অভাজনের রামায়ণ। বনবাস ০২

মাহবুব লীলেন এর ছবি
লিখেছেন মাহবুব লীলেন (তারিখ: শুক্র, ২১/০১/২০২২ - ১০:০৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কানতে কানতে মইরাই গেলেন রাজা দশরথ। রাম যাবার পর মাত্র চাইর দিন টিকলেন তিনি। সুমন্ত্র রামরে ফালাইয়া আসছে দুই দিনের পথ দূরে; ফিরতেও লাগছে দুইদিন। রাম ঘরছাড়ার কালে পথে পড়া রাজারে কুড়ায়া সেই যে বিছানায় শোয়ানো হইছিল; সেই বিছানা তিনি আর ছাড়তে পারেন নাই। থাইকা থাইকা কানছেন আর এরে তারে জিগাইছেন- সুমন্ত্র ফিরছেনি আমারে কও…

তার আশা আছিল যাইতে যাইতে রামের হয়ত মনে হবে- যামু ক্যান? আর ঘু্ইরা আইসা বদলায়া দিবে কৈকেয়ীর বিধান। কিন্তু সুমন্ত্র আইসা কয়- রামেরে গাঙপারে ফালায়া আসছি আমি...
দশরথ বারবার জানতে চান- রামে আর কী কইছে কও…
সুমন্ত্র কয়- আর কিছু কন নাই; শ্রেণিমতো সবাইরে শুভেচ্ছা-পেন্নাম দিছেন…
কৌশল্যা কন- সুমন্ত্র আমারেও নিয়া যাও পুতের কাছে…
সুমন্ত্র কয়- নদীঘাটে নামায়া দিবার পর বৌ-ভাই নিয়া রাম কোন দিকে যে কোথায় গেছে সেইটা তো আমার জানা নাই মহারানি...
কৌশল্যা করেন বিলাপ; দশরথ কান্দেন। কানতে কানতে মাঝ রাত্তিরে রাজার কান্দন থামে। দশরথ মরেন…

রাজার কান্দন থামার পর পয়লা কান্দেন কৌশল্যা। তারপর কান্দে রাজবাড়ি। কান্দন হাল্কা হইয়া আসলে গালাগালি বাড়ে কৈকেয়ীর নামে। নইড়া বসেন মন্ত্রী ও আমাত্যগণ- কী করা এখন?

বিভিন্নজনে বিভিন্ন কথা কয়; সবচে বেশি কথা হয় রামেরে ফিরাইয়া আনার…

রাজার লাশখান ঠিকঠাকমতো তেলে ডুবাইয়া মুখ খোলেন প্রধান পুরোহিত বশিষ্ঠ- বহু আগেই অযোধ্যার পরবর্তী রাজা ঠিক হইয়া আছে; রামের হইছে সদ্য নির্বাসন। দুই সিদ্ধান্তই নিয়া গেছেন রাজা দশরথ। আমাগো দায়িত্ব রাজার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন; সিদ্ধান্ত উল্টানের এখতিয়ার আমাদের নাই। দশরথের সিদ্ধান্তমতে ভরতই এখন অযোধ্যার রাজা...
দুয়েকজন মিনমিনায়- প্রয়াত রাজায় কিন্তু এইটাও বলছেন যে ভরত যেন তার শেষকৃত্য না করে...
এইবার ধামকি লাগান বশিষ্ঠ- উত্তরাধিকার নির্বাচন যেমন রাজার এখতিয়ার তেমনি লাশ সৎকারের বিধান পুরোহিতের এখতিয়ার। পুত্রের উপর মনোক্ষুণ্ন পিতার রাগেরে দাম দিয়া চাইর পোলার বাপের অপুত্রক শেষকৃত্য যথাকর্ম বইলা গণ্য করি না আমি…
বশিষ্ঠর বিধি কিংবা বিধানের বিপক্ষে আর কোনো বাক্য উঠে না। ভরতরে আনতে তার নানাবাড়ি কেকয় দেশে রওয়ানা দেয় চাইরজন দূত…

