কাঠকয়লা

মাহবুব লীলেন এর ছবি
লিখেছেন মাহবুব লীলেন (তারিখ: সোম, ২৮/০১/২০০৮ - ৬:১৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ডক্টরের জন্য যখন হাসপাতালে ভিড় বাড়ছে তখন প্রেশার কমতে কমতে খালামণি নিজেই ইমার্জেন্সির পেশেন্ট। আর ডক্টর মারা যাবার কথা শুনে পুরো দেশ যখন হাসপাতালে এসে উঠছে তখন তিনি ইমার্জেন্সির বেডে শুয়ে একা একা বিড়বিড় করছেন। তাকে কিছুই জানানো হয়নি। তার খবরও জানে না কেউ। তিনি কে? কার জন্য এই চারদিন তিনি হাসপাতালে আছেন কেউ খেয়াল করেনি। অথচ এই চারদিন ডক্টরকে দেখতে আসা লোকজনের জন্য হাসপাতাল প্রায় বন্ধ হবার জোগাড়। রাস্তা থেকে শুরু করে আইসিইউ। শত শত লোক। হাসপাতালের লোকরা এদিকে ল্যাব সামলাচ্ছে তো অন্যদিকে আরেকজন ঢুকে পড়ছে আইসিইউতে। কোনো ডাক্তার হয়তো রোগী দেখতে দৌড়াচ্ছে কিন্তু তাকে আটকে দিয়েছে কোনো সাংবাদিক- না হয় কোনো ক্যামেরা- না হয় অন্য কেউ; ডক্টরের খবর কী ডাক্তার?

হাসপাতালের সবাই কি এক ডক্টরকে নিয়েই থাকবে? এখানে তো আরো রোগী আছে। আরো কাজকর্ম আছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। ডক্টর হাসপাতালে সুতরাং পুরো হাসপাতাল ডক্টরকে নিয়েই ভাববে। ব্যাস

হাসপাতালের কমচারীরা বিরক্ত হলেও মালিকরা মনে মনে খুশি। বিখ্যাত লোক রোগী হলে আপনাতেই কোটি টাকার বিজ্ঞাপন হয়ে যায়। এই কয় দিনে পত্রিকায়-টিভিতে-ইন্টারনেটে- মোবাইলে কমসে কম কয়েক লক্ষবার উচ্চারিত হয়েছে এই হাসপাতালের নাম। সে তো হচ্ছে এই ডক্টরের কারণেই। এই বিজ্ঞাপন কি টাকা দিয়ে হয়? একসঙ্গে অতগুলো সাংবাদিক- দেশের সবগুলো চ্যানেলের ক্যামেরা- দেশের সব বিখ্যাত লোকজন বারান্দায়- সিঁড়িতে বসে আছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ডক্টর যদি না এখানে ভর্তি হতেন তাহলে কি কোনোভাবেই সম্ভব হতো এদেরকে এখানে আনা?

এই বিজ্ঞাপন কে ছাড়ে? এতে যদি বিরক্ত হয়ে দুচারটা সাধারণ রোগী বিদায়ও হয়ে যায় তাতেও কিছু যায় আসে না। কারণ ওরা গিয়ে বড়োজোর দুচারজন বন্ধুবান্ধবের কাছে হাসপাতালের বদনাম করবে। কিন্তু ডক্টরের লোকজন ক্ষেপে গেলে কিংবা তারা যদি মনে করে যে ডক্টরকে অবহেলা করা হচ্ছে তবে এই হাসপাতাল পথে বসতে একদিনও লাগবে না

কারা কারা আসছে এবং তারা কারা তা লিখে রাখার জন্য হাসপাতালওয়ালারা চারজন স্টাফকে অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছে। দর্শনার্থী সেজে দুটো ছেলে ক্যামেরা নিয়ে হাসপাতালে আসা ভিআইপিদের ছবি তুলছে। এদের উপর লোকজন বিরক্ত হলেও তারা যে হাসপাতালের লোক তা কেউ বুঝতে পারছে না। সবাই ভাবছে গ্রাম থেকে আসা ডক্টরের কোনো নতুন স্টুডেন্ট। একসঙ্গে অত সেলিব্রেটি দেখে তাদের মাথা আউলা হয়ে গেছে। এদের উপর লোকজন বিরক্ত হচ্ছে বলেই তাদের কাজ আরো সহজ হয়ে গেছে। আপদ বিদায় করার জন্য ছবি তোলায় ব্যাপারে আপত্তি করছে না কেউ। যা তোল। তুলে তাড়াতাড়ি বিদায় হ। ...ভবিষ্যৎ বিজ্ঞাপনে কাজ দেবে এইসব ছবি

মিডিয়াতে সাক্ষাৎকার দেয়া এবং দর্শনার্থী ভিআইপিদেরকে কুশল জিজ্ঞাসার জন্য সার্বক্ষণিক হাসপাতালে থাকছেন তিনজন ডিরেক্টর। সর্বক্ষণ নজর রাখছেন যাতে হাসপাতালের কোনো স্টাফ কারো সাথে খারাপ ব্যবহার না করে। এই কয়দিনে তারা মোটামুটি সবার সাথেই ব্যক্তিগতভাবে কথা বলেছেন। ডক্টরকে নিয়ে নিজেদের আশঙ্কা এবং আশাবাদ প্রকাশ করেছেন। এবং অবশ্যই কয়েক হাজার ভিজিটিং কার্ড বিতরণ করেছেন দর্শনার্থীদের হাতে। যারা নিয়মিত এখানে এসেছে তাদের সবার কাছেই এরা পরিচিত হয়ে গেছেন। আইসিইউ গেটে অন্য কেউ থাকলে যে কোনো সময় যে কোনো ঝামেলা হতে পারে ভেবে তিন ডিরেক্টরই পালা করে আইসিইউ গেটে ডিউটি দিচ্ছেন। বিনীতভাবে অনুরোধ করছেন যেন তারা ডক্টরের খাতিরেই সেখানে ভিড় না করেন। এবং সেই সাথে বারবার জানাচ্ছেন যে ডক্টরকে তারা শুধু একজন পেশেন্ট হিসেবে দেখেন না। তারা তাকে একজন জাতীয় সম্পদ হিসেবেও ভাবেন। এজন্য এই হাসপাতালের সর্বোচ্চ চেষ্টার সাথে যদি বিদেশ থেকে কোনো ডাক্তার এমনকি মহামূল্যবান কোনো ইকুইপমেন্টও আনতে হয় তাহলেও হাসপাতাল তা ডক্টরের জন্য আনবে। কারণ এখন ব্যবসার সময় না। একজন জাতীয় ব্যক্তিত্বের জীবনের প্রশ্নকে সামনে রেখে কোনো ব্যবসা চলে না। বিষয়টি এখন একটি জাতীয় দায়

