ড্রেসডেনের ভগ্নী মন্দির

জীবনযুদ্ধ এর ছবি
লিখেছেন জীবনযুদ্ধ [অতিথি] (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৭/০৮/২০২০ - ৬:২৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ট্রেনের জানালা অফুরান মাঠ গাছ গম্বুজ
অতি দ্রুত ধাবমান ছবিরং স্বপ্নসবুজ
হাত তুলে সহযাত্রী দেখায় সমবায় ক্ষেত
ট্রাক্টর গরু নবীনধবল। দূর সংকেত………
এইবার বুঝি পৌঁছুবে এই রূপকথা ট্রেন,
দুই চোখ দুই শবরীর মত, দূরে ড্রেসডেন।
( ড্রেসডেন, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র)

১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়। পূর্ব জার্মানির ড্রেসডেন শহর তখনও শীতের চাদরে মোড়া। শহরের পথে পথে স্ফটিকের মত তুষারের দানা। তাদেরকে মাড়িয়ে পথ চলতে গেলে মিহি আর্তনাদের শব্দ শোনা যায়। কনকনে ঠাণ্ডার মাঝে পাক খেয়ে ভেসে বেড়ায় এল্বে নদী থেকে ছুটে আসা বিষণ্ণ বাতাস। অন্য সময়ে এল্বের উপর ছোট ছোট স্টিমার নৌকা ভেসে বেড়ালেও, এখন তারা উধাও। যুদ্ধ চলছে, তাই তারাও ছুটি নিয়ে অপেক্ষা করছে দূরের কোনো গুপ্ত বন্দরে।

ড্রেসডেন শহরটাকে অনেকে ডাকেন জার্মানির ফ্লোরেন্স বলে। সেটা শুধু স্থাপত্যের কারণে-ই নয়, বরং কয়েক শ বছর ধরে ড্রেসডেন যেভাবে শিল্পী সাহিত্যিকদের আলোছায়া দিয়ে বেড়ে তুলেছে, সে কারণে খুব সম্ভবত। তবে সেই শিল্পী সাহিত্যিক কিংবা স্থাপত্য– সবায়ের কপালেই যুদ্ধের ডামাডোলে নেমে এসেছে দুর্যোগের ঘূর্ণিঝড়। শহরের ইহুদি আর্ট ডিলার, শিল্পী– এরা তো বহু আগেই মালবাহী ওয়াগনের মাধ্যমে চালান হয়ে গেছেন ত্রেবলিঙ্কা কিংবা সোবিবরে। সেখানে ট্রেন থেকে নামামাত্র তাদেরকে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে মানুষ পোড়াবার চুল্লিতে। বাকি ছিলেন বিশুদ্ধ আর্য রক্তের অধিকারী আদি বাসিন্দাগণ। তারা ভেবেছিলেন, ড্রেসডেনের ঐতিহ্যবাহী চার্চগুলোর ঘণ্টাঘর, কিংবা দুশ বছর পুরনো জাদুঘরের সুনামই মিত্র বাহিনীর বিমানগুলোকে বাধ্য করবে নাক ঘুরিয়ে ভিন্ন দিকে চলে যেতে। হাজার হোক, শিল্প সমঝদার বলে তো ব্রিটিশদেরও খ্যাতি আছে।

যে সময়ের কথা বলছি, তখন ভিস্তুলা নদী পেরিয়ে সোভিয়েত বাহিনী পোলিশ রাজধানী ওয়ারশ-এ পৌঁছে গেছে। ওদিকে প্রায় দেশ মাস তুমুল যুদ্ধের পর লাল বাহিনীর বেলারুশিয়ান ইউনিট পৌঁছে গেছে বুদাপেস্টেও। ফলে অস্ট্রিয়া আর পোল্যান্ড পেরিয়ে জার্মানির অভ্যন্তরে তাঁদের প্রবেশ ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র।

আর তাই যুদ্ধের এই অন্তিম পর্যায়ে মিত্র বাহিনী যে ড্রেসডেন শহরকে বোমা মেরে মাটিতে শুইয়ে দিতে পারে, সেটি ছিল অনেকেরই চিন্তাতীত। কিন্তু বাস্তবে সেটাই ঘটেছিল।

ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখে হটাতই ড্রেসডেনের আকাশে পঙ্গপালের দলের মত ছুটে আসে কয়েক শ বোমারু বিমান। কয়েক হাজার বোমা আকাশ থেকে ছুঁড়ে দিয়ে তারা পালিয়ে যায়। পরদিন এই ধ্বংসলীলায় আরেক দফা আগুন লাগাবার জন্যে উপস্থিত হয় মার্কিন বোমারু বিমানের দল। যে কাজটুকু ব্রিটিশ বিমানগুলো পারেনি, সেটুকু সম্পূর্ণ করে এই মার্কিন বিমানগুলো।

গোটা শহরটাই পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে। প্রায় পঁচিশ হাজার মানুষ তো দগ্ধ হয়ে মারা যায়-ই, তার চেয়েও বড় কথা হল, অমূল্য স্থাপত্যগুলো কংকালের মতো হতশ্রী চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য হয়।

সকল স্থাপত্যের মাঝে যেটির জন্য ড্রেসডেনের মানুষের পরিতাপের অন্ত ছিল না, সেটি হল ফ্রাউয়েন কিরশে। ফ্রাউয়েন মানে যুবতীগণ, আর কিরশে মানে গির্জা। তাই বাংলায় ভাবান্তর করলে এটিকে হয়তো বলা যায়– ভগ্নী মন্দির। প্রায় আকাশের কাছে উঠে যাওয়া এই গির্জাটির গায়ে আকাশ থেকে উল্কাপিণ্ডের মতো ঝসে পড়া হাজার কেজি ওজনের বোমা তৈরি করেছিল স্থায়ী ক্ষত। বুলেটের ক্ষত যেমন কয়েকদিনের মাঝেই অঙ্গপ্রত্যঙ্গে সংক্রমণ ঘটিয়ে মানুষকে মেরে ফেলে, তেমনি এই বোমার ক্ষতও ভগ্নী মন্দিরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেয়নি। দুদিন বাদেই হুড়মুড় করে বিশাল এই গির্জাটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।

শুধু সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকে ভেঙে পড়া চার্চের এক টুকরো খাড়া দেয়াল।

বহু পরে নব্বই-এর দশকে দু জার্মানি একত্র হলে বিলেতি সাহেবরা নিজেদের ভুল স্বীকার করেন। তারা স্বীকার করেন, জার্মানি শত্রু দেশ হলেও সেদিন ড্রেসডেনকে মাটিতে মিশিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা ছিল অপ্রয়োজনীয়। এটা সত্য যে, তখন ড্রেসডেনের রেল স্টেশন ছিল পূর্ব-পশ্চিমে সেনা আনা-নেয়ার মূল জংশন, কিন্তু তারপরও চাইলে শহরের এই অসামরিক স্থাপনায় হামলা এড়ানো যেত। অনুতপ্ত ব্রিটিশ রাণী ঘোষণা দেন– ব্রিটিশ জনগণের অর্থে আবারও নতুন করে ভগ্নী মন্দিরটিকে গড়ে দেয়া হবে।

হলও তাই। আগের বহু ছবি দেখে, কম্পিউটারে মডেল করে ঠিক আগের মতোই, আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে গেল ফ্রাউয়েন কিরশে। আর সেটি দেখার কল্পেই আজ আমি চলেছি ড্রেসডেনের পুরনো শহরের কেন্দ্রস্থলে।

যুদ্ধের পর যখন গোটা শহরটাই এক ভগ্নস্তূপ, সমাজতান্ত্রিক সরকার ঘোষণা করেছিল– সবকিছু বুলডোজার দিয়ে মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে সোভিয়েত স্টাইলে আবাসন গড়ে তোলা হবে। এতে নগরবাসী ব্যাথিত হয়। তাঁদের অনুনয়ের ফলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, পুরনো শহরটাকে হয়তো আবারও আগের আদলে গড়ে তোলা হবে, কিন্তু বাকি ভাগটাকে ভিন্ন ভাগ্য বরং করে নিতে হবেই। আর সেভাবেই পুরনো শহরের বাইরের অঞ্চলে দাঁড়িয়ে গেল বাক্সের মত কিছু কংক্রিটের ইমারত। আমি যে হোটেলে উঠেছি, সেটি ওই অঞ্চলেই। সেখান থেকে এল্বে নদীর ধারে এসে পৌঁছেছি বাসে করে।

