বনের রাজা হইবার আশায় রাম দেখতে আছে বন; এর মাঝে তার সামনে থাইকা খপ কইরা তার বৌরে উঠায়া নিয়া বনের চকিদার কয়- দুই বেটায় বনবিলাস করতে আছে এক নারী নিয়া। যা বেটা ফুট। এই মাইয়ারে বিয়া করব আমি…
সীতারে কান্ধে তুইলা হাঁটতে হাঁটতে রাম-লক্ষ্মণের গতরে সন্ন্যাসী বেশ আর হাতে অস্ত্র দেইখা ঘাড় ফিরায়া চকিদার কয়- ওইসব অস্ত্রফস্ত্র কিংবা ঋষিবেশ দেখায়া লাভ নাই; আমি বিরাধ রাক্ষস। এইরকম দুইচাইরটা ঋষি আমি ডেইলি কিলায়া হুতাই…
বন ও জলাভূমি যারা ভোগ করে তাগোরে কয় যক্ষ; এরা খুব সম্পদশালী আর ফুর্তিবাজ হয়। যক্ষদের সৈনিকদের কয় রক্ষক আর সাধারণ ভূমিজ যারা বন-জল-প্রকৃতির সম্পদ সংগ্রহ করে; যত্ন নেয়; দেইখা রাখে; তাগোরে কয় রাক্ষস। বনের ভিতর বাইরের লোক দেখলে এরা খেদায়। ভূমির বর্তমান বাসিন্দা বইলা রাক্ষসগো অনেকে ভূত বইলাও ডাকে…
বর্শাহাতে বিরাধের পিটানো শরীর দেইখা রামের গলা হুকায়। কয়- কাণ্ডটা দেখলানি লক্ষ্মণ; রাজা জনকের মাইয়া; আমার বৌ আইজ পরপুরুষের কোলে। আমারে বনে পাঠায়া এই অপমানটাই চাইছিলেন কৈকেয়ী; তার খায়েশই আইজ পূর্ণ হইল। নিজের বৌর শইলে পরপুরুষের ছোঁয়ায় যতটা দুঃখ হইতেছে আমার; সেইটা কিন্তু বাপের মরণ কিংবা রাজ্য হারানো থাইকা শতগুণ বেশি রে ভাই…
লক্ষ্মণ কয়- বৌরে আরেক বেটার কোলে থুইয়া প্যানপ্যান করেন ক্যান? আপনে না বীর? নিজে কিছু করতে না পারলে আমারে কন; তির মারি হালারে। একটাই তো লোক…
রাম-লক্ষ্মণের মুখে রাজবাড়ির কথা শুইনা বিরাধ জিগায়- তোমরা কেডা? যাবা কই?
রাম লোকটা কেডা; এই প্রশ্ন বনে বনে; গ্রামে গ্রামে ছড়াইছে ভরত আইসা ফিরা যাবার পর। মুনিঋষিগো পেন্নাম করতে রাজা-বাদশা হামেশাই বনে আসে। কিন্তু হাতিঘোড়া-সেনাপুরোহিত নিয়া এক রাজা আইসা যেই তরুণের জুতা মাথায় নিয়া ফিরা যায়। লোকটা কেডা?
