করফু দ্বীপের কল্লোল

জীবনযুদ্ধ এর ছবি
লিখেছেন জীবনযুদ্ধ [অতিথি] (তারিখ: বুধ, ২৮/০৭/২০২১ - ১১:১৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকা প্রশস্ত ধাপের সিঁড়ি। শ্বেত পাথরের। শতাব্দীর প্রবঞ্চনায় এখন আর ওগুলো শ্বেত নেই অবশ্য। ধূসর। দুপাশ থেকে বৃক্ষমঞ্জরির শাখা নেমে এসে জাপটে ধরতে চেয়েছে সিঁড়ির সবগুলোকে ধাপকে। দু এক জায়গায় আবার পাহাড়ের ধূমল মৃত্তিকা প্লাবন ধারায় ভাসিয়ে দিয়েছে সিঁড়ির জমিন। আর তাই আয়তনের দিক থেকে মেলা জায়গা জুড়ে থাকলেও সিঁড়ির বুকে পা ফেলার স্থান কিন্তু তেমন একটা নেই। সেটুকু অসুবিধে মেনে নিয়েই লম্বা লম্বা ধাপ পেরিয়ে যখন পাহাড়ের চুড়োয় পৌঁছি, তখন দেখি– বেশ কিছু চেয়ার-টেবিল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে একটি ক্যাফে কেবল সকালের পয়লা কাস্টোমার ধরার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে। উনুনে বসানো হয়েছে জল গরম করার যন্ত্র। জলের বাষ্প পাঁক খেয়ে ক্যাফের ছাদের যে অংশের দিকে ধেয়ে যায়, সেখানে ছোট্ট একটি টানানো সাইনবোর্ডে লেখা– স্থাপিত ১৮৬৯।

আমি পাহাড়ের ধারে রেলিং দিয়ে ঘেরা একটা স্থানে ফাঁকা টেবিল বেছে নিয়ে বসি। অবশ্য এ-বেলায় সবগুলো টেবিল-ই ফাঁকা। যেকোনো একটিতে বসলেই হত। কিন্তু বহু নিচের দৃশ্যাবলীর একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ খুঁজে পাবার লোভে এই টেবিলটির চেয়ে যোগ্য আর কোনো স্থান বোধহয় আর নেই। সে অর্থে ভাগ্যবান আমি। অন্তত সকালের এই বিশেষ সময়টিতে।

খানিক আগে পাহাড়ের সিঁড়ি বাইবার সময়ে খানিকটা হাঁসফাঁস লাগছিল। মুখে কাপড়ের ঠুলি আঁটা থাকায়। একবার ভেবেছিলাম– খুলে ফেলি। কিন্তু পরে দেখলাম, বহু দূরে যে ধীবর একাকী নিভৃতে বসে মাছ ধরছে, তার মুখেও ঠুলি আঁটা। অর্থাৎ, এখানে সবাই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাহলে আমিই-বা আইনভঙ্গকারী হব কেন? তবে এখানে যেহেতু মুখে তুলে নিতে হবে পানীয়, তাই অনুমান করি– ক্যাফের এই সীমানায় হয়তো মাস্ক-বিষয়ক আইনটি প্রযোজ্য নয়। আমি তাই মাস্কটি খুলে টেবিলে রাখি। পাশেই পড়ে থাকে জীবাণুনাশকের স্বচ্ছ বোতল। ভেতরে তুঁতরঙা তরল। শুধু এ টেবিলেই নয়, প্রতিটি টেবিলেই একটি করে রাখা। বিশ্বব্যাপী যে অতিমারির তাণ্ডব চলছে, তাতে করে বাড়তি সতর্কতা হিসেবে এমন ব্যাবস্থা না করেই বা উপায় কি?

আমাকে দেখে ওয়েটার মেয়েটি এগিয়ে আসে। মেন্যু কার্ডটি এগিয়ে দেবার আগেই আমি ঝটপট এক কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে দিই। তারপর রেলিঙয়ে ঝুঁকে পড়ে বহু নিচের দৃশ্যাবলী দেখায় মন দিই।

গ্রীসের করফু দ্বীপে এসে পৌঁছেছি গতকাল। অনেক অনিশ্চয়তার পর এই যাত্রা। এর আগের দেড়টি বছর জুড়ে একপ্রকার অন্তরীণ অবস্থা কাটাবার পর মন চাইছিল মুক্তি, চাইছিল জনমানুষের সান্নিধ্য। বহুকাল জেলখানায় কাটাবার পর কয়েদিদের যেমনটা হয়, তেমন। বিষণ্ণতার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে তাই দিন গুনছিলাম– কবে আবার খানিকটা নির্ভার হয়ে পৃথিবীর পথে হাঁটা সম্ভব হবে। পত্রিকায় পাতায় চোখ রাখি। খুঁজে ফিরি সংবাদ। আমেরিকা-নিবাসীদের জন্যে কোনো দেশ তাদের দোর খুলে দিচ্ছে কি? অবশেষে মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে আচমকাই একটি সংবাদ নজরে এল– যেহেতু আমেরিকায় ভ্যাক্সিনের সফল প্রয়োগের ফলে সংক্রমণ অনেকটাই কমে এসেছে, তাই গ্রীস তাদেরকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। শর্ত হল– দু ডোজ ভ্যাক্সিন নেবার প্রমাণ দেখাতে হবে। হুররে বলে চেঁচিয়ে উঠলাম। সেই কবে ফেব্রুয়ারি মাসেই তো ভ্যাক্সিন নিয়ে বসে আছি। প্রমাণপত্রের কার্ডটা অবহেলায় পড়ে আছে পড়ার টেবিলের এক কোণে। ওটা দেখিয়েই যদি গ্রীসের সৈকতে পৌঁছা যায়, তবে আর বিলম্ব করে কী লাভ!

