আমি ছাত্র, তাই

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি
লিখেছেন ইশতিয়াক রউফ (তারিখ: শুক্র, ২৪/০৮/২০০৭ - ১০:০৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মাঝে মধ্যে মনে হয় স্রেফ বসে থাকি। কিচ্ছু না করে, কোন দিকে না তাকিয়ে, কোন চিন্তায় না ভেসে। স্রেফ বসে থাকি। অলস, অচল, অসার সময় কাটাই কিছু। জানি ভুল, তবু সময় নষ্ট করি হেলায়। আবার কখনো খুব বেশি ইচ্ছা করে কিছু করতে। ‘কিছু’। কী, জানি না। তবে ‘কিছু একটা’। খুব অস্থির লাগে। কখনো উদ্দেশ্যহীন ভাবে হেঁটে বেড়াই, কখনো পথের পাড়ে অচেনা কারো সাথে আড্ডায় মশগুল হয়ে যাই, কখনো ঘাসের পালঙ্কে শুয়ে আকাশ দেখি।

কোন কোন দিন এক রিকশায় চার-পাঁচ জন চড়ে বসি। জান্তব ফোঁসফোঁস আওয়াজে দম নিতে নিতে এগিয়ে চলে রিকশা। আমরা তখন হুডখোলা রিকশায় নগরদর্শনে ব্যস্ত। উঁচু দালানগুলোর দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হই, গল্প করি দূর ভবিষ্যতে কে কেমন দালান বানাবো তা নিয়ে। রিকশাওয়ালার পিঠবেয়ে নেমে আসা ঘামের রেখাগুলো ধীরে ধীরে মূর্ত হয়ে ওঠে চিত্রকল্পের মত। এই চিত্র কিছু পরেই বদলে যায়, চোখে পড়ে না আমাদের। এই আমিই কখনো বিকেল কাটাই তাদের সাথে। বুড়ো চাচাকে বলি আমার পাশে সিটে বসতে, জিজ্ঞেস করি কোথায় ঘুমান উনি, কত টাকা জোটে দিনে, কোনদিন পকেট উলটে শেষ পয়সাটাও দিয়ে দেই।

একেকদিন মেয়ে-ছেলে দেখে লোলুপ চোখে তাকাই। চোখ দিয়ে চেটে দেই যেন। পাশের বন্ধুকে বলি বিশ্রী সব চিন্তার কথা। শিশ বাজাই, চোখ মারি, কামাতুর হয়ে ঠোঁট কামড়াই। এই আমিই বাসে গর্জে উঠি মেয়েদের গায়ে কেউ হাত লাগালে। আমারই সামনে অন্য কেউ শিশ বাজালে এই আমারই কেন যেন গা জ্বালা করে।

বাজারে গেলে হাত নিশপিশ করে যা পাই তা কিনতে। কিনতে না পারি তো মনে হয় স্রেফ আলগোছে মেরে দেই। খুব উশখুশ লাগে। নিষিদ্ধ রোমাঞ্চে কেমন যেন হাল্কা লাগে পা জোড়া। স্বপ্নে ভেসে যাই। এই আমিই আদ্ধেকটা খেয়ে খাবার দিয়ে দেই পাশের নাকশি ভেজা, পেটফোলা, ছেঁড়া হাফপ্যান্ট পড়া কৌতূহলী জীবটাকে।

আয়না সামনে পেলেই কেমন যেন পালোয়ান হয়ে যাই। কখনো ক্রিকেট টিমের ক্যাপ্টেন তো কখনো মাসুদ রানা। আলতো শ্যাডোর সাথে উড়ে যায় ম্যাচজয়ী ছক্কাগুলো, মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকে সোহানা চৌধুরীরা। ওয়েস্টার্ন মুভি মনে পড়ে। ঘোড়া ছুটিয়ে যাই ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড ওয়েস্টের মত। হাইয়ো সিল্ভার, আওয়ে! সামান্য ঝগড়া থেকে বন্ধুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ি প্রায় বিকেলেই। এক বেলা জিতি তো আরেক বেলা হারি। গতরে না পারলে বচনে পুষিয়ে দেই। কখনো বাতাসের সাথে যুদ্ধ করে বীর, কখনো ছায়ার সাথে। তুচ্ছ থেকে তুচ্ছতর ঘটনায়ও আমি হাতা গুটিয়ে এগিয়ে যাই দু’কদম। আবার এই আমিই কখনো পিঠ পেতে ঠেকাই নিপীড়িত বন্ধুকে। একটুও ফিরে তাকাই না, একবারের জন্যও প্রত্যাঘাত করি না। আঘাত করতে যাবার ফাঁকে যদি আমার আশ্রিত বন্ধুর গায়ে লাঠি পড়ে, সেই ভয়ে পরম স্নেহের বাতাবরনে ঢেকে রাখি তাকে।

