ভিয়েনার ক্যাফে সেন্ট্রাল

জীবনযুদ্ধ এর ছবি
লিখেছেন জীবনযুদ্ধ [অতিথি] (তারিখ: শনি, ০৭/০১/২০১৭ - ৮:২৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


জানুয়ারি, ১৯১৩ সাল

হারেন গাসে এবং স্ট্রাসমান গাসে- এ দুটি সড়ক একে অপরকে ছেদ করেছে উল্লম্ব আর আনুভূমিকের মাঝামাঝি কৌণিক অবস্থানে। আর ঠিক সে কৌণিক স্থানটিতেই নিজের মাথাটিকে ঠেলে দাঁড়িয়ে আছে নব্যগথিক স্থাপত্যে নির্মিত তেতল এক দালান। ভিয়েনা এখন অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের রাজধানী, যে সুবিশাল রাজ্য বিস্তৃত সেই পশ্চিমের ইন্সব্রুক শহর থেকে পূবের কৃষ্ণসাগর অবধি। সে সুবাদে এ রাজধানী শহরে এসে ভিড় জমিয়েছেন আশেপাশের নানা দেশের প্রতিজশা সাহিত্যিক, চিন্তাবিদ, রাজনীতিবিদ কিংবা স্থপতিরা। তাঁদেরই একজন, হাইনরিখ ফন হেরসটেল, এই ভবনটির নকশাকার। এক ধনী ইহুদী বণিকের মালিকানাধীন এ ভবনটি নিছক বসতদালান হলে হয়তো এ ভবনের পাশ দিয়ে পথিকেরা সতত হেঁটে গেলেও কেও খুব একটা গা করতেন না, কিন্তু সেটি হয়নি ও দালানের নিচতলের এক ক্যাফে দোকানের কল্যাণে। ক্যাফে ব্যাপারটির চল ভিয়েনায় হয়েছে কিছুকাল আগে। আর হবার পর থেকেই দেখা যাচ্ছে, শহরের সবচেয়ে জনপ্রিয় জমায়েত-স্থলে পরিণত হয়েছে এই ক্যাফেগুলো। আমাদের আলোচ্য ভবনের নিচতলের ক্যাফে সেন্ট্রালও তেমন-ই একটি জননন্দিত, লোকসমাগমে মুখর, সুপরিচিত ক্যাফে।

জানুয়ারি মাসের শীতার্ত অপরাহ্ণ। পথে-ঘাটে জনসমাগম এমনিতেই কিছুটা স্বল্প। হটাৎ মাঝে-মাঝে একটি দু’টি ঘোড়ায় টানা গাড়ি খটখট শব্দ তুলে পেরিয়ে যায়। তাদের মাঝে একটি কি দু’টি গাড়ি চটজলদি যাত্রী নামিয়ে দেয় ক্যাফের সামনের রোয়াকে, ক্ষণিকের বিশ্রামে ঘোড়াগুলো তখন তপ্ত নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। এ দালানটি মূলসড়ক থেকে কিছুটা ভেতরে হওয়ায় এ-পথে ট্রাম চলে না, তবে মূল সড়ক থেকে ভেসে আসা ঘোড়ায়-টানা ট্রামের ঘণ্টির শব্দ ঠিকই ভেসে আসে। আর এ শব্দ ক্যাফের ভেতরের খদ্দেরদের কর্ণকুহরে পৌঁছে যায় যখন কেও ক্যাফের ভারী দরজাটি ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করেন। এই যেমন, ঠিক এখন ক্যাফের ভেতরকার মানুষরা শুনতে পেলেন বাইরের সড়কে বরফের কুচি হটিয়ে ছুটে চলা ঘোড়ার শকটের চাকার আর অদূরের মূল সড়কে ছুটে চলা ট্রামগাড়ির শব্দের মিশ্রণ। আর সেই সাথে তাঁরা দেখলেন, দরজা থেকে পায়ের জুতোয় বেশ কিছুটা তুষার কণা নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন দীর্ঘদেহী একজন। যিনি ঢুকলেন, তাঁর বয়স হয়তো চল্লিশের কোঠায়। শক্ত চোয়াল, গালের দাড়িগুলো নিখুঁতভাবে কামানো, ঠোঁটের উপর মসৃণ লালচে পুরু গোঁফ। গত প্রায় একদশক তিনি থুঁতনির নিচে কিছুটা শ্মশ্রু রাখলেও অধুনা এই নির্বাসিত জীবনে ছদ্মবেশের অভিপ্রায়ে ও বস্তুটিকে ছেঁটে ফেলেছেন। ভদ্রলোকের গায়ে ধূসর রঙের এক ওভার কোট, যেটি খুলে তিনি রাখলেন ঢোকার মুখের এক কোণে। ঘিয়ে রঙের ওয়েস্ট কোটের উপর আজ তিনি ছাপিয়েছেন একই রঙের আরেকটি কোট, মাথায় একটি ফারের টুপি। ক্যাফেতে ঢুঁকে তিনি এগিয়ে গেলেন বাঁ ধারে, সেদিকের শেষ সারির একটি গদিমোড়া আসনে বসে তিনি নিজের টুপিটি খুলে রাখলেন সম্মুখস্থিত টেবিলের এক কোণে।

এ শহরে তিনি কেবলই এক আগন্তুক, নেহায়েতই ঠেকে এসেছেন কিছুদিনের জন্যে। স্ত্রী কন্সতানতিনভনার জটিল ব্যাধি, এর আগে স্ত্রীকে নিয়ে গিয়েছিলেন সুইজারল্যান্ডের বার্ন শহরে। সেখানকার ডাক্তাররা আরোগ্যলাভে তেমন একটা সাহায্য করতে পারেননি। তাই কয়েক সপ্তাহের জন্যে ভিয়েনায় এসেছেন এখানে যদি কিছু হয় সে আশায়, আর সাথে আছে পার্টির কিছু কাজও।

তিনার কথা বাদ দিয়ে এবার না-হয় কিছুটা এ ক্যাফের ভেতরকার অঙ্গসজ্জার কথা যাক। ক্যাফের ডান দিকটায় বিন্যস্ত আছে কিছু গোলাকার টেবিল, সেখানে দু’তিন জন বসে অনায়াসে আড্ডা দিতে পারে। ওদিকেই মাঝ বরাবর বসানো আছে একটি ঢাউস পিয়ানো। শহরের নামকরা কয়েকজন বাজিয়ে সেখানে বাজাতে আসেন বিকেল তিনটের পর, ও-সময়টাতে অনেকে এ ক্যাফতে আসেন কেবল ওই সুরলহরী শুনবার লোভেই। আর তার পেছনের দিকটায় ক্যাফের রাঁধুনি ঘর, যেখানে কয়লার গনগনে উনুনে ফুটছে কফির জল। অন্যপাশে হয়তো দু’তিন জন পিষে চলেছে পেস্ট্রির মাখনের দলা। এ তো গেলো ক্যাফের ডান আর পেছনের দিকের কথা। ওদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে আমরা যদি ক্যাফের বাঁ দিকে তাকাই, তবে হয়তো দেখতে পাব- রেলগাড়ির কামরার মতো সারি সারি আসন, নরম গদি মোড়া আসনে যেখানে একপক্ষ অন্যপক্ষের মুখোমুখি হয়ে কফির পেয়ালায় চুমুক দিতে পারে। ঘরের ডোমাকৃতির ছাদের প্রান্ত থেকে ঝুলছে প্রায় টেবিল অবধি নুয়ে আসা ঝাড়বাতি আর ভাজবিহীন টেবিল ঢাকনিতে ঢাকা এ টেবিলগুলোর পৃষ্ঠ। দেয়ালে টানানো রয়েছে কিছু বিখ্যাত শিল্পীর শিল্পকর্ম আর ঘরের একেবারের কোণের একটি গ্র্যান্ডফাদার ক্লকের পেন্ডুলাম অদ্ভুত গাম্ভীর্যের সাথে দুলে চলেছে। ক্যাফের ডান দিকটাতে সাধারণত বসেন যারা একা কিংবা বড়জোর একজন সঙ্গী নিয়ে আসেন, আর এই বাঁ দিকটাতে মূলত বসেন যারা দলবল নিয়ে সুদীর্ঘ আড্ডার নিমিত্তে এ ক্যাফে ঢুঁ মারেন। যার কথা দিয়ে গল্প শুরু হয়েছিলো তিনিও আজ একাকী কফিপানের পরিকল্পে এ ক্যাফেতে পদার্পণ করেননি, আজ তাঁর সাথে মিলিত হবার কথা আরও একজন মানুষের, যিনি তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মী। তার এ সময়েই আসবার কথা, হয়তো তিনি-ই আজ একটু আগেভাগে এসে পৌঁছেছেন। যদিও দু’জন মিলে বাইরে কোথাও একত্রিত হয়েও এ-ক্যাফেতে আসতে পারতেন তাঁরা, কিন্তু সেটি করলে মিছিমিছি কিছু ঝুঁকি নেয়া হয়। যে-দেশে তিনি এখন আছেন, সেই অস্ট্রিয়ার পুলিশের গোপন নজরদারির ভয় তো আছেই, উপরন্তু আছে জারের গোপন পুলিশবাহিনী ওখ্রানের গুপ্তচরদের অশুভ ছায়ার সম্ভাবনা। যদিও এসব আজকাল অনেকটাই তাঁর গা সওয়া হয়ে গেছে, সেই যৌবনের প্রারম্ভ থেকে তো এ-ই চলছে, কখনো নির্বাসনের জীবন, আবার কখনো ছদ্মবেশের জীবন।