তবে হ্যাঁ, তারপরও শঙ্কা ছিল। এখনও তো পৃথিবী থেকে অতিমারি দূর হয়ে যায়নি। কবে হবে, তারও কোনো সঠিক দিনক্ষণ নেই। হয়তো আরও দু একবছর এমন অবস্থার মাঝেই পৃথিবীকে চলতে হবে। আর তেমনটা হলে, কোনো দেশই স্থিরসিদ্ধান্তে অবিচল থাকতে পারবে না। হয়তো আজ পরিস্থিতি ভালো; কিন্তু কয়েক সপ্তাহ বাদেই যে পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নেবে না, তার কি নিশ্চয়তা? এমন বেশ কিছু ঘটনা করোনা সংক্রমণের প্রথম বছরে ঘটেছে। এমন হয়েছে যে, কোনো দেশ পরিস্থিতি নিরাপদ ভেবে নীতিমালা কিছুটা শিথিল করেছে, তার কিছুদিন বাদেই করোনা ক্রুদ্ধ আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়েছে সেখানে। তারপর আবারও সেই একই শোকগাথার পুনরাবৃত্তি। তাই মনে মনে নানা হিসেব কষে ভাবলাম, এই বেলাতেই ঘুরে আসা ভাল। অন্তত যতদিন গ্রীসে পরিস্থিতি খানিকটা অনুকূল।

শেঞ্জেনভুক্ত যেকোনো দেশে যাবার প্রাক্কালে এই বলয়ের যে-দেশটিতে প্রথম যাত্রাবিরতি থাকবে, সেখানেই ইমিগ্রেসনের যাবতীয় কার্যাদি সম্পাদন হয়। যেমন, আমেরিকা থেকে জার্মানি যাবার কালে যদি আইসল্যান্ডে থেমে আমাকে প্লেন পাল্টাতে হয়, তাহলে আইসল্যান্ডের ইমিগ্রেসন পুলিশ আমার পাসপোর্টে সিলছাপ্পর মেরে বলবেন– ইউরোপে স্বাগতম। সেখানেই যদি আমি নেমে পড়ি, তবুও কোনো সমস্যা নেই। সেইভাবেই গ্রীসে যাবার পথে ইমিগ্রেসন পুলিশের মুখোমুখি হলাম আমস্টারডামে। তবে আগেরকার মত চাইলেই এখানে নেমে পড়া সম্ভব নয়। কারণ গোটা ইউরোপ-এ একমাত্র গ্রীস, সাইপ্রাস আর আইসল্যান্ড ভিন্ন আর কোনো দেশই এখন পর্যন্ত পর্যটকদের আমন্ত্রণ জানাবার সাহস করে উঠতে পারেনি। এই তিনটি দেশের-ও সাহস করে এগিয়ে আসার পেছনে কারণ আছে। এদের সবার জাতীয় অর্থনীতি পর্যটনের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। যেমন, গ্রীসের ক্ষেত্রে ওদের জাতীয় আয়ের শতকরা বিশ ভাগই আসে এ-খাত থেকে। কাজেই দীর্ঘকাল পর্যটন বন্ধ করে বসে থাকলে করোনায় না মরলেও দারিদ্র্যের হাতে মরতে হবে।

নেদারল্যান্ড অবশ্য ধনী দেশ। তাদের আরও কিছুদিন হয়তো এভাবে রুদ্ধদ্বার পরিস্থিতিতে কাটাবার মত সঞ্চয় কোষাগারে আছে। এখানে তাই পুলিশের কড়া নজর– গ্রীসে যাবার নাম করে কেও আবার হুট করে শিফল এয়ারপোর্টের বহির্গমন দিয়ে বেরিয়ে না যায়!

আমস্টারডাম থেকে এথেন্স। সেখান থেকে আবার ঘণ্টাখানেক বাদের প্লেনে করফু দ্বীপে। দীর্ঘ যাত্রাপথ। এতোটুকু সময়ে হয়তো আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে পৌঁছে যাওয়া যায়। দ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তের হোটেলটিতে গতরাতে এসে তাই দীর্ঘ ঘুমে এলিয়ে পড়া ছাড়া গত্যান্তর ছিল না। সেই ঘুম ভেঙেছে আজ বেশ সকালের দিকে। মোরগের ডাকে।

হোটেলটির মালিক এলেক্স। পৈত্রিকসূত্রে এই হোটেল ব্যাবসাটি বুঝে পেয়েছেন। বাবা অবশ্য গত হয়েছেন কয়েক বছর আগে। এখন মা আর বৌকে নিয়ে এই হোটেল সামলান। এরই একদিকে পরিবার নিয়ে থাকেন।

হোটেলটি ঠিক শহুরে হোটেলের মত বহুতলবিশিষ্ট নয়। ঢোকার মুখেই দ্বিতল একটি বাড়ি। পেছনের দিকে উঠোন। ডান দিকে সাঁতার কাটার পুকুর। আর তার বাদে দুটো একচালা ঘর। ছাদে টালি। সামনে টুকরো বারান্দা। সেখানে কাপড় শুকোবার র‍্যাক। বসবার জন্যে একটা ছোট্ট টেবিল। দুটো ধাতব চেয়ার। এই যে পেছনের দিককার দুটি ঘর, এরই একটিতে অ্যালেক্স আমার থাকার বন্দোবস্ত করেছে।

ঘরটির পাশে একটুকরো জমিন। সেখানে অ্যালেক্সদের পোষা একদল মোরগ-মুরগি চড়ে বেড়ায়। আজ সকালে আমার ঘুম ভাঙিয়েছে এরাই।

