পঞ্চমীর চাঁদ

নীল রোদ্দুর এর ছবি
লিখেছেন নীল রোদ্দুর [অতিথি] (তারিখ: শনি, ০৬/০৩/২০১০ - ১০:৫৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মিঠু ভাই,
এ নিছকই এক সাধারণ চিঠি। আমি কি লিখতে যাচ্ছি এই চিঠিতে এখনও জানিনা। তবে সবার আগে যে কাজটি করলাম, তা হল, আপনার নামের সামনে থেকে প্রিয় শব্দটা তুলে দিলাম। অজানা অচেনা প্রফেসরকে মেইল করতে গেলেও ডিয়ার লিখেই শুরু করি, বহুল ব্যবহারে, প্রিয় শব্দটি আমার কাছে মূল্য হারিয়েছে। তবে, প্রিয়তম শব্দটি এখনও মূল্য হারায় নি। এই শব্দটি ব্যবহার করে এখন কাউকে প্রেমপত্র লেখা হয়নি। ভাবছি, এই কাজটিও করে ফেলতে হবে। জীবনে সব কিছুই একবার হলেও করে দেখা দরকার। নইলে পৃথিবীর রঙ, রূপ, গন্ধ ঠিক বোঝা যায় না। মানব জন্ম যখন একটাই, এটাকে যথাসম্ভব পরিপূর্ণ করাটাই ভালো।আমার ধারণা, একটা শিশু যখন জন্মায়, তখন তার জীবনের ক্যানভাসটা কাল থাকে। কাল মানে, সব বর্ণের আলোর অনুপস্থিতি। আস্তে আস্তে ক্যানভাসে রঙ লাগতে শুরু করে। আমি চাই, আমার মৃত্যুর সময় এই ক্যানভাসটা যেন সাদা হয়ে যায়। মানে সব বর্ণের আলোর উপস্থিতি যেন সরব হয়ে ওঠে। পুনর্জন্ম বলে কিছু আছে কিনা, জানিনা আমি। না মরলে জানতেও পারব না। মরলেও জানতে পারব কিনা, তাও জানিনা। আমার ধারণা, আত্মার অমরত্ব বলে কিছু নেই। আমার নিউরনগুলো পচে, গলে মাটির সাথে মিশে যাওয়ার সাথে সাথেই আমার আত্মার সব ধরণের অস্তিত্ব শেষ হয়ে যাবে। সেই ভালো, যুগ যুগান্তরের, জন্ম জন্মাতরের এতো স্মৃতি নিয়ে যদি কোন আত্মাকে চলতে হয়, সেটা নিজের ভারেই মুখ থুবড়ে পরে যাবে। দেখেন, কথাবার্তা কেমন মৃত্যুর দিকে চলে গেল। এক্ষনি হয়ত কেউ বলে উঠবে, কি সব বাজে কথা বল। আমি বলি, না বাজে কথা না। আমি যে এই পৃথিবীতে দু’দিনের ঘরে আছি, এটা ভুলে যাওয়াই একটা বাজে ব্যাপার। মৃ্যুর কথা মনে না রাখলে জীবনের সৌন্দর্য্য উপভোগ করা যায় না।

