দাতো তুরাশভিলি’র জিনস জেনারেশন-১

জীবনযুদ্ধ এর ছবি
লিখেছেন জীবনযুদ্ধ [অতিথি] (তারিখ: শুক্র, ১৭/০৭/২০২০ - ১১:৪৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

তিব্লিসি শহরের সায়েন্স একাডেমীর পার্শ্বস্থিত একখানা আন্ডারপাসের মাঝ দিয়ে পথ পেরোতে গিয়ে খানিকটা বিপাকে পড়তে হয়। কারণটা– বিদ্যুৎ বিভ্রাট। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামবার পরই এই বিড়ম্বনা।

আন্ডারপাসের একধারে বেশ কিছু দোকান। খেলনার, অন্তর্বাসের, সুগন্ধির। সেখানে ধীরে ধীরে জ্বলে ওঠে হ্যাজাক বাতি। তাতে করে এ-স্থানটি কিছু মাত্রায় আলোকিত হয়। ওদিকে ডান দিকটিতে কিন্তু কোনো দোকান নেই। সেখানে ময়লা দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জনা দুয়েক ভিখিরি আর আপেল নিয়ে বসা কয়েক হকার। হকাররা সাথে থাকা সিগারেটের লাইটার দিয়ে ইতোমধ্যেই মোমবাতি জ্বালিয়ে ফেলেছে। বোঝা যায়, এ ধরণের বিদ্যুৎ বিভ্রাটের সাথে এরা বেশ সুপরিচিত। সে অবশ্য হবার-ই কথা। মাত্র এক দশক আগে সেই রুশ-জর্জিয়া যুদ্ধের সময়কালে পুরো তিব্লিসি শহরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল যখন-তখন আক্রান্ত হত বিদ্যুৎবিভ্রাটের কবলে। এখন অবশ্য সে অবস্থার উন্নতি হয়েছে। বিশেষ করে শহরের ধনী পাড়াগুলোতে বিদ্যুতের অবস্থা বেশ বাড়বাড়ন্ত। তবে নিম্নমধ্যবিত্তের পণ্যে ঠাসা দোকানমণ্ডলী সম্বলিত এ আন্ডারপাসটি বোধকরি সেসব বিশেষ অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত নয়।

এ আন্ডারপাসের ভিকিরি দুজনের একজনকে আগেও দেখেছি। ঠিক এইখানেই। ইনি অন্ধ। বিশীর্ণ কাঁপা কাঁপা হাতে কাগজের গ্লাস হাতে নিয়ে নত মস্তকে দাঁড়িয়ে থাকেন সদা। গুটি বসন্তের দাগ রয়ে যাওয়া মুখে কোনো রব নেই। গ্লাসের ভেতরে টুং করে পয়সা ফেলে দিলে কেবল বিড়বিড় করে বলেন, দিদি মাদলোবা। আজ এই আধো অন্ধকারে তাকে দেখে মনে হয়– ঠিক যেন শীতের পত্রবিহীন বিশুষ্ক বৃক্ষ; অমাবস্যার তৃতীয় পক্ষের আঁধার যে বৃক্ষের শাখাগুলোকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাইছে। দ্বিতীয় জনকে আজই প্রথম দেখছি। ইনি বৃদ্ধা। ঠোঁটের উপর দুদিকে ব্যাটা ছেলেদের মত খানিক গোঁফ। পাশের আপেলওয়ালার জ্বেলে রাখা মোমবাতির আলোয় ইনার মুখমণ্ডলের কিছুটা আলোকিত। নিজেকে বিশাল কালো ওভারকোটে মুড়ে নেয়ায় এই আলোআঁধারিময় স্থানে তার ওই মুখমণ্ডলটিকে মনে হয় নিকষ কালো পটভূমিকায় আঁকা কারাভাজিও’র একখানা দুষ্প্রাপ্য ছবি।

