ইউনিপেটু্ইউ (UNIPAY2U), মানি মেকিং মেশিন নাকি ফাঁদ?

নীড় সন্ধানী এর ছবি
লিখেছেন নীড় সন্ধানী (তারিখ: বুধ, ২২/১২/২০১০ - ১০:৫৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১.
দ্রুত বড়লোক হতে কে না চায়?

সবচেয়ে বেশী চায় স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত যারা প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশী আয় করে। ধরা যাক, আমি সেরকম একজন আবুল হোসেন। আমার মাসিক আয় ২৫০০০ টাকা। মাসিক খরচ ২০০০০ টাকা গিয়ে সঞ্চয় থাকে ৫০০০ টাকা। বছরে আমার জমে প্রায় ৬০০০০ টাকা। দশ বছরে জমবে ৬০০০০০ টাকা। তবু দেখা যায় এই টাকা দশ বছর জমিয়েও একটা গাড়ী কিনতে পারবো না, ততদিনে গাড়ীর দাম আরো বেড়ে যাবে এবং একশো বছর চাকরী করেও একটা ফ্ল্যাট কিনতে পারবো না।

এখন আমার সামনে কেউ যদি একটা মুলো ঝুলিয়ে বলে ১ বছরে টাকা দ্বিগুন হবে তেমন একটা যাদুকরী মেশিন এসেছে, আমি মরিয়া হয়ে সেই মেশিনে টাকা ঢালার জন্য ছুটবো।

কারণ আমার ব্যাংকে আছে ৩ লাখ টাকা। তার অন্তত ২ লাখ টাকা এখানে খাটালে ২০১১ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই অন্তত ১৯৯৭ মডেলের একটা টয়োটা কিনতে পারবো। আরেকটু দূর স্বপ্নে পাঁচ বছর চললে এই টাকা (২..৪..৮..১৬..৩২..৬৪) =১২৬ লাখ হয়ে যাবে এবং মাত্র পাঁচ বছরে আমি কোটি পতি!! টাকা বাড়ে গুনিতক হারে, কে না জানে।

সুতরাং বুদ্ধিমানের মতো ২ লাখ টাকা ইউনিপেটুইউর হাতে তুলে দিলাম।

২.
পুরোনো বাংলা সিনেমার একটা গান ছিল রুনা লায়লার কন্ঠে -"প্রেমেরই ফাঁদ পাতা ভূবনে, কে কোথায় ধরা পড়ে কে জানে......."। আজকাল প্রেমের ফাঁদ নেই আর, ভোগবাদী মানুষের জন্য এখানে সেখানে মোহনীয় টাকার ফাঁদ।

বেশ কিছুদিন ধরে ইউনিপেটু্ইউ (UNIPAY2U) নামে নতুন একটা ফাঁদের গল্প শুনে যাচ্ছিলাম নানা জনের কাছ থেকে। দ্রততম উপায়ে বড়লোক হবার প্রকল্পে যোগ দেবার জোর নিমন্ত্রন পাচ্ছিলাম। কিন্তু সহজ উপায়ে বড়লোক হবার ব্যাপারে গুরুর নিষেধাজ্ঞা থাকাতে পাত্তা দেইনি। কিন্তু গতকাল এমন একজনের কাছ থেকে এর গুনগান শুনলাম যার কথাকে আমি গুরুত্ব দেই। তিনিও বললেন এটা 'ওয়ার্ল্ডওয়াইড' কোম্পানী। শুনে একটু নড়ে চড়ে বসলাম। ভাবলাম অন্ততঃ একটু সাইবার ভ্রমন হোক।

