যদি কিছু আমারে শুধাও.....

নীড় সন্ধানী এর ছবি
লিখেছেন নীড় সন্ধানী (তারিখ: শুক্র, ৩১/০৫/২০১৯ - ১:৫৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১.
বৈশাখে জড়ো হওয়া বৃষ্টির মেঘগুলো এবার জ্যৈষ্ঠমাসে এসে উধাও। অথচ এই দিনে খুব বৃষ্টি ছিল সেদিন। ঝড়ো হাওয়ার সিগন্যাল ছিল। ভিজতে ভিজতে সেই রেস্তোঁরায় ঢুকে পড়েছিলাম জুবুথুবু হয়ে। জিইসির কাছাকাছি সেই রেস্তোঁরা ভেঙ্গে মার্কেট উঠে গেছে এখন। ওখানে আমরা গরমে আইস কফি খেয়েছি কতদিন! স্মৃতিগুলো গল্পের মধ্যেই বেঁচে থাকবে।

ছুটির দিন আজ। কোন কাজ নেই দুপুরে খাবার আগে। মেসের সবাই বাড়ি চলে গেছে। ইচ্ছে ছিল কোন বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে আড্ডা দিয়ে কাটাবো। কিন্তু বন্ধুরা সব এখন একেকটি সংসারের মালিক। ছুটির সকাল তাদের ব্যস্ততম সময়। আমার মতো গতস্য নিঃসঙ্গ মানুষকে সেখানে বেমানান লাগে।

সকালে নাস্তা সেরে রেডিও টিউন করতে বসলাম। র‍্যাণ্ডম স্টেশনের র‍্যাণ্ডম মিউজিক। হঠাৎ ভেসে এলো বহু পুরোনো একটি গান। যে গানের কারণে জীবনের একটি অধ্যায়ের সমাপনী ঘটেছিল। অথচ ব্যাপারটা ইচ্ছাকৃত ছিল না। কিন্তু না চাইলেও কিছু কিছু ভুল বোঝাবুঝি আপনাকে নাকাল করে দিতে পারে একেক সময়।

নবনীতার কথা মনে আছে নিশ্চয়ই। উঠে যাওয়া সেই রেস্তোঁরায় আইসকফি খেতাম যাকে নিয়ে। না, যা ভাবছেন সেরকম কিছু নয়। আমাদের মধ্যে তেমন কিছু ছিল না। ক্লাসমেটরা একটু ভালো বন্ধু হলে যেটুক হয় ততটাই। অন্তত প্রকাশ্যে তাই।

নবনীতার কাছ থেকে একদিন অনুরোধ এলো একটি গানের অনুবাদ করতে হবে। গানটি হাতে লিখে প্যারায় প্যারায় ফাঁকা রাখলো মাঝখানে। ফাঁকা জায়গায় অনুবাদ লিখে ডাকযোগে পাঠাতে হবে। বাংলা গানের বাংলা অনুবাদ? আমি অবাক। এমন অনুবাদও হয় নাকি? সেই অনুবাদ আবার ডাকযোগে পাঠাতে হবে। কী মজার কাণ্ড। সবসময় অদ্ভুত কিছু করতে পছন্দ করতো সে। তাই সাদামাটাভাবে নিলাম ব্যাপারটাকে। সেখানেই মস্ত ভুল করেছি। মনে মনে তো আমার অন্য ইচ্ছা ছিল। আরো পরে টের পেয়েছি- সময় গেলে সাধন হয় না।

২.
গানটার লেখা ও সুর সলিল চৌধুরীর। আদিতে গেয়েছিলেন শ্যামল মিত্র, দেবব্রত বিশ্বাস দুজনই। কিন্তু কেন জানি শ্রীকান্তের কণ্ঠে বেশি ভালো লেগেছিল। যুগের প্রভাব হতে পারে।

প্যারায় প্যারায় গানের অনুবাদ করে চিঠিটা ডাকবাক্সে রেখে আসলাম।

যদি কিছু আমারে শুধাও
কি যে তোমারে কবো
নীরবে চাহিয়া রবো
না বলা কথা বুঝিয়া নাও।।
(সে যে আমারই কথা। এই একই কথা। এই ভাষার অনুবাদ হয় না। হলেও তা প্রকাশ করা যায় না। আমাদের জন্য ভীষণ ভীষণ অসম্ভব। নীরবতার যে ভাষা কেবল দুজন মানুষের মধ্যে বিনিময় ঘটে সে ভাষার অনুবাদ দরকার হয় না)

