একটি মোবাইলজনিত দুর্ঘটনা

হিমু এর ছবি
লিখেছেন হিমু (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৬/০৩/২০০৮ - ৮:১২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

[শিরোনাম দেখেই বোঝা যায়, গল্পের নামকরণে আমি শিব্রামসমর্থিত গুন্ডাসাহিত্যিক গ্রুপের পান্ডা৷ যদি কেউ না বোঝেন তাই আবার লিখে দিলাম৷ গল্পের তারিখ দেখাচ্ছে 26শে মে, 2004৷ ম্যালেরিয়ার প্রথম ধাক্কাটা তখন সবেমাত্র গেছে৷ মাথাও আউলানো৷ কী লিখতে কী লিখেছি নিজেরই খায়াল নাই৷ হরলিক্সেরও একটা ভূমিকা আছে৷ সাইজেও ব্যাপক৷ যারা সাইজ নিয়ে ঘ্যান ঘ্যান করেন তাঁদের ঠুকে মারি৷ জয় মা সাইজেশ্বরী!]

১.

পিন্টুর মেজমামাকে দেখে আমরা খানিকটা অবাক হই৷ দেখা হওয়ার পর থেকেই সেই যে দাঁত বের নিঃশব্দ ভেটকি দিয়ে আছেন, কিছুতেই আর বুঁজে আসছে না সেটা৷

আমরা নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করি, অ্যাতো ফূর্তির কী পেয়েছে ব্যাটা?

আমাদের ফিসফাস দেখে মামার হাসি চওড়া হয় শুধু, সেই সাথে একটা বিড়ি হাঁকান তিনি৷

'কী হয়েছে?' অনেক শলাপরামর্শের পর শেষ পর্যন্ত জানতে চাই আমি৷

'হে হে হে ---,' অ্যাতোক্ষণে হাসিটা একটা শব্দ খুঁজে পায়, '--- তোদের দোস্তো, হে হে হে ---৷'

'কোন দোস্তো?'

'মোফা! বুঝলি, অ্যামন ইয়ে না ---৷'

'কিয়ে?'

'বেকুব, আবুল একটা!'

'কেন? কী হয়েছে?'

'আবার হাসপাতালে গেছে ব্যাটা!'

আমরা আঁতকে উঠি৷ 'কেন?'

'ধোলাই খেয়েছে৷' মামা হাসেন খিলখিল করে৷

'কে দিলো?'

'একটা লোক আর আমি৷'

এবার আমরা আগ্রহী হয়ে উঠি৷ একটা লোক মোফাকে ঠেঙিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়েছে, এ এমন নতুন কিছু নয়, কিন্তু মামাও দুচার ঘা লাগিয়ে দিয়েছেন! --- আমাদের ঘনীভূত আগ্রহ দেখে মামা বিড়ি নামিয়ে জুম্মনকে হাঁক পেড়ে ডাকেন৷

২.

গতকাল মোফার সাথে মামার দেখা, এই চায়ের দোকানেই৷ ভারি আনন্দিত মুখে বসে বসে চায়ের কাপে সাহিত্যিকসুলভ সশব্দ, রসিক চুমুক মারছিলো সে, মামাকে দেখেই উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে মোফা, মহা আপ্যায়ন করে বসায় তাঁকে৷ জানায়, তার একটা কবিতা, উকুন, শকুন যতো দুধভাত এঁটো করে যায়, এটা দুই বাংলার বিপ্লবী কবিতা সংকলনে স্থান পেয়েছে, এবং এ বাবদ সে কয়েকজন স্বদেশী ও পরদেশী মহিলা ভক্তের গদগদ পত্রও পেয়েছে৷ এসব নিয়ে মামা অতটা মাথা ঘামান না, তিনি জানতে চান, মালকড়ি কিছু জুটেছে কি না মোফার কপালে৷ জবাবে মোফা জানায়, মালকড়ি তার কাছে কিছু আছে, মামা যদি চান, তবে এই আনন্দসংবাদকে সেলিব্রেট করা যেতে পারে, ওমিনাস পিত্‍সাখানায়, পিত্‍সা আর হরলিক্স সহযোগে৷

এ পর্যায়ে আমরা ক্ষেপে উঠি৷ মোফাকে আরেকদফা প্যাঁদানোর একটা অন্যায় ইচ্ছা মনের মধ্যে বাড়তে থাকে৷ বেরোক না শালা একটিবার হাসপাতাল থেকে, তদ্দন্ডেই ওকে আবার ঠেঙিয়ে তার ভেতরেই ফেরত পাঠাবো৷ হতচ্ছাড়াটা আমাদের বাদ দিয়েই শুধু মামাকে খাওয়ালো? তাও পিত্‍সা আর হরলিক্স?