এই হাসপাতালে কমপক্ষে দশ হাজার ভিজিটর বসতে পারে। কিন্তু তারপরও সবাই এসে ভিড় করছে আইসিইউর সামনে। যদিও প্রত্যেকে জানে আইসিইউতে ঢোকা নিষেধ। এবং ভেতরে ডক্টরকে রাখা হয়েছে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে। কিন্তু তবুও ঘুরেফিরে এসে দাঁড়াচ্ছে এখানেই। কারণ এখানে এলেই সবাইকে দেখানো সম্ভব যে আমি এসেছি। আমি ডক্টরের জন্য চিন্তিত

এরা কি ডক্টরকে দেখতে এসেছে নাকি দেখাতে এসেছে নিজেদেরকে? না হলে কেন এসেই সবাই নিজের আসার সাক্ষী খুঁজছে? কেন ক্যামেরার সামনে ঘুরছে? কেন ফোনের পরে ফোন করছে- আমি এই হাসপাতালে। ডক্টরকে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে রাখা হয়েছে। কী আশ্চর্য জানো না তুমি? তুমি এখনও আসোনি? আমি তো সেই গতকাল এসেছি আর যাইনি। এভাবে তাকে রেখে যাওয়া যায়?

কাউকে না বললে গতকাল থেকে আসা কিংবা সারারাত বসে থাকা কিংবা প্রতিদিন চারবার করে আসার কোনো প্রমাণ থাকে না। কাউকে না দেখালে কে কার থেকে বেশি অস্থির আর টেনশনে তারও প্রমাণ থাকে না। ডক্টর এক জাতীয় প্রতীক। তাকে দেখতে আসা মানে জাতীয় বিষয়ে নিজে কতটুকু চিন্তিত তা প্রমাণ করা। কেউ যদি নাই জানল কিংবা কোনো প্রমাণই না থাকল তাহলে এসে কী লাভ?

পুরো হাসপাতাল দখল করে ফেলা এইসব দর্শনার্থীর ভিড়ে আরেকজন ছিলেন। যিনি চারদিন আগে গভীর রাতে ডক্টরের সাথে এসে আর একবারও যাননি কোথাও। একবারও কাউকে একটা কথাও বলেননি। একবারও কারো সামনে আসেননি। ওয়েটিং রুমের কোনার একটা চেয়ারে চুপচাপ বসেছিলেন। তাকে কেউ দেখেনি। তিনি খালামণি। ডক্টরের স্ত্রী

দুপুরে আইসিইউ থেকে বের হওয়া ডাক্তারের মুখ স্যরি উচ্চারণের সাথে সাথে সারা দেশে যখন মোবাইলে-চ্যানেলে-ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ছে ডক্টরের মৃত্যু সংবাদ; তার এক ঘণ্টা আগে থেকেই খালামণির প্রেশার দ্রুত লো হতে থাকে। তিনি পড়ে যান। তাকে ভর্তি করা হয় ইমার্জেন্সিতে। আর যখন সারা দেশের মানুষ ডক্টরের শেষ সংবাদ শুনে এসে কান্না আর স্মৃতিতে কাঁপিয়ে তুলছে হাসপাতাল তখন ইমার্জেন্সির বেডে শুয়ে একা একা তিনি বিড়বিড় করছেন

কোথায়? ডক্টর কোথায়? কখন? কীভাবে?
যারা আসছে তাদের সবার মুখে এইসব প্রশ্ন আর যারা আগে এসছে তাদের চোখে পানি- শরীরে উত্তেজনা- মুখে কথার তুবড়ি। প্রশ্ন যে করছে সে প্রমাণ করছে তার দুশ্চিন্তা আর উত্তর যে দিচ্ছে সে প্রমাণ করছে তার শোক। কিন্তু কেউই শুনছে না কারো কথা। শোনার দরকার নেই। বলাটাই মুখ্য। মুখ নাড়লেই হলো। তাই ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে স্মৃতিচারণ- অভিজ্ঞাতা বর্ণনা আর টিভি ক্যামেরা দেখলে কান্নার কম্পিটিশন। শুধু একটা মেয়ে হাসপাতাল গেটে এসে জিজ্ঞেস করে- খালামণি কই?

এই মেয়েটা কেউ না। ডক্টরের ছাত্রীও না আত্মীয়ও না। তার কয়েকটা ফ্রেন্ড ডক্টরের স্টুডেন্ট। সে মাঝে মাঝে ডক্টরের ক্যাম্পাসে আড্ডা মারতে যায়। কিছুদিন আগে ডক্টরকে জড়িয়ে মেয়েটার নামে একটা স্ক্যান্ডালও ছড়িয়েছে ক্যাম্পাসে। পরপর কয়েকদিন ডক্টরের ডিপার্টমেন্টে যাওয়ার পরেই তার নামে এই স্ক্যান্ডাল। স্ক্যান্ডালের জন্য ডক্টরের ক্যাম্পাস তুলনাহীন। আর ডক্টরকে নিয়ে সপ্তায় দুয়েকটা স্ক্যান্ডাল ওখানে রুটিন ওয়ার্ক। অনেক মেয়ে নিজেই ডক্টরকে জড়িয়ে নিজের নামে স্ক্যান্ডাল ছড়ায়। এতে খুব দ্রুত পরিচিত হওয়া যায়। আর ছেলেরা ছড়ানোর সময় খুব যতœ করে প্রমাণ করে যে সে ডক্টরের খুব ঘনিষ্ঠ এবং ডক্টরকে নিয়ে অনেক বেশি চিন্তিত। এতে ডক্টরের ঘনিষ্ঠ হিসেবে বহু জায়গায় দ্রুত নিজের গুরুত্ব আদায় করে ফেলা যায়

