অপ্রত্যাশিত বিদ্যুতের চমক

নীড় সন্ধানী এর ছবি
লিখেছেন নীড় সন্ধানী (তারিখ: মঙ্গল, ১৪/১০/২০১৪ - ২:০৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

গল্পের সুত্রপাতের গল্প-

তিনি মাঝে মাঝে গল্প লেখেন। সবগুলো ঠিক গল্প হয়ে উঠতে পারে না। তবু একজন স্থায়ী পাঠকের মনোযোগ পেয়ে তিনি লেখালেখি জারি রেখেছেন। এই পাঠক তাঁর লেখার ঠিক ভক্ত নয়। যদিও তাঁর সব গল্প মনোযোগ দিয়ে পড়ে। গল্পের রেটিং করে, সমালোচনা করে, মাঝে মাঝে উৎসাহও দেয়। লেখক সেদিন একটা নতুন সিদ্ধান্ত নিলেন। পাঠকের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহনে একটা গল্প হোক। কিন্তু এত রাতে কোথায় খুঁজবে পাঠককে। তাছাড়া ভৌগলিক দূরত্বও কম নয়। হোক দূর, হোক রাত, এখন ইন্টারনেট যুগ, এই যুগে পৃথিবীতে কিছুই দূর নয়, কোন সময়ই অসময় নয়। কিছু মানুষ আছে যাদের গরু খোঁজা করে বাস্তবে কোথাও পাওয়া না গেলেও ইন্টারনেটে বা ফেসবুকে ২৪ ঘন্টাই খুঁজে পাওয়া সম্ভব। তিনিও যথারীতি খুঁজে পেয়ে গেলেন পাঠককে। দূরবর্তী পাঠক তখন ঘুম থেকে উঠে নাশতা করতে বসেছে মাত্র। প্রস্তাব পেয়ে প্রথমে দোনোমোনো করলেও অবশেষে সে রাজি হয়েছে গল্প সৃষ্টির অংশীদার হতে। লেখক এখনো জানেন না কি গল্প হবে। গল্পের কাহিনী না জানলেও তার একটা চটকদার নাম ঠিক করা হয়েছে- "অপ্রত্যাশিত বিদ্যুতের চমক"।

লেখক গল্পের সূত্রপাত নিয়ে কিছুক্ষণ আলাপ করলেন পাঠকের সাথে। এই গল্পের মধ্যে পরস্পরের অপরিচিত দুজন চরিত্র থাকবে যার একজন পুরুষ আরেকজন নারী। অথবা দুজন পুরুষ কিংবা দুজন নারী। নাহ...দুজন নারীকে নিয়ে ছোট গল্প লেখা যাবে না। কারন দুজন নারী একত্রিত হলে গল্প অনেক বড় হয়ে যাবে, সাধারনতঃ নারীগণ স্বল্পভাষী হন না। সুতরাং গল্পের আকার এবং প্রকার সুসংহত রাখতে এক নারী এবং এক পুরুষকে নিয়ে লেখাই শ্রেয়। দুজন পুরুষকে নিয়ে গল্প দাঁড় করানো যেতো কিন্তু সে এক কঠিন কাজ। কারন পুরুষেরা পরস্পরের সাথে কথা বলে কম। অপরিচিত হলে তো দুটো বোবা মানুষ হয়ে বসে থাকবে। তারচে বরং অচেনা নারী ও অচেনা পুরুষকে নিয়ে গল্প তৈরী করা যায়। দুই লিঙ্গের মধ্যে বিপরীত ও সহজাত আকর্ষনের কারনে গল্প হয়ে উঠতে পারে রোমান্টিক। কিন্তু না, রোমান্টিক গল্প লিখতে চাইছে না লেখক। নারী ও পুরুষের ব্যাপার হলেই কি রোমান্টিক গল্প হতে হবে? নারী পুরুষের মধ্যে অন্য সম্পর্ক হতে পারে না? আরো বেশী অর্থপূর্ন কোন সম্পর্ক? কি সেটা? প্রেম ছাড়া আর কি আছে? প্রেম কি পদ্যের মতো ছন্দময়? প্রেম ছাড়া অনুরাগের আর কোন প্রকাশ নেই? হয়তো আছে। সেটা গল্প চরিত্রের মনে মনেও থাকতে পারে।