স্তালিন জমানায় গড়ে তোলা বিজ্ঞান একাডেমীটি এককালে জর্জিয়ায় বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্রবিন্দু হলেও আজ একে চারুকলা ভবন ভেবে ভ্রম হয়। হবেই-বা না কেন! ভবনের সুবিশাল সিঁড়ি থেকে শুরু করে টানা বারান্দা, পুরোটাই যেন চিত্রশিল্পীদের দখলে। তাদের অনেকেই পূর্বে আঁকা ছবিগুলোকে সিঁড়ির গায়ে ঠেকনা দিয়ে রেখে নতুন ছবি আঁকায় মন দিয়েছেন। ইনারা ইংরেজিতে পটু নন। দাম জিজ্ঞেস করলে হাতের চেটোতে তুলি দিয়ে টাকার অংকটা লিখে বোঝান। এই বিজ্ঞান একাডেমী কিংবা ছবির হাট– দুটোর কোনটির সন্ধানেই এখানে আসিনি। এসেছি বন্ধুবর দাতো তুরাশভিলি’র সন্ধানে। এই তুরাশভিলি হল পদবী। ভিলি মানে অমুকের সন্তান। অর্থাৎ তুরাশভিলির অর্থ– তুরাশের সন্তান। সেইভাবে দাতো’র ছেলেমেয়ের নামের পদবী হবে দাতোশভিলি।


বিজ্ঞান একাডেমী

দাতো’র এখানেই আসবার কথা। এই ভবনের পেছনে প্রায় শত বছরের পুরনো একটি বিশেষ বাড়ি দেখিয়ে ও আমাকে নিয়ে যাবে কাছের এক ক্যাফেতে। সেখানে ওর বই নিয়ে কিছু সাহিত্য অনুরাগী আলোচনায় বসবে। কোন বই নিয়ে এ আলোচনা কিংবা দাতো-র পরিচয় কী, সেটি বিশদভাবে আগেই বলে না নিলে এই লেখাটিকে এগিয়ে নেয়া কঠিন।

রুস্তাভেলি এভিনিউয়ের স্তাম্বা ক্যাফেটিকে বলা চলে এ শহরের অন্যতম বনেদী ক্যাফে। ভেতরে ঢুকতে গেলে উর্দি পরা দৌবারিক দরজার পাল্লা খুলে ভেতরে আমন্ত্রণ জানায়। উপরের তলে হোটেল। নিচে বাঁ দিকে ক্যাফে আর ডান দিকে বুক স্টোর। বাদবাকি জায়গায়টায় সিলিং অবধি ঠেসে রাখা শেলফে বইয়ের সমুদ্র। এগুলো কেবল পড়ার জন্যে। চাইলে কেও ক্যাফে থেকে কফির কাপ এনে এখানে সোফায় গা এলিয়ে পড়তে পারে, আবার হোটেলের বোর্ডাররাও অনেকে এসে বই পড়ে সময় কাটায়। পায়ের নিচে পুরু গালিচা। এখানে-ওখানে টেবিল ল্যাম্পের মৃদু আলো। আমি ওখানে বসে পাওলো কোয়ালহ-র কিলিমাঞ্জারো বইটি পড়তে গিয়েও মন বসাতে পারিনি। ভিন্ন কোনো বইয়ে মন বসানো যায় কিনা, এমন কিছু ভাবতে ভাবতে গেলাম সেই বুক স্টোরটিতে। মূলত যে লেখকদের বইগুলো সারা বিশ্বেই ভালো চলে, সেগুলোই এখানে আছে বিক্রির জন্যে ডিসপ্লেতে। এই যেমন– ওরহান পামুক, এলিফ শেফাক, জোজো ময়েস, কাজুও ইশিগারো, হেমিংওয়ে কিংবা পাওলো কোয়ালহ। তবে আমি ভাবছিলাম, এদের বইগুলো তো আমি সেই ইস্তাম্বুলের বিমানবন্দরের বুকশপ থেকে শুরু করে আমেরিকার এমাজন, যেকোনো স্থান থেকে সহজেই সংগ্রহ করে নিতে পারি। কিন্তু জর্জিয়ান কোনো লেখকের ইংরেজিতে অনূদিত বই? তেমন একটি বই হয়তো আমেরিকায় ফিরে গিয়ে আমার পক্ষে জোগাড় করা সহজ হবে না। তেমন বইয়ের সন্ধানে বুকশপটির নানা কোণে অভিযান চালাই। ফলাফল স্বরূপ যে বইটি আমার হাতে উঠে আসে, সেটির নাম– ফ্লাইট ফ্রম সোভিয়েত ইউনিয়ন। লেখক– দাতো তুরাশভিলি।

