চলচ্চিত্রঃ হালিমার পথ

জীবনযুদ্ধ এর ছবি
লিখেছেন জীবনযুদ্ধ [অতিথি] (তারিখ: সোম, ২৮/০৯/২০২০ - ১:৪৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

২০১৫ সালের জুলাই মাস। আমি তখন বসনিয়ার সারায়েভোতে। সারা শহর ছেয়ে গেছে পোপের ছবি সম্বলিত পোস্টারে। তাঁর আগমন উপলক্ষ্যে অবমুক্ত করা হয়েছে বিশেষ ডাকটিকেট। শুনছি– তিনি এবারে এসে যাবেন সেব্রেনিৎস্কায়। সেখানে সমবেত জনতার সামনে দাঁড়িয়ে আবারও জানাবেন সম্প্রীতির আহ্বান। এ দেশে এখনো এই সম্প্রীতির যে বড় প্রয়োজন। যুদ্ধ থেমে গেছে প্রায় দু দশক আগে। কিন্তু থামেনি সার্ব আর বসনিয়ান মুসলিমদের মাঝে বিরাজমান বিদ্বেষ। মুছে যায়নি অতীতের সকল কালো ইতিহাস। এখনো মায়েরা কাঁদে। তাঁদের মৃত পুত্রের জন্যে। প্রতি বছর সেব্রেনিৎস্কা দিবস এলেই তাঁদের ক্রন্দনে ভারী হয়ে ওঠে চারদিক। ইমাম আর সরকারি কর্তাব্যাক্তিদের উপস্থিতিতে তাঁরা বুঝে নেন বহুকাল আগে হারিয়ে যাওয়া ধনের অস্থি বিশেষ।

অনেকে ভাবতে পারেন দু দশক আগে শেষ হওয়া যুদ্ধের মৃত শহীদদের দেহাবশেষ এতকাল পর হস্তান্তর করা হচ্ছে কেন? হচ্ছে, কারণ– মৃত ব্যাক্তিদের শনাক্তরনের কাজটি সহজ ছিল না। যুদ্ধের পর দেখা গেল, অধিকাংশ গণকবর গিয়ে পড়েছে সার্ব অংশে। ফলে সেখানে খনন কাজ চালিয়ে দেহাবশেষ বের করে আনায় কিছুটা জটিলতা ছিল। এর পর দেখা গেল, সার্বদের আরেক কপট চালের নমুনা। তারা আগেই খননযন্ত্র দিয়ে গণকবর খুঁড়ে এক গণকবরের কিছু অংশ নিয়ে ফেলেছে আরেক বধ্যভূমিতে। ফলে দেখা গেল, এক জন শহীদের দেহাবশেষ হয়তো ছড়িয়ে আছে চার পাঁচটি বধ্যভূমিতে। সেই বধ্যভূমিগুলো থেকে যতটা সম্ভব সবগুলো অস্থি সংগ্রহ করে তারপর কাছের মানুষের ডিএনএ-এর সাথে মিলিয়ে তাঁদের কাছে হস্তান্তরের কাজটি যে বেজায় দুরূহ, তাতে সন্দেহ নেই। আর সে কারণেই প্রতি বছরেই মাত্র পনের থেকে বিশটি কফিন হস্তান্তর করা হয় মৃত ব্যাক্তির মা কিংবা স্ত্রীর কাছে। এভাবেই চলছে গত পঁচিশ বছর ধরে।

সারায়েভোর মায়েদের এই দুঃখগাথার কথা মনে পড়লো আজ একটি সিনেমা দেখতে যেয়ে। সিনেমার নাম– হালিমার পথ। সত্য কাহিনির ছায়া অবলম্বনে নির্মিত এই সিনেমাটির চিত্রনাট্য লিখেছেন একজন বসনিয়ার মানুষ আর ওদিকে বানিয়েছেন ক্রোয়েশিয়ার পরিচালক।

পশ্চিম বসনিয়ার একটি ছোট্ট গ্রাম প্রিজেদর। এখানেই হালিমার বাস স্বামীর সাথে। এই দম্পতি সন্তানহীন। সেজন্যে হালিমার স্বামীর কোন আফসোস কিংবা হালিমার প্রতি বিরাগ মনোভাব না থাকলেও, আত্মীয় স্বজনেরা দু কথা শোনাতে ছাড়ে না। এই গ্রামের পাশের গ্রামেই হালিমার বড় ভাইয়ের পরিবারের বাস। এই ভাইয়ের এক ছেলে, এক মেয়ে। মেয়েটি বড্ড রূপবতী। অষ্টাদশী। নাম– সাফিয়া। হালিমার সাথে এই মেয়েটির খুব ভাব।

একদিন সন্ধ্যের মুখে হালিমার বাড়িতে সাফিয়া এসে হাজির। বাইরে তখন মেঘ ডেকে বৃষ্টি নেমেছে। দ্রুত অন্ধকার নেমে এসেছে চারদিকে। হালিমা তো বেশ অবাক। হটাত এ সময়ে সাফিয়া কেন? কাঁদতে কাঁদতে সাফিয়া জানায় তাঁর এক দুর্দশার কথা। পাশের গাঁয়ের ছেলে স্লাভর সাথে ভাব ভালোবাসার এক পর্যায়ে সে হয়ে পড়েছে গর্ভবতী। মুশকিল হল, স্লাভরা খ্রিস্টান। সার্ব। তাই সাফিয়ার বাবা ওকে মেরে বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছে। ক্রন্দনরতা এই মেয়েটির দুর্দশার কথা শুনে হালিমা আর তাঁর স্বামী মেয়েটিকে অভয় দান করে।