যার কথা বলছি এতক্ষণ, তাঁর নাম ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ, জন্ম রাশিয়ার মহানদী ভলগা পাড়ের শহর সিমবিরস্কে। উলিয়ানভ তাঁর পারিবারিক পদবী, নিজ শহরে আর সাইবেরিয়ার নির্বাসনের দিনগুলোতে অবশ্য লোকে তাঁকে ভ্লাদিমির ইলিচ নামেই শুধাত। গেলো বারো বছর হল নিজের লেখা চিঠি আর প্রবন্ধগুলোতে তিনি নিজের এক নতুন ছদ্মনাম লেখা শুরু করেছেন। নামটি তিনি খুব সম্ভবত ধার করেছেন সেই নির্বাসনের স্থান সুশেনস্কয়ের পাশ দিয়ে বয়ে চলা একটি নদীর নাম থেকে। এখন পার্টির লোকেরা তাঁকে ওই ছদ্মনামেই চেনে।

আহ, সাইবেরিয়ায় সেই নির্বাসনের দিনগুলো! ভ্লাদিমির টেবিলের বাঁ পাশে রাখা ফারের সেই টুপিটির দিকে তাকিয়ে কিছুটা সময়ের জন্যে একযুগ আগের দিনগুলোতে ফিরে যান। এ টুপিটা মা এনেছিলেন। বৃদ্ধা মা অনেক ক’ বারই সাইবেরিয়ায় এসেছিলেন ছেলের সাথে দেখা করতে, প্রতিবারেই সাথে করে নিয়ে আসতেন একটি পুঁটুলি। তার মাঝে অনেক সময় থাকত নিজ হাতে বানানো পিঠে আর বোনদের পাঠানো অর্থ ও সমাজশাস্ত্র সম্পর্কিত পুস্তকাদি। বলাই বাহুল্য, সেসব পুস্তকের পাতায় পাতায় যতি আর ডট চিহ্নের মাধ্যমে তাঁর কাছে সময়ে-সময়ে নানা গোপন নির্দেশও পাঠানো হতো। আজ এতোকাল পর পুরনো সেই দিনগুলোর কথা কেন মনে পড়ছে কে জানে! ক্যাফের বাইরে আচমকা শুরু হওয়া তুষারপাতের জন্যে কি? গোরে আশ্রয় নেয়া কফিন যেভাবে ঢেকে যায় ঝুর ঝুর করে ফেলা নরম মাটির দলায়, ঠিক সেভাবেই ওক আর লাইম গাছের গুড়িতে গড়া সাইবেরিয়ায় তাঁর সেই নির্বাসন গৃহটি জানুয়ারি মাসের এমন দিনগুলোতে ঢেকে যেত তুষারের অবিরাম বর্ষণে। সেকারণেই হয়তো অপরাহ্নবেলার হটাৎ তুষারপাত তাঁকে করে তোলে কিছুটা স্মৃতিকাতর।

‘ভাস মুসটেন জী বিটে?’ অপেক্ষার মুহূর্তে বেয়ারা এসে একবার জিজ্ঞেস করে যায়, কিছু কি নেবেন? না, ভ্লাদিমির আরও কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে চান, যার সাথে দেখা করতে এসেছেন তিনি এলে তবেই না হয় কফি চাওয়া যাবে।

ঘড়িতে তখন তিনটে বেজে চল্লিশ। ক্যাফের পিয়ানো বাজিয়ে চলে এসেছেন, কাঠের ঢাকনাটি খুলে নিজের আঙুলগুলো বুলানো শুরু করেছেন পিয়ানোর রিডে। আর সেই অঙ্গুলি-চালন ধীরে ধীরে বুনতে থাকে সুরের ঊর্ণনাভ জাল। ভ্লাদিমির বিটোফেনের সুরের ভাঁজ চেনেন, শুধু চেনেন-ই না, এ সুরের মাঝে তিনি এক নির্মল আনন্দ খুঁজে পান। তাই ভেসে আসা ‘মুনলাইট সান্টা’র ঝঙ্কারগুলো তাঁকে কিছুটা আন্দোলিত করে, মুহূর্তের জন্যে তিনি ভুলে যান পার্টি, আন্দোলন- ইত্যাকার ব্যাপারগুলো। অনেকটা এ সময়ে তাঁকে মুখ তুলে তাকাতে হয় ‘কমরেড’ ডাকটি শুনে।

ত্রিশের কোঠার উপনীত এই জর্জিয়ান যুবকটিকে তিনি-ই বিশেষকরে দেখা করতে বলেছেন। গেলো বছর, অর্থাৎ ১৯১২ সালে এ যুবকের সাথে তাঁর দেখা হবার কথা ছিল প্রাগ সম্মেলনে, কিন্তু পুলিশের হাতে ধৃত হয়ে যুবক তখন কারাগারে। বেশ কিছু উদ্দেশ্য আছে তাঁর এঁকে ডেকে পাঠাবার পেছনে। তবে সে কথায় যাবার আগে যুবকের একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেয়া যাক। ইনার বাড়ি জর্জিয়াতে হলেও নিকটকালে বসবাস করছিলেন আজারবাইজানের বাকু শহরে। বেশ ডাকাবুকা ধরণের এই যুবকের পার্টির কাজে-কর্মে আছে অগাধ শ্রদ্ধা, এমনকি পার্টি-তহবিলে চাঁদা জোগানের জন্যে বেশ কিছু ব্যাংক ডাকাতি করতেও তিনি পিছপা হননি। আর সেভাবেই তিনি পেয়েছেন পার্টির সিনিয়র নেতাদের আনুকূল্য। শুধু তাই নয়, এঁকে পার্টির উপরের সারিতে তুলে আনার এক গোপন ইচ্ছে আছে ভ্লাদিমিরের মনে। মূলত দু’টো কারণে সেটি। একটি হল, ও সময়ে জাতীয়তা প্রশ্নে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে কিছু প্রশ্নের উদ্রেক হয়। পোল, চেক, জার্মান কিংবা ফিনিশ সমাজতন্ত্রীরা তাঁদের নিজেদের দল গঠন করে। ঠিক একই ভাবে যদি বৃহত্তর রাশিয়ায় রুশ ভিন্ন অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী নিজেদের পৃথক দল গঠন করে তবে জারকে হটানো আরও কঠিন হয়ে পড়বে। তাই তিনি পার্টির প্রথম সারির নেতাদের মাঝে এমন কাওকে রাখতে চান যিনি এই সংখ্যালঘু জাতিগুলোকে প্রতিনিধিত্ব করবেন। আরেকটি কারণ হল, গেলো বছরের প্রাগ সম্মেলনে রুশ সমাজতান্ত্রিক দলে একটি বড় ধরণের ভাঙ্গন ধরে সশস্ত্রপন্থায় বিপ্লবের উপযোগিতা নিয়ে। একটি দল প্রশ্ন করে বসে, গণতান্ত্রিক অহিংসপন্থায় সমাজতন্ত্রীদের ক্ষমতা দখলে সমস্যা কোথায়? ভ্লাদিমির এ পন্থার ঘোর-বিরোধী। তিনি তাঁর পক্ষালবম্বনকারী বৃহৎ অংশটিকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন সে সম্মেলন থেকে, যারা পরিচিত হলেন বলশেভিক নামে।

ভ্লাদিমির পূর্ব থেকেই জানতেন এ যুবকের নানা ডাকাবুকা কর্মকাণ্ডের কথা, এমনকি তিনি ফিনল্যান্ডে নির্বাসনে থাকার সময়ে এ যুবক-ই বাকুতে কিছু অপহরণ আর ব্যাংক ডাকাতি করে তা থেকে প্রাপ্ত অর্থ তাঁকে পাঠিয়েছিলো পার্টির কাজকর্ম চালিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু এদানিং এ যুবক পার্টির দু গ্রুপের একত্র হবার ব্যাপারে বেশ কিছু নিবন্ধ লিখছে, ব্যাপারটি বেশি সুবিধের নয়, এ নিয়ে যুবককে সতর্ক করা প্রয়োজন।

‘অনুগ্রহ করে বসুন, তো কেমন আছেন বলুন?’

