প্রথম যাযাবর - ২

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি
লিখেছেন ইশতিয়াক রউফ (তারিখ: সোম, ১৪/০১/২০০৮ - ১২:২০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

জানুয়ারি ১০, ২০০৪
০৬:১২
আবারো বাংলাদেশের সময়ে লিখলাম। সৌল’এ সময় আটকে আছে। তবে ঘড়ির কাঁটা ৩ ঘন্টা এগিয়ে। এখানকার সময় অনুযায়ী সকাল সাড়ে ৮ টার কিছু পরে পৌঁছেছি।

সৌল ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট দেখে আমি স্রেফ মুগ্ধ। এবার সিট পেয়েছিলাম প্যাসেজের পাশেই। গত ফ্লাইটটায় বসেছিলাম একেবারে বাম ডানার উপর। পাশের বিশাল মহিলাকে ডিঙিয়ে ওপাশে ট্রলির কিছুই দেখিনি। খাবার আসলে তার কথা শুনেই বললাম, ল্যাম্ব কারি! অন্য কীই বা বলবো? আমি তো মেন্যুই জানি না! তাই বলে ঠকিনি। খাবারটা মজার ছিল। সমস্যা ছিল একটাই, ভাত একেবারে কম। আয়েশ করে খাবার আশায় এই দফা মনে মনে প্যাসেজের পাশের সিট চাইছিলাম। আশা পুরালেও সাধ মিটলো না।

কোরিয়ান এয়ারের মিনি টিভি দেখে খুশি হয়ে উঠেছিলাম। অনেক কষ্টে জ্যাকি চ্যানের একটা গাজাখুরি সিনেমা (দ্য মেডালিয়ন) কিছুদূর দেখে আগের ফ্লাইট এর পথ ধরলাম। বসে বসে ক্ল্যাসিকাল শুনলাম। অসাধারণ, অপূর্ব, বেশি জোস!

প্লেনে উঠে প্রথমে পিপাসা মেটানোর পথ খুঁজলাম। আগের প্লেনে (টিজি ৩২২) দেখেছিলাম দুই লিটারের বোতল থেকে পানি দিতে। সেই ভরসায় পানি বা কোন ধরনের বোতল ছাড়া উঠেছিলাম। এখানে “চাহিবা-মাত্র” পানি পেলাম, তবে মাত্র ১২০ মিলি’র ছোট্ট কৌটায়। নানীর চমন বাহারের কৌটাও এর চেয়ে বড়! দশাসই বিমানবালার কাছে আরো চাইলাম, মিললো না। কিছুক্ষন পর সবার জন্য রঙ-বেরঙের তরল আসলো। আন্দাজের উপর টেনে নিয়ে অরেঞ্জ জুস পেলাম। স্বাদ ভাল, তবে পরিমাণে অতি, অতি, অতি সীমিত। চেয়েচিন্তে আরো কিছুটা পানি জোগাড় করতে করতেই ঘুমিয়ে গেলাম। একেবারে নিশিরাতে জার্নি হলেও মিনিট বিশেকের বেশি ঘুম হয়নি। জেগে উঠে দেখি আসল খাবার আসছে। খুশিতে নেচে উঠলাম। সব আনন্দের মত এটাও সাময়িক। কাছে এসে কী সব বললো বুঝলাম না। একবার শুধু অমলেট শুনে মানা করলাম। তারপর... (এখানে শুধু এমএসএনের মন খারাপ লাগবে, আসলেই খারাপ লেগেছিল)।

