অ্যাড্রিয়াটিকের মায়ায়

জীবনযুদ্ধ এর ছবি
লিখেছেন জীবনযুদ্ধ [অতিথি] (তারিখ: শনি, ০৪/০২/২০১৭ - ২:৫৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


তিরানার শহরতলী ছাড়িয়ে বহুদূর দিগন্তে দাইতি পর্বতশ্রেণির অপসৃয়মাণ কায়াকে পেছনে ফেলে আমরা যখন আলবেনিয়ার এক সরু মহাসড়ক ধরে এগিয়ে চলেছি তখন অপরাহ্নের শেষ প্রহর। তবে তাই বলে সূর্যের উত্তাপের কমতি নেই। আমাদের গাড়ির বুড়ো চালক তাই ক্ষণে ক্ষণেই স্বেদাসিক্ত হয়ে নিজের সাদা রুমালটি ললাটে ছুঁয়ে নিচ্ছেন। ভদ্রলোক যে বেজায় ক্লান্ত তা বেশ অনুমান করতে পারি। নাকি সেই সাত সকালে কিছু যাত্রী নিয়ে রওনা দিয়েছিলেন মন্টিনিগ্রো থেকে আলবেনিয়ার তিরানায়। পথিমধ্যে নানা স্থানের বিদঘুটে যানজটে তাকে আটকে থাকতে হয়েছে অতিরিক্ত বেশ কয়েকটি ঘণ্টা, আর তিরানায় পৌঁছে একটু জিরোতে না জিরোতেই ফিরতি যাত্রায় আমাদেরকে তুলে নিয়েছেন। এর মাঝে আর মধ্যাহ্নভোজের সময় করে উঠেতে পারেন নি। কিছুটা করুন অভিব্যক্তিতে তাই তিনি এবার নিজের বিশাল বপুটিকে আমাদের দিকে ঘুরিয়ে আর্জি পেশ করলেন, “এখানের কোন এক রেস্তোরাঁয় একটু থেমে যদি আমি কিছু-মিছু খেয়ে নিই, তবে তোমাদের খুব একটা অসুবিধে হবে কি”? এক্কেবারেই নয়, আমরা তো আর মন্টিনিগ্রোতে গিয়ে আজই কোন বিমান-ট্রেন ধরছি না, তাই কিছুটা সময় এদিক সেদিক হলে ক্ষতি কোথায়? উপরন্তু আমরাও কিছুটা জিরিয়ে হাত পা ছড়িয়ে বাইরের খোলা হাওয়া খেয়ে নিতে পারি। আমাদের অনাপত্তি জেনে চালক মহাসড়কের ধারে এক নির্জন রেস্তোরাঁয় গিয়ে গাড়ি থামালেন।

চোখে মুখে কিছুটা জলের ছাঁট দিয়ে নিজের বিশাল তেল চকচকে টাকের ঘাম মুছতে মুছতে চালক আমাকে বললেন, “তোমাদের নিয়ে এই বিশেষ রেস্তোরাঁতেই কেন থামলাম জানো? থেমেছি এক বিশেষ খাবারের লোভে। ওই যে ওদিকে তাকালেই সেটি বুঝতে পারবে”। যেদিকে তিনি নির্দেশ করলেন সেদিকে তাকিয়ে দেখি আস্ত একটি ভেড়াকে আগুনে ঝলসানো হচ্ছে মশলা সহযোগে, টুপ টুপ ঝরে পড়ছে নিঃসৃত চর্বি। এমন উনুনে আগে মুরগী, হাঁস কিংবা বড়জোর কচি ছাগলের নিম্নাংশ ফ্রাই হতে দেখেছি, কিন্তু পুরো একটি ভেড়াকে ফ্রাই বানাতে এই প্রথম দেখলাম। তা এ রেস্তোরাঁর নিয়ম হল ভেড়ার মাংস পুরো ফ্রাই হয়ে গেলে যে যার ইচ্ছেমতো স্থানের মাংস চাইতে পারে, পাচক সেই মোতাবেক কেটে তা প্লেটে পরিবেশন করে। যদিও এতসব কায়দা-কসরতের কারণে কাঙ্ক্ষিত খাবার পাতে পেতে সময় লাগে ঢের বেশি। এবেলায় যেহেতু ভেড়ার মাংস পোড়ান প্রায় শেষ পর্যায়ে ছিল তাই আমাদের চালক মশাইয়ের জন্যে আলবেনীয় বিয়ার সহযোগে এক প্লেট ঝলসানো মাংস পেতে খুব একটা বিলম্ব হল না।

আমরা চলেছি আলবেনিয়ার তিরানা থেকে মন্টিনিগ্রোর অ্যাড্রিয়াটিক পাড়ের শহর বুদভায়। গেলবারের বলকান ভ্রমণে ক্রোয়েশিয়ার দুব্রভনিক শহরে পরিভ্রমণের মাধ্যমে অ্যাড্রিয়াটিক দর্শনের সৌভাগ্য হয়েছিলো। দুব্রভনিক শহর থেকে মাত্র এক ঘণ্টা দূরেই মন্টিনিগ্রোর উপকূলবর্তী শহর কোটর। একবার মনে হয়েছিলো এক ঘণ্টা দূরের ও শহরে ঢুঁ মারলেই তো আরেকটি দেশে পা রাখা হয়, কিন্তু পরে ভেবে দেখেছিলাম সেটি করলে দুব্রভনিককে সময়-বঞ্চিত করা হবে। তবে অ্যাড্রিয়াটিককে আবারও নয়নভরে দর্শন আর মন্টিনেগ্রো দেশটিতে পা রাখবার ইচ্ছেটির কিন্তু মৃত্যু ঘটেনি। তাই এ যাত্রায় আমার আলবেনিয়া ভ্রমণের সাথে এই মন্টিনেগ্রোর বুদভা শহরে ভ্রমণ পরিকল্পনাটিকে যূথবদ্ধ করলাম।

সাধারণত দু দেশের সীমানা পার হবার সময়ে ডিঙিয়ে যেতে হয় দুটি সীমানা চৌকি। একটি যে দেশটি থেকে বহির্গমন ঘটছে সে দেশের, অপরটি যে দেশে আগমন ঘটছে সে দেশের। কিন্তু এই আলবেনিয়া–মন্টিনিগ্রোর সীমান্তে ঘটলো এক অদ্ভুত ঘটনা। একটি পরিত্যক্ত চেহারার জীর্ণ ঘরের সামনে গাড়ি ক্যাঁচ করে থামিয়ে চালক আমাদের সবাইয়ের পাসপোর্ট একে একে তুলে নিয়ে ভেতরে গেলেন, আর ফিরে এলেন মিনিট কয়েক বাদেই। আমি পাসপোর্ট ফেরত পেয়ে পাতা উল্টিয়ে দেখবার চেষ্টা করলাম কোন নতুন সিল ছাপ্পড় আছে কিনা, কিন্তু না তেমন কিছুই খুঁজে পেলাম না। ভাবলাম, হয়তো তবে মন্টিনিগ্রোতে ঢোকবার পর আবার যে সীমানা চৌকি তে দাঁড়াতে হবে সেখানে সিল ছাপ্পড় লাগাবে নিশ্চয়। কিন্তু কোথায় কি? গাড়ি কোথাও থামবার নামগন্ধ না নিয়ে ছুটে চলে এক গেঁয়ো সড়ক ধরে, যেখানে আশপাশ থেকে ভেসে আসে পাকা আঙ্গুরের তরতাজা গন্ধ, কখনো পিচ গাছের পাতা এসে ঝরে পড়ে গাড়ির সামনের কাঁচে। তবে কি আমরা যে স্থানে থেমেছিলেম সেটিই ছিল মন্টিনিগ্রোর সীমানা চৌকি? সে মুহূর্তে এ রহস্য ভেদ করা আমার পক্ষে আর সম্ভব হয় না। যদিবা পাসপোর্টে কোন নাম নিশানা থাকতো তবে হয়তোবা সত্যানুসন্ধানের চেষ্টা করতাম।