নিজেকে পরিচিত করার জন্য ডক্টর এক বিশাল ওয়ানস্টপ সার্ভিস। সারা দেশের মিডিয়া এবং সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রণ করছে তার শিষ্যরা। যারা তার স্টুডেন্ট কিংবা ভাবশিষ্য নয় তারাও মনে মনে নিজেদেরকে তার শিষ্য হিসেবে ভাবে কিংবা পরিচয় দেয়। আর যখনই সুযোগ পায় তখনই প্রচার করে ডক্টরের সাথে তার ঘনিষ্ঠতা। এবং কারো সাথে ঘনিষ্ঠতা প্রমাণের সবচেয়ে সহজ উপায় হলো তার সম্পর্কে চিন্তিত হবার ভান করা এবং তার কিছু গোপন সংবাদের উৎস হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা। কিন্তু ডক্টর এমন এক মানুষ যার প্রতিদিনকার খবর কমপক্ষে বিশটা মিডিয়া রাখে এবং যার স্টুডেন্ট কিংবা ভাবশিষ্যরা বিনা নোটিসেই যখন তখন তার বাড়িতে যাওয়া আসা করে; সেরকম একটা মানুষের বিশেষ খবর স্ক্যান্ডাল ছাড়া আর কী হতে পারে? তাছাড়া স্ক্যান্ডালের সবচেয়ে বড়ো সুবিধা হলো এটা শ্রোতাকে কান ধরে টেনে রাখে পুরোটা সময়

মেয়েটা তার বন্ধুদের সাথে গিয়েছিল ডক্টরের বাসায়। ডক্টর ছিলেন না। ছিলেন খালামণি। একটু পরেই যখন ডক্টর চলে এলেন তখন সে চলে আসে। কারণ এতো বড়ো মানুষের সাথে কথা বলতে তার ভয় লাগে। বড়ো মানুষেরা দূরে থাকাই ভালো। এছাড়া সে ডক্টরের বইগুলো পড়েওনি। ডক্টরের সামনে গেলে যদি তিনি তার বই সম্পর্কে প্রশ্ন করে বসেন? তাছাড়া মিডিয়াতে তার কোনো আগ্রহ নেই। ডক্টরের নাম বলে কোথাও গেটপাস কিংবা পাত্তা আদায় করার দরকারও নেই তার। সে ডক্টরের বাসায় গেছে এবং ডক্টরের স্ত্রীর সাথে বসে গল্প করেছে এটাই তার জন্য স্বস্তিদায়ক

এই একদিনই সে খালামণিকে দেখে। খালামণির সাথে আলাপ করে। আর পাবলিক মিডিয়াতে ডক্টরের মৃত্যুর কথা শুনে হাসপাতালে এসে সে ডক্টরকে না দেখে গিয়ে হাজির হয় ইমার্জেন্সির বেডে। ইমার্জেন্সির বেডে তখন খালামণি একা। একা একা কথা বলছেন

খালামণি একা একা কী বলছেন? গত আঠারো বছর তিনি ডক্টরের সাথে কথা বলেন না। চব্বিশ বছরের সংসারে প্রথম ছয় বছর তাদের মধ্যে কথাবার্তা ছিল। আর সংসারের আগে কথা বলেছেন দুই বছর। কিন্তু আঠারো বছর ধরে তারা সংসারে শব্দহীন। তাদের এই নির্বাক সংসার যাপনের কথা স্ক্যান্ডালবাজরাও জানে না। জানে ডক্টরের কিছু আত্মীয়। যারা ডক্টরের অসুস্থতার জন্যও খালামণিকে দায়ী করে। খালামণি যতœ করেননি বলেই ডক্টর এভাবে অসুস্থ হয়েছেন। খালামণি তার কোনো উত্তর দেননি কোনোদিন

যতœ করা মানে যদি সিগারেট ছাড়ার জন্য ঘ্যানঘ্যান করা বোঝায়। কিংবা মদ না খাওয়ার জন্য দিব্যি দেওয়া কিংবা কোনো মেয়ে স্টুডেন্টের সাথে ঘনিষ্ঠতার জন্য খিটখিট করা তাহলে খালামণি কিছুই করেননি গত আঠারো বছর। আঠারো বছর কেন চব্বিশ বছরেও করেননি কিছু। এতে যদি ডক্টর অসুস্থ হয়ে পড়েন তাহলে তার দায় খালামণির। কিন্তু ডক্টর কেন ডক্টর হয়ে উঠলেন? কেন লক্ষ লক্ষ মানুষ তার নাম যুক্ত করে নিজেদের পরিচয় দেয়? কেন তাকে দেখার নাম করে নিজেদের দেখাতে গিয়ে হাজার হাজার মানুষ এই দালানের ইট সিমেন্ট খসিয়ে দেয়?

ছাব্বিশ বছর আগে ডক্টর তো ডক্টর ছিলেন না। আঠারো বছর আগেও তার নাম কেউ জানতো না। সেখান থেকে তার ডক্টর হয়ে উঠার পেছনে কি কোনো যতœ নেই? ভার্সিটিতে অধ্যাপনার জন্য যে রেজাল্ট লাগে ডক্টরের তার কানাকড়িও ছিল না। তার রেজাল্ট দিয়ে বড়োজোর গ্রামের হাই ইস্কুলে মাস্টারি পেতে পারতেন তিনি। কিন্তু ডক্টর দেশের সবচেয়ে নামকরা ভার্সিটির নামকরা অধ্যাপক

পরিচয়ের সেই প্রথম দিকে; যখন কেউ কারো নাম ছাড়া জানেন না কিছু। ডক্টর বলেছিলেন- শারীরিক সঙ্গ পয়সা দিলেও পাওয়া যায় কিন্তু মানসিক সঙ্গ পাওয়ার জন্য লাগে একজন্ম সাধনা

খালামণি কথা বলতেন না। ডক্টরও না। কিন্তু ডক্টরের এমন কি কোনো শব্দ আছে যার প্রতিটি বর্ণ খালামণি চেনেন না? এমনি কোনো বাক্য আছে যার প্রথম পাঠক খালামণি নন? এমনকি কোনো প্যারাগ্রাফ আছে যার প্রথম মন্তব্য খালামণির নয়? এমন কি কোনো বই আছে তার যার সর্বশেষ প্র“ফ খালামণির কলমে নয়?

