প্রথম আলো এবং ইত্তেফাকের এলিটিস্ট প্রত্নতাত্ত্বিক চিন্তা!

যূথচারী এর ছবি
লিখেছেন যূথচারী (তারিখ: শুক্র, ২৫/০৭/২০০৮ - ৮:৫৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আজকের দুটি বড় কাগজে বাংলাদেশের পুরাকীর্তি বিষয়ে দুটি লেখা দেখলাম। এর মধ্যে প্রথম আলোর অন্য আলোতে পুরো এক পাতা জুড়ে ছাপা হয়েছে উয়ারী-বটেশ্বরের কীর্তি-কাহিনী আর দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদকীয় পাতায় শামসুজ্জামান খান লিখেছেন "ভাবনা : পুরাকীর্তি সুরক্ষা" নামে একটি মোটামুটি বড়সড় একটা লেখা।

প্রথম আলোর লেখাটি নিয়েই প্রথমে বলি। গত ৭৫ বছর ধরে হানীফ পাঠান এবং হাবীবুল্লা পাঠান উয়ারী-বটেশ্বরে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান চালিয়ে আসছেন। প্রাতিষ্ঠানিক প্রত্নতত্ত্ব চর্চায় কেউ কেউ এই চর্চাকে অবৈজ্ঞানিক বলতেই পারেন। তা আমাদের প্রত্নতত্ত্ব চর্চাকেও হাই-টেক প্রত্নতাত্ত্বিকরা প্রিমিটিভ-ই বলেন। যে যাই বলুন, উয়ারী বটেশ্বর প্রত্নস্থানের প্রধান প্রত্নতাত্ত্বিক হাবীবুল্লা পাঠান। উয়ারী-বটেশ্বর নিয়ে প্রথম বইটিও তারই লেখা। বর্তমানে আমরা যারা এই জায়গায় খনন করছি, সেটা শুরু হওয়ার অনেক আগে তিনি এলিট প্রত্নতাত্ত্বিকদের এই জায়গায় নিজ খরচে দাওয়াত দিয়ে এনে, ননী-মাখন খাইয়েও এখানে পদ্ধতিগত খনন করতে পারেন নি। আমরা যখন এখানে খনন শুরু করি, তার অবদানটাই সবচেয়ে বেশি ছিল এবং আছে। গত ৮ বছর ধরে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন চলাকালে আমাদেরকে আশ্রয়, খাদ্য এবং নিরাপত্তা দিয়ে তিনি আমাদেরকে আক্ষরিক অর্থেই বাঁচিয়ে রেখেছেন। এই মানবতাবাদী অবদানের বাইরে প্রত্নতাত্ত্বিক কর্মকাণ্ডের কথা যদি বলি, তবে স্বীকার করতেই হবে, উয়ারী-বটেশ্বরের সবচেয়ে বড় প্রত্নতাত্ত্বিক এখনও পর্যন্ত হাবীবুল্লা পাঠান। প্রথম আলো উয়ারী-বটেশ্বরের সেরা ১০ বলে যে বিষয়গুলোকে চিহ্নিত করেছে তার কমপক্ষে ৬টিই তার অবদান। আর রাস্তা, গর্তনিবাস এবং ইটের কাঠামোগুলো যে জায়গায় আবিষ্কৃত হয়েছে, সেই জমিও কমবেশি পাঠান পরিবারের। শুধু তাই নয়, এখন পর্যন্ত জাতীয় জাদুঘরসহ যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে উয়ারী-বটেশ্বরের প্রত্ননিদর্শন আছে, তার সিংহভাগের মালিক তিনিই। প্রতিষ্ঠান থেকে প্রত্নতাত্ত্বিক শিক্ষা গ্রহণ করার ফলে আমরা আরো বেশি পদ্ধতিগত ভাবে খনন করতে পেরেছি, এই তথ্য কোনোভাবেই হাবীবুল্লা পাঠানের অবদানকে খাটো করতে পারে না। উয়ারী-বটেশ্বরের প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ইতিবৃত্ত লিখতে গিয়ে কাল-পরিক্রমা (লেখক-অজ্ঞাত) এবং সুফিদের সাধনা (লেখক-ইশতিয়াক হাসান) শিরোনামে যে দুটি শিশুসুলভ রচনা সেখানে উয়ারী-বটেশ্বরের প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ইতিহাসকে ইচ্ছাকৃতভাবে খণ্ডিত করা হয়েছে। হাবীবুল্লা পাঠান এবং পাঠান পরিবারের প্রত্নতত্ত্ব-চর্চা ও প্রয়াসসমূহকে বাদ দেয়া হয়েছে। পুরো পাতা জুড়ে অসংখ্য তথ্যগত ভ্রান্তিকে অনিচ্ছাকৃত ধরে নিয়েও বলতে হচ্ছে, লোকশিল্পকলাকে যেমনভাবে শিল্প নয় বলে এলিট শিল্পসমালোচকরা শিল্পের ইতিহাস থেকে বাদ দেন, তেমনি ভাবেই লোক-প্রত্নতত্ত্বকে প্রত্নতত্ত্ব নয় বলে প্রথম আলো মনে করে। অন্তত সেটাই তাদের এই লেখামালা থেকে বোঝা যাচ্ছে।