প্যাকেট খুলে দেখি শুধুই ভাত। ধবধবে সাদা, হালকা গরম, একটু নরম। তবে শুধুই ভাত। পাশের প্যাকেটে ফ্রুটস। প্যাকেটের সাইজ এবার চুনের কৌটার মত। সবচেয়ে ছোটটায় হলুদ কী একটা কাটা ছিল। এক কামড় দিয়ে আর পারলাম না। শেষ পর্যন্ত এক কিউব পেয়ারা, তিন টুকরো আনারস, কিছু পেপে, আর একটি মাত্র আঙ্গুরের সেই প্যাকেট সারলাম ভাত দিয়ে। এরপর কফি দিয়ে খেলাম ভেজানো নুডুলস। কাঁচা নুডুলসে গরম পানি, অপূর্ব! ওহ, সাথে কিছু ধনে পাতা ছিল।

০৭:১৪
হঠাৎ দৌঁড়াতে হয়েছিল বোর্ডিঙের জন্য। লাইন ধরে ঢুকলাম। ঢোকার পথে প্রশ্ন করে জানলাম, লাগেজ পৌঁছে গেছে। এস্কেলেটর দিয়ে নামতেই আলাদা করে ডাকা হল। ডিটেকটর দিয়ে দেহতল্লাসী হল। তার আগে জুতা খুলিয়ে খোঁজ করা হল। আমার আগে আরো কয়েকজনকে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া হয়েছিল। ভুল জায়গায় এবং ভুল কারণে হলেও অবশেষে কিছুটা বাড়তি মনোযোগ পেয়ে ভালই লাগছিল। মেটাল ডিটেকশনের সময় অনেক রকম কসরত করতে হল। সব সেরে হাঁটা দেবার মুহূর্তে এক সুন্দরী সুধালো। মানুষ আমার ভেতরটা তখন কোরবানির গরুর মত তড়পাচ্ছে উত্তেজনায়। সুন্দরী হাসলো। আমিও। কাছে এলো। উষ্ণ একটা স্রোত নেমে যাচ্ছে আমার শিড়দাঁড়া বেয়ে, প্রথম জানুয়ারির হিম হাওয়ার সাথে মিলে ঠান্ডা-গরমে কাঁপাচ্ছে। গরু আগেই ছিলাম, এবার কোরবান হয়ে গেলাম।

এরপর বজ্রপাত। সিনেমায় যেমনটা হয়। আই ওয়ান্ট ইউ টু টেক দ্যাট অফ, প্লিজ। বিস্ফারিত চোখে শার্ট খুললাম। গেঞ্জিটাও। ঊর্ধ্বাঙ্গে গান্ধী হলেও আমি তখনও নিম্নাঙ্গে ব্রিটিশ-রাজ। সইলো না সুখ। বেল্ট গিয়েছিল আগেই, এবার প্যান্টও নেমে গেল। বঙ্গ থেকে কেনা থার্মালটায় তখনও জানালা-দরজা গজায়নি বলে রক্ষা। মন ক্ষুব্ধ স্বরে বলছিল, প্লেনের দরজার সাত গজ দূরে শীতের হাওয়ার বদলে হয়তো একটা ঘরে তল্লাসী করা যেত। ফিরে যাবার উপায় বা সামর্থ্য নেই ভেবে মনকে নোয়ালাম। চোখের আগুন ফেটে পড়ছিল আমার সামনে প্লেনে ওঠা এইসব লোকগুলোর সাথেই প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিতে হবে ভেবে। কীট দেখে দৃষ্টির অপচয় হবে ভেবে চোখকে নোয়ালাম। বাকি সব হিমশীতল হাওয়াই নুইয়ে রেখেছিল। ফিরে এল মেটাল ডিটেকটর। হাওয়াই সুরসুরি দিয়ে গেল আমাকে। ক্ষণিক পর রায় দিল, আমি ঝুঁকিমুক্ত। নিঃশব্দ প্রতিজ্ঞা রেখে গেলাম, এমনই এক শীতে আমার ধাতুর সাথে তোমার মিলন হবে। জমিয়ে রাখলাম সব ধাতু সেই নির্বসন সকালের জন্য।

