাঁসফাঁস লাগতো। আর কেনাকাটা হতোও সব মেয়েলি জিনিস, এর বিয়েতে শাড়ি, ওর বিয়েতে ডিনার সেট, ওর জন্মদিনে বাচ্চার জন্য জামা। তারেক নিজের কেনাকাটা সব দুমদাম করে মিটিয়ে ফেলেছে সারাজীবন। এলিফ্যান্ট রোডে বাঁধা দোকান, তেত্রিশ ইঞ্চি কোমরের জিন্সের প্যান্ট, দাম কতো বললেন ... আটশো? ধুর ভাই, খামাকা সময় নষ্ট করেন। পাঁচশো। এই দুটা নিচ্ছি। এক হাজার। না, আর দিবো না।

তারেক কৈফিয়ত দ্যায়, "আমার আসলে ঐ রসিয়ে রসিয়ে কেনাকাটার রসটা ঠিক ... কী বলে এটাকে ... বোঝার সুযোগ আসেনি। আম্মা তো খুব দেখেশুনে দরদাম করে কেনেন, আমার ধৈর্যে কুলায় না। ... কিন্তু তুমি জানলে কিভাবে?"

মুনিরা বলে, "আবার কিভাবে? মা-ই বলছিলেন একদিন বিরক্ত হয়ে। বললেন জার্মানী গিয়ে দেখেশুনে সবকিছু কিনতে, তুমি ধমকাধমকি করলে উল্টে তোমাকে ধমক দিতে।"

তারেক গম্ভীর মুখে বলে, "বেশ। দেখেশুনেই কেনো। কিচ্ছু বলছি না।"

মুনিরা এগিয়ে যায় একগাদা পাপোষের দিকে। তারেক হঠাৎ একটু অপরাধবোধে ভুগতে থাকে। একটু আগে নিজের ভালো লাগার কথা ভেবে সে হঠাৎ বুঝতে পারে, এই যে কেনাকাটা করতে আসা, খুব বেছে বেছে কেনা, দরদাম করা, এর পেছনের আনন্দটুকু অন্যরকম, শুধু খরচ করায় নয়, খরচ বাঁচানোতেও নয়। নিজের সংসারটা তিল তিল করে সাজানোর তৃপ্তিটুকু আজ কাজ করছে তার মধ্যে, তার মায়ের মনেও নিশ্চয়ই এই একই ভালোলাগাটুকু কাজ করেছে এতটা দিন। নিউ মার্কেটে পনেরো টাকা দিয়ে সেই ডাল ঘুঁটুনিটা কেনা কি শুধু দরদাম করে পাঁচটা টাকা কমানোর জন্যেই? আম্মা নিশ্চয়ই সেই সময়টুকু উপভোগ করছিলেন খুব, রোদের নিচে দাঁড়িয়ে, রুমাল দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে তারেকের চোখে একইরকম বিশপঁচিশটা ডাল ঘুঁটুনির মধ্যে তাঁর চোখে সেরাটা বেছে কেনার প্রত্যেকটা মূহুর্ত নিশ্চয়ই উপভোগ করছিলেন তিনি। একই রকম ভাবে তারেকের খালাতো ভাইয়ের বিয়েতে কেনা শাড়ি, চাচাতো বোনের বিয়েতে কেনা ঘড়ি ... প্রত্যেকটা জিনিস কেনার সময়ই এই যত্নটুকু, এই আনন্দটুকু কাজ করেছে তাঁর মধ্যে। তারেক প্রত্যেকবারই বিরক্ত মুখে তাগাদা দিয়েছে তাঁকে। আজ যদি কেউ তারেককে হুড়ো দিয়ে বার করে নিয়ে আসে ইকেয়া থেকে, তার কি আদৌ ভালো লাগবে?

মুনিরা একটা পাপোষ নিয়ে দৌড়ে আসে। "দ্যাখো, এটাতে ভিলকমেন লেখা। দাম লেখা আট ইউরো! এটা কি ঠিক আছে?"

