অভাজনের রামায়ণ: রাবণ ০৩

মাহবুব লীলেন এর ছবি
লিখেছেন মাহবুব লীলেন (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৩/০২/২০২৩ - ১১:২৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এমন সুপুষ্ট নারী যে পায়; নিশ্চিত হিংসায় তারে দানো-দেবতায়। আহা কী সৌন্দর্য…

বেদের মন্ত্র গাইতে গাইতে আশ্রমের উঠানে পা দিয়া সীতাবন্দনায় কাব্যিক হইয়া উঠে অভিজাত ব্রাহ্মণ- দণ্ডের মতো একসিধা উঁচা বৃক্ষের অরণ্য বইলা এর নাম দণ্ডকারণ্য। এমন নিষ্ফলা বনে ক্ষুণ্ণ মনে একলা ক্যান বসতি করো হে সুন্দরী? নিশ্চিত ধন্য তোমার পতি; কিন্তু তারে তো দেখি না কোথাও। তুমি কেডা গো? কই থাইকা কী বাসনায় এমন রাক্ষস দেশে আইসা নিছ ঠাঁই?

ব্রাহ্মণভক্ত রামের বৌ তো আর দুঃখের বাহানায় বাবন ঠেলতে পারে না। তাই পেন্নাম ঠুইকা আগত ব্রাহ্মণরে বসায়া খাইতে দেয় সীতা। স্বামী-দেবরের লাইগা দুশ্চিন্তার ফাঁকে ফাঁকে নিজের পরিচয় জানায়- এই বনে বেশিদিন হয় নাই ঠাকুর; তয় বনে বনেই আছি গত দশটা বছর। অযোধ্যায় বারো বছর সংসার কইরা বনে ঢোকার কালে আমি আছিলাম আঠারো আর স্বামী রাম পঁচিশ…
- আহা হা। নগরে আর বনে অতটা বছর স্বামীসঙ্গ তবু কোনো পোলাপান নাই কোলে। আফসুস…

এই খোঁটা দেশেও শুনছে সীতা। একই দিনে বিবাহ করছে রামেরা চাইর ভাই; বাকি তিন ভাইর ঘর পোলাপানে ভরপুর হইলেও রামের ঘর থাইকা গেছে ফাঁকা। ব্রাহ্মণের খোঁচার উত্তর না দিয়া সীতা দুশ্চিন্ত মনে বাইরে উঁকিঝুঁকি মারে। লক্ষ্মণের লগে আইজ তার দুর্ব্যবহারের মাত্রাটা অতিরিক্ত হয়া গেছে। খারাপ লাগে তার…

মারিচের লগে দণ্ডকারণ্যে আইসা আড়ালে খাড়ায় রাবণ। হরিণের চামড়া পইরা আশ্রমের দিকে আগায় মারিচ। আশ্রমের পিছনে তখন ফুলপাতা তুলতে আছিল সীতা; রাম-লক্ষ্মণ ঘরে…
সীতার দৃষ্টি সীমায় ঝোপ নাড়ায়া ডাক দেয় মারিচ- হয়াউ… হয়াউ…

ঝোপের আড়ালে হরিণটা একটু চোখে পড়ে সীতার। মুনিঋষিগো আশ্রম ছাড়া জ্যান্তা হরিণ সে দেখে নাই। এখন তারই বাড়িতে হরিণ আসছে দেইখা সে আগায়া যায়। কিঞ্চিত দূরে আরেকটা ঝোপের আড়ালে গিয়া সীতার দিকে তাকায়া হরিণটা আবারো ডাকে- হয়াউ… হয়াউ…

এইটা একটা মায়াহরিণ। সীতা চিনতে পারে। শেষ রাত্তিরে মায়া হরিণের ডাক শুনলে মনে হয় ছোরায় গলাকাটা কোনো মানুষ গোঙাইতেছে। সীতা খাড়ায়া থাকে। হরিণটা তার দিকে তাকায়া দুয়েকটা ঘাস খায়। আবার তাকায়…
সীতা তারে অভয় দিতে চায়। সে পিছায়া আসলে হরিণটা তার দিকে একটু আগায়। কিন্তু সীতা আগায়া গেলে হরিণটা ভয়ে পিছায়া তার দিকে তাকায়া ডাকে- হয়াউ…