হ্যাঁ, তাই৷ মোফার এই আব্দার মামা না মেনে পারলেন না, পিত্‍সা খাবেন বলেই কয়েকদিন ধরে মুরগি খুঁজছিলেন তিনি৷ মোফা ছাগলটা তার বাইসাইকেলে ডাবল রাইড করে মামাকে সেই সুদূর ওমিনাসে নিয়ে যেতে চাইছিলো, ধমক খেয়ে সে একটা রিকশা ডাকলো, সাইকেলটা রেখে গেলে কলিমুদ্দির তত্ত্বাবধানে৷

ওমিনাস পিত্‍সাখানা একটা ঘুটঘুটে দেড়তালা বাড়িতে, আগে সম্ভবত সেখানে বিড়ির কারখানা বা ম্যাসেজ পারলার ছিলো৷ কিন্তু বাড়িটার যথাযথ সত্‍কার করে বর্তমান ভাড়াটে সেটাকে একেবারে জটিল একটি গাঁজার আড্ডার রূপ দিয়েছেন৷ আধো আলো আধো অন্ধকারে এখানে কবি সাহিত্যক আর বখে যাওয়া ছেলেমেয়েরা পিত্‍সা খেতে আসে৷ শুনেছি সেখানে রাত ন'টার পর বড় পানিও পাওয়া যায়, কিন্তু পরিবেশন করা হয় শুধু বাছা বাছা কয়েকজনকে৷ এমন একটা মাফিয়ামার্কা জায়গায় কেন মোফা খেতে বা খাওয়াতে উত্‍সুক, আমরা বুঝি না৷

কিন্তু মামা গোমর ফাঁক করেন৷ ওমিনাস পিত্‍সাখানার মালিক নাকি আগে একটা বিপ্লবী ম্যাগাজিন সম্পাদনা করতো, আর মোফা তাতে অনেক অনলগর্ভা কবিতা, গল্প আর আর্টিকেল ঝেড়েছে, সম্মানী চুকিয়ে দিয়ে তাকে অসম্মান করার মতো অবিপ্লবীজনোচিত কাজ করার স্পর্ধা সম্পাদক দেখাননি৷ কাজেই মোফার হিসেব অনুযায়ী বেশ মোটা অঙ্কের টাকা সে পায়, এবং সেটা বাটর্ার পদ্ধতিতে শোধ না করা হলে সত্যিকারের বিপ্লব করার হুমকি দিয়েছে সে, আর ঐ এলাকার প্রতিষ্ঠিত মাস্তান দামড়া দিলদার ভাই মোফার দুঃসম্পর্কের খালু৷ তাই সেই সম্পাদক রাজি হয়ে গেছেন মোফার প্রস্তাবে৷

মামা ওমিনাসে পৌঁছে মোফার মোঘলাই হালচাল দেখে হতবাক৷ সে এক জাহাঙ্গিরি তুড়ি দিয়ে এক ইয়া মুশকো ওয়েটারকে ডাকে, তারপর কষে ধমকায়, 'একটা একফুটি পিত্‍সা মারো তো বিল্লাল ভাই৷ মাংসের কিমা আর চিংড়ি যদি বাসি হয়, কপালে দুঃখু আছে তোমার বসের!'

সেই ভীম বিমর্ষ মুখে অর্ডার টুকে নিয়ে বলে, 'ড্রিংক্স স্যার? কোক, সেভেন আপ, ফ্রুট জু্যস?'

মোফা গম্ভীর গলায় বলে, 'অল্প চিনি দিয়ে ভালো করে দুই মগ হরলিক্স বানাও!'

মামা ঘাবড়ে যান৷ ভীম বিদায় নেয়, আর মোফা ব্যাখ্য করে, 'হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার সময় হেড নার্স বলেছে বেশি করে হরলিক্স খেতে, বুঝলেন তো ---৷'