তারেক মাথা দোলায়। "ঠিক আছে।"

মুনিরা ট্রলিতে পাপোষটা রেখে আবার ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে যায় অন্যদিকে। তারেক এগিয়ে গিয়ে পাপোষটা ভাঁজ করে রাখে ট্রলির নিচের দিকে। একটা কাপ বেরিয়ে পড়েছে প্যাকেটের ভেতর থেকে, সেটাকে আবার ভেতরে গুঁজে দেয় সে। সুন্দর সেটটা। তার সংসারের প্রথম কাপ সেট।

কাপ নিয়ে একটা স্মৃতি খচ করে ওঠে তারেকের ভেতর। তার মুখের ভেতরটা নিমিষে তিক্ত হয়ে যায়। বাবা মারা যাবার কিছুদিন পর একটা কাপ তারেক ভেঙে ফেলেছিলো। মা তখন খুব মানসিক বিপর্যয়ের মুখে ছিলেন, তিনি হাঁ হাঁ করে ছুটে এসেছিলেন, "করলি কি এইটা? ভাইঙ্গা ফালাইলি? তর আব্বার হাতের কাপটা!"

তারেক সেদিন খুব তীব্রভাবে বকেছিলো মা-কে। কেন, কে জানে? হয়তো বাবার স্মৃতির সাথে জড়িত প্রত্যেকটা জিনিস নিয়ে মায়ের এই খুঁতখুঁতুমি দেখেই। তারেকের মা অসহায় মুখে বলেছিলেন, "এইটা একটা স্মৃতি, আমরা পয়লা পরথম কিনলাম, আমাগো সংসারের প্রথম কাপ সেট, ভাইঙ্গা ফালাইলি, আর আমি রাগ করুম না? মানুষটা নাই, জিনিসটা তো আছে!"

তারেক আরো চেঁচামেচি করেছিলো সেদিন মায়ের সাথে। তারেকের মা কিছুক্ষণ গুম মেরে থেকে রান্নাঘরে চলে গিয়েছিলেন। একটু পর কাপ ভাঙার ঝন ঝন আওয়াজ শুনে তারেক দৌড়ে গিয়ে দ্যাখে, সেই সেটের বাকি কাপ আর পিরিচ মা আছড়ে আছড়ে ভাঙছেন। তারেক কিছু বলেনি আর। মা-ও কিছু বলেননি।

তারেকের বুকটা ধ্বকধ্বক করতে থাকে। মা-কে সেদিন সে যা বোঝাতে চেয়েছিলো, বোঝাতে পারেনি। তারেক শুধু বলতে চেয়েছিলো, একটা কাপের চেয়ে তারেকের নিজের মূল্য কি স্মৃতি হিসেবে বড় নয়? কাপটা ভেঙে গেছে, কিন্তু তারেক আছে, তার ভাই আর বোন আছে, তারও তো সবাই তাদের বাবার স্মৃতিই। একটা সামান্য কাপ নিয়ে কেন মা এতো রাগ করবেন?

তারেকের চোখে আচমকা জল চলে আসে। সে বুঝতে পারে, সেদিন সেই ভেঙে ফেলা কাপটা আর কাপগুলোর কাছে সে কিছুই না। তার, তার ভাইয়ের, তার বোনের চেয়ে অনেক উঁচুতে বসে আছে সেই কাপটা, সেই কাপগুলো। সেই কাপগুলো যখন কিনতে বেরিয়েছিলো তার বাবা, মা-ও কি ছিলেন না সাথে? নিউ মার্কেটের কোন দোকান থেকে হয়তো বিস্তর দরদাম করে কিনেছিলেন সেই সেটটা, তাঁদের সংসারের প্রথম কাপ সেট, কত আনন্দ তার সাথে জড়ানো। তখন তারেক ছিলো না, ছিলো না তার ভাই, তার বোন, শুধু বাবা ছিলেন, মা ছিলেন, আর সেই কাপ সেটটা ছিলো। নতুন সংসার গোছানোর আনন্দটা ছিলো। আজ যেমন তারেক মুনিরাকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে কেনাকাটা করছে ভিন দেশের দোকানে, যে গভীর আনন্দ তাকে গ্রাস করেছিলো কিছুক্ষণ আগে, সেই একই আনন্দ জড়ানো সেই ভেঙে ফেলা কাপগুলোর সাথে।