ইত্তেফাকের লেখাটা আরো জঘন্য। শামসুজ্জামান খান ফোকলরিস্ট। (আমার মতে, এলিট ফোকলরিস্ট)। তার লেখাটার শুরুটা এই রকম- "বাংলাদেশের সভ্যতার ইতিহাস প্রায় আড়াই হাজার বছরের পুরনো। তবে পশ্চিমবাংলার পান্ডু রাজার ঢিবি আর চন্দ্রকেতুগড়ে উৎখননে প্রাপ্ত নিদর্শনের কথা বিবেচনায় নিলে বাঙালির প্রত্ন-ইতিহাস প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর পেছনে নিয়ে যাওয়া যায়।" চরম জঘন্য এবং আপত্তিকর বিবৃতি। উয়ারী-বটেশ্বরে প্রত্নতাত্ত্বিক খননে আমরা যে গর্তবসতিগুলো পেয়েছি, তা কমপক্ষে সাড়ে তিন হাজার বছরের পুরনো। পান্ডুরাজার ঢিবি এবং চন্দ্রকেতুগড়ে যেসব নিদর্শনের কারণে সেগুলোকে সভ্যতার নিদর্শন বলা হচ্ছে, উয়ারী বটেশ্বরে তার প্রায় প্রত্যেকটাই আমরা পেয়েছি। তাহলে উয়ারী-বটেশ্বরকে ধরতে তার আপত্তি কিসের? পুরো লেখার কোথাও উয়ারী-বটেশ্বর প্রসঙ্গটি নেই। অথচ গত ৭৫ বছর ধরে এখানে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান চলছে, এবং এখানে যা পাওয়া গেছে পুরো ভারতবর্ষেও তা পাওয়া যায়নি। আমার তো মনে হয়, এখানে আমরা যত রৌপ্যমুদ্রা পেয়েছি, পুরো ভারতেও এতো রৌপ্যমুদ্রা পাওয়া যায়নি। আসলে ঘটনাটা সেখানেই যেখানে তিনি একজন ফোকলরিস্ট (?) হয়েও দেশীয় প্রত্নতত্ত্ব চর্চাকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না। তার পুন্ড্রনগরের (বগুড়া) প্রশংসা এবং শেষ লাইনের দ্ব্যর্থবোধক বাক্যাংশ দিয়ে ফরাসিদের প্রশংসা করলেন না নিন্দা করলেন, বুঝতে পারলাম না। তবে পুরো লেখাজুড়ে কয়েকবার পুন্ড্রনগরের প্রশংসা, বিদেশিদের প্রশংসা (মায় কলকাতার-ও) থেকে আমার বলতে ইচ্ছে করছে, অমুক সিমেন্ট যখন বিদেশে রপ্তানি হয়, তখন তো তারা তাকে বিদেশি সিমেন্ট-ই বলে। উয়ারী-বটেশ্বরের স্বীকৃতি বহু বিদেশি এবং সাদা চামড়া-ওয়ালারাও করেছেন (এমনকি কোলকাতাওয়ালারাও)। তারপরেও শামসুজ্জামান খানের চোখ সেখানে না যাওয়াটাকে আমি বলতে চাই, ইচ্ছাকৃতভাবে পরিহার করা। দৃষ্টিভঙ্গি একই। প্রথম আলোর মতোই। বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব চর্চা কোনো প্রত্নতত্ত্ব চর্চাই নয়-এই এলিটিস্ট প্রত্নতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি।