মামা বিমর্ষ হয়ে পড়েন, কারণ তিনি তো আর হাসপাতালফেরত নন, আর হেড নার্স তাঁর এমন কোন গুরু নয় যে হরলিক্স খেতে বললেই তিনি খেয়ে চলবেন৷ হরলিক্সের মতো বাজে একটা জিনিস --- কিন্তু মোফা তাঁর মনোভাব বুঝতে পেরে বিকল্প বিশুদ্ধ-বার্লি খাওয়ার প্রস্তাব দেয়৷ মামা তত্‍ক্ষণাত্‍ হরলিক্সকেই আঁকড়ে ধরেন, জানান যে হরলিক্স এক অসাধারণ মাল, তিনি নিয়মিত সেবন করে থাকেন৷
যথাসময়ে পিত্‍সা আর হরলিক্স আসে, একেবারে টোম্যাটো-চীজ-কিমা-চিংড়ি-ক্যাপসিকাম জরোজরো কঠিন মাল, মামা ঝাঁপিয়ে পড়েন৷ মোফা সাহিত্যিকসুলভ গোগ্রাসে খায়, আর একটু পর পর একটা নির্দিষ্ট কোণে তাকিয়ে চালবাজের হাসি হাসে৷ মামা অবহিত হন, ঐ কোণে গোমড়ামুখে যে টেকো, দাড়িয়াল ভদ্রলোক বসে আছেন, তিনিই এই পিত্‍সাখানার খানেদার, সেই ভূতপূর্ব সম্পাদক সাহেব, আর মোফা তাই তাঁর সাথে সাহিত্যিকসুলভ সৌজন্য রক্ষা করে যাচ্ছে৷

খাওয়ার মাঝেই মামা মোফার চালবাজিতা দেখে বিস্মিত হন৷ তলে তলে যে মোফা অ্যাতো বড় চালিয়াত্‍ হয়ে গেছে, তা তিনি না দেখলে বিশ্বাসই করতেন না৷ বিশাল এক মগ হরলিক্স কোঁত্‍কোঁত্‍ করে এক নিঃশ্বাসে গিলে ফেলে রূমালে গোঁফ মোছে সে৷ এরই মাঝে ট্যাঁটোঁপ্যাঁপোঁ করে বিদঘুটে সুরে মোবাইল বেজে ওঠে, কোত্থেকে একটা ছোট্ট মোবাইল মোফা বের করে আনে, সেটা কানে দিয়ে গম্ভীর গলায় বলে, 'হ্যালো!'

ওপাশ থেকে ভেসে আসা মিষ্টি নারীকন্ঠের কথাবার্তা সব মামা শুনতে পান৷ তাই কথোপকথনের পুরোটাই হেফজ করতে পারেন তিনি৷

--- অ্যাই শোনো না, কোথায় তুমি, অফিসে?
--- না, একটু বাইরে৷
--- একা?
--- উঁহু, আমার বসের সাথে৷ কেন?
--- শোন না, আমি এখন নিউ মার্কেটে, পেহলু নাম্বার ওয়ানে৷
--- পেহলু নাম্বার ওয়ান কী?
--- তা-ও জানো না? শাড়ির দোকান! ঢাকার টপ শাড়ির দোকান৷
--- হুম, তো?
--- একটা শাড়ি আমার দারূণ পছন্দ হয়েছে, বুঝলে, জর্জেটের ওপর বেনারসীর কাজ, কি যে সুন্দোওর আর ইয়ে --- ৷
--- হুম, তো?
--- মাত্র বত্রিশ হাজার চাইছে৷
--- বলো কী?
--- হ্যাঁ, কিন্তু আমি বলে কয়ে একত্রিশ হাজারে নামাতে পারবো৷
--- পারবে?
--- হ্যাঁ! নামাবো?
--- নামাও!
--- সত্যি, বলছো তাহলে?
--- নামাও, নামিয়ে ফেলো৷ কী-ই বা আছে জীবনে?
মোফার উদারতা দেখে ঘাবড়ে যান মামা৷ কত কিছুই যে শোনার আছে এ জীবনে!
--- ওহ্, তুমি যে কী সুইট না! কুচিকুচিকু!
--- অ্যাই কী করো, শুনবে লোকে!
--- শুনুক, শাড়ির দোকানের লোক শুনলেই কী?'
--- হুম, তাই তো!
--- আচ্ছা শোনো, রেখে দিও না৷ আমার আরেকটা জিনিস পছন্দ হয়েছে, এলিফ্যান্ট রোডে৷
--- কী জিনিস?
--- একটা গালিচা৷
--- বলো কী?
--- হ্যাঁ! ইরান থেকে এসেছে! ইরানি কারিগররা এই গালিচা একমাস রোজা রেখে শুধু ডানহাতে বানায়!
--- বলো কী? রমজান মাস, না অন্য কোন মাস?
--- অন্য কোন মাসই হবে!
--- আর বাম হাত দিয়ে ওরা কী করে?
--- তা তো আমাকে দোকানী বলেনি, কিন্তু গালিচাটা দারূণ, বুঝলে, ছয় ইঞ্চি মোটা!
--- বলো কী? জাজিম একেবারে!
--- ধ্যত্‍, তুমি যে কী না! শোনো না, ছাবি্বশ হাজার চাইছে!
--- অ্যাঁ? কেন, এটাও কি জর্জেটের ওপর বেনারসী নাকি?
--- হি হি হি, তুমি মাঝে মাঝে এমন ফানি --- না, শোনো, ঠাট্টা না, আমার দারূণ ভালো লেগেছে জিনিসটা৷ আমি বলে কয়ে পঁচিশে নামাতে পারবো ---৷'
--- পারবে? পারবে তো?
--- হ্যাঁ! নামাবো?
--- নামাও!

