অভাজনের রামায়ণ: রাবণ ০১

মাহবুব লীলেন এর ছবি
লিখেছেন মাহবুব লীলেন (তারিখ: মঙ্গল, ২৫/১০/২০২২ - ১:১৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কোনো মাইয়া কাউরে বিবাহের প্রস্তাব দিলে তার নাক কান কাইটা দিবার উদাহরণ কি শাস্ত্র বেদ বা সংহিতায় আছে?

এক লগে দশখান শাস্ত্রে পণ্ডিত বইলা দশমাথা নামে মর্যাদাবান রাবণের অংক মিলে না সংখ্যাশাস্ত্রের বিদ্যায়; যোগশাস্ত্রের ধ্যানে আসে না শান্তি; ন্যায়শাস্ত্রে নাই এমন আকামের উপযুক্ত শাস্তি; মীমাংসা শাস্ত্রে মিলে না এর যুক্তি…
মন শান্ত করো হে দেবদেবতাগণ…

বীণা হাতে সামগান গাইতে শুরু করে সামবেদের স্বরলিপিকার রাবণ। কিন্তু তবু অশান্ত থাইকা যায় মন…
বীণা ফালায়া খিত্তা ভাইঙা দৌড়াইতে দৌড়াইতে দৌড়াইতে গিয়া থামে চরের কিনারায়; যেইখানে লঙ্কাদ্বীপের মাটি ধীরে ধীরে ঢাল হইয়া নাইমা গেছে শবরী বিলের জলে…
বিলপারের কাদাপানি দাবায়া নাচ শুরু করে শিব তাণ্ডব স্তোত্রের রচনাকার লঙ্কেশ্বর রাবণ…

জটাটবীগলজ্জলপ্রবাহপাবিতস্থলে
গলেবলংব্য লংবিতাং ভুজংগতুংগমালিকাম্
ডমড্ডমড্ডমড্ডমন্নিনাদবড্ডমর্বযং
চকার চংডতাংডবং তনোতু নঃ শিবঃ শিবম্….

সিস্তানের শবরী বিলের চরে গইড়া উঠা এই চাষি গ্রামটারে মাইনসে স্বর্ণলঙ্কা বইলা ডাকে। মৌসুমে সরস্বতী নদীর জলে বিল ভইরা চারিপাশ থৈ থৈ হইবার কালে পলিও আইসা জমে বেসুমার। মৌসুম শেষে পানি নাইমা গেলেও চরের বুকে বইসা থাকে পুরুষ্ট পলির স্তর। সেই পলিতে ফলানো শস্য পাইকা সোনালি হইলে পুরা চরটারেই মনে হয় সোনায় মোড়ানো দ্বীপ। এই কারণেই শবরী বিলের এই দ্বীপটার নাম স্বর্ণলঙ্কা; রাবণের মাতৃভূমি; তার মা নিকষার জন্মস্থান…

নাচতে নাচতে ক্লান্ত হয় রাবণ। গাইতে গাইতে স্থির হয় মন। কাদাপানিতে হাঁটু গাইড়া বসে শূর্পণখার ভাই- ওম নমঃ শিবায়…

শিব তার মায়ের দিকের দেবতা। পিতামহ পুলস্ত্য আছিলেন আর্যগো মাঝে সপ্তর্ষি বইলা সম্মানিত সাত ঋষির একজন। পিতা বিশ্রবা মুনির চাইর বৌর একজন লঙ্কাদ্বীপের আদিবাসী নিকষা। মায়ের মাধ্যমেই শিবের লগে রাবণের পরিচয়…

পিতৃবংশের শাস্ত্রপাঠ দিয়াই শিক্ষা শুরু হইছিল তার; পণ্ডিতও হইছে। আর্যগো প্রার্থনা সংকলন সামবেদের স্বরলিপিও তৈরি ছাড়াও নিজেই রচনা করছে চিকিৎসা আর জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ে দুইখান সংহিতা। কিন্তু শেষমেশ বসবাসের লাইগা সে যেমন বাইছা নিছে মাতৃভূমি লঙ্কা; তেমনি আরাধ্য হিসাবেও বাইছা নিছে লঙ্কার পূজ্য মহাদেব শিব…