‘ভালো কমরেড’, বরফশীতল চোখে ভ্লাদিমিরের দিকে তাকিয়ে যুবকের জবাব।

স্বভাবমতো নিজের বুড়ো আঙুলদু’টো ওয়েস্ট-কোটের পকেটে ঢুকিয়ে ভ্লাদিমির শুরু করেন, ‘কমরেড, আমি আজ আপনাকে এখানে ডেকেছি একটি বিশেষ কাজের ভার দেবো বলে। অনেক ভেবে দেখেছি আমি। আমার মতে আপনিই এ কাজের সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি।’

‘কাজটি কি, সেটি একটু ব্যাখ্যা করবেন?’

‘করবো, দাঁড়ান তাঁর আগে বরং আমাদের জন্যে কফির অর্ডার দেয়া যাক, হের ওবার!’

ভ্লাদিমির বেয়ারাকে ডেকে দু’ পেয়ালা কফি এবং দু’ পিস পেস্ট্রির অর্ডার দেন।

‘কাজের কথায় যাবার আগে আপনাকে ক’টি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে চাই। গেলো বছরের বসন্তে সেইন্ট পিটার্সবার্গ থেকে আমরা যে প্রাভদার প্রকাশনী শুরু করেছিলাম, তাঁর সম্পাদকের দায়িত্ব আপনার উপর কিন্তু ন্যস্ত হয়েছিলো আপনাকে সবাই একজন খাঁটি বলশেভিক হিসেবে জানে বলেই। কিন্তু এ কি করছেন আপনি? আপনার বিভিন্ন প্রবন্ধে আপনি ক্রমাগতভাবে মেনশেভিকদের সাথে একত্রীকরণের প্রস্তাব দিয়ে চলেছেন, এর পরিণাম কতটা সুদূরপ্রসারী হতে পারে ভেবে দেখেছেন একবার? প্রাগ সম্মেলনে আমরা বহু কায়দা করে মেনশেভিক হারামজাদাগুলোকে হটিয়ে দিয়েছি, কিন্তু এদের প্রতি ‘প্রাভদায়’ আপনার প্রচ্ছন্ন সমর্থন মেনশেভিক দলকে পুনর্জীবিত করতে পারে।’

‘কমরেড, আপনি তো জানেন, আমি আপনার বুর্জোয়া-বিরোধী রাজনীতি এবং সুবিধাবাদের সাথে আপোষহীন নীতির অনুগামী। কিন্তু মেনশেভিকদের ব্যাপারে আমার একটি স্বতন্ত্র অবস্থান আছে। পাঁচ সালের বিপ্লবে আমাদের শোচনীয় পরাজয়ের পর পার্টির অনেকেই আজ ভাবতে বসেছেন, আমাদের সশস্ত্র বিপ্লবী সংগঠন কিংবা গুপ্ত শ্রমিক সংগঠনগুলো রাখবার উপযোগিতা ঠিক কতটুকু? এরচেয়ে কিছুটা নমনীয় পন্থায় যদি রাজনৈতিক অধিকার আদায় করা যায় তবে হয়তো সেটাই শ্রেয়তর, এই হল তাঁদের মত। এ মত হয়তো আমাদের মত হতে ভিন্ন, কিন্ত একবার ভেবে দেখেছেন কি, আজ যদি আমরা তাদেরকে পার্টি থেকে বহিষ্কার করি তবে কিন্তু এক অর্থে জারের পরিকল্পনাই সফল হল। আমরা যাতে কমজোরি হই, সেটাই তো তিনি চান, তাই না? সেজন্যে প্রাভদায় প্রকাশিত আমার প্রবন্ধগুলোতে আমি মতভেদ থাকা সত্ত্বেও দু অংশের একত্রীকরণের উপর জোর দিয়েছিলাম।’

ভ্লাদিমির এতক্ষণ চুপ মেরে যুবকের কথা শুনছিলেন, তাঁদের কথার মাঝেই এক ফাঁকে বেয়ারা এসে রেখে গেছে দু পেয়ালা কফি, পেস্ট্রি আসবে কফির পর। ভ্লাদিমির কফির পেয়ালায় কিছুটা চিনি ঢেলে লম্বা এক চুমুক দিয়ে তাঁর জবাব ছুড়ে দেন, ‘আপনার কথা অনুযায়ী আমরা যদি পার্টিতে এই অন্তর্কলহবাদী এবং শ্রমিক স্বার্থবিরোধী কীটগুলোকে স্থান দিই, তবে তাঁরা হবে শরীরে জেগে থাকা পচা ঘায়ের মতো, যা থেকে সময়ে সময়ে পচা পুঁজ বেরোয়। আমি অমন ঘা রাখবার পক্ষপাতী নই কমরেড। বরং ঘা কেটে ফেলে নীরোগ শরীরই আমার কাম্য। আপনি নিশ্চয়ই আমার ইঙ্গিত বুঝতে পারছেন। একটা কথা মনে রাখবেন, বুর্জোয়ার সঙ্গে আপোষ আর প্রতিক্রিয়াশীলদের ব্যবস্থা মেনে নেয়া মানে হল আমাদের আন্দোলনের মৃত্যু।’

এ নিয়ে আরও কিছু মতদ্বৈততামূলক আলোচনা চলল দু জনের মাঝে, সেসব সমাপ্ত হলে ভ্লাদিমির পারলেন কাজের কথাটি, ‘কমরেড, এবারে বলি যে বিশেষ কারণে আপনার সাথে দেখা করতে চেয়েছি। আপনি নিশ্চয়ই অবগত আছে সাম্প্রতিককালে জাতীয় পরিচয় একটি মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের আন্দোলনে। এই জাতি বৈরিকে উসকিয়ে শ্রমিক-শ্রেণির মাঝেও দৃশ্যমান বিভেদ তৈরি করা সম্ভব। বহুজাতিভিত্তিক রুশ দেশে এটি হয়তো একনম্বর সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে, আর আমরা যদি এর কোন সুরাহা আমাদের মারক্সিয় নীতির মধ্য থেকেই তুলে আনতে না পারি তবে জারের কুচক্রীরা সেই ছুতোকে কাজে লাগিয়েই আমাদের কমজোরি করে তুলতে পারে। এ নিয়ে সুবিশাল পরিসরে যাবার আগে আমাদের তাত্ত্বিক ভিত্তি কিছুটা মজবুত করা প্রয়োজন।’

টানা বেশ কিচ্ছুক্ষণ কথা বলে একটু দম নেন ভ্লাদিমির, বুক পকেট থেকে নিজের পাইপটি বের করে তামাক ধরান, তারপর আবার শুরু করেন, ‘আপনার কাজটি হবে মারক্সিয় নীতি এবং জাতীয়তাবাদকে সম্মিলন করে একটি নিবন্ধ লেখা। আর এ-কাজটি আপনি করতে পারেন ভিয়েনাতে বসেই।

‘ভিয়েনায় আমি এসেছিলাম শুধু আপনার সাথে দেখা করতেই, খুব বেশি সময় থাকার কোন পরিকল্পনা আমার ছিল না। আর তাছাড়া এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নিবন্ধ লিখতে গেলে আমার বেশ কিছু বই-পত্তরও দরকার। সেগুলোও-বা মিলবে কীভাবে?’

