কোপার্নিকাসের দেশে-০২

জীবনযুদ্ধ এর ছবি
লিখেছেন জীবনযুদ্ধ [অতিথি] (তারিখ: বুধ, ২২/০৪/২০১৫ - ১২:২৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


১৯৪০ সালের এপ্রিল মাসের এক পড়ন্ত দুপুর। পোল্যান্ডের দক্ষিণ-পশ্চিমের এক ছোট্ট গ্রাম আউসভিতযের মেঠো পথ ধরে ধুলো উড়িয়ে ছুটে চলেছে এক জার্মান সামরিক গাড়ি। গাড়ির পেছনের আসনের আরোহী বয়সে তরুণ হলেও এ বয়সেই কুখ্যাত এস এস বাহিনীতে বেশ উন্নতি লাভ করেছে। তবে এই গণ্ডগ্রামের পদায়নটি তার পদোন্নতির পক্ষে সহায়ক হবে কিনা তা তখনো তার বোধগম্য নয়। এই অফিসারের প্রাথমিক আরোপিত দায়িত্ব হল এই গ্রামের এক পরিত্যাক্ত পোলিশ সামরিক ব্যারাককে নবাগত রাশান বন্দীদের ধারণ-উপযোগী করে গড়ে তোলা আর পরবর্তীতে পাশের নির্মিতব্য জার্মান কারখানায় বিনে পয়সার শ্রমিক যোগানের উপায় বের করা। শুনতে বেশ মামুলি, অসামরিক মনে হলেও এই অফিসারের হাতে রোপিত সেই বিষবৃক্ষই পরবর্তীতে গিলে খায় প্রায় এগার লক্ষ মানুষের প্রাণ। ভাবা যায়, মাত্র চার বছরে এই প্রত্যন্ত গ্রামের পাঁচ বর্গমাইল জায়গায় মনুষ্যকুলের এই অসুরদের নির্মমতার বলি হয়ে স্রেফ ভস্মে পরিণত হয়েছিলো এতো বিপুল সংখ্যক নিরাপরাধ মানুষ। মানব ইতিহাসে এতো বৃহৎ শব তৈরির কারখানা আরও কোথাও তৈরি হয়েছিল কিনা সন্দেহ। আমার আজকের গন্তব্য ক্রাকভের মাইল চল্লিশেক পশ্চিমে এককালের গ্রাম, আজকের উপশহর সেই আউসভিতযে।

আউসভিতযে যাবার জন্যে ক্রাকভ শহর থেকেই নানা পর্যটন কোম্পানির বাস ছেড়ে যায়, আগে থেকে ঠিক করা থাকলে তাদের অনেকেই আবার হোটেল থেকেও সাত সকালে তুলে নিয়ে যায়। কিন্তু অমন সৌখিন পর্যটকদের সাথে গা ভাসিয়ে ঘুরতে যাবার আহ্লাদ আমি কোনও কালেই বোধ করিনা, তাই দোকানের ঝাঁপি ফেলা হিম হিম ঠাণ্ডার সেই সকালে জুতোর ফিতে বেধেই ছুট লাগালাম ক্রাকভ শহরের প্রধান বাস-ষ্টেশন পানে। এখান থেকেই লোকাল কোনও বাস ধরে যাব ঠিক করলাম, টিকেট কিনতে গিয়ে জানলাম বাস ছাড়তে তখনো আধ-ঘণ্টা খানেক দেরী। এ ফাঁকে তবে প্রাতঃরাশটা সেরে নেয়া যাক। কাঁচের এক টং ঘর থেকে দু পদের ক্রশয়া কিনে উদরপূর্তি করে বাসের সামনের দিকের একখানা আসন বাগিয়ে বসে রইলাম বাস ছাড়ার অপেক্ষায়।

এ বাসটি অনেকটা আমাদের সেই ঢাকা-সাভার পথের বাসগুলোর মতই। ছোটখাটো, পুরনো ধাঁচের, তবে যাত্রীদের গুঁতোগুঁতি নেই মোটেও। সেদিনের দিনটি আবার রবিবার হওয়ায় বাসটিকে থামতে হচ্ছে বেশ ঘন ঘন, মাঝের গ্রামগুলোর হাট-বাজারমুখী মানুষদের তুলে নেবার জন্যে। তা থামুক, আপত্তি নেই আমার কোনও। আমি বরং তন্ময়- এই বাজারের থলে হাতে সুখী গৃহস্থদের আরোহণ, কান-ঢাকা স্কার্ফ পড়ে দুই খুড়িমার কথোপকথনের মাঝে হেসে গড়াগড়ি খাওয়া, শান্ত স্থবির গ্রামের নিরালা ছাউনিতে অপেক্ষারত বুড়ো চাষি, মন্থর সকালে গাঁয়ের তেপান্তরের মাঠে ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে থাকা লালচে টালির চাষি বাড়ি - এমনি নানা টুকরো দৃশ্যের মাঝে। আর এভাবেই পঞ্চাশ মিনিটের পথ শেষ হয় প্রায় দেড় ঘণ্টায়, এসে নামি আউসভিতযের মূল ক্যাম্পের প্রধান ফটকে।

আউসভিতযে আজকাল দর্শনে আসে পৃথিবীর নানা দেশের পর্যটক, আর তাই তাদের জন্যে আছে নানা ভাষায় পারদর্শী গাইড। ভেতরে ঢোকার টিকেট কিনবার সময়েই উল্লেখ করতে হয় কোন ভাষার গাইডের সাথে ভেতরে যেতে ইচ্ছুক, আর এর সাথে ধরিয়ে দেয়া হয় হেডফোন যাতে দলছুট হয়ে গেলেও গাইডের কথা ভালোভাবে শোনা যায়।