আর্যগো সূর্য দেবতার বন্দনা কইরা গায়ত্রী মন্ত্র লিখছিলেন বিশ্বামিত্র ঋষি। সেইটারে টেক্কা দিয়া শিবের বন্দনায় তাণ্ডব স্তোত্র রচনা করে রাবণ…
কাদার ভিতরে হঠাৎ লাফ দিয়া উঠে রাবণ- আরিশ্শালা। এই পোলা তো বিশ্বামিত্রের চ্যালা…

রামের জাতকুল- কাহিনী ও কাইজার বহুত সংবাদই পাইছে রাবণ। কোনোকিছু বিশেষ মনে হয় নাই আগে। কিন্তু এইবার সে সম্পূর্ণ নতুন এক হিসাব মিলায়- দশরথের এই পোলা আদৌ বনবাসে আসে নাই। বনে ব্রাহ্মণ শাসন কায়েমের ধান্দাতেই ঘুরতে আছে সে…

রামেরে বন চিনাইছেন বিশ্বামিত্র ঋষি। তারে দিয়া তাড়কা মাইরা বন দখলের লোভও জাগায়া দিছেন খ্যাতিহীন রাজা দশরথের সিংহাসনে দাবিহীন পোলার ভিতর। বনে সে বনবাসের ধারেকাছেও নাই; দশ বছর ধইরা সে একটার পর একটা ব্রাহ্মণের আশ্রম ঘুরতেছে। ঋষিরাও তারে দিতেছেন গাদাগাদা অস্ত্রপাতি; অনেকেই আবার তারে রাজা বইলা স্বীকৃতিও দিয়া দিছেন। হিসাব মিলতে আছে…

রাবণ তাগো লাইগা বহু দিকেই সমস্যা। তাগো নতুন দেবতা বিষ্ণুর প্রতিষ্ঠায় পয়লা বাধা রাবণ। শিবরে ধ্বংসের প্রতীক বইলা অপবাদ দিয়া বিষ্ণুরে বেদের সূর্যদেবতা কইয়া প্রচারে নামছেন আর্য ঋষিরা। কিন্তু শিবের সেরাভক্ত রাবণরে থুইয়া তো বিষ্ণুর প্রতিষ্ঠা করা যাবে না; তাই তাগো সকলেরই চাওয়া রাবণের বিনাশ…

দ্বিতীয় কারণ বনের জমি। শবরী বিলের চাইরপাশের বনগুলা সকলের লাইগা উন্মুক্ত স্থান। সেইসব বনে শিকার-পশুচারণ-সংগ্রহ-বসতি কিংবা চলাফেরায় যেমন কারো অনুমতি লাগে না তেমনি কাউরে কেউ বাধা দিবারও নিয়ম নাই। সেই সূত্রেই বনের ফাঁকে ফাঁকে যেমন গইড়া উঠছে আদিবাসীগো বহুত বিচ্ছিন্ন গ্রাম; তেমনি অগুনতি ব্রাহ্মণরাও আইসা বসাইছেন আশ্রম। বাবনেরা এখন চাইতেছে বনগুলাতে শাসন কায়েম কইরা আদিবাসীগো তাদের হুকুমের দাস কিংবা প্রজায় পরিণত করতে। রাবণ বাঁইচা থাকতে সেইটাও সম্ভব না…

ঋষিগো লাঠির শক্তি যোগাইত যে ইন্দ্র রাজা; কয়দিন আগে রাবণের পোলা মেঘনাদের মাইর খাইয়া সে ভাগল দিবার পর ঋষিরা এখন বিকল্প রাজা খুঁজতে আছেন রামের ভিতর…

