আমরা তোমাদের ভুলে গেছি: অদম্য এক সংশপ্তক 'হোসেন ফরিদ'

নীড় সন্ধানী এর ছবি
লিখেছেন নীড় সন্ধানী (তারিখ: শনি, ১২/১২/২০১৫ - ১০:৪৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে একবার রক্ষা পেয়ে আবারও যাঁরা সেই মৃত্যুগুহায় ফিরে যাবার জন্য বারংবার জেদ করতে পারে এবং মৃত্যুকে নির্দ্বিধায় আলিঙ্গন করতে পারে, তেমন লোককে উন্মাদ বা আত্মঘাতী বলা যায়, কিন্তু ১৯৭১ তাঁদের বলেছে সংশপ্তক। সেই দুর্লভ সংশপ্তকদের রক্ত দিয়ে তৈরী বাংলাদেশের পতাকার লাল বৃত্তটি। তাঁদের যা দেবার তাঁরা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে দিয়েছেন। যা কিছু পাবার, যা কিছু লাভের, লোভের, উপভোগের সব আমাদের জন্য রেখে গেছেন। আমরা তাঁদের দেয়া বিজয় নিয়ে উল্লাস করি, দম্ভ করি, গর্ব করি, দখলবাজি করি, এমনকি তাঁদের দেয়া বিজয়ের ফুলফল নির্বিচারে বিনাশও করি। অথচ বিনিময়ে আমরা তাঁদের মর্মভেদী আত্মত্যাগের ভুলে যেতে কার্পণ্য করিনা। সেরকম একজন হোসেন ফরিদের গল্প পড়বো আজ।

১.
আহমদ মিয়া সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে ফরিদকে না দেখে বুঝে নিলেন ছেলেটা আজকেও কারো না কারো পাল্লায় পড়ে বাইরে গেছে। দিনকাল ভালো না। পাড়ার আজেবাজে কারো সাথে মিশছে কিনা সেটা ভেবে তিনি শংকিত। বয়স সতেরো পেরিয়েছে তবু ডানপিটেমি কমেনি। হোসেন ফরিদ পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্ভে ডিপার্টমেন্টে চেইনম্যানের কাজ নিয়েছিল। যে কদিন কাজে ছিল তার রুটিন ঠিক ছিল। যুদ্ধ লাগার পর থেকে কাজকর্ম বন্ধ বলে সারাদিন গ্রামে টো টো করে ঘুরে বেড়ায় ভাদাইম্যা ছেলেদের সাথে। একদিন লুকিয়ে শহরেও গিয়েছিল। যেখানে পাঞ্জাবী সৈন্যদের অত্যাচারে জর্জরিত শহরের মানুষ, সেখানে কোন সাহসে শহরে যায় সে, ভেবে পায় না আহমদ মিয়া। মায়ের আশকারা পেয়ে পেয়ে মাথায় উঠে গেছে। আজকে কঠিন বকা দিতে হবে ওর মাকে।

আহমদ মিয়া নিজে রেলে কাজ করেন। শহরে যাবার দরকার হলে ট্রেনেই যান। এই পরিস্থিতিতে ট্রেন অনেক নিরাপদ। যদিও যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ট্রেন চলাচল অনিয়মিত হয়ে গেছে। কখন যে এই যুদ্ধ থামবে! আহমদ মিয়া রাজনীতি বোঝেন না। নৌকার জোয়ারে আর দশজনের মতো শেখ সাহেবকে ভোট দিয়েছেন এবার। মাত্র কমাস আগের কথা, তার মধ্যেই পাকিস্তানীরা দেশে গজব নামিয়ে ফেললো। গত বর্ষায়ও কিরকম প্রাণচঞ্চল ছিল এই এলাকা! আর এখন চারপাশে কী ভয়াবহ নির্জনতা। দিনের বেলায়ও বড় রাস্তায় লোক চলাচল করে না তেমন। সবাই মেপে মেপে ঘর ছেড়ে বের হয়। তবে বর্ষা নামার পর পাঞ্জাবীদের অত্যাচার একটু কমেছে। পাকিস্তানীরা কাদাপানিকে ভয় পায়। গেরিলা দলের আক্রমণ আসে অন্ধকারে।