ঘরে বাবার চেয়েও আমার দাপট বেশি। বাবা যতই উপার্জন করুক, আমার ভাগের খাবারটাই সময় মত আসা চাই। আমার ভাগের রুটিটাই গোল হতে হবে, আমার রুটিটাই পোড়া হতে পারবে না। কোনবেলায় আমিষ না থাকলে আমার মুখ ভার হয়ে থাকে। সবজি মানুষে খায় কিনা, এই নিয়ে আমি ক্ষিপ্ত মত রাখি। এই আমিই বাঁকা-ত্যাঁরা রুটি বানাই বন্যার্তের জন্য। পঁচা পানি ভেঙে মিশে যাই বানভাসির সাথে। এই আমিই সব অহম জলাঞ্জলি দিয়ে প্রবাসের পথে বসে ভিক্ষা করি দেশের জন্য দুটো টাকা জোগাড় করতে।

পড়ার নামে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াই সবান্ধব। ক্লাস বাদ দিয়ে টুয়েন্টি-নাইন খেলি ক্যাফে কাঁপিয়ে। ক্লাসে যাই তো নাক ডেকে ঘুমাই। জেগে থাকলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করি কল্পনাযোগ্য সব রকম নষ্টামি করে। বিকেল হলে দল বেঁধে মাঠে যাই খেলতে। সন্ধ্যা হলে আড্ডায় জমে যাই চা-বিস্কুট সমেত। রাত বাড়লে কোনদিন তেহারি তো কোনদিন বিরিয়ানি। খেলা দেখবো বলে ক্লাস ফাঁকি দেই। বড় কিছু হলে হল্লা-হুল্লোড় করে সব বন্ধ করে দেই। এই আমিই রাত জাগি সমীকরণ সমাধান করতে। গন্ডা খানেক টিউশনি আর পানসে ডালে ভর করে এই আমিই একটি একটি করে দিন অতিপাত করি নতুন দিনের আশায়। জীবনের গতির সাথে তাল রাখতে না পারলেও জীবনের গভীরতা চিনতে চাই কেন যেন।

একটু চাপ আসলেই আমি ঝোপ খুঁজে বসে পড়ি। দেওয়াল দেখলে চতুষ্পদের মত নিজের উপস্থিতির চিহ্ন রেখে যাই। কেউ গাছের ছেলা বাকল দেখে আমাকে মনে করে, কেউ দেওয়ালপাড়ের গন্ধে বাধ্য হয় আমাকে মনে করতে। আমি খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তুলে ফেলি ইমারতের প্লাস্টার। আবার পুরনো দালানগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে আমিই গর্বিত হই এর ঐতিহ্যের অংশ হতে পেরে। আমিই দেওয়াল দাগাই, আমিই দেওয়ালে চড়ি, আমিই দেওয়াল ভাঙি, আমিই দেওয়াল হয়ে দাঁড়াই।

একটু চোখ রাঙালেই আমি চুপ হয়ে যাই, আবার ট্রাক-ট্যাঙ্কের সামনে আমি দাঁড়িয়ে যাই জগতের সবটুকু প্রতিবাদের মূর্তি হয়ে। আমি পথে ধাক্কা দিয়ে চলে যাই, বাসে সিট ছেড়ে দাঁড়িয়ে থাকি। আমি শাহরুখের মত বুকফাড়া জামা পড়ি, আবার রাতজেগে বসে থাকি নববর্ষ বরণ করতে।

আমি পানির মত ভাসমান কখনো। বাঁধনগুলো আমি বাতাসের মত এড়িয়ে যাই কখনো। ধরিত্রীর মত সহিষ্ণু এই আমিই আগুনের মত জ্বলে উঠি অপমানের বদলা নিতে। নিজে না খেয়ে যাকে খাওয়াই, তাকেই প্রতিরোধ করতে আমি দেহের প্রতিটি উপশিরাকে মেরুদণ্ডে পরিণত করি কখনো। অনেক দুর্নীতি দেখেও আমি নিথর, আবার সামান্য অপনীতি দেখেও আমার চামড়ার ভেতরে-বাইরে জ্বলে ওঠে একসাথে।

অনেক দ্বন্দ্ব আমার। আমি ছাত্র, তাই।


মন্তব্য

??? এর ছবি

এই ব্লগারের ভক্ত আমি খামাখাই হই নাই।

.................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

ধন্যবাদ আবারো। জীবন বড় বেশি এলোমেলো এখনো, তাই ব্লগ পড়া হলেও লেখা হয় না। দেশের যা অবস্থা, তাতে ক্ষোভটা রাখতে পারলাম না আর।

এক সময় মনে হত, আমাদের দেশের শৃংখলাজনিত সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য এক বছরের বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষন দরকার সব ছাত্রের।

মত বদলেছে এখন। সামরিক বাহিনীতে কেউ যোগদান করলে তাকে দিয়ে ছয়মাস চাষাবাদ করানো উচিত। তখনই শুধু এই জলপাইগুলো উপলব্ধি করবে সাধারণ মানুষের আবেগ-দুঃখ-যন্ত্রনাগুলো কোথা থেকে আসে।

ভাস্কর এর ছবি

প্রস্তাব পছন্দ হইলো...