মুখে মুখে ছড়ায়া পড়ে রামের কাহিনী; বিশ্বামিত্রের শিষ্য- জনকের জামাই- ঋষ্যশৃঙ্গের শালা এই পোলারে একই লগে পছন্দ করেন একাধিক প্রভাবশালী ঋষি ও ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণ-স্বার্থের লাইগা লড়াই দিয়াই যে শুরু করছে ক্ষত্রিয় জীবন; সিংহাসন ছাইড়া ঋষিগো আশ্রমে ঘোরা সেই রামের মাঝে অনেক ব্রাহ্মণই দেখতে পান ভবিষ্যতের আশা…
এক সকালে চিত্রকূটে রামের কুটিরে অত্রি মুনির নাম কইয়া কাইন্দা পড়ে একদল ঋষি- তুমি ছাড়া আমাগো আর কেউ নাই। তুমি যদি রক্ষা না করো তাইলে আশ্রম ফালায়া ভাগা ছাড়া আর কোনো গতি নাই…
এরা সব খুচরা ব্রাহ্মণ। ঋষি হিসাবে নিজের ঘরানা কিংবা প্রতিপত্তি তৈরি হয় নাই। সংবাদ শুইনা বিভিন্ন যজ্ঞে-শ্রাদ্ধে হাজির হইয়া দান-দক্ষিণা নেন আর বনের ফাঁকে ফাঁকে ছোটখাটো গ্রাম বসায়া গবাদিচারণ করেন। কিন্তু ব্রাহ্মণগো এই বন দখল পছন্দ করে না চরের রাজা রাবণ…
রাক্ষস বংশজাত পুলস্ত্য ঘরানার ঋষি বিশ্রবা করছিলেন চাইরখান বিবাহ। ভরদ্বাজ বংশজাত পয়লা বৌ দেববর্ণিনীর গর্ভে জন্মানো বড়োপোলা কুবেরই হয় চইরাগো পয়লা রাজা; এক কালে দুনিয়ার সেরা ধনী বলা হইত তারে…
বিশ্রবার দ্বিতীয় বৌ নিকষার গর্ভে জন্মায় তিন পোলা এক মাইয়া। যার মধ্যে সবার বড়ো রাবণ…
যুদ্ধকলা-চিকিৎসা-জ্যোতির্বিদ্যা আর বাস্তুশিল্পসহ দশখান বিদ্যায় পারদর্শী বইলা রাবণরে দশমাথা বইলা ডাকে মানুষ। জ্যোতির্বিদ্যা-চিকিৎসা আর বাস্তুশিল্পে সংহিতাও রচনা করছে সে। বেদ বিশেষজ্ঞ এই রাবণ বৈদিকগো কোনো নিয়ম কিংবা দেবতারে পুছে না; ব্রাহ্মণ চাটে না; সে স্থানীয় দেবতা শিবের বড়ো ভক্ত; সংগীতে দারুণ দক্ষ রাবণ শিবতাণ্ডব নামে একখান শিববন্দনারও রচনাকার। বৌদ্ধগো লগেও এই লোকের অতিশয় খাতির…
দেশের লোক কেমন আছে না আছে; বাইরের লোকরা জমি-বন-নদী দখল করতেছে কিনা; এইসব নিয়া কোনো মাথাব্যথা আছিল না কুবেরের। সে নিজেরে যক্ষ বইলা পরিচয় দিতেই পছন্দ করত; তার একমাত্র আগ্রহ আছিল নিজের ধনসম্পদ বাড়ানো ধান্দা…
রাবণ তারে খেদায়া দিয়া নিজেই চরের রাজা হইয়া বসে। কুবেরের কাছ থিকা জব্দ করা সম্পদের ভিতর চলাচলের লাইগা রথটা নিজে রাইখা বাকিসব বিলায়া দেয় অন্যদের। ফলে রাবণরে আর কেউ যক্ষ কয় না; কিন্তু তার সোনালি ফসলের দেশ লঙ্কারে মানুষ ডাকতে থাকে স্বর্ণলঙ্কা নামে…
লঙ্কা হরিরুদ নদীর একটা চর। চইরা বা দ্বীপবাসী রাক্ষসগো আর্যরা কয় কয় দানব; বনবাসী কয় বানর…
লঙ্কার রাজধানী চরে হইলেও মূল ভূমির এই বনাগুলারও রক্ষক রাবণ; এইসব এলাকা দেখাশোনা করে রাবণের সতিলা দুই ভাই খর আর দূষণ। আর্যরা আইসা বনে জমি দখল করতেছে দেখলেই এরা পিটায়…