“আরবাইট মাক্ট ফ্রাই” অর্থাৎ কর্মেই মুক্তি। কর্ম এ ক্যাম্পের কোনও বন্দীকে মুক্তি না দিয়ে থাকলেও নিষ্ঠুর পরিহাসের মতো এই কথাগুলো ঝুলছে আউসভিতযের মূল ফটকে ক্যাম্পের যাত্রাকালের সময় থেকেই। ঠিক যেভাবে বিদ্যুতের তার দিয়ে ঘেরা ছিল পুরো ক্যাম্প, আজও ঠিক সেভাবেই রাখা আছে তারগুলো। তারের মাঝে প্রবাহিত বিদ্যুৎ আর নেই বটে, নেই “হালট” বলে চেঁচিয়ে ওঠা সেই প্রহরীগুলো, কিন্তু মহাকালের ক্ষুধা এই সীমানা ফটক, কনক্রিটের খুঁটিকে সিরামিকের অপরিবাহকের মধ্য দিয়ে পেঁচিয়ে রাখা তার, এসবকে এখনও সেভাবে গ্রাস করতে পারেনি। মূল ফটক পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই ভেতরে চোখে পড়ে সারি সারি লালচে ইটের ব্যারাক। ৪০’র গ্রীষ্মে যখন এডলফ হোস প্রথমে এই ক্যাম্পের দায়িত্ব নিয়ে আসে তখন কিন্তু মূল ক্যাম্পের এই ভবনগুলোর সবগুলো বিদ্যমান ছিলনা। অতঃপর ৪০’র শেষ দিক থেকে পোলিশ এবং সোভিয়েত বন্দীদের ঢল নামা শুরু হলে তাদের দিয়েই নির্মাণ করানো হয় এ ক্যাম্পের বাকি ভবনগুলো। গাইড আমাদের প্রথমে নিয়ে গেলো এমনি এক ভবনের ভেতর।

পাঁচ নাম্বার ভবনটি পরিক্রমা শুরু হল নিচ তলা থেকেই। প্রবেশমুখেই বিরাট এক ম্যাপ এঁকে বোঝান হয়েছে কিভাবে সারা ইউরোপ থেকে বন্দীদের ধরে এনে পোরা হয়েছিলো এই বন্দীশিবিরে। ৪০ থেকে ৪১ এর মধ্যে যেই বিপুল সংখ্যক রাশান আর পোলিশ বন্দীদের কাজে লাগানো হয় ক্যাম্প-২ নির্মাণে, তাদের শতকরা নব্বই ভাগই বছর পেরুতে না পেরুতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে অনাহার আর নানা রোগ-শোকে। প্রথম এক দেড় বছর যুদ্ধবন্দী আর রাজনৈতিক বন্দীদের আনা হলেও ৪২ এর শুরু থেকে দৃশ্যপট পাল্টে যেতে থাকে। পূবের রাশান ফ্রন্টে মার খেয়ে এবার হিটলার মনোনিবেশ করে ইউরোপ থেকে চিরতরে ইহুদী নিকাশে। এর পরের দু’তিন বছর এই ক্যাম্পের আকাশ বাতাস ভারী হয়ে ওঠে কেবল শব পোড়ানোর ভস্মে। প্রশ্ন হল এই নিভৃত গ্রামকেই কেন বাছা হল এই জল্লাদখানা বানাবার জন্যে, মানচিত্রের দিকে তাকালে বোঝা যায় এর উত্তর। পোল্যান্ড তদুপরি এই আউসভিতয অঞ্চলটি নাৎসি অধিকৃত ইউরোপের অনেকটা কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। ওদিকে পোল্যান্ড তখন ইউরোপের বৃহত্তম ইহুদী আবাসস্থল। তাই এই অঞ্চলকেই নির্বাচন করা হয় যাতায়াতের সুবিধার কথা চিন্তা করে।

ভয়ে জুবুথুবু মারা রমা সম্প্রদায়ের একদল নর-নারী, হতাশ-ক্লান্ত রাশান যুদ্ধবন্দীদের একটি দল, বিধ্বস্ত পথশ্রান্ত ফ্রানসিসকান যাজকদের একটি কাফেলা এমনি অনেক আলোকচিত্রের মাধ্যমে এ ভবনের নিচতলায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই ক্যাম্পের প্রথম কটি বছরের ইতিহাস। গাইড এর পর আমাদের নিয়ে এলো ভবনের দ্বিতলে, সত্যি বলতে কি পরে মনে হয়েছে এই বিশেষ তলটিতে না এলেই বোধ হয় ভালো করতাম, অন্তত কিছু হতাশা আর কিছু মন-যাতনা থেকে অন্তত মুক্তি মিলত।


ছবিঃ আউসভিতয কাম্প-১ এর কিছু ছবি

দোতলার প্রথম কক্ষে ঢুকেই চোখে পড়লো এই ক্যাম্পের গ্যাস চেম্বারের একটি ছোটখাটো নমুনা। গ্যাস চেম্বারের আসল চেম্বারটি হতো ভূগর্ভে। বন্দীরা সিঁড়ি বেয়ে পাতালে নেমে যেতেই দেখতে পেত একটি স্নানাগার। তাদের বোঝান হতো ক্যাম্পে ঢোকার আগে একটি পরিচ্ছন্নতামুলক স্নান আবশ্যক, তারপর গাদাগাদি করে হাজার খানেক মানুষকে পোরা হতো সেই স্নানাগারে। এই স্নানাগারের উপর একটি চিমনীর মতো নল দিয়ে উপর থেকে দুই জল্লাদ ততোক্ষণে ঢেলে দিত প্রাণঘাতী জাইক্লন বি গ্যাস। আমার পূর্বে ধারণা ছিল এই জাইক্লন বি খুব সম্ভবত কোনও উদ্বায়ী গ্যাস, কিন্তু এই কক্ষে এসে আমার ধারণা ভাঙল। জাইক্লন বি মূলত স্ফটিকদানার মতো দেখতে কিছু স্বচ্ছ দানা, এক ধরণের টিনের কৌটোয় যা ভরা থাকত। কৌটো খুলে ছেড়ে দিলে বায়ুর সংস্পর্শে এসে কয়েক সেকেন্ডের ভেতরেই এই দানাগুলো গ্যাসে রূপান্তরিত হয়। যুদ্ধের পূর্বে এক জার্মান কেমিক্যাল কোম্পানি এটি বাজারজাত করতো ইঁদুর মারার কাজে ব্যাবহারের জন্যে। যুদ্ধ যখন তুঙ্গে, তখন এই কোম্পানিই নাৎসিদের উৎসাহিত করে কম খরচায়, কম সময়ে বেশি সংখ্যক মানুষ মারার জন্যে তাদের এই গ্যাস ব্যাবহারের জন্যে। ঠিক সেই সময়ে নাৎসিরাও খুঁজছিল একটি জুতসই সাশ্রয়ী সমাধান, এই গ্যাসের সন্ধান পেয়ে তারা যেন হাতে চাঁদ পায়। ৪৫’এ এই ক্যাম্পের পতনের মুখে পালাবার সময় তাড়াহুড়োয় সব প্রমাণ নষ্টের চেষ্টা করলেও এস এস বাহিনী সরিয়ে নিতে পারেনি জাইক্লন বির সব খালি কৌটো। একটি ঘরের কাঁচের আলমারির ওপাশে রাখা অসংখ্য জাইক্লন বির সেইসব শূন্য কৌটো। একটি কৌটোর জাইক্লন দিয়েই যেখানে খুন করা সম্ভব কয়েক শত মানুষকে, সেখানে এই এই শত শত কৌটোর গ্যাস দিয়ে যে মারা হয়েছে কত অগুনতি সংখ্যক মানুষকে, সেকথা ভাবতেই রীতিমতো গায়ে কাঁটা দেয়।