‘ও নিয়ে আপনি ভাববেন না। কমরেড বুখারিনকে তো চেনেন? আপনার সাথে বোধকরি আলাপ হয়েছিলো ক্রাকভ সম্মেলনে। তিনিও কিন্তু এ মুহূর্তে ভিয়েনায় অবস্থান করছেন। তাঁর সাথে কথা হয়েছে আমার। লেখার রসদ এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য সব ব্যাপারেই তিনি আপনাকে সাহায্য করবেন। তিন-চার-পাঁচ সপ্তাহ যতদিনই লাগুক, এখানে বসেই শেষ করে যান লেখাটা। আর থাকার জায়গা নিয়েও ভাববেন না। এখানকার এক ধনী বলশেভিক পরিবার সানন্দে আপনাকে আতিথ্য প্রদান করবে। আর এ শহরে বসেই আপনাকে লিখতে বলছি, কারণ, এ রাজশহরে আপনি পাবেন বেশ ক’টি জাতি, বেশ কটি ধর্মের মানুষের সম্মিলন। অনেকটা যেন আমাদের রুশ দেশের মতো। আমস্টারডাম কিংবা প্রাগে বসে লিখলে হয়তো আপনি সেই আবহটি পাবেন না।’

কফির পালা শেষ হলে রুপোলী রঙের বাহারি চামচ দিয়ে বেয়ারার এনে রাখা পেস্ট্রির কিছু অংশ মুখে পুরতে পুরতে দু’জনের মাঝে আরও কথা হয় জারের পুলিশের নজর এড়িয়ে কি করে প্রাভদার সংখ্যাগুলো আরও গ্রাম-শহরাঞ্চলে পৌঁছে দেয়া যায়, সে নিয়ে। হটাৎ কেও পুলিশের হাতে ধরা পড়লে কাকে কোথায় পাঠানো যায় পরিপূরক হিসেবে, এ জাতীয় কিছু টুকিটাকি কিন্তু প্রয়োজনীয় আলাপও সেরে নেন তাঁরা।

বিদায় বেলায় সে যুবক ভ্লাদিমিরকে শক্ত শীতল হাতে করমর্দন করে বলে, ‘ধন্যবাদ কমরেড লেনিন, আশা করি আপনার চাহিদা মোতাবেক লেখাটি খুব শীঘ্রই শেষ করে ফেলতে পারবো।’

‘আপনি পারবেন, কমরেড স্টালিন, আপনার উপর সে বিশ্বাস আমার আছে।’

ফেব্রুয়ারি, ১৯১৩ সাল

লেনিন ভিয়েনা ছেড়েছেন গত মাসের শেষ দিকে, তিনি চলে গেছেন রুশ সীমান্তবর্তী এক পোলিশ গ্রামে। পোরোনিন নামক সে গ্রামে কিছুটা দিন নিরিবিলিতে কাটিয়ে নিজের কিছু কাজ গোছাবেন, এই তাঁর উদ্দেশ্য। যাবার আগে স্টালিনকে আবারও অনুরোধ করে গেছেন প্রবন্ধের কাজটা যৎতাড়াতাড়ি সম্ভব শেষ করতে।

প্রায় চার সপ্তাহ সময় নিয়ে স্টালিন লেখার কাজটা প্রায় গুছিয়ে এনেছেন। এর মাঝেই একদিন পার্টির এক গোপন বার্তাবাহক মারফত তাঁর কাছে খবর এলো, ক্যাফে সেন্ট্রালে আবারও তাঁর ডাক পড়েছে।

সেদিন অবশ্য তিনি একটু আগেভাগেই চলে গেলেন ক্যাফে সেন্ট্রালে। এবারে তিনি কিন্তু বাঁ ধারে বসলেন না, বরং ক্যাফের ডান দিকে অগ্রসর হয়ে একটি গোল টেবিল বেছে নিলেন। সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলেন এক সংবাদপত্র, সেটি খুলে সবে ভেতরের পাতায় চোখ দিয়েছেন, এমন সময়েই দেখতে পেলেন যার সাথে দেখা করবার জন্যে এসেছেন, তিনি উপস্থিত। পার্টির এ প্রভাবশালী কমরেডের সাথে তাঁর মুলাকাত এই প্রথম নয়, প্রায় চার বছর আগে বলশেভিক দলের লন্ডন কংগ্রেসে এ দু জনের প্রথম দেখা হয়। প্রথম সাক্ষাতে এই কমরেড সম্পর্কে কেনো যেন স্টালিনের একটি ঋণাত্মক ধারণা জন্মে, তাঁর মনে হয় ভদ্রলোক বাজে বকেন বেশি। মোটের উপর ছোটখাটো গড়নের এই কমরেডের প্রতি তাঁর ভক্তিশ্রদ্ধা খুব একটা জন্মায়নি। অবশ্য, তার আরেকটা কারণ হতে পারে, এ দু’জনের বয়স প্রায় এক। নিজের বয়সের একজনকে সিনিয়র নেতা মানতে অনেকেরই হয়তো বাঁধে। যাকগে, এমন মনোভাবের পরও স্টালিন আজকের এ সাক্ষাতের ব্যাপারে গররাজি হননি একটি কারণে। পাঁচ সালের বিফল বিপ্লবে এই কমরেড সেইন্ট পিটার্সবার্গে বেশ তাগদ দেখিয়েছিলেন, তাই লেনিনের অবর্তমানে ইনি পার্টি-প্রধান হলেও হতে পারেন। সেক্ষেত্রে এঁকে অবহেলা করাটা হবে এক ধরণের বোকামি।

এবারে সেই কমরেডের কিছুটা পরিচয় দেয়া যাক। ইউক্রেনের পাড়াগাঁয়ের এক নিতান্তই দরিদ্র ইহুদী পরিবারে তাঁর জন্ম। জার শাসিত সে-আমলে ইহুদীদেরকে লেখাপড়া শিখতে চাইলে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হতো, সেসব করেই ইনি নিজের প্রতিভা আর ইচ্ছেশক্তিতে ওডেসার বড় শিক্ষায়াতনগুলোতে পড়বার সুযোগ পান। কিন্তু যৌবনের প্রারম্ভ থেকেই রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ায় আজ তাঁকে কাটাতে হচ্ছে ফেরারি জীবন। ভিয়েনায় আছেন তিনি বেশ কিছুদিন, এখানে এখন তিনি প্রাভদার ভিয়েনা সংস্করণ বের করার পাশাপাশি অতিপ্রাকৃত মনস্তত্ত্ব নিয়ে ইদানীং বেশ পড়াশোনা করছেন। পার্টির স্থানীয়সূত্র মারফত তিনি শুনেছেন স্টালিন এখন এ শহরে, সেটি শুনেই তিনি স্টালিনের সাথে দেখা করবেন ভেবেছেন। প্রাগ সম্মেলন শেষে দেশে ফেরার পর পার্টির সেন্ট্রাল-কমিটির অনেকেই জারের গুপ্ত পুলিশের হাতে বন্দি হয়েছেন। আর সেই শূন্য স্থানের একটিতে লেনিন এনে বসিয়েছেন স্টালিন কে, যদিও স্টালিন এর পূর্বে ছিলেন পার্টির মধ্যম সারির নেতা। স্টালিনের সাথে দেখা করবার কারণ হল, এঁকে কিছুটা বাজিয়ে দেখা। তিনি শুনেছেন এই ভদ্রলোক মেনশেভিক এবং বলশেভিকদের একত্রীকরণের পক্ষে, তিনি নিজেও তা-ই চান, এ মতাদর্শের কারণেই লেনিনের সাথে তাঁর বেশ কয়েকবার বিবাদ হয়েছে। এখন যেহেতু স্টালিন সেন্ট্রাল কমিটিতে স্থান করে নিয়েছেন, তাই এ-ব্যাপারে স্টালিনকে পাশে পেলে নিজের কিছুটা দল-ভারী হয়। আরও একটি কারণ আছে। প্রাগ সম্মেলনের পর দেখা যায় যে, পার্টির হাড়ির খবর পৌঁছে গেছে ওখ্রানের কাছে, পার্টির ভেতরের কোনো প্রভাবশালী নেতা বিশ্বাসঘাতকতা না করলে এমনটি ঘটার কথা নয়। কিন্তু প্রশ্ন হল, সেই মানুষটি কে? তাঁর দু একজন শিষ্য গোপনে বলেছে, তাঁদের সন্দেহের তির স্টালিনের দিকে। স্টালিনের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলে কোন ইঙ্গিত পাওয়া যায় কিনা সেটিও তাঁর লক্ষ্য।