লিংক: প্রথম আলো: http://www.prothom-alo.com/fcat.news.details.php?issuedate=2008-07-25&nid=Mjc3MzM=&fid=MTU=

ইত্তেফাক: http://www.ittefaq.com/content/2008/07/25/news0228.htm


মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

যূথচারী লিখেছেন:
দাদাদের ধুতির নিচে কিছু মধু থাকে, যে সেখানে তিনি তার পূর্ব-প্রজন্মের স্মৃতি খোঁজেন?

এই ধরনের কথা রেসিস্ট, ব্যক্তি আক্রমন এবং চরম আপত্তিকর!

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

যূথচারী এর ছবি

বাক্যটাতে একটু ভুল আছে, কিছুর যায়গায় কি হবে এবং শেষের দিকে একটা বাক্যে জাওয়ার জায়গায় হবে যাওয়া।

আপনার আপত্তির রেসিস্ট অংশটা গ্রহণ করলাম এবং বাক্যটা মুছে দিলাম।

ব্যক্তিআক্রমণ প্রসঙ্গে বলছি, ব্যক্তিআক্রমণ তো অবশ্যই। ব্যক্তিআহ্লাদ দেখানোর এখানে কোনো সুযোগ নাই। আর এই লেখকেরা কেউ শিশু নন, তাদেরকে শেখানোর কিছু নাই, তারা খুব পরিকল্পিত ভাবেই উয়ারী-বটেশ্বর এবং এর দেশীয় ও লোক-প্রত্নতত্ত্ব চর্চার বিরোধিতা করছেন, যার পেছনে প্রত্নসম্পদ ব্যবসার সংশ্লিষ্টতা আছে। আমরা প্রত্নতত্ত্ব চর্চা করলে এদের ব্যবসা হয় না, তাই এরা আমাদেরকে সবসময় আড়ালে রাখে। এবং প্রকৃতপক্ষে প্রথম আলো এবং ইত্তেফাকের লেখাগুলো দেশীয় এবং লোকায়ত প্রত্নতাত্ত্বিক চর্চার প্রতি আক্রমণ। আমার এই লেখাতে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও যথেষ্ট জোরালো প্রতি-আক্রমণ করতে পারলাম না। ভবিষ্যতে কোনো একটা লেখায় আরো জোরালো আক্রমণ করতে পারবো- এই আশা করছি।


চোখের সামনে পুড়ছে যখন মনসুন্দর গ্রাম...
আমি যাই নাইরে, আমি যেতে পারি না, আমি যাই না...


চোখের সামনে পুড়ছে যখন মনসুন্দর গ্রাম...
আমি যাই নাইরে, আমি যেতে পারি না, আমি যাই না...