মোফা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, অর্থাত্‍, কী-ই বা আছে এ জীবনে? মামা শুধু ঘাই দিয়ে চমকে চমকে ওঠেন৷

--- নামাবো? ওহ্, তুমি যে কী সুইট না!
--- রাখি এখন?
--- অ্যাই না, শোনো, কথা শেষ হয়নি৷ আমি শাহবাগে গিয়েছিলাম, খোয়াশ ল্যাম্পের শোরূমে৷ ওখানেও একটা জিনিস আমার পছন্দ হয়েছে!
--- বলো কী? কী জিনিস?
--- একটা শ্যান্ডেলিয়র, মানে, ঝাড়বাতি!
--- আচ্ছা?
--- হ্যাঁ, দারূণ একটা জিনিস! জার্মানী থেকে আনা পাথর, ক্রিস্টাল আর সোনার গিল্টের কাজ, মানে, কী বলবো?
--- কী বলবে?
--- এক কথায় দারূণ জিনিসটা! ভেবে দেখো, আমি ঐ শাড়িটা পড়ে এই ঝাড়বাতির নিচে গালিচায় যখন বসবো, আমাকে দেখতে কেমন লাগবে?
--- হুমম৷ ভালোই লাগবে?
--- ভালোই? ভালোই?
--- না না, অপূর্ব লাগবে! মনে হবে তুমি একমাস রোজা রেখে এসেছো!
--- তুমি কি রসিকতা করছো আমার সাথে?
--- ইয়ে, এটা কত চাইছে?
--- শোন, তোমার যদি আপত্তি থাকে তো শুরুতেই বলতে ---৷
--- আরে না, আপত্তি থাকবে কেন? কত চাইছে এটা?
--- তেইশ হাজার৷
--- কমাতে পারবে না, বলেকয়ে?
--- উঁহু৷ ওরা বড্ড গোঁয়ার৷ বলছে কনসেশড কার্ড দেবে, পরবর্তীতে যে কোন জিনিস ওদের কাছ থেকে কিনলে দু'হাজার টাকা কম রাখবে৷ কিন্তু এটার দাম কম রাখতে পারবে না৷
--- কী আর করা তাহলে৷ রাজি হয়ে যাও৷ কনসেশন কার্ডটা যত্ন করে রেখো৷
--- হবো? রাজি হবো? বলছো তাহলে?
--- হ্যাঁ, বলছি তো৷
--- ওহ্ সোনা, আই লাভ ইউ! আমার বান্ধবী মনিরা বলছিলো, তুমি কিছুতেই রাজি হবে না, যা কঞ্জুষ আর গাঁওয়ার তুমি! আমি তাই ওর সাথে বাজি রেখেছিলাম পাঁচশো টাকা, ওটাও আমি জিতেছি! হুররে!
--- মনিরা এইসব বলে?
--- অ্যাই না, রাগ করো না লক্ষ্মীটি, ও ঠাট্টা করেছে!
--- উচিত শিক্ষা পেয়েছে, পাঁচশো টাকা গচ্চা দিক এবার!
--- হা হা হা, ঠিক বলেছো! অ্যাই শোনো, রাখি তাহলে! সন্ধ্যার পর দেখা হচ্ছে, ঠিক আছে? --- আর হ্যাঁ, তোমার বসের সাথে মিশে তোমার কথা যা ইমপ্রুভ করেছে না! একেবারে পেন্টিভির সংবাদপাঠক গামছুদ্দিন হালিমের মতো!
--- ঠিক আছে৷
--- টা টা, উউউউউউউম্মাহ!
--- টাটা!

মোফা ফোনটাকে নামিয়ে উল্টে পাল্টে দ্যাখে৷

'জোস সেট!' মন্তব্য করে সে৷

মামা রূদ্ধশ্বাসে সব শুনে নির্বাক হয়ে ছিলেন, বহুকষ্টে দুই চুমুক হরলিক্স খেয়ে বলেন, 'কত দিয়ে কিনলি?'

মোফা বলে, 'আমি? এই সেট কেনার সামর্থ্য কি আমার আছে?'

মামা ঘাবড়ে যান৷ 'মানে?'