অ্যালেক্সের বয়স হয়তো মধ্য চল্লিশ। গায়ের রঙ উজ্জ্বল গৌড়বর্ণ। মাথার চুল অনেকটাই উবে গেছে। স্নেহজাতীয় পদার্থের আধিক্য মুখায়বে স্পষ্ট। মুখটিতে সর্বদাই লেগে আছে এক টুকরো সুখি-সুখি হাসি। সাত সকালে আমাকে উঠোন পেরিয়ে আসতে দেখে নিজের ছোট্ট অফিস থেকে ছুটে এসে বললেন, ‘কালিমেরা, কালিমেরা’। অর্থাৎ– শুভ সকাল। এটুকু বলার মাঝেই করমর্দনের জন্যে হাত বাড়িয়ে দিলেন। তৎক্ষণাৎ অবশ্য নিজের ভুল বুঝতে পেরে বাড়িয়ে দেয়া হাতখানা মুষ্টিবদ্ধ করে আমার মুষ্টির সাথে ঠোকাঠুকির জন্যে বাড়িয়ে দিলেন। সর্বনাশা করোনা কতো কেতাকেই না ধীরে ধীরে বদলে ফেলছে!

হোটেলের প্রাতরাশের ঘরটা একটা হল ঘরের মত। দুদিকেই কাচের দেয়াল। সেগুলো আবার জানালার পাল্লার মত করে ভাঁজ করে রাখা। ফলে সকালের মিঠে রোদের সাথে সেখানে হু হু করে ঢুকে পড়ে সাগর থেকে ছুটে আসা সমুদ্রবায়ু। সে বায়ুতে স্নান করে টোস্টে মাখন লাগাবার সময়ে কোথা থেকে এক হুলো বেড়াল এসে জুটে যায়। ওটি আমার পায়ের কাছে এসে মিউ মিউ করে। কি জ্বালা! টোস্ট কি আমি খাব? নাকি তোকে দেব? এ নিশ্চয়ই অ্যালেক্সের পোষা বেড়াল। তাই এখানে এসে দুষ্টুমি করার জন্যে জোরে যে একটা ধমক লাগাবো, সেটি করতেও সংকোচ হচ্ছে। আমার এই করুণ মুহূর্তে আবারও হাজির হয় অ্যালেক্স। সকালের দিক বলেই হয়তো অফিস ঘরে কাজ নেই। আর তাছাড়া হোটেলে অতিথির সমাগমও খুব একটা নেই। এই তো গতকালই ওর মুখ থেকে শুনছিলাম– গোটা গত বছরই ব্যাবসায় গেছে চূড়ান্ত মন্দা। অথচ করফু দ্বীপে করোনা পরিস্থিতি নাকি ভালোই ছিল। সপ্তাহে হয়তো দু একটি রুগী ধরা পড়েছে। কিন্তু তবুও সতর্কতা হিসেবে সরকার ভিনদেশী পর্যটকদের দ্বীপের কাছে ভিড়তে দেয়নি। সেটিকে খানিকটা বাড়াবাড়ি হিসেবে আখ্যায়িত করে অ্যালেক্স বলছিল– এভাবে আর কিছুদিন চললে ব্যাবসাপাতি সব লাটে উঠত। বছরখানেক আগেই ব্যাংক থেকে ঋণ কয়েকটা গাড়ি কিনলাম। ভাড়া দেব বলে। এর মাঝেই শুরু হল এসব। যাকগে, সবই নিয়তি। এ বছরটা এখন ভালোয় ভালোয় কাটলেই বাঁচি।

দূরের এক টেবিলে থাকা ওয়াটার স্প্রেয়ার নিয়ে অ্যালেক্স বিড়ালটাকে পিছু ধাওয়া করে। গায়ে জলের ঝাঁপটা লাগতেই ওটিও নিমিষেই দৌড়ে পালায়। পলায়নের এই দৃশ্য দেখে অ্যালেক্স বুড়োদের মত খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসে। তারপর আমার টেবিলের কাছে এসে বলে– ‘তা, আজ সকালে কোথায় যাবে ভাবছ?’

সত্যি বলতে কি, আমি কিছুই ভাবিনি। ভাবার মত অবকাশও খুব একটা ছিল না। কারণ আর সব বারের মত তো আর এবারের ভ্রমণ নয়। এবারে শঙ্কা ছিল, যদি যাবার আগের দিন করে নেয়া করোনার টেস্টে পজিটিভ রিপোর্ট আসে? যদি কোনো কারণে ডাচ বিমানসংস্থা করোনা-সংক্রান্ত নতুন কোনো নিয়মের ছুতো দেখিয়ে বোর্ডিং কার্ড দিতে অস্বীকৃত জানায়? তবে? সেকারণেই খুব একটা পূর্ব পরিকল্পনা করে এবারের যাত্রায় আসা হয়নি।

ঠিক জানি না। তোমার কোনো সাজেশন আছে?’– অরেঞ্জ জুসের গ্লাসটা হাতে নেবার সময়ে বলি।

‘উমম, আজ তো রবিবার। রবিবারে এক ক্যাচাল।’– এটুকু বলে ও থামে। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় সোমবারে নানা জাদুঘর, দর্শনীয় স্থান বন্ধ থাকে বলে শুনেছি। তবে কি এখানে রবিবারে সেসব বন্ধ? সেকারণেই অ্যালেক্স ক্যাচালের কথা বলছে?