সুমন চৌধুরী এর ছবি

আক্রমণ এমনিতে ঠিকই আছে। আসলে বর্ণবাদের প্রতিবাদে পাল্টা বর্ণবাদী মন্তব্য করতে গেলে মনোযোগের কেন্দ্র বিষয় থেকে সরে যায়।

যেই প্রসঙ্গটা বললা সেইটা ভয়াবহ। তবে অপ্রত্যাশিত না।



ঈশ্বরাসিদ্ধে:

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

বিষয়টা নিয়ে একটু আধটু খোঁজখবর পেতাম, বিতর্কটা যে গুরুতর তাও মানতাম। এবং মানি। যতদূর জানি, এদেশের অন্যান্য বিষয়ের মতো, এক্ষেত্রেও আমাদের গবেষকরা যার যার প্যাট্রন-অ্যাঞ্জেল দ্বারা চালিত। কেউ ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বের একটা ধারা, কেউ বা ফ্রান্স আবার কেউবা অস্ট্রেলিয়া। এরা আবার তালুকও ভাগ করে নিয়েছেন, মহাস্থানে অনেককিছু বেহাত হচ্ছে ফরাসিদের হাতে, এমন অভিযোগ শুনি। আবার ফ্রান্সে প্রত্নকীর্তি পাচারের সময় ফরাসি ঘরানার বুদ্ধিজীবী-প্রত্নবিদদের কমই দেখা গেছে প্রতিবাদে। প্রত্নতাত্ত্বিকরা নন, প্রতিবাদের উদ্যোগে ছিলাম যারা, তাঁরা শিল্পী, অধ্যাপক (নিসার হোসেন, শিশির ভট্টাচার্য, রেহনুমা আহমেদ প্রমুখ) এবং সাংবাদিক-গবেষক। এসব বিষয় নিয়ে আপনি আরো ভাল বলতে পারবেন। বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক সংষ্কৃতির একটি বাণিজ্যিক ঘাঁটি নাকি এই চৌর্যকর্মের সঙ্গে ছিল বলে অভিযোগও রয়েছে। তো এই যখন অবস্থা, তখন পাঠানদ্বয় বনেদি মোঘলদের অধস্তনই থাকবেন; এতে আর বিষ্ময় কী?
তবে আমার মনে হয়, কেবল এই দুটি পত্রিকার অবস্থান নয়, কেন কোন ক্ষমতাসম্পর্কের মধ্যে এরকম অবস্থান এবংতার জ্ঞানতাত্ত্বিক ভিত্তি তৈরি ও প্রচারিত হয়, সেটায় নজর দেয়া দরকার। আশা করি এ নিয়ে আপনি পুরোটা লিখবেন। আর সুফি স্যারের লেখাটায় মনে হয়, মূল প্রতিপাদ্য ছিল উয়ারী-বটেশ্বরের গুরুত্ব। ব্যক্তির অবদান নয়। ওনার কাছ থেকে তিনি যাঁকে গুরু বলেছেন, সেই হাবিবুল্লাহ পাঠানের ওপর একটি সম্মাননা লেখা পেলে মনে হয় গুরুকৃত্য সম্ভব হয়। সেটা না করলে মনে করব, গুরুর ঋণ শোধ হলো না।

আমি এ ব্যাপারে আপনার সঙ্গে একমত, এবং ঐ দুই পাঠানকে ভক্তি জানাই।
আপনার অসন্তোষের বিষয়টি ধরতে পেরেছি মনে হয়। তবে কথা কী,
সাম্প্রদায়িকতার জবাবটাও যদি সাম্প্রদায়িক ঢংয়ে হয়, তাহলে সেই জবাবের উদ্দেশ্যটাই হারিয়ে যায় নজর থেকে। আমি বলছি না আপনি ডেলিবারেটলি সেটা করেছেন, কিন্তু কথার তোড়ে এটা চলে এসেছে।
যাহোক, আমি আপনার এ লেখাটা যথাযথ জায়গার নজরে আনার চেষ্টা করব। আবারো প্রয়োজনীয় লেখাটার জন্য অভিনন্দন।

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

লেখার মূল সূর বোঝা গিয়েছে। একহয়ে কাজ করার মানসিকতা আমাদের একটু কমই আছে। সেজন্যই বোধহয় এমন হয়:

