হরনেট ফ্লাইট (প্রথম পর্ব)

মানিক চন্দ্র দাস এর ছবি
লিখেছেন মানিক চন্দ্র দাস [অতিথি] (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৮/১১/২০১০ - ৪:৫৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

পূর্ব কথা

হাসপাতালের দীর্ঘ করিডর, শুনশান নীরবতা। শুধু একজন মানুষের হাঁটার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। ভদ্রলোকের এক পা কাঠের। তিনি মাথা নিচু করে হেঁটে চলেছেন। হাঁটা দূর থেকে দেখলে ভদ্রলোকের এক পা যে কাঠের তা বোঝা যায়না। স্বাস্থ্য অ্যাথলেটদের মতো, ছোটখাটো গড়ন, বয়স ত্রিশের কোঠায়। পড়নে চারকোল গ্রে স্যুট। হাঁটার সময় ট্যাক ট্যাক ধরনের শব্দ হচ্ছে। তাঁর চোখমুখ শক্ত। হাঁটার সাথে চলছে আবেগ দমন করার তীব্র চেষ্টা।

করিডরের শেষ মাথায় নার্স ডেস্ক। ডেস্কে নার্স বসা। ভদ্রলোক ডেস্কে পৌঁছে বললেন, “ফ্লাইট লেফটেনেন্ট হোয়ার আছেন?”

রেজিষ্ট্রার খাতা থেকে নার্স চোখ তুলে তাকালো। মেয়েটা সুন্দরী, গোলগাল মুখ, চোখে ভারী কাঁচের চশমা। সে মিহি গলায় উত্তর দিলো, “আপনি কি তার কোন আত্মীয় ?” নার্সের মুখে চমৎকার একটুকরো হাসি।

নার্সের হাসিতে ভদ্রলোকের চেহারায় কোন ভাবান্তর হলোনা। তিনি নির্বিকার গলায় বললেন, “হোয়ার আমার ভাই। কোন বেডে আছে?”

“বামের সারির একদম শেষ বিছানা।“

ভদ্রলোক সোজা ওয়ার্ডে ঢুকে গেলেন। ওয়ার্ডের বাম সারির বিছানাগুলোর একদম শেষটা ফাঁকা। তবে বিছানার পাশে একটা চেয়ার দেখা যাচ্ছে। তাতে পেছন ফিরে একজন বসে আছে। তাই মুখ দেখা যাচ্ছেনা। তবে ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। লোকটা ওয়ার্ডের ভেতরেই সিগারেট ধরিয়ে টানা শুরু করেছে।
ভদ্রলোক ফাঁকা বিছানা দেখে একটু দ্বিধার ভেতরে পড়ে গেলেন। বিছানার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন, “ বার্ট নাকি? ”

চেয়ারে বসা লোকটা উঠে ঘুরে দাড়ালো। তার মাথায়, হাতে ব্যান্ডেজ। মুখে হাসি। সে বললো, “হ্যালো ডিগবি।”

ডিগবি ভাইকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর বললেন, “ মনে করেছি তুই মরে গেছিস।”
এরপর দু ভাই একসাথে কেঁদে উঠলো। এ কান্না আনন্দের। অনিশ্চিত শোকের হাত থেকে মুক্তি পাবার আনন্দ।


*********************************

বার্ট বললো, “আমি একটা হুইটলি চালাচ্ছিলাম।” কথাটা বলেই একটু চুপ করে রইলো বার্ট।

হুইটলি হচ্ছে একধরনের বিমান। পুরো নাম আর্মষ্ট্রং হোয়াইটওয়ার্থ হুইটলি। বিমানটা দেখতে শষার মতো, কাজে বম্বার এবং উড়ে নাক নীচু করে একটু বিচিত্র ভঙ্গীতে। ১৯৪১ সালের শেষের দিকে ইংল্যান্ডের বম্বিং স্কোয়াডের সাতশ বিমানের মধ্যে হুইটলি বম্বার ছিলো প্রায় একশো।