সেদিন হোটেলে ফিরেই খাটের পাশের ফিউটনে গা এলিয়ে দিলাম। হাতে রইলো বিকেলে কেনা বইটি। মলাটে একটি জিন্সের ছবি। ফ্ল্যাপে লেখা কাহিনী-সংক্ষেপ পড়ে যতটুকু বুঝেছি, একটি বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনা নিয়ে বইটির কাহিনী আবর্তিত। তাহলে এর সাথে জিন্সের সম্পর্ক কোথায়? বলা চলে সেই কৌতূহলই আমাকে বইটির শেষ পাতায় ছুটে যেতে বাধ্য করে। বন্যার জলের তোড় ঠেলে নিজের বাড়ির অভিমুখে যাবার মত করেই আমি ঘুমের প্লাবনকে দূরে ঠেলে একটু একটু করে বইটির মাঝে ডুবে যাই।

জর্জিয়া সোভিয়েত শাসনের অধীনে আসে ১৯২১ সালে। স্তালিনের নিজের দেশ এই জর্জিয়ার সকল রকমের বিদ্রোহ তখন ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করে দেয়া হয়। তবে সামগ্রিক সোভিয়েত সমাজের যে দমবন্ধ করা আবহ, তার বিরুদ্ধে এক ধরণের ক্ষোভ তৈরি হচ্ছিল দশকের পর দশক ধরে। যার কিছুটা স্ফুরণ ঘটে আশির দশকের দিকে, বিশেষত তরুণ সমাজের মাঝে। তরুণরা তখন ডিসকো গান শুনতে চায়, লিভাইসের জিনস পরতে চায়। কিন্তু সোভিয়েত কানুন অনুযায়ী এসব-ই সমাজবিরুদ্ধ কাজ। এমন ঘেরাটোপ বিদ্রোহী করে তুলল সাত যুবক-যুবতীকে। এদের সকলেই একে-অপরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ওরা ফন্দি আটে– পালিয়ে যাবে জর্জিয়া থেকে। কিন্তু পালাবে কী করে? সমুদ্র পথে পালানো প্রায় অসম্ভব। ওদিকে তুরস্কের সাথে স্থলসীমান্তে নিশ্ছিদ্র প্রহরা। অনন্যোপায় হয়ে ওরা সিদ্ধান্ত নেয়– যাত্রীবাহী প্লেন হাইজ্যাক করে তুরস্কের মার্কিন বিমানঘাঁটিতে গিয়ে পৌঁছাবে। একবার সেখানে পৌঁছাতে পারলেই কেল্লা ফতে। কিন্তু বোমা, পিস্তল? সেসব নিয়ে প্লেনে উঠবে কী করে? এই দলের সমবয়সী এক পাদ্রী ছিলেন এদের বন্ধু, কিংবা বলা চলে আধ্যাত্মিক গুরু। এরা তার শরণাপন্ন হল। কারণ– তখন তিব্লিসির এয়ারপোর্টে পাদ্রীদের দেহ তল্লাশি করা হত না। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে পাদ্রী যদি এদেরকে বোমা পিস্তল বিমানে বহন করতে সাহায্য করেন আরকী। পাদ্রী কিন্তু প্রস্তাবে সম্মত হলেন না। কারণ, তিনি ঈশ্বরের ঘরের লোক হয়ে তো আর খুনোখুনিতে অংশ নিতে পারেন না! অবশেষ সেই দলটি আরেক উপায় বাতলালো। তাদের দলের টিনা আর গেগা একে-অপরের প্রেমে মত্ত। ওরা যদি এ-বেলায় বিয়েটা সেরে নেয়, তাহলে টিনাকে গর্ভবতী সাজিয়ে ওর পেটে গোলা-পিস্তল বেঁধে প্লেনে ওঠা যায়। সে সময়ে গর্ভবতী নারীদের সিকিউরিটি চেক করা হত না। ঠিক হল, ওরা তিব্লিসি থেকে বাটুমিগামী প্লেনে চড়বে। সাথে থাকবে দলের বাকি পাঁচজন। প্লেনটি হাইজ্যাক করে বাটুমি ছাড়িয়ে আরও পশ্চিমে তুরস্কের পথে নিয়ে যাওয়া হবে।