কেউ ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বের একটা ধারা, কেউ বা ফ্রান্স আবার কেউবা অস্ট্রেলিয়া।

আলমগীর এর ছবি

বক্তব্য পরিষ্কার। তবে আক্রমণ না করে বললে হয়ত গ্রহণযোগ্যতা বাড়ত।
তুর্কিতে রক্ষণশীল সরকার আসার পর, ইউ যখন তাদের সদস্যপদ ঝুলিয়ে দেয়, তখন রক্ষণশীলদের এক নেতা বলেছিল,
রাগলেন তো হেরে গেলেন।

ভারতের সাথে যা লেনদেন, সীমান্ত-হত্যা, পুশব্যাক তা না রেগেই মীমাংসা করতে হবে।

সৌরভ এর ছবি

প্রথম আলোতে রিপোর্টটা পড়ছিলাম।
সুফিদের সাধনায় প্রথম আলো র কর্তা ডেইলি স্টারের স্পন্সর ছিলো দেখা যায়। কাজেই তারা সেইরকম করবে, সেটাই স্বাভাবিক।

এইরকম করে কৃতিত্ব চলে যায় ক্ষমতাবানদের হাতে।


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

সবুজ বাঘ এর ছবি

ভালো কতাডাই তুমার মুইছা দিওন নাগল? খুবই পরিতাপের বিষয়। আর দাদা চুদলে অসুবিদা কি? দাদারা কি আমাগো কম চুদছে?
পুনশ্চ: তুমার নগে কি নালের সম্পর্ক ভাইঙ্গা গেছে? নাল তো নিজের মুকেই পাঠানরে বস মানছে, তাইলে অসুবিধা কনে? তয় বলতেই হয়, গাতার মইদ্যে নাল যেমনে বইয়া এট্টা ছবি তুলা দিছে তাতে তো ওরেই পাকা বস মুনে হয়। এ বিষয়ে তুমার সিন কি?