পথিমধ্যে আমরা পোঁছাই বার শহরের সীমানায়। আমাদের গাড়ি দেখে চালচুলোহীন দু ভবঘুরে হাত দেখিয়ে গাড়ি থামাতে চায়, তারাও বুদভা শহরে যেতে চায়। আমাদের চালক গাড়ি থামান, তবে অচিরেই আমরা বুঝতে পারি ঠিক দয়াপরবশ হয়ে তিনি গাড়ি থামান নি। বার থেকে কোটর অবধি তাঁর গাড়িতে চাপতে গেলে কি পরিমাণে ভাড়ার টাকা গুনতে হবে, সেটি জানিয়ে তিনি তাদেরকে শুধালেন কি হে দেবে পয়সা? উঠবে আমার যানে? যুবকদ্বয় লাজুক হেসে মাথা নাড়িয়ে জানায় তাদের কাছে তেমন পয়সা নেই, বিনে ভাড়ায় যাবার সুযোগ খুঁজছে তারা। “তবে এখানেই দাঁড়িয়ে থেকে পরের কাওকে খোঁজ কর”, এই বলে চালক আবার এক্সিলেটরে পা দাবালেন।

ঠিক সন্ধ্যে আর রাতের সন্ধিক্ষণের সময় সেটি। পাহাড়ি পথে একে-বেঁকে চলবার সময়ে ভেসে আসছিলো বুনো পোকার গুঞ্জন। আর ক্রমাগত নানা বাঁকে মোচড় নেবার ফলে আমাদের অবস্থা সেই ঝড়ো সমুদ্র-জলের ঝাঁপটায় ক্রমাগত দুলতে থাকা তরণীর যাত্রীদের মতোই শোচনীয়। এমন সময়েই পরিত্রাণের বাণী নিয়ে এলে এক ঝলক আলো। সে আলো বহু নিচে সাগরের প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা একরত্তি এক শহরের ঘরগুলোতে টিম টিম করে জ্বলতে থাকা বাতির আলো। আমরা তখন সুউচ্চ এক পাহাড়ের চুড়োয় গিরিখাত পেরিয়ে সবে নিম্নমুখী পথে ধাবমান হয়েছি, আমাদের মাঝে যারা একটু ঝিমিয়ে পড়েছিল তারাও এই অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে ধরফরিয়ে জেগে উঠে বিস্মিত হয়ে গেলো।

হ্যাঁ এই সেই বুদভা নগরী। কালের পুরাণকে বক্ষে ধারণ করে নানা রাজাধিরাজের অধীনস্থ হয়ে এক প্রস্তর প্রাকার সহযোগে যে শহর আজ নিজেকে আগলে রেখেছে স্বচ্ছ নীলাভ জলের অ্যাড্রিয়াটিক সাগর থেকে। খ্রিস্টের জন্মেরও প্রায় তেরশ বছর পূর্বে যে শহরের পত্তন, সেই সুপ্রাচীন নগরে পদার্পণ আমার মাঝে এক রোমাঞ্চের ঘূর্ণাবর্ত তৈরি করে। যদিও সে আবর্তে কিছুটা ছেদ পড়ে নিজের কুকুর ছানাকে নিয়ে পুরনো শহরের দ্বারপ্রান্তে আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা হোটেল ম্যানেজারের সাক্ষাত পেয়ে। বুদভার পুরনো শহরের ভেতরের পাড়াগুলোতে যান্ত্রিক যান চলবার বিধান নেই, সেখানে যেতে হয় পয়দলে। ম্যানেজার ভদ্রমহিলা তাই প্রধান সড়কের ধারে আগেভাগেই এসে অপেক্ষা করছেন আমাকে পথ দেখিয়ে প্রাকার-বেষ্টিত পুরনো শহরে উদরে নিয়ে যাবেন বলে। আমি তাঁর অনুগামী হয়ে নানা সঙ্কীর্ণ গলি পেরিয়ে যে অট্টালিকার সামনে এসে দাঁড়াই সেটি সে পাড়ার আর সব নিবাসের মতোই একটি সাদামাটা দ্বিতল বাড়ি, হয়তো তার একটি তল আগত অতিথিদের কাছে ভাড়া দিয়ে কিছু বাড়তি পয়সা রোজগার করা হয়। আমার কাছে ব্যবস্থাটি খাসা বলে প্রতীয়মান হয়। জানালা খুলেই নিচে হুল্লোড়রত নানা দেশের নানা বর্ণের মানুষের কথামালা যখন কর্ণকুহরে প্রবেশ করে তখন নিঃসঙ্গ রাতে নিজেকে সাথি-হারা না ভেবে বহুজনের গোত্রভুক্ত বলে মনে হয়। আমি পথের ধকল কিছুটা কাটিয়ে উঠে জানালার নিচে অপেক্ষমান জনস্রোতের ভিড়ে রাতের বুদভা নগরীকে আবিষ্কারের প্রয়াস চালাই।

শুনেছি দিল্লী শহরে আছে যন্তর-মন্তর আর লখনৌ শহরে আছে ভুলভালাইয়া নামক গোলকধাঁধা। সেসব দেখবার সৌভাগ্য অদ্যাবধি হয়নি। তবে এই বুদভার পুরনো শহরে পথ চলতে গিয়ে মনে হল সে আকাঙ্ক্ষা ঠিক ষোল আনা না হলেও কয়েক আনা তো পূরণ হলই। ধমনীর মতো বিস্তৃত হাজার গলি-ঘুপচির এ স্থানে পথ হারানোটিই যেন বড্ড স্বাভাবিক। তবে হ্যাঁ সে থেকে পরিত্রাণের উপায়ও অবশ্য আছে। এই যেমন যদি কেবল পশ্চিমদিকে মুখ করে নানা গলি পেরিয়ে যাওয়া যায় তবে কোন একসময়ে সাগরমুখী প্রাকারের কাছে পৌঁছে শহরের এক ধারে গির্জার ঘণ্টাঘরকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব, আর সেইভাবে সম্ভব আবারও ভিন্ন কোন গন্তব্যে পা ফেলা। আমি এতসব কিছু না ভেবে নানা গলির মাঝে ধীরলয়ে ঘুরে বেড়াই। মজার ব্যাপার হল আঁধারে ঢাকা এইসব গলির মাঝেই আবার বিভিন্ন বাড়ির উঠোনে বসে গেছে অস্থায়ী পানশালা, চড়া বাদ্যের সুর আর সেই সাথে পানোল্লাসে মত্ত নবীন কণ্ঠ ছিটকে আসে সেসব উঠোন থেকে। তেমনই এক বাড়ির দু দেয়ালের কোণের প্রায়ান্ধকার স্থানে এক ঝলক সাদা কিছুর অস্তিত্ব পরিলক্ষিত করে আমি হটাত ভূত দেখার মতো চমকে উঠে। চোখ আরও কিছুটা ধাতস্থ হবার পর বুঝতে পারি বাঁ হাঁটু মুচড়ে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাদা ফ্রক পরিহিত এক যুবতী, আর হাতে চেপে ধরা মেয়েলি ধুম্রশলাকা থেকে ওড়াচ্ছে মিষ্টি ধোঁয়া। কিন্তু প্রশ্ন হল এমন এক হুল্লোড়ে ভরা স্থানে তরুণী একা কেন?