সেদিন এয়ারপোর্টে গিয়ে ওরা শুনল, বাটুমিগামী ছোট প্লেনটির বদলে একটি বড় প্লেন দেয়া হয়েছে। আর সেই ফ্লাইটটি বাটুমিতে থেমে উড়ে যাবে লেনিনগ্রাদে। দলটি একটু দমে গেলেও বিমানবন্দর থেকে ফিরে এল না; তখন ফিরে এলে কেও সন্দেহ করতে পারে। তারা প্লেনে চাপল। তার কিছুক্ষণ পর শুরু হল হাইজ্যাকের পালা। সে আমলে প্রতিটি ফ্লাইটেই একজন করে কেজিবির এজেন্ট থাকতেন। তথ্যটি এই হাইজ্যাকার দলের ছেলেরাও জানতো। তবে তারা ভেবেছিল, সেই ছদ্মবেশী কেজিবি এজেন্ট হয়তো থাকবেন যাত্রীদের দলে। তাই সেদিকে পিস্তল তাক করে তাদের একজন যায় ককপিটে। তাদের ধারণাতেও ছিল না এই প্লেনটি বড় বিধায় এর ককপিটও বড়, আর সেই কেজিবি এজেন্ট ঘাপটি মেরে ছিল এখানেই। সেই যুবক বেখেয়ালে ককপিটে ঢোকামাত্র কেজিবি এজেন্টের গুলিতে মারা যায়। এরপর পাইলট দ্রুত মস্কোতে জানিয়ে দেন এই ঘটনা। দুটি মিগ জঙ্গিবিমান মুহূর্তেই ছুটে আসে প্লেনের দু পাশে। তাদের উপর নির্দেশ থাকে, প্লেনটি সোভিয়েত সীমানা পার হবার কোনো চেষ্টা করলে যেন গুলি করে নামিয়ে দেয়া হয়। পাইলটের নানা কারসাজিতে এরপর প্লেনটি ফিরে আসে তিব্লিসির বিমান বন্দরে। রানওয়েতে পার্ক করামাত্র স্পেশাল ফোরসের সদস্যরা প্লেনটি লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলি ছুড়তে থাকেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে নিজের দেশের সাধারণ মানুষের দাম যে কতখানি তুচ্ছ ছিল, এই হল তার প্রমাণ। অন্য যেকোনো দেশ হলে সাধারণ যাত্রীদের নিরাপত্তা আগে নিশ্চিত করতো। কিন্তু এদিকে এদের পরিকল্পনা ছিল, সাধারণ যাত্রীরা জখম হয়ে যদি আর্তনাদ শুরু করে দেয়, তবে সেই চিৎকার চেঁচামেচিতে ছিনতাইকারী দল বিভ্রান্ত হয়ে পড়বে। আর সেভাবেই ছিনতাইকারীদের গুলিতে নয়, বরং স্পেশাল ফোরসের ছোড়া গুলিতে প্রাণ হারায় প্রায় সাত জন মানুষ।

এবারে আসে বিচারের পালা। সে সময়ে জর্জিয়ায় কম্যুনিস্ট পার্টি প্রধান ছিলেন এডওয়ার্ড সোভারদেনাজ। তার পরবর্তী লক্ষ্য তখন মস্কোর মসনদ। এই ঘটনায় মস্কো যতোটা না ক্ষিপ্ত হল, তিনি হলেন তার চেয়েও বেশি। মস্কোর কাছে নিজের আনুগত্য প্রকাশে ব্যাতিব্যস্ত হয়ে তিনি এই দলটিকে চরম শিক্ষা দিতে চাইলেন। ফলে নীরবেই যেন বিচারের রায় নির্ধারিত হয়ে গেল। সেদিনের ঘটনায় যারা প্রাণ হারিয়েছিল, তারা গুলি খেয়েছিল স্পেশাল ফোরসের। কিন্তু যাত্রীদের মাঝে কয়েকজনকে নানা প্রকার হুমকি-ধামকি দিয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে রাজি করান হল। তাদেরকে বলতে বলা হল– গুলি চালিয়েছিল এই ছিনতাইকারীরাই। ওদিকে এই সাতজনের দলটির কারুর পক্ষেই উকিল নেই, এমনকি তাদের পরিবারকেও রাখা হল অন্ধকারে। ও হ্যাঁ, মজার ব্যাপার হল, সেই পাদ্রী যিনি কিনা এ অভিযানে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন, তাকেও রিং লিডার হিসেবে ফাঁসানো হল। জর্জিয়ানদের কাছে গির্জা বড় পবিত্র স্থান, তাই সেই পাদ্রীকে ফাঁসিয়ে তাদের এক সংবেদনশীল স্থানে ছুরি চালিয়ে দেয়া হল।