আলাপ পর্ব শেষ। এবার গল্প। গল্প শুরু করবে কে? লেখক না পাঠক? সিদ্ধান্ত হলো লেখকই শুরু করবে। তারপর পাঠক বাকীটা চালিয়ে নিয়ে শেষ করবে। লেখক গল্পের সুত্র দেয়া শুরু করলো।

লেখকের অংশঃ
………..একটি লোকাল ট্রেনের বগি। ধলঘাট ষ্টেশান থেকে ট্রেনে উঠেছে রূপম। কাঁধে একটা চামড়ার ব্যাগ। ব্যাগের ভেতর একগাদা বই। জানালার পাশে বসে রূপম নিবিষ্ট মনে বইয়ের ভেতরে ডুবে আছে। জানালা দিয়ে ছুটে যাচ্ছে সবুজের অপূর্ব সমারোহ। সূর্য তখন হেলে পড়েছে পশ্চিম দিগন্তের পানে। বিকেলের সোনালী রোদে গ্রামগুলো যেন ধুয়ে যাচ্ছে। হেমন্তকাল তখন। হালকা কুয়াশার আস্তরন ভেসে আছে ধানক্ষেতের উপর।

মিনিট পনের পর কদলপুর ষ্টেশান থেকে একই বগিতে ট্রেনে উঠলো এক তরুনী। নাম জয়া। রূপম যেখানে বসেছে তার চেয়ে একটু দুরের একটা সীটে বসে পড়লো সে। যদিও লক্করঝক্কর লোকাল ট্রেন, তবে ট্রেনে ভীড় একেবারেই নেই। কারন এই সময়ে শহরমুখী যাত্রী থাকে না বললেই চলে। শহর এখনো অনেক দুর। এভাবে চললে ঘন্টা দুয়েক লাগার কথা। পথে আরো আটটা ষ্টেশান ধরার কথা। আরেকটা বড় জংশনে আধা ঘন্টার মতো থামার কথা একটা এক্সপ্রেস ট্রেনকে পার করে দিতে। ততক্ষনে সন্ধ্যে পেরিয়ে যাবে।

তবে এই তথ্যগুলো তরুন তরুনী দুজনেরই অজানা। কারন তরুন বিদেশ থেকে এসে বন্ধুর বাড়ীতে বেড়াতে গিয়েছিল। কোন কিছুই চেনে না সে। সে জানে কেবল এই ট্রেন যেখানে থামবে সেখানে তাকে নেমে যেতে হবে। ওখানে তার জন্য দাড়ানো থাকবে একটা গাড়ী। আর তরুনী এই পথে কখনো ট্রেনে চড়েনি। সে মামার বাড়ীতে থেকে পড়াশোনা করে। মামীর সাথে রাগ করে বেরিয়ে পড়েছে যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাবে। ট্রেনটা ছুটে যাচ্ছে ঝমঝম করে, দিগন্ত চিরে।

.............................................................................................................................

পাঠকের মনে ভাবনার সুত্র ধরিয়ে দিয়ে লেখক উঠে গেল। রাত অনেক, ঘুমোতে হবে। গল্পটির সাইজ মোটামুটি ২০০০ শব্দের ভেতর রাখার ইচ্ছে। তার মধ্যে ২০০টির মতো শব্দ লেখা হয়েছে। লেখকের ধারনা সকালের মধ্যে পাঠক গল্পটি শেষ করে ফেলতে পারে।

শোবার আগে আরো এক কাপ চা খেয়ে ছাদে উঠে ইজিচেয়ারে শুয়ে কিছুক্ষণ নক্ষত্র মণ্ডলী দেখতে দেখতে নশ্বর পৃথিবীর অবিনশ্বর বস্তুর কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে লেখক জানেই না। এই ছাদে অনেক গ্রীষ্মের রাত ঘুমিয়েছে লেখক। খেসারত হিসেবে গত কয়েক বছরে লিটারখানেক রক্তের চালান পৌঁছেছে করেছে প্রতিবেশী মশাদের পেটে।