ছবিঃ জাইক্লন বির কিছু খালি কৌটো

অন্য ঘরগুলোর কাঁচের আলমারিগুলোর কোনটিতে রাখা কেবল শত শত চশমা, হাজার হাজার জুতো, লক্ষাধিক খৈরিকার্যের সামগ্রী, অসংখ্য তালা-বাটি কিংবা থরে থরে রাখা কাঠের কৃত্তিম পা। সবচেয়ে মর্মান্তিক যে ঘরটি, সে বিশাল ঘরের একদিকে কাঁচের আধারের ওধারে রাখা কেবল মৃত মানুষদের পাঁচ টন চুল। সেসব মানুষদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এ ঘরটিতে ছবি তোলা নিষিদ্ধ। এই চুল বন্দী কিংবা মৃতদেহ থেকে সংগ্রহ করে সেগুলো মূল জার্মানিতে নিয়ে ব্যবহৃত হতো নানা প্রসাধন সামগ্রী তৈরিতে। শেষের ঘরটি বোঝাই কেবল নানা দেশের নানা মানুষের তোরঙ্গে। এলসে মাইয়ার কোলন- ফেব্রুয়ারি ১৮৯২, জুডিথ গেলবার্গ-দেনহাগ-হল্যান্ড-১৮৮৩, ফ্রানয এঙ্গেল-১৯০৬, গ্রুটকেল-হল্যান্ড-১৯০৫, হিটসমান-সকলস্কা-চেক প্রজাতন্ত্র- শত বছরের ব্যবধানে বিবর্ণ হয়ে এলেও আজও ঠিক পড়ে নেয়া যায় সেইসব হতভাগ্যদের তোরঙ্গের ওপর লেখা নিজেদের নাম-ধাম আর সনগুলো।

ছবিঃ পরিত্যাক্ত থাল-বাটি-তোরঙ্গ

নিচ তলার করিডোর দিয়ে যখন ফিরে আসছি তখন দেখি এক পর্যটক নিবিষ্ট মনে একটি ফ্রেমে ভরা ছবির ছবি তুলছেন। খেয়াল করে দেখলাম শুধু সেই ফ্রেমটিই নয়, পুরো করিডোরটি জুড়েই শত শত মানুষের ছবি। ফ্রেমবন্দী সেই সারি সারি ছবির মাঝে হৃদয়কে নাড়া দিয়ে যায় কিছু নিষ্পাপ হাসি-হাসি মুখ করে থাকা কিছু শিশুর ছবি। হয়তবা সেই শিশু তার ক্ষুদ্র জীবনে এই প্রথম এসেছে ক্যামেরার সামনে, কি অবাক কৌতূহলে সে তাকিয়ে আছে ঠোঁটের কোণায় একটুকরো হাসি সম্বল করে। এই ক্যাম্পের প্রথম দিকের বছরগুলোতে বন্দীদের ছবি তোলা শুরু হলেও পরে বন্দীদের ঢল নামায় এই ব্যবস্থাকে ব্যয়বহুল বলে প্রতীয়মান হয়, আর তা ছাড়া শেষের দেড় বছরে তো ট্রেন থেকে নামার পর মোটামুটি আধ-ঘণ্টার ভেতরেই সবাইকে নিয়ে যাওয়া হয় গ্যাস চেম্বার অভিমুখে, আর তাই ফ্রেমের এই ছবিগুলো এই ক্যাম্পে প্রাণ হারানোদের এক ভগ্নাংশের প্রতিনিধি মাত্র।

ছবিঃ সেইসব হতভাগ্যদের ক’জনার ছবি

প্রথমদিকে যখন এই ক্যাম্পে বন্দীদের নিয়ে আসা শুরু হয় তখন ভবনগুলোতে শোবার কোনও ব্যবস্থা ছিলোনা, কনকনে শীতের মাঝেও হিমশীতল মেঝেতে কেবল খড়ের বিছানা পেতে তার উপরিই রাত যাপন করতে হতো, পরের বছরগুলতে অবশ্য কিছু বাঙ্কার বিছানার ব্যবস্থা করা হয়। নিচতলায় দেখতে পেলাম কয়েকটি ঘরে সেরকমই কিছু বাঙ্কার বিছানা আর মেঝেতে পাতা খড় রাখা আছে অবিকল সেই ভাবে, সত্তর বছর আগে তারা যেমনভাবে ছিল।