বার্ট বললো, “ একটা মেসারখমিট আমাদের গুলি করে, আমারটাতে গুলি লেগেছিলো বেশ কয়েকটা। আমাদের পুরোপুরি শেষ না করেই বিমানটা সটকে পড়ে। বোধহয় ফুয়েল শেষ হয়ে গিয়েছিলো। কপাল ভালো, নইলে মোরব্বা হয়ে যেতাম গুলি খেয়ে। তবে ঐ মেসারখমিট সরে যাবার পরপরই আমি অলটিচ্যুড হারানো শুরু করি। হুইটলির দুই ইঞ্জিনেই গুলি লেগেছিলো বোধহয়। বিমান থেকে অতিরিক্ত অ্যামুনিশন ফেলে দিয়ে ভাবলাম অলটিচ্যুড কিছু হলেও ফিরে পাবো। কোন লাভ হলোনা। সাগরে আছড়ে পড়াটা হয়ে গেলো স্রেফ সময়ের ব্যাপার। ”

ডিগবি হাসপাতালের বিছানার কোনে চুপ করে বসে ভাইয়ের কথা শুনছেন। চোখ শুকনো, তাকিয়ে আছেন ভাইয়ের দিকে।

বার্ট বললো, “আছড়ে পড়বো বোঝার পরই ক্রুদের বললাম, আমাদের অবস্থা ভালোনা, সবাই বাল্কহেডে চলে যাও।”

ডিগবির মনে পড়লো বার্টের সাথে ক্রু ছিলো আরও চারজন।

“ আমাদের অলটিচ্যুড যখন জিরো হয়ে গেলো তখন আমি শেষ চেষ্টা করলাম অলটিচ্যুড ফিরে পাবার। থ্রটল খুলে দিলাম। সুবিধা হলোনা। সোজা গিয়ে আছড়ে পড়লাম খোলা সাগরে। ”

ডিগবি আর বার্ট সৎ ভাই। ডিগবির বয়স যখন তেরো, তখন তার মা মারা যায়। এরপর ডিগবির বাবা এক বিধবা কে বিয়ে করেন। ঐ মহিলারও আগের ঘরের এক ছেলে ছিলো। বার্ট সেই ছেলে। সেই ছোট্ট বেলা থেকেই ডিগবি বার্টকে আপন ছোট ভাইএর মতো করেই দেখে এসেছে। ছোট ভাইকে স্কুলের মারামারি থেকে বাচিয়েছে। হোমওয়ার্কে সাহায্য করা, পড়া তৈরি করা, সবকিছুতেই বার্টের পাশে থাকতো ডিগবি। দুই ভাই এ সবখানেই মিল। দুজনেই প্লেন বলতে পাগল। দুজনেরই স্বপ্ন ছিলো পাইলট হবে। এক মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ডিগবির পায়ে সমস্যা দেখা দেয়। তাই তার আর পাইলট হওয়া হয়নি। সে পড়েছে ইঞ্জিনিয়ারিং এবং পরবর্তীতে প্লেনের ডিজাইনিং এর কাজে ডিগবিকে দেখা গেলো। বার্টের অবশ্য পাইলট হতে কোন সমস্যা হয়নি।

“ বুঝলে ভাইয়া, সাগরে পড়ার পরই জ্ঞান হারিয়েছিলাম। একটু পর যখন জ্ঞান ফিরলো তখন খুব পোড়া গন্ধ পেলাম। আশেপাশে তাকিয়ে দেখি বিমানের ভাঙ্গা টুকরো পানিতে ভাসছে। ভাঙ্গা টুকরোতে জ্বলছে আগুন। চারদিকে কবরের অন্ধকার, পানির ঢেউ এর শব্দ। আগুনের আলোয় অল্প কিছু দেখা যায়। বহু কষ্টে ফিউজিলাজের কাছে গেলাম। জায়গামতোই ডিনঘি প্যাক পাওয়া গেলো। প্যাক নিয়ে হ্যাচ দিয়ে বেরিয়ে এলাম, ঝাঁপ দিলাম খোলা সাগরে। ওহ জিসাস, ভাইয়া পানি যে কি ঠান্ডা, কি আর বলবো ! ”