এরপর সিনেমার সময়ের চাকা কিছুটা এগিয়ে যায়। আমরা দেখি– স্লাভ ফিরে এসেছে গাঁয়ে। মাঝে সে কয়েক বছরের জন্যে গিয়েছিল জার্মানিতে। সেখান থেকে পয়সাপাতি বানিয়ে ফিরে এসেছে। হালিমার কাছে এসে উচ্ছ্বসিত হয়ে সে বলে, চল আমরা পালিয়ে যাই। ও হ্যাঁ, তার আগে স্লাভ জিজ্ঞেস করে নেয়, আচ্ছা সেই সন্তান কোথায় আমার? সেই যে আমাদের ভালোবাসার ফলে তুমি সন্তানসম্ভাবা হলে? তোমার বাবা আমাকে মেরে বাড়ি থেকে কুকুরের মত তাড়িয়ে দিল! সাফিয়া কিছুটা অপ্রস্তুত কণ্ঠে জানায়, জন্মদানের সময়েই সেই সন্তান মরে গেছে স্লাভ। সেই সন্তানের কথা ভেবে আর লাভ নেই। চল, আমরা সামনের দিনগুলোর কথা ভাবি। স্লাভ সেটা মেনে নেয়। ওরা চলে যায় দূরের এক সার্ব-প্রধান গ্রামে। সেখানে স্লাভর এক কাকার দান করা জমিতে ওরা ঘর বানিয়ে সংসার বাঁধে। ওদের ঘর আলো করে তিনটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়।

এর কয়েক বছর পরই সারা যুগোস্লাভিয়ার মানচিত্র একেবারে ওলটপালট হয়ে যায়। যুদ্ধ বাঁধে। সর্বনাশা যুদ্ধ।

এরপর আমরা এক লাফে চলে আসি বহু বছর পরের এক ঘটনায়। ক্যালেন্ডারে সময়টা তখন ২০০০। পাঁচ বছর আগে যুদ্ধ শেষ হয়েছে। এখনো অনেক মা খুঁজে ফিরছে তাঁদের স্বামী কিংবা সন্তানের দেহাবশেষ। হালিমাও খুঁজছে। তার ছেলে মির্জার দেহাবশেষ। এর আগে হালিমা খুঁজে পেয়েছে তার স্বামীর অস্থি। কিন্তু মির্জার অস্থি খুঁজে পেতে গিয়ে বেঁধেছে গোল। কারণ, মির্জার প্রকৃত মা তো সে নয়। ওর জন্মদায়িনি মা তো হল সাফিয়া। সাফিয়ার সন্তানকেই ওরা নিজ সন্তান রূপে বড় করে তুলছিল। এতে ওদেরও সন্তানের সাধ পূরণ হল, ওদিকে সাফিয়াও গঞ্জনার হাত থেকে বাঁচল। কিন্তু সাফিয়া? বহু দূরের সার্ব গ্রামে থাকা সার্ব বাড়ির বৌ সে এখন। ওখানে তার নাম খানিকটা বদলে গিয়ে হয়েছে সোফিয়া। তাকে কি করে হালিমা খুঁজে পাবে? খুঁজে পেলেও সে রাজি হবে আসতে? তাকে যে বড্ড প্রয়োজন ডিএনএ টেস্টের জন্যে। সে না এলে হালিমার পক্ষে কিছুতেই মির্জার দেহাস্থি খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। আর সেটা না পেলে হালিমা মরেও শান্তি পাবে না। তার স্বামী নেই, পুত্র নেই। আছে কেবল অতীতের স্মৃতি আর মির্জার দেহাস্থি খুঁজে পাবার আশা। সাফিয়ার কাছে হয়তো এই পুত্র মৃতবৎ, কিন্তু হালিমার কাছে তো মির্জাই তার একমাত্র পুত্র।

হালিমা দমে যায় না। সাফিয়ার হদিশ সে ঠিকই খুঁজে বার করে। আর সেটা করতে গিয়েই সে আবিষ্কার করে আরেক নিষ্ঠুর সত্য কাহিনী। যে কাহিনিতে মির্জার মৃত্যুর সাথে জড়িয়ে আছে মির্জার প্রকৃত পিতা স্লাভর নাম।

এভাবেই হালিমার পথ আমাদেরকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসে বসনিয়ার এক নিতান্ত গ্রাম্য বিধবার বেদনাবিধুর জীবনপথের ধার দিয়ে।


মন্তব্য

Aaynamoti এর ছবি

'হালিমার পথ' ধরে এসে সুন্দর একখানা সিনেরিভিউ পড়া হলো। দেখবো নাগালে পেলে। আপনাকে ধন্যবাদ ভ্রাত।

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

আপনাকেও ধন্যবাদ সময় নিয়ে পড়ার জন্য

নৈ ছৈ এর ছবি

হালিমার কন্টকময় পথের গল্প পড়ে মনটা বিষন্ন হয়ে গেল

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

এই সিনেমাগুলো মনের উপর বেশ চাপ তৈরি করে

আসগর এর ছবি

সিনেমার কাহিনী আগাগোড়া বলে যাওয়াকে 'চলচ্চিত্রালোচনা' বলে না। অনেকের কাছেই এটা স্পয়লার মনে হতে পারে।

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

আপনার মতামতের জন্যে ধন্যবাদ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।