ফরিদের মা আম্বিয়া খাতুনকে একচোট বকা দিয়ে বাইরের উঠোনে একটা মোড়া নিয়ে বসলেন তিনি। মাকেও নাকি বলে যায়নি সে। রাত বাড়তে থাকে। ফরিদের পাত্তা নেই। পাড়ার মধ্যে জানাজানি হলে আরো বিপদ। বাড়ি থেকে কোন ছেলে হঠাৎ উধাও হবার অর্থ এখন অনেকে বোঝে। তাই সবাইকে জিজ্ঞেসও করতে পারছেন না। দেশে তো শত্রুর অভাব নাই। কে কখন রাজাকারদের কানে তুলে দেবে খবর, তখন এসে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেবে ওরা। তার চেয়ে আল্লাহর কাছে হাত তুলে মোনাজাত করা ভালো। ছেলে যেখানেই থাকুক, নিরাপদে ফিরে আসে যেন।

কিন্তু একদিন দুদিন করে মাস গড়িয়ে গেলেও ফরিদ ফেরে না। বেঁচে আছে কি মরে গেছে কেউ জানে না। পাড়ার লোককে বলা হয়েছে ফরিদ ফুফুর বাড়ি গেছে বেড়াতে। ফুফুর বাড়ি বাঁশখালীতে। ওখানে সে নিরাপদে আছে। শোকাহত আম্বিয়া খাতুন দুই সপ্তাহ বিছানায় অসুস্থ থেকে এখন একটু স্বাভাবিক হয়েছেন। আহমদ মিয়া বুকে পাথর বেঁধে কাজে যান। সন্ধ্যায় কাজ থেকে ফিরে উঠোনে মোড়া নিয়ে হুঁকো টানতে থাকেন একমনে। পাড়ার কেউ এলে গল্পগুজব করেন, স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেন। ফরিদের অনুপস্থিতি একসময় সয়ে যায় সবার। শুধু মায়ের বুকটা খচ খচ করতে থাকে সারাক্ষণ। তখন আম্বিয়া খাতুন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে উপরঅলার কাছে বিচার দেন।

২.
চট্টগ্রাম বন্দরে ১৫ আগস্ট অপারেশন জ্যাকপটের সাফল্যের পর দ্বিতীয় অপারেশনের জন্য তৈরী হয় আরেকটি দল। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সেই দল চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ করে। দলনেতা মাজহারউল্লাহ মাঝপথে পায়ে আঘাত পেয়ে আহত হলে দায়িত্ব নেন উপনেতা ফারুক-ই-আজম যিনি ১৫ আগস্ট জ্যাকপট অপারেশনে শাহ আলমের দলভুক্ত ছিলেন। এবার আগাম কোন টার্গেট দেয়া হয়নি সেক্টর কমান্ডার থেকে। টার্গেট নির্ধারণ করতে বলা হয়েছে পরিস্থিতি বুঝে। শহরে ঢুকে দলটি বিভিন্ন শেলটারে ছড়িয়ে পড়ে। অপারেশন লক্ষ্য নির্ধারণে পরামর্শের জন্য ফারুক খুঁজে বের করেন কাকলী’র এনায়েত মওলাকে। অপারেশন জ্যাকপটে ‘কাকলী’ নামের বাড়িটা ছিল কমান্ডোদের অন্যতম একটি আশ্রয়। জ্যাকপট অপারেশনের পর খোঁজ পেয়ে পাক আর্মি কাকলী রেইড করলে এনায়েত সাহেব নতুন ঠিকানায় আত্মগোপন করেন।