স্বপ্নের মতোন মিলেছি সংশয়ে...সংশয় কাটলেই যেনো মৃত্যু আলিঙ্গন...


স্বপ্নের মতোন মিলেছি সংশয়ে...সংশয় কাটলেই যেনো মৃত্যু আলিঙ্গন...

অয়ন এর ছবি

সামরিক বাহিনী আর ছাত্ররা সমাজের পুরাপুরি বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গির দুইটা অংশ। একটা অংশের কাছে নিয়ম ভাঙ্গাই আনন্দ আর আরেকটা অংশের কাছে নিয়ম রক্ষা করাই শিরোধার্য। প্রশ্নই আসে না এই দুই অংশের পাশাপাশি থাকার।
লেখা ভালো লাগছে।

কনফুসিয়াস এর ছবি

কথা পছন্দ হইছে।
-যা দেখি তা-ই বলি...

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

বলতে পারেন আপনার লেখার একজন ভক্ত আমি। কিন্তু অনেকদিন আপনি চুপচাপ ছিলেন। এখন বুঝলাম ছাত্রত্বের দ্বন্দ্বই এর কারণ।

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

এখন বুঝলাম ছাত্রত্বের দ্বন্দ্বই এর কারণ

...ওরফে নারীদর্শনে ব্যস্ততা! চোখ টিপি

সবেমাত্র ক্যাম্পাস বদলালাম। এখনো ঘরবাড়ি গুছিয়ে কুলাতে পারি নাই। কাজ, ক্লাস, সংসার, ইত্যাদি মিলিয়ে আল্লাহর ঠ্যাডা মাথায় পড়ছে সকাল-বিকাল! লেখার মত অ নে ক কিছু জমে আছে, হয়ে উঠছে না। সুন্দরের প্রাচুর্যে পড়ে গেছি হঠাৎ। দেঁতো হাসি

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

এসব আমাকে কী বলছেন, লোভ দেখানো ভাল না।

...........
যত বড় হোক সে ইন্দ্রধনু দূর আকাশে আঁকা
আমি ভালবাসি মোর ধরনীর প্রজাপতির পাখা

কিংকর্তব্যবিমূঢ় এর ছবি

আমি আর ছাত্র নাই মন খারাপ

এই দুষ্ক রাখি কই ...

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

বান্দা, তোমার বিবাহ আসন্ন। এখন হইতেই একটি একটি করিয়া নিজস্ব জিনিস 'নাই' করা আরম্ভ করিয়া দাও। ভবিষ্যতে এমনিতেই গৃহে সবকিছু অবাঞ্ছিত ঘোষিত হইবে!

সিরাত এর ছবি

দারুণ!

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

নিচের দিক থেকে জবাব দিচ্ছিলাম। এখন বুঝলাম, তুইই আসল কালপ্রিট। লেখাটা এতদিন পর চোখের সামনে আনার জন্য অনেক ধন্যবাদ রে।

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

নাহ, আমি জহুরী খাইছে - রত্ন চিনতে আমার ভুল হয় নাই...

ইশতি ভাই ব্যাপকই বস পাব্লিক...
---------------------------------------------------------------------------
- আমি ভালোবাসি মেঘ। যে মেঘেরা উড়ে যায় এই ওখানে- ওই সেখানে।সত্যি, কী বিস্ময়কর ওই মেঘদল !!!

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

আরে!! হঠাৎ এই পোস্টে?! ধন্যবাদ অনেক। আমি নিজেও ভুলে গেছিলাম এটার কথা।

জি.এম.তানিম এর ছবি

সেই দিনগুলি... কি ভীষণ মিস করি... মন খারাপ
-----------------------------------------------------------------
কাচের জগে, বালতি-মগে, চায়ের কাপে ছাই,
অন্ধকারে ভূতের কোরাস, “মুন্ডু কেটে খাই” ।

-----------------------------------------------------------------
কাচের জগে, বালতি-মগে, চায়ের কাপে ছাই,
অন্ধকারে ভূতের কোরাস, “মুন্ডু কেটে খাই” ।

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

আমিও করি। খুব মিস করি। সময় যে কোন দিক দিয়ে চলে যায়!

সিরাত এর ছবি

সচলায়তনের পুরান লেখা পড়া আমার প্রিয় কাজ! চোখ টিপি

সাবেকা  এর ছবি

এতো বছর পর সুযোগ পেয়ে আমিও আজ পড়ে ফেললাম হাসি
ভাল লেগেছে পড়ে ।

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখাটা একদম আয়নার মতো; কোন ছাত্র এই লেখার সামনে দাঁড়ালেই নিজের স্বরূপটা দেখতে পাবে চলুক

হিল্লোল

মৃত্যুময় ঈষৎ এর ছবি

দ্বিতীয়বার পড়লাম, সমান মুগ্ধ করলো!!


_____________________
Give Her Freedom!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।