নিজের গোলাকার কালো রিমের চশমাটিকে নাকের ডগায় ঠেলে তিনি প্রশ্ন বললেন, ‘কমরেড আমি শুনেছি আপনি একটি প্রবন্ধের ব্যাপারে কাজ করছেন। একটিবার কি সেটি পড়া যায়? আপনার লেখাটি পড়বার ব্যাপারে আমি যারপরনাই উৎসুক।’

‘অবশ্যই পড়বেন, তবে লেখাটি এখনো পুরো শেষ করতে পারিনি। আশা করছি দিন কয়েকের মাঝেই শেষ হবে। আমাদের এখন একটি সুপ্রকাশক খুঁজে বের করতে হবে এটিকে গ্রন্থাকারে ছাপাবার জন্যে।’

‘ও নিয়ে আপনি ভাববেন না, আশেপাশের দেশে আমাদের সমব্যথী বেশকিছু প্রকাশক আছেন যারা আগেই আমাদের কথা দিয়ে রেখেছেন এ ধরণের পুস্তক প্রকাশের ব্যাপারে।’

স্টালিনের প্রবন্ধের তাত্ত্বিক বিষয় নিয়ে এবারে বেশ কিছুক্ষণ কথা হয় দু’জনের মাঝে, আর তার বাদে কিছুটা সাবধানী ভঙ্গিতে সেই প্রবীণ নেতা স্টালিনকে জিজ্ঞেস করে বসেন, ‘মেনশেভিকদের পার্টি থেকে হটিয়ে দেয়া নিয়ে লেনিন যা করছেন, আপনার কি মনে হয় না সেটা একধরণের হঠকারিতা?’

স্টালিন চতুর লোক, তিনি জানেন এ ইস্যুতে তিনি যতই সরব থাকুন না কেন, এখনকার হাওয়া বেশ একটা সুবিধের নয়। কারণ, এর মাঝেই অনেকে বলা শুরু করেছে যারা একত্রীকরণের পক্ষে, তাঁরা আসলে জারের গুপ্তচর, মেনশেভিকদের পার্টিতে ঢুকিয়ে পার্টির শক্তি ক্ষয় করতে চায়। এমনকি গত মাসের সেই সাক্ষাতের সময়ে লেনিন তাঁকে আকারে-ইঙ্গিতে বুঝিয়ে গেছেন, এ ইস্যুতে লেনিনের পাশে থাকলে ভবিষ্যতে তিনিও লেনিনের কৃপাধন্য হবেন। উল্টোদিকের নেতাটি দুঁদে নেতা সেটি বটে, কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না- তিনি একজন ইহুদী। তাই জারকে হটিয়ে পার্টি কখনো ক্ষমতায় গেলেও লেনিনকে টপকে ইনার পার্টি-প্রধান হবার কিংবা ক্ষমতার শীর্ষে থাকার সম্ভাবনা কিছুটা কম। তাই চট করে কিছুটা হিসেব-নিকেশ করে স্টালিনের সাবধানী উত্তর, ‘কমরেড, চূড়ান্ত বিজয়ের জন্যে সকলের এক থাকাটা দরকার সেটা আমি মানছি, এমনকি আমি নিজেও প্রাভদায় এ-নিয়ে বেশ কিছু প্রবন্ধ লিখেছি। তবে সাম্প্রতিককালে ধরপাকড়ের ব্যাপারটাও তো দেখছেন। এ মুহূর্তে মেনশেভিকদের পার্টিতে ঢোকালে হয়তো বাদবাকিদের মনে একে-অপরের সম্পর্কে সন্দেহ জন্মাবে। তাই আমার মনে হয়, এ-মুহূর্তে পার্টির বিশুদ্ধতা, গোপনীয়তা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠদের মতামত বজায় রাখাটাই বেশি জরুরী। তা না হলে হয়তো কয়েক বছরের মাঝেই আমরা ছিটকে পরবো মূল পথ থেকে, আর সেই সাথে রুশ ভূমি থেকে। জারকে হটিয়ে আমরা ক্ষমতায় যেতে পারলে হয়তো মেনশেভিকদের নিয়ে ভাবা যেতে পারে, তার আগে নয়।’

এ কথার পর তাঁদের মাঝে আর কথা এগুলো না, দু’জনেই বুঝে গেছেন তাঁরা ঠিক কোন মতের লোক এবং দু’জনের মাঝে দূরত্বটা ঠিক কতটুকু।

এ দু’জন যখন নিজেদের মাঝে এসব গুরুগম্ভীর আলোচনায় মত্ত ছিলেন তখন তাঁদের টেবিলের অনতিদূরের টেবিলে এসে বসেছিল এক ছোকরা, বয়স সবে কুড়ি পেরিয়েছে। ছোকরার বাড়ি ক্রোয়েশিয়ার কুম্রভেতচ গ্রামে। সে ভিয়েনার বাসিন্দা নয়, বরং থাকে ভিয়েনার দক্ষিণের এক ছোট শহরে- বড় ভাইয়ের বাড়িতে। পেশায় মোটর মেকানিক সে। ও-শহরেই ডাইমলার গাড়ির কারখানায় মেকানিকের কাজ করে। গতমাসে সে একখানা চিঠি পেয়েছে সেনা-সদর থেকে, রাজার সৈন্যবাহিনীতে বাধ্যতামূলক দু বছরের সার্ভিসের জন্যে। রাজধানী শহরে আজ সে এসেছে সেই চিঠিটি নিয়ে। সামনের মে মাস থেকে তাঁর যোগদানের কথা, তাই সে ভাবছিল কিছুটা তদবির করে যদি ক্রোয়েশিয়ায় বাড়ির কাছাকাছি কোন স্থানের গ্যারিসনে আত্তীকৃত হওয়া যায়! কাজ শেষে সে এসেছে এই ক্যাফেতে। এখানে অবশ্য যারা আসেন তাঁরা আরও উঁচু তলার মানুষ। কিন্তু মাসের প্রথম, পকেটেও তাই আছে মাইনের টাকা, তাই যুবক ভাবে একটু বাবুয়ানা করলে মন্দ কি! যুবক তাই বেয়ারাকে ডেকে এ ক্যাফের সেরা একটি কেক এবং এক কাপ কফির অর্ডার দেয়।

স্টালিন আর সেই নেতার মাঝে ‘কিছুটা অস্বস্তিকর’ আলোচনাটি আর এগোয় না। অগত্যা স্টালিনই আজ নিজ থেকে আগেভাগে উঠে পড়বার জন্যে অনুগ্রহ প্রার্থনা করেন। যাবার বেলায় নিজের সিল্কের হ্যাটটি মাথায় চরিয়ে অগ্রভাগটি নিচের দিকে ঠেলে কপালের উপর নুয়ে থাকা অবাধ্য চুলের গোছাকে ঠিক করতে করতে বলেন, ‘আশা করি, এরপর হয়তো আমাদের দেখা হবে রুশ ভূমিতে, কমরেড ত্রতস্কি।’

ক্যাফের সেই ভারী দরজা ঠেলে নিজের ওভার কোটের ডান পকেটে হাত রেখে তিনি যখন বাইরে বেরুবেন, অনেকটা একই সময়ে সেই যুবকও দরজা ঠেলে বাইরে যাবার প্রতীক্ষায়, কিন্তু স্টালিনকে সে আগে যাবার সুযোগ দিয়ে নিজে কয়েক মুহূর্তের জন্যে সেখানে দাঁড়ায়। যুবকের দিকে ফিরে না তাকিয়ে স্মিতস্বরে ‘ডাঙকে’ বলে স্টালিন ক্যাফে থেকে বেরিয়ে যান। সেদিন যদি তিনি এই যুবকের দিকে ভালোকরে তাকাতেন, বা পরিচিত হতেন, তবে কি ১৯৪৪ সালে এই যুবকের সাথে যখন মস্কোতে তাঁর দেখা হয়, তখন কি সেই অতীতস্মৃতি স্মরণ করতে পারতেন? হয়তো পারতেন, হয়তো না। মুহূর্তে কাওকে দেখা স্মৃতির প্রায় বিশ বছর পরও সজীব থাকার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ। যদি সেদিনের সেই স্মৃতি সমুজ্জ্বল থাকতো, তবে হয়তো স্টালিন চমকে উঠতেন এই ভেবে যে, সেদিনের সেই মলিন পোশাকের মোটর মেকানিক যুবকই আজকের বিশাল দেশ যুগোস্লাভিয়ার প্রখ্যাত পার্টিজান নেতা মার্শাল টিটো।

ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ সাল

ভিয়েনা শহর আর সেই ভিয়েনা নেই, বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত বুকে নিয়ে এ শহর আজ মলিন, শ্রীহীন। এখানে-ওখানে চলছে কিছু মেরামতের কাজ, ভেঙে পড়া কড়ি-বর্গা সরিয়ে নেবার কাজ, মৃত ভবনগুলোয় পুণরায় জীবন দেবার কাজ। ক্যাফে সেন্ট্রাল ভবনেরও ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে ৪৩-৪৪ সালের বোমাবর্ষণে। সে ক্ষতি পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি, তাই ও-ভবনের এক অক্ষত অংশে সীমিত পরিসরে চালু হয়েছে ক্যাফে সেন্ট্রাল। এ-শহরে এখন মার্কিন এবং সোভিয়েত দু’পক্ষের গ্যারিসন-ই বিদ্যমান, তাঁদের সৈনিক-কূটনীতিকরাই আজকাল এ ক্যাফের মূল খদ্দের।

ক্যাফে সেন্ট্রালের বাঁ ধারের বিশাল কাচের সার্সিগুলো বহু আগেই সেই ৪৩ সালের দিকে যুদ্ধের বোমায় চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়েছে, তাই পুরো বাঁ দিকটি ঢেকে রেখে ডান দিকের অংশে কিছু টেবিল-চেয়ার পেতে আজকাল খদ্দেরকে বসানো হয়। তেমনই এক দু’ মানুষের টেবিলে এসে আজ বসেছেন দু’ কূটনীতিক। এঁদের একজনের বয়স এই ত্রিশের কোঠায়, গায়ে ধবধবে সাদা স্যুট, মাথায় সাদা হ্যাট। ভদ্রলোকের নাম পিয়তোর সেমিয়নভিচ পোপোভ, লোকে জানে ইনি সোভিয়েত দূতাবাসের একজন সচিব। কিন্তু লোকে যা জানে না সেটি হল, ভদ্রলোক মূলত সোভিয়েত গুপ্তচর সংস্থা এনকেভিডির একজন দুঁদে চর। তাঁর কাজ হল মূলত ভিয়েনা থেকে যুগোস্লাভিয়ায় নানা গোয়েন্দা অভিযান পরিচালনা করা। সময়টা স্টালিন–টিটো দ্বন্দ্বের যুগ, তাই সোভিয়েত-যুগোস্লাভিয়া সম্পর্ক তখন আদায়-কাঁচকলায়। মস্কো থেকে আসা টিটো-বিরোধী নানা কমান্ড বাস্তবায়ন করতে তিনি ভিয়েনা থেকেই কলকাঠি নাড়েন।

আর তাঁর উল্টোদিকে যিনি বসেছেন তাঁর পরনে কালো কোট, সাথে মানানসই টাই। তাঁর ঠোঁটের উপর একটি পাতলা গোঁফের রেখা, উদর কিছুটা স্থূলকায়, আর বাঁ হাতে দামি ব্র্যান্ডের একখানা হাতঘড়ি। ইনার জীবনাতিহাস বরই চমকপ্রদ। ভদ্রলোকের পোশাকি নাম, ইয়ুশিফ রমাউলদভিচ গ্রিউলেভিচ। জন্ম লিথুয়ানিয়ায়, কিন্তু পরে তাঁর পিতা আর্জেন্টিনায় পাড়ি জমানোয় শৈশব ও কৈশোর কেটেছে আর্জেন্টিনায়। যৌবনে অবশ্য উচ্চশিক্ষার্থে চলে আসেন ইউরোপে। প্যারিস, স্পেনে কাটান সুদীর্ঘ সময়। স্পেনে থাকার সময়েই তিনি রিক্রুট হয়ে যান এনকেভিডি দ্বারা। তারাই একসময় তাঁকে নিজেদের লক্ষে ব্যবহারের জন্যে পুণরায় ল্যাটিন আমেরিকায় প্রেরণ করে। তিনি অনর্গল বলতে পারেন ফরাসি, স্প্যানিশ, ইংরেজি এবং রুশ। তাই যেখানেই তিনি যান না কেন, একটি ছদ্মপরিচয় বাগিয়ে নিতে তাঁর তেমন বেগ পেতে হয় না। ল্যাটিন আমেরিকায় যখন তাঁকে প্রথম একটি বড় অভিযানের দায়িত্ব দেয়া হয়, সেটি ১৯৪০ সালের কথা। এর কিছুকাল আগেই তিনি মেক্সিকো সিটিতে গিয়ে ঘাঁটি গেড়েছিলেন। সেবারে তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্বটি ছিল একটি ছোটখাটো দল নিয়ে ত্রতস্কির কম্পাউন্ডে হামলা করা। কিন্তু সে-যাত্রায় অল্পের জন্যে রক্ষে পান ত্রতস্কি, আর সে নিয়ে বাহিনীতে বড্ড দুর্নাম হয় গ্রিউলেভিচের। ও হ্যাঁ, গ্রিউলেভিচ নামটি কিন্তু ও সময়ে কেও জানত না, বাহিনীতে তাঁর ছদ্ম নাম ছিল- ম্যাক্স। এ ব্যর্থ অভিযানের পর কিছুদিনের জন্যে তাঁর পদায়ন হয় ইউরোপে। তারপর এই আবার কয়েক বছর আগে এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তাঁকে পাঠানো হয় কোস্টারিকায়। সেখানে তিনি এক ধনাঢ্য কোস্টারিকান পরিবারের সদস্য পরিচয় নিয়ে অল্পসময়েই পৌঁছে যান ক্ষমতার উঁচু মহলে, বলাই বাহুল্য, এর পেছনে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অদৃশ্য হাত। এমনকি তাঁদের তদবিরেই তাঁকে চার্জ দ্যা অ্যাফেয়ার্স করে পাঠানো হয় ইটালিতে।

আজকের বৈঠকটি রোমেও হতে পারত। কিন্তু ইচ্ছে করেই পোপোভ তাঁকে ভিয়েনাতে ডেকে এনেছেন। রোমে এখন গিজগিজ করছে মার্কিন আর ব্রিটিশ গোয়েন্দারা, সোভিয়েত বাহিনীর উপস্থিতি সেখানে নেই। সেদিক দিয়ে ভিয়েনা কিছুটা নিরাপদ। এখানে মার্কিন বাহিনী থাকলেও সোভিয়েত গুপ্তচরদের ছত্রছায়ায় একটি বৈঠক করা কঠিন নয়। আর তাছাড়া রোমে যেমন অনেকেই গ্রিউলেভিচকে একজন কূটনীতিক হিসেবে চেনেন, এখানে তিনি তেমনভাবে পরিচিত নন।

‘কমরেড ম্যাক্স, আপনাকে এতটা দূর টেনে আনবার জন্যে দুঃখিত। কিন্তু বুঝতে পারছেন নিশ্চয়-ই, তেমন গুরুত্বপূর্ণ না হলে হয়তো আমরা এ সিদ্ধান্ত নিতাম না। মস্কো থেকে বার্তা এসেছে, আপনাকে আবারও একটি বড় কাজে জড়াতে হবে।’

এবার যে বেশ বড় কোন অপারেশনে তাঁকে জড়ান হবে সেটি গ্রিউলেভিচ তখনই অনুমান করেছিলেন, যখন তাঁকে কূটনীতিকের পদ যোগাড় করে ইটালিতে পাঠানো হয়। মেক্সিকো সিটির সেই ব্যর্থ অপারেশনের বেদনা তিনি আজও ভুলেননি, তাই তেমন ধরণের কিছুর জন্যে আজও তাঁর রক্ত চনমন করে। তিনি অধির হয়ে তাই পোপোভের কাছে আদ্যন্ত জানতে চান।

নিজের পাইপে দেশলাই দিয়ে আগুন ধড়িয়ে কিছুটা শান্ত ভঙ্গিতে পোপোভ শুরু করেন, ‘যুগোস্লাভিয়া নিয়ে মস্কোতে বেশ একটা মাথাব্যাথা আছে, সেটি নিশ্চয়ই জেনে থাকবেন। ওই হারামি টিটো আমাদের বহু জ্বালিয়েছে, তাই মস্কো বহুদিন থেকেই চাইছে তাঁকে সরিয়ে দেবার। কিন্তু আমাদের এজেন্টরা এ-পর্যন্ত ওর দেহরক্ষীদের পেরিয়ে কিছু একটা করে উঠতে পারেনি, ব্যাটা বহুত সেয়ানা। তাই এবারে আমরা ভেবেছি সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পন্থা।’