ক্লিক করি unipay2u.com ওয়েব সাইটে। ঢুকে দেখলাম ওয়েবসাইটটিতে মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, ভারত, বাংলাদেশ, দুবাই, নেপাল, চীন এইদেশগুলোর আলাদা ট্যাবে মিরর ওয়েবসাইটের মতো তৈরী করা আছে। সবার শেষে আছে ইউনিগোল্ড টু ইউ ট্যাব। এটি ব্লিংকিং করে চোখ মারছে সোনালীর রঙে। বড়শির ছিপের ফাৎনার মতো মনে হলো জিনিসটা। এতগুলো দেশের তালিকা দেখেই প্রথমে ভড়কে যায় বাঙালী। মনে হবে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানী। মাল্টিন্যাশনাল মানে বিশ্বাসী, টাকা পয়সার বটগাছ ওরা। সবগুলো লিংক কাজ করছে না দুবাই এবং চীন এরর দেখায়।

বাকীগুলো বাদ দিয়ে, খালি বাংলাদেশের অংশে মন দিলাম। প্রথম পাতার নীচের দিকে দেখি দুটো সার্টিফিকেটের রঙিন স্ক্যানকপি দেয়া আছে। সম্ভবতঃ বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ানোর স্বার্থে। বাঙালী আবার সার্টিফিকেট জাতীয় বস্তুর খুব ভক্ত।

একটা সার্টিফিকেট জয়েন্ট স্টক কোম্পানীর ইনকরপোরেটেড সার্টিফিকেট, আরেকটা হলো আমদানী সার্টিফিকেট(IRC) যাতে ১৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত বার্ষিক আমদানী সীমা দেয়া আছে।

এই কোম্পানী ১৫ লক্ষ টাকার কী আমদানী করার সার্টিফিকেট নিল? বছরে শতকোটি টাকার আমদানী সার্টিফিকেট হলে না হয় বুঝতাম স্বর্ন আমদানীর লাইসেন্স পেয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের FOREIGN EXCHANGE REGULATION ACT, 1947 ACT NO. VII অনুযায়ী সরকার কাউকে স্বর্ন আমদানীর লাইসেন্স দেয় না। তাছাড়া দেশে যে কোন ধরনের আর্থিক ব্যবসা করার জন্য লাইসেন্স দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। সেরকম কোন অনুমতিপত্র দেয়নি ওরা সাইটে। থাকলে নিশ্চয়ই একটা খেলো আমদানী সার্টিফিকেট দিয়ে পাবলিকের চোখে চশমা পরাতো না। তাহলে ব্যাপারটা কি?

তারপর একটু টেকি বিষয়ে খোঁজ খবর নিলাম। ওয়েবসাইটের হোষ্ট ও আইপি বিষয়ক তথ্যগুলোতেও বেনামী থাকার প্রবণতা লক্ষ্য করলাম, যেটা সন্দেহকে আরো গাঢ় করে তুললো। আইপি বিষয়ক তথ্য প্রকাশে বিধিনিষেধ আছে বলে এখানে প্রকাশ করলাম না। কিন্তু যে কেউ http://www.ip-adress.com/whois অথবা http://www.dnsstuff.com এ গিয়ে সার্চ দিয়ে তথ্যগুলো দেখে নিতে পারবেন।

সব মিলিয়ে মনে হয় বড় ধরনের ঘাপলা আছে কোথাও। কি সেই ঘাপলা? যারা ফাঁদে পা দিয়েছে সবাই তো অশিক্ষিত না। সরকারের চোখের সামনেই তো ঘটছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বা সরকার কি অপেক্ষা করছে কখন মানুষ রাস্তায় নেমে 'সব নিয়ে গেল রে' বলে বুক চাপড়ে কাঁদবে? মধ্যবিত্তের সামান্য সঞ্চয়কে ছেঁকে নেবার ফাঁদ পাতার সুযোগ আর কতকাল দিয়ে যাবো আমরা?