বার্ট কথা বলছে শীতল গলায়, শুধু কথা বলতে বলতে সে সিগারেটে কষে টান দিচ্ছে। ধোঁয়া, নীলচে ধোঁয়া পৌঁছে যাচ্ছে ফুসফুসে আর সাদা ধোঁয়া বেরিয়ে আসছে তীব্র বেগে, জেটের মতো।

“ আমার পড়নে লাইফ জ্যাকেট ছিলো। তার কল্যানে ভেসে রইলাম কর্কের মতো। পানিতে খুব ঢেউ ছিলো, একবার ভাসি, একবার ডুবি। পানিতে পড়ার পর ডিনঘি প্যাক হাত থেকে ছুটে গেলো। কপাল ভালো, হঠাৎ দেখি প্যাকটা ভাসছে নাকের সামনেই। প্যাকের ষ্ট্রিং ধরে টান দিলাম, প্যাক নিজে নিজেই খুলে ফুলে উঠলো। কিন্তু সমস্যা হলো ওতে আমার উঠার ক্ষমতা ছিলোনা। ক্ষমতা কেন হয়নি তা আমি তখন বুঝিনি। বুঝতেই পারিনি যে আমার শোল্ডার জয়েন্ট খুলে গেছে, হাতের কবজি ভেঙ্গেছে, পাঁজরের হাঁড় ভেঙ্গেছে তিনটা। উঠতে পারিনি তাই প্যাক ধরেই ভেসে রইলাম। কিন্তু ঠান্ডায় মনে হচ্ছিলো মারা যাবো। ঠিক ঐ সময়েই জোনস আর ক্রফটকে দেখতে পেলাম। এরা দুজনেই প্লেনের টেইল ধরে ভেসে ছিলো। ওরা সাঁতার জানেনা। টেইল ডোবার পর ওরা কোনরকমে হাঁচড়েপাচড়ে প্যাকে উঠেছে। ওরাই আমাকে টেনে তোলে।”

এটুকু বলে বার্ট নতুন একটা সিগারেট ধরালো। কষে এক সুখটান। এরপর আবারো সে বলা শুরু করলো।

“সাগরে পড়ার পর থেকেই পিকারিং কে দেখিনি। সাগরের তলাতেই বোধহয় ওর সমাধি হয়েছে।”

চুপ করে রইলো বার্ট। কষ্ট চেপে রাখার প্রানপণ চেষ্টা চলছে তার ভেতর। এসময় ডিগবির মনে হলো, ক্রু ছিলো ওরা মোট পাঁচ জন। আরেকজনের কথা বার্ট বলছেনা কেন?

ডিগবি একসময় নীরবতা ভেঙ্গে বললো, “আরেকজনের কি হলো? তোরা মোট পাঁচ জন ছিলি, তাইনা?”

“ হ্যা পাঁচ জন ছিলাম। পঞ্চমজনের নাম জন রোলি। বম্ব এইমার ছিলো। দুর্ঘটনার পর বেঁচেও ছিলো। আমরা ওর চিৎকারও শুনেছি। আমি প্রায় অজ্ঞান ছিলাম তাই কিছু করতে পারিনি। কিন্তু জোনস আর ক্রফট চিৎকারের উৎস অনেক খুঁজেছে।”

মাথানীচু করে বসে আছে বার্ট। বসার ভঙ্গীতে অদ্ভুত এক ধরনের অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে।