সে বাড়ির কাঁধ সমান উঁচু পাঁচিলের প্রান্তে গিয়ে উঁকি-ঝুঁকি মেরে আমি ভেতরের পরিবেশের হাল হকিকত বোঝার চেষ্টা করি। রাত এখন মেলা, এমন সময়ে গেলাস ভর্তি তরল উদরে ঢোকালে কাল দিনের অর্ধেক মাটি হবার সম্ভাবনা অত্যাধিক। তাই ভেতরের মানুষদের সাথে মিলে-ঝুলে চলবার মতো মনোবল পাই না। তার চেয়ে বরং সেই শুভ্রবসনা ইটালিয় ললনার সাথে দু চারটে সদালাপের অভিসন্ধিতে আমাদের অন্তর্জগত আমাকে ঠেলে দেয়। তরুণী এখানে একা নয়, সে এসেছে তার এক বন্ধু-মহলের সাথে। পুরকৌশলে স্নাতক সম্পন্ন করার পর সে আনন্দে ওরা দল বেঁধে এসেছে এই বুদভা নগরে। কিন্তু ওই যে বলেছিলাম গোলকধাঁধার শহর, তারই গ্যাঁড়াকলে পড়ে বেচারি এক সময় দেখতে পায় ওকে ফেলে বাকি বন্ধুরা হারিয়ে গেছে কোন এক গলির ভাঁজে। সে নিয়ে অবশ্য ওর তেমন মাথাব্যথা নেই, হারালেও খুঁজে পাওয়া যাবেই এমন নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে মেয়েটি হাতে থাকা শলাকায় সুদীর্ঘ এক টান দেয়। এক ফাঁকে অবশ্য আমাকে জিজ্ঞেস করে নেয়, ইটালিতে কখনো গিয়েছি কিনা। না ওদেশে কখনো যাওয়া হয়নি, তবে একবার রোম শহরে যাবার ইচ্ছে আছে বৈকি, সে কথা বলতে মেয়েটি মিষ্টি হেসে বলে, “ইটালিতে কেও ঘুরতে এলে রোম থাকে তাদের তালিকার পয়লা নম্বরে, তবে আমি কিন্তু সুযোগ পেলেও রোমের বাসিন্দা হতে চাই না। রাজধানী শহরের এতসব ব্যস্ততা, হৈচৈ, যানজট এসব অসহ্য লাগে আমার। তার চেয়ে আমার নিজের শহর বোলগনা ঢের ভালো। ফিরে গিয়ে আমার নিজের শহরেই চাকরি জোটাবার চেষ্টা করবো”। এসব আলাপের মাঝেই ওর শলাকা পুড়ে নিঃশেষ হয়ে আসে, আর সেই সাথে ওর মনে পড়ে হারানো বন্ধুরা না জানি ওকে কোথায় খুঁজে মরছে। কিছুটা তাই চিন্তিত মুখে ও হারিয়ে যায় ডান ধারের এক গলির বাঁকে। আর আমি সেই অন্ধকার স্থানটিতে ঝিম মেরে আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি।

এপথ সেপথে হেঁটে আমি এবার পৌঁছে যাই শহরের আরেক প্রান্তে, যেখানে রাতের সমুদ্র ক্রমাগত দুলিয়ে যায় তিরে বাঁধা সৌখিন জাহাজের মাস্তুল। সে দুলুনির মাঝেই কেও হিক্কা তুলে বেসুরো গলায় গান ধরে জাহাজের সামনের খোলা জায়গায় পা ছড়িয়ে বসে। ওদিকে তির থেকে অল্প দূরেই এক বাঁধানো পথের ধারে বসে গেছে উন্মুক্ত সঙ্গীতোৎসবের মেলা। যার ইচ্ছে ভেতরে গিয়ে গান গেয়ে দু দণ্ড নেচে হাতে তুলে নিচ্ছে একটি বিয়ারের বোতল। ভেতরে ঢোকবার জন্যে কোন প্রবেশ মূল্য নেই, ওই যে বিয়ার কেনা ওর মাঝেই হয়তো প্রবেশের মূল্যও নিহিত। শত মানুষের পদচারনায় মুখর গমগমে এ পরিবেশ দেখে কে বলবে আজ সপ্তাহের মাঝের এক দিনের রাত! তবে আশেপাশে যাদের দেখা যাচ্ছে এদের অধিকাংশই কিন্তু পার্শ্ববর্তী নানা দেশ থেকে আগত পর্যটক, এদের মাঝে স্থানীয় লোকের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। মন্টিনিগ্রো ২০০৬ সালে স্বাধীন হবার পর খুব দ্রুত প্রবৃদ্ধি ঘটে এ শররের পর্যটন খাতের। বিশেষত রাশিয়ান পর্যটকদের কাছে এক বিশেষ সুখ্যাতি পায় এ অঞ্চল। ফলশ্রুতিতে ঝাঁকে ঝাঁকে রাশিয়ান ধনকুবেররা এ অঞ্চলে ছুটে আসেন বিনিয়োগ আর বিনোদন দুইয়ের জন্যেই। আমি যদিও বুদভায় এসেছি এ শহরের পানশালা কিংবা সঙ্গীতোৎসবের লোভে নয়, বরং বুদভাসহ কাছাকাছি আরও কয়েকটি ঐতিহাসিক এবং দৃষ্টিনন্দন শহরে দেখে এই দক্ষিণ অ্যাড্রিয়াটিক এলাকা সম্পর্কে একটা ধারণা নিতে। কাল সে প্রয়াসে প্রথমেই যাবো এখান থেকে ঘণ্টাখানেক দূরের শহর কোটরে।

পরদিন সকালে প্রাতঃরাশের খাবারের খোঁজ করতে গিয়ে টের পাই পকেটের অবস্থা তেমন সুবিধের নয়, সাথে বেশ কিছু আলবেনিয়ার লেক আর সার্বিয়ার দিনার থাকলেও ইউরোর নোট আছে গোটাখানেক। ও দিয়ে বড়জোর সকালের খাবার চলতে পারে, কিন্তু আর কিছু নয়। মন্টিনেগ্রো স্বাধীনতা লাভের পর ইউরোকেই মুদ্রা হিসেবে গ্রহণ করে, যদিও দেশটি এখনও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন কিংবা ইউরোজোনের সদস্য রাষ্ট্র নয়। ইউরোপে দেখেছি যেসব দেশে ইউরো চলে সেসব দেশে মুদ্রা ভাঙ্গাতে হলে যেতে হয় ব্যাঙ্কে, এ দেশেও তাই আমার সাথে থাকা লেক আর দিনারগুলোকে ইউরোতে বদলে নিতে দ্বারস্থ হতে হল নিকটস্থ এক ব্যাঙ্কের। কিন্তু সেখানে গিয়ে জানলাম এক অবাক খবর, মন্টিনেগ্রোর কোন ব্যাঙ্কেই লেক বদলে ইউরো দেয়া হয় না, যদিও সার্বিয়ান দিনার নিয়ে এদের সেই সীমাবদ্ধতা নেই। পরবর্তীতে দেখেছি শুধু মন্টিনেগ্রোতেই নয়, আশেপাশের কোন দেশেই লেক বদলে অন্য মুদ্রা পাবার ব্যবস্থা নেই। অর্থাৎ আলবেনিয়ায় গেলে বুদ্ধিমানের কাজ হল ফেরার সময় পকেটের সকল লেক ওদেশেই খরচ করে ফেলা।

সে সকালে পেট পুরে খাবার পর পোতাশ্রয়ের কাছে বালিয়াড়ির উপর পেতে রাখা এক কাঠের পাটাতনে আনমনে হাঁটছি এমন সময় পড়ে গেলাম এক ট্যুর কোম্পানির খপ্পরে। তারা বেশ সুলভে কাছের এক দ্বীপে যাবার ব্যবস্থা করবে, প্রথমে তাদের গাড়িতে নিয়ে যাবে ঘণ্টাখানেক দূরের এক শহরে, তারপর সে শহরের ঘাটে বেঁধে রাখা নৌকায় সে দ্বীপ দর্শন। কিছুটা আমতা আমতা করে আমি রাজি হয়ে গেলাম তাদের প্রস্তাবে। রফা হল আমাকে ঘণ্টাকয়েক পর একটি নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে দাঁড়াতে হবে, সেখান থেকেই তাদের গাইড আমাকে গাড়িতে তুলে নেবে। আমি এই মাঝের কয়েক ঘণ্টায় বেশ কয়েকটি মিষ্টি আইসক্রিম সাবাড় করে ঠিক সময়েই ঠিক স্থানে গিয়ে হাজির হলাম। কিন্তু গোল বাঁধল ট্যুর কোম্পানির গাড়ি এসে পৌঁছোবার পর। বোঝা গেলো এ গাড়ি আগেই বেশ কিছু পর্যটক নিয়ে এসেছে, আমি তাদের তুলে নেবার লিস্টের শেষ যাত্রী। মূল সমস্যা অবশ্য অন্যখানে, গাইড এসে আমার সাথে করমর্দনের সময়ে বুঝলাম ভদ্রমহিলা এক বর্ণ ইংরেজিও জানেন না। এ দলটি মূলত রুশ পর্যটকদের এক গ্রুপ, আর এ ভদ্রমহিলাও একজন রুশ ভাষী ইউক্রেনিয়ান। আমি পড়ে গেলাম এক দ্বিধায়। এদের সাথে যদি যাই তবে গাইডের এক বর্ণ শব্দও তো বোধগম্য হবে না, অন্যদিকে যদি না যাই তবে দিনের বাকি ভাগটিতেও খুব একটা কিছু করার নেই আমার। ওদিকে ভদ্রমহিলা আকারে ইঙ্গিতে আমাকে বোঝাতে চাইছেন কথা না বোঝ অন্তত পথের রূপটি তো দেখতে পাবে। ভেবে দেখলাম সেটি মিথ্যে নয়, আমি না হয় এদের কাফেলার সহযাত্রী হয়ে আমার মতো করেই সব কিছু দেখে নিলাম!