'কার না কার সেট কে জানে৷ কোন কঞ্জুষ গাঁওয়ারের সেট হবে হয়তো, এখানে ফেলে রেখে গেছে! আমার সীটের তলে!'

মামার বিস্ময় না কাটতেই মোফা ঝোলা কাঁধে করে উঠে পড়ে, তারপর সেই ভূতপূর্ব সম্পাদকের দিকে এগিয়ে যায়, সেটটাকে টেবিলের ওপর ফেলে রেখে৷

মামা উঠে পড়ার আগেই এক রূপসী, উদ্ভিন্নযৌবনা, উগ্রসজ্জিতা তরূণীকে বগলদাবা করে এক টেকো মাঝবয়েসী গুঁফো লোক হাঁপাতে হাঁপাতে দরজা ঠেলে ঢোকে৷ সোজা মামার দিকে ছুটে আসে ব্যাটা৷
মোবাইল সেটটা দেখেই ডুকরে ওঠে সে, 'থ্যাঙ্ক ঘড!'
তরূণী ঝামটে ওঠে, 'সাচ আ ক্রাইবেবি উ্য আ'! --- ঈমানে কইতাছি, তোমার লাহান কনজুস মাক্ষিচুস আগে দেহি নাইক্কা!'

গুঁফো ঝাঁঝিয়ে ওঠে, 'হেই, ইট'স মাই লাকি সেট! আর খোদার খামুকা এইখানে এইটারে ফালায়া যামু কেলেগা? পয়ছা ছস্তা দেখছো?'

তরূণী আরেকদিকে তাকিয়ে গজগজ করতে থাকে, 'সো য়ু্যভ গট ইট ব্যাক, নোওয়ন স্টোল ইট৷ নাউ লেট্স গেট ব্যাক৷ ইফ য়ু্য ক্যান্ট ড্রপ মি উইদিন সিক্স, মায় কিন্তু বুইঝা ফালাইবো যে তোমার লগে কেলাস ফালায়া বাইর উইছি, তারপর কেয়ামত দেখায় দিবো কইতাছি! চিনো আমার মায়রে?'

মামা এই চোস্ত ইংরেজি ও চোস্ততর ঢাকাই ভাষার খিচুড়ি থেকে একটা কাহিনী আন্দাজ করার চেষ্টা করেন৷ কাহিনী জটিল কিছু নয়, মামা দুয়ে দুয়ে চার মেলাতে ওস্তাদ --- গুঁফোটা সেই মোবাইলনন্দিনী বর্ণিত কঞ্জুষ গাঁওয়ার, সে প্রেম করে বেড়ায় এই ক্লাস-ফাঁকি-দিয়ে-আসা ঝাক্কাস ছুকরির সাথে, এবং মোফা গুঁফোর অ্যাকাউন্টের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে৷ মোবাইল আর ব্যাঙ্ক, দুটোরই! একত্রিশ আর পঁচিশ আর তেইশ হাজার, একুনে ঊনাশি হাজার, বনাম একটা দু'হাজার টাকার কনসেশন কার্ড --- এটা হচ্ছে আরো টাকা খসানোর ওয়াস্তা মাত্র --- আর মনিরার বাজির পাঁচশো টাকা! উঁহু, ভালো ছিল খেয়েছে বেচারা৷