বিচার অনুষ্ঠিত হল আগস্ট মাসে। সে-কালে সোভিয়েত ইউনিয়নে এই আগস্ট মাসে সকলেই ছুটি কাটাতে নানা স্থানে চলে যেতেন (এই সংস্কৃতিটি এখনো আছে)। ফলে শহরগুলো হয়ে পড়তো স্থবির। বিচারের জন্যে এই সময়টি বাছার কারণ হল– লোকে তখন ব্যস্ত থাকবে দূরের সমুদ্রতটে। বহু দূরে তিব্লিসিতে চলমান বিচার নিয়ে তাদের মাথা ব্যাথা থাকবে না। খুব দ্রুত বিচার করে এদেরকে ফাঁসি দিয়ে দেয়া হল। এর মাঝে আরও একটি ঘটনা ঘটে। ছিনতাইকারী দলের একমাত্র নারী সদস্য টিনা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। সেই টিনার অনাগত সন্তান যাতে সাধারণ মানুষের সহমর্মিতায় কোনোভাবেই ভাগ না বসাতে পারে, সে জন্যে টিনার শরীরে বিষাক্ত ইনজেকশন পুশ করে গর্ভপাত ঘটানো হয়। আর সকল ক্ষেত্রে ফাঁসির আদেশের পর সাধারণত কয়েক বছর লেগে যায় মস্কো হয়ে রিভিউ আসতে। কিন্তু এক্ষেত্রে অস্বাভাবিক দ্রুততায় মাত্র দু মাসের মাঝেই ফাঁসি কার্যকর করা হল। সবচেয়ে মর্মান্তিক ব্যাপার হল, ফাঁসির পর এদের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর না করে অজানা স্থানে সমাহিত করা হল। পরিবারগুলো তাই পরের বিশটি বছর হন্যে হয়ে তাদের নিকটজনদের কবর খুঁজে বেড়ায়।

সেই সোভারদেনাজ, যার কারণেই বলা চলে বিচারের নামে এমন এক প্রহসন ঘটে, তিনি এর দু বছর পর সারা সোভিয়েত ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নির্বাচিত হন (নির্ভেজাল আনুগত্যের পুরস্কার স্বরূপ) । গরবাচেভের পর সে-সময়ে তিনিই ছিলেন দ্বিতীয় ব্যক্তি, যিনি বিদেশ নীতি প্রস্তুত করতেন। ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার সময়ে পশ্চিমা দেশগুলোর সাথেও তার বেশ সখ্যতা তৈরি হয়। মজার ব্যাপার হল, জর্জিয়া স্বাধীন হবার এই ইনি, যিনি কিনা নিজেকে সাচ্চা কম্যুনিস্ট প্রমাণে এই এতোসব দমন-পীড়ন চালিয়েছিলেন, তিনি-ই আবার গণতন্ত্রী সেজে জর্জিয়ার প্রেসিডেন্ট হয়ে বসেন। তারপর দেশ শাসন করেন এক যুগেরও বেশি সময়। ফলে দাতো তুরাশভিলি যখন এই বইটি লিখে এর একটা নাট্যরূপ নব্বই-এর দশকে দাঁড় করান, তখন অনেকেই সরকারি রোষানলের ভয়ে সেই নাটক মঞ্চস্থ করতে চায়নি। আর সেভাবেই ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর হাহাকার গণমানুষের কাছে পৌছুতে জর্জিয়ার স্বাধীনতার পরও প্রায় দেড় যুগ অপেক্ষা করতে হয়েছে।

‘ফ্লাইট ফ্রম সোভিয়েত ইউনিয়ন’ আমাকে এর লেখক দাতো সম্পর্কে কৌতূহলী করে তোলে। এই বইটি যেহেতু ইতিহাসাশ্রয়ী, তাই এটি লিখতে গিয়ে তিনি নিশ্চয়ই এই পুরো ঘটনার সাথে জড়িত বহু মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, আশির দশকের সেই উন্মাতাল সময়ে তিনি নিজেও ছিলেন ছাত্র। সে সময়কার সামাজিক বিপ্লবকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য বা সুযোগ কিছুটা হলেও তার হয়েছে। এমন একজন লেখকের সাথে পরিচিত হয়ে যদি খানিক আলাপ করা যায়, তবে তো বেশ হয়।