মন্তব্য

রাগিব এর ছবি

বাঙালির পুরানো অভ্যাস হলো কান পাতলা হওয়া, আর সব কিছুতে শর্টকাট খোজা। তাই ইউনিপে, ডেস্টিনি এদের মতো কোম্পানিরা ব্যবসা করে বেড়াতে পারে। পনজি স্কিম নতুন কিছু না, বহু আগে থেকেই নানা দেশে নানা ভাবে এইসব ধান্ধা চলছে।

----------------
গণক মিস্তিরি
মায়ানগর, আম্রিকা
ওয়েবসাইট | টুইটার

----------------
গণক মিস্তিরি
জাদুনগর, আম্রিকা
ওয়েবসাইট | শিক্ষক.কম | যন্ত্রগণক.কম

আব্দুল্লাহ এ এম এর ছবি

শুধু শুধু বাঙালীদের দোষ দেওয়া কেন? পানজী স্কীম তো বাংলাদেশে প্রথম সূচীত হয় নি, তথাকথিত উন্নত দেশগুলোতেই এর উৎপত্তি এবং বিকাশ। সে সব দেশের মানুষগুলোর ব্যাপরে আগে কিছু বলুন।

ওসিরিস এর ছবি

আমার বন্ধুমহলের একটা বড় অংশ এর সাথে জড়িত। এদের মাঝে কেউ কেউ বেশ মোটা অঙ্কের টাকা লাভ করেছে বলেই জানি। ইউনিপের ব্যবসাটা মূলত দুই রকম, কেউ চাইলে (সম্ভবত হাজার ছয়েক টাকা লাগে) একটা একাউণ্ট খুলে তারপর ডেস্টিনি স্টাইলে কাজ করতে পারে, অথবা কেউ চাইলে একটা মোটা অঙ্কের টাকা (২১ হাজারের মত) বিনিয়োগ করে প্রতি দশ মাস পর টাকা দ্বিগুন করতে পারে। বন্ধুকূলের মতামত অনু্যায়ী, এরা নাকি উভয়ক্ষেত্রেই ঠিকঠাক মতই টাকা পে করে। কিন্তু আমার প্রশ্ন হল এই কোম্পানীটি নিশ্চিতভাবেই লাভ না করে আপনাকে টাকা দিচ্ছে না, তাহলে তারা রাজস্ব সরকারকে দিচ্ছে কি??

যতদূর মনে হয় এরকম কিছু শুনেছিলাম যে, এরা গ্রাহকদের কাছ থেকে যে টাকা নেয় তা দেশের ব্যাঙ্ককেই ফেলে রাখে, সেটার লাভের অংশ দিয়েই গ্রাহকদের টাকা পরিশোধ করে। এরকম অস্বাভাবিক কার্যক্রম দেখে কিছুদিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের ব্যাংক একাউণ্ট স্থগিত করেছিল। কিন্তু এখনো এ ব্যাবসা কিভাবে চলছে তা বোধগম্য হয় না।
_______________________________________________
সিগনেচার কই??? আমি ভাই শিক্ষিৎ নই। চলবে টিপসই???

নৈষাদ এর ছবি

মাঝে মাঝে মনে হয় কত সহজ এদেশে 'ব্যবসা' করা। কতবার তো দেশের মানুষ এইসব পঞ্জি স্কিমে ‘ধরা’ খেল। কত লেখালেখি – সেই সফিস্টিকেটেড ডেস্টিনি থেকে নট-সো-সফিস্টিকেটেড কাজল (এখন আবার লেখা হয় না, ব্যবসায়ীরা জানে কোথায় ম্যানেজ করতে হয়)। তারপরও ধরা খাওয়ার জন্য উন্মুখ। গত সপ্তাহে চিটাগাং গিয়ে ইউনিটুপে তে ইভেস্ট করা ঝকঝকে এক ব্যাংকার তরূণের সাথে কথা হল। বোঝেই সব, তারপরও লোভ...। আবার কিছু রং সিগন্যালও পায়। যেমনঃ (১) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অমুক শিক্ষক, অমুক ব্যাংকের ম্যানেজার ইনভেস্ট করেছে। (২) পেপারে বিজ্ঞাপন দিয়ে বিজয়ীদের মালয়েশিয়া পাঠিয়েছে। (৩) সরকার তো কিছু করছে না। (৪) বাতাসে উড়া কন্সপিরেসি থিওরী... এত বছর তাদের কোন সমস্যা হবে না।

যতদূর জানি রেগুলেটারি বডি তাদের ব্যাংক একাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছিল। কোর্ট থেকে নাকি এর উপর ইঞ্জাংকশ নেয়া হয়েছে... !!! কোর্ট কেন?