বনের ফাঁকেফাঁকে গ্রাম বসানো এই বাবনরা রাক্ষসগো ঠেকাইতে সহায়তা চাইছিলেন অত্রি মুনির কাছে। অতি প্রবীণ এই মুনির মনে হইছে বনে ঘুইরা বেড়ানো একটা বেকার ক্ষত্রিয় রাইখা নিজে লোক পাঠায়া লাঠালাঠির কী কাম। তিনি তাগোরে কন- রামেরে গিয়া কও তোমাগো সহায়তা দিতে…
আশীর্বাদ যদি আপনে আইসা হাজির হয় তাইলে সেইটা তো ফালানোর কোনো মানে নাই। কথায় কথায় রাম ভরতরে বইলা দিছিল বনে রাজত্ব করব সে। সেই স্বপ্ন তার মাথায় ঝিলিক দিয়া উঠে; অত্রি মুনির আশীর্বাদ পড়ছে তার উপর…
ব্রাহ্মণরা চেষ্টায় আছেন বেদরে কেন্দ্র কইরা একটা বৈদিক সমাজ তৈরির। তারা বিধান দিতেছেন; বাস্তবায়ন করতেছে ক্ষত্রিয়রা। বিধানে তারা সব মানুষরে বিবিধ ভাগ কইরা নিজেগো রাখতেছেন সর্বোচ্চ শ্রেণিতে আর ক্ষত্রিয়গো দিতেছেন অঢেল ভোগ বিলাসের সুযোগ। বাকি দলের মানুষদের কর্ম নির্ধারিত হইতেছে ক্ষত্রিয়ের শাসন মানা আর ব্রাহ্মণের সেবা…
মূল যে সাতটা ঋষি গোত্রের হাতে বেদের রচনা শুরু তার মাঝে চাইরটারই আশীর্বাদ পাইছে রাম। বিশ্বামিত্রের হাত ধইরা তার ক্ষত্রিয় জীবন শুরু; বিশ্বামিত্র তার সংযোগ ঘটায়া দিছেন গৌতম ঘরানার লগে। প্রয়াগে বুক খুইলা রাখছেন ভরদ্বাজ; অযোধ্যার পুরোহিত বশিষ্ঠ ভরতের লগে থাকলেও এখন আর রামের বিরোধিতার মতো বোকামি করবেন না নিশ্চিত…
সপ্তর্ষি নামে সম্মানিত বেদ রূপকার সেই সাত ঘরানার মাঝে এইবার পঞ্চম গোত্রের ঋষি অত্রির আশীর্বাদ আপনাতেই আইসা হাজির হইছে রামের কুটিরে…
সপ্তর্ষি কইলেও মূলত আটখান ঋষি গোত্রের নাম ঘুইরা ফিরা আসে ভিন্ন ভিন্ন তালিকায়; বিশ্বামিত্র-গৌতম-বশিষ্ঠ-ভরদ্বাজ ছাড়া সব তালিকাতেই আছে জমদগ্নির নাম। কিন্তু একেক তালিকায় বাকি দুইটা নাম অগস্ত্য-অত্রি-কশ্যপ; এই তিন গোত্র থাইকা বাইছা বাইছা নেয়া…
রামের বড়ো বইন শান্তার স্বামী ঋষ্যশৃঙ্গও কশ্যপ গোত্রের ঋষি; এরই মাঝে বেশ প্রভাবশালী নিজস্ব গুরুঘরানাও তৈরি কইরা ফেলছেন…
সপ্তর্ষি তালিকার বাইরেও বেশ কিছু প্রভাবশালী ঘরানা আছে রামের লগে। ভৃগুমুনির মেজো পোলার ঘরের নাতি জন্মদগ্নির পুতের হাতে তৈরি হইছিল পরশুরাম ঘরানা। বিয়া কইরা ফিরার পথেই দাঙ্গাবাজ পরশুরামগো কায়দা করছে রাম। ভৃগুমুনির বড়ো পোলা চ্যবন একলাই তৈরি করছেন একাধিক ঘরানা; তার মাঝে একটা হইল বাল্মিকী; বাল্মিকী রত্মাকরের আশ্রয়েই চিত্রকূটে আছে রাম। বাল্মিকীরা আবার কবিও; এরা কাল্পনিক কাব্য আর জীবনী রচনা করেন…