স্তাম্বা ক্যাফের বুক শপে

পরদিন আমি আবার গেলাম সেই স্তাম্বা ক্যাফের বুক শপে। বেশ বড় বুক শপ হলেও বিক্রেতা মাত্র একজন। তাই কেও কোনো বই নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি এ-মাথা থেকে ও-মাথায় ছুটে গিয়ে সাহায্য করছেন। আবার পরমুহুর্তেই হয়তো ফিরে আসছেন ক্যাশ রেজিস্টারে। নাকের কাছে আটকে থাকা চশমাটা এই ছুটোছুটির কবলে পড়ে মাঝে মাঝেই ঢলে পড়ছে নিচে। গতকাল এখান থেকে যখন বইটি কিনেছিলাম, তখন বুকশপের কোণের দিকে এক লেখক জনা পনের ভক্ত নিয়ে একটি পাঠালোচনা সভা পরিচালনা করছিলেন। এ ধরণের বড় বুক শপগুলো আজকাল অনেক সময়েই এমন লেখক-পাঠকের মিলন মেলার আয়োজন করে, ব্যাপারটা তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থেই। সে কারণেই মনে হয়েছে এদের কাছে দাতো-র সন্ধান থাকলেও থাকতে পারে।

বিক্রেতা মহিলাটিকে দাতো-র কথা জিজ্ঞেস করতেই তিনি ফিক করে হেসে দেন। তারপর একটা স্টিকিপ্যাড হাতে নিয়ে তাতে খস খস করে একখানা ইমেইল এড্রেস লিখে কাগজটি আমার দিকে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘দাতো আমার স্বামী। আপনি ওকে মেইল করে দেখুন। সময় থাকলে নিশ্চয়ই হয়তো আপনার সাথে দেখা করবে।’ এদের কাছে দাতো-র সন্ধান পেতে পারি, তেমন একটি আশা মনে ছিল, কিন্তু তাই বলে একেবারে ওর স্ত্রীর কাছেই ওর হদিস জিজ্ঞেস করবো, এতটা নাটকীয় মুহূর্তের জন্যে প্রস্তুত ছিলাম না। মহিলাকে অশেষ ধন্যবাদ জানিয়ে সেই বুক-ক্যাফের এককোণে রাখা একটি কম্পিউটার থেকে দাতো-কে মেইল করে সাক্ষাতের আগ্রহ জানিয়ে রাখলাম।

কী আশ্চর্য! উত্তর পেলাম সেদিন রাতেই। নিজের ফোন নম্বরখানা উল্লেখ করে দাতো লিখেছে– কাল চল, কোথাও দেখা করা যাক। তোমার কাছ থেকে আমি বাংলাদেশের কথা শুনতে আগ্রহী।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

প্রায় তিন বছর পর লিখলেন। আপনার লেখা পড়লে লেখালেখি করার ইচ্ছেটা জেগে ওঠে,মনে হয়,বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি? স্থান-কাল-গল্প মানুষের গল্প/পুরনো-নতুন দিনের গল্প/চেনা-অচেনা পৃথিবীর গল্প।

রাজর্ষি

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

হ্যাঁ, বেশ লম্বা একটা বিরতির পর সচলে লিখলাম।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ লেখাটি পড়ার জন্যে

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

দাতোর ছেলে দাতোভিলি না হয়ে দাতোশভিলি হবে কি ওই সমাস না ব্যাকরণ কী যেন বলে সেগুলোর কারসাজিতে?

দাতো'র সঙ্গে পরের পর্বে কী কথা হলো সেসব লেখার মতো হলে লিখে ফেলেন। আগ্রহী পাঠক আছে। হাসি

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

নামের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা হয়তো তেমনই এক কারসাজির ফল।
দাতো'র সাথে বাকি কথোপকথন আসছে পরের পর্বে । ধন্যবাদ আপনাকে

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

স্বীকার করতেই হবে তোমার লেখার স্টাইলে ব্যাপক উন্নতি ঘটিয়েছ। এই স্টাইলটা আরও আকর্ষনীয়, আরও আগ্রহোদ্দীপক। পরবর্তী পর্ব দ্রুত আসুক।

Eduard Shevardnadze'র নামের উচ্চারণটা ঠিক কী হওয়া উচিত?