সকালে পকেটের মোবাইলের খটাং শব্দে জেগে উঠলো লেখক। শব্দটা জানান দিল মোবাইলে নতুন একটা মেসেজ এসেছে। চোখ রগড়ে চশমাটা লাগিয়ে দেখলো পাঠক জানিয়েছে- ‘কাজ শেষ’। বার্তা পড়ে লেখকের হাসি আকর্ণ বিস্তৃত হলো। রাতে বিছানা বিহীন ঘুমের কষ্ট নিমেষে মুছে গেল। আরো খানিক ঘুমোতে হবে। তার আগে গল্পটা পড়ে নেয়া যাক। আড়মোড়া ভেঙ্গে নীচে তার ঘরে গেল। ল্যাপটপ খুলে দেখলো পাঠকের কয়েকটা নগদ বার্তার বার্তার আইকন জ্বলছে নিভছে। দ্বিতীয় পর্বের ঘুম মূলতবী রেখে গল্পটা পড়তে বসে গেল।

পাঠকের অংশঃ

ট্রেনটা তখন ভুজপুর জংশনে এসে থেমেছে। বগিতে মৃদু আলো। বেশীরভাগ যাত্রী নেমে গেছে। বগির এই অংশে মাত্র দুজন মানুষ। দুজনেই নীরব। মেয়েটি তখনো বিষন্নমুখে বাইরে তাকিয়ে আছে। মেয়েটি যেদিকে বসেছে সেদিকে লোকালয় নেই, দেখার কিছু নেই, স্টেশনের বিপরীত দিক ওটা। তবু মেয়েটি বাইরের দিকে চেয়ে আছে অনির্দিষ্ট দৃষ্টিতে। তরুণটি বই থেকে মুখ তুলে বাইরের দিকে তাকালো। প্ল্যাটফরমে কতগুলো ফেরীওয়ালা বসা, ভবঘুরে লোকজনও দেখা যাচ্ছে কিছু।

দুজনের মধ্যে দূরত্ব বড়জোর পাঁচফুট। এই দূরত্বে একজন মানুষ আরেকজন মানুষের সাথে কিভাবে কথোপকথন শুরু করে তরুণের কোন ধারনা নেই। সে যে দেশে পড়াশোনা করেছে সেই দেশে অবশ্য অপরিচিত মানুষকেও হাই হ্যালো করা যায়। এদেশে কেমন সংকোচ কাজ করে। নারী হলে তো কথাই নেই। তরুণটি মুগ্ধ হয়ে তরুণীর বিষণ্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো কয়েক সেকেন্ড। তারপর চোখ ফিরিয়ে নিলো। সরাসরি তাকানো অভদ্রতা হয়ে যায়। আবার আড়চোখে তাকানোও ভব্যতার মধ্যে পড়ে না। তবে মেয়েটির মধ্যে এমন কিছু আছে- না তাকিয়ে বেশীক্ষণ থাকা যাচ্ছে না। আবার ভদ্রতা করে হাই বলাও যাচ্ছে না। কিন্তু মেয়েটার সাথে পরিচিত হবার সুপ্ত একটা বাসনা ধীরে ধীরে দানা বাধছে সেটা রূপম ভালোই টের পাচ্ছে।

ট্রেনটা কতক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে? খিদে পেয়ে গেছে রূপমের। খাবার নেই সাথে। খাবার দোকান খুঁজতে স্টেশনে নামতে সাহস পাচ্ছে না। গ্রামের স্টেশনগুলোর আশেপাশে বিস্কুট চায়ের দোকান থাকে, তবে অচেনা জায়গায় নামার ব্যাপারে বাজে অভিজ্ঞতা হয়েছিল রূপমের বহুবছর আগে একবার। সেকথা মনে পড়তেই সে চিন্তাটা বাদ দিল। কিচ্ছু করার নেই। পকেট থেকে সিগারেট বের করে ফস করে ধরিয়ে ফেললো রূপম। খিদে পেটে সিগারেট যুত লাগে না, তবু নিঃসঙ্গতা কাটাতে সিগারেটের জুড়ি নেই। সিগারেটের ধোঁয়ার সাথে ভাবনাগুলো কেমন খেলে যায়।