তুঁতরঙা জলের সাগর অ্যাড্রিয়াটিক দক্ষিণ বলকানের নানা শৈলশ্রেণিতে বাঁধা পেয়ে নারীর উড়ে যাওয়া দোপাট্টার মতো করে অসরল রেখায় ঢুকে গেছে এ অঞ্চলের নানা পার্বত্য উপত্যকায়, সেখানে তৈরি হয়েছে উপসাগর, জলে ভেসে থাকা লিলির দলের মতোই সে উপসাগরে জেগে উঠেছে নানা দ্বীপমালা। বুদভা নগরের নিকটে বোকা–কোটরস্কা হল তেমনই এক উপসাগর, যে উপসাগরকে উত্তুরে হাওয়া থেকে বাঁচিয়ে দু ধার থেকে বেষ্টন করে রাখে সেইন্ট এলিয়াস পর্বতমালা। রোদে ভরা ঝলমলে দিনে মেঘের পাল যখন সেইন্ট এলিয়াসের তামাটে গাত্র ছুঁয়ে চলে যায় বহু দূর অজানায়, তখন পর্বতের পদপ্রান্তে থাকা বোকা–কোটরস্কার নীল জল তার প্রতিফলনকে টলটলে জলে আটকে রেখে বিদায় পর্বটিকে প্রলম্বিত করে কিছুটা সময়ের জন্যে। এই পর্বত আর উপসাগরের মাঝে যে এক চিলতে ব্যবধান, সেখানেই বহুকাল আগে মন্টিনেগ্রোর কিছু মানুষ গড়ে তুলেছিল ক্ষুদ্রায়তনের এক শহর, নাম তার পেরাস্ত। শহরবাসীদের প্রধান জীবিকা ছিল মৎস্যাহরণ। সমুদ্রগামী জাহাজে দূরদূরান্তে যাত্রা করে ফিরে আসবার সময়ে নানা সময়ে তাদের পড়তে হতো বাদলা কিংবা জলদস্যুর কবলে। ধর্মাশ্রয়ী এই নাবিক সম্প্রদায়ের কাছে একসময় পরিত্রাণের আলোকবর্তিকা নিয়ে হাজির হলেন এক দেবী। দেবীর আরাধনায় মুক্তি মিলল তাদের, মিলল নানা অনিশ্চয়তায় অলৌকিক ভরসা। সেই থেকে তারা পণ করলেন দেবীকে তারা অধিষ্ঠান করবেন পেরাস্ত শহরের খুব কাছেই কোন এক স্থানে। ভাবনা মোতাবেক কাজ শুরু হয়ে গেলো চতুর্দশ শতকের এক সময়ে। শহরবাসী পেরাস্ত উপকুলের খুব কাছেই সমুদ্রের মাঝে এক স্থান নির্বাচন করে সেখানে প্রস্তর অর্পণ করে বানিয়ে ফেললেন এক প্রস্তর দ্বীপ, কৃত্রিম সে দ্বীপে তারপর গড়া হল অপূর্ব এক শ্বেত পাথরের গির্জা। আর সে গির্জাতেই গত প্রায় সাতশো বছর ধরে পূজিত হচ্ছেন সে দেবী, যিনি আজ প্রস্তর দ্বীপের দেবী নামেই সর্বজনবিদিত। পেরাস্ত শহরে আমাদের সেদিন গমন মূলত শহরের উপকণ্ঠের উপসাগরে জেগে থাকা সেই প্রস্তর দ্বীপের গির্জা আর দেবী দর্শন।

ইতোমধ্যে আমার সেই ভাষা সমস্যার কিছুটা সমাধান হয়েছে। দেখা গেল আমাদের দলের রুশ ভদ্রমহিলা কিছুটা ইংরেজি জানেন। সব কথার না হলেও গাইডের গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথার অনুবাদ করে বলে তিনি আমাকে উপকৃত করছেন। ওদিকে আমাদের সেই ইউক্রেনিয়ান গাইড লজ্জায় মরমে যাচ্ছেন আমাকে এমন একটি অবস্থায় ফেলবার জন্যে। আমার বাকি সহযাত্রীরা কিন্তু বেজায় খুশি আমাকে পেয়ে। তাদের কাছে আমি এক ভিনদেশি। মস্কো থেকে আগত এক বৃদ্ধ দম্পতি সেই ইংরেজি জানা ভদ্রমহিলার মাধ্যমে আমাকে শুধলেন আমি কোন রুশ ভাষা জানি কিনা। ভাষা না জানলেও চার পাঁচটে শব্দ কিন্তু দিব্যি জানি। এককালে আমার এক সর্বকর্মী ছিল স্ট্যান আনেনকোভ, স্ট্যানের বাড়ি রাশিয়ার সেইন্ট পিটার্সবার্গে। একসময়ে ও কাজ করেছে রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে, পরে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে চলে আসে আমেরিকায়। ওই স্ট্যানই আমাকে শিখিয়েছিল কিছু কিছু শব্দ, এই যেমন, ‘কেমন আছেন’, ‘ভালো আছি’, ‘শুভ দিন’ কিংবা ‘ধন্যবাদ’ এসবের রাশিয়ান প্রতিশব্দ। এবারে সুযোগ পেয়ে সেই বৃদ্ধ দম্পতিকে শুনিয়ে দিলাম রুশ ভাষায় আমার সেই ক্ষুদ্র জ্ঞানের বহর। আমার মুখে ওই পাঁচ-ছটি রুশ শব্দ শুনেই তারা মুগ্ধতায় ডুবে গেলেন, সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোকটি তৎক্ষণাৎ তাঁর মাথার টুপিটি খুলে আমার মাথায় পড়িয়ে দিয়ে বললেন, “প্রেসেন্ট”, টুপির গায়ে সুতোর সেলাইয়ে লেখা “মস্কোভা”।

এমন একটি দলের সাথে ভাষার ব্যবধান থাকলেও মনের ব্যবধান ঘুচে গেলো অচিরেই। আমরা সবাই বেশ হইচই করে গিয়ে উঠলাম পোতাশ্রয়ে বেঁধে রাখা এক মোটর নৌকায়, যেটি আমাদেরকে নিয়ে জলের ফোয়ারা ছুটিয়ে বয়ে চলল প্রস্তর দ্বীপের পানে।

