একটি ভ্রমনের ইতিবৃত্ত : : কুয়াকাটা-০১

ইমরুল কায়েস এর ছবি
লিখেছেন ইমরুল কায়েস (তারিখ: রবি, ৩০/১১/২০০৮ - ১০:২০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

[১] বুয়েটে এক শিডিউলে পরীক্ষা খুব কম সময়েই হয়েছে । এবারও তাই হল। ঈদের আগে একটামাত্র পরীক্ষা ছিল । এটাও নাকি দেয়া যাবে না । মিছিল হল দুইদিন । পরীক্ষা পিছাও , পরীক্ষা পিছাও আওয়াজ । আর বুয়েটের স্টুডেন্ট সবাই জানে এরকম মিছিল হলে পরীক্ষা আর হয় না । এবারও হল না। মাসখানেকের বন্ধ পেয়ে মনে হল এইবারে একটু কোথাও থেকে ঘুরে আসা যাক। সেই কবে একবছর আগে বান্দরবন-বগালেক গিয়েছিলাম এরপর এই এক বছরে শুধু খাওয়া-পড়া-ঘুম আর খাওয়া-পড়া-ঘুম । এই চক্র থেকে বের হতে হবে বলে মনস্ত করলাম । সিদ্ধান্ত হল কুয়াকাটা যাব । কুয়াকাটায় আগে কখনো যাওয়া হয় নি । এখানে নাকি সূর্যাস্ত-সূর্যোদয় দুটোই দেখা যায় । যতদূর চোখ যায় পানি ছাড়া আর কিছু নেই এমন একটা জায়গা থেকে আস্তে আস্তে সূর্য উঠবে আবার সারাদিন গরম ছড়িয়ে পড়ন্ত বিকেলে এই রকমই আরেকটা জায়গা দিয়ে আস্তে আস্তে নামতে নামতে একসময় পানির মধ্যে হারিয়ে যাবে এরকম দুটি দৃশ্য কল্পনা করতেই ভাল লাগছিল । এ দৃশ্য দেখার জন্য খুব বেশী দেরী করতে হল না । বলামাত্র আরও পাঁচজন রাজী হয়ে গেল । সুন্দরবন-৫ এর কেবিনে শুক্রবার সন্ধ্যায় আমরা ছয়জন চেপে বসলাম ।

[২] লঞ্চে আগে কখনো চড়া হয় নি । সাঁতারও জানি না । সাঁতার শেখার চেষ্টাও করিনি জীবনে । সারাবছরে যে হারে লঞ্চ ডোবে এর আর ভরসা কি ? লঞ্চে উঠে আমি তাই কেবিনের আশে-পাশে সবার অলক্ষ্যে লাইফ জ্যাকেট জাতীয় কিছু খুঁজে বেড়ালাম । এরকম কিছু পেলাম না । কেবিনের দরজার সামনে অবশ্য যানবাহনের টায়ার টাইপ একটা জিনিস দেখতে পেলাম । ভাবলাম যাক এটা দিয়ে অন্তত ভেসে থাকা যাবে ।অন্য পাঁচজন যখন কেবিনের সামনে আড্ডাকেবিনে আড্ডায় মশগুল আমি তখন এই টায়ার জাতীয় জিনিসটা খোলার চেষ্টা করলাম এবং যারপরনাই হতাশ হলাম ।এখন যদি এটা খোলা না যায় লঞ্চ ডোবার ক্রান্তিকালে এটা কিভাবে খোলা যাবে ভেবে পেলাম না । কুয়াকাটায় বীচে গিয়ে দেখেছি একটা ফুটবল নিয়ে আরামসে পানির মধ্যে ভেসে থাকা যায় । আগে জানলে এদের উপর আর ভরসা না করে নিজেই ব্যাগের মধ্যে একটা ফুটবল নিয়ে আসতাম ! জীবন বলে কথা । ফুটবল পাওয়া কঠিন কিছু হত না । হলের পোলাপাইনের কাছে বিকেলে খেলার জন্য এমনিই ফুটবল থাকে ।