শবরীটা মূলত মৌসুমি বিল। শুকনা মৌসুমে এর বহু জায়গা দিয়া হাঁইটাও পৌঁছানো যায় চারিপাশের পাহাড়ে। রাবণ অবশ্য ডাঙায় যায় তার খচ্চরে টানা রথে। নেশাই তারে ডাঙায় নিয়া যায়। তার নেশা সোমরস। খালি সোমগাছের লাইগাই চরের বাইরে বহ্লিকের কিছু শুকনা অঞ্চল নিজের দখলে রাখছে রাবণ। মাঝে মাঝে নিজেরই গিয়া তুইলা আনে রসালো কাণ্ডগুলা…

চর কিংবা ভাটিতে সোম জন্মায় না। পশুরজন-বহ্লিক আর কপিলাবস্তুর রুক্ষ-শুষ্ক এলাকাগুলাতেই পাওয়া যায় এই পাতাবিহীন গুল্ম। বহ্লিকের আশ্রমগুলাতে পড়তে গিয়াই সোম রসের লগে তার পরিচয়। রাইত জাইগা পড়া মুখস্থ করার লাইগা বিত্তবান শিক্ষার্থীরা এই রস খায়। ধনীরা খায় দেহমন চাগায়া রাখতে। তয় বেশি বেশি সোমরস খাইলে আবার রাবণের ভাই কুম্ভকর্ণের মতো কাণ্ডজ্ঞান হারায়া ফেলে মানুষ….

ভাটির বাবনরা অবশ্য একটা লতারে সোমলতা নাম দিয়া ভেজাল সোমরস দিয়া যজ্ঞ চালায়। বহ্লিকের ঋষি চ্যাবন আবার ফলমূল পচা পানিরে সুরা নাম দিয়া গরিবের সস্তা নেশা চালু করছিলেন। ওইসব দুর্গন্ধ পানি মুখেও তোলে না রাবণ…

রাবণের বংশের লগে আবার শত্রুতা আছে এই চ্যাবন বংশের। বেশি কন্যাপণের লোভে চ্যাবনের মায়ের বাপ মাইয়ারে বিয়া দিয়া দিছিলেন ভৃগু মুনির লগে। কিন্তু চ্যাবনজননীর ভালোবাসা আছিল পুলস্ত্য বংশের এক গরিব পোলার লগে। সেই পোলা গিয়া পরে ভৃগুর বাড়ি থাইকা প্রেমিকারে উঠায়া নিয়া আসে। এতে ঋষিবংশের অপমান হয় বইলা চ্যাবন বড়ো হইয়া মায়ের প্রেমিকরে মাইরা তারে আবার তার স্বামীর ঘরে নিয়া আসে। তারপর নিজের বীরত্ব জাহির কইরা রচনা করে পুলস্ত্যবধ কাব্য নামে একখান কাহিনী…
ক্যান? ঋষি পুলস্ত্যের বংশের নামে এই কাব্য লিখতে হবে ক্যান?
দশ বছর ধইরা রামেরে বন সমন্বয়ের পুরা পরিকল্পনা কইরা দিছেন চ্যাবন বংশীয় ঋষি বাল্মিকী রত্নাকর। রাবণ হাসে। তার সকল শত্রুই গিয়া লাইন ধরছে রামের পিছনে…

রাবণের সোম ক্ষেত্রের পাশেই এখন আস্তানা গাইড়া আছে দশরথের পোলা। খালি রাবণের বইন হইবার দোষেই যে শূর্পণখার নাককান কাইটা দিছে…
হিসাব পরিষ্কার। শূর্পণখারে বিকৃত কইরা মূলত রাবণের লগে সংঘাতের বার্তা পাঠাইছে ব্রাহ্মণগো রাজা রাম…

বিলের পানিতে ঝাঁপায়া বহুক্ষণ সাঁতার কাটে রাবণ। তারপর স্থির মাথায় ফিরতে থাকে বাড়ির দিকে- ক্ষত্রিয় কায়দায় এর কোনো সমাধান নাই…

