মানুষের মন-২

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি
লিখেছেন জুলিয়ান সিদ্দিকী (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৩/০৯/২০০৯ - ৪:১৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অন্যদিকে হজুম মোল্লার ছেলে ফজু মোল্লাকে সকাল-সন্ধ্যা মসজিদে আনাগোনা করতে দেখে কেউ ভুলেও সন্দেহ পোষণ করবে না যে, লোকটি জীবনে কোনো দুষ্কর্ম করেছে। যেহেতু তার এবং তার মৃত পিতার নামের সঙ্গে মোল্লা নামটি জড়িয়ে আছে, তাও তাকে ভালো মানুষের সন্তান হিসেবে অনেকটা হলেও সাব্যস্ত করে বৈকি। কিন্তু যৌবনে লোকটি যে ঘরে চোলাই মদ বানিয়ে রাতের আঁধারে নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে দিয়েছে কতদিন সে গল্প তার ছেলে-মেয়েদের মুখ থেকেই শুনেছে গফুর মিয়া। হয়তো এখন সে কথা ওরা স্বীকার করবে না। যদিও কৈশোরে গফুর মিয়া আর ফজু মোল্লার মেয়ে শাহেদা অনেক সময় কাটিয়েছে প্রায় একই সঙ্গে। তখন গল্পে-গল্পে আর কথায়-কথায় অনেক কথাই বলেছিলো সে। বলেছে কিভাবে অবৈধ চোলাই মদ সহ পুলিশের হাতে ধরা পড়েও তার বাবা ফজু মোল্লা উপস্থিত বুদ্ধির বলে সে রজনীর বিপদ উৎরে গেছে। উৎরে গেছে আরো নানাবিধ অপকর্মের সেতুও।

আর এভাবে দেখতে গেলে বলতে হয় যে, প্রতিটি মানুষের জীবনেই কিছু না কিছু ছোট-বড় অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘটনা থাকে। থাকে কিছুটা হলেও মানবতার মহান আলোকে উদ্ভাসিত দু'একটি মধুর স্মৃতি। কিন্তু সময়ের একটি ধীর অথচ সুদীর্ঘ আবর্তনের পর সবাই চায় মন্দ ঘটনাগুলোকে তাদের জীবন থেকে মুছে দিতে। তা না পারলে অন্তত চেষ্টা করে অন্যের কাছ থেকে আড়াল করতে। আর এভাবেই তৈরী হয় একটি মিথ্যে। সে মিথ্যেকে আড়াল করতে আবার তৈরী করতে হয় আরেকটি মিথ্যে। যার ফলে ক্রমাগত মিথ্যের আবরণে ঢাকা পড়ে যেতে থাকে একটি মানব অথবা মানবীর প্রকৃত সত্ত্বা। সে তখন কতগুলো মিথ্যেকে আশ্রয় করে কিংবা অনেক পরত অসত্যের আড়ালে আত্মগোপন করে বেঁচে থাকে। অন্তত সে চেষ্টাই হয়তো সে বাকি জীবন করে যায়। আর সে কারণেই হয়তো কোনো একটি অন্যায় হতে দেখেও তার বিরুদ্ধে পুরোপুরি সোচ্চার হতে পারে না মানুষ। হয়তো বা একটি ন্যায়কে জোর সমর্থন করতে গিয়ে তার অতীতের কোনো নোংরা ঘটনাও অকস্মাৎ উম্মোচিত হয়ে পড়তে পারে জনসমক্ষে। সে ভয়ও হয়তো তাকে কিছুটা দুর্বল করে রাখে। কারণ আমাদের সমাজে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনাই কেউ চট করে ভুলে যায় না। হয়তো বা তাদের নিজেদের স্বার্থেই সাময়ীক ভাবে ঘটনাগুলোকে চেপে রাখে। হয়তো বা সে কারণে দেখা যায় শঠ-প্রবঞ্চক কিংবা সমদোষে দুষ্ট সবাই একই ছাতার তলে জড়ো হতে খুব একটা সময় লাগে না।

কিছুক্ষণ আগে কাদের খোনকারের দোকানে আড্ডাটা দেখতে পেয়ে গফুর মিয়া মাঝ পথ থেকেই ফিরে গিয়েছিলো। ভেবেছিলো যে, কিছুক্ষণ পর এমনিতেই ওরা উঠে যাবে। কিন্তু অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলেও তাদের উঠবার কোনো লক্ষণ দেখতে না পেয়ে আবার ফিরে এসেছে সে। তার বিড়ি ফুরিয়েছে অনেক্ষণ। এখন তার বিড়ি না হলেই নয়। তাই অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে না চাইলেও বাধ্য হয়ে সে কাদের খোনকারের চায়ের দোকানের সামনে এসে উপস্থিত হয়।

কাঠের টুলে বসে থাকা লোকগুলো সবাই একবার করে ঘাড় ঘুরিয়ে গফুর মিয়াকে দেখলো যেন। তারপরই কেমন চুপচাপ হয়ে যায় সবাই। যেন কোনো অস্বস্তিকর বিষয়ে কথা বলছিলো ওরা। অথবা এমনও হতে পারে গফুর মিয়ার বিষয় নিয়েই কথা বলছিলো। মুখের ভাবগতিক দেখে গফুর মিয়ার তাই মনে হয়।

দোকানের এক পাশে গিয়ে গফুর মিয়া কাদের খোনকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললো, খোনকার, এক প্যাকেট বিড়ি দেও দিনি!