সিগারেটের ধোঁয়ার গন্ধ নাকে যেতেই ভ্রু কুঁচকে জয়া জানালা থেকে চোখ ফিরিয়ে রূপমের দিকে তাকালো। এই প্রথম তার খেয়াল হলো বগির এই অংশে ওই তরুণটি ছাড়া আর কেউ নেই। সিগারেটের গন্ধ তার খুব বিশ্রী লাগে। গাড়ীতে যারা সিগারেট খায় তাদের প্রচণ্ড ঘেন্নার চোখে দেখে সে। তরুণটি বাইরে তাকিয়ে আপনমনে সিগারেট টানছে। সিগারেটটা তরুণের ঠোঁটে কেমন বেমানান লাগলো। এত সুন্দর মানুষ সিগারেটের মত বিশ্রী জিনিস খায় কি করে। ঠোঁট কালো হয়ে যায় না? আশ্চর্য ব্যাপার যে সিগারেটের গন্ধে নাকে ওড়না দেবার বদলে জয়া ভাবতে বসে গেল অদ্ভুত একটা বিষয়ে- ‘বেমানান ঠোঁটে সিগারেট’। একটা কবিতা হতে পারে না? ওটা নিয়ে এপার ওপার ভাবতে ভাবতে সময় কাটাতে লাগলো।

সিগারেট টানার পুরোটা সময় রূপম বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল সচেতনভাবেই। সে নারী ও শিশুদের সামনে সিগারেট ধরায় না কখনো। আজ ব্যতিক্রম ঘটলো। অপরিচিত জায়গা বলেই কি? সিগারেট ধরালেও সংকোচে মেয়েটার দিকে তাকানো থেকে বিরত রাখলো নিজেকে। যেন ওই মেয়ের কোন অস্তিত্বই জানা নেই তার। ফলে তার জানা হলো না মেয়েটা তার দিকে কঠিন মনোযোগের সাথে তাকিয়ে ছিল পাক্কা দুমিনিট। সিগারেটের শেষাংশ বাইরে ছুড়ে দিয়ে বইটা খুলে বসলো আবার। এবার আর বইয়ে মন বসলো না। মেয়েটার দিকে ফিরে তাকাবার অবদমিত বাসনাটা জেগে উঠলো আবার। কিন্তু কিছুক্ষণ আগের সিগারেট ধরানোর অপরাধবোধ তাকে সংকুচিত করে রাখলো। কিছু পর সংকোচকে ধামাচাপা দিয়ে যখন সে চোখ তুললো, মেয়েটা তখন বাইরের অন্ধকারে ডুবে গেছে।

ট্রেনটা চলতে শুরু করলো আবারো। ট্রেন ও লাইনের ঝমঝম শব্দের ছন্দটা উপভোগ করছে রূপম। আরো এক ঘণ্টার রাস্তা বাকী আছে হিসেবমতে। মোবাইল ফোনটা বেজে উঠতে পকেট থেকে বের করে দেখলো আশিকের ফোন। কতক্ষণ লাগবে জিজ্ঞেস করলো বন্ধু আশিক। পথের সুবিধা অসুবিধা নিয়ে সাবধান করলো এবং জানালো স্টেশনে থাকবে গাড়ী নিয়ে।

জয়া না তাকিয়েও কথাগুলো শুনছে মন দিয়ে। বুঝতে পারছে ছেলেটা একটু আনাড়ি আছে। এত বড় মরদকে কত জ্ঞান দিতে হয়, যেন বাংলাদেশে নতুন এসেছে। যত্তসব। এসব জিনিস মাম্মী ড্যাডির ছেলে হয়, এটা নিশ্চিত। আবার সিগ্রেটও খায়। বাপরে বাপ.... ইশটাইল করে! কাঁধের ব্যাগ দেখলে মনে হয় বিদেশী টুরিস্ট। মনে মনে ছেলেটার সাথে ঝগড়া শুরু করে কেন যেন। যখন কিছু করার থাকে না এরকম মনে মনে খেলা জয়ার ভীষণ প্রিয়। এমনকি মনে মনে প্রেমও করে কখনো কখনো। নির্দিষ্ট কারো সাথে নয়। কল্পনার সৃষ্টি সব। তবে এই ছেলেকে তার কল্পনার মানুষের সাথে মেলানো যাচ্ছে না। বেখাপ্পা টাইপ। তবু সামনে আছে এর সাথে প্রেম না হোক ঝগড়া করা যাক। সময় কাটবে তার।