এনায়েত সাহেব জানালেন এই মুহূর্তে বন্দরে কোন অপারেশান চালানো অসম্ভব। তার চেয়ে বন্দরের বাইরে একটু দূরবর্তী কোন টার্গেটে অপারেশন করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে। বিশেষ করে বহিঃনোঙ্গরে অবস্থানরত জাহাজের উপর।

এনায়েত সাহেবের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল ইস্টার্ন রিফাইনারির ইঞ্জিনিয়ার আজিজুর রহমানের সাথে। কর্মক্ষেত্র পতেঙ্গা হওয়াতে বন্দর এলাকায় গাড়ি নিয়ে নিরুপদ্রব চলাচল করতে পারতেন তিনি। অপারেশন জ্যাকপটে তিনি ও তাঁর স্ত্রী সতর্কতার সাথে খুব সহযোগিতা করেছিলেন নৌকমান্ডোদের। এছাড়া এনায়েত সাহেবের যোগাযোগ ছিল বাঙালী হিতাকাংখী বিরল প্রজাতির এক পাক নেভি অফিসারের সাথে যিনি পাক বাহিনীর অবস্থান সম্পর্কিত বিভিন্ন গোপন তথ্য সরবরাহ করতেন তাঁকে। সেই সূত্রে পাক নেভির অবস্থান সংক্রান্ত খোঁজখবর নিয়ে তিনি আজিজুর রহমানের গাড়িতে করে ফারুককে বন্দর এলাকায় রেকি করতে সাহায্য করেন।

সমস্ত দিনভর রেকি শেষে ফারুক জানালেন বন্দর এলাকায় কোন অভিযান সম্ভব না হলেও বহিঃনোঙ্গরে অপারেশন করা সম্ভব। এবং সেটা কর্ণফুলী মোহনার উল্টোদিকে আনোয়ারার গহিরা সৈকত দিয়ে। তবে পাক বাহিনীর কড়া নজরদারী এড়িয়ে নদী পার হতে হবে ভিন্ন কৌশলে। আনোয়ারায় মোহছেন আউলিয়ার মাজার। সেই মাজারে প্রতিদিন অনেক লোক যাতায়াত করে নৌকা করে। সেই মাজারে সিন্নি দেবার অজুহাতে শহর থেকে ছাগল, চাল চাল ইত্যাদি কিনে নৌকায় করে মাজারভক্তের বেশবাস নিয়ে নৌকা করে নদী পার হতে হবে।

পরিকল্পনামাফিক পাক আর্মির চোখের প্রায় সম্মুখ দিয়েই একাধিক দলে বিভক্ত হয়ে কমান্ডোরা চলে যায় নদীর ওপারে। এবারও পুরো অপারেশন আত্মঘাতী। গহিরা পৌঁছে চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেয় দলটা। নির্বাচিত কমান্ডো দলে মোট ৯ টি মাইন নিয়ে ৯ জন থাকলেও হঠাৎ করে সেলিম বাঙালী নামে একজন শেষ মুহূর্তে প্রাণভয়ে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলে সমস্যা হয়ে গেল। তাকে বাদ দিয়েই অপারেশনটা করতে হবে এখন। এরকম অবস্থায় দলের একজন বিগড়ে যাওয়াও সমস্ত অপারেশনের জন্য বিপর্যয়কর। আবার তাকে ছেড়েও দেয়া যাচ্ছে না নিরাপত্তার কারণে।

আশংকায় ভরা সেই বিপর্যয়ের মুখে হঠাৎ করে পেছনের সারির একটি তরুণ মুখ এগিয়ে এসে জেদ ধরলো তাকে নিতে হবে। তরুণটি গত ২৮ আগস্ট এই এলাকা দিয়েই একটি অপ্রচারিত এবং ব্যর্থ নৌ অভিযানে অংশ নিয়েছিল আবদুর রশীদের নেতৃত্বে। ছেলেটির বয়স বড়জোর ১৭/১৮, মুখে এখনো কৈশোরের চিহ্ন। বয়স কম, অনভিজ্ঞ ইত্যাদি কারণে দলনেতা তাকে নিতে রাজী হচ্ছিল না। কিন্তু ছেলেটা নাছোড়বান্দা। সে কঠিন জেদ ধরেছে তাকে নিতেই হবে। দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে ভুগতে ফারুক-ই-আজম শেষমেশ রাজী হলেন তাকে কমান্ডো দলভুক্ত করতে।
এই জেদী ছেলেটি হাটহাজারীর সেই ঘর পালানো হোসেন ফরিদ।