চিত্রকূটে বাল্মিকীর আশ্রয় ছাইড়া বনান্তরে রাম গিয়া হাজির হয় অত্রি মুনির আশ্রমে; অতি আদরে স্বাগত হয় রাম লক্ষ্মণ সীতা। রামেরে বিশেষ কিছু কন না অত্রি; জিগানও না কিছু। তিনি বরং তাগো কাছে নিজের বৌ অনসূয়ার বিস্তারিত শোনান। কোনো ঋষির মুখে নিজের বৌর প্রশংসা এই প্রথম শুনতেছে রাম…
যেইখানে সেইখানে গরুছাগলের মতো যখন তখন যৌনতার লাইগা কাপড় ধইরা টান দেওয়ায় বৌ প্রদ্বেষার হাতে মাইর খাইয়া নারীগো পুরুষের ইচ্ছার অধীন বানায়া বিধান দিছিলেন আদি ভরদ্বাজের মায়ের পেটের বড়ো ভাই আন্ধা ঋষি দীর্ঘতমা। তারপর থাইকা আর্যরা নারীগো নিজেদের সেবাদাসী হিসাবেই গণ্য করে…
ঋষিগো মাঝে এখন পর্যন্ত আদি বাল্মিকী চ্যবন নিজের মায়ের লাইগা খুনখারাবি করছেন; বাপের ঘরে মায়েরে প্রতিষ্ঠা করতে শালিস দরবার করছেন; সেই ঘটনা নিয়া একখান কাব্যও রচনা করছেন। তার ছোটভাই শুক্রাচার্য নিজের মাইয়ার খুশির লাইগা আস্তা বেদ অস্বীকার কইরা বিধান দিয়া বসছিলেন। এই দুই ভার্গবের বাইরে কোনো ঋষির মুখে নারীদের প্রসঙ্গ আইজ রাম শুনতেছে অত্রির মুখে…
অত্রি রামরে কন- দশ বছর বয়সেই কঠোর শ্রম দিয়া জাহ্নবী নদী থাইকা খাল কাইটা নিয়া অনাবৃষ্টির অঞ্চলে ফসল ফলাইছেন এই নারী; ফসল ফলাইতে দিছেন অন্য শত কৃষি পরিবারে। তার নেওয়া সেই জলের ধারায় সজীব হইছে বহু মুনি ঋষির গ্রাম; সহজ হইছিল তাগো তপস্যা। অনুসূয়ারে নিজের মায়ের মতো দেইখো রাম…
এর আগে কেউ কোনো নারীরে এইভাবে পরিচয় করায়া দিছে বইলা মনে পড়ে না রামের। ঋষি গৌতম তো নিজের বৌরে পিটায়া বাইন্ধাই রাখছিলেন; রাম গিয়া সেই শালিস কইরা দিছে…
অনুসূয়ারে প্রণাম করে রাম। অনুসূয়ার প্রচুর বয়স; শরীরে বলিরেখা; মাথায় সাদা চুল; হাঁটাচলায় শরীর কাঁপে। সীতারে নিয়া নিজের ঘরে যান অনুসূয়া…
সীতারে নিজের মাইয়ার মতো বস্ত্রে অলংকারে সাজান অনুসূয়া। রাম খেয়াল কইরা দেখে; ভরদ্বাজ যেইখানে রাজপুত্র রামরে খাতির দেখাইছেন; সেইখানে বাল্মিকী কিংবা অত্রির মতো ঋষিরা কিন্তু সীতার খাতিরদারি করতেছেন বেশি। ভরদ্বাজ তারে দেখছেন ঘরের পোলা হিসাবে। কিন্তু দস্যু বাল্মিকী বা দাস অত্রি সীতারে গণ্য করতেছেন ঘরের মেয়ে বইলা…
শইলে আদিবাসী রক্ত বহন করেন অত্রি আর বাল্মিকী। দস্যু কথাটা দেশ্য বা দেশীয় কথার ভিন্ন উচ্চারণ; উচ্চারণ পাল্টায়া কেউ কেউ দেশ্যগো দাস বইলাও ডাকে। নারীগো খাতির করা হয়তো তাগো দাস-দস্যু সংস্কৃতির প্রভাব। যার লাইগা নিজে ঋষি হইয়াও শুষ্ক জমিতে অনুসূয়ার ফসল ফলানোরে বড়ো কৃতিত্ব বইলা গণ্য করেন অত্রি দাস…