আমি শুধু ব্যাংকারকে উপদেশ দিলাম তোমার টাকা মাল্টিপ্লাই করতে থাক। শুধু আরও ইনভেস্টার ‘ধরে’ আনার দরকার নেই (এর উপর কমিশন আছে)। বছর দুই পরে কোম্পানি ‘হাওয়া’ হয়ে গেলে 'রাস্থায় গাড়ী ভাঙ্গচুরের' সাথে কিছু লোক যখন মারধর খাবে, তখন যেন বাঁচতে পার।

উঠতি ব্যাংকার নিজেই আরেক তথ্যদিল... ব্যাংকের কনজিউমার ক্রেডিটের (বিদেশি ব্যাংকগুলি খুব আগ্রহী) একটা বড় অংশ এই পঞ্জি স্কিমে যায়, তারপর আছে শেয়ার বাজার...আরেক জিনিস।

শুনলাম আরও তিন বড় বড় পঞ্জি প্লেয়ার নাকি চিটাগাং এর ফিল্ডে নেমেছে...।

গুডলাক চট্টলাবাসী!!

বাউলিয়ানা এর ছবি

হাহ্‌ কবে যে মানুষগুলো শিক্ষাদীক্ষা কাজে লাগিয়ে ব্যাবসা অর্থ লগ্নি করার চিন্তা করবে কে জানে। শুধু শর্টকাটে বড়লোক হবার ইচ্ছাটা কাজে লাগিয়ে এই ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের বাঁশ মেরে দিচ্ছে।

মানিক চন্দ্র দাস এর ছবি

speakasiaonline.com কি এই জাতীয় কিছু নাকি? ইদানিং বেশ গুঁতো খাচ্ছি এদের কাছ থেকে। কেমনে যে কি হয়!! কেউ কি কিছু জানেন? ওয়েব ঘেটে আমার মাথায় খুব বেশী কিছু ঢুকলোনা।

মং হ্লা প্রু পিন্টু [অতিথি] এর ছবি

আমরা জানি, বাঙালি হুজুগে এবং কিছুটা লোভীও। বিশেষ করে বাঙালি বাবুরা অল্প পরিশ্রমে ক্ষেত্র বিশেষে বিনা পরিশ্রমে রাতারাতি ধনী হতে চায়। তাই হুজুগে পড়ে এ সমস্ত (ডেসটিনি, নিই ওয়ে, ইউনি পে টু ইউ ইত্যাদি) প্রতিষ্ঠানের পিছনে এখন লাইন ধরেছে। কয়েকদিন যাক, এর পর দেখবেন হায়-হায় রবে কোরাস গাইতে শুরু করবে তারা।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

এরা তো পুরনো পাপী। অধমের এই পোস্টে হিমুর করা ৩৩ নং(৭৫) মন্তব্যটা একটু দেখুন।



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

কাঙ্গালের কথা বাসি হলে ফলে। আপনি সতর্ক করার পরেও যারা মরার তারা ঠিকই মরল। এবং গত এক যুগে আরও হাজার হাজার ইউনিটুপে তৈরি হলো > ডুবে গেলো, মাঝখান দিয়ে কয়েক মিলিয়ন মানুষ তাদের কয়েক ট্রিলিয়ন টাকা নিয়ে আচ্ছন্ন মাছির মতো মরল।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।