আমার মধ্যে মৃ্ত্যু নিয়ে অনেক ফ্যান্টাসি কাজ করে। জন্মাবার সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীনতা আমার ছিল না। কিন্তু মৃত্যুর সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীনতা আমার থাকা উচিৎ। আপনার মনে আছে, সেন্টমার্টিনের সৈকতে রাতের বেলায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল এগারো জনের পর্যটক দল? তারাভরা রাতের আকাশে অমিতাভ আমাদের দেখিয়েছিল মিল্কিওয়ে, লঘু সপ্তর্ষি, গুরু সপ্তর্ষি আরো কত কি! আপনি কি এক বিরহের গান গেয়ে উঠলেন! অভি আমাকে জিজ্ঞেশ করেছিল, সমুদ্রের কাছে এলে তুমি এমন নিশ্চুপ হয়ে যাও কেন? আমি বলেছিলাম, সাগরের বিশালতার সামনে আমার কথা হারিয়ে যায়। মনে মনে কি নিজেকে তখন কেবলি এক প্রবালখন্ড ভাবিনি? ভেবেছিলাম। আজ অন্য কিছু ভাবছি। একাকী অমন এক তারা ভরা জোৎস্নাময় রাতে বসে থাকব ঢেউ আর বালি সন্ধিস্থলে। আকাশে থাকবে পূর্ণিমার চাঁদ। আস্তে আস্তে পানির উচ্চতা বেড়ে যাবে। একসময় প্রবল স্রোত আমাকে টেনে নিয়ে যাবে সমুদ্রের কোলে। আমি তখনও প্রকৃতির সুধায় ডুবে থাকবো, যতক্ষন পারা যায়। মৃত্যুর ঠিক আগের মূহুর্তে হয়ত বেঁচে থাকার প্রবল ইচ্ছা জাগবে আমার মধ্যে। হয়ত আরো কয়েক সেকেন্ডের জন্য এই সুন্দর পৃথিবীর সুন্দরের অংশ বলে নিজেকে ভাবতে চাইব। তারপর সত্যি সত্যি সাগরের ফেনা হয়ে যাবো। অসাধারণ! বার্ধক্যে ধুঁকে ধুঁকে মরার চেয়ে এই মৃত্যু আমার কাছে অনেক বেশী আরাধ্য! আপনি আবার ভেবে বসেন না, কোন গভীর হতাশা বা অপূর্ণতা থেকে আমার এমন মরার সাধ জেগেছে। আমার জীবন এই মূহুর্তে অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে পরিপূর্ণ। আমার জীবনকে ঘিরের আছে অদ্ভুত সুন্দর ভালোবাসা। আমার বর্তমান সময়টা অনেক সুন্দর বলেই আমি এমন একটা মৃত্যুর কথা চিন্তা করতে পারছি। আসলে এই মূহুর্তে আমি রোমান্টিসিজমে ডুবে আছি। আমি এখন ওয়ার্ডসওয়ার্থের প্রেমিকা। আমি মানুষ নয়, হয়ত কোন এক জলজ প্রানী। হয়ত আমি কেবলি এক শিশির ভেজা ঘাস। হয়ত আমি জীবনানন্দ দাসের সেই শংখচিল অথবা শালিখ। জীবনানন্দ দাস কত সুন্দর করে তার রোমান্টিক দর্শনকে কবিতায় লিখে গেছে। আমি অবাক হই।
“যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হল তার সাধ।”
আমি হয়ত সেই মানুষটি যার পঞ্চমীর চাঁদ দেখলে মরতে সাধ জাগে।

আমি যখন ক্লাস নাইনে পড়তাম, তখন ফিজিক্স ছিল আমার কাছে চকলেট সাবজেক্ট। এখন সেই চকলেটের স্বাদ ফিজিক্স থেকে ফিলোসোফিতে এসে গেছে! এ আমার নতুন পাগলামী। আমার কাছে এখন জীবন, মৃত্যু, ভালোবাসা সবই ফ্যান্টাসি।

আমার মনে হয় ভালোবাসা ঘেরা এক নতুন পৃথিবীতে আমি জীবন আর মৃত্যুর সীমান্তে দাঁড়িয়ে আছি। যেকোন সময় যেকোন দিকে আমি চলে যেতে পারি। কি? ভয় পেলেন নাকি? আমার মা জননী একবার আদর করে আমাকে ডেকেছিলেন, “কিঞ্চিত ছিটগ্রস্থ বালিকা!” কথাটা কিন্তু আমার দারুন লাগে। এমন মানুষ যেকোন সময় কেবলি একটি কবিতা অথবা দেয়ালে টাঙ্গানো একটা ছবি হয়ে যেতে পারে। ইচ্ছে হলেই নিজেকে এক টুকরো মেঘ ভেবে অসীম আকাশে ঘুরে বেড়াতে পারে। গাছের সবুজ পাতায় লেগে থাকা রোদ্দুর হয়ে যেতে পারে। আমিও পারি। হাসি