সময় যাচ্ছে। রাত বাড়ছে। আরো দুটো স্টেশন পেরোবার পর ট্রেনটা গতি ধীর করতে শুরু করলো হঠাৎ। একসময় ঝমঝম শব্দটা থেমেই গেলো। কি হলো? রূপম বই থেকে মুখ তুলে বাইরে তাকালো। জয়া জানালা থেকে একটু সরে আসলো। ট্রেন যখন অচেনা কোথাও থামে তখন বাইরে তাকানো নিরাপদ নয়। সে জানে, কিন্তু হাঁদারাম ছেলেটা জানে না বোধহয়। তাকে ওসব বিষয়ে ট্রেনিং দেয়নি মাম্মীডেডী? রূপম এবার পুরো মাথাটা বের করে দেখছে বাইরের অন্ধকারে।

জয়ার ভীষণ রাগ হচ্ছে এবার ছেলেটার উপর। আরে বোকা করছো কি? বাইরে অত দেখার কি আছে? মাথা ঢোকাও ভেতরে। ধুর.......কিচ্ছু শুনছে না ছেলেটা।

শুনবে কি করে, জয়াতো মনে মনেই চিৎকার করছে। যদি কেউ রামদা দিয়ে কোপ মারে? জয়ার গাটা শিরশির করে উঠলো এবার। অন্ধকারে বাইরে তাকালেই তার এই ভয় করে। কেন যেন। কিন্তু অপরিচিত মানুষ, তাকে কি করে বলবে। রাজ্যের সংকোচ এসে জড়ো হয় ।

ট্রেনটা চলতে শুরু করে আবার। রূপম মাথাটা ভেতরে ঢুকিয়ে বইয়ে মন দেয়। জয়ার বুক থেকে একটা ভার নেমে যায়।

আরো প্রায় আধঘণ্টার পথ। তারপর গন্তব্য। রূপমের একটু মন খারাপ হয়। আরো কিছুক্ষণ যাওয়া যেতো যদি। মেয়েটার সাথে কথা বলার কোন ছুতো বের করা গেল না। গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়া মানেই তো একটা আকাংখার অপমৃত্যু। সামনে আর কোন স্টেশন নেই। রূপম ছটফট করতে থাকে মনে মনে। কিন্তু মেয়েটার দিকে তাকাতে পারে না সরাসরি। একবারও চোখাচোখি হয়নি ওদের।

জয়া কোথায় যাবে জানে না। মামার বাড়ী আর ফিরবে না বলে এক কাপড়ে বেরিয়ে পড়েছে। তার বাবা মা নেই। ঘনিষ্ঠ আত্মীয় বলতে এক খালা আছে, বিদেশে থাকে। দেশে এই মামা ছাড়া আর কেউ নেই। মামাই লালনপালন করেছে পনের বছর আগে দুর্ঘটনায় বাবা মা দুজনে মারা যাবার পর থেকে। ট্রেনটা তাকে যদি আজীবন বহন করে নিত। এই যাত্রা যদি কখনো শেষ না হতো, ট্রেনটাকে ঘরবাড়ী বানিয়ে যদি বিশ্বময় ঘোরা যেত। কত আবজাব ভাবে জয়া। মেয়েদের জন্য দেশটা মোটেও নিরাপদ নয়। তবু জয়া মরে গেলেও ফিরবে না ওই ঘরে। এত বড় অপমান সে সহ্য করবে না। সে এই ট্রেনেই আজকের রাতটা কাটাবে ঠিক করলো।