সকালে প্রণাম দিয়া বিদায় চাইলে অত্রি শুধু রামরে আশীর্বাদ করেন; লাঠালাঠি বিষয়ে কিছুই কন না তিনি। আশ্রমের অন্য ঋষিরা রামেরে অনুনয় করে সাহায্যের আশায়- চারিপাশে পিলপিল খালি রাক্ষস আর রাক্ষস; আমাগো হাঁটাচলা দায়; জীবনটা ছ্যারাবেরা; রক্ষা করো…
ঋষিগো বিবরণ আর অনুনয় শুইনা দণ্ডকারণ্যে পা বাড়ায় রাম। পথে পথে অসংখ্য অখ্যাত ঋষিদের ছোট ছোট গ্রাম। রাম লক্ষ্মণ সীতা তাগোরে বিধিমতে পেন্নাম জানায়; তারাও তাগোরে খানাদানা দিয়া খাতির করেন। কেউ কেউ রামেরে নিজেগো রাজা ঘোষণা কইরা কন- আইজ থাইকা আমরা তোমার আশ্রিত মানুষ; আমাগো রক্ষা করো পুত…
বনাঞ্চলের ফাঁকে ফাঁকে বসানো ব্রাহ্মণগো গ্রামগুলারে সংযুক্ত করতে পারলে সহজেই গইড়া উঠতে পারে একটা ক্ষত্রিয় রাজ্য। কিন্তু ব্রাহ্মণদের সামলানোর ক্ষমতা না থাকলে সেই পথে পা বাড়ানো আত্মহত্যার সামিল…
ব্রাহ্মণরা চোঙা লাগায়া রাজাগো রক্ত চোষেন। দেশে যুদ্ধ না থাকলে তারা আইসা রাজারে কন- শান্তিতে আছো; আরো বেশিদিন শান্তিতে থাকার লাইগা যজ্ঞ করো; আমরা প্রার্থনা কইরা তোমার শান্তি নিশ্চিত কইরা দিব…
যজ্ঞ মানেই হইল ব্রাহ্মণগো কাড়িকাড়ি পয়সাকড়ি-গরুবাছুর-দাসদাসী দান। কোথাও যুদ্ধ শুরু হইলে তারা আইসা বলবেন- যুদ্ধ জয়ের লাইগা যজ্ঞ করো। যুদ্ধে হারলে কইবেন- আর যাতে হারতে না হয় তার লাইগা যজ্ঞ করো। যুদ্ধ জিতলে বলবেন- বিজয় ধইরা রাখার লাইগা যজ্ঞ করো। বিয়া করলে বলবেন- পোলাপান পাওয়ার লাইগা যজ্ঞ করো। বাচ্চা হইলে বলবেন- পোলার দীর্ঘায়ুর লাইগা যজ্ঞ করো। বাপ মরলে বলবেন- মরা বাপের লাইগা যজ্ঞ করো। বাপ না মরলে বলবেন বাপের দীর্ঘায়ুর খুশিতে যজ্ঞ করো…
যজ্ঞ করতে করতে বহু রাজা ফকির হইবার ঘটনাও আছে। আবার ব্রাহ্মণগো বিগড়াইলে তারা সহজেই রাজারে অযোগ্য ঘোষণা কইরা অন্য কাউরে সিংহাসনে বসায়া দিতে পারেন। নিজের বাপ দশরথের ঘটনাও প্রায় এক; সারা জীবন পুরোহিত বশিষ্ঠর কথা মাইনাই শাসন করতেছিলেন তিনি। মাত্র একবার বশিষ্ঠরে পাশ কাটায়া রামেরে যুবরাজ বানাইবার সিদ্ধান্ত নিছিলেন; সেই ঘটনায় বশিষ্ঠের পাল্টা দানে দশরথ পয়লা হইলেন গৃহবন্দি; পরে মরলেন আর রামেরেও রাজ্য ছাইড়া আসতে হইল বনে…
সীতার বাবা জনক কিংবা রাবণের মতো দুয়েকজন শিক্ষিত আর শক্তিশালী রাজার পক্ষেই শুধু সম্ভব এইসব ব্রাহ্মণদের খপ্পর থাইকা রাজ্য বাঁচায়া রাখা…
অত দূর অবশ্য এখনো ভাবে না রাম। কিন্তু বন শাসনের মালার পুতিগুলা যখন আপনা আপনি আসতেছে; সময়ে সুযোগে সেইগুলারে এক সুতায় গাঁথার লাইগা আপাতত তুইলা রাখতে তো কোনো অসুবিধা নাই…