ভরত অযোধ্যা আইসা পৌঁছায় সাত দিন পর। তত দিনে রাজ্যে টানা হইয়া গেছে সাধারণ এক সমীকরণ- রাজা মরছেন রামের দুঃখে আর রাম বনে গেছে ভরতের কারণ…
আগাগোড়াই অশ্বপতির কেকয় রাজ্যে থাইকা রাজনীতি শিখছে ভরত। সে ভালো কইরাই জানে ক্ষ্যাপা মাইনসেরে সামলানো গেলেও দুঃখিত মানুষ সামলানো কঠিন। নিরীহ রাজা দশরথ প্রজাগো কাছে পছন্দেরই ছিলেন। রাম আগাগোড়াই অযোধ্যার চোখের উপরে বড়ো হওয়ায় তার লাইগা এইখানে লোকজনের মায়াও আছে; যেইটা ভরতের লাইগা একেবারেই নাই…
প্রজাদের রাগ কান্ধে নিয়া সিংহাসনে না বইসা বাপ ও ভাইর দুঃখে দুঃখিত হইয়া ভরতও মিশা যায় দুঃখিত মানুষের দলে- আমি তো এইসব জানি না কিছুই। বাপও গেলো ভাইও গেলো আমার; কী করি এখন। আমারে এমন খিচুড়ির ভিত্রে ফালায়া ঘুটা দেয়া ঠিক হয় নাই মায়ের। শাস্ত্রে কয় নারী জাতি মূর্খতা আর পাপের খনি। কৈকেয়ী আমার জননী হইলেও নারীজাতির মূর্খতায় বড়োই পাপকর্ম করছেন তিনি…
জনে জনে গিয়া ভরত বুঝায়- এই রাজ্য নিমু না আমি। বিশ্বাস করেন ভাইজানের বনবাস কিংবা বাপজানের মরণ কোনোটাতেই আমার কোনো হাত নাই। মূর্খতার দোষে আমারে রাজা বানাইতে গিয়া নিজের পুতেরই বাপ-ভাই কাইড়া নিয়া আমার মাথায় ঠাটা ফালাইছেন মায়…

অযোধ্যায় বাকিদের দুঃখ কইমা আসে আর বাড়তে থাকে ভরতের বিলাপ। আস্তে আস্তে কিছু মানুষের মনে হইতে থাকে ভরতের আসলেই কোনো দোষ নাই। তার জন্মের আগেই দশরথে তারে রাজা করার সিদ্ধান্ত নিছেন। শেষকালে সেই সিদ্ধান্ত বদলাইতে গিয়া ধরা খাইছেন কৈকেয়ীর হাতে; এইসবের কিছুই জানে না ভরত…
শেষ পর্যন্ত ভরতের বিলাপ থামাইতে রাম জননী কৌশল্যা আইসা কন- তোর কোনো দোষ নাই বাজান; দোষ আমার পুতের কপালে। তুই আর কান্দিস না…
ভরতরে বিলাপ থামার লগে লগে বশিষ্ঠ তারে দায়িত্ব বুঝান- পুত্রের অপেক্ষায় যে পইড়া আছে পিতার শেষকৃত্যের কাজ…