অবশেষে ট্রেনটি যাত্রা সমাপ্ত করলো। এটা কোন জায়গা? জয়া ঠিক জানে না। শেষ স্টেশন আসতেই রূপম তাড়াহুড়ো করে নেমে গেল। একবারো তাকালো না জয়ার দিকে। যেন তাকে খেয়ালই করেনি। মেয়েদের সাথে এরকম ভাব ধরা তার পুরোনো অভ্যেস। এতে করে দুর্বলতা এড়ানো যায়।

রূপমের নেমে যাওয়া দেখে জয়ার একাকীত্বটা ভীষণ চেপে বসলো। এতক্ষণ সময়টা ভালোই কাটছিল, এখন কি করবে সে? একা এই বগিতে শুয়ে ঘুমোবে, শেয়াল কুকুরের খাবার হতে হবে না তার? রাতের বেলা একা একটা মেয়েকে পেলে মানুষগুলো কি পশু হয়ে যেতে পারে তা পত্রিকার পাতায় প্রায়ই পড়ে সে। আজ কি তার সেই দিন? হোক, আত্মহত্যাই হোক এভাবে।

কতক্ষণ কেটেছে তার জানা নেই। ট্রেনের বাতিগুলো নিবে গেছে। সীটে হেলান দিয়ে তার ঘুমের মতো এসেছে। হঠাৎ মোবাইল ফোনের শব্দে ঘোর কাটলো। আরে এ যে সেই ছেলেটার ফোনের রিংটোন। সেকি ফিরে এসেছে? কি করে সম্ভব। নাকি স্বপ্ন দেখছে। ফোন বাজছেই। খুব কাছে। অন্ধকারে দেখলো ছেলেটা যেখানে বসেছিল সেইখানে ফোনটা বাজছে অন্ধকারে নীলাভ আলো ছড়িয়ে। ছেলেটা ফোনটা ফেলে গেছে ভুলে।

ফোন তুলবে কি তুলবে না ভাবতে ভাবতে কেটে গেল লাইনটা। আবারো বাজলো ফোনটা। আবারো। তিনবার বাজার পর সংকোচে ফোনটা তুললো সে। রিসিভ করতেই ভেসে এলো সেই কণ্ঠ। বহুল কাংখিত ছিল যেন এই ‘হ্যালো’ শব্দটা। কয়েকবার হ্যালো শোনা গেল ওপার থেকে। জয়া কয়েক সেকেন্ড পরে বললো হ্যালো। এই প্রথম কথা হলো ওদের।

-হ্যালো.....কথা বলছেন না কেন? (ওপাশ থেকে পুরুষ কণ্ঠ বললো)
-হ্যালো...
-কে বলছেন?
-আমি..........
-আপনার হাতে ওটা আমার মোবাইল......
-জী আমি....মানে.....ফোনটা বাজছিল, ধরলাম
-ওটা আমার ফোন.... হারিয়ে গিয়েছিল, আপনি কোথায় পেয়েছেন
-আমি জানি না, আমি ঠিক..... (আমতা আমতা করে নারী কণ্ঠ)
-দেখুন ফোনটা আমার দরকার, অনেকগুলো দরকারী নাম্বার ওখানে, আপনি কোথায় আছেন বলুন
-আসলে..... আমি জানি না আমি ঠিক কোন জায়গায়
-কি বলছেন? আপনি জানেন না আপনি কোথায়?
-আসলেই জানি না
-আপনি কি জোক করছেন? দেখুন ফোনটা দিতে না চাইলে না দিন, কিন্তু সিমটা আমার খুব দরকার, ওটা ফেরত চাই আমার।
-না না আপনি বুঝতে পারছেন না, আমি বোঝাতে পারছি না.....ফোনটা আপনি নিয়ে যেতে পারেন
-তাহলে আপনি কোথায় বলছেন না কেন এখনো? কোথায় আছেন বলুন.. টাকা পয়সা চাইলে দিতে পারি, কত লাগবে জানান
-ছি ছি আপনি কিসব বলছেন, আপনার ফোন আপনি নিয়ে যান, আমি আপনার ফোন নেব কেন?
-তাহলে ঠিক ঠিক বলেন আপনি এখন কোথায়?
-আমি এখন ট্রেনে
-ট্রেনে মানে? কোন ট্রেনে?
-সেই ট্রেনে, যেই ট্রেনে আমি এসেছি,
-মানে?
-সেই ট্রেন....সেই শেষ স্টেশনে, যেখানে ট্রেন থেমেছিল, স্টেশনের নাম জানি না
-আশ্চর্য!! কি বলছেন? আপনি কে? আপনি কি ......
-আমি এই ট্রেনে এসেছিলাম
-আপনি সেই.......ট্রেন থেকে নামেননি আপনি এখনো??
-না
-কেন?
-কোথায় নামবো, আমার কোথাও যাবার নেই
-আশ্চর্য......আপনি....তবে কি বলি......ইয়ে আমি আসলে খুব সরি, অনেক আজেবাজে কথা বলেছি না চিনে......আমি ভেবেছি অন্য কেউ
-না ঠিক আছে, আমি তো চেনা কেউ না আপনার
-না না, ঠিক করিনি আমি.......আমি দুঃখিত
-আপনি এসে নিয়ে যান আপনার ফোন
-আসছি আমি এখুনি, আধঘণ্টার মধ্যে, আপনি থাকুন
-আচ্ছা