হরিণটারে রাইখা দিবার ইচ্ছা হয় সীতার। মুনিঋষিগো আশ্রমে দেখছে; বুনো হরিণরে কিছুদিন বাইন্ধা খানাপিনা দিলে পোষ মানে। তারপর ছাইড়া দিলেও আর যায় না…
সীতা গিয়া রামের কাছে আব্দার ধরে- হরিণটা আমারে জ্যান্ত ধইরা দেও…

রাম-লক্ষ্মণ বাইরে আসলে হরিণটা গিয়া আরেকটু দূরে লুকায়। কতক্ষণের চেষ্টায় দুই ভাই হরিণটা দেখে। লক্ষ্মণের সন্দেহ হয়- এমন হরিণ তো আমি জীবনেও দেখি নাই। কে জানে এইটা কি আসলেই হরিণ নাকি হরিণের বেশ ধইরা আবার রাক্ষসগো কেউ শোধ নিতে আসছে…

সীতা বিরক্ত হয় লক্ষ্মণের উপর। সে রামেরে গিয়া কয়- তুমি আমারে হরিণটা জ্যান্ত ধইরা দিবা। বনবাস শেষে এরে আমি অযোধ্যায় নিয়া পুষব…
হরিণটা দেইখা রামও অবাক হইছে। সে লক্ষ্মণরে কয়- হরিণ হিসাবে এইটা কিন্তু একটু বেশিই সুন্দর। তুই সীতার লগে আশ্রমেই থাক। আমি দেখতেছি…
রাম অস্ত্রপাতি নিয়া বাইর হয়। সীতা পিছন থাইকা স্মরণ করায়া দেয় হরিণটা কিন্তু আমারে জেন্দা আইনা দিতে হবে…

ঝোপের আড়াল রাইখা হরিণটার দিকে সতর্ক পা চালায় রাম। কিন্তু কাছে যাবার আগে প্রতিবারই সে হরিণটার চোখে পইড়া যায় আর হরিণটা বনে হারায়া যায়। কতক্ষণ পরে আরো দূরে গিয়া ডাক দেয়। রামও আবার আড়ালে আড়ালে হরিণের পিছনে যায়…
হরিণের পিছে ছুটতে ছুটতে পাহাড়ের উপর পর্যন্ত গিয়া রাম বোঝে ধাওয়া দিয়া এরে ধরা সম্ভব না। ক্লান্ত বিরক্ত হইয়া সে সোজা তির চালায়া দেয়…

বুকে তির খাইবার পরে আর হরিণ থাকে না মারিচ। লাফ দিয়া দুই পায়ে খাড়ায়া দেয় চিক্কুর- সীতা…। লক্ষ্মণ… ভাই আমার… তুই কই…

এইটা রাবণের চাল। এক ভাইরে বনের ভিতরে নিয়া যাবার পর পাহাড়ের উপর থাইকা অন্য ভাইর নাম ধইরা দিতে হবে ভয়ার্ত ডাক। তাতে অন্যটাও গিয়া ঢুকবে বনে…

মারিচের চিক্কুর আইসা পৌঁছায় সীতা ও লক্ষ্মণের কানে। আতঙ্কিত সীতা লক্ষ্মণরে তাড়া দেয়- তোমার ভাই বিপদে পড়ছেন। তাড়াতাড়ি যাও…

লক্ষ্মণ কয়- চিক্কুরটা আমিও শুনছি। কিন্তু ওইটা ভাইর গলা না। আমগো ফান্দে ফালানোর চেষ্টা করতেছে কেউ। ভাই ঠিকাছেন। চিন্তার কিছু নাই…
সীতা কয়- আমি শুনছি। ওইটা তোমার ভাইরই গলা। তুমি যাও...
লক্ষ্মণ কয়- ভাই আমারে পরিষ্কার বইলা গেছে আশ্রমে থাকতে…

