পিতৃপুরাণ ০১

মাহবুব লীলেন এর ছবি
লিখেছেন মাহবুব লীলেন (তারিখ: সোম, ২১/০৬/২০২১ - ৭:২৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ঠিক কতটা ধীরে একজন পিতা প্রয়োজন হারায়? অথবা ঠিক কোন সময় থাইকা সে পোলাপানের কাছে অপ্রাসঙ্গিক এক মানুষ হিসাবে গণ্য হইতে থাকে?

দিনক্ষণ ঠিক করা মুশকিল; ঘটনার উদাহরণ দিয়াও মনে হয় না কারো পিতৃদায় পালনের শেষ দিন কিংবা কোনো সন্তানের পিতৃভরসার সর্বশেষ মাইলফলক চিহ্নিত করা যাবে। পিতৃত্বটা বড়ো বেশি ব্যক্তিগত হয়; দেখতে একই রকম হইলেও ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে তা প্রচণ্ড আলাদা হয়। আলাদা আলাদা পিতৃ-চেহারা দেখে আলাদা আলাদা সন্তান…

আমি এক পিতারে চিনতাম। কবি দিলওয়ার; যিনি তার অর্ধশতাব্দি ছোঁয়া সন্তানের শেষকৃত্যরে তার শেষ পিতৃদায় বইলা মানতেন; অথচ সন্তানের মৃত্যু নাকি পিতার কাছে দুনিয়ার সবচে বড়ো অবহ বেদনার নাম…

দিলওয়ারের সেই সন্তানও কবি; কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার। বাপ-বেটা দুজনেই আছিলেন মরমিবাদের ঘোর অনুসারী। তারা বিশ্বাস করতেন মন বইলা অনশ্বর কিছু একটা আছে। সত্যমনে যদি সেই মনের কাছে কোনো মনস্কামনা জানানো হয় তবে মন তারে বাস্তবতা দেয়…

দিলওয়ার প্রকাশ্যেই তার পাঠক ও ভক্তগো কাছে প্রার্থনা রাখতেন- যদি তোমার প্রার্থনার কার্যকারিতায় বিশ্বাস থাকে; তয় আমার লাইগা এই প্রার্থনা করো যেন আমি আমার এই প্রৌঢ় পুত্রটারে নিজের হাতে কবরে শোয়ায়া মরতে পারি। আর যদি তুমি প্রার্থনারে দুর্বলমন মানুষের মুখ লুকানোর আশ্রয় ভাবো; তবে এইটুকু শুভ কামনা রাইখো যেন কোনোভাবেই এই পুত্রের আগে আমার মরণ না হয়…

কিশওয়ার আছিল সিজোফ্রেনিক; এই কঠিন দুনিয়ায় একা একা বাঁইচা থাকার অনুপযোগী ও অপ্রস্তুত; যার গর্ভধারিণীও গত হইছেন বহুত বছর আগে। অসহায়ভাবে তারে জীবিত রাইখা নিজে মইরা যাওয়ারে অপরাধ বইলা গণ্য করতেন দিলওয়ার। পিতার এই আকুতি পুত্র জানতেন এবং সেইটারে মানতেনও সর্বোত্তম পন্থা বিবেচনায়…

একদিন সত্যি সত্যিই তাই ঘইটা গেলো। ‘আব্বা ঘুমাতে যাই’ বইলা এক দুপুরে কিশওয়ার ভাতঘুমে যাবার পর বৈকালিক চায়ের লাইগা তারে আর ডাইকা উঠানো গেলো না। কবিমৃত্যুর ঘটনা শুইনা যখন সান্ত্বনা দিবার লাইগা দিলওয়াররে আমি ফোন দিলাম; তখন শোকের বদলে শুনলাম কবিপিতার অতি উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠ- পুত্র আমার কথা রাখছে লীলেন। আমার আগেই সে মারা গেছে। এখন নিজের একটা শান্তিপূর্ণ মৃত্যুর অপেক্ষা ছাড়া আমার অন্য কোনো কাজ নাই…

বড়োই উচ্চমার্গীয় আছিল সেই পিতা-পুত্রের বোঝাপড়া। ঈশ্বর অবিশ্বাসী কিশওয়ার পিতা দিলওয়াররে মানতেন মরমি মুর্শিদ বা পথপ্রদর্শক। বলতেন- যেই পিতা আমারে পৃথিবীতে আনছেন সময়মতো তিনিই আবার প্রত্যাহার কইরা নিবেন…
কথা ভাববাদী কিন্তু আবেগটা মর্মান্তিক। অবশেষে কোনোকালেই কোনো পুত্রদায় পালন না করা পুতেরে নিজে মরার আগে ‘প্রত্যাহার’ কইরা অক্ষরে অক্ষরে পিতৃদায় শোধ করছিলেন কবি দিলওয়ার…

অথচ মৃত্যুকালে কিশওয়ারের বয়স আছিল ছিচল্লিশ আর দিলওয়ারের আট দশকের বেশি। আশি বয়সী কারো পিতৃদায় কিংবা আবেগ থাকার কথা না যদি না তিনি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন হন…