৩.
যুদ্ধ শুরু হবার মাস দেড়েক পর ফরিদ একদিন গ্রামের এক ছেলের কাছে জানলো আশেপাশে অনেকে ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নিচ্ছে। পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু হয়েছে বিভিন্ন জায়গায়, ফরিদ যেতে আগ্রহী কিনা। এতদিন ধরে এই ডাকের অপেক্ষায় ছিল ফরিদ। ডাক পাওয়া মাত্র রক্তে বান ডাকলো ফরিদের। বাড়িতে কাউকে কিছু না বলে একদিন নিরুদ্দেশ হয়ে গেল।

১৫ আগস্ট অপারেশন জ্যাকপট সাফল্যের মুখ দেখলেও সেই অপারেশনে তিন গ্রুপের মধ্যে রশিদ আহমদ গ্রুপ অংশ নিতে পারেনি যাত্রাপথে বিঘ্ন ঘটার কারণে। সেই রশিদ আহমদ ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়ে ৬ জনের একটি দল নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের মোহনার দিকে একটি অপ্রচারিত অপারেশনে অংশ নিয়েছিল ২৮ আগস্ট। সেই দলের একজন ছিল হোসেন ফরিদ। কিন্তু দলটি অপারেশন সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয় অনভিজ্ঞতার কারণে। ব্যর্থ হলেও কেউ ধরা পড়েনি। শহরে ফিরে এসে পরবর্তী অপারেশনে অংশ নেবার অপেক্ষা করে গোপন আস্তানায়।

কিন্তু গ্রামে গিয়ে একবার মাকে দেখে আসার সময় করতে পারছে না নিরাপত্তার কারণে। যে অপারেশনের কাজে নেমেছে তাতে ভীষণ গোপনীয়তা। কেউ যেন না জানে। ধরা পড়া চলবে না। ট্রেনিং এর সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা ছিল ধরা না পড়া এবং ধরা পড়লেও কোন তথ্য ফাঁস না করা। ফরিদ ধর্মগ্রন্থ ছুঁয়ে পবিত্র শপথ করেছে। প্রাণ গেলেও কারো কোন তথ্য প্রকাশ করবে না।

তবে ট্রেনিং এ গিয়ে ফরিদ একটা কঠিন মিথ্যে বলেছিল। এই ট্রেনিং এর অন্যতম পূর্বশর্ত ছিল- কোন পরিবারের একমাত্র ছেলে এই অপারেশনে যোগ দিতে পারবে না। এটি একটি আত্মঘাতী অপারেশন যেখানে মৃত্যুর সম্ভাবনা ৯৯%। পিতামাতাকে একমাত্র সন্তান হারাবার মতো আঘাত না দেয়ার জন্যই ট্রেনিং কর্তৃপক্ষ সেই শর্ত আরোপ করেছিলেন। ফরিদ পরিবারের একমাত্র সন্তান- এই তথ্য গোপন করে কমান্ডো ট্রেনিং এ যোগদান করেছিল।

দেশে প্রবেশ করে অপারেশনের উদ্দেশ্যে পাহাড়তলী সরাইপাড়া হয়ে যখন ওরা শহরে প্রবেশ করছিল মধ্যরাতে, ফরিদের বুকে মাকে দেখার আকুতিটা প্রচণ্ড বেগে ঝড় তুলতে শুরু করেছিল। কিন্তু সেটা জোর করে চেপে রেখে নিজেকে বোঝালো অপারেশানটা হয়ে যাক আগে, ফাঁক পেলে একদিন মাকে দেখে আসবো। এখন রুটের বাইরে যাওয়া চলবে না। সফল হবার জন্য কমান্ডারের হুকুম ও রুট-ম্যাপ ধরে আগাতে হবে প্রতিটা পদক্ষেপে।