ছবিঃ এস এস অফিসারদের একটি অফিস ঘর


ছবিঃ এমন মেঝেতেই কাটাতে হতো রাত

পাঁচ নম্বর ভবন থেকে বেড়িয়ে কিছু দূর হেঁটে যে ভবনের সামনে এসে দাঁড়ালাম, সেখানে যাবার ডাক পেলে বন্দীরা সবাই বুঝে নিত সাক্ষাৎ যমদূত আজ্ঞা পাঠিয়েছে। এগার নম্বর এই ভবনটি মূলত ব্যবহৃত হতো নির্যাতন-শালা হিসেবে। পলায়নে বিফল বন্দী, আশেপাশের গ্রামের মানুষ যারা এই ক্যাম্পের মানুষদের গোপনে খাবার সরবরাহ করতো তারা, কিংবা পোল্যান্ডের অন্যান্য শহরের মুক্তিকামী মানুষদের ধরে এনে অকথ্য নির্যাতন চালানো হতো এই সাদামাটা ভবনে। শুধু তাই নয়, ইতিহাসে এই এগার নম্বর ভবনটি জায়গা করে নিয়েছে আরও একটি বিশেষ কারণে। জাইক্লন বির কথা আগেই বলেছি, ৪১ এর শরতে এস এস বাহিনী ঠিক করে কিছু বন্দী গিনিপিগের উপর প্রয়োগ করে দেখা হবে এই প্রাণঘাতী গ্যাস। যদি প্রমাণিত হয় এ অস্ত্র অব্যর্থ, তবেই ব্যাপক আকারে এর প্রয়োগ শুরু হবে। এ ভবনের ভূগর্ভের এক কালিগোলা অন্ধকারময় ঘরে আটকে রেখে মেরে ফেলা হয় প্রায় সাড়ে সাতশো পোলিশ এবং রাশান বন্দীকে। এতগুলো মানুষকে অকাতরে প্রাণ দিতে হল শুধুমাত্র এই গ্যাসের কার্যকারিতা প্রমাণের জন্যে। ভূগর্ভের সেই ঘরগুলর কাছে গেলে মনে হয় কিছু ছটফট করা মানুষের আর্তনাদ যেন আজও এই অন্ধকার প্রকোষ্ঠের চার দেয়ালের মাঝে বন্দী ইথারের মাঝে ভেসে বেড়ায়।

একুশ নাম্বার ভবনের সদর দরজার উপরিভাগে কাঁচের উপর লেখা- “ক্রাঙ্কেনহাউস, আইনট্রিট ফেরবোটেন”। প্রায় বার বছর আগে শেখা কিছু মিছু জার্মান দিয়ে বুঝলাম, এটি হাসপাতাল। মনে প্রশ্ন এলো যেখানে এই বন্দীদের ন্যূনতম চাহিদা পূরণের ব্যাপারটাই ছিল অনুপস্থিত, সেখানে এই হাসপাতাল কি একটু বেমানান নয়? আমার প্রশ্নে গাইড স্মিত হেসে বলল, হাসপাতাল ছিল বলেই ভেবনা সেখানে রোগে পরা মাত্র বন্দী রোগীদের এনে চিকিৎসা করানো হতো। এই হাসপাতালটি মূলত ছিল কুখ্যাত কিছু নাৎসি চিকিৎসকের গবেষণা কেন্দ্র। শুধু নাৎসি চিকিৎসকরাই যে তাদের গবেষণার খেয়ালে এই হাসপাতাল বা বন্দীদের ব্যবহার করতো তা নয়, জার্মান কেমিক্যাল কোম্পানি ‘বায়ার’ও নাৎসিদের সাথে চুক্তি করে তাদের কিছু পরীক্ষামূলক প্রকল্প এই বন্দীদের উপর প্রয়োগের জন্যে। রক্তের লাল দাগ তাই বিদ্যমান এই বহুজাতিক কোম্পানি হাতেও, যুদ্ধের সেই পাপ-তাপ ধুয়েমুছে এই কোম্পানি আজ দাপটের সাথে ব্যবসা করে যাচ্ছে দুনিয়া জুড়ে।

আউসভিতযের নিপীড়িত শিশুদের কথা যখন উঠছিল, তখন বেশ কয়েক বারই একটি নাম কেবল ঘুরে ফিরে আসছিলো। সেই নামটি “জোসেফ মেঙ্গেলে”। “ওঙ্কেল মেঙ্গেলে” নামে যে পরিচিত ছিল ক্যাম্পের শিশুমহলে। ক্যাম্প পরিদর্শনের সময় এই দানব শিশুদের জন্যে সাথে করে নিয়ে যেত চকোলেট কিংবা বিস্কুট। অবোধ শিশুরা খুশি হয়ে উঠত তাকে দেখে, তারা জানতোনা এই হায়েনা আসলে পরিদর্শনে এসেছে তার গবেষণার উপযোগী শিশুটিকে খুঁজে বের করতে, তারা জানতো না এই পিশাচের হাতেই তাদের মৃত্যু নিহিত ধুঁকে ধুঁকে, যন্ত্রণায় নীল হয়ে। চিকিৎসক নামের কলঙ্ক এই মেঙ্গেলের গবেষণার মূল বিষয় ছিল মূলত যমজ শিশুরা। তার গবেষণার বিষয়বস্তু রীতিমতো গা শিউরে ওঠার মতো, একই ভাইরাস সে যমজ ভাই বোনের উপর প্রয়োগ করে দেখত তাদের প্রতিক্রিয়ায় কোনও মিল খুঁজে পাওয়া যায় কিনা, কালো চোখের মণিতে পরীক্ষামূলক তরল প্রবেশ করিয়ে দেখত সে চোখের মণি আর্যদের মতো গাঢ় নীলবর্ণ ধারণ করে কিনা। বলা বাহুল্য যুদ্ধ শেষ হবার জানা যায়, এসব কোনও গবেষণাই আসলে মূলধারার গবেষণা ছিলনা, ছিল গবেষণার নামে উন্মত্ততা আর উন্মাদনা।

