যাপিত জীবন

মানিক চন্দ্র দাস এর ছবি
লিখেছেন মানিক চন্দ্র দাস [অতিথি] (তারিখ: বুধ, ১৫/০৯/২০১০ - ২:৫৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


কতক্ষন ধরে দাঁড়িয়ে আছি ঠিক মনে করতে পারছিনা। আমি ঘড়ি পড়িনা, মোবাইলের ঘড়ির অপশনটাও বন্ধ করে রেখেছি। ঘড়িটাকে কেমন ঘন্টি ঘন্টি লাগে। যেন বার বার বলে, ব্যাটা তোর সময় ফুরোচ্ছে। যা করার তাড়াতাড়ি কর। আমার তাড়াহুড়া পছন্দ না। আমি একটু আয়েশ করেই থাকতেই পছন্দ করি।

ক্যাব থেকে মাত্রই নামলো দেবী। আমার চোখের সামনে আমার দেবী। ক্যাব থেকে নেমেই ভাড়া চুকিয়ে আমার কাছে এলো। ঘেমো মুখ। অদ্ভুত টোল পড়া হাসি দিয়ে বললো,”তুমি কি অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে আছো?”
“জানিনা দেবী। তোমার অপেক্ষায় থাকতে আমার তীব্র আনন্দ হয়। তাই আর ওসব সময়-টময় নিয়ে মাথা ঘামাই না। কেমন আছো দেবী।”
“খুব ব্যাস্ত। রোগীর চাপে মাঝে মাঝে মাথা খারাপ হয়ে যায়। আচ্ছা গাইনী ওয়ার্ডে এতো রোগীর চাপ কেন হয় বলতে পারো?”
“পারি। মানুষই একমাত্র প্রানী, যাদের বছরের আলাদা কোন সময় নির্ধারন করা হয়নি মেটিং সিজন হিসেবে। আমরা সারা বছর ঐ বিশেষ কাজটি করি। তার ফলাফল তো তুমি নিজেই দেখতে পাচ্ছ।”
“যত্তোসব আলতুফালতু কথা। এবার বলো আমাকে এই বসুন্ধরায় ডেকে আনার কারন কি?”
“বলছি। একটু ঠান্ডা হও। বলছি। একটু হাটঁবে আমার সাথে?”
“আবার কোথায় যাবো। তাহলে ক্যবটা ছাড়লাম কেন?”
“ক্যাব লাগবেনা। এইতো সামনের দুটো ব্লক পড়েই আমাদের গন্তব্য।“
“ঠিক আছে চলো। আমার হাঁটতে একটু কষ্ট হচ্ছে। হাঁটুতে ব্যাথা।”
“কোলে নেবো?”
“এই দিনের বেলায় রাস্তার মাঝে তুমি আমাকে কোলে নেবে? লজ্জা-শরম কিছু কি আছে তোমার?”
“নিজের প্রেমিকা কে আমি কোলে নেবো তাতে লজ্জার কি আছে?”
“আমার লজ্জা করবে। আমি তো তোমার মতো বেহায়া না।”
“আচ্ছা ঠিক আছে হেঁটেই চলো। দেখো কষ্ট হলে কিন্তু আমার দোষ দিতে পারবেনা।”
“একশো বার দেবো। হাজার বার দেবো। কোটি বার দেবো। তাতে তোমার সমস্যা কি?”
“আমাকে গালিগালাজ করবে আর আমার গায়ে লাগবেনা?”
“না লাগবেনা, মাই সুইট গাধু। আমি কি তোমাকে গালিগালাজ করি। তুমিই বলো করি? ”
“না করনা।” গম্ভীর মুখে উত্তর দিলাম।
“কি লিকু রাগ করলে নাকি?”
“না করিনি।”
“দেখে তো তা মনে হচ্ছেনা। আমার হাত ধরো। তোমার রাগ কেটে যাবে।”
“না।”
“আরে গাধু, ধরেই দেখনা।”
“আমি হাত ধরলাম। কি অদ্ভুত, আমার এখন কোন রাগ নেই। একেই কি ভালোবাসার ছোঁয়া বলে? কে জানে?”
“কোথায় যেন নেবে বলেছিলে ?”
“যেখানে নিতে চেয়েছি তুমি এখন তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছো।”