এ-পর্যন্ত বলে কিছুটা দম দেন পোপোভ। মাঝে অবশ্য বেয়ারা এসে তাঁদের দু’জনের জন্যে দু’পেয়ালা কফি রেখে গেছে। চোরা চোখে তিনি একবার দেখে নিলেন, আশপাশে তাঁর এজেন্ট ভিন্ন আর কারও অস্তিত্ব চোখে পড়ে কি না। কিন্তু না, তাঁর নিজের চার জন চর ছাড়া ঠিক এ-মুহূর্তে আশেপাশের টেবিলে আর কেও নেই। অর্থাৎ, নিশ্চিন্তভাবেই আসল কথা ম্যাক্সকে বলা যায়।

পোপোভ অসমাপ্ত কথার খেই ধরে বলে, ‘যুগোস্লাভিয়ায় এ মুহূর্তে কোস্টা রিকার কোন দূত নেই সেটি নিশ্চয়ই জানেন, তাই আমরা চেষ্টা-তদবির করছি আপনাকে আপনার ইটালির দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসেবে যুগোস্লাভিয়াতেও কোস্টারিকার দূত হিসেবে নিয়োগ দেবার। আর ওটি হয়ে গেলেই আমাদের কেল্লা ফতে।’

গ্রিউলেভিচ এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে পোপোভের কথা শুনছিলেন। তিনি এ-ধরণের কাজে আছেন প্রায় পনের বছর, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ আছে তাঁর, ব্রিফিঙের সময়ে যে ফালতু প্রশ্ন করা মানা সেটি তিনি জানেন। তবে এ-পর্যায়ে তাঁর মনে উঁকি দেয়া একটি প্রশ্ন তিনি না করে পারলেন না।

‘কিন্তু, যুগোস্লাভিয়ায় গেলেও তো আমার মর্যাদা এবং পরিচয় হবে একজন কূটনীতিকের। সেটি বহন করে কি আপনি আমাকে টিটোর বুকে ছুরি কিংবা টিটোর বাড়িতে গ্রেনেড ছুঁড়তে বলছেন? তেমনটি হলে কূটনীতিক মহলে কি একটা যাচ্ছেতাই ব্যাপার হবে, সেটি কি ভেবে দেখেছেন আপনারা?’

‘কমরেড ম্যাক্স, আমরা হিসেব-নিকেশ করেই এবারে পা ফেলেছি। আর আপনাকে কে বলল, চাকু-গ্রেনেড ছুঁড়তে? আপনার সাহায্য আমরা নিচ্ছি এই কারণে যে, অন্যথায় টিটোর কাছ পৌছা আমাদের পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রদূত হিসেবে আপনার সাথে বেশকিছু অনুষ্ঠানে হয়তো টিটোর মুলাকাত ঘটবেই। আর সেই মুহূর্তটিকেই আমরা ব্যবহার করবো মোক্ষম সুযোগ হিসেবে।’

গ্রিউলেভিচ এখনও অন্ধকারে। সত্যি বলতে কি, তিনি প্রথম যখন এই বাহিনীতে নাম লেখান, সে সময়ে এমবুশ, ছুরি চালিয়ে দেয়া কিংবা গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেবার মতো বেশ ভালো কিছু প্রশিক্ষণ তিনি পেয়েছিলেন। তাই এখনও কোন শত্রুর নিকেশ বলতে তিনি এ-ধরণের কোনো পন্থাকেই বোঝেন। কিন্তু এগুলো এড়িয়ে ভিন্ন কোন পন্থার কথা পোপোভ ভাবছে সেটি তিনি ঠিক ভেবে কুলোতে পারেন না।

হয়তো গ্রিউলেভিচের অন্তরের প্রশ্নের কথা বুঝতে পেরেই পোপোভ বলে, ‘আপনি নিশ্চয়ই ভাবছেন, সহিংস কোনো পন্থা ব্যতীত আমরা কোন পদ্ধতিতে আপনার দ্বারা টিটোর নিকেশের কথা ভাবছি, তাই তো?’

থোবড়া গালের চউরা মুখটিকে উপর-নিচে ঈষৎ দুলিয়ে গ্রিউলেভিচ তাঁর সন্দিহান মনোভাবের কথা ব্যক্ত করেন।

‘আপনাকে খুব সম্ভবত এ বছরের শেষনাগাদ যুগোস্লাভিয়ায় চার্জ দ্যা এফ্যেয়ারস হিসেবে নিয়োগ দেয়া হবে। সুতরাং আশা করা যায়, আগামী বছরের মার্চ-এপ্রিল মাসের দিকে আপনি হয়তো টিটোর কাছে আপনার পরিচয়পত্র পেশ করার অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হবেন। আমাদের কোন এজেন্ট তার আগেই আপনার কাছে পৌঁছে দেবে একটি বাক্স, আপনার কাজ হবে শুধু আলোচনার এক পর্যায়ে আলগোছে সেই বাক্সটি খুলে ধরা, যেন আপনি কিছু বের করছেন সেই বাক্স থেকে।’

‘শুধু বাক্স খুলে ধরলাম, আর তাতেই খেল খতম? আমি কিন্তু সত্যি-ই এখনও অন্ধকারে।’

‘এ বাক্স কোন মামুলি বাক্স নয়, কমরেড ম্যাক্স, এ-তে আগে থেকেই ভরা থাকবে প্লেগের জীবাণু। আর তাই পরিকল্পনা-মাফিক কাজ করতে পারলে অল্প কদিনের মাঝেই প্লেগে ভুগে টিটোর মৃত্যু অবধারিত। তবে আপনি ভয় পাবেন না, আমাদের এজেন্ট আপনাকে আরও একটি বাক্স আগেই পৌঁছে দেবে, যাতে থাকবে প্লেগের প্রতিষেধক। আপনার কাজ হবে নির্ধারিত বৈঠকে যাবার আগে নিজের শরীরে সেই প্রতিষেধক ইনজেকট করে নেয়া, তবেই আপনি বিপদমুক্ত থাকবেন। কি, বোঝা গেলো এইবারে পুরো ব্যাপারটা?’

নিয়তির কি অদ্ভুত পরিহাস! গ্রিউলেভিচ এবং পোপভ আজ এই সেন্ট্রাল ক্যাফের যে স্থানটিতে বসে টিটোকে নিকেশের ছক আঁকছিলেন, তাঁদের বড় কর্তা স্টালিনের হুকুমে, ঠিক ও স্থানটিতে বসেই আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে দু’জনে কফি খেয়ে গেছেন, তখন যদিও দু’জন দু’জনের সাথে পরিচিত ছিলেন না। আর থাকলেও বা, তখন কি আর তাঁরা জানতেন কোনও এক দূর ভবিষ্যতে তাঁরা হবেন এঁকে অপরের ঘোরতর দুশমন!

অগাস্ট, ২০১৬ সাল

রোদের দাবদাহ ভিয়েনাকে করেছে বাষ্পবিহীন, তৃষ্ণার্ত পথিক ক্ষণে ক্ষণেই ঘেমে নেয়ে উঠে পানীয়ের প্রত্যাশায় হা পিত্যেশ করে মরে। সারাদিন এ শহরের পথে-প্রান্তরে ঘুরে ঘুরে আমিও বেজায় ক্লান্ত, পিপাষার্ত, কিছুটা ছায়ার প্রত্যাশায় ব্যাকুল। অপরাহ্নের দিকে অস্ট্রিয়ান সংসদ ভবনে একটি দু’ঘণ্টার ট্যুর নিয়ে সাঙ্গ হবার পর যখন সিটি হলের সামনে এক ছোটখাটো মেলায় মিশে গেছি, তখনই অনুভব করতে পারি এ বেলায় ক্ষুদ্র করে হলেও পেটে কিছু দানা-পানি পড়া দরকার। ঘুরতে ঘুরতে কি করে যেন আমি পৌঁছে যাই হেরমান গ্রাস স্ট্রিটে। এ পাড়ায় হেঁটে দু গলি পেরিয়ে কোণের দিকে সামনে সামিয়ানা পাতা ক্যাফের দোকান আমার চোখে পড়ে, হাঁপ ছেড়ে বাঁচি আমি। আর যাই হোক, কেক-পেস্ট্রি, মিল্কশেক কিংবা ক্যারামেল চকলেটের পিঠে তো নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে সেখানে। আমি পা রাখি সে ক্যাফেতে, ঘড়িতে বাজে চারটে বিশ। সেই শতবর্ষের রীতি মেনেই ডান ধারের পিয়ানো নিয়ে বসে গেছেন এক বাজিয়ে, উঠে যাবার সময়ে দু একজন খদ্দের তাঁর সামনের টেবিলে রেখে যাচ্ছেন বকশিসের কাগুজে নোট।