সীতা কয়- বইলা গেলে হইছেটা কী? বনের ভিতর ভাইর মরণ চিক্কুর শুইনাও যাবা না? নাকি তলে তলে রামের মরণই চাও তুমি? রাম মরলে তুমি আমারে বিয়া করতে পারবা; তাই না? এর লাইগাই যারে পাহারা দিতে বনে আসছ তারে বিপদে রাইখা তুমি আমারে পাহারা দিতে চাও। অতদিনে তোমার আসল চেহারা বাইরে আসছে তবে…

সীতার মুখ তলোয়ার থাইকাও ধারালো লক্ষ্মণ জানে। কিন্তু এই অপবাদ সে নিতে পারে না। সীতার পায়ের কাছে মাথা নামায়া লক্ষ্মণ কয়- এমন অপবাদ আমারে দিয়েন না। আমি বলতেছি ওইটা ভাইর গলা না। তিনার কিছু হয় নাই। একটু পরেই তিনি ফিরা আসবেন। নিশ্চিত থাকেন। আপনেরে একলা রাইখা আমার যাওয়া ঠিক না…

সীতা কয়- তা তো যাবা না। কারণ রামের বিপদেই তোমার মঙ্গল। আইজ বুঝলাম তুমি একটা ভণ্ড। তুমি বনে আসছ হয় আমারে পাইবার লোভে; না হয় ভরতের চর হিসাবে। তবে এইটাও জাইনা রাখো; তোমার মতো ছোটলোকরে কোনোদিনও স্বামী মানব না আমি। রামের কিছু হইলে আমিও জান দিব কইলাম…

লক্ষ্মণ ভাইঙা পড়ে- আপনেরে আমি দেবতার মতো দেখি আর আপনে আমারে করেন সন্দেহ। এমন কঠিন দিন জীবনেও আগে আসে নাই আমার। রামের নির্দেশ অমান্য করা থাইকা আপনের কথাগুলা সহ্য করা কঠিন। ঠিক আছে; যাইতেছি আমি। প্রার্থনা করি ফিরার পর যেন আশ্রমে আপনেরে দেখতে পাই…

আশ্রম ছাইড়া লক্ষ্মণ বনে ঢুকতেই সীতার উঠানে আইসা খাড়ায় রাবণ- আহা কী সুন্দর সুপুষ্ট নারী…

রাম-লক্ষ্মণের কোনো নিশানা দেখা যায় না। সীতা কয়- আপনে আরাম করেন। আমার স্বামী শিগগিরই হরিণ-গুইসাপ বা শুকর কিছু একটা শিকার নিয়া চইলা আসবে…
রাবণ কয়- সে ধীরেসুস্থেই আহুক। তার আসা নিয়া আমার তাড়া নাই। আমি তোমার লগেই কথা কই…
সীতা কয়- আমার পরিচয় তো কইলাম। তা আপনের নামগোত্র কুল যদি বলেন তো উপকার হয়। আর এই বনে আপনেই বা একলা ক্যান ঘুরতে আছেন?
রাবণ কয়- ব্রাহ্মণ হিসাবে যদি গোত্রপরিচয় দিতে হয় তাইলে তো বলতে হয় পিতা বিশ্রবা মুনি; পিতামহ পুলস্ত্য ঋষি। আর বন বেড়ানোর বিষয়ে কইতে গেলে তো বলতে হয়; বনটা যে আমারই। আমিই এই বনের রাজা। রাবণ আমার নাম…