ফরিদ মায়ের মুখ দেখার আকুতিকে স্থগিত রাখে দেশ মাতৃকার নিরাপত্তার কথা ভেবে।

৪.
অপারেশন আরো ঘণ্টা দুয়েক পর। তিনটা দলকে মোট নয়টি লিমপেট মাইন বুঝিয়ে দিয়ে সবকিছু চূড়ান্ত করে গোটা অপারেশানটা নিয়ে ভাবতে বসলেন দলনেতা। সেই সাথে ভাবলেন ফরিদকে নিয়ে। দলের মধ্যে সবচেয়ে কনিষ্ঠ ছেলেটি। সে আগেও একটা দুঃসাহসী অপারেশনে অংশ নিয়েছে। সেবার ব্যর্থ হলেও আবারো সে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি এই দুর্গম অপারেশনে যুক্ত হবার জন্য জেদ ধরেছে, এই জেদের উৎস কী? দেশপ্রেম একটা মানুষকে কতটা শক্তিশালী করে? স্বাভাবিক সময়ে এরকম আত্মঘাতী একটা পরিকল্পনায় যুক্ত হবার জন্য কোন পাগলও রাজী হবার কথা নয়। কিন্তু দেশের মুক্তির যে তীব্র আবেগ সেই আবেগ ভয়ের অনেক ঊর্ধ্বাকাশে বাস করে।

মাঝরাতের দিকে নতুন একটা ঝামেলা হয়ে গেল। কথা ছিল দুটো নৌকা আসবে ওদের সমুদ্রে নামিয়ে দেবার জন্য। কোন কারণে নৌকাগুলো আসেনি। আজ সমুদ্র গরম। উত্তাল ঢেউ। সেই কারণেই হয়তো নৌকার মাঝি সাহস করেনি। দলের সবাই দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। দলনেতা অনেক খোঁজখবর নিয়েও কিছু পেলেন না। আর কোন নৌকা নেই কাছে ধারে। সেরকম বিশ্বাসী মাঝি পাওয়া মুশকিল। পরিকল্পনা প্রায় ভেস্তে যাবার দশা। কিন্তু কমান্ডোরা বললো, নৌকা ছাড়াই তারা অপারেশন করতে পারবে। ফিরে আসার সময় হয়তো জোয়ার থাকবে। দুঘণ্টা সাঁতরাতে হলেও তারা পারবে।

নানান অনিশ্চয়তার দোলায় দুলতে দুলতে দলনেতা সিদ্ধান্ত দিলেন অপারেশন হবে। রাত তখন সাড়ে এগারোটা পেরিয়েছে।

ফরিদ তৈরী হয়ে নিল। পায়ে ফিন লাগিয়ে, কোমরের গামছায় ৫ কেজি ওজনের মাইনটা বেধে নিল। তিনজনে একটা দল। একটা জাহাজের জন্য তিনটা মাইন বরাদ্দ। সমুদ্রে নামার আগে ফরিদ দলনেতাকে বললো, আমাকে কলেমা পড়িয়ে বিদায় দিন। দলনেতার বুকটা কেঁপে উঠলো অজানা আশংকায়। কলেমা পড়ে মাথায় ফরিদের মাথায় ফু দিয়ে দিলেন।