ফোনটা আস্তে নামিয়ে রাখলো জয়া। ওটার নীলচে আলোটা নিভে গেল কয়েক সেকেন্ড পর। চারপাশে এখন নিকষ কালো অন্ধকার। অচেনা জায়গার অচেনা রাতের শব্দ। অন্ধকারে ওটার দিকে তাকিয়ে জয়া ভাবলো যে আলোটা এতক্ষণ জ্বলেছিল একটু পর সেরকম একটা আলো আবারো জ্বলবে কয়েক মিনিটের জন্য। ফোনটা নিয়ে ছেলেটা চলে যাবার পর আবারো ফের সেই অন্ধকার। সেই একাকীত্ব। রাত ভোর হতে এখনো অনেক বাকী। সেই অজানা ভোরের প্রতীক্ষায় বসে থাকবে জয়া এই অচেনা স্টেশনে। আগামী ভোরটা কি দেখা হবে তার?

গল্পটি আপাততঃ এখানে শেষ। পাঠক যেখানে শেষ করেছে তারপর থেকে লেখক আরো একটু বাড়াতে পারতেন। কিন্তু না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলেন শেষমেষ। এই সমাপ্তির মধ্যে যে একটা অনিশ্চয়তার মাধুর্য আছে তার লোভ সামলাতে পারলেন না লেখক। পাঠকের কাছে কৃতজ্ঞতাবোধ করলো একটা সমাপনী ভাবনার সুত্র ধরিয়ে দেবার জন্য। কোন কোন গল্পের শেষ একটা উপন্যাসেরও সূচনা করে। সেই সম্ভাবনা এখানে লুকিয়ে আছে কিনা এখনই বলা যাচ্ছে না। কিছুটা নির্ভর করছে রূপমের উপর, কিছুটা জয়ার উপর, বাকীটা লেখকের আজকের কলমবাজির উপর। জয়ার জীবনটা কোন খাতে প্রবাহিত হবে সেটা কি রূপমের কোন হঠকারী সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করছে? মানুষের জীবনের গতিপথগুলো অদ্ভুত, কখনো কখনো এক সেকেন্ডের একটা সিদ্ধান্ত আমূল পাল্টে দিতে পারে একেকটা জীবনের গতিপথ। কোন মানুষই এর বাইরে নয়। প্রতিটি মানুষের জীবন একেকটি ত্রিমাত্রিক উপন্যাস।

ভাবনা এবং ল্যাপি উভয়ের ডালা বন্ধ করে লেখক অবশিষ্ট ঘুমের সন্ধানে বিছানার আশ্রয় নিলেন।


মন্তব্য

মাসুদ সজীব এর ছবি

গপ্পো ভালোলেগেছে চলুক, গল্প উপন্যাসে পরিণত হোক।কিন্তু নামের সাথে গপ্পের মিল খুঁজে পেলাম না।