‘আমাদের এটা দ্বীপ। মানুষজন কম। এথেন্সের মত এখানে মিনিটে-মিনিটে বাস পাবে না। হয়তো ঘণ্টায় একটা। তায় আবার রবিবারের দিন সেটা হয়ে যায় কয়েক ঘণ্টায় একটা।’

আমি প্রমাদ গুনি। এ-দ্বীপে যে বাস-ট্রামের অবস্থা সুবিধের নয়, সেটা গতকাল এয়ারপোর্টে নেমেই বুঝেছি। চারদিকে সুনসান। কেবল দু চারটে লজ-ভিলার লোকেরা তাদের গাড়িতে বোর্ডারদের তুলে নিতে এসেছে। উপায়ান্তর না দেখে আমাকেও অ্যালেক্সকে ফোন করে সাহায্য চাইতে হয়েছিল।

এয়ারপোর্টের প্রসঙ্গ আসায় ও নিয়ে দুটো কথা বলি। বিমানের টিকেট কাটার সময়ে আমি করফু এয়ারপোর্ট নামে সার্চ করি। কিন্তু পৃথিবীর কোথাও এ-নামে কোন এয়ারপোর্ট নেই। তবে কি এই দ্বীপে বিমানপোতে যাবার কোনো ব্যবস্থাই নেই? কিন্তু সেটিও তো হবার কথা নয়। গ্রীসের প্রখ্যাত দ্বীপ হিসেবে যাদের কথা উঠে আসে, সেই সান্তরিনি, ক্রিট, মাইকনাস, রোডস– তাদের সাথেই একই কাতারে আসে করফুর নাম। এ দ্বীপে বিমানবন্দর থাকবে না, সেটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। পরে আরও খানিকটা খোঁজ করে বুঝলাম, এখানকার এয়ারপোর্টের নাম– কেরকিরাস এয়ারপোর্ট। কেরকিরাস করফু দ্বীপেরই আরেকটি নাম। স্থানীয় নাম।

এয়ারপোর্টটি বেশ চমৎকার। একদিকে আগ্নেয় শিলায় ঢাকা পাহাড়, অন্যদিকে সাগর। রানওয়ের কোণে কয়েকটি সিঙ্গেল ইঞ্জিনের শৌখিন বিমান পার্ক করে রাখা। আমি নিশ্চিত– এগুলো হয়তো ধনী পর্যটকদের লনিয়ান সাগরে উড়িয়ে নিয়ে নীল জল দর্শনের বন্দোবস্ত করে দেয়। তবে এই করোনাকালীন মন্দার সময়ে প্লেনগুলো অলস হয়ে কিছুদিনের জন্যে ঝিমিয়ে নিচ্ছে হয়তো।

‘তুমি বরং এক কাজ কর। আগে ভ্লাসারনা মঠটা দেখে এসো। এই এখানেই ওটা। হাঁটা পথ। হোটেল থেকে বেরিয়ে ডানে যাবে। একটু হাঁটলেই দেখবে নিসোস নামের এক রেস্তোরাঁ। ওর পাশ দিয়ে ঢালু পথ। ও পথে গেলেই পেয়ে যাবে মঠটা।’– আমাকে খানিকক্ষণ ভাবতে দেখে অ্যালেক্স বলে।

‘সে না হয় গেলাম। তারপর? পুরো দিনটাই কি এভাবে ফ্যা ফ্যা করে আশেপাশে হেঁটে বেড়াবো?’– অ্যালেক্সের একটা স্বভাব হল দাঁড়িয়ে কথা বলার সময়ে ও অনবরত এক হাতের মুষ্টি দিয়ে আরেক হাতের মুষ্টিতে ঘুসি মারে। আমার এই প্রশ্নটি ছুঁড়ে দেবার সময়ে ব্যাপারটা খেয়াল করি।

‘ওখান থেকে ফিরে এসে চাইলে আমার ভাড়ার গাড়িটা নিয়ে আখিলিয়ন প্যালেসে যেতে পার। যাওয়া আর আসা মিলিয়ে তোমাকে বিশ ইউরো চার্জ করবো।’

‘দেখা যাক, আগে এই কাছের মঠটা থেকে ঘুরে আসি।’– বিশ ইউরো একটু বেশিই মনে হচ্ছে। তাই পরিস্থিতি দেখে পরে সিদ্ধান্ত নেব বলে ঠিক করি।

হোটেলের ঠিক উল্টোদিকেই কিন্তু একটি বাসস্টপের ছাউনি। লোহার একটি বেঞ্চ। পেছনের দিকটাতে অনেকগুলো কচি বাঁশের ঝাড়। ভ্রম হয়– যেন ইক্ষু দণ্ড। হাওয়ায় ক্রমাগত দুলছে। নবীন সবুজ পাতাগুলো আদর বুলিয়ে দিচ্ছে বেঞ্চের হাতলে। ছাউনিতে কেও নেই। নেই বাসের সময়সূচী লেখা কোনো নোটিশ। তাই পরের বাসটি কি দু মিনিট পরে এসে দাঁড়াবে, নাকি দু ঘণ্টা পর, সেটি বোঝারও কোনো উপায় নেই।

আমি সে-চেষ্টায় প্রাণপাত না করে নিসোস রেস্তোরাঁর দিকে হাঁটতে থাকি। রাস্তাটি ক্রমশ একটি পাহাড়ের দিকে ধেয়ে যায়। অনতিদূরে তীক্ষ্ণ বাঁক। বাঁকের কোণেই রেস্তোরাঁটি। পথের পাশে বিশাল নোটিশ বোর্ড। সেখানে খাবারের ছবি আর পদের মূল্য। দামের উপর নজর বুলিয়েই বলে দেয়া যায়– এটি মালদার আদমিদের জায়গা। সেটি হবার অবশ্য কারণও আছে। এর তেতলের ছাদ, যেখানে বসবার ব্যাবস্থা, সেখান থেকে বেশ একটা জম্পেশ ভিউ পাওয়া যায়। সেদিকে তাকিয়ে দেখি, ছাদে পেতে রাখা সবগুলো চেয়ার খালি। হাওয়ায় দুলছে টেবিলে পেতে রাখা সফেদ কাপড়। আমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে রেলিঙের ধারে দৌড়ে আসে ম্যানেজার। ‘প্লিজ আসুন না আমাদের রেস্তোরাঁয়। ভালো অক্টোপাস আছে। ভেজে খাওয়াব।’ আমি ‘সকালের খাওয়া মাত্র খেলাম, দুপুরে লাঞ্চের সময়ে আপনার এখানকার কথা ভেবে দেখব’– বলে দ্রুত সেখান থেকে কেটে পড়ি।