নদীর এপারটাতেই সেই পুরনো শহর। সেখানে যেতে হলে নদীর ধারে দাঁড়িয়ে থাকা বেলে পাথর নির্মিত ঘাটের সিঁড়ি পেরিয়ে যেতে হয়।

আজ এই সকালে সেই সিঁড়ির এক কোণে ছোট একটা টেবিল পেতে বসেছেন এক চিত্রশিল্পী। মাথায় কালো লম্বাটে হ্যাট, আর পরনের কালো কোটটি অদূরের গাছের ডালে টানিয়ে রাখা। ভদ্রলোক কেবলই আঁকার সরঞ্জাম বের করে নিয়ে বসেছেন। এখনো কোনো আঁকায় হাত দেননি। নতুবা তার কাজের একখানা নমুনা হয়তো এখুনি দেখে নেয়া যেত। তাকে পেছনে ফেলে পুরনো শহরে ঢোকার মুখে দেখি, এক কোণে ভূতের মত চেহারা নিয়ে এক লোক দাঁড়িয়ে। বেশভূষা মাইকেল জ্যাক্সনের মত। পাশে যিনি দাঁড়ানো, তিনি খুব সম্ভবত ছেলেটির মা। মাথায় জামরঙা হিজাব। ছেলেকে দ্রুত তৈরি হয়ে নিতে সাহায্য করছেন। মা-ছেলে হয়তো সিরিয়ান শরণার্থী। সব কিছু পরিপাটি করে দিয়ে সেই ভদ্রমহিলা বিদায় নিলেন। আর সেই যুবক পাথরের মূর্তির মত দাঁড়ালেন আল্টমার্কট বা পুরনো বাজার চত্বরের এক কোণে। পায়ের সামনে পড়ে রইলো অনুদান সংগ্রহের টুপি।

জার্মানির আর সব শহরের মত এ শহরেও হয়তো নেমেছে শরণার্থীর ঢল। আমার হোটেলের কাছেই এ-শহরের কর্মসংস্থান অফিস। এদেশের ভাষায় যার নাম– আরবাইটস-আমট। সকালে বাসে ওঠার সময়ে দেখলাম, অফিসের সামনের ফুটপাথে বহু যুবক বসে আছে। অফিস খোলার অপেক্ষায়। মুখগুলো শুকনো, ভাষাহীন। কপালের কুঞ্চনে অনিশ্চয়তায় অব্যাক্ত ছাপ। জার্মানির মত চৌকস দেশ হয়তো কাজকর্ম কিছু শিখিয়ে খুব দ্রুতই এদেরকে মূল কর্মশক্তি প্রবাহে যুক্ত করে নেবে, কিন্তু ড্রেসডেনের মত শহর যেখানে কিনা নব্য নাৎসিদের কর্মকাণ্ড সর্বজনবিদিত, সেখানে তারা আদৌ টিকতে পারবে কি? জানি না। অবশ্য আমি এখানে যাঁদেরকে দেখছি, তারা পালিয়ে এসেছে যুদ্ধের গোলার মুখ থেকে, পালিয়ে এসেছে সেই কমলালেবুর বাগান থেকে যার কাণ্ডে লেবুর পরিবর্তে ঝোলে সবুজাভ গ্রেনেডের খোল। তো সেই তাঁদের কাছে এখানকার নব্য নাৎসিদের আচরণ আর কতটুকুই বা প্রতিকূল বলে প্রতিভাত হতে পারে?

ড্রেসডেনে এসে পৌঁছেছিলাম গতকাল মধ্যাহ্নে। গতকালই ইচ্ছে ছিল পুরনো শহরের এই চত্বরে ছুটে আসার। কিন্তু মজার এক ট্রেন ভ্রমণ করতে গিয়ে দিনের বাকি ভাগের অনেকটাই খরচ হয়ে যায়। সেই ট্রেন ভ্রমণ নিয়েও না হয় এখানে দুকথা বলে যাই।