ডক্টর স্লিপ লিখতেন খালামণিকে। তারিখ দেওয়া এই স্লিপগুলো শুধু খালামণি দেখতেন আর রেখে দিতেন একটা বাকশে বন্ধ করে। সেইসব স্লিপে কী লিখতেন ডক্টর?

- ভালো রেজাল্ট প্রতিবছরই কেউ না কেউ করে। প্রতি বছরই কেউ না কেউ বহু ভালো চাকরি পায়। কিন্তু আমি এমন কিছু করতে চাই যা একমাত্র আমিই করতে পারি। ভালো রেজাল্ট করার কাজ আমার নয়
ডক্টর যখন একেবারে তরুণ। পরিচয়ের সেই প্রথম দিকে ডক্টরের এই কথাগুলো খালামণি ছাড়া আর যারা শুনেছে তারা কি মনে রেখেছে কেউ?
- কিছু করতে হলে তোমাকে এমন একটা জায়গায় যেতে হবে যেখানে দাঁড়ালে তোমার কথা শোনার জন্য মানুষ অন্তত একবার ফিরে তাকাবে
খালামণির এই কথায় স্বপ্নময় ডক্টর শিশুর মতো জিজ্ঞেস করেছিলেন- সেই জায়গাটা কোথায়?
- তোমার জন্য ইউনিভারসিটি সব চেয়ে ভালো জায়গা
- কিন্তু আমার রেজাল্ট?
- অন্যভাবে নিজেকে অনিবার্য করে তুলতে পারলে রেজাল্ট ছাড়াও ভার্সিটিতে ঢোকা যায়

তখনও স্লিপের চল শুরু হয়নি। তখন কথার পিঠে কথা গেঁথে স্বপ্নকে এগিয়ে নেয়ার সময়। ডক্টর যেখানটায় নিজে দাঁড়াতে চান সেদিকে পা বাড়ান। কিন্তু ডক্টরকে অনিবার্য হয়ে উঠার সঙ্গে সঙ্গে উপযুক্তও হয়ে উঠতে হবে। কীভাবে? ...ডক্টরের জন্য একটা ডক্টরেট দরকার। কিন্তু ডক্টরেট একটা কেরানিবিদ্যা। ডক্টর সেখানে সময় দিলে তার কাজের কী হবে?

খালামণিতো আছেন। গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে উপাত্ত জোগাড়। রাতের পর রাত জেগে থিসিস তৈরি। খালামণি একা। ডক্টর শুধু কাগজগুলো তার নামে জমা দেন আর দেখেন তার নামে একটা ডক্টরেট হয়ে গেছে

এই ক্যাম্পাসটায় যখন তারা এলেন তখন ডক্টরের সব মেয়ে স্টুডেন্টই তাকে হয় আপা না হয় ভাবী ডাকতো। আর এখনতো বাইরের অন্যরাও ডাকে খালামণি। ...অনেক সময়। ...বহু বছর। এখন ডক্টরের আশেপাশে এত লোক আছে যে খালামণি আছেন কি না টেরই পায় না কেউ। কিন্তু ডক্টরের এই মধ্যমণি হয়ে উঠা; একটু একটু করে জনতার মাঝখান থেকে একজন হয়ে উঠা; এর সাক্ষী কে? অত লোকের মধ্যে কেউ? নাকি খালামণি? কিন্তু তার নামেতো অসংখ্য অভিযোগ- তার অবহেলার জন্যই ডক্টরের এই দশা আজ

এর উত্তর খালামণি কাকে দেবেন? ডক্টর যদি ফিরে আসতেন তাহলে হয়তো আঠারো বছর পরে খালামণি মুখ খুলে তাকে বলতেন এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়ে যেতে। অথবা হয়তো ডক্টর ফিরে এসে প্রথমেই এই প্রশ্নগুলোর উত্তর নিজে থেকে দিতেন

স্লিপগুলোতে খালামণিকে কী লিখতেন ডক্টর? কথা না বলার কোনো কারণ কি তিনি স্লিপে লিখেছেন কোনোদিন? খালামণি কি কোনো উত্তর দিয়েছেন সেসব স্লিপের? ...কেউ জানে না। কেউ জানে না কথা না বলেও কেন তারা আঠারো বছর এক সংসারে ছিলেন। কেন তারা কাউকেই বুঝতে দিতেন না যে তারা কথা বলেন না

সম্পর্ক কোথায় গিয়ে অভিমান হয়ে উঠে আর অভিমান কোথায় গিয়ে হয়ে পড়ে নির্বাক; তৃতীয় কোনো মানুষ কি তা বোঝে? নাকি কাউকে বোঝানো সম্ভব? যার উপর অভিমান সেও কি বোঝে? অথবা যে অভিমান করে সে নিজেও কি অভিমান আর অবিচারের মধ্যে সব সময় পার্থক্য করতে পারে? কাউকে কি বোঝানো যাবে যে আঠারো বছর কথা হয় না কিন্তু সংসার কীভাবে হয়? সেই সংসার কেন টিকে থাকে তার ব্যাখ্যা কি দেয়া যাবে কাউকে? দিলেও বুঝবে কেউ?

খাবার সময় পাতে খাবার তুলে দেয়া- সময়মতো ওষুধ খাওয়ানো; এর জন্য কি বৌ দরকার ছিল ডক্টরের? এটাকেই কি মানুষ যতœ নেয়া বলে? যে কাজ পাঁচ বছরের শিশুও নিজে করতে পারে তা না করলে কিংবা তা করা বাদ দিলেই কি কারো প্রতি যতœ না নেয়ার অভিযোগ তোলা যায়? খালামণি কি ডক্টরের গৃহিণী ছিলেন? নাকি নার্স? নাকি স্ত্রী? নাকি অন্য কিছু? ...কিন্তু ডক্টরের আত্মীয়রা তাকে জানে ডক্টরের স্ত্রী বলে; যিনি আজ ডক্টরের নামে সম্মানিত। তবে কেন তিনি ডক্টরকে যতœ করবেন না? কিন্তু ডক্টরও কি একই রকম ভাবেন?