বেশ কায়দা করে দ্বীপের পাথুরে রোয়াকে নৌকোর রশিখানা বেঁধে মাঝি আমাদেরকে নেমে আসবার নির্দেশ করে। আমি একুয়ারিয়ামে খেলে বেড়ানো রঙিন মাছের ন্যায় কিছু সামুদ্রিক বগি মাছকে তিরের কাছটায় স্বচ্ছ জলের পর্দা ভেদ করে দল বেঁধে ছুটে যেতে দেখি। আর ডান ধারে দেখি গির্জার ঘণ্টাঘরের চুড়োর ডোমে দলছুট একটি সারস কিছুক্ষণের বিশ্রাম নিয়েই আবার তারস্বরে চিৎকার করে ছুটে যায় বাকি সাথীদের পানে। এই এক চিলতে দ্বীপের এক চিলতে গির্জার প্রবেশদ্বারের রঙ ওই ঘণ্টাঘরের ডোমের রঙের মতই-গাঢ় নীল, চারধারের জলের রঙের সাথে এই রঙটি বেমানান মনে হয় না তাই মোটেও। হাট করে খুলে রাখা সেই দ্বার ঠেলে ভেতরে প্রবেশমাত্র আমার মনে হয় দুষ্প্রাপ্য তৈলচিত্রের সম্ভার নিয়ে অপেক্ষায় থাকা কোন জাদুঘরের গ্যালারীতে এলাম না তো? তেমনটি মনে হবার বেশ দৃঢ় কারণ আছে। প্রার্থনা ঘরের দু পাশের দেয়াল আর ছাদের গায়ে সোনালি কারুকাজমণ্ডিত ফ্রেমের মাঝে বন্দি হয়ে ঝুলছে কম করে হলেও পাঁচ শতকের পুরনো বেশ কিছু অনবদ্য ছবি, বলাই বাহুল্য যার সব কটিই নানা ধর্মীয় আবহে আঁকা। এই যেমন ছাদের বিশালাকারের ছবিটিতে দৃশ্যমান মেরির স্বর্গের দেবদূত পরিবেষ্টিতরূপে ধরাধাম থেকে বিদায়ের মুহূর্ত। দু পাশের দেয়ালের চিত্রগুলো সাজানো রয়েছে তিনটি সারিতে। সবচেয়ে নিচের সারির ছবিগুলো শিল্পীর জীবনের প্রথম পর্যায়ে আঁকা, তাই ওগুলোতে মুন্সিয়ানার ছাপ কিছুটা কম সবচেয়ে ওপরের সারির ছবিগুলোর চাইতে। আর মাঝের সারির যে ছবিগুলো, সেগুলো কিছুটা কৌতূহলোদ্দীপক। এই ছবিগুলো কোন কাগজ বা কাপড়ের ক্যানভাসে আঁকা নয়, বরং এগুলো আঁকা সিলভারের ক্যানভাসে। আর এ ক্যানভাসে কোন দেবদেবীর ছবি নয়, বরং স্থান পেয়েছে তরঙ্গবিক্ষুব্ধ সাগরে উত্তাল জলরাশির সাথে যুদ্ধরত নানা জাহাজের দৃশ্য। এমন সব দৃশ্যের অবতারণা এই গির্জায় কেন? জানলাম, সেই ষোড়শ শতকের ওই সময়ে অত্র অঞ্চলের নাবিকেরা তাদের জাহাজ নিয়ে যখন সাগরে ভাসতেন, তখন প্রতিকূল অবস্থার মুখোমুখি হয়ে তাঁরা স্মরণ করতেন এ গির্জার দেবীকে আর মানত করতেন যদি প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারেন তবে এই প্রতিকূল অবস্থার স্মৃতিকে ছবিতে পরিণত করে দামি ধাতুর ক্যানভাসে করে বসিয়ে দেবেন গির্জার দেয়ালে, আর সেভাবেই কত কয়েক শতকে পুণ্যার্থীদের দানকৃত প্রায় দু হাজার সিলভার ধাতুর ক্যানভাসে ছেয়ে গেছে দু পাশের দেয়াল। মাঝের যে প্রধান বেদি সেখানে কিন্তু যিশু বা মেরীর কোন মূর্তি নেই, সেটা থাকবার কথাও নয়। কারণ অর্থোডক্স গির্জাগুলোতে সাধারণত যিশু বা মেরীর মূর্তি না রেখে সেখানে রাখা হয় কোন তৈলচিত্র, যদিও মেরীর চিত্রপট রাখবার চলটাই বেশি। এ গির্জাটিও তার ব্যতিক্রম নয়। এখানেও সম্মুখের বেদিতে অধিষ্ঠান মেরীর একটি তৈলচিত্রের, যেখানে মেরি দীপ্তময় শিশু যীশুকে কোলে নিয়ে তাঁর দ্যুতি ছড়িয়ে দিচ্ছেন চারপাশে। এই চিত্রটি আঁকা হয়েছিলো খুব সম্ভবত চতুর্দশ শতকে। তারপর বহুবার তুর্কী বা তিউনিসিয়ান তস্করকের হামলার মুখে পড়েছে এ গির্জা, কিন্তু প্রতিবারেই পেরাস্তের জনগণ এই চিত্রকর্মটিকে আগলে রেখে বাঁচিয়েছেন, ঝড় ঝাঁপটা পেরিয়ে যাবার পর আবার ছবিটিকে ফিরিয়ে এনে স্থান দিয়েছেন যথাপবিত্র স্থানে। আর সেভাবেই শত শত বছর ধরে মেরীর এ ছবিটি পূজিত হয়ে আসছে এ গির্জায়, তিনি পরিচিতি পেয়েছেন প্রস্তর দ্বীপের দেবী হিসেবে।

আমার দলের বাকি সবাইকে আমি দেখি এই প্রধান বেদিটিকে প্রদক্ষিণ করতে। সেটি আমার মাঝে কিছুটা কৌতূহল জন্ম দেয়। আমি তাদের অনুসরণ করে বেদির পেছনের অন্ধকারময় স্থানটিতে গেলে দলের বয়োবৃদ্ধা একজন আমাকে ডেকে নেন সেদিকে, তারপর আমাকে আকারে ইঙ্গিতে যা বোঝান সেটি অনেকটা এমন- বেদির পেছনে রয়েছে এক ছোট্ট কোটর, তার মাঝে হাত ঢুকিয়ে কোন মনকামনা করলে সেটি সফল হবেই। আমাকে তিনি পরামর্শ দিলেন, এমন সুযোগ হেলায় হারিয়ো না বাপু, আমাদের দলের সাথেই এবেলায় কিছু মিছু চেয়ে নাও মেরীর কাছে। আমি গৃহী মানুষ, জাগতিক নানা বিষয়ে আমার কামনাবাসনা, বৃদ্ধার পরামর্শ শুনে তাই ভাবলাম এ সুযোগে কিছু একটা চেয়ে নিতে দোষ কি?

এই অর্থোডক্স গির্জার গল্পের সাথে আরও কিছু কথা যোগ করে রাখি। মন্টিনেগ্রো দেশটির প্রায় আটাত্তর শতাংশ মানুষই অর্থোডক্স খ্রিস্ট ধর্মালম্বী। সে বিষয়টি অবশ্য আমার মাঝে মন্টিনেগ্রোর স্বাধীনতা নিয়ে এক বিরাট প্রশ্ন জন্ম দিয়েছিল। কারণ যুগোস্লাভিয়া থেকে একে একে সব কটি দেশ বিদায় নেবার পর শেষ যে দুটি অংশ একত্রিত ছিল তারা হল সার্বিয়া এবং এই মন্টিনেগ্রো। এই দুটি অংশের অধিকাংশ মানুষের ভাষা এক, ধর্মও ওই একই। শুধু তাই নয়, মন্টিনেগ্রোর অর্থনৈতিক বুনিয়াদও তেমন মজবুত নয়। এখনো দেশটির একটি বড় অংশের মানুষ গ্রীষ্মের সময়টাতে মন্টিনেগ্রোর সৈকত শহরগুলোতে কাজ করলেও শীতের সময়ে কাজের অভাবে পাড়ি জমায় সার্বিয়ার কয়েকটি শহরে। এমনতর অবস্থায় তবে পৃথক হবার যুক্তি কি? এ নিয়ে কয়েক জনের সাথে কথা বলে যা বুঝলাম তা হল সাধারণ জনগণের ইচ্ছেতে নয়, মূলত দেশটি পৃথক হয়েছে বর্তমান প্রধান মন্ত্রী মিলোর নানা রাজনৈতিক চাতুর্যে। এই মিলো নিকট অতীতে সবচেয়ে দীর্ঘসময় ক্ষমতায় থাকা রাজনীতিবিদদের মধ্যে অন্যতম। কখনো রাষ্ট্রপতি, কখনো প্রধানমন্ত্রী এভাবেই তিনি মন্টিনেগ্রোর রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে আসীন আছেন বিগত প্রায় দু দশক। অতিশয় ধূর্ত এই রাজনীতিবিদের রাজনৈতিক জীবন কিন্তু শুরু হয়েছিলো যুগোস্লাভ সময়ে সমাজতান্ত্রিক দলের হাত ধরে। এরপর যুগোস্লাভিয়া যখন অন্যায়ভাবে ক্রোয়েশিয়ার দুব্রভনিক বন্দরে আক্রমণ করে, তাতে ছিল তিনার সক্রিয় সমর্থন এবং সহযোগিতা। কারণ মন্টিনেগ্রোর পোতাশ্রয় থেকে ছেড়ে গিয়েই নৌ বাহিনীর জাহাজগুলো দুব্রভনিকে আঘাত হেনেছিল। আর মিলো ছিলেন এর পেছনের ব্যাক্তি। কিন্তু এর কয়েক বছর পর যুগোস্লাভিয়া-কসোভো সঙ্কট ঘনীভূত হলে মিলো বুঝে যান যুগোস্লাভিয়ার সাথে গাঁটছাড়া বেঁধে হাঁটতে গেলে লাভের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণই বেশি। রাতারাতি ভোল পাল্টে ফেলেন তিনি, এবারে তিনি পরিণত হলেন এক জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদে। যুগোস্লাভিয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তিনি পাশ্চাত্যের সাথে বন্ধন গড়তে প্রত্যয়ী হলেন। ওদিকে যুগোস্লাভিয়ার ফেডারেল সরকারের তখন অর্থনৈতিক সংকটসহ নানা কারণে বেশ পর্যুদস্ত অবস্থা। তাই ওই মোক্ষম সময়ে মিলো দেখলেন এ বেলায় যদি মন্টিনেগ্রোকে স্বাধীন করে ফেলা যায় তবে স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার ব্যক্তিগত প্রভাব-প্রতিপত্তি যাবে বহু গুনে বেড়ে। এমতাবস্থায় ইঙ্গ-মার্কিন পক্ষের অকুণ্ঠ সমর্থনও তিনি পেলেন। শুধু তাই নয়, মন্টিনেগ্রোর বাদবাকি বাইশ শতাংশ জনগোষ্ঠী যারা জাতিগতভাবে আলবেনিয়ান মুসলিম তারাও স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন একাট্টা। ফলে রাজনৈতিকভাবে স্বাধীনতার প্রশ্নটি নিজ গৃহে মোকাবেলা করা মিলোর পক্ষে সহজ হয়ে যায়। আর সেভাবেই সুবিধেবাদি এই রাজিনিতবিদের হাত ধরে এলো মন্টিনেগ্রোর স্বাধীনতা।