তারেক মুনিরাকে এগিয়ে আসতে দেখে দ্রুত মুখ ফেরায়। মুনিরা ঝলমলে মুখে একটা ফ্লাওয়ার ভাস হাতে নিয়ে বলে, "তেরো ইউরো! সুন্দর না?"

তারেক মাথা দোলায়। সুন্দর।

মুনিরা সন্তর্পণে ট্রলিতে ভাসটা রেখে আবার ফিরে যায় অন্যদিকে।

তারেক পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বার করে। খুব কি দেরি হয়ে গেলো? প্রায় তেরো বছর। মাপ চাওয়ার জন্য খুব কি দেরি হয়ে গেলো? তার তো সংসার ছিলো না এতদিন, সে কিভাবে বুঝবে এই ভালোবাসার কথা? মা বুঝবেন নিশ্চয়ই।

তারেক কাঁপা হাতে ডায়াল ঘোরায়। দূরে মুনিরা ঝুঁকে পড়ে কী যেন দেখছে। তারেকের সংসার একটু একটু করে সেজে উঠছে ইকেয়ার রঙিন আলোয় ভরা ছাদের নিচে।

[সমাপ্ত]


মন্তব্য

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

জমজমাট।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

শিক্ষানবিস এর ছবি

খুব ভাল লাগল।

---------------------------------
মুহাম্মদ

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- তারেকের গায়ের রং কী রে? (ঈমাণে ক'বি)
লেখাটা ভালো না লাগার মতো কোনো কারণ নেই। তবে স্মৃতির জায়গাটা নিয়ে কিছুটা দ্বিমতের লঘু উপস্থিতি টের পাচ্ছি।
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>

হিমু এর ছবি

ধন্যবাদ। তা-ও ভালো মুনিরার ব্রায়ের মাপ জানতে চাস নাই। তোর মতো কৌতূহলী পাঠক, যে গল্প পার হয়ে আরো ভিতরে বাম হাত ঢুকাতে চায়, সত্যিই বিরল।


হাঁটুপানির জলদস্যু

পরিবর্তনশীল এর ছবি

ভালো হইছে।
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

জাহিদ হোসেন এর ছবি

উফফ-ভারী ভাল লাগলো। তবে দুঃখটা হোল এই যে এতদিন ধরে আইকিয়াতে ঘোরাঘুরি করলাম আমি, আর গল্পটা ধরা দিলো আপনার হাতে! ফেয়ার না।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

জীবনের গল্প...

কনফুসিয়াস এর ছবি

দারুন লাগলো।
-----------------------------------
... করি বাংলায় চিৎকার ...

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

মাশীদ এর ছবি

দুর্দান্ত।
খুব ভাল লাগল কারণ অনেক কিছুর সাথে রিলেট করতে পেরেছি।

ইকিয়ার (আসল উচ্চারণটা কি? ইকেয়া, ইকিয়া না আইকিয়া?) সাথে আমার সম্পর্কটাও খুব গভীর। দেশ ছেড়ে প্রথম যখন সিঙ্গাপুর গেলাম তখন মন স্বভাবতই খুব খারাপ থাকত। কপালগুণে আমার হোস্টেল ছিল ইকিয়ার খুব কাছে। আমার যখনই মন বেশি খারাপ থাকত, আমি ইকিয়ায় গিয়ে ঘুরে বেড়াতাম আর ভাবতাম পড়ার পাট চুকিয়ে সংসার শুরু করলে ইকিয়ার কি কি দিয়ে সাজাবো আমাদের বাড়ি। টুকটাক করে কিনেও রাখতাম অনেক কিছু। মালেশিয়াতে আমার একটা বড় দুঃখ হচ্ছে ইকিয়া বাসা থেকে অনেক দূরে। তারপরেও সুযোগ হলেই চলে যাই। এখন বাসার অনেক কিছুই ইকিয়া থেকে কেনা। মজাই লাগে।