মঠাভিমুখী ঢালু পথটির দু ধারে অল্প কয়েকটি বাড়ি। সামনে প্রশস্ত বাগান। সেখানে নানা জাতের ফলদ উদ্ভিদ। বাগান থেকে ভেতর বাড়ি অবধি চলে গেছে বাঁধানো বাগানপথ। এ বাড়িগুলোর সীমানাপাঁচিল টপকে উঁকি মারছে জেসমিন ফুলের ঝাঁক। সবুজ পাতা উপচে সাদা ফুল মৌতাত ছড়াচ্ছে। ফুলের এই উন্মাতাল ঘ্রাণ ডেকে এনেছে রাজ্যের মৌমাছিকে। তাদের দু চারটে দলছুট হয়ে এসে আমার মাথার চারদিকে বনবন করে ঘোরে। দু পাশের এই বাড়িগুলো বেশ সুনসান। তেমন একটি বাড়ির বারান্দায় এক বুড়ি বসে আছেন। কুরুশ দিয়ে সোয়েটার বুনছেন। এই ঘোর গ্রীষ্মে তিনি হয়তো শীতের অপেক্ষায় দিন গুনছেন। আমাকে দেখে খানিকটা মুখ তুলে চেয়ে আবারও উলের সুতো বোনায় মন দেন। এর দুটি বাড়ি পরের বাড়িটি বেশ অদ্ভুত। হলদে বিবর্ণ বাড়িটিতে খড়খড়ি দেয়া জানালা। দোতলার ঝুল বারান্দাটি এখনও অটুট। নিচতলার মূল দরজাটি হাট করে খোলা। কিন্তু তাই বলে ভেতরে ঢুকে যাবার জো নেই। সাদা অপরাজিতার গাছ বিপুল পত্রালীসহ সে পথ আগলে আছে। যেন প্রহরী। ওদিকে পুরো বাড়িটাকেই যেন গিলে খাচ্ছে পেঁচিয়ে আসা লতাগুল্ম। জানালার ফাঁকা স্থান দিয়ে ঢুকে পড়েছে অন্দরমহলে। সাগরের এতো কাছে এমন এক মোক্ষম স্থানে এই পোড়ো বাড়িটি দেখে মনে খেয়াল জাগে, এটিকে বেশ কম দামে কিনে নিয়ে সংস্কার করে কিছুদিন কাটিয়ে গেলে কেমন হয়?

পায়ে চলা পথটির একেবারে শেষ প্রান্তে উঁচু ঘাসের অরণ্যে প্লাবিত নিচু ভূমি। মাঝের একটি ডুমুর গাছের কাণ্ডে নোটিস আঁটা – ‘এই জমি বিক্রয় হইবে।’ ঘেমে নেয়া ওঠা এক কৃষক জমির ঘাস কাটার জোগাড়যন্ত্র করছেন। তার যন্ত্রটিতে বুঝি তেল ফুরিয়েছে। জ্যারিকেন থেকে তেল ঢেলে নিয়ে তিনি ঘাস কাটার যন্ত্রটি বিকট শব্দে চালু করেন। এমন শান্ত স্নিগ্ধ একটা পরিবেশ সেই শব্দে যেন কাচের আয়নার মত ঝনঝন করে ভেঙে পড়ে।

এখান থেকেই সমুদ্র শুরু। আসলে এটি মূল সমুদ্র নয়। বরং সমুদ্র থেকে ছিটকে আসা খাড়ি। তাই এখানে উন্মাতাল ঢেউ নেই। ঝিমিয়ে থাকা মন্থর হ্রদের মতই এখানকার জল আক্রোশবিহীন। খুব মৃদু শব্দে একেকটি ঢেউ তীরের নুড়িগুলোকে ভিজিয়ে দিচ্ছে কেবল। সেখানে দাঁড়িয়েই আমি মঠটিকে দেখতে পাই। তবে সেটি কিন্তু এপারে নয়। ওপারে।

এপার থেকে ওপারের মাঝে কংক্রিটের ব্যারাজ। একটু দূরে জলের মাঝে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত জেগে আছে কংক্রিটের আরেকটি পাটাতন। হটাত দেখলে মনে হয়– যেন একটি সেতু নির্মাণ করতে গিয়েও কোনো কারণে কাজ শেষ করা হয়নি। শ্রমিকরা সব কাজ ফেলে পালিয়েছে। কেবল রয়ে গেছে নির্মাণপর্বের প্রাথমিক সাক্ষীখানি। কিন্তু তাই যদি হবে, তাহলে এর গায়ে সারি সারি বাতি কেন? আর সেই বাতিগুলো সূর্যমুখী ফুলের মত কেনই বা আকাশের দিকে মুখ করে তাকিয়ে আছে? রাতের আকাশ অভিমুখে খামোখা আলোকসম্পাত করে-ই বা কি লাভ?

