প্যাচাল

কনফুসিয়াস এর ছবি
লিখেছেন কনফুসিয়াস (তারিখ: শনি, ২২/০৯/২০০৭ - ১১:৩৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এইচএসসির পর কোচিং করতে আমরা যারা " ফরেইনার ' অর্থাৎ ঢাকার বাইরে থেকে ঢাকায় আসি,থাকার জন্য " এক টুকরো ' জায়গার খোঁজে আমাদের যে কি ঝক্কি পোহাতে হয় সে শুধু আমরাই জানি। ঐ যে বলে না, " কি যাতনা বিষে বুঝিবে সে কিসে।।। ' সত্যিই সে এক বিষময় যাতনা!

তো ধন নয়,মান নয়,এতটুকু বাসা ... থুক্কু বাসা নয়,মেস। সেই মেস খোঁজার জন্য আমি আর আমর বন্ধু চপল পুরো ফার্মগেট এলাকা চষে বেড়াচ্ছি। ফার্মগেট কেন? কারণ,কোচিং সেন্টারগুলো সব ওখানে গিয়েই " উৎপাদিত ' হয়েছে। কিন্তু কোথাও ভ্যাকেন্সি নাই। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে ফোন করি; কিন্তু কাজ হয় না। পরে ঠিকানা টুকে নিয়ে হাঁটা দিলাম। যেখানেই দেখি " টু-লেট ' অথবা " রুম ভাড়া দেয়া হবে ' - সেখানেই একবার করে ঢুঁ মারি। কিন্তু হায়! বাড়িওয়ালাদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে হয় আরও আজব অভিজ্ঞতা। প্রথমেই জিজ্ঞেস করে " আপনারা কি স্টুডেন্ট?'

ঘাড় কাত করে স্টুডেন্ট হওয়ার অপরাধ স্বীকার করি। হ্যাঁ,তাই। মেস খুঁজে বেড়াতে হয়েছে এমন ছাত্র মাত্রই জানেন ঢাকা শহরে " স্টূডেন্ট ' হওয়া বিরাট অপরাধ।

" না ভাই,আমরা স্টুডেন্টকে ভাড়া দেই না। '

হতাশ হই এবং অবাক লাগে। পৃথিবীতে এমন কোন " শালার ব্যাটা ' আছে যে " স্টুডেন্ট ' না থেকে সরাসরি চাকরি পেয়ে গেছে!! তবু হাল ছাড়লে তো চলবে না। খুঁজে যাই। বিচিত্র সব বাড়ি,বিচিত্র সব ব্যাপার স্যাপার।

একটা বাসায় গেলাম,টিনের ঘর ভাড়া দেবে।বাড়িওয়ালার অসীম দয়া- আমরা "স্টুডেন্ট ' জেনেও তিনি রাজি হয়েছেন! বেশ ভাল। সবই ঠিক আছে কিন্তু লাগোয়া কোন টয়লেট নেই। সেটা হল ভেতর বাড়িতে। মানে বাড়িওয়ালার টয়লেট। তাতে কি? ঘর পেয়েছি এই ঢের। কিন্তু না,শর্ত আছে। তা হল রাত দশটার পরে সামনের গ্রিলে তালা দেয়া হবে তাই ভেতরের টয়লেটে যাওয়া যাবে না।

মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। কি আচানক কথা। মানুশের টয়লেটের কি কোন ঠিক-ঠিকানা আছে নাকি! প্রকৃতির খেয়াল। কখন যে সে " ডাক ' দিবে আর কখন আমাদের বদনা হাতে দৌড় দিতে হবে তা আগে থেকে কি করে বলব! পেট তো জানবে না যে রাত দশটার পর টয়লেট বন্ধ!