কিন্তু ডক্টর কিছুই বলেননি কাউকে কোনোদিন। এমনকি যখন তার স্টুডেন্টদের কেউ কেউ ইঙ্গিতে অভিযোগ করত খালামণিকে তখনও না। ডক্টর শুধু ব্যস্ত ছিলেন ক্রমাগত ডক্টর হয়ে উঠায়। অন্য কিছুকে কখনও তার দায়িত্ব মনে করেননি তিনি

সেই সময়টায়। যখন দেশের প্রায় সবাই ভয় পাচ্ছিল যে মৌলবাদীরা ডক্টরকে আক্রমণ করবে যে কোনো সময়। তাকে হত্যাও করতে পারে তারা। তার স্টুডেন্টরা পালা করে যখন তাকে পাহারা দিচ্ছিল বাড়ির ভেতরে বাইরে। ...প্রত্যেকে ডক্টরের জন্য চিন্তিত। শুধু চিন্তিত নয় উত্তেজিতও। তখন উত্তেজনার অংশ হিসেবেই এক ছাত্র অভিযোগ করে বসে- খালামণির তো কোনো চিন্তা নেই মনে হচ্ছে

কথাটা ডক্টরও শুনলেন। কিন্তু তাকালেনও না। তিনি তখন একটা শব্দ খুঁজতে ব্যস্ত। একটা শব্দ তার কাছে অনেক মূল্যবান। তিনি তখন পাতার পর পাতা নষ্ট করছেন শব্দ খুঁজে। কিন্তু পছন্দের শব্দ পাচ্ছেন না। কাগজ দুমড়ে ফেলছেন বাস্কেটে। বাস্কেট ভরে উঠছে খসড়া রচনায়। ডক্টর চূড়ান্ত অনিবার্য শব্দ খুঁজছেন। শব্দই তার ব্রহ্মাস্ত্র। কিন্তু তারই সামনে তারই স্টুডেন্টের শব্দগুচ্ছ খালামণিকে আক্রমণ করছে তিনি তা খেয়ালই করলেন না। অথবা খেয়াল করলেও সেখানে একটা মামুলি শব্দ খরচ করতে তিনি নারাজ। তাহলে কি তিনি নিজেও মনে করেন যে যখন তার প্রাণ বিপন্ন তখন খালামণির কোনো চিন্তা নেই?

খালামণি তার ঘরে। কোনো স্টুডেন্টের জানার কথা নয় খালামণি ঘুমিয়ে আছেন না টিভি দেখছেন। কিন্তু ডক্টর? যিনি তার পড়ার ঘর- থাকার ঘর- ডাইনিং ঘর রেখেও সব সময় খালামণির ঘরে গিয়ে পানি খান। সে ঘরের দরজা ভেজানো থাকে কিন্তু কোনোদিনও সিঁটকিনি লাগে না। রাত জেগে যতক্ষণ ডক্টর লেখেন কিংবা পড়েন ততক্ষণ সে ঘরে আলো জ্বলে। গত আঠারো বছর ধরে খালামণির শো কেসের উপর একটা গ্লাস আর জগ ভর্তি পানি থাকে সারাদিন। সারারাত। এই পানি ডক্টর ছাড়া অন্য কেউ খায় না

সেই ঘরে ডক্টর আজ অন্যদিন থেকে অনেক বেশিবার গেছেন। খুব ধীরে ধীরে পানি খেয়েছেন। যদিও সবাইকে তিনি বলেছেন প্রাণের ভয় তিনি করেন না। প্রাণনাশের হুমকিতে তার জীবনযাত্রায় কোনো পরিবর্তন আসেনি। কিন্তু তিনি তো জানেন এই কয়দিন তিনি দিনে কত বেশিবার পানি খেতে সেই ঘরে গেছেন। এই কয়দিনে সেই ঘরের লাইট একবারও অফ হয়নি তা আর কেউ না জানুক ডক্টরতো জানেন। অন্তত তিনিতো জানেন এই কয়দিন ধরে সেই ঘরের দরজা একেবারে হাট করে খোলা থাকে চব্বিশ ঘণ্টা

কিন্তু সেই ঘরের খবর অন্য কেউ জানে না। না তার আত্মীয়েরা- না তার শুভাকাক্সক্ষী স্টুডেন্টেরা। তাই তারা অবলীলায় বলতে পারে খালামণির কোনো চিন্তা নেই। কারণ এই কয়দিনে তারা খালামণিকে একবারও ডক্টরের পড়ার ঘরে আসতে দেখেনি। কিন্তু ডক্টরতো জানেন খালামণি কখন এই ঘরে ঢোকেন?

ডক্টর কোনোদিনই তার কাগজপত্র গুছিয়ে রাখেন না। কিন্তু প্রতিদিনই ফিরে এসে দেখেন তার কাগজপত্র গোছানো। তিনি কোনোদিনও লেখার সময় তার লেখাগুলোতে পৃষ্ঠা নম্বর দেন না। কিন্তু তার প্রতিটা লেখাতেই পৃষ্ঠা নম্বর থাকে। যে কেউ পাতাগুলোর দিকে তাকালেই দেখবে লেখাগুলো এক হাতের আর পৃষ্ঠা নম্বর অন্য হাতে লেখা। এই পৃষ্ঠা নম্বর নিশ্চয়ই কোনো স্টুডেন্ট কিংবা কাজের লোক দেয় না। ডক্টর জানেন এই কাজগুলো কার। কে পারে তার এলোমেলো পাতাগুলোতে সঠিক পৃষ্ঠা নম্বর দিয়ে গোছাতে। কে তার কাটাছেঁড়া করা পাতাগুলোকে আবার ফ্রেশ কপি করতে পারে ডক্টর তা জানেন