ঐ আকাশ নত যুগে যুগে সংযত
নীরবতা অবিরত
কথা বলে গেছে কত।
(আকাশের চেয়েও আমরা সংযত। কখনো কোন মেঘের ছায়া খুঁজিনি। বাতাসে বকুল গন্ধ, বৃষ্টির ধোঁয়ায় আনমনা)

তেমনই আমার বাণী
সৌরভে কানাকানি।
হয় যদি ভ্রমরা গো
সে ব্যাথা বুঝিয়া নাও।।
(সেই সৌরভ তোমার আছে জানি। যুগ যুগ ধরে বইছে তবু কখনো হাত বাড়াইনি কল্পনার বাইরে এসে। দূর থেকেই বুঝে গিয়েছি যা বোঝার ছিল)

অন্তরে অন্তরে যদি কোন মন্তরে
বোবা এ প্রাণের ব্যাথা
বোঝানো যেতো গো তারে।
(তাকে বোঝানো গেছে। কোন মন্ত্রের প্রয়োজন হয়নি। একই প্রাণের ব্যথা তার ভেতরেও খুব গোপনে বাজে)

কবির কবিতা সবই
তুলি দিয়ে আঁকা ছবি।
কিছু নয় তার কাছে
এটুকু বুঝিয়া নাও।।
(কবিরা আমাদের কবিতা লিখেছে কী? শিল্পীদের তুলিতে আমাদের ছবি আঁকার সাহস আছে কী? কলম নিয়ে চুপ করে বসে থাকবে কবি। তুলি নিয়ে উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকে শিল্পী।আমাদের দুজনের সামনে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অপারগ, অসম্ভব, অবাস্তব….এমন কত কত স্বরে-অ। আমাদের সবই, সবই, সবই স্বরে-অ তে জব্দ!)

৩.
কিন্তু তারপর কী যেন হয়ে গেল। অনুবাদের জবাবে আর কোন চিঠি এলো না। দেখা হলো না। সুর কেটে গেল। ছন্দ ভেসে গেল। সব চুপচাপ হয়ে গেল। মাঝে মাঝে ডাকঘরে খোঁজ নেই। কোথাও কোন পত্র চিরকুটের চিহ্ন নেই। একসময় টের পেলাম আমাদের তুমুল চিঠিযুগ শেষ হয়ে শীতযুগ চলে এসেছে।

অনেকদিন পর এলো একটা টেলিফোন।

জিজ্ঞেস করলাম, এতদিন কোথায় ছিলে? কেন চুপ হয়ে গেলে? এই নীরবতার হেতু কী?

বলা হলো- “নীরবতা! অনুবাদের ভাষায় এটাই তো বলেছো তুমি। এই তো চেয়েছো তুমি। নীরবতাই তোমার চাওয়া ছিল। নীরবতাই পাওনা তোমার। আমাদের সম্পর্কটার নাম নীরবতা। চার অক্ষরের একটি শব্দের মধ্যে দুজনের সমস্ত ভালোবাসা অন্তর্নিহিত। সুতরাং আমাদের আর কোন কথা হবে না।”

ফোন রেখে দিল সে। সেদিন থেকে আর কখনো আমাদের যোগাযোগ হয়নি। কোন কোন সম্পর্ক এমন অদ্ভুত কারণেও শেষ হয়ে যেতে পারে।

৪.
এফ এম রেডিওর গানটা শেষ হবার পর গুনে দেখলাম আট বছর কেটে গেছে। তেইশ বছর বয়সের সেই তরুণ এখন ত্রিশ পাড়ি দিচ্ছে। মনে হয় এই সেদিন। একেকটা গান একেকটা সময়কে ধরে রাখে। এই গানটিও সেই দিনকে ধরে রেখেছে। যখনই যেখানেই শুনি, সেই পুরোনো সময়টা সামনে এসে দাঁড়ায়। একটা দুমুখো শাঁখের করাত নিয়ে কলিজা বরাবর ঘষাঘষি করতে থাকে।

দুপুরের পর চাকরীর ইন্টারভিউর কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাসটা চেপে রাখলাম। এই চাকরীতে পোষাচ্ছে না আর। নতুন চাকরীটা খুব দরকার।