তাই " ইচ্ছা নাহি হয় হায়,তবু।।।

অন্য বাসা খুঁজতে বের হলাম।

স্টুডেন্টদের ব্যাপারে এত আপত্তি কেন? এক ঠোঁট কাটা বাড়িওয়ালা জানিয়ে দিলেন," ওদের কোন গ্যারান্টি থাকে না,কখন যে টাকা না দিয়েই চলে যায় তার ঠিক নেই। '

আমরা তখন তাকে তেল দেয়া শুরু করলাম। আমাদের পূর্ব ইতিহাস জানালাম, কলেজ থেকে দেয়া " চারিত্রিক ' সনদপত্র দেখালাম, পৃথিবীর কোন প্রান্তেই যে বহু খুঁজেও আমাদের মত " ভদ্র ' ," শান্ত ' , এবং " ভাল ' ছেলে খুঁজে পাওয়া যাবে না তা-ও বোঝালাম।

এক পর্যায়ে থাকতে না পেরে চপল বলল।।। " দরকার হলে আপনি আমার মেইন মার্কশীট জমা রাখেন।।। । '

কিন্তু শিঁকে ছিড়ল না। মেইন মার্কশীটের মর্ম ঐ পাষাণ কেমন করে বুঝবে!

খুঁজতে খুঁজতে এমনি এক হতাশ দুপুরে গিয়ে উপস্থিত হলাম এক একতলা বাড়ির সামনে। " টু-লেট ' লেখা দেখে গেট ধাক্কাতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো সুবহানাল্লাহ সাক্ষাৎ এক ডানাকাটা পরী! আমাদের বুকের ভেতরের ছোট্ট হার্ট দুটো ততক্ষনে টগবগে দু'খানা এরাবিয়ান ঘোড়া হয়ে ছুটতে শুরু করেছে।

" কাকে চাই '

জানালাম।।। বাড়িওয়ালাকে চাই।

" দাঁড়ান,আব্বাকে ডেকে দিচ্ছি। '

খানিক পরে " আব্বাজান ' এলেন। এসেই উনি প্রথমে জিজ্ঞেস করলেন," আপনারা কি ব্যাচেলার ? '

ঘোড়া নয়। হার্ট ততক্ষনে জেট ইনি হয়ে উড়ছে আকাশে। কি শুভক্ষনেই না এসেছি এখানে। ঘরে এত সুন্দর " মেয়ে ' আর উনি খুঁজছেন ব্যাচেলার - আমরা দু'জনে সবেগে উপর-নিচে মাথা ঝাঁকাতে লাগলাম । এক মুহুর্তের জন্যে মনে হল , ছিঁড়ে না যায় আবার।

বাড়িওয়ালা বললেন," সরি, আমি ব্যাচেলারদের ভাড়া দেই না... । '

জেট ইন্জিন ক্র্যাশ করল! দু'জনেই আবার মাটিতে ফিরে এলাম।

আর কি! আবার খোঁজা শুরু হল। এরকম কয়েকটা জায়গায় ব্যাচেলার হওয়ার দায়ে ভাড়া না পেয়ে ঠিক করলাম আজই বাবা-মাকে পত্র লিখব- " তোমাদের ছেলের জন্য একজন "পুত্রবধূ' এই মুহুর্তে অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেমন করেই পারো...'

অবশেষে পেলাম। না, বাবা-মার জন্য পুত্রবধূ না,আমাদের দুই বন্ধুর জন্য একটা মেস। রাজাবাজারে সেটা ভুপেন আংকেলের মেস। ছয়তলা বাড়ির পাঁচতলায় মেস ভাড়া দিয়ে রেখেছেন। বসে বসে ইনকামের এমন সুন্দর প্রসেস আর নাই। মনে মনে নিজের এইম ইন লাইফ ঠিক করে ফেললাম। ঢাকা শহরে একটা মেসবাড়ির মালিক হতে হবে যে করেই হোক।

মেস পেতেই আরেক বন্ধু এসে হাজির হল, তৌহিদ। তিন বন্ধু মিলে একগাদা জিনিসপত্র কিনে রুম ঠিক করলাম। সাজিয়ে-গুছিয়ে ভাল করে তাকিয়ে দেখি- এক "বউ' ছাড়া আর যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিসই সেখানে উপস্থিত।

রুম ছিল বটে একখানা। ঘুপচি অন্ধকার। এটা কি রোদভরা দিন না অমাবস্যার রাত রুমে বসে বোঝার কোন উপায়ই নেই।
মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙ্গে ঘড়িতে ছয়টা বজে দেখে দ্বিধায় পড়ে যেতাম,কোন "ছয়',ভোর না সন্ধ্যা?