লাভ লোকসানের হিসাবটা বুঝি যখন আমার বাঁ পাশ থেকে চারদিকের পাহাড়গুলোকে প্রকম্পিত করে এক দানবীয় আওয়াজ ভেসে আসে। ওদিকটার পানে চেয়ে আমি একেবারে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যাই।

টুই এয়ারলাইন্সের বিশাল নীল এয়ারবাস প্লেনটি আমার ঠিক বাঁ দিকের রানওয়েতে দাঁড়িয়ে। পাগলা ষাঁড় যেমন দৌড়োবার আগে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে মাটিতে পা দাপায়, ঠিক তেমনি এই বিমানটিও ফাইনাল রান শুরু করার আগে দু পাশের দু ইঞ্জিন কাজে লাগিয়ে পেছনে ধুলোর ঝড় তুলেছে। ইঞ্জিনের হাওয়ার দমকে সাগরের জলেও তৈরি হয় ক্ষণিকের মাতম। তারপর হুট করেই যেন বিমানটি ছুট লাগায় সম্মুখস্থিত পাহাড়ের পানে। দেখে মনে হয়– পাহাড়ের গায়ে আছড়ে পড়বে এর নাক। কিন্তু না, সেই দুর্ঘটনা ঘটার আগেই কৌশলী পাইলট হয়তো থ্রাসট বাড়িয়ে বিমানটিকে আরও ঊর্ধ্বমুখী করে পাহাড়ের শীর্ষদেশ প্রায় ছুঁয়ে পালিয়ে যান। তিনদিকে ঘিরে থাকা শৈলশ্রেণী সেই পলায়নদৃশ্যকে দ্রুত আড়াল করে ফেলে।

এবারে আমি বুঝি, ডান ধারে জেগে থাকা সেই একফালি কংক্রিটের স্থাপনার রহস্য। ওগুলো আসলে সার্চ লাইট। রাতের বিমানগুলোকে রানওয়ের নিশানা দেখিয়ে দেবার জন্যে। এ ছাড়া উপায়ও নেই। কারণ এই রানওয়েটি যেন গড়া হয়েছে সাগরের মাঝ থেকে এক খণ্ড ভূমিকে জাগিয়ে তুলে। তিন ধারেই জল। একটু বেশি বা কম দৌড়ুলেই বিমানকে সে-জলে আছড়ে পড়তে হবে। আর সে কারণেই ইউরোপের দশটি ব্যাতিক্রমি বিমান বন্দরের এটি একটি।

এবারে সেই সরু ব্যরাজটির উপর হাঁটতে থাকি। ওপার থেকে ভ্যাস্পা মোটরসাইকেল চালিয়ে একজন এগিয়ে এলে আমাকে কিছুটা সাইড দিতে হয়। ওটি চলে যাবার পর দেখি, দু বন্ধু মনোযোগ দিয়ে ছিপ ফেলে বসে আছেন। মাথায় হ্যাট, মুখে চুরুট। ষাটের আশেপাশে বয়স। খুব সম্ভবত শখের মৎস্যশিকারি। তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে খানিকটা গলা বাড়িয়ে ঝুঁকে দেখি, তাদের একজনের ছিপে টোপ হিসেবে আটকে থাকা চিংড়িখানি ডুবে আছে ব্যারাজের দেয়াল ঘেঁষে পড়ে থাকা ডুবো পাথরের ভাঁজে। আর তাকে গিলে খেতে খুব ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে সবুজাভ খোলের বিশাল এক কাঁকড়া। যেই না কাঁকড়াটি সামনের দুটো হাতকে সাঁড়াশির মত বাগিয়ে এগিয়ে আসে, ওমনি মৎস্যশিকারি ফিশিং নেটটি জলে ডুবিয়ে ওটিকে ধরাশায়ী করে ফেলেন। স্বচ্ছ জল হওয়ায় এর নিচের পুরো দৃশ্যটাই আমি একুরিয়ামের কাচের বাইরে থেকে দেখার মত করে দেখতে পারছি।

ব্যারাজের অপর প্রান্তেই সেই মঠটি। একটু ডানে। অনেকটা যেন জলের মাঝে ভেসে আছে। তীর থেকে সেখানে যেতে হলে একটা সাঁকো পেরোতে হয়। সাঁকোর একধারে খুঁটি ধরে লটকে আছে কয়েকটি ইঞ্জিনচালিত নৌকো। মাঝিরা চেয়ার পেতে গল্পগুজব করছে। দুএকজন টেবিল পেতে সদ্য ধরে আনা মাছ সাজিয়ে রাখছে। বিক্রির জন্যে।

তাঁদেরকে পাশ কাটিয়ে খানিকটা এগিয়ে দেখি, সাঁকো আগলে থাকা লোহার দরজাখানি শেকলবদ্ধ। আমাকে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মাঝিদের আড্ডা থেকে ঢ্যাঙ্গামত একজন এগিয়ে এসে বলেন, ‘এতো সক্কাল-সক্কাল মঠের দরজা খুলি না। তবে আপনি এসেছেন যখন, খুলে দিচ্ছি। একটু অপেক্ষা করুন। আমি ভেতরটা আগে একটু ঝাড়পোঁছ করে নিই।’

বুঝলাম, ইনি আসলে মাঝি নন, বরং মঠের তত্ত্বাবধায়ক।

এই ভ্লাসারনা মঠের উঠোনটি পাকা করা। চারধারে সীমানা প্রাচীর নেই। সেজন্যে আনমনে হাঁটলে সোজা সাগরের জলে গিয়ে ভাসতে হবে। প্রাচীরের আগল না থাকায় কয়েকটি কৃষ্ণকায়া সারস সহজেই জল থেকে উঠে এসে উঠোনে জিরিয়ে নিচ্ছে। তাদের চক্ষু মুদিত। আচরণে আলসে ভাব প্রকট। ওদিকে মঠের মূল প্রবেশদ্বারের মাথায় শ্বেতপাথরের ফলকে মঠের প্রতিষ্ঠাকাল উল্লেখ করে লেখা- ১৬৮৫। এই প্রবেশদ্বারের পার্শ্বস্থিত দেয়ালে শুয়েবসে জিরিয়ে নিচ্ছে এক বেড়াল দম্পতি। অসংখ্য ছানাপোনা সমেত। পেছনের সাইপ্রেস গাছ থেকে মাঝে মধ্যে তাদের মাথায় টুপ করে ঝরে পড়ছে গোলাকার ফল।