সমুদ্রে নেমে গেল সবাই। তিনটা দল। প্রতি তিনজনে একটা দল। ফরিদ নুরুল হকের দলে। মাঝে নুরুল হক, দুপাশে ফরিদ ও গোলাম মওলা। তিনজন হাত ধরে সাঁতার কেটে এগিয়ে যাচ্ছে জাহাজের দিকে। একটা ব্যাপারে হিসেবে ভুল হয়ে গিয়েছিল। নৌকার জন্য অপেক্ষা করতে করতে নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাওয়াতে সমুদ্রের জোয়ারের সময় চলে এসেছে। স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটতে গিয়ে বুঝতে পারলো এটা নতুন ধরনের অভিজ্ঞতা। এই স্রোতটা কেমন একটু ভিন্ন। ওরা তিনজন হাত ধরে সাঁতরাচ্ছিল। মোহনায় লক্ষ লক্ষ চিংড়ির পোনার ঝাঁকের বাধা পেরিয়ে আরো এগিয়ে যাবার পর ত্রিমুখী স্রোতের টান অনুভব করলো ওরা।

হঠাৎ প্রচণ্ড এক ঢেউয়ের ধাক্কায় ফরিদ ছিটকে গেল নুরুল হকের হাত থেকে। ফরিদ ওদের হারিয়ে ফেললো, ওরা ফরিদকে হারিয়ে ফেললো। চারদিকে ঢেউয়ের নাচন, তীব্র অন্ধকার, ডাকতে পারছে না ওদের, চিৎকার করার উপায় নেই, কেউ শুনে ফেললে মরণ।

তবু ফরিদ সাহস হারালো না। শুরু হলো এবার একাকী সাঁতার। কিছুক্ষণ পর ফরিদ দেখলো জাহাজের দিকে আর আগানো যাচ্ছে না। জাহাজের বাতিগুলো সেই দূরেই রয়ে গেছে। অনেকক্ষণ সাঁতার দেবার পরও মনে হচ্ছে একই জায়গায় আটকে আছে। ঢেউয়ের আঘাতে দিগভ্রান্তি ঘটলো ফরিদের। একসময় জাহাজ, তীর, বাতিঘর কিছুই দেখতে পেলো না সে। এভাবে মাঝসমুদ্রে আর কতক্ষণ। ডুবে মরতে হবে বেঘোরে? কাজটা তো বাকী রয়ে গেল। এভাবে মরলে চলবে না। তীর খুঁজে তাকে আবারো চেষ্টা করতে হবে। সঙ্গীদের কাউকে দেখলো না অন্ধকারে। এবার চিৎকার করে ডাকার চেষ্টা করেও লাভ হলো না। চারপাশের অন্ধকার ঘিরে শুধু ঢেউয়ের নাচন।

হঠাৎ দূরে একটা বাতি চোখে পড়লো। ওই তো গহিরার বাতিঘর। সে বাতিঘর লক্ষ্য করে সাঁতরাতে শুরু করলো। অনেকক্ষণ সাঁতার দেবার পর তীরের কাছাকাছি এসে সমস্ত শক্তি যেন নিঃশেষ হয়ে গেল। অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়লো তীরে। পেটের কাছে গামছায় তখনো মাইনটা বাধা আছে, পায়ে ফিন আটকানো।

ভোরের আলো ফুটলে ফরিদের জ্ঞান ফিরে আসে। সমস্ত শরীর ব্যথা হয়ে আছে। প্রচণ্ড পানির পিপাসা। গলায় নোনাজল ঢুকে গেছে। সে টলতে টলতে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো। তখনই বুঝলো এটা গহিরা নয়। এটা পতেঙ্গা। অন্ধকারে ভুল করে সে উল্টোদিকে এসে পড়েছে। এখানে তো পাকিস্তানীদের কড়া পাহারা। কোথায় পালাবে?