যে ট্রেনের কথা বলছি, সেটি আদতে শিশুদের চড়ার ট্রেন। শহরের এক প্রান্তে বিশাল উদ্যান। সেই উদ্যানের চারধারে পাতা এই ট্রেনের লাইন। মজার ব্যাপার হল, এই ট্রেনের কন্ডাকটর, লাইন-ম্যান সবাই শিশু-কিশোর। সবার পরনে নীল শার্ট, মাথায় হ্যাট। কয়লা চালিত ট্রেনের ইঞ্জিন যখন ভুসভুসিয়ে সাদা ধোঁয়া চারদিকে ছড়িয়ে প্ল্যাটফর্মে এসে থামে, তখন তারা পাকা টিকেট-চেকারের মত টিকেট পরখ করে বগিতে যাত্রী ওঠায়। তারপর শুরু হয় মন্থরগতিতে সেই রোমাঞ্চকর ট্রেন ভ্রমণ। ঝিক ঝিক শব্দে ট্রেন চলে, ধোঁয়ার সাদা ফিতে পাক খেয়ে ছুঁতে চায় আশেপাশের পত্রালীকে। পার্কের জমিনে বেড়ে ওঠা হাঁটু সমান বেয়ারা ঘাসের পাশ দিয়ে চলার সময়ে অনেক সময়ে দেখা যায় পাশের শেডে মেরামতের অপেক্ষায় কিংবা বিশ্রামে থাকা আরও কিছু ইঞ্জিন। আবার কখনো দেখা যায়, সেডার গাছের পাতার সামিয়ানার নিচে বিশ্রামরত মানুষ।

এই ট্রেনটি কিংবা এমনতর ট্রেন খুব সম্ভবত পূর্ব জার্মান অংশেই আছে। কারণ, এগুলো মূলত তৈরি হত সোভিয়েত ইউনিয়নে। সর্বপ্রথম এমন একটি ট্রেন যাত্রা শুরু করেছিল মস্কোর গোরকি পার্কে, ১৯৩২ সালে। মিনিমাম গেজ লাইনে চলা এই ট্রেনগুলো যেন বাস্তব ট্রেনের একটি লিলিপুট সংস্করণ। তখনকার সময়ে ইয়ং পাইওনিয়ার দলের শিশু কিশোরদের এই ট্রেনের নানা কর্মে লাগানো হত। যাতে করে তারা ট্রেনের যান্ত্রিক আর রক্ষণাবেক্ষণের নানা ব্যাপার হাতে-কলমে শেখে। আমার মনে হয়, পশ্চিম জার্মানির অংশ থেকে সমাজতন্ত্র বিদায় নিলেও সেই শিশুদের স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে ট্রেনের নানা কাজ চালাবার রীতিটা হয়তো এখনো বিদায় নেয়নি। এখানে যে কিশোর-কিশোরীরা কাজ করছে, তাদের মুখশ্রী দেখে মনে হল, বেশ কৌতূহল আর আনন্দ নিয়েই কাজটি করছে। এই বয়সেই বেশ দায়িত্বপূর্ণ কাজ পেয়ে বেশ উল্লসিত ওরা।

ফিরে আসি পুরনো শহরের কথায়। আজ সকালে ব্রেকফাস্ট না করেই হোটেল থেকে বেরিয়েছি। তাই ‘ভিয়েনার ফাইনবেকার’ নামক ক্যাফেতে ঢুকে অর্ডার করে বসি কিউই’র টুকরো বসানো পেস্ট্রি আর ব্ল্যাক টি। দোকানের দেয়ালে একটি ফলকে লেখা, এটি নাকি শহরের অন্যতম সেরা ক্যাফে, একশ বছরেরও বেশি আগে প্রতিষ্ঠিত। দোকানের সুনামের কথা যা এখানে লেখা আছে, সেটা যে ফাঁকা বুলি নয়, তা টের পেলাম ওই পেস্ট্রি খেয়েই। মধুময় তুলোর মত সেই পেস্ট্রি খাবার পর ব্ল্যাক টি-কে খানিকটা বিস্বাদ ঠেকল। তাই চায়ের পেয়ালা পুরোটা শেষ না করেই আবারও মূল চত্বরে বেরিয়ে আসি।

লুথেরান মতাদর্শের প্রবক্তা মারটিন লুথারের বিশাল প্রস্তরনির্মিত ভাস্কর্যের পাশেই ভগ্নী মন্দির। সেখানে চাইলে যে কেও ঢুকে যেতে পারে। কেও বাঁধা দেবে না। তবে হ্যাঁ, এর এক পাশে থাকা ঘোরানো সিঁড়ির মসৃণ পথ বেয়ে কেও যদি চুড়োতে পৌঁছাতে চায়, তবে তাকে কিছু মালকড়ি ঢালতে হবে। বেশ খানিকটা মেহনতের সম্ভাবনা মাথায় নিয়েই আমি সে টিকেট কিনে গির্জার ভেতরে ঢুকে পড়ি।