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

ধন্যবাদ পাণ্ডব দা। ওরা দেখলাম, শেওয়ারদেনাজ বলে।

তারেক অণু এর ছবি

পরের পর্বের জন্য অপেক্ষা করছি।

বাটুমির নাম দেখে মনে হলো যে পাখি দর্শক, আলোকচিত্রগ্রাহক, গবেষক এবং রিংগার সকলের কাছেই জর্জিয়া এক তীর্থভূমি, পরিযায়নের পথে পড়ায় লাখ লাখ পাখি সেখানে দেখতে ভিড় জমায় সবাই, বছরে দুই বার ।

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

বাটুমি আর সোচি, এ দুটি শহর একসময়ে গোটা সোভিয়েত দেশের মানুষের জন্যে ছিল তীর্থ ভূমি। সবার মনেই স্বপ্ন থাকতো একবারের জন্যে হলেও গ্রীষ্মের ছুটিতে এখানে আসবার। তবে এখন বাটুমি সেই আগের জৌলুশ আর আকর্ষণ হারিয়েছে অনেকটাই।

যেতে চেয়েছিলাম। একজন শুনে বলল, 'হোয়াট টু সি দেয়ার আদার দ্যান সাম রাশান হুকারস?'

এক লহমা এর ছবি

চলুক
পরের পর্বের জন্য সাগ্রহ অপেক্ষায় থাকলাম

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

ধন্যবাদ, আসবে শীঘ্রই

নৈ ছৈ এর ছবি

রঙ্গিন ছবির সাথে তরতাজা লেখা পড়ে খুব ভাল লাগলো। পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ আপনাকে

সৈয়দ আখতারুজ্জামান এর ছবি

আগাগোড়া পড়লাম। বেশ লেগেছে। যখন আর তখনের মাঝখানে হাইপেন দিলেন। দোকানের সাথে মন্ডলী যোগ করলেন। ভিখিরকে ভিকিরি বললেন। কোথাও কোথাও দারুণ মানানসইভাবে সেই পুরনোকালের সদা, রব, আধো, বিশুষ্ক, ভ্রম শব্দগুলো ব্যবহার করলেন। ‘ভালোবাসে না’ না বলে বললেন ‘প্রেমে মত্ত’। হা হা হা... সুখপাঠ্য হয়েছে।
বিদেশী শব্দ দিদি মাদলোবা, ভিলি শব্দ দুটো পেলাম। যদিও দিদি মাদলোবার মানেটা পেলাম না।
বহুদিন কারাভাজিওর নাম কারো মুখে শুনিনি। সেই সূত্রে রাশিয়ার অন্যতম নামকরা পেইন্টার নিকোলাস রোরিকের কথা মনে পড়ে গেলো। মানালিতে তার বাড়ি-যাদুঘরে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিলো।
খুব রোমাঞ্চিত হয়েছি যখন লিখেছেন, “আজ এই আধো অন্ধকারে তাকে দেখে মনে হয়– ঠিক যেন শীতের পত্রবিহীন বিশুষ্ক বৃক্ষ; অমাবস্যার তৃতীয় পক্ষের আঁধার যে বৃক্ষের শাখাগুলোকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাইছে।“ অথবা, “আজ এই আধো অন্ধকারে তাকে দেখে মনে হয়– ঠিক যেন শীতের পত্রবিহীন বিশুষ্ক বৃক্ষ; অমাবস্যার তৃতীয় পক্ষের আঁধার যে বৃক্ষের শাখাগুলোকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাইছে।"
বাকিটা জানার অপেক্ষায় থাকলাম.....

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

আপনি যে পুরোটা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়েছেন, সেটা মন্তব্য দেখে টের পাওয়া যায়। অনেক ধন্যবাদ সেজন্যে।
কারাভাজিও'র কিছু মাস্টারপিসের দেখা পাওয়া যায় ফ্লরেন্সে। সেগুলো এখনো মাথায় ঢুকে আছে।
'দিদি মাদলবা''র অর্থ 'অনেক ধন্যবাদ।'
পরের পর্ব নিয়ে আসছি খুব শীঘ্রই।

ওডিন এর ছবি

দুর্দান্ত লাগল। পরের পর্বের সাগ্রহ অপেক্ষায়

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

ধন্যবাদ। চেষ্টা করবো খুব শীঘ্রই দ্বিতীয় পর্ব প্রকাশ করতে

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

তোমার কাছ থেকে আমি বাংলাদেশের কথা শুনতে আগ্রহী।

বাহ! তাকে কি কি বললেন- সেটি শুনতে আমরাও আগ্রহী! পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।