পনের নম্বর ভবন পেরিয়ে ক্যাম্পের এক ধারে এসে খুঁজে পেলাম একখানা ফাঁসী মঞ্চ। নাহ, ক্যাম্পের বন্দীদের ফাঁসী দেয়া হতনা এখানে, ততটা সময় বা ধৈর্য নাৎসিদের ছিলনা। তবে এক সময় এখানে পলায়নপর বন্দীদের নির্যাতন করা হতো বটে। মূলত এই ফাঁসি মঞ্চটি বানানো হয় এই ক্যাম্পের কর্ণধার হোসকে ১৯৪৭ সালে ফাঁসি দেবার উদ্দেশে। এই হোসকে যুদ্ধের পর পরই ব্রিটিশরা জার্মানিতে আটক করে, যদিও তার বিচার সম্পন্ন হয় পোল্যান্ডের আদালতে। মূলত প্রতীকী অর্থেই তাকে ফাঁসি দেয়া হয় ঠিক সেই স্থানে যেখানে তার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানেই সম্পন্ন হয়েছিলো ইতিহাসের বৃহত্তম হত্যাযজ্ঞ। এতো বড় একজন যুদ্ধাপরাধীকে যুদ্ধের ঠিক দু বছরের মাথাতেই ফাঁসিতে চড়ান হল, তাই আমি ভাবলাম হয়তো এই ক্যাম্পের মূল যুদ্ধাপরাধীদের সবাইকেই বিচারের আওতায় আনা হয়েছিলো। ভুল ভেবেছিলাম, এই ভাবনার খানিক পরেই গাইড জানাল ক্যাম্পের যুদ্ধাপরাধীদের মাত্র এগার শতাংশকে বিচারের আওতা আনা সম্ভব হয় আজ অবধি। কিন্তু কেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে রইলো বাকি বিশাল অংশটি? আউসভিতয থেকে ফেরার এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্যে এই ক্যাম্প এবং আশেপাশের কিছু ক্যাম্পের নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের জীবনী পর্যালোচনা করি, আর তাতেই দেখতে পাই কয়েকটি সমীকরণ।

যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলেও তার সাথে সাথে মৃত্যু ঘটেনি নাৎসিবাদ কিংবা নাৎসিদের প্রতি সহানুভূতিশীল মানুষদের। এই সমর্থক গোষ্ঠীরই অনেকে যুদ্ধের পর এই নরপিশাচদের অনেককে গা ঢাকা দিতে সহায়তা করে। আর যুদ্ধের ডামাডোলে ব্যাপারটা ছিল অনেক সহজ। জাল পাসপোর্ট কিংবা পরিচয় পত্র তৈরি করা দুঃসাধ্য কিছু ছিলনা। তারপরও ৪৫ থেকে ৪৮ এর মধ্যে অনেকে ধরা পড়ে মিত্রবাহিনীর হাতে, তাদের অনেকেই আবার প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে যায় অল্প কিছুদিনের মাঝেই। ওদিকে যুদ্ধের পর পরই জার্মানি জুড়ে শুরু হয় নতুন এক মেরুকরণ, রুশ বনাম মার্কিন আধিপত্য বিস্তার। এই কাজে তাদেরও প্রয়োজন ছিল প্রশিক্ষিত গোয়েন্দা এবং গোয়েন্দা চক্র। এই অভিলাষে তারা বেছে নেয় সহজতম পথটি, স্রেফ বেতনভুক্ত করে নেয় অনেক প্রাক্তন নাৎসি চাঁইদের। আর এভাবেই বহু নাৎসি ভোল পাল্টে গিয়ে দাঁড়ায় সিআইএ বা কেজিবির বাতাবরণের তলে। অন্য আরেকটি দল সে পথে না গিয়ে ধরে অন্য পথ, আর এই দলটিকে অকুণ্ঠ সহায়তা করে রোমের ভ্যাটিকান। এমন নিষ্ঠাবান ক্যাথলিকদের কি তারা সহায়তা না করে পারে? এই দলটিকে তারাই নকল পাসপোর্ট, ইতালি ছাড়ার ভিসাসহ সমুদয় জোগাড়যন্ত্র করে তুলে দেয় লাতিন আমেরিকাগামী জাহাজে। আইখম্যান এবং মেঙ্গেলের মতো বহু চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী ছিল সেই দলে, যারা পরবর্তীতে সুখের আবাস গড়ে ব্রাজিল কিংবা আর্জেন্টিনায়। ষাটের দশকে আইখম্যানকে ধরা সম্ভব হলেও ব্রাজিলের এক সমুদ্র সৈকতে ডুবে মরার আগ অবধি মেঙ্গেলে থেকে যায় ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তৃতীয় দলটি যুদ্ধের পর নতুন নাম, নতুন পরিচয় নিয়ে মিশে যায় সাধারণ জনগোষ্ঠীর মাঝে, যদিও সে কাজটিও তাদের কাছের কিছু প্রভাবশালী মানুষের সহায়তা ছাড়া সম্ভব ছিলনা। আর এভাবেই নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের বিশাল একটি অংশকে কোনও কালেই বিচারকের কামরায় আনা সম্ভব হয়নি।

ফিরে আশি ক্যাম্পের কথায়। সেই ফাঁসি মঞ্চের বাঁ পাশেই একটি কনক্রিটের গুদামঘরের মতো একটি বাড়ি, মাথায় বেশ বড়সড় একটি চিমনী। এটি এই মূল ক্যাম্পের একমাত্র গ্যাস চেম্বার ভবন, যদিও এটি ভূগর্ভস্থ নয় আর আকারেও বেশ ছোট। সদর দরজা দিয়ে সোজা হেঁটে ভেতরে গেলেই হাতের ডানে চোখে পড়ে জানালাবিহীন একটি বেশ প্রশস্ত একটি ঘর, টিমটিমে আলো জ্বলা সেই ঘরের মাঝখানের ফুলদানিতে রাখা একগুচ্ছ গোলাপ। হ্যাঁ, এই ঘরটি ছিল প্রধান গ্যাস চেম্বার। এই ঘরে পুরে বাইরের দরজা বন্ধ করে দিয়েই উপরের চিমনী থেকে ছেড়ে দেয়া হতো বিষাক্ত জাইক্লন বি। মৃতদেহগুলো পুড়িয়ে ফেলার ব্যবস্থাও ওই একই ভবনে। বাঁ ধারের এক বেশ বড়সড় ঘরে সারি সারি দাহন-চুল্লী। একই ছাদ-তলে এ যেন এক মানব ভস্ম তৈরির কারখানা। এক ধার দিয়ে দিয়ে বন্দীদের নিয়ে এসো, গ্যাস চেম্বারে বিষাক্ত বাষ্পে তাদের খুন করো, তারপর নিয়ে যাও পাশের ঘরের চুল্লীতে। ব্যাস, মানব থেকে ভস্ম কিছু সময়ের মাঝেই। এই ক্যাম্পের পতন মুহূর্তে নাৎসিরা হয় এই ভবনটি ধ্বংস করার পর্যাপ্ত সময় পায়নি, অথবা প্রয়োজন বোধ করেনি। আর তাই যুদ্ধাপরাধের জ্বলন্ত সাক্ষী হয়ে এই কনক্রিটের দঙ্গল দাঁড়িয়ে আছে বিগত অর্ধ শতাব্দী ধরে।