যূথচারী এর ছবি

(শাপলুকে নিচের পুরো লেখাটা পড়ার অনুরোধ করছি। অন্যদেরকেও...)
সমস্যাটা তো লাল স্যারের লেখাটা নিয়ে না। স্যারসহ আমরা তো ফিল্ডে কাজ করি, সুতরাং আমরা জানি, কার কতোটুকু অবদান। মূল সমস্যাটা হলো, পুরো পাতা জুড়ে প্রথম আলো উয়ারী-বটেশ্বরের খননকাজকে যেভাবে উপস্থাপন করেছে, তাতে এই পাতার লেখক এবং সম্পাদকদের এই প্রত্নস্থান সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নাই বললেই চলে। উয়ারী-বটেশ্বরে আমরা যে কাজ করছি, তাকে যদি হাইলাইট করতে হয়, তবে তা হবে এক রকম, সেখানে আমাদের কথাবার্তা আমাদের আবিষ্কার বেশি থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। আবার যদি উয়ারী-বটেশ্বরের গত ৭০-৭৫ বছরের প্রত্নতত্ত্ব চর্চাকে উপস্থাপন করা হয়, তবে সেখানে পাঠান পরিবারের অংশটাই বেশি থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। আবার যদি পুরো প্রত্নতাত্ত্বিক চর্চা (পাঠান পরিবার এবং আমরা)-কে উপস্থাপন করা হয়, তা হলে যার যতোটুকু অবদান, তার ততটুকু স্বীকৃতি থাকবে- এটাই স্বাভাবিক। প্রথম আলো একটা টোটালিস্টিক মুখোশ পড়েছে, কিন্তু প্রথম আলোর লেখা পড়লে মনে হবে হানীফ পাঠান স্রেফ ঈশ্বরের দান হিসেবে কিছু জিনিস পেয়েছেন এবং হাবীবুল্লা পাঠান সেগুলো সংরক্ষণ করেছেন। বাকী যতকিছু আবিষ্কার তার সবই আমাদের কৃতিত্ব। অথচ, পুরো পাতাটিতে আমাদের কাজ নিয়ে আলাদা একটা ফিচার পর্যন্ত হয়েছে, আর পাঠানের কাজ নিয়ে বলা হয়নি কিছুই (যদিও আমাদের সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়েও প্রথম আলো কোথাও বলেনি, লাল স্যার ছাড়াও আরো কমপক্ষে আটজন পেশাদার তরুণ প্রত্নতাত্ত্বিক সেখানে কাজ করেছেন; পড়লে মনে হবে, যেন সুফি স্যার একাই সব কাজ করেছেন এবং সেখানে তাকে সাহায্য করেছে শুধুমাত্র কিছু প্রতিষ্ঠান এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়-এর ছাত্রছাত্রীরা)।
বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রত্নতত্ত্ব পড়ানোর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে যারা প্রত্নতত্ত্ব চর্চা করেছেন, তাদের প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে একাডেমিক ডিগ্রি না থাকাটাকেই আমরা তাদের প্রত্নতাত্ত্বিক কর্মকাণ্ডের গুরুত্ব পরিমাপের একমাত্র মানদণ্ড বলে মেনে নিতে পারি না। সারা পৃথিবীতেই যারা প্রত্নতত্ত্ব চর্চা করে বিশ্ববিখ্যাত হয়েছেন, তাদের অনেকেরই প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। আর তাদের বই পড়েই তো আমরা প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে ডিগ্রি নিয়েছি। হাবীবুল্লা পাঠান সম্পর্কে আমি যতটুকু জানি, তিনি প্রত্নতত্ত্ব বিষয়টি বোঝার জন্য অনেক আগে থেকেই প্রচুর বইপত্র সংগ্রহ করেছেন, সমকালীন বিশ্বপ্রত্নতত্ত্ব চর্চা বিষয়ে জ্ঞান লাভের চেষ্টা করেছেন। আমি নিজে জানি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা পর্যন্ত তার কাছ থেকে প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে বই ধার করেছেন, যেসব বই তিনি নিজ আগ্রহে বিদেশ থেকে আনিয়েছেন।
প্রথম আলোর পুরো পাতা জুড়ে হাবীবুল্লা পাঠানের নাম সাতবার লেখা হয়েছে, প্রথম ও দ্বিতীয়বার তার বালক বেলার লোহার পিণ্ড দেখে চমকে ওঠার ঘটনায় আর এএইচ দানীকে অনুরোধ করতে গিয়ে, তৃতীয় বার এক ইঞ্ঝি বাই আধা ইঞ্চি ছবির নিচে, চতুর্থ বার লাল স্যারের লেখায়, পঞ্চম বারও লাল স্যারের লেখায় তার বই থেকে উদ্ধৃত করতে গিয়ে, ষষ্ঠ বার জাদুঘরের স্বপ্ন শিরোনামে লেখায় "সেই সংগ্রহকেই দিনে দিনে আরও সমৃদ্ধ করেছেন তার সুযোগ্য ছেলে হাবীবুল্লা পাঠান" এবং সপ্তম বার "হাবীবুল্লা পাঠান এখন পোস্ট মাস্টার"-এর মাধ্যমে। সবই, আমার মতে, হাবীবুল্লা পাঠানকে ছোট করার চেষ্টা- তাকে "সখের প্রত্নতাত্ত্বিক" বলে গা চাপড়িয়ে দিয়ে প্রকারান্তরে আমরাই আসল প্রত্নতাত্ত্বিক- এই স্বীকৃতি কাড়ার চেষ্টা। হাবীবুল্লা পাঠানের প্রত্নতত্ত্ব চর্চার ইতিবৃত্ত প্রথম আলোতে অনুপস্থিত। প্রথম আলো যে তথাকথিত সেরা ১০ করেছে, তার কমপক্ষে ৬টার নিচে লেখা থাকার কথা- এটির আবিষ্কারক হাবীবুল্লা পাঠান। হাবীবুল্লা পাঠানের পুরো কৃতিত্বকে প্রথম আলো ধামাচাপা দিয়েছে, যেমনি ভাবে দিয়েছে আমরা যারা তরুণ প্রত্নতাত্ত্বিক সেখানে কাজ করছি তাদেরকে। কিন্তু আমাদের বিষয়টি আমি বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি না, এর কারণ আমার বাসায় প্রথম আলো নিয়মিত আসে না, দ্বিতীয় বা তৃতীয় পত্রিকা হিসেবে মাঝে মাঝে আমি প্রথম আলো পড়ি। (সমঝদারকে লিয়ে আর কিছু বলছি না)
কিন্তু হাবীবুল্লা পাঠান, যিনি এখন জীবনের প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছেন, আমি পাঁচ হাজার টাকা বাজি রেখে বলতে পারি, প্রথম আলোর এই সংখ্যাটি তিনি সযত্নে সংরক্ষণ করেছেন। এবং আমি জানতে চাই, এই লেখাটি পড়ে যদি তিনি অস্বীকৃতি এবং অপস্বীকৃতির বেদনায় মর্মাহত হন, তার দায় কে নেবে?