-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

নামের সাথে গল্পের মিল না থাকার কারণ হলো এই সৃষ্টিছাড়া গল্প সৃষ্টির আগেই নামটা ঠিক করা হয়েছিল। লেখক যা ভেবে গল্পের নামকরণ করেছিলেন, গল্পে তা ঘটেনি। আমার এক বন্ধু গল্পটি পড়ে এক বাক্যে রায় দিয়েছে, ভুয়া গল্প। কথাটা খুব একটা মিথ্যা বলে নাই খাইছে

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

রিক্তা এর ছবি

গল্পের ভেতর গল্প! ইন্টারেস্টিং। আর আপনি এতো সুন্দর করে গুছিয়ে আলাদা করে লিখেছেন চলুক । ভালো লাগলো।

--------------------------------
হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজো চমৎকার?
আমিও তোমার মত বুড়ো হব – বুড়ি চাঁদটারে আমি করে দেব বেনোজলে পার
আমরা দুজনে মিলে শূন্য করে চলে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার ।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

ভালো কিছু হলে তার কৃতিত্ব পাঠকের। খাইছে

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

মেঘলা মানুষ এর ছবি

ভালো লেগেছে গল্প, বর্ণনা ঝরঝরে - ৫ তারা।
কোথায় শেষ হবে সেটা আন্দাজ করা কঠিন ছিল, তাই একরকম 'শেষ' হলোই না।

একটা অনুরোধ: আকাংখা > আকাঙ্ক্ষা।

শুভেচ্ছা হাসি

নীড় সন্ধানী এর ছবি

এই যে আন্দাজ করা কঠিন ছিল বলেছেন সেজন্য আপনার মন্তব্যকেও পাঁচতারকা দিলাম হো হো হো

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

ট্রেনটা নাম না জানা একটা স্টেশনে থামিয়ে দিলেন? এখন গন্তব্য খুঁজে পাই কেমনে! ট্রেনটা কি আবার ছাড়বেনা? না বাকিটা পাঠককেই চালিয়ে নিতে হবে? দারুণ হয়েছে গল্পটা! হাসি

এক লহমা এর ছবি

একটি উপাদেয় ফাজলামি হয়েছে। হাততালি পরেরটির অপেক্ষায় রইলাম। হাসি

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

নীড় সন্ধানী এর ছবি

নাহ আর ফাজলামো না, এবার সিরিয়াস কিছু নিয়ে লিখতে হবে। টেকাটুকা আসে তেমন কিছু দেঁতো হাসি

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

মর্ম এর ছবি

গল্পের ভেতর গল্পের আইডিয়া, তায় আবার লেখকের অংশ, পাঠকের অংশ। পাঠকের অসমাপ্ত রেখে দেওয়া, লেখকের সেটাতেই শেষ করে দেয়া ভাল মনে হওয়া, গল্পের গড়ন গঠন নিয়ে লেখকের ছাড়া ছাড়া চিন্তা- সব মিলিয়ে ছিমছাম আর পছন্দের হল।

সচলায়তনের পুরানো দিনের কথা মনে পড়ল। এখনকার পাঠকেরা 'বারোয়ারি গল্প' দেখে মজা পাবেন হয়ত, আর যারা পড়েছেন তারা পাচ্ছেন আবার ফিরে পড়ার সুযোগ।

~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

হুমম... আপনি খালি প্রাচীনানুভূতিতে খোঁচা দ্যান চাল্লু

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

একটি ভিন্ন আঙ্গিকের গল্প। পাঠককে খুব ভোগাচ্ছে! পড়ে পাঠক ভাবছেই। ভাল থাকুন।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

অতিথি লেখক এর ছবি

গল্প ভালো লেগেছে। লেখক পাঠক মিলে গল্প লেখার বিষয়টা নিয়ে আমি একটা বাড়তি প্রত্যাশা করছিলাম। ভেতরের গল্পটার সমাপ্তি এসেছে। ভাবলাম পাঠকের গল্প আর লেখকের গল্প ভাবনায় একটা দ্বন্দ্ব হাজির হবে শেষ পর্যন্ত। হয়নি।

স্বয়ম

মরুদ্যান এর ছবি

চলুক দেঁতো হাসি

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে

অতিথি লেখক এর ছবি

ইন্টারেস্টিং !

রাসিক রেজা নাহিয়েন

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।