ইউরোপে এ ধরণের বিশালাকার চার্চে ঢুকলেই যেন অর্গান পাইপ, প্রধান বেদি কিংবা মেরির সাথে দেবদূতদের ভাষা বিনিময়ের ভাস্কর্যগুলো থেকে পাওয়া যায় দূর অতীতের সুতীব্র ঘ্রাণ। বোঝা যায়, বহু বছর ধরে ভক্তদের ধূপধুনী, পদভার আর স্পর্শ সাথী করে সেই গির্জাগুলো এই এতোটা পথ পাড়ি দিয়েছে। কিন্তু সেই গির্জাটি সেসব দিক দিয়ে একেবারেই যেন স্বতন্ত্র। মূল বেদির দু পাশে সারি বেঁধে রাখা কাঠের বেঞ্চের বার্ণিশ এখনো ঝকঝকে, ভক্তদের অবিরল চুম্বনে তার রঙে এখনো কালচে ভাব আসেনি। ওদিকে গোলাকার এই গির্জার দেয়ালে আঁকা যে ফ্রেস্কগুলো, ওগুলোর উজ্জ্বলতা দেখে যে কেউই বলে দিতে পারবেন, হয়তো বছর কয়েক আগেই আঁকা সেগুলো। আমাকে তাই আভ্যন্তরীণ পরিবেশ ততটা মুগ্ধ করে না।

আমি চলে যাই সিঁড়ি বাইতে। যদিও বলছি সিঁড়ি, আসলে হয়তো এটি সিঁড়ি নয়। বরং একে ঢালু পথ বলা যেতে পারে। পাহাড়ের গায়ে যে কায়দায় ঘোরানো পথ বানিয়ে উপরে টেনে নেয়া হয়, ঠিক সেভাবেই এই গোলাকার গির্জার চারধারে সেই পথকে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে নিয়ে দর্শনার্থীকে পৌঁছে দেয়া হয় একেবারে চুড়োর মাথায়।

সেখানে পৌঁছুতেই প্রায় পুরো ড্রেসডেন শহরটাই যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে। নদীর ওপরকার সেতুটিকে কাঁপিয়ে সেই মুহূর্তে চলে যাচ্ছে একটা হলদে ট্রাম। নদীর ধারে নোঙর ফেলে যাত্রীর অপেক্ষায় বসে আছে বিলাসী স্টিমার। এসবেরও বহু দূরে, যেখানটায় কালচে সবুজ পাহাড় রচনা করেছে শহরের সীমানা, সেখানে মেঘাচ্ছন্ন পুরো আকাশ নুয়ে পড়ে মিতালীর আহবানে।

এল্বা নদী থেকে ছুটে আসা দুরন্ত বাতাসে মাথায় থাকা টুপিটি উড়ে যাবার উপক্রম হয়। সেটিকে আঁকড়ে ধরে আমি আশেপাশের এইসব দৃশ্যাবলী তন্ময় হয়ে দেখি।


মন্তব্য

তাসনীম এর ছবি

চমৎকার। ড্রেসডেনে মিত্রবাহিনীর নির্বিচারে বোমাবর্ষণের উপর নেটফ্লিক্সে একটা ডকুমেন্টারি দেখেছিলাম।

________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

ধন্যবাদ তাসনীম ভাই। হ্যাঁ, ওই বোমাবর্ষণকে আজকাল অনেকেই যুদ্ধাপরাধ বলে। শুধু ড্রেসডেন-ই নয়, কাছে শহর লাইপসিস কেও একই সময়ে বোমা মেরে মাটিতে মিশিয়ে দেয়া হয়েছিল। দুটোই ছিল অপ্রয়োজনীয়।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

সর্বপ্রথম এমন একটি ট্রেন যাত্রা শুরু করেছিল মস্কোর গোরকি পার্কে, ১৯৩২ সালে। মিনিমাম গেজ লাইনে চলা এই ট্রেনগুলো যেন বাস্তব ট্রেনের একটি লিলিপুট সংস্করণ। তখনকার সময়ে ইয়ং পাইওনিয়ার দলের শিশু কিশোরদের এই ট্রেনের নানা কর্মে লাগানো হত। যাতে করে তারা ট্রেনের যান্ত্রিক আর রক্ষণাবেক্ষণের নানা ব্যাপার হাতে-কলমে শেখে।

আহা, মিশকা আর দুই ইয়ারের কথা মনে পড়ে গেল। ইয়ে, মানে...