-ইতি
নীল রোদ্দুর

[বিঃ দ্রঃ আপনি শুধাতে পারেন, চিঠিটা কেন আপনাকেই লিখলাম? র‌্যান্ডম স্যাম্পলিং এ কে বা কি আমার হাতের মুঠোতে উঠে আসলো তা কিন্তু কোন ব্যাপার না। নিয়তিবাদীরা হয়ত বলবে, নীল রোদ্দুর প্রজেক্ট থেকে মিঠু প্রজেক্টে অমুক সময়ে অমুক স্থানে একটা যোগাযোগ হবে, তা পূর্ব নির্ধারিত ছিল।]


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

কলেজে থাকতে খুব দর্শনের পাগল ছিলাম, রীতিমত বুঁদ হয়ে থাকা যাকে বলে। আপনার লেখা সেই সব স্বপ্নকাতর দিনের কথা মনে করিয়ে দিল, যদিও সে সব দিন খুব দূরের নয়।

খুব সতেজ একটা লেখা, উদ্দেশ্যহীন হলেও উপভোগ্য। এমন চিঠি আরো পাঠাবেন, মিঠু ভাইকে হোক বা যাকেই হোক, তাই ইচ্ছা রইল।

ফারাবী

নীল রোদ্দুর এর ছবি

এমন অদ্ভুত ঘোর লাগা পাগলামী আবার আমাকে অস্থির করে তুললে
যা লিখব তা এমনি হয়ে যাবে হাসি
--------------------------------------------------------
যখন প্রাণের সব ঢেউ
জেগে ওঠে, কথা বলে, রক্তের আশ্চর্য কলরবে
বৃষ্টির দুপুরে মনে পড়ে
বর্ষার মতন গাঢ় চোখ মেলে তুমি আছ দু'দিনের ঘরে।।
[শামসুর রাহমান]

-----------------------------------------------------------------------------
বুকের ভেতর কিছু পাথর থাকা ভালো- ধ্বনি দিলে প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়

রিখি এর ছবি

এর পরের চিঠিটা কাকে লিখবেন? খুব ভাল লেগেছে চিঠিটা। আমাকেও একটা লিখবেন? "রিখি, তুমি বলেই সম্বোধন করলাম। তোমাকে প্রিয় বলা হয়নি কখনও, জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণে এসে মনে হলো কিছু কথা তোমাকে বলা দরকার। যে ভুল আমি করেছি..."

নীল রোদ্দুর এর ছবি

রিখি নামটা তুলে রাখলাম স্মৃতিতে , কেমন যেন সাইন্স ফিকশন গন্ধ পাই নামটাতে। বলা যায় না, এরপরের চিঠি ঠিক এভাবেই শুরু করে দিতে পারি।
হাসি
এই লেখাটা একটা আবছায়া, আমার মনের ভিতরের অজানা আমি।
একে আমিও ঠিক চিনিনা। -------------------------------------------------------
যখন প্রাণের সব ঢেউ
জেগে ওঠে, কথা বলে, রক্তের আশ্চর্য কলরবে
বৃষ্টির দুপুরে মনে পড়ে
বর্ষার মতন গাঢ় চোখ মেলে তুমি আছ দু'দিনের ঘরে।।
[শামসুর রাহমান]

-----------------------------------------------------------------------------
বুকের ভেতর কিছু পাথর থাকা ভালো- ধ্বনি দিলে প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়

ওডিন এর ছবি

যতই উদ্দেশ্যহীন লেখালেখি হোক- আমার কাছে বেশ ভাল লাগলো।

জন্মাবার সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীনতা আমার ছিল না। কিন্তু মৃত্যুর সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীনতা আমার থাকা উচিৎ।

এই কথাটার জন্য আপনাকে একটা উত্তম জাঝা!