ছবিঃ জানালাবিহীন সেই অন্ধকার ঘরটি

এবার আমাদের মূল ক্যাম্প থেকে মাইল দেড়েক দূরের ক্যাম্প-২ অর্থাৎ বিরকানাও ক্যাম্পে যাবার পালা। বিরকানাও ক্যাম্পটি বানানো হয়েছিলো হিটলার ঘোষিত ইহুদীদের সমূলে উৎপাটন কার্যক্রম শুরু হবার পর। আসলে আউসভিতয বলতে বিভিন্ন চলচ্চিত্র এবং তথ্যচিত্রে যে ছবি দেখান হয় তা মূলত এই বিরকানাও ক্যাম্পের, কারণ মূল ক্যাম্পের তুলনায় এই ক্যাম্পটি ছিল আকারে কয়েকগুণ বৃহৎ এবং গণহত্যার ব্যাপকতাতেও এটি মূল ক্যাম্পের চেয়ে অগ্রগণ্য। মূল ক্যাম্প থেকে ওখানকারই একটি বাস আমাদের পৌঁছে দিল সেই মৃত্যুপুরীর দোরগোড়ায়।

যক্ষ্মা রোগীর দমকে ওঠা কাশির মতো প্রজ্বলিত কয়লার ধূমায়িত বাষ্প ছেড়ে ধীর লয়ে “ডয়েসে রাইখ বানের” যে ওয়াগনগুলো এসে ঢুকত এই মৃত্যুপুরীর ভেতরে তার ভেতরে থাকা নারী পুরুষের অনেকেরই জানা থাকতনা এই সুনীল পৃথিবীতে তাদের জীবনবায়ুর স্থায়িত্ব বড়জোড় আর এক ঘণ্টা। অস্থায়ী ভাবে নির্মিত দু’নম্বর প্লাটফর্মে ভেরা মাত্রই আবালবৃদ্ধবনিতা সবাইকে নামিয়ে পৃথক করা হতো দুটি লাইনে। অপেক্ষাকৃত সক্ষমদের একটি লাইনে, আর বৃদ্ধ-পঙ্গু এবং শিশুদের আরেকটি লাইনে যেটির গন্তব্য সোজা গ্যাস চেম্বারের পাতাল অভিমুখী সিঁড়ির পানে। যদিও যুদ্ধের একেবারে শেষের দিকে মোটামুটি সবাইকেই পাঠানো হতো ওই মৃত্যুর লাইনে। আর এই লাইন বাছাইয়ের কাজে তদারককারিদের অন্যতম ছিল মেঙ্গেলে। এই হায়েনা ওত পেতেই থাকত ‘নতুন চালানের’মানুষদের মাঝে যদিবা কোনও যমজ শিশু পাওয়া যায় সেই আশায়। সেই প্লাটফর্মে গিয়ে দাঁড়ালাম, না এখন সেখানে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। ধুলি আর নুড়ি পাথরে ঢাকা পায়ের তলার কনক্রিটের আস্তরের দিকে লক্ষ্য বোঝা যায় এককালে কিছু একটা ছিল ঠিক এইখানে। এর অদূরে প্রায় বুজে আসা রেললাইনের উপর দূরে দাঁড়ানো একটি ওয়াগন। এটি কি কোনও প্রতিকৃতি, নাকি মূল সময়েই ব্যবহৃত ওয়াগন? কাছে গিয়ে একটু বোঝার চেষ্টা করলাম। যে চারটি লোহার চাকার ওপর সমস্ত ভার চাপিয়ে দিয়ে দিব্যি ঠায় দাঁড়িয়ে আছে এই কাঠের ওয়াগনটি, সেই চাকার দিকে খেয়াল করে দেখলাম লেখা, “ভিটসমান হেস্পেল-১৯২৩”, হুম খুব সম্ভবত এটি সেই সময়কারই কোনও বাহন।


ছবিঃ কাম্প-২ অর্থাৎ বিরকানাও ক্যাম্পের কিছু ছবি

বিরকানাও ক্যাম্পে ঢোকার মুখের প্রাকারটি অনেকটা সেই আগেকার আমলের দুর্গের মতো, যার ঠিক মাঝ বরাবর বিদ্যমান ফটক ফুঁড়ে ভেতরে ঢুকে গেছে এক জোড়া লোহার পাত, ভেতরে ঢুকেই অবশ্য সেই এক জোড়া পাতই তিনদিকে ছড়িয়ে গেছে তিন জোড়া পাত হয়ে। এর মাঝে সর্বডানের পাতজোড়া গিয়ে শেষ হয়েছে ক্যাম্পের একেবারে শেষ মাথায় সুনশান নীরব এক প্রান্তে, যার ঠিক পেছনে সারি সারি উইলো গাছ অনেকটা যেন দেয়ালের মতো করে এক ক্যাম্পটিকে আড়াল করে রেখেছে পেছনের গ্রাম থেকে। ঠিক এই প্রান্তে ছিল এ ক্যাম্পের দুটি গ্যাস চেম্বারের একটি, আর অন্যটি ছিল ক্যাম্পে ঢুকেই ডান দিকের কোণের শেষ প্রান্তে। আগে থেকে কেও বলে না দিলে বোঝার উপায় নেয় যে এখানে কোনও গ্যাস চেম্বার বা ওই জাতীয় কিছু ছিল। কারণ এই দু’স্থানেই কেবল চোখে পড়ে মাটি দুমড়ে মুচড়ে পরে থাকা কয়েক ফুট পুরু কনক্রিটের চাঙ্গর। হটাৎ দেখলে মনে হয় যেন কোনও প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্প বয়ে গেছে এই সন্নিবেশিত অঞ্চলে। এই দুটি গ্যাস চেম্বারই ছিল নাৎসি বাহিনীর সব চেয়ে বড় গণহত্যার প্রমাণ, আর তাই সরে পড়বার আগ মুহূর্তে ডিনামাইট দিয়ে তারা ধ্বংস করে যায় এই প্রমাণদ্বয়।