তারা পালিয়ে এসেছে যুদ্ধের গোলার মুখ থেকে, পালিয়ে এসেছে সেই কমলালেবুর বাগান থেকে যার কাণ্ডে লেবুর পরিবর্তে ঝোলে সবুজাভ গ্রেনেডের খোল। তো সেই তাঁদের কাছে এখানকার নব্য নাৎসিদের আচরণ আর কতটুকুই বা প্রতিকূল বলে প্রতিভাত হতে পারে?

হুম! সৃষ্টির সেরা জীব বনাম সৃষ্টির সেরা জীব! মন খারাপ

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

মিশকা আর দুই ইয়ারের গল্পটা কোন বইয়ের?

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

মিশকার খোঁজ এখানে পাবেন, (আরেকটা ছিল, খুঁজে পাচ্ছি না) আর দুই ইয়ারকে এখানে পাবেন।

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

ব্রাত্য নীল এর ছবি

নিবন্ধ টি পড়ে খুব ভালো লাগলো । ড্রেশডেন সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারলাম।
আপনার লেখা চমৎকার।

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

ধন্যবাদ ব্রাত্য নীল

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

ড্রেসডেনের বোমাবর্ষন হয়েছিল নিজেদের কৃতিত্ব জাহির করার জন্য? জার্মানীকে পরাস্ত করার কৃতিত্বটা সোভিয়েতদের না দিয়ে নিজেদের করে নেয়া?

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

কৃতিত্ব জাহির কিংবা হয়তো লন্ডন-কোভেন্ট্রিতে বোমা হামলার প্রতিশোধ নেয়া।

নৈ ছৈ এর ছবি

চমৎকার লেখা! ড্রেসডেনে যাওয়া হয়নি, লেখা পড়ে মনে হচ্ছে এখনি চলে যাই। আরো লিখুন।

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকে

রাজর্ষি  এর ছবি

এলবের পাড়ে কত ইতিহাসের সাক্ষী ড্রেসডেন। এক জায়গায় দেখেছিলাম জার্মান সাক্সনী রাজাদের ছবি একে একে আঁকা। ফ্রাউয়েন কিরশের আশেপাশে। একটা মিউজিয়ামে দেখেছিলাম বিশ্বযুদ্ধের বোমার ধ্বংসাবশেষ দিয়ে কেউ প্রেশার কুকার তৈরি করেছিল সেসময়। হালের ন্যাশনালিস্ট পেগিডা আন্দোলনের হাওয়াও এশহরেই বেশি লেগেছিল এই কদিন আগেই। কিন্তু ধ্বংসস্তূপ থেকে একটা শহর কীভাবে এত সুন্দর করে দাঁড়িয়ে গেছে ভাবাই যায় না। শহরের কাছেই অতি মনোমুগ্ধকর সাক্সজিসে সুয়াৎজ বা জার্মানির সুইজারল্যান্ড। এ সৌন্দর্য চোখ জুড়ানো।

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

রাজর্ষি দা, আপনি কি ড্রেসডেনের আশেপাশের কোন শহরেই থাকেন?

Arnab এর ছবি

বরাবরের মতই দারুণ লেখা! কেন যেন মনে হয় আরো আছে বাকি, তাই হলে অপেক্ষায় থাকলাম।

অর্ণব

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

ধন্যবাদ অর্ণব, ভালো থাকবেন

নিবিড়  এর ছবি

আপনার লেখা সবসময়ই ভালো লাগে, আপনার বর্ণনা ভঙ্গির কারণে। খুব ভালো লেগেছে। শুধু খারাপ লাগে হারিয়ে যাওয়া শিল্পগুলোর জন্য। এসব বিরোধের কারণে কতো অমূল্য জিনিস যুগে যুগে আমরা হারিয়েছি। ধন্যবাদ।

আঘ্রাণ প্রান্তর

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ নিবিড়

সোহেল ইমাম এর ছবি

আপনার সাথে বেড়িয়ে বেড়াবার মজাই আলাদা।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।