চোখের সামনে পুড়ছে যখন মনসুন্দর গ্রাম...
আমি যাই নাইরে, আমি যেতে পারি না, আমি যাই না...


চোখের সামনে পুড়ছে যখন মনসুন্দর গ্রাম...
আমি যাই নাইরে, আমি যেতে পারি না, আমি যাই না...

otithi এর ছবি

I can't understand what was wrong with the fact that ChandraketuGarh may be as old as Uari-Boteshwar.
Objectively speaking West Bengal had earlier signs of human living/civilization. I don't find anything wrong with that fact in Bengal human civilization moved from West to East. So this is not surprising at all.

I can't understand the communalism -- anti-communalism part of this discussion. This goes to show the Pakistani -era mentality (calling 'dada' and displaying the inner 'shamprodaiykota' as such) has not been changed in Bangladesh at all.

And this kind of behavior gets justified by writers like Faruk Wasif et al. Truly sorry state of our society.

যূথচারী এর ছবি

আপনি আসলে লেখাটা পড়েনই নাই এবং বাংলাদেশের ইতিহাস সম্পর্কে আপনার কোনো ধারণাই নাই। আপনি বলছেন,

I don't find anything wrong with that fact in Bengal human civilization moved from West to East. So this is not surprising at all.
৪০ বছর আগের কাহিনী। ১৯৬৮ সাল থেকেই এই বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত যে, পশ্চিম থেকে পূবে না, পূব থেকেই পশ্চিমে গেছে মানুষের সভ্যতা (দুই বাংলার প্রেক্ষিতে)। কিছু নতুন বইপত্র, জার্নাল-টার্নাল কিনে পড়েন। তার পর আপনার সাথে কথা হবে।

চোখের সামনে পুড়ছে যখন মনসুন্দর গ্রাম...
আমি যাই নাইরে, আমি যেতে পারি না, আমি যাই না...


চোখের সামনে পুড়ছে যখন মনসুন্দর গ্রাম...
আমি যাই নাইরে, আমি যেতে পারি না, আমি যাই না...

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

প্রিয় অতিথি, আপনাকে স্বাগতম। আপনি যেহেতু কেবলই অতিথি, তাই প্রীতিটাই কেবল রইল। আপনার নাম-ধাম-পরিচয় জানলে হয়তো কপট রাগ করতাম, মান করতাম হয়তো ধমকেও দিতাম।

যাহোক, আমি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে পাল্টা সাম্প্রদায়িকতাকে অপছন্দই করেছি মনে হয়। এবং আমার চলতে চলতে করা মন্তব্যে তার অধিক কিছু প্রকাশিতও হয়নি। তাহলে আপনি কেমনে বললেন যে,

this kind of behavior gets justified by writers like Faruk Wasif et al
???