আমি বাঁ ধারের একটি খালি টেবিল পেয়ে ঝুপ করে বসে ভেতরের সুশীতল বাতাসে নিজেকে একটু ধাতস্থ করবার প্রয়াস চালাই। আমি বসেছি সদর দরজার দিকে মুখ করে, সেটি হাট করে খোলা। আর সেই দরজা দিয়ে খেয়াল করি একালের ঝাঁ চকচকে গাড়ির সাথে এ-পাড়ায় এখনো চলছে ঘোড়ায় টানা টমটম গাড়ি। তবে পাঠক বিভ্রান্ত হবেন না, ভিয়েনা তেমন অনগ্রসর শহর নয় যে এ শহরের অধিবাসীরা ঘোড়ায় টানা টমটমে চড়ে ঘুরবেন, ওগুলো মূলত শহরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে রাজ্যের পর্যটকদের চড়িয়ে।

এবারে আমি ক্যাফের ভেতরটায় একটু নজর বুলাবার চেষ্টা করি। শতবর্ষের ব্যবধানে হয়তো পরিবর্তন এসেছে অঙ্গসজ্জায়, কিন্তু দেয়ালের কারুকাজ, উপরের ছাদের ভারটিকে বয়ে চলা গথিক কায়দায় নির্মিত থামগুলোর সৌন্দর্য কিন্তু একই রয়ে গেছে। আমি এ ক্যাফের ঐতিহ্যবাহী কফির অর্ডার দিলে বেয়ারা সাফ জানিয়ে দেয় মিনিট বিশেকের আগে পরিবেশন সম্ভব নয়, আমি কি এর মাঝে খাবার জন্যে ভিন্ন কিছু চাই? অদূরেই এক কাচের সেলফে নানা পদের পেস্ট্রি আমি দেখতে পাই, কিন্তু তাদের নাম আমার জানা নেই, বলতে চাইছি জার্মান ভাষায় এই পেস্ট্রিগুলোর নামের সাথে আমি পরিচিত নই। অগত্যা সেই বেয়ারাকে নিয়ে গেলাম শেলফের কাছে, সেখানে গিয়ে হাত দিয়ে দেখালাম কোন দু পদের পেস্ট্রি আমি চাই।

‘ওক, হুম, এস্টার হেতসি রিলোডেড উন্ড ট্রুফেল টোরটে’ এই বলে সে বিদেয় নিলো।

লোভনীয় স্বাদের পেস্ট্রিদুটো টেবিলে পৌঁছাবার পর আমি ঝকঝকে চামচে তারিয়ে তারিয়ে খাবার বেলায় ভাবি, আমি এখন এ ক্যাফের যে স্থানটিতে বসে, কোনো এককালে এ দিকটাতেই কি পড়েছে টিটো-স্টালিন-ত্রতস্কির পদচিহ্ন? কেমন হতো যদি তাঁরা এই ভিয়েনা, সেন্ট্রাল ক্যাফে- এসবের মায়ামোহে পরে এখানেই কাটিয়ে দিতেন তাদের জীবনের পরবর্তীকাল! পৃথিবীর ইতিহাস তখন হয়তো অন্যভাবে লিখতে হতো। আমি আনমনে হেসে উঠি।


মন্তব্য

সত্যপীর এর ছবি

একশোতে একশো।

..................................................................
#Banshibir.

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

ধন্যবাদ, পীরদা

সত্যপীর এর ছবি

এই লেখাটা গল্প হতে হতেও হয়নি। ফরম্যাট নিয়ে আপনার পরীক্ষা প্রশংসনীয়। ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখতে পারেন ইতিহাসভিত্তিক গল্পে হাত দিতে চান কিনা।

(সংযোজনঃ লেনিনের আসল নাম জানা ছিল বলে প্রথমেই ধরে ফেলেছি এইটা লেনিনের গল্প। আমি হলে কেবল ভ্লাদিমির বলে চালিয়ে দিতাম প্রথমে, পাঠককে কিছুক্ষণ ধাঁধায় রাখতে হাসি )

..................................................................
#Banshibir.

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

পীর দা, আমিও প্রথমে ওটাই ভেবেছিলাম, কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম লেনিনের আসল নামটা হয়তো খুব পাঠকই জানে, তাই এ রিস্কটা নেয়া যায়.

আর হ্যাঁ, বলতে পারেন এটা আমার এক ধরণের এক্সপেরিমেন্ট। এ যাবৎ তো কেবল ভ্রমণ কাহিনীই লিখলাম, তাই এবারে ভাবলাম ভিন্ন ধাঁচে ভিন্ন ভাবে লিখি, তাতে যে ব্যাপারটা কতটা ভালো হল সে হয়তো আপনারাই বলতে পারবেন।

এ ধরণের ফরম্যাটে আরো কিছু লেখার ইচ্ছে রইলো। ধন্যবাদ

অতিথি লেখক এর ছবি

সত্যপীর মিথ্যা বলেন নি। আপনার এক্সপেরিমেন্ট দুর্দান্ত হয়েছে জীবনযুদ্ধ।
---মোখলেস হোসেন।

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

ধন্যবাদ মোখলেস ভাই

এক লহমা এর ছবি

হাততালি হাসি

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

জীবনযুদ্ধ এর ছবি
অতিথি লেখক এর ছবি

অসাধারণ, অসাধারণ, সত্যিই অসাধারণ। এখন পর্যন্ত আমার পড়া আপনার সেরা লেখা। চালিয়ে যান।

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ রূপক

মাহবুব লীলেন এর ছবি

দুর্ধর্ষ। একেবারে ঘোরের মধ্যে ছিলাম

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

প্রীত হলাম জেনে লীনেন দা

অতিথি লেখক এর ছবি

ভ্রমণ আর ইতিহাস মিলিয়ে অনেকে অনেক রকম আঙ্গিকে চেষ্টা করেছেন, তবে এই আঙ্গিকটা ভালো লেগেছে। ছবি গল্প মিলিয়ে চমৎকার! প্যারিসের ক্যাফেগুলো নিয়েও এমন অসাধারণ গল্প হতে পারে। ক্যারি অন!!

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ আপনাকে.

সোহেল ইমাম এর ছবি

সব সময়ই আপনার লেখা ভালো লাগে। কি দুর্দান্ত লেখার হাত আপনার। আপনার লেখা ভ্রমন কাহিনী গুলো পড়ার জন্য অধীর হয়ে বসে থাকি। তবে অন্যদের সাথে আমিও বলবো অদ্ভুত সুন্দর কিছু উপন্যাস কিন্তু অপেক্ষা করছে আপনার কলমের (কি-বোর্ডের) ভেতর।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

ধন্যবাদ সোহেল ভাই, আপনাদের প্রেরণাই আমার পাথেয়

মুস্তাফিজ এর ছবি

চমতকার বুনোন। ভালো লেগেছে।

...........................
Every Picture Tells a Story

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

ধন্যবাদ মুস্তাফিজ ভাই

অতিথি লেখক এর ছবি

সুন্দর

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকে

শাব্দিক এর ছবি

অপূর্ব!!!

সৌভাগ্যবশত মাত্র কিছুদিন আগে ক্রাকো, ভিয়ানা, প্রাগ দেখার সুযোগ হয়েছিল।
এরপর এমন একটা লেখা পড়ার সৌভাগ্য হল। পড়ার সময় প্রতিটি শব্দ অনুভব করছিলাম আপনার এই লেখার।
অতুলনীয়! চলুক

---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, এই তিনটি শহর-ই আমার বড় প্রিয়

শাব্দিক এর ছবি

আচ্ছা "নব্যগথিক স্থাপত্য" বলতে কি Neo-Gothic architecture বুঝিয়েছেন?

---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

হ্যাঁ, সেটাই বুঝিয়েছি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।