ঘণ্টাতোরণটির দিকে টাকাই। যেন একটি একহারা দেয়ালের কোটরে লুকিয়ে আছে তিনটি মাঝারি আকারের ধাতব ঘণ্টা। নিচের সারিতে দুটি। উপরে একটি। খুব সম্ভবত ব্রোঞ্জ নির্মিত। পৃথিবীর নানা দেশে খ্রিস্টধর্মের নানা মতের মঠ-গির্জায় ভিন্ন ভিন্ন ধরণের ঘণ্টা দেখা যায়। তাদের কোনটি স্থান পায় গির্জায় চুড়ায়, আবার কোনটি রক্ষিত থাকে গির্জার প্রাঙ্গণে নির্মিত মিনার আকৃতির কাঠামোতে। গ্রিক মঠগুলো কিন্তু তেমন নয়। এখানে ঘণ্টাগুলো ঝুলনো থাকে একটি দেয়ালে। সেই দেয়ালটি হতে পারে সীমানা দেয়াল, হতে পারে প্রবেশদ্বারের তোরণ। ক্যালিফোর্নিয়ায় যে স্প্যানিশ মঠগুলো দেখা যায়, তাদের সাথে এই গ্রিক মঠের এদিক থেকে কিছুটা মিল আছে। অবশ্য স্পেন আর গ্রিস তো ভৌগোলিকভাবে খুব দূরে নয়। কাজেই হতে পারে সেই একই স্থাপত্যরীতি ভূমধ্যসাগরের জল পাড়ি দিয়ে মেক্সিকো হয়ে গিয়ে পৌঁছেছে ক্যালিফোর্নিয়ার ধূসর প্রান্তরে।

‘এবারে ভেতরে আসতে পারেন।’– উঠোনের পাশে সাগরের জলকে থামিয়ে দেয়া বিশাল কয়েকটি পাথরের বোল্ডারের উপর দাঁড়িয়ে আছি, এ-সময়ে সেই ঢ্যাঙ্গামত লোকটি এসে ডাকেন। আমাকে মূল প্রার্থনাঘরের দরজা চিনিয়ে দিয়ে তিনি পাশের সুভ্যেনিরের দোকানের ঝাঁপি খোলেন। এ-কে ছাড়া আর কাওকে চোখে পড়ে না। তবে কি মঠটি যাজকবিহীন নিঃসঙ্গ এক উপাসনালয়?

প্রার্থনাঘরটি বেশ নিরাভরণ। এক চিলতে। বসবার মত কিছু নেই। ভক্তকে তার শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করতে হবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই। মূল বেদির পাশে কাঠের ফ্রেমে এককালে হয়তো কিছু ফ্রেস্কো আঁকা ছিল; কালের আবর্তনে আজ সেগুলো ধূসর। যেন আবছা জলছাপ।

খানিকটা গুমোট সে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আমি এবারে সাঁকোতে বেঁধে রাখা নৌকোগুলোর কাছে আসি।

‘যাবেন নাকি ওদিকটার দ্বীপে? যাওয়া-আসা মাত্র আড়াই ইউরো। আর একজন যাত্রী পেলেই নৌকা ছেড়ে দেব।’– এতক্ষণ যে মাঝিরা গুলতানি মারছিল, তাদের মধ্য থেকে বৃদ্ধ একজনের প্রশ্ন। রোদের তাপ খানিকটা বাড়ায় ইনি শার্টের উপরের বোতামগুলো খুলে ফেলেছেন। তামাটে খুলিতে আটকে থাকা একগুচ্ছ চুল হাওয়ায় উড়ছে। এদিকে আমি খানিকটা ইতস্তত করছি। এখান থেকে কিছুটা দূরে সাগরের মাঝে ছোট্ট একটা দ্বীপ দেখা যাচ্ছে বটে, কিন্তু সেখানে কেনই বা যাব?

‘এনাদার বিউটিফুল মনাস্তেরি।’– যেন মনের কথা আঁচ করতে পেরেই বুড়োর উত্তর। আমার তো আর কোনো তাড়া নেই। কাজেই বুড়োর নৌকায় চেপে দ্বীপে একটু পা ফেলে এলে তেমন কোনো ক্ষতি বোধহয় নেই। নীল জলকন্যার ছবিআঁকা ইঞ্জিনের পাশেই আমি বেশ আয়েশ করে বসি।

নীল জলের ঢেউকে সন্তর্পণে সরিয়ে দিয়ে নৌকাটি দুলে দুলে চলে দ্বীপের পানে। ‘এখানেই নামুন, আমি আধ ঘণ্টাখানেক বাদে এসে আবার নিয়ে যাবো।’– বলে মাঝি দ্বীপের এককোণে নামান। সেখানে পাথরে বাঁধাই করা একচিলতে জমিন। নৌকা ভিড়বার ঘাট। দ্বীপটিকে চারদিক থেকে ঢেকে রেখেছে সাইপ্রেস গাছের উঁচু শিখর। তাই একরত্তি দ্বীপের সবেধন নীলমণি পাহাড়ের মাথায় থাকা মঠটিকে এখান থেকে দেখার কোনো উপায় নেই। ওটির দর্শন পেতে হলে পাহাড় বাইতে হবে। আমি পাহাড় বাই।