বিষয়টাকে আমি গুরুত্ব দিয়েই নিচ্ছি। কারণ, আপনি প্রকারান্তরে আমাকে সাম্প্রদায়িকতার পৃষ্ঠপোষক গংয়ের দলভুক্ত করার দুঃখটা উপভোগ করেছেন। ওখানে থামলেও চলতো, আপনি আমাদের গোটা সমাজকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন।
বিতর্কের বিষয়টায় আমার বিশেষজ্ঞ জ্ঞান নাই। তাই ওটা আপনার এবং তাঁদের এখতিয়ারেই জিম্মা রাখছি। কিন্তু যেখানে লেখক নিজেই তাঁর আপত্তিকর উক্তিটি সরিয়ে নিয়েছেন এবং বলছেন যে, পান্ডুয়ার সমপ্রাচীন হওয়ার সম্ভাবনা উয়ারি বটেশ্বরের আছে, এবং দেখিয়ে দিচ্ছেন যে, শামসুজ্জামান খান দের মতো লোকশিল্প ব্যাপারীদের দৃষ্টি ততদূর না যাওয়ার মধ্যে ব্যাধিগ্রস্থতা আছে।
আর হ্যাঁ, আমি কথা বলছি আমার মন্তব্য নিয়ে আর তার আপনার জবাব নিয়ে। আর আর বিষয়ে যাব না। এধরনের কমেন্টে আপনার পাকিস্তান আমলের কথা মনে পড়ায় আমার মনে পড়ল সেই কথাটা, যার মনে যা ফাল দিয়া ওঠে তা।

উপমহাদেশে দেশবিভাগ এখনো শেষ হয় নাই দেখছি। আমরা ভারত-পাকিস্তান উভয়কেই ফেলে এসেছি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, কারো কারো মনের মধ্যে এখনও দেশভাগ অন্তহীনভাবে ঘটেই চলেছে।

এ কথাও বলে রাখি, আমি আমার সমাজকে পাকিস্তানের সমাজ থেকে অগ্রসরই মনে করি এবং ভারতের সমাজ দেখে কোনো হীনম্মন্যতায় ভুগি না। রাষ্ট্রের বিচার আলাদা। সে বিষয়টা অন্য পত্রে ফয়সালা করা যাবে।

এ ধরনের ক্লিশে মন্তব্যের শিকার দয়া করে আমাকে করবেন না।
তবে আপনার এ উক্তিটি ভাল লেগেছে,
Bengal human civilization moved from West to East. So this is not surprising at all.
আজো সেই অগ্রসরণ কিন্তু ঘটছে, খেয়াল করেন?

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

কেন কোন ক্ষমতাসম্পর্কের মধ্যে এরকম অবস্থান এবং তার জ্ঞানতাত্ত্বিক ভিত্তি তৈরি ও প্রচারিত হয়, সেটায় নজর দেয়া দরকার।

উপরের উদ্ধৃতিটি আছে ফারুক ওয়াসিফের মন্তব্যে। জরুরি একটা কথা। জ্ঞান, তথ্য ইত্যাদি সৃষ্টি ও ক্ষমতাকাঠামোর সাথে সেই সৃষ্টিকর্মের নিবিড় যোগাযোগ সমাজবিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন বিভিন্ন দেশের ক্ষেত্রে কীভাবে ঘটে বা ঘটছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলো কীভাবে ঘটছে তার সার্বক্ষণিক পাঠ চালু থাকা দরকার।

অন্তত: ব্লগের সুযোগ নিয়ে আমরা আমাদের বুদ্ধি-ভাবনাকে শাণ দিয়ে রাখতে পারি।
-----------------------------------------------
সচল থাকুন... ...সচল রাখুন

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।