কষ্টের মাঝেও এয়ারপোর্টটা দেখে খুব ভাল লেগেছিল। পাহাড়ের পাশে তৈরি খুবই স্পেশাস, অডিবল, আর ভিজিবল একটা বন্দর। বিশাল স্প্যানের নিচে বাহ্যত খুব অল্প অবলম্বনে তৈরি অদ্ভুত সুন্দর, গোছানো, আর ছিমছাম এয়ারপোর্ট। এখানে-সেখানে লোকজন অলস সময় কাটাচ্ছে। সময় যেন আশ্চর্য ধীর, অথচ গভীর আর ঘন।

টেক-অফ। বন্ধ করি। ঘুমাবো। ওটা শুধু প্রয়োজন না, প্রাপ্য।

১০:৩৩
ডায়েরিটা হাতে ধরেই ঘুমিয়ে গেছিলাম। চোখ মেলে দেখি প্লেন ছুটছে উর্ধ্বাকাশে। গলা বাড়িয়ে নিচে দেখলাম। এয়ারপোর্টটা আসলে অতটা বড় না, তবে যথেষ্ট টার্মিনাল আছে। একটা ছোট্ট লাগোয়া দ্বীপে তৈরি। আশে-পাশে নির্মাণকাজ চলছে। মূল দ্বীপের উপর দিয়ে যেতে যেতে উপর থেকেই বোঝা গেল কত সিস্টেম্যাটিক এই শহরটা। নির্দিষ্ট এলাকার সব দালান এক উচ্চতার, রাস্তাগুলো অনেক তলা বিশিষ্ট, দ্বীপ থেকে দ্বীপে যোগাযোগ রাখছে বিশাল সব ব্রিজ, পাশাপাশি দাঁড়ানো পাহাড়গুলোকে যেন রাস্তা আর তারগুলো জড়িয়ে ধরে আছে।

মন কিছুটা বিষন্ন। নিজেকে অপাঙ্কতেয় দেখে অভ্যস্ত থাকলেও আলাদা বা সন্দেহভাজন হিসেবে দেখে অভ্যাস নেই। দেখা যাক, সময় আর জীবনের দ্বন্দ্বে কে জেতে। আজকে সকালে মেঘের উপর সূর্যোদয় দেখেছি। অনেক দিনের একটা স্বপ্ন পূরণ হল। রাতের ব্যাংককের আলোর রেখা আর দিনের সৌল’এর পরিকল্পিত সৌন্দর্য নিয়ে লেখার ইচ্ছে ছিল, এখন আর নেই। এই প্লেনে টিভি নেই। না থাকায় খুব একটা ক্ষতি-বৃদ্ধি হয়নি। এটা আমার ঘুম আর ক্ল্যাসিকাল শোনার ফ্লাইট। ঘুমটা পুরো হয়নি, ক্ল্যাসিকালটা চলছে। এই বার খাওয়া-দাওয়া প্রচুর করেছি। তবে দুঃখ হল, অনেক দিনের মধ্যে শেষ খাওয়া বিফ’টা এত জঘন্য হবে ভাবতে পারিনি। বমি আসছিলো কালো, পিচ্ছিল মাংসগুলো খেতে গিয়ে। আরেক রাউন্ড বাকি খাবার দেওয়া বাকি। দেখা যাক কী হয় তখন।

যেদিকে তাকাই না কেন, মনে হচ্ছে আর কিছু মানুষ থাকলে সম্পূর্ণ হত সৌন্দর্যটা। ব্যাংককের বইয়ের দোকানে নাঈম, সিডির দোকানে অর্ণব, সৌল এয়ারপোর্টের ঐ অপূর্ব লাউঞ্জে আসিফ, “ডালিম” (Daelim) অটো-ওয়াশ এর সামনে রাহাত, এই মুহূর্তে পাশে আশফাক, খাবার দিলে মা, ডিপার্চার লাউঞ্জে আব্বু, এস্কেলেটরে হামীম, বিমানবালাদের মাঝে মাহমুদ (হারুন), হিন্দি গানের সাথে জায়ান... নাহ্‌, থামার সময় এসেছে।