ফরিদ পালানোর কোন পথ খুঁজে পাবার আগেই তাকে খুঁজে পেল পাকিস্তানী সেনাদের একটা দল এবং তার শরীরে গামছায় আটকানো মাইনটা দেখে বোঝার বাকী রইল না সে কে। অতঃপর সৈন্যদল তাকে ধরে নিকটস্থ ঘাঁটিতে নিয়ে গেল। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে শুরু হলো নির্যাতন। অপারেশন সংক্রান্ত তথ্যের খোঁজে অকথ্য অত্যাচার। যতরকমের নির্যাতন কৌশল আছে সবগুলো প্রয়োগ করা হলো। ফরিদের চেহারা চেনা যাচ্ছে না। রক্তে ভিজে গেছে আপাদমস্তক। তবু তার মুখ দিয়ে কোন কথা বের করতে পারলো না ওরা। জেদ চেপে গেল পাক বাহিনীর। বাঙালের বাচ্চাকে প্রকাশ্যে সাজা দিয়ে দৃষ্টান্ত দেখাতে হবে।

রক্তাক্ত ফরিদকে টেনে হিঁচড়ে নেভাল রোডে নিয়ে আসা হলো। ফরিদের চেতনা প্রায় লোপ পাবার মুখে। ওকে একটা ম্যানহোলে কোমর পর্যন্ত ঢোকানো হলো। কোমরের নীচের অংশ ম্যানহোলের ভিতরে, কোমর থেকে মাথা পর্যন্ত রাস্তার উপর। যেন সে ডুব দিয়ে আছে রাস্তার মাঝখানে। দূর থেকে স্থানীয় লোকজন ভীতচোখে তাকে দেখছে। ওরা চেনে না ফরিদকে। কেন তাকে সাজা দেয়া হচ্ছে তাও জানে না তখনো। ফরিদের ত্রাহি চিৎকারে পতেঙ্গা এলাকার বাতাস কেঁপে কেঁপে উঠছিল।

ম্যানহোলে ঢুকিয়ে দুই সেপাই বগলের কাছে দুপাশে টেনে ধরে আছে। সামনে একজন জিজ্ঞেস করছে- বল এখনো সময় আছে, বল তোর সঙ্গীরা কোথায়, বল তোদের ঘাঁটি কোথায়, বল কোথায় তোদের ট্রেনিং..................ফরিদ কিছুই বললো না, সে ওদের কোন কথাই শুনছিল না আর, তার কান দিয়ে রক্ত পড়ছে। তার পিঠকে পেছন দিকে বাঁকা করে ফেলেছে ওরা। মেরুদণ্ডে চাপ পড়ছে। ওহহহ কী অসহ্য ব্যথা!!!! মেরুদণ্ডের হাড় ভাঙছিল মড়াৎ করে। সেই শব্দ ফরিদের কানে যাচ্ছে না। তার চেতনা লোপ পাচ্ছে। শেষ মুহূর্তে সে তখন মায়ের মুখটা মনে করার চেষ্টা করছিল প্রাণপণে......... “মা... মা ....অমা....মাগো......তার ঠোঁট নড়ছিল। মাকে তার দেখতে যাওয়া হলো না আর.... মা আমাকে ক্ষমা করো.... আমি তোমার জন্য কিছু করতে পারলাম না...তোমাকে আমি দেখতে পেলাম না....আমাকে তুমি দেখতে পেলে না.....আমি তোমার জন্য কোন কিছুই করিনি মা....... দেশের জন্য শুধু আমার সামান্য প্রাণটা দিলাম। যে প্রাণটা তুমি আমাকে দিয়েছিলে, সেই প্রাণ আজ আমি বাংলার মাটিতে রেখে গেলাম”।

সেই রক্তাক্ত হৃদয়শব্দ বোঝার মতো কেউ সেখানে ছিল না। ভিনদেশী দুই সেপাই ফরিদের পিঠটা উল্টোদিকে চাপ দিলে ছোট্ট একটা শব্দে মেরুদণ্ডটা ভেঙ্গে গেল চিরতরে। সেই শব্দটা বড়জোর শুনতে পেল ম্যানহোলের ঢাকনা, সড়কের কাঁকর আর কয়েকটি পাকিস্তানী জানোয়ার। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষেরা কেউ সাহস করে এগিয়ে আসতে পারলো না লাশটা নিতে। যে লাশ এমন কোথাও ফেলে দেয়া হয়েছে যার কোন চিহ্ন স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ পায়নি।