ব্রাহ্মণগো আপ্যায়ন ও আব্দার নিয়া বনে ঢোকে রাম। ঢুকতেই থাবা দিয়া সীতারে নিয়া যায় বিরাধ। রাম যায় ঘাবড়ায়া…
বিপদে পড়লে ঘাবড়ায়া বিলাপ করা রামের স্বভাব। লক্ষ্মণের গুঁতা খায়া তার হুশ ফিরে। সে পরপর সাতখান তির মারে বিরাধরে। কিন্তু একে তো তার গতরে পশু চামড়ার পোশাক; তার উপরে তার কোলে সীতা। কোনো তিরই সুবিধামতো লাগাইতে পারে না রাম; দুয়েকটা তিরে খালি বিরাধের কিছু চামড়া ছিলে…
তিরের গুঁতা খাইয়া ক্ষেইপা যায় বিরাধ। সীতারে ফিককা ফালায়া শূল নিয়া তাড়ায়া আসে রাম লক্ষ্মণের দিকে। হাতে আরেকটা তির লাগায় তার হাত থাইকা শূল পইড়া যায়। হাতের তির খুইলা সে মুঠা বাগায়া আসে। রাম-লক্ষ্মণ ধনুক থুইয়া তলোয়ার খুলবার আগেই বিশালদেহী বিরাধ দুইজনরে দুই বগলে চাইপা বনের ভিতরে হাঁটা দেয়- চল তগো খরের কাছে নিয়া যাই…
রাম লক্ষ্মণরে কয়- নড়িস না। যেইদিকে নিতে চায় নিতে দে। সুযোগ পাওয়া যাবে…
সীতা গিয়া খাড়ায় বিরাধের সামনে- এইটা কেমন কথা? কইলা আমারে বিয়া করবা আর এখন নিয়া যাইতেছ দুইজন বেটা মানুষ। আমারে এইখানে রাইখা গেলে তো বাঘে-ভাল্লুকে খাবে। ছাড়ো এগোরে; আমারে নেও…
সীতার কথা মনে ধরে বিরাধের; বেহুদা দুই বেটারে নিয়া কোনো লাভ নাই। সে রাম-লক্ষ্মণরে ছাইড়া সীতার দিকে আগাইতেই পিছন দিক থাইকা তলোয়ারের কোপ দিয়া বিরাধের দুই হাত লটকায়া ফালায় রাম-লক্ষ্মণ…
দুইজনে বিরাধরে মাটিতে ফালায়া পা দিয়া রাম চাইপা ধরে বিরাধের গলা- এর আওয়াজ শুনলে আবার অন্য লোক হাজির হইতে পারে…
পায়ের চাপ একটু ছাইড়া রাম জিগায়- এই বনে আর বড়ো কোনো ঋষি আশ্রম আছে?
বিরাধ কয়- দেড় যোজন দূরে ঋষি শরভঙ্গের আশ্রম। আমি তারে জ্বালাই না…
রাম কয়- রাস্তা বল…
কাৎরাইতে কাৎরাইতে বিরাধ শরভঙ্গের আশ্রমের রাস্তার বিবরণ দিয়া কয়- আমারে যদি মাইরাই ফালাও; তয় অনুরোধ; আমার জাতির নিয়মমতো আমারে কবর দিও…
তলোয়ার বাগায়া লক্ষ্মণ কয়- ঠিকাছে তাইলে। এখন শেষ কইরা দেই…
রাম কয়- গর্ত খোঁড়। দশরথের পুত্রবধূরে ছুঁইছে হালা; এরে জেন্তা পুঁতব আমি…
দেশ্য দাস দস্যু যক্ষ রাক্ষস বিষয়ক সূত্র:
G. Ramadasa: The Aboriginal Tribes in the Ramayana
লঙ্কার ভূগোল বিষয়ক সূত্র:
Rajesh Kochhar: Vedic People History & Geography
মন্তব্য
বিরধ রাক্ষস যে ব্রহ্মের আশীর্বাদ পাওয়া, কুবেরের অভিশাপ খাওয়া শিল্পীমানুষ, সেটা নিয়ে কিছু লিখলেন না?
যখনি অভাজনের রামায়ণ পড়ি তখনি দেবমিতা সেনগুপ্তের এই অপূ্র্ব সুন্দর নাচটা মনে পড়ে
https://youtu.be/SDIJnutmLUA
পড়তেছি গো দাদা
facebook
নতুন মন্তব্য করুন