মন্তব্য

সৌরভ এর ছবি

এরপর বজ্রপাত। সিনেমায় যেমনটা হয়। আই ওয়ান্ট ইউ টু টেক দ্যাট অফ, প্লিজ। বিস্ফারিত চোখে শার্ট খুললাম। গেঞ্জিটাও। ঊর্ধ্বাঙ্গে গান্ধী হলেও আমি তখনও নিম্নাঙ্গে ব্রিটিশ-রাজ। সইলো না সুখ। বেল্ট গিয়েছিল আগেই, এবার প্যান্টও নেমে গেল।

আমাকে একবার কানেক্টিং এ আটকেছিলো কেএল এ, অরূপ মিয়ার দ্যাশে। আমার সাথে সবসময়ের জন্যে থাকা স্কুলব্যাগটা খুলে সব দেখাইতে কয়, আসলে ছিলো প্লাস্টিক দিয়ে ড়্যাপিং করা চকলেট, যেটাকে ব্যাটারা এক্সরেতে বুঝতে পারেনি।

জব্বর ক্ষেপা ক্ষেপসিলাম ওইদিন।
আম্রিকা ছাড়া এইসব জায়গায় ঝাড়িতে ভালো কাজ হয়।


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

আমেরিকার ইমিগ্রেশনে এসব করলে জানেনই তো ফলাফল! প্রথম বার ছিল, জানতাম না কিছুই। জীবনে এত্ত অপমানজনক অভিজ্ঞতা হয় নাই আগে। ইমিগ্রেশনে করলেও পোষাতো। ব্যাটারা একদম প্লেনের সামনে নিয়ে খুলালো সব। ভাবলেই সুন্দর সুন্দর সব গালি মুখে চলে আসে!

কনফুসিয়াস এর ছবি

হাসি
-----------------------------------
যা দেখি তা-ই বলি...

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

ব্যাপারটা কী? আমার পাতলুন নেমে যাওয়ার ঘটনায় আপনি এত খুশি হয়ে উঠলেন যে দাদা? চোখ টিপি

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

বিদেশ ভ্রমনের সবচেয়ে অপ্রিতিকর অংশটুকু মনে হয় বিদেশী এয়ারপোর্টে আমাদের প্রতি কর্তৃপক্ষের বাড়তি মনোযোগ।

তৃতীয় বিশ্ব শব্দটা তখন আর স্রেফ শব্দ থাকে না।

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

আমেরিকার সাধারণ মানুষ খুবই ভাল। তারা এগুলোর বিপক্ষে, কোনদিন বিশ্বাসও করতে পারে না যে এরকম হয়। কিন্তু ইমিগ্রেশনের লোকগুলো আরো খারাপ। সবচেয়ে খারাপ হল ঢাকার কনসুলেটে কাজ করা মেয়েগুলো। পিটায় পিঠের ছাল গুলে ফেলতে মন চায় ওগুলার। ধরাকে সরা জ্ঞান করারো একটা সীমা-পরিসীমা থাকে!

ফারুক হাসান এর ছবি

পিটায় পিঠের ছাল গুলে ফেলতে মন চায় ওগুলার।

ক্ষোভের পরিমাণ বোঝাই যাচ্ছে!
----------------------------------------------
আমাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে একটা নদী-
সাথে নিয়ে একটা পাহাড় আর একটা নিঃসঙ্গ মেঘ।

ইফতেখার নূর এর ছবি

আমার সৌল এয়ারপোর্টের অভিজ্ঞতা খুব ভাল, অন্য সব এয়ারপোর্টের মতই। আমি একটু হাল্কা-পাতলা বলে কি একেবারে ট্রান্সপারেন্ট ছিলুম মনে হয় স্ক্যানারে নাকি!

সিরাত এর ছবি

ভাল লাগলো।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।