কাদের খোনকার একটি ছোট কাচের গ্লাসে চায়ে দুধ ঢেলে চামচ দিয়ে নাড়তে ব্যস্ত ছিলো। সে একই ভাবে চামচ নাড়াতে নাড়াতে টুলে বসে থাকা নজুমুদ্দির দিকে তাকিয়ে বললো, আরে সফুরার জামাই ক্যান তারে তালাক দিয়ে দেছে গফুরই মনে কয় ভালো কতি পারবে। ঘরের লাগোয়া ঘর যখন...।

কাদের খোনকারের সঙ্গে গফুর মিয়ার সম্পর্ক ততটা তিক্ত নয়। এক সময় ওরা দু’জনেই এক সঙ্গে দক্ষিনে যেতো কাজ করতে। কিন্তু আস্তে ধীরে কাদের খোনকার এখন গ্রামের নষ্ট আর দুষ্টু লোকগুলোর সঙ্গে অনেকটা গভীর ভাবেই যেন জড়িয়ে গেছে। মাঝে মধ্যে নানা ঝামেলার কাজে কিংবা ছোটখাট অপকর্মেও তার নামটা কোনো না কোনোভাবে সম্পৃক্ত থাকে। সে কারণেও গফুর মিয়া কাদের খোনকারকে এড়িয়ে চলে অনেকটা।

গফুর মিয়া কাদের খোনকারের কথায় কান না দিয়ে আবার বললো, এক প্যাকেট বিড়ি দেও তড়া কইরে! অনেক্ষণ হইয়েছে বিড়িত টান দিতি পারিনি!

বিড়ি তো নেবাই! ওই যে একটা কথা কলাম, তা নিয়ে তো কিছু কইলে না! বলতে বলতে কাদের খোনকার কানা জইল্যার দিকে চায়ের গ্লাসটা বাড়িয়ে দেয়।

বাপ-মা আদর করে আব্দুল জলিল নাম রাখলেও ছোট বেলা বাঁশ ঝাঁড়ে উঠে বকের ছানা ধরতে গিয়ে ডান চোখে কঞ্চির খোঁচা লেগেছিলো। কিন্তু উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে চোখটি নষ্ট হয়ে গেছে। ডান চোখে সে কিছুই দেখতে পায় না। কেমন একটি সাদা গোলাকার আবরণে ঢেকে গেছে চোখের কালো মণিটি। সেই থেকে আস্তে ধীরে তার নামটাও কখন আব্দুল জলিল থেকে কানা জইল্যায় রূপান্তর হয়ে গেছে কেউ সঠিক বলতে পারবে না হয়তো।
(চলবে...)


মন্তব্য

স্পর্শ এর ছবি

মাটি ও মানুষের কাছের গল্প। ভালো লাগছে।

প্রথম পর্ব পড়েছিলাম আগেই এখন আবার প্রথম থেকে শুরু করে আসলাম।
গল্পটা কি পুরোটা লিখে ফেলেছেন আপনি? তাহলে একবারে পিডিএফ আকারে দিয়ে দিতে পারেন।
ধারাবাহিক উপন্যাসের প্রতি এক ধরণের ভীতিকাজ করে পাঠকের।

আগ্রহ সহকারে পড়ছি। হাসি


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

ধন্যবাদ স্পর্শ। গল্পটি লেখা হয়ে গেছে ঠিকই। পিডিএফ করে দিতে পারলে ভালোই হতো। কিন্তু একটু একটু এডিট করছি আর পোস্ট দিচ্ছি।
.
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

সৈয়দ আখতারুজ্জামান এর ছবি

চলুক।

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

চলছে...
.
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

বইখাতা এর ছবি

ভালো লাগছে। পরের পর্বগুলো আসুক নিয়মিত। অপেক্ষায় রইলাম।

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

ধন্যবাদ। চেষ্টা থাকবে।
.
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

এইটা ও পড়লাম। এখন ৩ এ যাবো। স্পর্শের কথাটা একটু ভেবে দেখতে পারেন বস। পুরো উপন্যাস একত্রে পড়লে সেটার রস নেয়া অনেক সহজ হয়...
---------------------------------------------------------------------------
- আমি ভালোবাসি মেঘ। যে মেঘেরা উড়ে যায় এই ওখানে- ওই সেখানে।সত্যি, কী বিস্ময়কর ওই মেঘদল !!!

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

.নিয়মিত হতে পারছি না বলে আমার অনেক ভ্যাজাল! ধন্যবাদ
.
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।