দেবী সামনে তাকালো। বিরাট একটা বাড়ি সামনে।
“এইটাতো একটা বিল্ডিং। এটা দেখনো জন্য সেই ঢাকা মেডিক্যাল থেকে জরুরি ফোন করে নিয়ে এলে?”
“হুমম। চলো ভেতরে ঢুকি।”
“দাড়াও লিকু। এটা কি লিটনের ফ্ল্যাট টাইপের কিছু? যদি তাই হয় আমি যাবোনা। ”
“না লিটনের ফ্ল্যাট না। এই বিল্ডিং আটতলা। চার ইউনিটের বাড়ী। তার মাঝে সাত তলায় চারটা ইউনিটই আমি কিনে নিয়েছি। আমি তোমাকে দেখাতে এনেছি এজায়গাটা তোমার পছন্দ হয়েছে কিনা। আর কিছুনা। তুমি আমার কাছে দেবী। বিয়ের আগে কিছু করা দেবী শব্দটার সাথে যায়না। আমার কাছে তুমি দেবীর মতোই। ওতে পাপ দাগ ফেলতে পারেনা। খুশী??”

“৩৬০০ স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাট আমার জন্য?”
“হ্যাঁ। তোমার। আমার বাবা-মায়েরা থাকবে। তোমার ভাই যেহেতু ভ্যাগাবন্ড তোমার বাবা-মায়েরাও আমাদের সাথে থাকবে। আমরা থাকবো একটা যৌথ পরিবারের মতো। আমরা আমাদের বাবা-মায়েদের চালাবো। শিশু বয়স থেকে তাঁরা আমাদের কোলে পিঠে করে মানুষ করেছেন । আমরা তাদের ছাড়া একলা থাকতে পারবনা।”
“তাতো অবশ্যই থাকবেন তারা।”
“এটা নিয়ে কিন্তু ঝগড়া করবেনা। ঠিক আছে?”
“আচ্ছা। আচ্ছা। বেডরুমে কি রঙ দিয়েছো?”
“তুমি ঠিক করবে।”
“বেডরুমের সিলিং এ আকাশের প্যাটার্ন দিতে হবে, যাতে শুলেই মনে হয় খোলা আকাশের নীচে শুয়ে আছি। আর জানালার পর্দা হবে আকাশী নীল। তাতে মেঘের ছোপ ছোপ থাকবে। শরৎ এর আকাশ। একপাশে বিরাট একটা আয়না। যাতে গোসল শেষে আয়নায় শরীরের সবটুকু একবারে দেখা যায় । ”
“আয়নাটাকি তোমার জন্য?”
“হ্যাঁ, আমার। আমি আমার শরীর দেখবো।”
“ওটা তো বাথরুমেও রাখা যায়। তোমার দিগম্বর শরীর তুমি দেখো।”
“এমন ভাব, যেন সে আমাকে দেখতে চায়না। লিকু, সত্য করে বলোতো তুমি আমার শরীর দেখতে চাওনা?”
“চাই। তবে এখন না। বিয়ের পর। এর আগে না।”
“তুমি কি সাধু সন্যাসী নাকি?”
“তা হবো কেন? আমি তো ভোগী মানুষ।”
“তাহলে এখন কেন দেখতে চাইলেনা? এখানে তো কেউ নেই।”
“এতে তোমার নারীত্বের অপমান হবে। দেবী তোমার অপমান, আমারই অপমান।”
“হুমম। জানি। তুমি একটা সুইট গাধা।”
“বেডরুমে কোন পেইন্টিং ঝুলবেনা?”
“ঝুলবে।”
“কিসের?”
“বর্ষার ছবি। আমি ছোটবেলায় বৃষ্টি হলেই পুকুরে নেমে যেতাম। সাঁতার কাটতাম।একা না। আমরা একসাথে অনেকজন। আসলে আমি ঠিকঠাক সাঁতার জানতাম না। এ জন্যে অনেককে নিয়েই নামতাম। এরকম একটা ছবি আমাকে এনে দিতে পারো।”
“চাইলে বাঘের দুধ আনতে পারি এতো একটা হাতে আঁকা ছবি। ওয়াটার কালার নাকি ওয়েল কালার?”
“ওয়াটার কালার। জানো, ওয়াটার কালারে কেমন যেন একটা স্বপ্ন ছড়িয়ে থাকে। দেখা যায়, ছোঁয়া যায়না। তাইনা?”
“হুমম। দেখা যায়, ছোয়া যায়না। তোমার মতো।”
“শয়তান ছেলে। ছোঁয়া যায়না না? দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা।”