বলতে না বলতে আবার ফোন আসে, গুঁফো ঘাবড়ে গিয়ে ফোন ধরে৷ আর ফোন ধরেই সেই লাস্যময়ী সঙ্গিনীর দিকে পেছন ফিরে ফিসফিসিয়ে গর্জাতে থাকে সে৷ 'হ্যালো? ক্যাঠা? তোমারে না একবার কইছি আইজকা আমারে আটটার আগে ফোন মারবা না --- কী? --- হ হ, আমিই তো, হ, বাইরে, হ, বসের লগে --- কী? কোনহানে? এলিফ্যান্ট রোড? উইখানে গ্যাছো কেলেগা? --- গালিচা? গালিচা? এইডা কী? ইরানের গালিচা? ক্যান, বাঙ্গালি হালারা গালিচা বানাইবার পারে না? গালিচা দিয়া কী করূম আমরা? --- কী কইলা, ঝাড়বাত্তি আর গালিচা কিন্যা ফালাইছো? ব্যানারছি শাড়ি ভি? --- আবে হাল্লায় মাথা গরম হইছে নিকি তোমার, বুইড়া উমরে ব্যানারছি শাড়ি পিনবার চাও? বোরখা কিইন্যা পিনবার বয়স ভি তোমার নাইক্যা, আর তুমি পিনবা ব্যানারছি? --- কী কইলা? আমি কিনতে কইছি? আমারে কি গর্মিতে ধরা কুত্তায় কামড়াইছে নিকি যে আমি তোমারে ব্যানারছি শাড়ি কিন্যা পিনতে কমু? --- কী? গালিচা আর ঝাড়বাত্তিও আমি কিনবার কইছি? আরে মরা, আমি এইগুলি তোমারে কিনতে ক্যান কমু? আমার কী মাথা খারাব উইছে নিকি? --- খাবাদার, ফোন রাখবা না! হাদিয়া কত নিছে এগুলির? --- শাড়ি দছ হাজার? ঝাড়বাত্তি পাঁচ হাজার? গালিচা আট হাজার? আরে বেওকুফ আওরাত, করছো কী তুমি? নাজিমুদ্দি রোডে বহাইয়া ভিখ মাঙ্গাইতে চাও আমারে দিয়া? করলা কী তুমি এইটা? যাও, ফিরায়া দিয়া আহো! --- কী কইতাছো এগুলি? আমারে জিগায়া কিনছো? --- কোন আমলে জিগাইছিলা, আমি নাদান থাকতে? --- দছ মিনিট আগে? আমার লগে কথা উইছে? --- প্যাচাল বাদ দিয়া মালসামানা যা খরিদ করছো সব ফিরায়া দিয়া আহো! --- ফিরত নিবো না? নাকি ফিরত দিবা না? --- বেচলে আর ফেরত নেয় না? --- কোন হালায় কয় এগুলি? --- আইচ্ছা, আহো বাড়িত, দ্যাখতাছি!'
এই বলে গুঁফো তার মোবাইলের অন্ধিসন্ধি তদন্ত করতে থাকে, ওদিকে রূপসী তরূণী মামার সাথে নানা প্রজাতির কটাক্ষ বিনিময় করছিলো, সেই প্রক্রিয়া অত্যন্ত অননুমোদী দৃষ্টিতে আড়চোখে দেখে সে, তারপর মোবাইলের কল রেকর্ড চেক করে সে মামার দিকে গভীর অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে তাকায়৷

'এক্সকু্যজ মি, ভাইছাব! এই ফোন কি কেউ ইয়ুজ করছিলো নিকি?'

মামা আকাশ থেকে পড়েন৷ 'জ্বি?'

'কইতাছি আপনে তো বয়া ছিলেন এইহানে --- এই যে টেবিলের উপরে ফোনটা কেউ ইয়ুজ করছিলো নিকি, তা দেখছিলেন? কইবার পারেন কেডা আমার ফোন ধরছিলো?'

মামা গভীর তাজিমের সাথে বলেন, 'জ্বি না, আমি তো মাত্র এলাম, খেয়াল করিনি৷'

গুঁফো ফোঁসফোঁস করে, কিছু বলে না৷

কিন্তু তখন এগিয়ে আসে সেই ভীম ওয়েটার৷

'স্যার, কিছু লাগবে?'

গুঁফো লাফ দিয়ে ওঠে৷ 'হ লাগবো! কও তো বিল্লাল, তুমি ঈমানদার মানুছ --- আমি এই ফোনটা ভুলে ফালায়া থুইয়া গেছিলাম, পনরো মিনিট বাদে আয়া দেখি কোন হালায় জানি একটা দশ মিনিটের ইনকামিং কল মাইরা বইছে! --- ক্যাঠায় ধরছে আমার ফোন?'

ওয়েটার নিঃসংশয়ে আঙুল তুলে মোফাকে শনাক্ত করে৷ এবং মামা দেখেন, পিছন ফিরে দাঁড়ানো মোফা গোটা বিপদ সম্পর্কেই অচেতন, আর এদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকা সম্পাদক-কাম-খানেদারের মুখে একটি বিলোল হাসি ফুটে উঠেছে৷ নিঃসন্দেহে বিল্লাল পালোয়ানের এই হঠাত্‍ উদয়ের পেছনে এঁর কোন পরিকল্পিত ইঙ্গিত আছে৷

গুঁফো তেড়ে ছুটে যায়, আর রূপসী যৌবনবতী তরূণীটি মোফার জায়গায় ধপ করে বসে পড়ে৷

'হি'জ ইনটলারেবল!' ঝাঁঝিয়ে ওঠে সে৷ 'বুইড়া খাটাছ হালায়!'

মামা একটা চোখ সম্ভাব্য ঝামেলার দিকে রেখে আরেকটা চোখ এই সম্ভাব্য --- ঝামেলাই বলা যায় --- ইয়ের দিকে রেখে বলেন, 'ইজ দ্যাট সো? ক্যান, মুরুবি্ব করছে কী?'