কাপ সেটটার কথায় আমার একটা গ্লাস সেটের কথা মনে পড়ে গেল। বিয়ের পরপরই সিঙ্গাপুর চলে গেলাম আমি, তার একমাসের মাথায় অপু গেল মালেশিয়া। সেখানে ও যে বাড়িটায় থাকত, সেটার জন্য কেনা প্রথম দিকের জিনিসগুলোর মধ্যে একটা ছিল একটা গ্লাস সেট। এরপর অনেক কিছু কেনা হয়েছে, কিন্তু এখনো ওটা আমার প্রিয় জিনিসের তালিকার উপরের দিকে থাকে সবসময়। অপুর সাথে ঝগড়া হলেই আমি যখন মনে মনে ঠিক করি কি কি জিনিস সাথে নিয়ে বাড়ি ছাড়ব, আমার পাসপোর্ট আর ল্যাপটপের সাথে ঐ গ্লাস সেটটাও ঢুকে পড়ে মনে।

তোর এই লেখা পড়ে আরো মনে পড়ে গেল আম্মার সাথে নিউ মার্কেট বা অন্য অপেক্ষাকৃত আরো 'নিউ' মার্কেটগুলোয় ঘুরে ঘুরে কেমন করে বাসার জিনিস বা কারো বিয়ে-জন্মদিনের গিফট্ কিনতাম। তুই ঠিক ধরেছিস, যেকোন কিছু কেনার মধ্যে - সে নিজের জন্যই হোক বার অন্য কারো - কতটা এফোর্ট আর যত্ন যে থাকতে পারে সেটা এখন দেখি আম্মার থেকে আমার মধ্যেও সংক্রমিত হয়ে গেছে। আম্মা যেবার বেড়াতে আসল, সেবার সিঙ্গাপুরের দর্শনীয় স্থানগুলোর একটা ইকিয়া ছিল, বলাই বাহুল্য।


ভাল আছি, ভাল থেকো।


ভাল আছি, ভাল থেকো।

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- উচ্চারণটা ইকেয়া
জার্মানরা I কে বলে ই, E-কে বলে এ, A-কে বলে আ। IKEA- সেই মতে ইক-এয়া ই হয়।
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>

মাশীদ এর ছবি

বুঝলাম।
তবে আসল দোকানটাতো সুইডিশ, জার্মান না। সুইডিশ উচ্চারণও কি জার্মানের মত?


ভাল আছি, ভাল থেকো।


ভাল আছি, ভাল থেকো।

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- কিছুটা কাছাকাছি। তবে IKEA-র ব্যাপারে জানি না। এক কাজ করুম নে। সুইডেন যাওয়ার এট্টা প্ল্যান আছে। ওখানে গিয়া সরেজমিন তদন্ত করিয়া অবশেষে কমিশন রিপোর্ট দিবো নে!
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>

কনফুসিয়াস এর ছবি

এইখানে আইকেয়া কয়। নো হাঙ্কি পাঙ্কি।
-----------------------------------
... করি বাংলায় চিৎকার ...

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- আম্রিকানরাতো পাসওয়ার্ডরে কয় পেসওয়ার্ড আর সেমিরে কয় সেমাই! আংরেজী বুলনেওয়ালা'রা আসলেই কেমন জানি হাংকি পাংকি করে, ঈমাণে কই।
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।