দশরথের সৎকার শেষ হইলে ভরত-শত্রুঘ্ন আবারো শুরু করে বিলাপ। বিলাপ করতে করতে শত্রুঘ্ন গিয়া কৈকেয়ীর দাসী মন্থরারে শুরু করে কিল- এই বেটিই সব কণ্ডলের ঘটি। এই বেটির কুবুদ্ধিতেই রাজ্যনাশ হইছে আমাদের…
ভরত শত্রুঘ্নরে থামায়- কথা ঠিক তবে তার পরে আরো কথা আছে। খালি রামভাই আমারে মাতৃঘাতী বইলা গালি দিবেন নাইলে কিন্তু আমি এই আকামের লাইগা নিজের মায়েরেও মাইরা ফেলতাম। এরে ছাইড়া দে; নাইলে ভাইজানে আবার তোরে নারী নির্যাতক বইলা ঝাড়ি দিবেন…
অযোধ্যার আরো দুই সপ্তা যায় বিনা রাজায়। ভরত কয়- রাজা হবে বংশের বড়ো পোলা। এইটাই বংশের বিধান। ভাইজানরে আনতে বনে যাব আমি; আয়োজন করো সকলে…
বনযাত্রার আয়োজন ছাড়া অযোধ্যায় এখন আর জরুরি কোনো কাম নাই। আয়োজনের শুরুতে নিজের পছন্দমতো সেনাদল সাজায় ভরত। জাহ্নবী নদীর তীর পর্যন্ত তৈরি হয় বাড়িঘর সেতু কূপ; জঙ্গল কাইট্টা করা হয় পথ; ন্যাড়া জায়গায় লাগানো হয় গাছ। আর এইসব দেইখা আমজনতা জিগায়- এত কাণ্ড করতেছে কেডা?
সেনাসৈনিক উত্তর দেয়- রাজা হইতে না চাওয়া অযোধ্যার নতুন রাজা ভরত…
লোকজন জিগায়- রাজা ক্যান রাজা হইতে চায় না?
মন্ত্রীরা কয়- বনবাসী বড়ো ভাইরা লাইগা তার নম্রতা বেশি তাই বনে যাবার সিদ্ধান্ত নিছেন তিনি…
গ্রামবাসী কয়- যে বনে গেছে সে না হয় বনেই থাউক। মনে তো হইতেছে রাজা পোলাটাই বড়ো ভালো…
আমাত্যরা কয়- রাজা ভালো বইলাই তো বন সাফ কইরা বনে যাবার রাস্তা করে সেনাসৈনিক দিয়া…
বনযাত্রার আয়োজনকালে রাজ্যের সকলে আইসা পড়ে ভরতের অধীন। বন্দনাকারীরাও একদিন রাজা বইলা তার স্তুতি কইরা বসে; রাজার মতোই তারে সংবর্ধনা দেয় মন্ত্রিপরিষদ। পুরোহিত বশিষ্ঠ কন- সজ্ঞানেই প্রয়াত রাজা তোমারে রাজা কইরা গেছেন। নিজের প্রতিজ্ঞাতেই বনে গেছে রাম। তোমার উপরে কারো কোনো অভিযোগ নাই। তাই আমাগো প্রস্তাব; রাজা হইয়া তুমিই রাজ্য শাসন করো। সকলেই অনুগত হইবে তোমার…

অযোধ্যায় পা দিয়াই ভরত টের পাইছে পরিবারের বড়োপোলা রামের জনপ্রিয়তা; তার বীরত্বের কথাও লোকজন বলে। জনক রাজার জামাই সে; বিশ্বামিত্র-গৌতমরা তার পিছনে আছেন। তাই রামের পুরা ক্ষমতা না বুইঝা কাঁটার উপরে পা দিতে রাজি না সে। সে কয়- রামের সিংহাসন আমি কেমনে ছিনতাই করি? আমি তিনারে ফিরায়া আনব। তিনি যদি প্রতিজ্ঞা ভাইঙা ফিরা না আসেন; তয় আমিও কিন্তু তিনার লগে বনবাসী হমু বইলা দিলাম। সিংহাসনের এই পাপটা আমার মাথায় চাপাইছেন জননী; দয়া কইরা আমারে সেই পাপের ভাগীদার হইতে বইলেন না কেউ…

দশরথের ঘনিষ্ঠ লোকদের মাঝে ভরতের উপর সবচে বেশি ক্ষেইপা আছিল সুমন্ত্র। এইবার সেও গইলা যায়। ভরত সুমন্ত্ররে কয়- তুমিই বনযাত্রার আয়োজন আর সৈন্য সমাবেশ করো...

মাইয়া বিবাহ দিবার কালে আউলাঝাড়া জামাই দশরথের রাজ্যে আরো দুইজন মানুষ পাঠাইছিলেন অশ্বপতি। এর একজন কৈকেয়ীর দাসী মন্থরা; আরেকজন রাজ্যের প্রধান পুরোহিত বশিষ্ঠ। কেকয় দেশে থাইকা ভারতের শেখা রাজনীতি বিদ্যায় বড়োই খুশি হন বশিষ্ঠ- এইবার তবে দেখা যাক রামের লগে আর কারা কারা আছে…

ভরত রাজা বনে যায়; লগে যান দশরথের তিন রানি; যায় সব পুরোহিত আর বিশাল সেনাদল। মালমশলা নিয়া লগে আছে অস্ত্রের কারিগর; আছে কুড়ালি- কামার- বানিয়া- মাটি কামলা ও ভূমিবিশারদ। সহায়ক দলে আছে স্বর্ণকার- তাঁতি- নর্তকী আর নদী পারাপার কামের লাইগা দাস গোত্রজাত সুঠাম মাইমল দল। কেউ যায় ঘোড়ায় টানা রথে; কেউ যায় গরুর গাড়িতে; কেউ কেউ হাঁটে আর দৌড়ায়…