'অহনতরি কিছু করে নাইক্কা, মাগার করবো!' গোমড়া মুখে বলে ললনাটি৷

ওদিকে দেখা যায়, মোফার সাথে গুঁফোর আলাপ আস্তে আস্তে গরম হচ্ছে৷ মোফা অসহায় ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাচ্ছে, আর গুঁফো ভারি সহিংস ভঙ্গিতে আঙুল নাচাচ্ছে৷

মামা এই স্বল্প ফাঁকে মেয়েটার সাথে ঘ্যাম আলাপ জমিয়ে ফেলেন৷ সবেমাত্র ফোন নাম্বার বিনিময় করেছেন, তখনই একটা ধুপধাপ শব্দ শোনা যায়৷ সেই তরূণী, যার নাম পাকিজা, নামের মযর্াদারক্ষার বিন্দুমাত্র খায়েশ যার নেই, আঁতকে ওঠে, 'ঔ ল'র্ড, হি'জ গনা কিল দ্যাট চ্যাপ!'

মামা ঘাড় ফিরিয়ে দ্যাখেন, মোফাকে মাটিতে পেড়ে ফেলে এক কপি মেনু দিয়ে ধাঁই ধাঁই করে গুঁফো তাকে বাঁটিয়ে চলছে, আর মাঝে মাঝে চুল টেনে কিলও মারছে৷ মোফার অবস্থা কাহিল, দেরি করলে আবারো তাকে হরলিক্স-বার্লির ওপর হপ্তাখানেক চলতে হবে৷ মোফার পিত্‍সার ঋণ শুধতে গিয়েই মামার মনে পড়ে বাধ্যতামূলক হরলিক্সের কাগদেশান্তরি স্বাদের কথা, তিনি তাই পাকিজাকে আরো মিনিটখানেক সান্ত্বনা দেন৷ বুইড়া খাটাছ দেইখা কী উইছে, শরীফ খান্দানের ইয়াংম্যান ভি আছে, ইন দিস ড্যাম্ড সিটি! তার পর উঠে যান অকুস্থলে৷

মোফাকে দেখেই গর্জে ওঠেন মামা৷ 'ইয়ু্য ড্যাম ফুল! --- এইখানে এসে হাজির হয়েছো তুমি?' গুঁফোকে ঠেলে সরিয়ে দেন তিনি, '--- দেখি জনাব! আজকে এই শালাকে আমি পেঁদিয়ে আলু বানাবো৷' গুঁফোর কাছ থেকে মেনুটা ছিনিয়ে নেন তিনি, '--- দেখি জনাব!' তারপর ধাঁই ধাঁই করে ঠ্যাঙাতে থাকেন মোফাকে৷ মোফা সেই গুঁফোর ঘায়ে নেতিয়ে পড়েছিলো, মামাকেও বেঈমানি-পিত্‍সাহারামি করতে দেখে সে হাল ছেড়ে দেয়, একেবারেই জিভ বের করে চোখ উল্টে পড়ে৷

'আয় হায় --- করলেন কী এটা?' মামা নিজে পিটিয়ে নিজেই চেঁচিয়ে ওঠেন, গুঁফোকে ঘাবড়ে দেয়াই তাঁর মতলব৷ 'ব্যাটা দেখি ফিট হয়ে গেছে? এহহে, একে জলদি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে৷ পুলিশে কেস টেস করে দিলে মুশকিল ---!'

কিন্তু মামার সাইকোলজিক্যাল ব্ল্যাকমেইলের ফন্দি ব্যাকফায়ার করে৷ 'কিয়ের মুছকিল?' গর্জে ওঠে গুঁফো৷ 'লালবাগ থানার ওছি আমার ল্যাংটা জমানার দোস্ত, লয়া চলেন হালারে থানায়, দ্যাখেন কেমন ডলা দেয়! --- দিগদারি করনের জায়গা পায় না হালায়! মারেন না আর দুইখান, এইছব অ্যাকটিং মারতাছে হালায়! টেংরি ভাইঙ্গা হাতে ধরায়া দেন হালার!'

তত্‍ক্ষণাত্‍ মামা সত্‍পথে ফিরে এসে বরাভয়মুদ্রা দেখান৷ 'শান্ত হোন স্যার৷ --- একে আমি ভালো করেই চিনি, বদমাইশের হাড্ডি একটা৷ বহুত জ্বালিয়েছে আমাদেরও৷ একে আমার পাড়ার ক্লাবে নিয়ে যাচ্ছি, আমার পোলাপান একদম সাইজ করে ছাড়বে ব্যাটাকে৷ ব্যাটা বুঝবে তখন, গ্রেনেড গফুরের সাথে মামদোবাজি করার শাস্তি কত ভয়ানক --- ভয়ানক --- ভয়ানক ---৷'

এবার কাজ হয়, গ্রেনেড গফুর নাম শুনেই গুঁফো পিছিয়ে যায়৷ 'লয়া যান ভাই, লয়া যান!'