রাতের লঞ্চভ্রমন অদ্ভুদ লাগে । চারিদিকে শুনশান নীরবতার মধ্যে মৃদু শব্দ তুলে লঞ্চটা এগিয়ে যায় । কেবিন পেরিয়ে সামনে লঞ্চের সার্চলাইট , মাঝে মাঝে সেটা জ্বলে ওঠে । লঞ্চের সার্চইটের পাশেএদিক ওদিক ফোকাস করে নদীরে বুক চিরে আলো ফেলে । হু-হু করে মৃদু ঠান্ডা বাতাস এসে চরিদিক ভরিয়ে দেয় । সোজা কথায় বলতে গেলে এক অপার্থিব পরিবেশ ।

[৩] কুয়াকাটা যাওয়ার আগে এক সুশীলের পরামর্শ নিলাম । সে আমাকে বলল লঞ্চে যাবতীয় খাবারদাবার আগে থেকেই এনে রাখবি । লঞ্চের ডিনারের অবস্থা খুব খারাপ আর দামও বেশী সো বেশী টাকাপয়সা দিয়ে খাবাপ খাওয়ার কি দরকার ? আমি এই কথাটা সবার কাছে পাড়লাম । সদরঘাটে রিক্সা যখন পুরান ঢাকা দিয়েই যাচ্ছে সুতরাং ওখানকার কোন দোকান থেকেই রাতের খাবার হিসেবে মোরগ-পোলাও অথবা বিরিয়ানী নিয়ে যাওয়া হোক । কেউ কথাটায় খুব একটা গা করল না , সবাই নাকি লঞ্চের খাবারই খাবে । সুশীলের পরামর্শ কেউ শুনল না । অগত্যা আমি আর এক কুশীল এই দুই কুশীল মিলে পুরান ঢাকার একটা দোকান থেকে মোরগ পোলাও কিনলাম । আমি আবার মোরগ পোলাওয়ের সাথে গরূর মাংসও আলাদা করে কিনলাম । শালারা কথা শুনলি না , লঞ্চে ফালতু খাবার যখন তোরা খাবি তখন দেখিয়ে দেখিয়ে আমরা দুজন এসব খাব । পোলাওয়ের দোকানদারকে বললাম ভাই খাবারগুলো রাত দশটার দিকে খাওয়া হবে সমস্যা তো নাই নাকি ? সে বলল ছমছ্যার কি আছে ? সমস্যা অবশ্য হল , কিছুটা না , সমস্যা ভালই হল ।