ডক্টর না থাকলে তার ঘর সব সময় তালা দেয়া থাকে। এটা সবাই জানে। কিন্তু ডক্টর জীবনেও কোনো তালা নিজের হাতে লাগাননি। কোনো তালা খোলেনওনি। এমনকি কোনো চাবিও তার কাছে নেই। তিনি তার মতো বের হয়ে গেছেন কাগজপত্র আর বই এলোমেলো রেখে। যখন ফিরে এসেছেন তখন দেখেছেন বই আর কাগজপত্র ঠিকঠাক গোছানো। এলোমেলো পাতাগুলোতে পৃষ্ঠা নম্বর দেয়া। লেখার কোনো কোনো জায়গায় অন্য কালিতে বিভিন্ন চিহ্ন আঁকা। এসব চিহ্নের মানে ডক্টর জানেন; এই চিহ্নগুলোর কোনোটার মানে- এই বিষয়টা আরো ভাবা দরকার। কোনোটার মানে- এখানে তথ্যগত ভুল আছে। কোনোটার মানে- এখানে রিপিটেশন। কোনোটার মানে- এখানে আরেকটু ডিটেল করা দরকার... এগুলো ছাব্বিশ বছর আগে আবিষ্কার করা চিহ্ন। তখন ডক্টরের এলোমেলো লেখাগুলোকে গোছানোর দায়িত্ব যে নিয়েছিল সে সারারাত ধরে তার লেখাগুলো পড়তো আর মার্জিনে এই চিহ্নগুলো বসাতো। ডক্টর পরেরদিন সেই চিহ্নগুলো দেখে দেখে লেখা এডিট করতেন। সেই নিয়ম এখনও চলছে। মার্জিনে অন্য কালিতে চিহ্ন দেয়া আর চিহ্ন দেখে দেখে এডিট করা। ডক্টর জানেন তার খসড়া পাণ্ডুলিপিতে কে দাগ দেয়। এবং একমাত্র ডক্টরই জানেন কেন তিনি কয়েক পাতা লেখার পর লেখাগুলো টেবিলে ফেলে রেখে বাইরে চলে যান। কেন তিনি গুরুত্বপূর্ণ লেখার ফাঁকে কয়েক ঘণ্টা কোথাও গিয়ে ঘুরে আসেন। ...তিনি জানেন কালোকালিতে লেখা তার খসড়া পাণ্ডুলিপিটা টেবিলে ফেলে যতক্ষণ তিনি বাইরে ঘুরবেন ততক্ষণ তার পাতাগুলোতে পৃষ্ঠা নম্বর পড়বে। লাইনের ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন প্রতীক আর চিহ্ন বসবে নীল রংয়ের কালিতে এবং তিনি ফিরে এসে নীল কালির সূত্র ধরে দ্রুত ফাইনাল করে ফেলবেন খসড়া পাণ্ডুলিপি

তার সেই প্রাণ আশঙ্কার দিনে প্রতি ঘণ্টায় কতটা স্লিপ জমে উঠেছে খালামণির ঘরে পানির জগের কাছে তা ডক্টর জানেন। কিন্তু ডক্টরের শুভাকাক্সক্ষী স্টুডেন্টরা দেখেছে যে খালামণিকে একবারও দেখা যায়নি ডক্টরের ঘরে। তাই হয়তো তার কোনো চিন্তা নেই। কিন্তু ডক্টর কথাটা শুনেও বললেন না কিছু। হয়তো তাতে তার মাহাত্ম্য কমে যেত । হয়তো তিনি মনে করেন স্ত্রীর পক্ষে কথা বলা কোনো কেরানিকে মানায়। ডক্টরের পক্ষে স্ত্রীর পক্ষ নিয়ে কথা বলা বেমানান। ডক্টর শুধু কথা বলবেন জাতি আর মানবজাতির পক্ষ নিয়ে

সন্ধ্যা পর্যন্ত খালামণি জানেন না কিছু। দুপুরের পরে মেয়েটি ছাড়া তাকে দেখে গেছে শুধু নার্স। ডক্টরকে দেখতে এসে মেয়েটি একবারের জন্যও ডক্টরকে দেখতে যায়নি। ডক্টরকে দেখছে পুরো জাতি। ডক্টরের দায়িত্ব জাতির। তারাই ঠিক করছে ডক্টর কখন হাসপাতাল থেকে বের হবেন। বের হয়ে কোথায় যাবেন না যাবেন। কে কতক্ষণ ডক্টরের জন্য কাঁদবে- কে কীভাবে কোন কথা বলবে; সবই ঠিক করছে তারা

কিন্তু খালামণি কথা বলছেন একা। অন্য কেউ না শোনার মতো করে বলছেন তিনি। তিনি কি আঠারো বছরের কথাগুলো রিহার্সাল করছেন? যেন ডক্টর সুস্থ হলেই একসাথে সব বলে ফেলতে পারেন? নাকি তিনি বুঝে গেছেন ডক্টর আর শুনবেন না কিছু তাই বাতাসে উড়িয়ে দিচ্ছেন ডক্টরের উদ্দেশ্যে বলার মতো আঠারো বছরের সবগুলো কথা? তিনি কি কিছু টের পেয়েছেন? কখন? সকালেই?

সকাল থেকেই তিনি বিড়বিড় করছেন। তখনও ডাক্তার আশাবাদী। কিন্তু হঠাৎ করেই খালামণি বিড়বিড় শুরু করলেন আর তার প্রেশার নামতে শুরু করল। আইসিইউর ভেতর থেকে অজ্ঞান ডক্টর কি আঠারো বছর পরে কোনো সংকেত পাঠিয়েছিলেন খালামণিকে? যে সংকেত একমাত্র তিনি আর খালামণি বোঝেন? এমন কোনো সংকেত কি ডক্টর সকালেই খালামণিকে দিয়েছেন? আঠারো বছর পরে কি অজ্ঞানতার দূরত্ব থেকে খালামণির জন্য তিনি প্রথম শব্দ উচ্চারণ করেছেন- বিদায়? আর তারপর থেকেই অভিমানে আটকানো আঠারো বছরের কথা জলোচ্ছ্বাসের মতো বের হয়ে আসছে খালামণির মুখে? এই কথাগুলো কি কেউ শুনছে না? ডক্টরও না?