দেবী প্রথমে তার ওড়না ফেলে দিলো। আমি আঁৎকে উঠলাম।

“মাফ করো দেবী। আমি তোমার পায়ে পড়ছি। ওটা এমনি কথার কথা বলেছি। চলো বাথরুমটা দেখে আসি। আমি মাফ চাইছি দেবী। ক্ষমা করো। ”

“আচ্ছা চলো।”
বাথরুমে এলাহী কারবার। সাদা ঝকঝকে একটা রুম। বিরাট একটা বাথটাব। দুজন একসাথেই স্নানে নেমে যাওয়া যায়।
“কি দেবী স্নান করবে ?”
“এখন?”
“না। পরে।”
“ও মা। করবো না। আমার স্বামী আমাকে বাথটাবে স্নান করাতে চায় আর আমি করবো না?”
“সাথে যদি আমি থাকি কোন সমস্যা হবে?”
“না হবেনা। তখন তো আমরা স্বামী স্ত্রী, তাইনা। সাতখুন মাফ।”

এবারে দেবী হাসলো চমৎকার করে। ওর হাসিটা কেন যে এত্তো সুন্দর! মিহি একটা শব্দতরঙ্গের ঢেউ বয়ে গেলো কানের ভেতর দিয়ে। এই হাসিটা মনের ভেতর গেঁথে যদি রাখতে পারতাম। যখন তখন শুনতে পারতাম। যখন তখন...।

“আচ্ছা আমাদের বিয়েটা কবে?”
“এখনো কিছু ঠিক হয়নি।”
“কবে ঠিক হবে?”
“কয়েক দিনের মাঝেই আমার বাবা- মা তোমাদের বাসায় যাবে।”
“কয়েক দিন? ” দেবীর আবারো সেই হাসি...আমার বুকে আবারো সেই গেঁথে রাখার ইচ্ছে হয়।

“আচ্ছা বিয়ে কি তুমি করছো না আমি?
“তুমি আমাকে বিয়ে করছো। ”
“দ্যাটস রাইট সুইট গাধু। আমি বিয়ে করবো আর তুমি বিয়ে বসবে।”
“জ্বী বেগম।”
“ফ্ল্যাট পছন্দ হয়েছে?”
“হুমম। হয়েছে।”
“বিয়ে কবে হচ্ছে?”
“বড়জোর সাতদিন”

এর দিন কতক পরেই আমার জীবন থেকে দেবী চলে গেলো। মাঝে মাঝে মনে হয় খুন করে ফেলি। আমার এই ভালবাসার মানুষটি আর আমার হলনা। কি হবে খুন করে? আমার জীবনের এই যে ব্যার্থতা, কেন? কেন? কেন? আমি এর উত্তর জানিনা। জানতে চাইও না। ভালো থাকুক আমার দেবী। এটাই আমার বড় পাওয়া। হয়তো আমার চে ভালো কাউকে সে জীবন সঙ্গী হিসেবে পেয়েছে। কে জানে। দুনিয়াটাইতো প্রতিযোগিতার।

কাঁদি, বুক ছেড়ে আমি কাঁদি। এখন বিষন্ন মনে ভাবি, দেবী কেনো চলে গেলো? এতো বছরের আমাদের প্লেটনিক সম্পর্ক ছেড়ে? আমি জানিনা। কিছু জানিনা। যেখানেই থাকো, ভালো থেকো দেবী। ভালো থেক?

শুধু আমি কাজটাই ঠিকমতো করতে পারিনা। সব কিছু অর্থহীন মনে হয়। কেমন যেন অদ্ভুত লাগে সব,বোধ হয় পাগল হয়ে যাচ্ছি। দেবী তুমি কেন চলে গেলে? এই একাকীত্ব ভালো লাগেনা। সাহস নেই আর বাবা মায়ের দিকে তাকালে আমি পারিনা। আত্মহত্যা করতে পারিনা।


মন্তব্য

সাইদ এর ছবি

অসাধারণ!!!!!!!