মামা মোফাকে টেনে হিঁচড়ে বের করে নিয়ে চলেন, সোজা হাসপাতালে৷ তবে যাওয়ার আগে একটা আবছা হাতছানি আর হালকা কটাক্ষ ঝাড়তে ভোলেন না৷ পাকিজা জবাবে মিষ্টি হাসে৷

৩.

'মোফা এখন কই?' রূদ্ধশ্বাসে বলি আমরা৷

'বললাম না, হাসপাতালে৷ আজকে দেখতে গিয়েছিলাম৷ আছে ভালোই, ঘাবড়াস না৷ বার্লি খাচ্ছে তিন বেলা৷ সেরে উঠবে এ যাত্রা৷'

'বেশ হয়েছে!' শিবলি গজগজ করে৷ 'আমাদের ফেলে ---৷'

কথা শেষ করার আগেই মামার মোবাইল ভাওয়াইয়া সুরে ডেকে ওঠে৷ তিনি মোবাইল বের করে নাম্বারটা দেখেন, তারপর মুচকি হেসে বলেন, 'প্লিজ এক্সকিয়ু্যজ মি, আভ গট আ কল!'

আমরা হাঁ করে চেয়ে থাকি, মামা হাসিমুখে গ্যাজাতে থাকেন৷ 'হ, পাকিজা, কেমুন আছো? আরে না, ব্যস্ত না --- কী যে কও, তুমি ফোন লাগাইছো আর আমি ব্যস্ত থাকুম ---৷ ঔ, দ্যাট'স সো সুইট অফ য়ু্য জান ---!' ইত্যাদি ইত্যাদি৷

কেন জানি না, আমাদের গাত্রদাহ হতে থাকে৷ নিজের অজান্তেই আমরা গজগজ করতে করতে উঠে পড়ি, এমনকি প্লেটে কয়েকটা পুরি-সিঙ্গারাও অস্পৃষ্ট পড়ে থাকে৷


মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

এইটা আগে পড়ছিলাম। জটিল।

====
মানুষ চেনা দায়!

ঝরাপাতা এর ছবি

হ সামহয়্যারে। আপনার গল্পে কাউরে না কাউরে মাইর খাইতেই হয়, মনে হয় সেই মালিনীর গোয়া ভ্রমণের গল্পটাই ব্যতিক্রম। আপনি মনে হয়, দাঙ্গাবাজ পাবলিক।
_______________________________________
পোড়াতে পোড়াতে ছাই, ওড়াতে ওড়াতে চলে যাই . . .


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

হিমু এর ছবি

মুহুহুহুহুহুহুহু!


হাঁটুপানির জলদস্যু

সৌরভ এর ছবি

লা-জওয়াব!
তোফা তোফা..

------ooo0------
বিবর্ণ আকাশ এবং আমি ...


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

ধুসর গোধূলি এর ছবি

ঘটনা হইলো ফলেন, গল্পের মাইর খাওয়া চরিত্রের বাস্তব রূপায়ন হইলো হিমু। বাস্তবে মাধ্যম গধ্যম খায় বইলা কি গল্পেও খাইবো নাকি? গল্পকারের একটা ইয়ে আছে না?

তবে জিনিষটা পুরান, আগে পড়ছি। নয়া জিনিষ নামাও ভাতিজা।
_________________________________
<স্বাক্ষর দিমুনা, পরে জমিজমা সব লেইখা লইলে!>

আরিফ জেবতিক এর ছবি

ধুরো ভাইজান,কেন যে লেখালেখিটারে সিরিয়াসলি নিলেন না....

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

ফাটনো!!!!!!!!!!

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

দ্রোহী এর ছবি

কথায় আছে হুইস্কি খাইয়া মুতলে ব্র্যান্ডি বাইর হয়।

মানুষ মরলে ভূত হয়। হিমুর কি হবে রে কালিয়া?????????
__________
কি মাঝি? ডরাইলা?

সুমন চৌধুরী এর ছবি

হাহহাহাহা
.......................................
ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

উৎস এর ছবি

হিমুর মাথা কি ম্যালেরিয়ার পরে খুলেছে বেশী?

অনুপম ত্রিবেদি এর ছবি

এক কথায় - "চমেতকার"।

---------------------------------------------------------------------
সকলই চলিয়া যায়,
সকলের যেতে হয় বলে।

==========================================================
ফ্লিকারফেসবুক500 PX

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।