ডক্টর নিশ্চয়ই শুনছেন খালামণির কথা। যদিও ডক্টর তা স্বীকার করবেন না বরাবরের মতো। আত্মীয় আর শিষ্যদের সামনে স্ত্রীর পক্ষে কোনো কথা বলবেন না ডক্টর। কারণ তিনি জানেন আঠারো বছর পরে খালামণি তাকে কী বলতে পারেন? আঠারো বছর পরে খালামণির অভিযোগের উত্তর হয়ত তার যে কোনো স্টুডেন্টও দিতে পারবে। কিন্তু অভিমানের উত্তর কি তিনি আবার জীবিত হয়ে উঠলেও দিতে পারবে? তাই ডক্টর সকাল বেলাই খালামণিকে বিশেষ সংকেত পাঠিয়ে চুপ হয়ে গেছেন। পুরো জাতি ডক্টরকে নিয়ে ভাবছে আর খালামণি ইমার্জেন্সির বেডে শুয়ে অনর্গল কথা বলছেন ডক্টরের সাথে। এখন ডক্টর তার সবকথা শুনছেন। এখন ডক্টর একেবারে ফ্রি। তিনি মৃত। তিনি এখন খালামণির আঠারো বছরের না বলা কথার শ্রোতা

খালামণির খোঁজে কেউ না আসায় রাত দশটায় মেয়েটা বাইরে যায়। তখন ডক্টরের লাশ বাইরে নেয়ার আয়োজন হচ্ছে। খালামণির কথা কেউ জানে না। অথবা ভুলে গেছে। মেয়েটা ডক্টরের লাশ আগলে দাঁড়ায়- এখানে খালামণি আছেন। তার কাছে কে থাকবে?

জাতি এই অর্বাচীন মেয়েটির উপর খুবই বিরক্ত হয়। যখন ডক্টরের লাশের উপর ফুলের ডিজাইন কী হবে এবং তাকে খোলা গাড়িতে না ঢাকা গাড়িতে নেয়া হবে এই নিয়ে সবাই চিন্তিত তখন কি না খালামণির নাম করে ডক্টরের লাশ আটকে দিলো কোথাকার কোন এক মেয়ে? কিন্তু বিষয়টা সেনসিটিভ। আর যেহেতু মেয়েটাকে কেউ চেনে না সেহেতু তার গ্যাঞ্জাম করার ক্ষমতা সম্পর্কে কারো ধারণা নেই। তাই তাকেই খালামণির কাছে থাকার প্রস্তাব করে তারা

ডক্টরের লাশ সবার আগে তার ক্যাম্পাসে যাবে। সেখান থেকে রাতেই ঘুরে আসবে আবার হাসপাতালে। পরদিন সকাল থেকে ডক্টর কবরে যাওয়ার আগে পর্যন্ত ভিজিট করবেন অনেকগুলো জায়গা। অন্তত ডক্টর তার ক্যাম্পাস থেকে ঘুরে আসার আগে যেন খালামণি না জানেন ডক্টর আর নেই। মেয়েটাকে এই পরামর্শ দিয়ে তারা রওয়ানা দেয় ডক্টরের ক্যাম্পাসের দিকে

ডক্টর কখন আবার হাসপাতালে ফিরে এলেন তা খালামণিও জানেন না। পাশে বসা মেয়েটিও না। পাশে যে কেউ বসে আছে খালামণি তা জানেনও না। সকালে তার ছেলে যখন তাকে নিয়ে গেলো তখনও তিনি একটি কথাও বললেন না মেয়েটির সাথে। তাকালেনও না। হয়তো তাকে দেখেনইনি তিনি। অথবা দেখলেও বুঝতে পারেননি যে তার জন্য কেউ বসে থাকতে পারে অথবা তার কাছে কেউ আসতে পারে। গত ছাব্বিশ বছরে যারা তার কাছে এসেছে তারা ডক্টরের জন্য এসেছে। ডক্টরকে দেখতে এসে সামনে পড়ে যাওয়ায় তাকেও দেখেছে। তাকে যে কেউ দেখতে আসতে পারে এই কথা কীভাবে তিনি বিশ্বাস করেন? তাই ছেলে যখন তাকে যাওয়ার কথা বলল তিনি উঠে চলে গেলেন মেয়েটির দিকে একবারও না তাকিয়ে

মেয়েটি কিছুই বলেনি তাকে। ছেলেও ডক্টর সম্পর্কে খালামণিকে বলল না কিছু। শুধু যেতে বলল আর বিড়বিড় করতে করতে বের হয়ে গেলেন তিনি

পরের দুদিন ডক্টরকে বহু জায়গায় ঘুরতে হলো। যেসব জায়গা তার প্রিয় ছিল। যেসব জায়গায় তিনি লড়াই করেছেন তার ডক্টর হয়ে উঠার পুরোটা সময়। সবগুলো জায়গায় গিয়ে ডক্টর ফুল নিলেন। কান্না নিলেন। মিডিয়াকে সংবাদ আর ছবি দিলেন। এবং পুরো দুদিন সবগুলো পত্রিকা আর টিভি জুড়ে থাকলেন ডক্টর। খালামণি কোথাও নেই। কেউ তার খোঁজও করল না- তার সম্পর্কে লিখলও না। তাকে দেখলও না- দেখালোও না। তাকে নিয়ে কিছু বললও না- তাকে দিয়ে কিছু বলালোও না। সবাই নিজেকে দেখাল- নিজের মতো বলল- নিজের মতো লিখল আর পছন্দমতো কান্না করল

খালামণি কি এই দুদিন পত্রিকা পড়েছেন? তিনি কি টিভি দেখেছেন এই দুদিন? তিনি কি জানেন ডক্টরের কথা? তাকে জানিয়েছে কেউ? ...খালামণি কোথায়?

সব শেষে ডক্টর আসলেন শহীদ মিনারে। শহীদ মিনারে শহীদ দিবসেও অত মানুষ আসে না। যত মানুষ আজ এখানে এসেছে। এর মধ্যে খালামণি কোথায়? মেয়েটি কাকে জিজ্ঞেস করবে? এখানকার কেউ কি খালামণিকে চেনে?