বারান্দা আছে অবশ্য একটা। তবে সেখানে দাঁড়ালে আকাশ নয়,পাশের বাড়ির দেয়াল চোখে পড়ত। সেটা এতই কাছে- , রোদ দূরে থাক,বৃষ্টি পড়লেও টের পেতাম না।

তেলাপোকার ছড়াছড়ি,মেসের অখাদ্য-কুখাদ্য,এসব নিয়ে ভালই ছিলাম। কোচিং শেষ করে অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে রুমে এসে শুয়ে পড়তাম।

ফ্লোরের উপর বিছানো তোশক; তার ওপর চিটচিটে চাদর,সেখানেই শুয়ে হাতটাকে বালিশ বানিয়ে,সদ্য কেনা সিলিং ফ্যানটার ঘুরতে থাকা পাখাগুলোর দিকে তাকিয়ে,তিনজনেই; কি জানি কার কথা ভেবে হেঁড়ে গলায় এক সঙ্গে গেয়ে উঠতাম- " চন্দন পালংকে শুয়ে,একা একা কী হবে,জীবনে তোমায় যদি পেলাম না। '

*********************
ফুটনোটঃ
১। দৈনিক যুগান্তরের সাপ্তাহিক ফান ম্যাগাজিন "বিচ্ছু'-তে প্রথম প্রকাশিত।
২। পুরোনো পোষ্ট আমদানীকরণ প্রকল্পের আওতায় সচলায়তনে পুনরায় পোষ্টিত।


মন্তব্য

অমিত এর ছবি

আগে পড়া ছিল না।
অতঃপর সেই গান শুনে...

______ ____________________
suspended animation...

অয়ন এর ছবি

কোচিং করতে ঢাকা আসি নাই। ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর ২০ দিনের মতো মহাখালীর এক বাসাতে কয়েক বন্ধুর সাথে ছিলাম। ওই ২০ দিন আমার জীবনের সবচেয়ে দু:সহ সময়। তেলাপোকার ছড়াছড়ি,মেসের অখাদ্য-কুখাদ্য,এসব কিছুই ছিল না,বর্ণনা দিলে হয়তো ভালোই মনে হবে, কিন্তু তারপরো অসহ্য। মনে হতো স্বর্গ থেকে যেন দোযগে এসেছি। প্রথম কয়েক মাস বুধবার ক্লাস করেই সুবর্ণতে চিটাগাং,শুক্রবার আবার ঢাকা। ঢাকার জীবনযাত্রার সাথে এ্যাডজাস্ট করতে অনেক সময় লেগেছে।

নিঘাত তিথি এর ছবি

এটা বহুবার পড়া, তারপরেও যতবার পড়ি মজা লাগে। গানটা জোস আসলেই।

--তিথি

----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

নুকতাওয়ালা লেখা ভেঙ্গে গেছে। এইটা দেখে ঠিক করে নিও।
====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

হা হা হা! তবে সেই ডানাকাটা সুন্দরীর বাবাকে কারো বলা উচিত ছিলো, ঘরজামাই হতে চাই। তাহলে শুধু বাসা নয়, সাথে জামাই আদরও মিলতো। চোখ টিপি

সুস্বাদু লিখা।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

দ্রোহী এর ছবি

এই লেখাটা মুসা নবীর আমল থেকেই পড়ে আসছি। যতবার পড়ি ততোবারই ভালো লাগে।

কনফু, নতুন কিছু ছাড়ো ভাই। এখনতো রান্না করতে হয় না। বেঁচে যাওয়া সময়টুকু থেকে অল্প কিছু দাও আমাদের....


কি মাঝি? ডরাইলা?