ছবিঃ একটি গণ শৌচাগার

ধ্বসে পরা এই গ্যাস চেম্বারের অদূরেই প্রায় বূঁজে আসা এক জলো ডোবা, প্রারম্ভিক বসন্তের শ্যাওলা যাকে ঢেকে ফেলেছে অনেকটাই। আশেপাশে শন শন করে দুলছে নীরব প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে থাকা বার্চ আর চেস্টনাট গাছের সারি, যার অনেকেই এই ডোবার বেদনাশ্রু মুছে দেবার জন্যে ভাসিয়ে দেয় তাদের পাতা এই ডোবার সবুজাভ জলে। কিন্তু কোন গভীর দুঃখেই বা অনবরত কেঁদে চলে সে? বস্তুত এই ক্যাম্পের বন্দীদের দিয়েই খোঁড়ান হয় এই ডোবা। হাজার হাজার মানুষকে নাহয় মেরে ফেলা হল, পোড়ানও হল, কিন্তু এই বিপুল পরিমাণের চিতাভষ্মকে ফেলা হবে কোথায়? আর তাই এই ডোবা খনন করে তাতেই এনে ফেলা হতে লাগলো সেই ভস্ম।


ছবিঃ নাৎসিদের ধ্বংস করে যাওয়া সেই গ্যাস চেম্বার এবং ভস্ম ফেলার সেই ডোবাটি

এই ক্যাম্পে ঢোকার পর পরই খেয়াল করেছিলাম ঢোকার মুখ বরাবর দু’ধারের আর ঢোকার পর হাতের ডান ধারের সারি সারি কাঠের ব্যারাক ছাড়া বাকি এই ক্যাম্পের বিশাল এলাকা জুড়েই ছড়ানো ইট ভাঁটার চিমনীর মতো ভুসমতল থেকে শুরু হওয়া কিছু লালচে ইটের চিমনী। গাইডকে জিজ্ঞেস করাতে সে জানাল ওসব জায়গাতেও ছিল এমনি কাঠের ব্যারাক, কিন্তু ব্যারাক ধ্বংস হয়ে আজ কেবল কঙ্কালের মতো ওই চিমনীগুলি রয়ে গেছে। অটুট কাঠের ব্যারাকগুলোর দিকে খেয়াল করে দেখালাম আরে তাই তো প্রতিটি কাঠের ব্যারাকের ঠিক মাঝ বরাবরই একটি এমন ইটের চিমনী বিদ্যমান, যদিও বন্দীদের সেই চুল্লীগুলয় আগুন ধরিয়ে তাপ পোহাবার মতো সৌভাগ্য কদাচিৎই মিলত। গাইড অন্যদিকে ব্যাস্ত হয়ে যাওয়ায় আমি ভাবছিলাম, নাৎসি বাহিনী যেহেতু পালাবার আগে গ্যাস চেম্বারগুলো ধ্বংস করে গেছে তবে তারাই কি এই অধিকাংশ ব্যরাকও ধ্বংসের জন্যে দায়ী?

জ্য মাহি লুসতিগে প্যারিসের আর্চবিশপের পদটি অলংকৃত করে ছিলেন প্রায় আড়াই দশক। ইহুদী পরিবার থেকে ধর্মান্তরিত এই যাজকের মা প্রাণ হারান এই বিরকানাও ক্যাম্পেই। তার সুদীর্ঘ যাজক জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়টি আসে বোধ করি আশির দশকের প্রথম ভাগে। আগেই বলেছি ক্যাম্প-১ এর ভবনগুলো ছিল ইট নির্মিত ব্যারাক ভবন। সমসাময়িক কালে একটি ক্যাথলিক নানদের দল সেই ভবনগুলো দখল করে একটি কনভেন্ট বানিয়ে ফেলে, গ্রামের মানুষদের জন্যে চালু করে একটি হাসপাতাল। ওদিকে গ্রামের লোকেরাও এতে মহা খুশি। এরপর একদিন রাতের আঁধারে গ্রামের লোকদের সহায়তায় নানরা সেই ক্যাম্প প্রাঙ্গণে একটি বড়সড় ক্রুশও পুঁতে দিলেন। প্রমাদ গুনলেন এবার এই ক্যাম্পের বেঁচে যাওয়া মানুষরা কিংবা তাদের স্বজনরা। ক্যাম্পের সব স্মৃতি মুছে দেবার আয়োজন যে প্রায় সম্পন্ন তা তারা বুঝতে পারলেন। উপায়ান্তর না দেখে তাদের অনেকেই এসে ধরলেন আর্চ বিশপ জ্য মাহিকে। জ্য মাহি বহুকাল আগেই তার বাবাকে কথা দিয়েছিলেন ধর্মান্তরিত হলেও মায়ের আত্মা কষ্ট পায় এমন কাজ তিনি কখনই করবেননা। ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে তিনি ছুটলেন ভ্যাটিকানে। পোপকে তিনি বোঝালেন, “কনভেন্ট খোলার জন্যে আরেকটি জায়গা বা ভবন আপনি ঠিকই পাবেন, কিন্তু এই স্বজনরা যারা তাদের মামা-বাবার অস্থি-মজ্জা মিশে থাকা এই স্থানে যায় দু’ফোঁটা চোখের জল ফেলতে তারা কি পাবে দ্বিতীয় আরেকটি আউসভিতয? অন্য কারও কথা ভাবার প্রয়োজন নেই, ভাবুন আপনার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আপনারই এই প্রিয়ভাজনের কথা। ওই স্থান হারিয়ে গেলে আমিই বা কোথায় গিয়ে দাঁড়াব আমার মায়ের স্মৃতিতে পুষ্পকস্তবনের জন্যে? একমাত্র আপনিই পারেন পোলিশ ক্যাথলিকদের বুঝিয়ে এই সংঘাতের পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে”। এই ঘটনাটির উল্লেখ করলাম এই ক্যাম্পের প্রতি আশেপাশের গ্রামের মানুষদের পুষে রাখা অবজ্ঞা আর বিদ্বেষমূলক মনোভাবটি বোঝাবার জন্যে। হতে পারে যুদ্ধ-পরবর্তী ডামাডোল, আবার হতে পারে এই মনোভাব- এর কোনও একটিই তাদের উদ্বুদ্ধ করে যুদ্ধের পর পরই বিরকানাও ক্যাম্পের সারি সারি ক্যাম্প ভবনগুলোর কাঠ লুটপাট করে সেগুলো শীতের জ্বালানী কাঠে রূপান্তরিত করতে। হ্যাঁ, নাৎসিরা নয়, বস্তুত গ্রামবাসীরাই ধ্বংস করে দেয় এই ক্যাম্পের অনেক চিহ্ন, ইতিহাসের অনেক উপাদান।