মঠের আঙিনায় পৌঁছানোমাত্র একটা আদুরে কুকুর পায়ের কাছে এসে কুঁইকুঁই করে। গলায় বাঁধা বেল্টটি দেখে অনুমান করা যায়, এটি পোষা কুকুর। কিন্তু এমন নির্জন নিরালা দ্বীপে কুকুর এল কি করে? পরক্ষণে দেখি শিস শোনামাত্র কুকুরটি লেজ নাড়িয়ে মনিবের পানে ছুট লাগায়। যিনি মনিব, তিনি হয়তো এ দ্বীপের একমাত্র স্থায়ী নিবাসী। মঠের পাশে ছোট্ট দোকান খুলে বসে আছেন। বিক্রি করছেন কোক-ফানটা-জল আর মঠের ভেতরে পুণ্যার্থীদের জ্বালাবার জন্যে মোম। তবে এখানে তো আর তেমন একটা খদ্দের নেই; তাই দোকানটিকে হাট করে খোলা রেখেই তিনি পাহাড়ের প্রান্তের পাঁচিলে বসে কুকুরটির মাথায় হাত বুলিয়ে আদার করায় মন দেন।

এই মঠের ঘণ্টাদেয়ালে কিন্তু তিনটি ঘণ্টা নেই। উপরের সারির ঘণ্টাটি উধাও। কেবল নিচের দুটো আছে। তবে এর ভেতরটা বেশ আলোকিত। সিলিং-এর দিকে থাকা ছোট্ট জানালাগুলো দিয়ে গলগল করে রোদ এসে ভাসিয়ে দিয়েছে ভেতরটা। আর সেই আলোতে প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠেছে যিশুর ছবিতে থাকা সোনালি পটভূমি।

নিঃসঙ্গ যিশুকে পাইন আর সাইপ্রেস গাছের অবগুণ্ঠনে বন্দি সেই দ্বীপে ফেলে এসে আমি আবারও এসে পৌঁছাই পূর্বের তটে। আর সেখানেই পাহাড়ের গায়ে লেপটে থাকা কয়েক শ বছরের পুরনো সিঁড়িটি আবিষ্কার করে এসে পৌঁছাই এ ক্যাফেটিতে।

এ ক্যাফেটি সড়কের একেবারে শেষ প্রান্তে। এর বাদে আর কিছু নেই। আছে পাহাড়ের ঢাল। মানে যেখান দিয়ে আমি উঠে এসেছি কেবল। সেই ওয়েটার মেয়েটি বলছিল, এখান থেকেও নাকি করফু শহরের মূলকেন্দ্র, মানে যেটিকে ওরা ওল্ডটাউন বলে, সেখানে যাওয়া সম্ভব। দূরত্ব খুব বেশি নয়। তাহলে এখন আমি কোন দিকে যাব? কফিটা শেষ করে এ রাস্তা ধরে পুরনো শহরের পানে হাঁটব? নাকি হোটেলে ফিরে গিয়ে অ্যালেক্সের গাড়ি ভাড়া করে আখিলিয়ন প্রাসাদের দিকে যাব? সঠিক কোন জবাব খুঁজে না পেয়ে অবশেষে এক ইউরোর একটা কয়েন পকেট থেকে বার করে টস করি। কয়েন আমাকে প্রাসাদের দিকে ঠেলে দেয়।


মন্তব্য

তারেক অণু এর ছবি

করফু নিয়ে বাল্যকালে খুব আগ্রহ জেগেছিল জেরাল্ড ড্যারেলের করফু ট্রিলজী পড়ে, যদিও মূলত পড়েছিলাম একটা, মাই ফ্যামিলি অ্যান্ড আদার অ্যানিমালস'। সেই ভালোবাসা থেকেই করফু গেছিলাম। যেয়ে দেখি ওনাসিস সাহেবের জাহাজ আর জেমস বন্ডের সিনেমার জায়গা!

তবে সেই বাড়ীটা এখনো আছে। এবং জেরাল্ডের ভাই লরেন্স ড্যারেল তো আরেক ওস্তাদ সাহিত্যের জগতে।

করফুর যে কমলালেবু বাগান ঘেরা সাগর ধারের আলিশান ভিলায় ছিলাম অতি সস্তা দরে সেটা খুব মনে পড়ে।

আপনার লেখায় মহামারিকালীন দ্বীপের অবস্থা টের পেলাম কিছুটা।

মহামারির মাঝে ঝামেলা পড়েছিলাম গ্রীসে যেতে লেগে, কী একটা ফর্ম ফিলাপ করতে দেরী হওয়ায় ১ রাত বিমানবন্দরে কাটাতে হয়েছিল।

আপনার এথেন্স নিয়ে লেখার অপেক্ষায় রইলাম।

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

হ্যাঁ, ওরা এখন একটা প্যাসেঞ্জার লোকেটর ফর্ম ফিলাপ করতে বলে। সেটার কনফার্মেশন না এলে ঢোকা যায় না।

জেরাল্ডের বাড়িতে যাওয়া হয়নি। আপনাদের করফু ভ্রমণের কথা পড়েছিলাম। ইচ্ছা ছিল করফু থেকে আলবেনিয়ায় যাব, ফেরিতে করে। কিন্তু ফেরি বন্ধ। করোনার কারণে।

করফুর আরও মেলা গপ্পো বাকি আছে। এথেন্সের আগে সেগুলো আসবে।

তিথীডোর এর ছবি

ঠিক। মাই ফ্যামিলি অ্যান্ড আদার অ্যানিমালস, অতি প্রিয় বই ছিল, আছে।

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।