প্রস্তর দ্বীপ থেকে এবার আমরা ফিরে আসি পেরাস্ত শহরের ঘাটে। পাথরে বাঁধানো ঘাটের একটি অংশে কয়েক রূপবতী যুবতী সেক্ষণে সাঁতারে পোশাক পড়ে ডাইভের প্রস্তুতি নেয়। আর অদূরের এক বাড়ির চুড়োয় লাগানো বিশালাকারের দেয়াল ঘড়ি ছটার কাটা স্পর্শ করে। গোধূলি বেলার কমলাভ রোদে আলোকিত হয়ে সে বাড়ির দ্বিতলের জানালাগুলোয় শুকোতে দেয়া কিছু সাদা কাপড় পতপত করে উড়তে থাকে। আমি তিরের কাছেই এক কফি শপের বাইরে পেতে রাখা বেঞ্চে ধপাস করে বসে একটি পেস্ট্রির অর্ডার দিয়ে পাথরের বিশাল সব চাঙ্গড়ে এসে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের একটানা ছলাত ছলাত শব্দ শুনি।

“তুজে নেচেমো সোয়ে নেদেমো”- বাংলা করলে যার অর্থ দাঁড়ায় “তুমি বাপু আমার কিছু চেয়ো না, বিনিময়ে আমিও তোমার কিছুর প্রতি হাত বাড়াবো না”। পরদিন আমি বুদভা শহর থেকে আবারও একঘণ্টা দূরের আরেক শহর কোটরে যাত্রা করে দুর্গসম সেই শহরের প্রবেশমুখে বেশ বড় করে এই লেখাটি দেখতে পাই। এই লেখাটির নিচে একটি তারিখ, ২১ শে নভেম্বর ১৯৪৪ সাল। কোটর শরটির ইতিহাস একটি দুটি শতকের নয়, সেই বুদভা শহরের মতোই এ শহরেরও পত্তন হয়েছিলো হাজার বছর আগে, আরে বুদভার মতোই এ শহরটিও উঁচু প্রাকার বেষ্টিত। হয়তো সেকালে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে শহর বাঁচাতে এভাবে পাঁচিল দিয়ে শহর-প্রতিরক্ষা বুজ্য তৈরি করা হতো। এমন হাজার বছরের পুরনো শহরের মূল প্রবেশদ্বারে মাত্র অর্ধশতাব্দী পূর্বের একটি বিশেষ তারিখ খোদাই করে লিখে রাখবার তাৎপর্য কি?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে এই গোটা এলাকাটি ছিল দখলদার ফ্যাসিবাদী ইটালিয় সেনাদের অধীনে। যুগোস্লাভিয়ার উত্তর-পূর্ব অংশ জার্মান বাহিনীর অধীনে থাকলেও এই দক্ষিণ-পশ্চিমের অংশটি কিন্তু আবার ছিল ইটালির অধীনে। মুসোলিনির সাথে হিটলারের সে রকমই দফারফা হয়েছিলো। ১৯৪৪ সালের অক্টোবরেই বেলগ্রেড জার্মান সেনা মুক্ত হলেও এই দক্ষিণতম প্রান্তের কোটর শহর তারও প্রায় এক মাস পর টিটোর অধীনস্থ পার্টিজান বাহিনীর অভিযানে শত্রুমুক্ত হয়। আজ আর সেই যুগোস্লাভিয়া নেই, টিটোও গত হয়েছেন প্রায় তিন দশক আগে, কিন্তু তারপরও শহরবাসী তাঁর প্রতি সম্মানার্থে সেই অর্ধ শতাব্দী পূর্বে শহরদ্বারে লিখে রাখা কথাগুলো মুছে দেয়নি, যে কথার মাধ্যমে বোঝান হয়েছিলো যুগোস্লাভিয়া বন্ধুর প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করবে, তবে আবার আক্রান্ত হলে শক্ত জবাব দিতেও পিছপা হবে না।

কোটর শহরটিতে পা দিয়ে আমার সহকর্মী মিলানের কথা আমার মনে পড়ে। মিলানের ঠাকুরদার বাড়ি এই কোটরে, ওর মা ক্রোয়েশিয়ান, আবার ওর বাবার কর্মসূত্রে ওর জন্ম হয়েছিলো স্লোভেনিয়ার লুব্লিয়ানায়, আর ওর বেড়ে ওঠা সার্বিয়ার বেলগ্রেডে। তাই মিলানকে কেও সার্বিয়ান হিসেবে অভিহিত করলে ও কিছুটা মাথা চুলকে বলে, আমি কি সত্যিই সার্বিয়ান? তারচেয়ে বল আমি একজন যুগোস্লাভ। সত্যিই তো রাজনীতি আর সময়ের প্রয়োজনে হয়তো দেশের মানচিত্র বদলে যায়, কিন্তু তাই বলে মানুষের জাতিসত্তাও কি বদলে যায়? বদলায় না হয়তো। এই যেমন আমাদের দেশের অনেক প্রবীণই হয়তো পার করেছেন ব্রিটিশ ভারত, পাকিস্তান এবং সবশেষে বাংলাদেশের সময়কাল। তারা পেয়েছেন তিনটি জাতীয়তার স্বাদ, কিন্তু জাতিসত্তা কিন্তু তাদের একই রয়ে গেছে, যেটি হল বাঙালি জাতিসত্তা। মিলানের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি তাই। মিলানের কথা যেহেতু এলোই, তখন ওর মুখ থেকে শোনা একটি গল্প বলি। মার্শাল টিটো পরলোকগমন করেন স্লোভেনিয়ার লুব্লিয়ানায়, তিনি সে সময়ে এক সরকারি সফরে বেলগ্রেড থেকে গিয়েছিলেন লুব্লিয়ানায়, তারপর সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়ে সেখানকার এক হাসপাতালে মৃত্যুবরণ। ঠিক এ সময়ে মিলানের পরিবার বাস করতো লুব্লিয়ানায়। টিটো গত হন ৪ঠা মে ১৯৮০ সালে, দিনটি ছিল এক রবিবারের দিন। প্রিয় নেতার অসুস্থ হবার সংবাদ অবশ্য তার আগেই শহরে ছড়িয়ে গিয়েছিলো। উৎসুক হয়ে তাই মিলানের বাবা শুক্রবারে কাজের শেষে হাসপাতালের সামনে গিয়ে অনির্দিষ্টভাবে পায়চারী করতে থাকেন, যদিবা টিটোর কোন সংবাদ পাওয়া যায় সেই আশায়। কিন্তু সে অপরাধে গোয়েন্দা পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে বেশ ক দিন আটকে রাখে। আজ এতো বছর বাদে মিলানের কথা হল ওর বাবাকে গ্রেফতার করা হয়েছিলো খুব সম্ভবত এ কারণে যে, টিটো হয়তো রবিবারে নয়, দু দিন আগে শুক্রবারেই গত হয়েছিলেন। কিন্তু পার্টির কর্তাব্যক্তিরা সেটি চেপে গিয়ে রবিবার পর্যন্ত হয়তো অপেক্ষা করেছিলেন দুটি কারণে- তাতে করে তারা কিছুটা গুছিয়ে নিয়ে দেশবাসীকে সংবাদটি দিতে পারবেন এবং রবিবারের দিন মৃত্যুসংবাদ ফাঁস করলে রাজপথে জনমানুষের ঢল নামবে। তখনকার সময়ে বহির্বিশ্বের কাছে এই জনসমর্থনের বিষয়টি ফলাও করে দেখানোর ব্যাপারটি সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর জন্যে একটি অপরিহার্য বিষয় ছিল। কিন্তু যাই হোক, হয়তো ওই সঠিক মৃত্যু দিনেই মিলানের বাবা হাসপাতালের বাইরে উঁকি-ঝুঁকি মারায় খামোখা গোয়েন্দা পুলিশের নজরে পড়ে যান।