না। খালামণি কোথাও নেই। তাকে আনা হয়নি কিংবা তাকে জানানো হয়নি ডক্টর এখানে এসেছেন। খালামণির কথা কারো মনে নেই। সবাই ব্যস্ত ডক্টরকে দেখতে আর নিজেকে দেখাতে। কেউ এসেছে ডক্টরের লেখার কোটেশন দিয়ে ডিজিটাল ব্যানার বানিয়ে। কেউ এসেছে ডক্টরের নাটকের কোনো চরিত্রের পোশাক পরে। কেউ এসেছে ডক্টরের কোনো বাণী কিংবা সংলাপ জোরে জোরে আওড়াতে আওড়াতে। কেউ এসেছে ডক্টরের বই হাতে নিয়ে। কেউ হাতে করে নিয়ে এসেছে ডক্টরের ছবি। আর ডক্টরকে আনা হয়েছে তার সর্বশেষ নাটকের সেটে করে; যে নাটকে তিনি এক অর্ধমৃত অধ্যাপককে করে তুলেছিলেন বৈশ্বিক মানবতা ও শান্তির প্রতীক। সেই অধ্যাপক মঞ্চে যে হুইল চেয়ারে চলাফেরা করতেন ডক্টরের লাশকে আনা হয়েছে সেই চেয়ারে শুইয়ে। চেয়ারের আশেপাশে মাইলকে মাইল জুড়ে ফুল আর মানুষ আর সংবাদপত্র আর ক্যামেরা আর কথা আর শব্দ আর ফোন আর কান্না। কিন্তু খালামণি নেই

মেয়েটার অবাক লাগে। মানুষ তিনদিন পরে কীভাবে কাঁদে? কান্না যদি সত্যি সত্যি আসে তাহলেতো সেই কান্না সঙ্গে সঙ্গেই কেঁদে ফেলার কথা। কিন্তু এখানে কেউই সাক্ষী ছাড়া কাঁদতে পারে না। যখন একা থাকে তখন তারা মোবাইলে কথা বলে। কিন্তু যখনই ক্যামেরার সামনে পড়ে তখন কাঁদে। কাঁদে ডক্টরের জন্য। চোখ মোছে। আর ক্যামেরা ঘুরে গেলেই কান্না থামিয়ে পাশের জনকে জিজ্ঞেস করে- এটা কোন টিভি? ...এরা সবাই ডক্টরের শিষ্য- ভাবশিষ্য কিংবা মনে মনে শিষ্য। এরাই এখানে আছে। কিন্তু ছাব্বিশ বছর ধরে যিনি ডক্টরের সঙ্গে ছিলেন তিনি নেই

আঠারো বছর কথা না বলার জন্য কি এখানকার কেউ দায়ী নয়? ক্রিয়েটিভ মানুষের জন্য দরকার মানসিক সুস্থতা আর স্বাধীনতা। সেই সুযোগ কি কেউ নেয়নি? ডক্টরের সঙ্গে খালামণির অস্তিত্ব কি সব সময় মনে রেখেছে সবাই? ...আত্মীয়রা এর জন্যও খালামণিকে দায়ী করে। নিজের স্বামী অন্য মেয়েদের সাথে মেশে; এটা যে আটকাতে পারে না সে আবার কীসের স্ত্রী? স্বামীকে সামলাতে হয়। ...স্বামীকে সামলানো মানে বাড়িতে তাকে বিষিয়ে তোলা। কর্মস্থলে গিয়ে গোয়েন্দাগিরি করা। অন্য মেয়েদেরকে ফোনে হুমকি দেয়া। তাতে স্বামীরা নিয়ন্ত্রিত হয়। কিন্তু সত্যি কি হয়?

মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়? নাকি করা উচিত? মানুষের মন যদি চলে যায় কিংবা থাকতে না চায় তবে তার শরীরকে আটকে কী লাভ? শরীরকে আটকে হয়ত কোনো চাষি বৌর লাভ হয় কিন্তু ডক্টরের শরীরকে আটকে খালামণির কী লাভ? ডক্টরকে বিষিয়ে তুলে ঘরে আটকালে কি টেবিলের সাদা কাগজগুলোতে আদৌ লেখা হতো কিছু?

খালামণি জানতেন। ডক্টর জানতেন। কিন্তু ডক্টর কি নিজে থেকে কিছু করতে পারতেন না? খালামণি কোনোদিন বাধা দেননি বলে খালামণির খারাপ লাগার অধিকারটাও কি তিনি ভুলে যাবেন? খালামণি কোনো আপত্তি করবেন না বলে কি সব কিছুই খালামণির চোখের সামনে করতে হবে? সামান্য একটু আড়াল করার দায়িত্বও কি নিতে পারতেন না ডক্টর অথবা তার যে মেয়ে স্টুডেন্টরা এখন এখানে সেজেগুজে মেকাপ দিয়ে এসে কাঁদছে তারা? তারাও কি একটু ভাবতে পারতো না খালামণির কথা? ডক্টর তো মানবজাতির আইকন। তিনি মানুষের অন্তরের পরিশুদ্ধি আর মানবিক দায়িত্বের কথা বলতেন। তার স্টুডেন্টরা কি এইটুকু দায়িত্ববান নিজেদেরকে প্রমাণ করতে পারতো না? একটা মানুষের কষ্ট কমানোর জন্য কি সামান্য একটু কষ্ট করতে পারতেন না ডক্টর কিংবা তার শিষ্যরা?

ফুলে ফুলে ছাওয়া শহীদ মিনারের বেদিতে দাঁড়িয়ে পুরো শহরকে দেখে মেয়েটি। সবাই নিজের চেহারা আর ডক্টরের জন্য মায়া দেখাতে ব্যস্ত। দেখাতে না পারলে কান্না অর্থহীন। কান্না করার সময়ই কান্না দেখাতে হয়। তাই সবাই ব্যস্ত। ...ক্যামেরার উপর ক্যামেরা। প্রতিটা ক্যামেরায় সাজানো গোছানো প্রেজেন্টেবল কান্না। মাঝখানে নিজের নাটকের সেটে ফুলের ভেতরে ডক্টর। হয়তো তখনও খালামণি কোথাও কোনো নিভৃত কোনায় বসে একা একা কথা বলছেন। কেউ দেখছে না তাকে। না কোনো মানুষ- না কোনো ক্যামেরা- না মৃত ডক্টর নিজে

মেয়েটা নিজের মোবাইলে ভিডিও অন করে। লেন্সের মধ্যে এক দলা থুতু ফেলে নিজের মুখে ক্যামেরা ধরে রেকর্ড বাটনে চাপ দেয়। তার আশপাশের অসংখ্য সাজানো গোছানো মানুষের সাথে থুতুর ভেতরে ভিডিও হতে থাকে তার নিজের এলোমেলো মুখ
২০০৮.০১.১৮ শুক্রবার


মন্তব্য

অনিন্দিতা এর ছবি

ভীষন ভালো লাগল। একদম ঝিম ধরানো।
মনে হলো চোখের সামনে সব ঘটনা দেখছি।

তাপস শর্মা এর ছবি

জটিল জীবন বোধের কঠিন সাতকাহন!!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।