সৌরভ এর ছবি

আমি সৌরভ নবীর আমল থেকে আবার পড়া শুরু কর্লাম।
পাহাড়ে বেড়াইতে গেসিলাম কয়দিন।

চাইরদিনের গুহাবাস থাইকা যখন আইসা বাড়িত পর্লাম, দেখি কনফু পুরান পোস্ট দিয়া পাব্লিকরে সান্ত্বনা দিতাসে।



আমি ও আমার স্বপ্নেরা লুকোচুরি খেলি


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

হাসান মোরশেদ এর ছবি

সৌরভ নবীর চল্লিশদিনের গুহাবাস নিয়া কিছু লিখো না কেন?

-----------------------------------
মানুষ এখনো বালক,এখনো কেবলি সম্ভাবনা
ফুরোয়নি তার আয়ু

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

অনেক পুরান স্মৃতি মনে করায় দিলেন! ঢাকা থেকে অন্য কোথাও চলে গেলেও একই ঝালেমা। চিটাগং-এ এক বছর ছিলাম চাকরির কারনে, কোন শালাই ভাড়া দিতে চায় নাই ব্যাচেলর বিধায়। বিদেশী ব্যাংকের ভিজিটিং কার্ড নাকের সামনে ঝুলাই, তাতেও পাত্তা পাই না। পরে বুড়া এক ভদ্রলোক দয়া করে আমাকে আর আমার আরেক সিনিয়র ভাইকে তার বাড়ির একটা ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়েছিলেন। সেইটা একটা খারাপ বছরই ছিল, বলতে হবে! প্রতি উইকেন্ডে সোহাগ-এ চেপে ঢাকা চলে আসতাম। ৮০টা সোহাগ টিকেট এখনো নাখালপাড়ার বাসার কোন চিপায় পড়ে আছে। অবশ্য প্রবাসে থাকার সবচেয়ে ভালো প্র্যাকটিস্‌ও ছিল সেটা! আর ছিল বুড়ার গল্প, ৪০ না ৫০-এর দশকে সে কোলকাতায় শেখ মুজিবের সহপাঠী ছিল বোধ হয়, এসব গল্প করতো।

দুর্বাশা তাপস এর ছবি

আমার সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা আরো করুন। আপনাদের সাথে শেয়ার করি।
পাস করার অপরাধে হল ছাড়ছি। একখান চাকরি জুটছে, কাজেই বাসা একটা চাই‌। অনেক কষ্টে একটা বাসা পওয়া গেল, সেই বর্ণনা আর দিলাম না। আমার সবকিছুই, মানে বই(আমার বই কেনার বদভ্যাস আছে, কাজেই সংখ্যাটা কম না), বিছানা আর কম্পিউটার সবই ফ্লোরে।
একদিন অফিস থেকে ফিরে দেখি সব ভিজে শেষ। সেদিন বেশ বৃষ্টি হইছে এবং আমার ঘরের ভিতর এক বিঘত পানি। আমার এত সাধের বইগুলা, দেখে আমি হাসবো না কাঁদবো কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না।

বাড়িওলার কাছে গিয়ে বললাম, আমাকে আগে জানাননি কেন বৃষ্টিতে ঘরে পানি ঢুকে? তিনি আবার কোন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মাষ্টার, আমারে ইংরেজীতে লেকচার শুনাইয়া দিল- দ্য হোল কানট্রি ইজ ফ্লাডেড... আরো কতকি। আমি বললাম, আচ্ছা যাক যা হওয়ার হইছে আমি আর আপনার বাসায় থাকবোনা। তার বয়ান- দিস ইজ এ ব্রীচ অব কনট্র্যাক্ট, টুডে ইজ দ্য সেভেনটিন্থ ডে অব দ্য মান্থ।

যথার্থ জ্ঞানী লোক কি বলেন? তাও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচার হইলে না হয় জ্ঞানের ঘাটতি থাকতে পারত, এরা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির টিচার, জ্ঞানে টইটুম্বুর, বর্তমান সময়ের সবচে লাভজনক ব্যবসার অংশীদার।

==============================
আমিও যদি মরে যেতে পারতাম
তাহলে আমাকে প্রতি মুহূর্তে মরে যেতে হত না।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।