আবারও ফিরে আসি সেই কোটর নগরীর কথায়। সেই প্রবেশদ্বারের মাঝ দিয়ে এ নগরে প্রবেশ করেই বুঝলাম এখানে ঘুরে বেড়াতে গেলে কোন মোটরযান বা মানচিত্রের প্রয়োজন নেই। ক্ষুদ্রাকারের এ শহরটি পয়দলে হেঁটেই অতিক্রম করে ফেলা সম্ভব, আর কোন কারণে পথ হারালেও চিন্তা নেই। ‘দোবার দান’ অর্থাৎ ‘শুভ দিন’ বলে পথচলতি কোন সদাশয় শহরবাসীর শরণাপন্ন হলে তিনি বেশ সবিনয়েই সঠিক পথ নির্দেশ করে দেবেন। আমি এলোমেলো পায়ে হেঁটে প্রথমেই খুঁজে বের করি শহরের প্রাণকেন্দ্রের স্কয়ারটিকে। হয়তো যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী কেটে গেছে, কিন্তু এ স্কয়ারের আশেপাশের বাড়িগুলোর পাথর নির্মিত দেয়াল বদলায়নি এতটুকুও। যদিও কালের ছোবলে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে কিছুটা, এই যা। সেজন্যেই হয়তোবা সবচেয়ে উঁচু তলের জানালার ভগ্ন খড়খড়িগুলো আমার দৃষ্টি এড়ায় না।

পথের এক ঘুপচি দোকান থেকে এক গেলাস লেবু- আলমন্ডের সরবত কিনে আমি এবার এ গলি-সে গলি পেরিয়ে পৌঁছে যাই শহরের পেছনের প্রান্তটিতে। এ দিকটায় বেশ কিছু স্যুভেনিরের দোকান আকাশ-ছোঁয়া মূল্যের পণ্য নিয়ে হাজির। আমার খুব নিকটেই এক অলঙ্কারের দোকান বাইরের কাঁচের বাক্সে গয়না সাজিয়ে ক্রেতার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে, আর এক নাদুস-নুদুস বেড়াল সে কাঁচের বাক্সের উপর কোন একভাবে উঠে পড়ে বেশ একখানা আয়েসি ঘুম দিয়েছে। আমি বেড়াল বাবাজীর ঘুম যাতে না ভাঙে সেভাবে বেশ সন্তর্পণে পা ফেলে ও স্থান থেকে সরে আসি, কারণ বলা তো যায় না ঘুম ভেঙে আমাকে দেখে অকাজের ক্রেতা ভেবে যদি দেয় এক ভেংচি!

এর মাঝেই কখন যেন শহরের ঘরগুলোতে জ্বলে ওঠে সন্ধ্যেবাতি। আমি অদূরের পাহাড়ে গায়ে মনুষ্যসৃষ্ট এক পথে সারি সারি আলো জ্বলতে দেখি, যে আলো গিয়ে শেষ হয়েছে ও পাহাড়ের চুড়োয় এক গির্জাতে। বহু কাল আগে প্লেগের আক্রমণে শহরের নিকেশ হলে রোগমুক্তির আকাঙ্ক্ষায় শহরবাসী নির্মাণ করেছিলেন এই গির্জা, যেখানে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন এক জাগ্রত সন্ত। এমন আঁধার ঢাকা বেলায় আমি আর সেই পাহাড়ি পথ বেয়ে গির্জায় ঢুঁ মারবার অবকাশ পাই না। কারণ আজ রাতে বুদভায় ফিরে যেতে হলে আমাকে এখুনি ফেরবার বাসটি ধরতে হবে। আমি তাই আর বিলম্ব না করে কারাম্পানা নামক এক ফোয়ারার জলে গলা ভিজিয়ে কোটর শহরকে বলি, ‘দভিদেনিয়া-বিদায়’।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখা যথারীতি সাবলীল, বর্ণনা আর ছবিও আকর্ষণীয়।

তিরানা থেকে কি শ্‌কদার (স্কুটারি) হয়ে বুদভা গিয়েছিলেন? ঐ এলাকার ইতিহাস পড়ার সময় স্কুটারি (ফিরিঙ্গী লেখকরা এভাবে লিখে গেছে) নামটা এতোবার এসেছে, তাকে নিয়ে চারপাশের নানা ভাগিদারদের এতো খেয়োখেয়ি হয়েছে যে নামটা মাথায় রয়ে গেছে। বুওনা নদী, জলপাই বাগান, বিভিন্ন কালের প্রতিরোধের গল্প শুধু পড়ে পড়ে স্কুটারি এক ছবি হয়ে আছে। আলবানিয়ার, বিশেষত তিরানার গল্প আমাদের পাওনা হয়ে থাকলো।

নৌকায় করে কোন দ্বীপে গিয়েছিলেন, সাধু নিকোলাসের দ্বীপে? কোন এক মারামারি গোলাগুলির বইয়ে সাধু নিকোলাসের দ্বীপে যাবার অতি ক্ষুদ্র একটা বর্ণনা পড়েছিলাম।

মন্টেনেগ্রো’র আলাদা হবার ইতিহাস আমাদের সময়কালের এক ইনট্রেস্টিং ঘটনা। মোটে ২,৩০০ ভোট বেশি পেয়ে একটা দেশ আলাদা হয়ে যেতে পারে সেটা একটা ব্যাপার বটে। এইখানে মিলো দুকানোভিচ শিখণ্ডী মাত্র। আলাদা হবার আগেই ১৯৯৬ সালে মিলো জার্মান মার্ককে মন্টেনেগ্রোর মুদ্রা হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিল। পরে জার্মানরা নিজেরাই মার্ককে ছাড়লে মন্টেনেগ্রোও ইউরোকে নিতে বাধ্য হয়। মন্টেনেগ্রো আর তার পড়শী কসোভো নিজেদের মুদ্রাবিহীন, কোন কারেন্সি ইউনিয়নের সদস্য না এমন দুই দেশ। মিলোর পেছনে আসলে কারা ছিল সেটা ভবিষ্যত বলে দেবে।

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। আমি শোকদার হয়ে তারপর বার শহরকে ছুঁয়ে বুদভায় গিয়েছিলাম।

আবারো ঠিক ধরেছেন, আমি নৌকায় করে গিয়েছিলাম সাধু নিকোলাসের দ্বীপে। চমৎকার এক টুকরো দ্বীপ এই নিকোলাসের দ্বীপ। দ্বীপের বেলাভূমিটি ঢেকে আছে বটবৃক্ষসম অতিকায় প্রাচীন কিছু বৃক্ষে, আর দ্বীপের অন্য ধারের স্বচ্ছ নীল জলে গা ভাসায় স্নান পিয়াসী জনেরা। এ অঞ্চল সম্পর্কে আপনার পান্ডিত্য আমাকে বরাবরই অভিভূত করে. (গোলাগুলির সে বইয়ের নামটি কি মনে আছে? আমি পড়তে ইচ্ছুক).