হ মহাভারতকার কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন; যারে মুনিঋষি কিংবা বহুত পুরাণের রচনাকার বইলা মাইনসে পেন্নাম ঠোকে; কিংবা পৌরাণিকেরা যারে আরো মহান বানাইতে গিয়া ঋষির গাম্ভীর্য নিয়া খাড়ায়া খাড়ায়া বংশের বিনাশ দেখতেও বাধ্য করছে ভাবলেশহীনভাবে…

কৌরব-পাণ্ডব সকলেই তার বংশধারা। কুরুযুদ্ধে এরা সব নির্বংশ হইলেও পৌরাণিক কেরানিগো কল্যাণে আমরা দ্বৈপায়নের চোখে কোনো অশ্রু দেখি না। কিন্তু কেরানিগো কলমে কুরুযুদ্ধ দানা পাকাইবার আগে একবার ঝিলিক দিয়া উঠে পুতের লাইগা তুচ্ছ পিতা দ্বৈপায়নের বুক চাপড়ায়া কান্নার মুখ…

ভারতীয় পুরাণের সবচে প্রভাবশালী নাম দ্বৈপায়নের পক্ষে যে কান্না করা সম্ভব সেইটা বোধহয় বিশ্বাস করাও অনেকের লাইগা কঠিন। ভাড়াটে বৌ ঘৃতাচীর গর্ভে জন্মানো পুত্র শুকদেবরে নিজেই তিনি বড়ো কইরা তোলেন; শিক্ষা দিয়া করেন চতুর্বেদী ঋষি; বহুত বড়ো মানুষ…

কিন্তু শিক্ষিত হইবার পরই পুতের মনে হয় অত বড়ো ঋষির কি আর বাপের আশ্রমে সহকারী হইয়া থাকা সাজে? তাই শুকদেব নিজের রাস্তা ধরে- আব্বা বিদায়…

পুত্রের হাত ধইরা মিনতি করে দ্বৈপায়ন। পুত্র ঘর ছাড়ে। কানতে কানতে পিছনে দৌড়ায় দ্বৈপায়ন। নিজের গৌরব প্রতিষ্ঠার আশায় গ্রাম ছাড়ে শুক। পিছনে একলা কান্দে দ্বৈপায়ন…

ঋষির বিশালতা ছাপায়া কোনো এক কবির চোখে পড়ে দ্বৈপায়নের সেই ভাঙাচোরা মুখ; রচিত হয় দ্বৈপায়নরে নিয়া একমাত্র ভক্তিবর্জিত বাক্য- পিতা দ্বৈপায়নের দুঃখে কান্দে বৃক্ষসকল- আমারে ফালায়া যাইও না শুক। বাপের কাছে থাকো…

সেই ঘটনা স্মরণ কইরা পুরাণকার নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী কন- ওই কান্দনের মূল্য বুঝে নাই বইলাই হাজারো চতুর্বেদীর মাঝে শুকদেব থাইকা গেছে হুদাই এক ঋষি; আর পুতের লাইগা এমন আকুলি কান্না কানতে পারত বইলাই কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন এক মহাকবি; যার মৃত্যুসংবাদ লেখার দুঃসাহস পর্যন্ত দেখায় নাই কোনো পুরাণকার…

বাপেরা মরে না। কানতে কানতে পিছনে পইড়া থাকে কোথাও…
২০১৯.০৬.০৮


মন্তব্য

Md. Belal Hossain এর ছবি

বাপেরা মরে অবশ্য সামগ্রিক ভাবে সব বাপ মরে না।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

আমি তো ঘাড়ের পিছে আমার বাপের ভূত দেখি মাঝে মাঝে

হিমেল এর ছবি

ঘাড়ের পিছনে আছেন, মাথার ভিতরে কথা বলেন - আর খালি মনে হয় যে কাজটা করলাম উনি থাকলে কি বলতেন - এটাও কি পিতৃদায়? জানিনা।

পাহাড়   এর ছবি

কেন জানিনে চোখে জল এলো।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

কান্দাকাটি ভালা না

করবী মালাকার এর ছবি

কঠিন বাস্তবতা।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

হ। সামনাটান পিছুটান

তারেক অণু এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা- কিছু কওনের নাই

মাহবুব লীলেন এর ছবি

কইয়েন না

সাবিহ ওমর এর ছবি

আহ এমন লেখার ক্ষমতা একটা গিফট।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

টেকা পাওনা রইল

এক লহমা এর ছবি

হ, তারা শুধু কানতে কানতে পিছনে পইড়া থাকে কোথাও…
এত ভাল লেখা মাইনসে কেমনে লেখে কে জানে।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

মাহবুব লীলেন এর ছবি

হ। পিছনে পড়া মানুষ

কল্যাণ এর ছবি

বাপ হওয়ার পরে বাপ আবার প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে, কিন্তু বাপের কাছে আর ফেরা হয় না, কারো কারোও অবিশ্যি ফেরার উপায়ও থাকে না আর।

_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩

সোহেল ইমাম এর ছবি

অদ্ভুত ভালো লাগলো লেখাটা পড়ে।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।