এর মাঝে বইনের অপমানের শোধ নিতে লাঠি-গদা নিয়া বেকুবের মতো তিরন্দাজগো লগে যুদ্ধ করতে গিয়া সতিলা দুই ভাই খর আর দূষণ মারা গেছে রাম-লক্ষ্মণের হাতে। তির চালাইতে আর সামলাইতেও জানে রাবণ। কিন্তু এইটা যুদ্ধের বিষয় না। যুদ্ধে মাইনসের মাইরা ফালানো যায় কিন্তু শাস্তি দেওয়া যায় না। শাস্তি জিনিসটা খালি জেন্দা মানুষের লাইগাই প্রযোজ্য। রামেরে শাস্তি পাইতে হবে। তার মর্যাদাহীনতাই হইব শূর্পণখা নির্যাতনের উপযুক্ত শাস্তি…

ঘরে আইসা রাবণ ব্রাহ্মণের বেশ নেয়। পা থাইকা মাথা পর্যন্ত পরতে পরতে তার ক্ষত্রিয় জীবনের কাটছেড়া দাগগুলা ঢাকতে পোশাকের উপর অভিজাত ঝালর-অলংকার চড়ায়া দাড়িতে হাত বুলায় রাবণ- রামের বৌটা নাকি আবার ঋষি বাল্মিকীর জাতের মানুষ। যাই বৌটারে একবার দেইখা আসি…

অভাজনের রামায়ণ। বনবাস ০৫

নোট:
০১. রামায়ণ সমাজের কেউ সমুদ্র চিনত না। হ্রদ বা বিলরেই তারা কইত সাগর- সায়র কিংবা হাওর; আর সিস্তানি ভাষায় হামুন। রামায়ণের লঙ্কা দ্বীপের অবস্থানটা আছিল সিস্তানের শবরী হামুনের কোনো একটা চরে…
০২. বৈদিক সরস্বতী নদীটা হইল আফগানিস্তানের হেলমন্দ নদী। রামায়ণের সরযু নদীটা হইল আফগানের হরিরুদ কিংবা হেরাত নদী। কপিলাবস্তু= কাবুল; বহ্লিক= বলখ; পশুরজন=পারস্য; সিস্তান= শক বা সিথিয়ান জনবসতি…
০৩. নেশাদ্রব্য সোমগাছের ইংরেজি নাম Ephedra…
০৪. গল্পে ফাইনালি কোন ভূগোলের বিবরণ দিব তা এখনো ঠিক কইরা উঠতে পারি নাই। হইতে পারে নৃতাত্ত্বিক সিস্তানি ভূগোল; হইতে পারে প্রচলিত দাক্ষিণাত্যের ‘স্থানান্তরিত’ ভূগোল। আবার এমনো হইতে পারে যে পুরাটাই রাইখা দিব ভূগোলবিহীন। তাই অন্য অধ্যায়গুলার লগে আপাতত ভূগোল ভেজাল বাদ দিয়া যাইবার অনুরোধ রইল…

ভূগোল ও ইতিহাসের সূত্র:
Rajesh Kochhar: Vedic People History & Geography
Ranajit Pal: Non-Jonesian Indology and Alexander
Karvey Kraft: The Buddha from Babylon: The Lost History and Cosmic Vision of Siddhartha Gautama
ভারতবর্ষের ইতিহাস: রমিলা থাপার
Communalism and Writing of Indian History: Romila Thapar, Harbans Mukhia and Bipan Chandra


মন্তব্য

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

লোকশ্রুতির বাইরের ভূগোল আর কার্যকারণ দিয়ে এবার গোটা জম্বুদ্বীপে আগুন লাগিয়ে দিলেন। আশা করি পরিস্থিতি ভালো ভাবে সামলাতে পারবেন। শুভ কামনা।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

এমনিতেই ভ্যাজালে আছি। তার উপরে নিয়া আসছেন জম্বুদ্বীপ। ‘জম্বুদ্বীপ’ জায়গাটা নাকি আদৌ পানির চর বা দ্বীপ আছিল না। জিনিসটা আছিল ঢিবি বা ‘স্থলজ চর’। বর্তমান বাংলায় আমরা ‘সড়কদ্বীপ’ বলতে যা বুঝাই সেইরকম কিছু

কবিগো উপরে ইতিহাস ফলাইতে যাওয়া কী কঠিন টের পাইতেছি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।