মিলো একজন ব্যক্তি বিশেষ নয়, সে এক দাবার ঘুটি মাত্র। এ পেছনের অলক্ষ্য ব্যক্তি যে কে, সেটি হয়তো সময়ই বলে দেবে।

তিরানায় এনভার হোজ্জার বাংকার নিয়ে একটা আলাদা লেখা লিখেছিলাম, কিন্তু সেটি আগেই একটি দৈনিকে প্রকাশিত হওয়ায় সচলে আর প্রকাশ করছি না. তবে সে লেখাটি এবং সচলে প্রকাশিত আগের লেখাগুলো নিয়ে এ বারের বইমেলায় আমার দুটো বই প্রকাশিত হয়েছে- 'বলকানের বারুদ' এবং 'আমেরিকার টুকরো গপ্পো' (পাললিক সৌরভ প্রকাশনী-স্টল নং ৪১২). বই দুটোর প্রচ্ছদ সংযুক্ত করে দিলাম।

অতিথি লেখক এর ছবি

আমি সাধারণত একসাথে চার/পাঁচটি বই পড়তে নেই যার মধ্যে একটা/দুইটা বই থাকে অগভীর। সেগুলোর নাম, লেখকের নাম, কাহিনী - কিছুই আর পরে মাথায় থাকে না। ঐ গোলাগুলির বইটা অমন একটা বই যার আর কিছু মনে নেই। সাধু নিকোলাসের দ্বীপের নাম মনে আছে ঐ বইটার অ্যানেকডোটের সাথে আড্রিয়াটিকের পূর্ব উপকূলের ইতিহাসের আরও কিছু অ্যানেকডোট আর গল্প মিলিয়ে।

আনোয়ার হোজ্জা'র (এনভার হোক্সা) বাংকার নিয়ে তিরানার গল্প শেষ করলে ক্যাম্নে কী! ছবি না থাকুক, তিরানার আরও গল্প করতে অসুবিধা কোথায়!

বই মেলায় যাবো না। মেলা শেষ হবার পর পাললিক সৌরভের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবো। (প্রচ্ছদের ছবি দেখতে পাচ্ছি না)

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

তিরানার আরো গল্প তবে লেখার কাজে হাত দিলাম। হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

অপেক্ষায় নাজির!

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

ধন্যবাদ নাজির

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

অতিথি লেখক,
এই ছবিটি আপনার জন্যে, সাধু নিকোলাস দ্বীপের একাংশ

অতিথি লেখক এর ছবি

অসংখ্য ধন্যবাদ! পাথরের দ্বিতীয় চাঙড়টাতে বসে পাহাড় আর সমুদ্র দেখে একটা গোটা দিন কাটিয়ে দেয়া যাবে।

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

যে স্থান থেকে ছবিটা তুলেছি সে স্থানে বসে আমিও পার করে দিয়েছিলাম বেশ কিছুটা সময়.

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

খবরে পড়লাম থাকসিন সিনাওয়াত্রা নাকি এই দ্বীপ কিনে নিয়েছেন (এবং তার সুবাদে মন্টেনেগ্রো'র নাগরিক হয়েছেন)। ভাগ্যিস আগেভাগে ঘুরে এসেছেন, নয়তো এখন প্রাইভেট প্রপার্টি বলে আর ঢুকতে দিতো না।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

বহুদিন পরে এলেন! পাললিক সৌরভে যাব পরদিন। (প্রচ্ছদের ছবি দেখতে পাচ্ছি না)

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

ধন্যবাদ সাক্ষী। ছবিটা কেন আসছে না বুঝতে পারছি না, দেখি আবারো সংযুক্ত করার চেষ্টা করে

মেঘলা মানুষ এর ছবি

চমৎকার ছবি আর বর্ণনা!

শুভেচ্ছা হাসি

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

ধন্যবাদ মেঘলা মানুষ

জীবনযুদ্ধ এর ছবি
অতিথি লেখক এর ছবি

দুটো প্রচ্ছদই পছন্দ হয়েছে, বিশেষত বলকানের বারুদ। আমেরিকার টুকরো গপ্পো'র প্রচ্ছদে আরেকটু উজ্জ্বল রঙ ব্যবহার করলে মনে হয় আরও ভালো হতো। প্রচ্ছদ শিল্পী কে? তাঁকে (বা তাঁদেরকে) আমার শুভেচ্ছা জানাবেন।

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

জানাবো অবশ্যই
আমেরিকার টুকরো গপ্পের প্রচ্ছদ শিল্পী- কাব্য কারীম
বলকানের বারুদের প্রচ্ছদ শিল্পী- আরাফাত করিম

আয়নামতি এর ছবি

হৈ হৈ করে আনন্দের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন আর নাম রাখা হয়েছে জীবনযুদ্ধ। এইটা কিছু হইল! খাইছে

*
আপনার লেখা দারুণ সাবলীল। এতদীর্ঘ একটা লেখা, পড়বার আগে কিঞ্চিৎ দ্বিধা ছিল, শেষ করতে গিয়ে খিদে লেগে যাবে ভেবে।
পড়তে গিয়ে খাবার কথা ভুলে গেছি ভ্রাত! আর ছবিগুলোও দারুণ ঝকঝকে।
*
এই আইফোন উইফোনের যুগে ইতালীয় শুভ্রবসনা বন্ধুদের হারিয়ে বিড়ি ফুঁকছে, কেমন কথা! আসলে সে ভীড়ের মাঝে একলা হবার ছুতোয় এমন করেছে হয়ত। দেঁতো হাসি

*
কোটর শহরের প্রবেশ দরজায় লেখাটা মনে হয় বহিঃশত্রুদের সাবধান করে দেবার জন্য, 'ঢিলটি মারিলে পাটকেলটি খাইতে হইবে'র ভদ্র সংস্করণ- ঠিক না!

আপনার বইয়ের শেষ প্রচ্ছদের লেখা আমি প্রথমে পড়েছি, আম টুকরোর গপ্পো! খাইছে
আরো লেখা আসুক ভ্রাত। হাসি

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

আমিও লিখবার আগে ভেবেছিলাম একটু দীর্ঘ হয়ে গেলো না তো? কিন্তু যা বলতে চাই, ততটুকু বলতে গেলে এর চেয়ে কম লিখলেও চলে না, তাই কলমকেও আর থামাই নি (মানে কি-বোর্ডকে আরকি).

ঠিক, হয়তো মেয়েটি কিছুটা সময়ের জন্যে নিরালার প্রত্যাশাতেই ছিল, আর সেই মাহেন্দ্রক্ষণেই হয়তো তাঁর সাথে আমার সাক্ষাৎ। হাসি

কোটর শহরের ওই কথাটি এক অর্থে ছিলো টিটোর নীতির সাথে সামঞ্জস্য পূর্ণ একটি বাণী, দেশ চালাবার ক্ষেত্রে এই ছিল মার্শালের নীতি। যে কারণে পাঁচ দশকের শাসনামলে তাঁকে খুব বেশি টলানো যায়নি।

অনেক ধন্যবাদ আপনাকে

সোহেল ইমাম এর ছবি

সময় পাচ্ছিলামনা একেবারেই। আবার আপনার লেখা পড়ার জন্য ছটফটানিটাও আছে। অফিসের সময় চুরি করে পড়ে ফেললাম। আপনার বই গুলো সংগ্রহ করে ফেলার ইচ্ছে আছে, আমার দোকানদারটাকে বলে রাখতে হবে। প্রচ্ছদ দু’টো দেখে ভালো লাগলো।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ সোহেল ভাই, পাঠপ্রতিক্রিয়া জানার অপেক্ষায় রইলাম।

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

ভালো লাগলো লেখাটা।
লেখাটা পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিলো, এইতো বাড়ির পাশেই জায়গাটা, তবু কখনো যাওয়া হয়ে উঠলো না!
কখনো বাল্টিকের মায়ায় লিখতে এদিকে এলে জানাবেন। এক কাপ কফি খাওয়া যাবে বসে হাসি

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

বালটিকের মায়ায় ওদিকে যাবার ইচ্ছে আছে, তবে আপনার ঠিকানা পাবো কোথায় সেটি-ই তো হল এক প্রশ্ন। এখানে একটু ঠিকানাটা দিয়ে রাখতে পারেন- https://www.facebook.com/sxdey

অবনীল এর ছবি

আহ। তিরানা! গিয়েছিলাম। ২০১৪ সালের অক্টোবরে দিন পাচেকের জন্য। বেশী ঘুরোঘুরির সুযোগ হয়নি কিন্তু যেটুকু দেখেছি তাতেই ভালো লেগে গেছে। ছিমছাম, শান্ত শহর। মাঝে মাঝে দারিদ্রতার চিহ্ন চোখে পড়ে, ওগুলো বাদ দিয়ে প্রাচীন স্থাপত্য আর আলবেনিয়ান রেড ওয়াইন , চা আর বন্ধুবৎসল মানুষদের কথা বার বার মনে পড়ে। আবার যেতে চাই। হয়তো হবে একদিন।

___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

আপনার সেই স্মৃতিগুলো নিয়ে ও কিছু লিখুন না !

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।