সীতা চমকায়া উঠে। রাবণ হাসে- ঘাবড়ানোর কিছু নাই। বহু দেশ থাইকা জোগাড় করা বহু বৌ আছে আমার। আমার সংসারে সকলেই সন্তানবতী হইছে তারা। তোমারে দেখার পর মনে হইতেছে এখন আর কোনো রানির দিকে তাকাইতেও পারব না আমি। চলো মোর লগে। লঙ্কায় রানি হইবা তুমি…
সীতা চিল্লাইতে থাকে- সাহস তো কম না তোর। পাতি শিয়াল হইয়া তুই সিংহীরে ধরতে চাস? সাপের মুখ থাইকা তুই দাঁত খুইলা নিতে চাস? তুই আমারে চিনস না; আমি ইন্দ্রের মতো ক্ষমতাবান রামের বৌ। ঘি খাইতে আইসা মাছি যেমন ল্যাপ্টায়া মরে; আমারে ছুঁইতে আসলে সেই দশা হবে তোর…
রাবণ হাসে- আইচ্ছা ঠিকাছে। ভড়ংভাড়ং যা করার কইরা নেও; ঠিকাছে। আর ইন্দ্রফিন্দ্র যেইসব দেবতার নাম কইলা তুমি; আমার নাম শুনলেই কিন্তু সেইগুলা ভাগে। কিন্তু কথা হইল রাজ্যহীন বেহুদা রামরে দিয়া তোমার কোনো কাম নাই। তুমি আমার লগে লঙ্কায় যাইতেছ এইটাই ফাইনাল…
সীতা এইবার অভিশাপ দেয়- আমারে হরণ করলে কিন্তু তুমি ধ্বংস হয়া যাবা; তোমার পুরা রাক্ষস জাতি ধ্বংস হবে…
রাবণ কয়- আরে দুর। ওইসব অভিশাপের প্যানপ্যানানি সারা জীবনই শুইনা আসতেছি আমি। অভিশাপ হইল নিশক্তির কুযুক্তি; আর শক্তিমানের যুক্তি হইল বাহুবল…
খপ কইরা বাম হাতে সীতার চুলের মুঠা ধইরা পেছনে হেলায়া ডান হাত তার উরাতের নিচে বিছায়া সীতারে কোলে উঠায় রাবণ- দেখলা? আমার আর কোনো যুক্তির দরকার নাই। এইবার রাম ছাইড়া আমারে স্বামী মাইনা নেও; ব্যাস…
সীতার ছটফটানি তোয়াক্কা করে না রাবণ। তারে কোলে নিয়া সোজা সে রথের দিকে আগায়। রাবণরে অভিশাপ দিতে দিতে রাম-লক্ষ্মণের নাম ধইরা বিলাপ করতে থাকে সীতা…

একটা গাছের গোড়ায় বইসা ঝিমাইতেছিল জটায়ু। সীতার কঠিন চিক্কুরে সে জাইগা আইসা রাবণরে নীতিকথা শোনায়- ও ভাই রাবণ। এমন বাজে কাম তো তোমার করা ঠিক হইল না। রাম একজন ভালো মানুষ আর সীতা তার বৌ। তুমি একজন রাজা; নিজের বৌরে যেমন সুরক্ষা দেয়া তোমার কাম তেমনি অন্যের বৌদের সুরক্ষাও তো তোমার দায়; এরে ছাইড়া দেও রাজা…
রাবণ ধামকি লাগায়- হালা কমজিলকা; সইরা খাড়া…
জটায়ু সরে না; রামরে সে কথা দিছিল সীতারে পাহারা দিবে। সে গিয়া রাবণরে কিল ঘুষি খামছি দিতে থাকে…
রাবণ কয়- এ তো দেখি এক আঠালির পাল্লায় পড়লাম রে বাপ…

এক হাতে সীতার চুলের মুঠা ধইরা অন্য হাতে রথ থাইকা তলোয়ার নিয়া চাইর কোপে জটায়ুর চাইর হাত-পা কাইটা রাবণ সীতারে কয়- লও যাই…

সীতা কান্দে; জটায়ু গোঙায় আর রাবণের রথের চাকা গড়াইতে থাকে খচ্চরের টানে; লঙ্কার পথে…

অভাজনের রামায়ণ: রাবণ ০২


মন্তব্য

সোহেল ইমাম এর ছবি

চলুক

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।