______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না

নীল রোদ্দুর এর ছবি

কিন্তু তবু স্বাধীনতাটা আমাদের বা আমার নেই। .আমার বেশী কিছু চাই না, শুধু এমন মুগ্ধতাটুকু থাকলেই হবে। --------------------------------------------------------
যখন প্রাণের সব ঢেউ
জেগে ওঠে, কথা বলে, রক্তের আশ্চর্য কলরবে
বৃষ্টির দুপুরে মনে পড়ে
বর্ষার মতন গাঢ় চোখ মেলে তুমি আছ দু'দিনের ঘরে।।
[শামসুর রাহমান]

-----------------------------------------------------------------------------
বুকের ভেতর কিছু পাথর থাকা ভালো- ধ্বনি দিলে প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়

মিঠু [অতিথি] এর ছবি

চিঠিটা সুন্দর হয়েছে। ভালো লেগেছে..ধন্যবাদ। হাসি

প্রিয় শব্দটি না দিয়ে ভালোই করেছো। "প্রিয় মিঠু ভাই" এর চেয়ে "মিঠু ভাই" অনেক বেশী প্রাণবন্ত! হাসি

ইদানিং বেশ কিছুদিন থেকে সাগর যেন ডাকছে আমাকেও... কক্সবাজার আর সেণ্টমার্টিন এর সেই স্বপ্নীল আচ্ছন্ন জগতে আবার যেতে ইচ্ছে করছে। তবে সেটা পঞ্চমীর চাঁদের মাঝে চিরতরে হারিয়ে যাবার জন্যে নয়, এই মায়াময় সৌন্দর্যকে বারবার প্রাণভরে উপভোগ করতে! হাসি
তাইতো গুষ্টি সহ যেতে চাই, আবারো।
আর হ্যা, মৃত্যু তো অবধারিত গন্তব্য, তাকে তার মতই আসতে দাও না! হৈ হুল্লোর আর কোলাহলপূর্ণ প্রাণচাঞ্চল্যের মধ্য দিয়ে কাটুক না বাকি সময় টুকু, গুষ্টির মধ্যে থেকে গুষ্টির একজন হয়ে! তুমি/আমি/...আমরা সবাই মিলেই তো গুষ্টি!!

ওহে ছিটগ্রস্ত বালিকা, অদ্ভুত সুন্দর ভালোবাসা ঘিরে থাকুক তোমাকে সবসময়!

নীল রোদ্দুর এর ছবি

মৃত্যুকে আমি তার মত করেই আসতে দেব... এই বস্তু তো অনেক পরের কথা, আমি সবকিছুই স্বাভাবিক ভাবেই দেখতে চাই।

জানেনই তো আমি দুই পায়ে খাড়া... শুধু ভাগ্যে থাকলে হয়। --------------------------------------------------------
যখন প্রাণের সব ঢেউ
জেগে ওঠে, কথা বলে, রক্তের আশ্চর্য কলরবে
বৃষ্টির দুপুরে মনে পড়ে
বর্ষার মতন গাঢ় চোখ মেলে তুমি আছ দু'দিনের ঘরে।।
[শামসুর রাহমান]

-----------------------------------------------------------------------------
বুকের ভেতর কিছু পাথর থাকা ভালো- ধ্বনি দিলে প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়

অমিতাভ অধিকারী [অতিথি] এর ছবি

হ্যাঁ আপু, সেন্টমার্টিন যেতে আবারো খুব ইচ্ছে করে। আবার।ঐ রাতের আকাশের কথা সারাজীবন মনে থাকবে। তবে পূর্ণিমা নয় অমাবস্যায় যাওয়ার ইচ্ছে আছে।
@ মিঠু ভাইঃ তৈরী হন। গুষ্টি সহ।

নীল রোদ্দুর এর ছবি

তোমাদের অমাবস্যা রাতের অ্যাডভেঞ্চারের অংশ হতে পারলে ভালোই লাগবে।

আমার ব্লগরব্লগরে স্বাগতম তোমাকে। কিন্তু আমি যে তোমাকেও এভাবে দেখতে চাই হে কবি। হাসি --------------------------------------------------------
যখন প্রাণের সব ঢেউ
জেগে ওঠে, কথা বলে, রক্তের আশ্চর্য কলরবে
বৃষ্টির দুপুরে মনে পড়ে
বর্ষার মতন গাঢ় চোখ মেলে তুমি আছ দু'দিনের ঘরে।।
[শামসুর রাহমান]

-----------------------------------------------------------------------------
বুকের ভেতর কিছু পাথর থাকা ভালো- ধ্বনি দিলে প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়

তুলিরেখা এর ছবি

আহ!
মাঝে মাঝে এমন ঘোরলাগা আসুক, আরো এমন চিঠি পাই।
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।