অর্ধ শতাব্দীর তুষারপাত, ঝড়ো হাওয়া, বাদল, গ্রীষ্মের খরতাপকে উপেক্ষা করে এই বিরকানাও ক্যাম্পের যে কয়েকটি কাঠের ব্যারাক ভবন এখনও স্বগর্বে টিকে আছে তার সব কটিই উন্মুক্ত নয়, তবে সেদিন একটি বিশেষ কারণে এমনি একটি তালাবদ্ধ ভবনের দ্বার খোলা হয়েছিলো। আর সেটি হয়েছিলো সেই ভবনে জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় পার করা একজনের সম্মানার্থে। হ্যাঁ, সোভিয়েত বাহিনী যেদিন এ ক্যাম্পে এসে পৌছয় সেদিন স্বল্প সংখ্যক বেঁচে যাওয়া মানুষের মধ্যে তিনিও ছিলেন। তিনি এসেছিলেন তার গল্পের কথা নতুন প্রজন্মের এক দল মানুষকে শোনাতে। তিনি দেখাচ্ছিলেন কোন এক চিলতে বাঙ্কার খাটে তিনি ঘুমতেন, শোনাচ্ছিলেন তার ক্যাম্প জীবনের নানা কাহিনী। কিন্তু মুশকিল হল তিনি সবই বলছিলেন হিব্রুতে, তাই কৌতূহল থাকলেও বোঝা হলনা তার সব কথা। পরে অবশ্য আপসোস হয়েছিলো কেন উনার বক্তৃতার পর উনার সাথে গিয়ে কথা বললাম না সে জন্যে।

এবার ফিরে যাবার সময়। মূল ক্যাম্পের প্রাঙ্গণে এক গাছের ছায়াতলে বসে অপেক্ষায় আছি ক্রাকভ অভিমুখী ফিরতি বাসের। আমার এই অর্ধ দিবসের পরিক্রমা মাথায় নিয়ে আসছিলো রাজ্যের এলোমেলো চিন্তা। অনেক চিন্তার মাঝেও সুদৃঢ়ভাবে যেটি ভাবছিলাম তা হল ঠিক এই ভাবেই তো আমার দেশেও ত্রিশ লক্ষ মানুষের গণহত্যা সংগঠিত হয়েছে। কিন্তু কটা বধ্যভূমিকে আমরা আজ অবধি সংরক্ষণ করতে পেরেছি? পেরেছি কি নতুন প্রজন্মের কাছে তাদের পূর্বপুরুষদের জীবনদানের স্থানগুলো সঠিকভাবে পরিচয় করিয়ে দিতে? আমাদের এই ব্যর্থতার জন্যে হয়তো প্রখ্যাত স্প্যানিশ কবি হরগে অগাস্টিনের বলে যাওয়া এই কথাটিই একদিন সত্য হবে-“ইতিহাসকে যারা ভুলে যায়, তাদেরকে কোনও না কোনও সময় আবার সেই পুরনো ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির মধ্য দিয়েই প্রবাহিত হতে হয়”।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

ইটা রাইখ্যা গেলাম...

স্বয়ম

অতিথি লেখক এর ছবি

খুব ভালো লাগলো লেখাটা। মনে হলো আমিও ঘুরে এলাম, দেখে এলাম। অনেক ধন্যবাদ।

স্বয়ম

আরাফ এর ছবি

চলুক

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

হ্যাঁ, একটি ঐতিহাসিক ভ্রমণ হলো বটে! চলুক

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

সময় নিয়ে পড়বার জন্যে ধন্যবাদ

ব্যাঙের ছাতা এর ছবি

ধন্যবাদ
"ফ্রেমের ছবি" দেখার সময় 'বয় ইন স্ট্রাইপড পাজামাস' সিনেমার কথা মনে হল, কাটাঁতারের ছবি দেখেও।

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

ধন্যবাদ, আমারও ঠিক একই অনুভূতি হয়েছিল ওই ছবিগুলো দেখার সময়

অতিথি লেখক এর ছবি

মনে হলো আমিও ঘুরে এলাম,
দেখে এলাম।

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

ধন্যবাদ, পাঠকের নামটি জানতে পারলে আরো ভালো লাগতো

নিটোল এর ছবি

বেশ বড়ো লেখা। পড়ে ফেললাম। ভালো লেগেছে। হাসি

_________________
[খোমাখাতা]

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

লেখা ভালো লাগবার জন্যে ধন্যবাদ

এক লহমা এর ছবি

“ইতিহাসকে যারা ভুলে যায়, তাদেরকে কোনও না কোনও সময় আবার সেই পুরনো ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির মধ্য দিয়েই প্রবাহিত হতে হয়” - সেইটাই।
চলুক

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

তারেক অণু এর ছবি

খুব গুরুত্বপূর্ণ জায়গা নিয়ে পোস্ট-, ধন্যবাদ।

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা- আপনিও তো বোধয় এখানে গিয়েছিলেন কযেক বছর আগে

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।