রাতে দেখি লঞ্চে খাবারদাবারের বিশাল আয়োজন । দেশী মুরগীর ঝোল , সব্জি , ডাল চচ্চরী । ঘরোয়া রান্না সব । পরিবেশনের সময়ই বোঝা যাচ্ছিল খাবারের কোয়ালিটি বোধহয় ভালই ,অন্তত সুশীল বর্ণিত কুখাদ্য নয় । আমরা দুইজনও আমাদের বাক্স-পেটরা থেকে মোরগ-পোলাও বের করে খাওয়া শুরু করলাম । কুশীল বন্ধু সবাইকে শুনিয়ে পোলায়ের নানান গুনগান গাওয়া শুরু করল । কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম কেস খারাপ । পোলাও টক-টক লাগে কেন ? আমি তাকে কানে কানে বললাম আস্তে চাপা কম পিটা সমস্যা আছে । গরূর যে মাংসটা নিয়েছিলাম গন্ধটা বেশী উঠেছিল বোধহয় তাতেই । আমি তাই বলতে গেলে বসেই আছি খাবার নিয়ে । এখন কি করা যায় । এমন সময় কেবিনে আরেক কুশীল ঢুকল যে এতক্ষন বাথরুমে ছিল । সে এসেই বলল , কি ব্যাপার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে কিসের ? আমি বললাম মোরগ পোলাওয়ের গন্ধ । সে বলল , না এটাতো পঁচা খাবারের গন্ধ মনে হচ্ছে , দেখ তোদের খাবার পঁচি (এই কুশীলের আবার ক্রিয়াপদে হ্রস্ব ই-কার প্রয়োগের বাতিগ আছে ) গেছে । আমরা বুঝলাম হ্যাঁ গন্ধটা মনে হয় বাড়াবাড়ি রকমেরই উঠেছে । খাওয়া আর গেল না বোধহয় । বাকী সবাই তখন লঞ্চের খাবারের প্রয়োজনের অধিক প্রশংসা শুরু করে দিয়েছে । হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে এরা সারাজীবনে এরকম মধুর রান্না আর খায় নাই , যদিও বোঝা যাচ্ছে এই প্রশংসার অধিকাংশই ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া হিসেবে । যাই হোক চিপায় পড়ে আমার দুজন তখন মিনমিনে গলায় ওরা যা খাচ্ছিল সেই খাবারেই অর্ডারই দিলাম । খাবার আসল । খাবার তো ভালই । রান্নায় কোন সমস্যা নাই । খাবারের বাকী পর্বটা ঐ সুশীলকে নিয়ে কুকথা বলেই পার করলাম সবাই ।

[৪] পটুয়াখালী পৌছালাম ভোরবেলায় । লঞ্চঘাটাতেই একটা মাইক্রোবাস পাওয়া গেল । মাইক্রোবাসওয়ালা দেখি পটুয়াখালি থেকে কুয়াকাটা মাত্র আটশো টাকা চায় । বাস ভাড়াই যেখানে প্রতিজনে একশো টাকা করে সেখানে ছয়জনের জন্য কিভাবে সে আটশো টাকা চায় ব্যাপারটা মাথায় ঢুকল না । মাইক্রোবাসে করে কুয়াকাটার পথেতার উপরে পটুয়াখালি-কুয়াকাটা রাস্তার বেহাল হাল সবাই জানে । যাই হোক বিষয়টা পরিষ্কার হল একটু পরে । কোন জানি অফিসের মাইক্রোবাস এটা । সকাল দশটার মধ্যে এমনিতেই ওদের কুয়াকাটা যেতে হবে । আমাদের কাছে টাকা-পয়সা যা পাওয়া যাচ্ছে সেটাই ওদের লাভ । সে আমাদের বলে, এ ছাড়া এত সস্তায় কি আর পাইতেন , এই রুটের ভাড়া তো এম্নিতেই পয়ত্রিশশো টাকা । চাপাই কি না কে জানে । আমরা মাথা নাড়ি ও আচ্ছা ! যাই হোক ড্রাইভারেরও লাভ আমাদেরও লাভ । ভাগ্য বটে । পটুয়াখালী থেকে কুয়াকাটার রাস্তাটা যেরকম ভেবেছিলাম তার চেয়ে বেশী খারাপ । কোথাও কোথাও পীচঢালা রাস্তা , কোথাও কোথাও রাস্তার মাঝে ইটের টুকফেরীর অপারেটিং রুমে আমরা দুজন---ভাইজান একটু ফেরী চালাইতাম চাইরা দিয়ে রাখা আছে হয়ত পীচ ঢালা হবে আর কিছুদিন পর , কোথাও কোথাও রাস্তার মাঝের পীচ বা ইট কিছুই নাই দেখলে মনে হয় কেউ যেন রাস্তাটা প্রবল আক্রোশে খুবলে খুবলে রেখে গেছে । আন্ধারমানিক পার হচ্ছি ফেরীতে করেযাত্রাপথে ফেরী পার হতে হল তিনটা নদীতে। নদীগুলোর নাম অসাধারণ । একটার নাম আন্ধারমানিক , একটার নাম সোনাতলা । তৃতীয়টা অবশ্য নদী কিনা বোঝা গেল না । খুবই ছোট । নামটাও খালের নামে আলীপুর খাল । দুই-তিনটা ফেরী পাশাপাশী রাখলেই মনে হয় এটা পার হওয়া যেত । তারপরেও এটা একটা ফেরীতেই পার হতে হল । আমাদের মত করে কে আর ভাবে ? কুয়াকাটা পৌছালাম সকাল ১০ টায় । উঠলাম কুয়াকাটা ইনে। ভাল হোটেল । সবার পেট চোঁ- চোঁ করছিল । লাগেজপত্র হোটেলে
রেখেই বেড়িয়ে পড়লাম সকালের নাস্তা করতে । সেখানে একটা কান্ড ঘটে গেল । সেটা না হয় আরেক পর্বেই বলি ।