“তখন আমরা যে কি অসহায় হয়ে গিয়েছিলাম ভাইয়া, তা আমি তোমাকে বলে বোঝাতে পারবোনা। চার ফুট -পাঁচ ফুট উঁচু ঢেউ। পানির তোড়ে বিমানের আগুনও নিভে আসছে, দৃষ্টিসীমা হয়ে আসছে সীমিত। বাতাসে তীব্র শোঁ শোঁ শব্দে কানে তালা লাগার জোগাড়। চিৎকার কোন দিক থেকে আসছে তা আমরা কেউ বুঝতেই পারলামনা। তারপরেও আমরা চেষ্টা করেছি। কিন্তু ঢেউএ আমরা ভেসে বেড়ালাম বাদামের খোসার মতো। রোলির চিৎকার একসময় থেমে গেলো।”

দুভাই হাত ধরে, মাথা নীচু করে বসে রইলো। কারও মুখে কোন শব্দ নেই। অসহায়ত্ব যেন ভাগ হয়ে যাচ্ছে দুই ভাইয়ের মধ্যে।

"ভোরের দিকে ইউ-বোট পেট্রলের ডেষ্ট্রয়ার আমাদের দেখতে পায়। ওরাই আমাদের তুলে নিয়ে আসে।"

বার্ট মাথা উঁচু করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। বাইরে চমৎকার সবুজ পৃথিবী। এই সবুজ পৃথিবী আবার কোনদিন বসে দেখা যাবে, সেইরাতে বার্ট একবারের জন্যেও ভাবতে পারেনি।

দুভাই দীর্ঘসময় চুপচাপ বসে রইলো। তারপর বার্ট বললো, “রেইড কি সফল হয়েছিলো সেদিন? আমাকে কেউ বলতেই পারলোনা কজন ঠিকমতো ফিরেছে।”

“রেইডের ফলাফল ভয়াবহ।” উত্তর দিলেন ডিগবি।

“আমার স্কোয়াড্রনের খবর কি?”

“সার্জেন্ট জেনকিনস আর ওর ক্রুরা ফিরেছে।” ডিগবি পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে দিলেন। “পাইলট অফিসার আবাসারাতনাম ও ফিরেছে। আচ্ছা আবাসারাতনাম, এইটা কি ধরনের নাম? এ ছেলে কোন দেশের?”

“সিলনের ছেলে।”

“আচ্ছা। আর সার্জেন্ট রিলে ফিরেছে। ওর কপাল ভালো যে ফিরতে পেরেছে। বেশ কয়েকটা গুলি খেয়েছে ওর বিমান।”

“আইরিশ গুলোর কপাল এমনিতেই ভালো হয়। উত্তর দিলো বার্ট। আর বাকীদের খবর কি?”

ডিগবি দুপাশে মাথা নাড়লেন।

“কিন্তু রেইডে তো আমার স্কোয়াড্রনেরই ছয়টা বিমান গেছে। আর কোন খবরই নেই?” প্রতিবাদ করলো বার্ট।

“শোন বার্ট, এই তথ্য আমি যেমন জানি, তুইও তেমন জানিস। আর কেউ বেঁচে ফেরেনি।”

“তাহলে...তাহলে...ক্রেইটন,স্মিথ নেই? বিলি স ও মরে গেছে...আর...ওহ খোদা।” ভয়াবহ শোক আর হতাশায় মুখ ঘুরিয়ে নিলো বার্ট।

“আমি দুঃখিত বার্ট।”

কথাটা শুনেই জ্বলে উঠলো বার্ট। “শুধু দুঃখিত বলেই শেষ? আমাদের ওখানে পাঠানোই হয়েছিলো মরার জন্যে।”

“জানি বার্ট।”

“ফর ক্রাইষ্টস সেইক ডিগবি। এই পরিকল্পনায় তোমারও হাত ছিলো। তুমি নিজেও এই সরকারের যাবতীয় কর্মপন্থার অংশীদার।”

“সেভাবে বললে তুই ঠিকই বলছিস। আমি প্রাইম মিনিষ্টারের জন্যে কাজ করি।”

প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের বেশ বিচিত্র কিছু অভ্যাস ছিলো। তিনি বিভিন্ন প্রাইভেট ইন্ডাষ্ট্রি থেকে লোকজন ধরে নিয়ে আসতেন সরকারের হয়ে কাজ করার জন্যে। ডিগবিও এরকম একজন। যুদ্ধের আগে ডিগবি ছিলেন এয়ারক্রাফট ডিজাইনার। এখন চার্চিলের বিমান বিষয়ক দিকটি দেখাশোনা করেন ডিগবি।