*** *** *** *** *** *** *** *** *** *** *** ***

আমরা ফরিদের সমাধির ঠিকানা না জানলেও তাঁর মহান আত্মত্যাগের কথা জানি, আরো জানি এই ফরিদদের আপোষহীন প্রাণের বিনিময়ে আমরা একটি পতাকা পেয়েছি, পেয়েছি একটি মানচিত্র। তাই ফরিদকে আমরা খুঁজবো সেই পতাকার লাল সবুজে। তবু সেই পতাকা উড়লে কেন দাঁড়িয়ে সম্মান জানাতে হয় বলে যেসব অর্বাচীন প্রশ্ন করে, তাদের বলি -শুধু একজন ফরিদ নয়, হাজারো লাখো ফরিদের রক্তে পাওয়া যে পতাকা, সে পতাকার লাল বৃত্ত একটি রং মাত্র নয়, আমাদের পতাকার লাল রং ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত চিহ্ন!!

[মোহাম্মদ হোসেন ফরিদের গ্রামের বাড়ি পশ্চিম ধলই, কাটিরহাট, হাটহাজারী। বাবা আহমদ মিয়া রেলওয়ের কর্মচারী ছিলেন। দেশ স্বাধীন হবার পর হোসেন ফরিদকে মরণোত্তর ‘বীর প্রতীক’ উপাধি দেয়া হয়।]

পাদটীকা

  • ১. তথ্য সুত্র:
    ১. কর্নেল (অব.) শফিক উল্লাহ, বীর প্রতীক
    ২. নৌ কমাণ্ডো নুরুল হক
    ৩. নৌ কমাণ্ডো খলিলুর রহমান

মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

এরপরেও যখন কিছু পাকি বীর্যের নাপাক ফসল বলে বেড়ায় পুরাতন সবকিছু ভুলে নতুন করে শুরু করা দরকার, তখন বেইমানগুলোকে ব্রাশফায়ার করে মারতে ইচ্ছে করে।

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

নীড় সন্ধানী এর ছবি

যারা বলে তারা তাদের পিতৃপুরুষ সম্পর্কেও একই কথা বললে মানানসই হতো।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

নজমুল আলবাব এর ছবি

সেদিনের অপারেশন শেষ পর্যন্ত হয়েছিলো? অন্য কমাণ্ডোরা ঠিক ছিলেন?

নীড় সন্ধানী এর ছবি

অপারেশানটা ব্যর্থ হয়েছিল। আরো দুই কমাণ্ডো ধরা পড়েছিল সেদিন।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

অনুসন্ধিৎসু এর ছবি

হোসেন ফরিদের মতো শহীদের জন্য রইলো লাখো সেলাম।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

লাখো সালাম!

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

এই ফরিদদের আপোষহীন প্রাণের বিনিময়ে আমরা একটি পতাকা পেয়েছি, পেয়েছি একটি মানচিত্র। তাই ফরিদকে আমরা খুঁজবো সেই পতাকার লাল সবুজে। তবু সেই পতাকা উড়লে কেন দাঁড়িয়ে সম্মান জানাতে হয় বলে যেসব অর্বাচীন প্রশ্ন করে, তাদের বলি -শুধু একজন ফরিদ নয়, হাজারো লাখো ফরিদের রক্তে পাওয়া যে পতাকা, সে পতাকার লাল বৃত্ত একটি রং মাত্র নয়, আমাদের পতাকার লাল রং ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত চিহ্ন!!

চলুক

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

নীড় সন্ধানী এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

রানা মেহের এর ছবি

এই মানুষগুলোর সাহসের উৎস কোথায়? এতো শক্তি কীকরে পেতেন তারা!

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

নীড় সন্ধানী এর ছবি

তাঁদের রক্তে, স্নায়ুতে এমন কোন অদৃশ্য শক্তি ছিল যা আমাদের বোঝার বাইরে!

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।