ভাবছি আপনার জীবনের গল্প নাকি চিন্তিত

মানিক চন্দ্র দাস এর ছবি

সাইদ ভাই,
আমার নিজের জীবন অতি সাদামাটা। কোন দেবীর মায়ায় পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়নি। ভালো থাকবেন।

মানিক চন্দ্র দাস এর ছবি

দেঁতো হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালোই লাগলো। তবে.......!
............................................
নতুনত্ব আছে বৈ কি।

ঘড়ি পড়ি> ঘড়ি পরি
জহিরুল ইসলাম নাদিম

দেবোত্তম দাশ এর ছবি

বানান গুলো দেখতে হবে:-
পড়িনা
রোগীর
হাটঁবে
সন্যাসী

আমরা আমাদের বাবা-মায়েদের চালাবো।

এই লাইনটি ভালো লাগছে না।

------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !

------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !

মানিক চন্দ্র দাস এর ছবি

দাদা,
বাবা-মা তাদের স্নেহ মমতা ভালোবাসা দিয়ে পঙ্কিল এই পৃথিবী থেকে সন্তানদের আগলে রাখেন। আমরা, সন্তানেরা তাদের বয়স হয়ে গেলে ভালোবাসা দিয়ে মুড়িয়ে রাখব। তাদের অধরা স্বপ্নগুলোকে বাস্তবে দেখাবো। নইলে আমরা আবার কিসের সন্তান?? এই কথাটাই আমি এক লাইনে বলতে চেয়েছি। আমার লেখার দূর্বলতার কারনে হয়তো আমার কথাটা আপনাকে বোঝাতে পারিনি। আমি দুঃখিত। আশা করি আমার দুর্বল লেখনি কে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ভালো থাকবেন দাদা।

অতিথি লেখক এর ছবি

মানিকদা আজকাল প্লেটোনিক প্রেমের ভাত নাই, ভাল একটা গেম দিলে দেখতেন দেবী তো দেবী, তার পাছ পাছ ইলেকট্রিক বিলের লাগান লাইন পরি যাইত:D।

অনন্ত আত্মা

প্রতিচ্ছবি [অতিথি] এর ছবি

অনন্ত আত্না আপনার সাথে সহমত, প্লেটোনিক লাভ এর দিন আসলেই শেষ!!

প্রতিচ্ছবি [অতিথি] এর ছবি

শুরুটা দারুণ লেগেছে, পরের অংশটুকু ও ভালো লাগছে। একই লেখায় প্রেমিকা ও বাবা-মা উভয় এর জন্যে ভালবাসা তুলে ধরার জন্যে ধন্যবাদ।

অতিথি লেখক এর ছবি

মানিক ভাই, গল্পটা পড়লাম। কাহিনীটা ভালো। লেখা ঝরঝরে।
মনে প্রশ্ন জাগে, দেবী চলে গেল কেন? কেন দেবীরা সবসময় শুধু চলে যায়?
সংলাপগুলো ভালো লেগেছে। আপনার লেখার হাত পরিস্কার। নিয়মিত চর্চা করলে তা আরও শাণিত হবে।
আপনার জন্য অনেক অনেক শুভ কামনা। হাসি

"দুনিয়াটাইতো প্রতিযোগিতার" - কথাটা ভালো লাগলো। এখন ভালোবাসাতেও তুমুল প্রতিযোগিতা। মন খারাপ

শাহেদ সেলিম

আশরাফ [অতিথি] এর ছবি

মানিকদা, দেবীরা প্রসাদ চায়, মুখ ফুটে না হলে ও আকারে প্রকারে। নৈতিকতা প্রয়োজন, তবে ভালবাসার খাতিরে একটু আধটু এদিক সেদিক হলে কী আসে যায়।

মানিক চন্দ্র দাস এর ছবি

প্রিয় আশরাফ,
দেবীরা প্রসাদ চায়না। ভোগ চায়, আমরা সাধারন মানুষ তার প্রসাদ পাই। নৈতিকতা প্রয়োজন অবশ্যই। ভালোবাসার খাতিরে এদিক ওদিক?? কি জানি ভাই, আমার নৈতিকতায় এটা ঠিক যায়না। মতটা অবশ্যই আমার ব্যক্তিগত। তাই হয়তো প্লেটনিক। ভালো থাকবেন।
মানিক

শ্রীকৃষ্ণ এর ছবি

আমার কেন যেন মাঝে মাঝে মনে হয়, পৃথিবীতে কি সুস্থ ভালবাসার দিন ফুরায়ে গেছে, কেন যেন মনে হয় যুগের সাথে অচল হয়ে গেছি, স্বার্থ আর পঙ্কিল সমঝোতা ছাড়া কি কোন ভালবাসা অবশিষ্ট নাই............ ভালো লাগছে লেখাটা পরে ............ আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।