সন্ধ্যার সময় মেসে ফিরে মনটা খুব ফুরফুরে হয়ে গেল। চাকরীটা আমার হয়েই যাবে। প্রাথমিক এবং লিখিত পরপর দুই পরীক্ষাতেই অসাধারণ করেছি। বাকী আছে মৌখিক। আগামীকাল হবে। মৌখিক পরীক্ষায় আমাকে কেউ কখনো ফেল করাতে পারেনি।

পরদিন ধোপধুরস্ত পোষাক পরে ঢুকে পড়লাম অফিসে। বিশাল এক দালানে অফিস। ঢুকতে ঢুকতে বেতনের অংকটা বারবার চোখে ভাসলো। অনেক বড় দায়িত্ব আমার। বেতন বর্তমানের দ্বিগুন। ভাইবা বোর্ডে ঢোকার আগে শুনলাম এটা মূলতঃ সাইকোলজি টেস্ট। চারজন আছেন বোর্ডে যারা আমাকে যাচাই করবেন চুড়ান্তভাবে।

আমার প্রতিদ্বন্দ্বী তিনজনের শেষ হলো একঘন্টার মধ্যেই। আমি শেষ প্রার্থী।

ঘরে ঢুকতেই আমাকে বসতে বললেন যে চশমা পরা তরুণী তাকে চিনতে আমার এক মুহুর্ত বিলম্ব হলো না। কিন্তু সে এখানে কী করে এলো সেই রহস্যের কথা ভাবতে ভাবতে আমার আত্মবিশ্বাস দ্রুতলয়ে নিন্মগামী হতে থাকলো। আমার কথা জড়িয়ে এলো। কোন প্রশ্নের জবাব ঠিকভাবে দিতে পারলাম না।

আধঘন্টা পর রাস্তায় নেমে আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। নবনীতা এই অফিসের হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজার। চেহারায় পূর্বপরিচিতের বিন্দুমাত্র ছাপ না রেখে শেষ বাক্যে রায় দিল - দুঃখিত, আপনাকে মানসিকভাবে ঠিক সুস্থির মনে হচ্ছে না।

আমি জানি বোর্ডে পরিচিত কেউ না থাকলে চাকরীটা নিশ্চিত হয়ে হতো।


মন্তব্য

সত্যপীর এর ছবি

শংকর ঘরাণার লেখা। চমৎকার লাগল।

..................................................................
#Banshibir.

নীড় সন্ধানী এর ছবি

আসলে লিখতে বসছিলাম নদীর রচনা, হয়ে গেল কুম্ভীর কাহিনী দেঁতো হাসি

অ-ট: আগের পোস্টে আপনার বিস্তারিত মন্তব্যের অপেক্ষায় আছি।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

অবনীল এর ছবি

গানটা শুনতে শুনতে লেখাটা পড়লাম। পড়তে পড়তে মনের মধ্যে একটা ভালো লাগা কাজ করলো । খুব সুন্দর একটা আমেজ আছে লেখায়।

___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা

নীড় সন্ধানী এর ছবি

এই গান শুনতে শুনতে লেখাটা ভালো লাগার কথাই। আমিও শুনে নিলাম আরেকবার হাসি

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

গগন শিরীষ এর ছবি

চমৎকার গল্প!

নীড় সন্ধানী এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ গগন শিরীষ হাসি

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

নজমুল আলবাব এর ছবি

ভালো লাগলো

নীড় সন্ধানী এর ছবি

পড়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ হাসি

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

কর্ণজয় এর ছবি

গল্পটা কোথাও থেকে যায়। মনের ভেতরে। অনেকক্ষণ। দিন পেরিয়ে পরের দিনেও। তা পেরিয়ে পরের দিনও, তার পরের দিনও। গল্পটা পড়েছি প্রায় চারদিন। একটা আমেজ (অবনীলের ভাষায়), আছে এখনও।
কোথাও গিয়ে নবনীতাকে চেনা মনে হয়।
এরকম নীরবতার গল্প, আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে আছে বলেই হয়তো।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

চারদিন ধরে গল্পের আমেজ থেকে যাওয়াটা লেখকের জন্য ভীষণ ভালো সংবাদ। মনে হচ্ছে গল্পটা লিখে সার্থকতা মিলেছে।
এই রক্ষণশীল দেশে এমন নীরবতার গল্প অবিরল হাসি

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

কীর্তিনাশা এর ছবি

সুন্দর গল্প।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

এক লহমা এর ছবি

পানীয় পুরানো। কিন্তু পাত্রখানা চমৎকার হয়েছে। দেঁতো হাসি

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।