অডিও : নূর হোসেন কাজ করেন কুয়াকাটা বীচে । পর্যটকদের বিশ্রামের জন্য রাখা আরামকেদারা আর ছাতাগুলোর দেখাশুনা করেন । সিডরকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন । সিডরে হারিয়েছেন বাবা আর ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে তার ব্যবসা । এসব নিয়েই কথা হয় তার সাথে ।

Get this widget | Track details | eSnips Social DNA


মন্তব্য

কিংকর্তব্যবিমূঢ় এর ছবি

দারূণ লিখছেন ... সুশীলের পরামর্শে মজা পাইছি চলুক
................................................................................................
খাদে নামতে আজ ভয় করে, নেই যে কেউ আর হাতটাকে ধরা ...

ইমরুল কায়েস এর ছবি

আপনে মজা পাইছেন এদিকে আমরা তো শ্যাষ ।
==============================
উত্তর বাংলার অনাহারী যুবক

মাহবুব লীলেন এর ছবি

বুদ্ধিজীবিদের বুদ্ধি নেবার মতো নির্বোধ মানুষও বাংলাদেশে আছে?

ইমরুল কায়েস এর ছবি

তাইতো মনে হচ্ছে ।
......................................................
উত্তর বাংলার অনাহারী যুবক

কীর্তিনাশা এর ছবি

কুয়াকাটা গিয়েছি সেই ১৯৯৯-এ। সেও এক দারুন ইতিহাস।
আপনার লেখা ভালো লাগছে। চালিয়ে যান

চলুক
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

মুস্তাফিজ এর ছবি

ভালো লাগতাসে, পটুয়াখালী থেকে কূয়াকাটা, হুম ঐটা একটা রাস্তা, আসলেই জিনিষ, কাউকে শাস্তি দিতে হইলে কূয়াকাটা বেড়ানোর প্রস্তাব দেয়া যায়। এবছর মার্চে গেসিলাম।

...........................
Every Picture Tells a Story

রায়হান আবীর এর ছবি

আর কইয়েন্না। আমরা গেছিলাম বরিশাল থেকে কুয়াকাটা। বাস ভর্তি মানুষ, উপরে মাছ। বাস ব্রেক করে আর সেই পানি জানালা দিয়ে আমাদের গায়ে এসে পড়ে। জঘন্য।

কায়েস ভাই লেখা ভালো হইছে চলুক

=============================

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

জীবনেও লঞ্চে চড়িনি। একবার চড়তে চাই।
লেখা ভালো হয়েছে।

নাসিফ এর ছবি

লিখে যাও কায়েস । sms কাহিনীটা বাদ দিলে কিন্তু আমাকে আবার লিখতে হবে । ঐটা যেন বাদ না যায় ।।

আলমগীর এর ছবি

হঠাৎ করে ঝুলায় দিলেন ক্যান? চলছিল ভালই।

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

ভাল লাগল। চলুক...


A question that sometimes drives me hazy: am I or are the others crazy?

Shahid এর ছবি

Nice to read

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।