ভূমিজ মানুষের ভিতর যারা সমতল আর জলাভূমিতে থাকে আর্যরা তাগোরে কয় দাস আর বনবাসী পাহাড়িদের কয় দস্যু। রামের দেখা পাইতে গেলে পয়লাই বাধা গঙ্গা পারাপার। জলদাসগো এলাকায় সেই গঙ্গা রামদোস্ত গুহকের রাজ্যসীমায়। ভরতের সেনা আসতে দেইখা গুহক নিজের লোকরে কয়- লক্ষ্মণের কথাই ঠিক। রামের বিনাশ করতেই এই লোক ধাওয়া দিছে বনে। অস্ত্র নিয়া রেডি হও আর নদী থাইকা উঠায়া নেও সমস্ত নৌযান…

নদী তীর ঘেরাও দিয়া দাঁড়ায়া আছে গুহকের সেনা। নিজের বাহিনীরে থামায়া কৌশল্যারে নিয়া গুহকের সামনে খাড়ায় বিনীত ভরত- শৃঙ্গবেরপুরের রাজা পিতৃবন্ধু গুহকরে প্রণাম। অযোধ্যার প্রয়াত রাজা দশরথের প্রধান মহিষী ইনি; রাম জননী কৌশল্যা। বনবাসী পুত্ররে ফিরায়া আনতে মহারানি যাইতেছেন বনে; আমি তার সেবাদাস। এখন দশরথ-বন্ধু যদি আমাদের নদীটা পার কইরা দেন তবে অযোধ্যার জ্যেষ্ঠ রাজপুত্ররে আইনা রাজ্যের শূন্য সিংহাসন পূর্ণ করতে পারেন এই শোকাতুর জননী…

ভরতের বিনয়ে বেকুব গুহক নিজেই যোগাড়যন্ত্র কইরা পরদিন পুরা বাহিনী গঙ্গা পার কইরা দেয়। কিন্তু মুনি ভরদ্বাজ যুদ্ধবিদ্যারও একজন গুরু। তিনি না করেন চিল্লাচিল্লি; না হন বেকুব…
এক ক্রোশ দূরে সেনাবাহিনী রাইখা পুরোহিতগো লগে নিরীহ চেহারায় পায়ে হাঁইটা ভরত গিয়া খাড়ায় ভরদ্বাজের সামনে- বড়োভাইরে দেখতে মন চায় গুরুদেব; একটু যদি ঠিকানাটা বলেন…
ভরদ্বাজ কন- সেনাবাহিনী লুকায়া রাইখা আসছ ক্যান? তোমার মতলব তো সুবিধার মনে হইতেছে না আমার…
ধরা খাওয়া ভরত কয়- আপনেও যদি এমন কথা কন তবে তো মইরা যাওয়াই ভালো আমার। আমি আসছি ভাইয়েরে রাজা বানাইতে ফিরায়া নিতে। আর বাহিনীরে দূরে রাখছি কারণ অতগুলা হুমাদেও নিয়া আসলে আপনের আশ্রম ছ্যারাবেরা কইরা দিবে যে…
ভরদ্বাজ কন- আমার গ্রামে আইসা তারা আমার ঘরে একবেলা খাবে না এইটা কি হয়? সবাইরে নিয়া আসো এইখানে…

পুরোহিত আর রাজবংশীয়দের খাতির করা শেষে ভরদ্বাজ শিষ্যদের কন- ভরতের পুরা বাহিনীরে খাওনের লগে মাদক দিয়া টাল বানায়া রাখো যাতে একটারও নড়ার ক্ষমতা না থাকে…

অভাজনের রামায়ণ। বনবাস ০১


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

আবার শুরু করেছ তাহলে! আশা করি এইবার ট্রেন চলতে থাকেব, মালগাড়ির গতিতে হলেও।
ভালো লাগলো পড়তে। মহাভারতের অভাজনকে ছোঁয়া কিন্তু সহজ হবেনা লীলেন।
- মোখলেস হোসেন।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

মালগাড়ি গতিতে চলিবে। ঘটনা হইল মহাভারতের চরিত্র বৈচিত্র রামায়ণে নাই। কাহিনী ভিন্ন

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।