“তাহলে ভাইয়া এতোগুলো সুস্থ্যসবল মানুষের মৃত্যুর পেছনে তোমারও ভূমিকা আছে। এই মূহুর্তে হাসপাতালে অসুস্থ্যদের দেখতে যাবার মতো বিলাসিতা করার সময় তোমার হাতে নেই। কিছু একটা করা উচিৎ।” বার্টের গলায় তীব্র শ্লেষের সুর।

ডিগবি শান্ত গলায় বললেন, “কিছু একটাই করার চেষ্টা করছি। রেইডে এই ভয়াবহ বিপর্যয় কেন হলো, সেটা তদন্তের ভার দেয়া হয়েছে আমার উপর । রেইডে আমরা প্রায় অর্ধেক বিমান হারিয়েছি।”

“ভাইয়া, আমার ধারণা আমাদের রেইডের ব্যাপারে তথ্য পাচার হয়েছে অনেক উপর থেকে। নয়তো কোন এক বেকুব এয়ার মার্শাল বারে মদ খেতে খেতে বেফাঁস কথা বলে ফেলেছে। আশেপাশেই হয়তো কোন নাৎসী বারম্যান ছিলো।”

“হতে পারে। এই সম্ভাবনাটাও আমরা মাথায় রেখেছি। সব খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”

বার্ট একটা দীর্ঘশ্বাষ ফেললো। “ আমি দুঃখিত ডিগবি। ভুলটা তোমার হয়নি, দায়ও তোমার নেই। আসলে আমার মাথাটাই বোধহয় গেছে। এই ঘটনাটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিনা। ”

“একটা বিষয় ভেবে বলতো বার্ট। আমরা এরকম মোরব্বা হয়ে গেলাম কেন? কারনটা কি হতে পারে? তুই তো অনেক মিশনে গেছিস, তোর বক্তব্য কি?”

একটু চিন্তা করলো বার্ট। “স্পাইদের কথাটাই বোধহয় ঠিক। আমরা যখন জার্মানীতে ঢুকলাম, দেখি ওরা প্রস্তুত হয়েই আছে। ওরা যেন জানতো যে আমরা আসছি।”

“একথা বললি কেন?”

“ওদের সব ফাইটার আকাশেই ছিলো। কোন ডিফেন্সিভ ফোর্সের জন্যে ঠিক সময় আকাশে ওড়াটা কি পরিমান শক্ত কাজ তাতো জানোই। কিন্তু ওদের এ ঝামেলাতে যেতেই হয়নি। ওরাই বরং আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিলো। অজগর যেমন শিকারের জন্যে অপেক্ষা করে, শিকার এসে পড়ে সামনে, আমাদের অবস্থাও হয়েছে ঠিক তেমনি। ওরা নিশ্চয়ই ওদের এয়ারফিল্ড থেকেই পুরো বিষয়টা ট্র্যাক করেছে। ট্র্যাক করার পর ওরা আমাদের অনেক উপরে উঠে গিয়ে চুপচাপ ছিলো। পৌঁছানো মাত্রই ওরা আমাদের উপর থেকে দেখেছে চাঁদের আলোয়। ব্যস, তারপরের ঘটনাতো তুমি জানোই। এ ধরনের পরিস্থিতির জন্যে আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। আমরা আসলে এরকম কিছু আশা করিনি।”

নড করলেন ডিগবি। বার্ট ছাড়াও অন্যান্য পাইলটদের বক্তব্য তিনি শুনেছেন। সবার বক্তব্য একইরকম। একথাটাই বলতে গিয়ে তিনি দেখলেন বার্টের পাশেই এক স্কোয়াড্রন লীডার নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়ে আছে।

বার্ট বললো, “হ্যালো চার্লস।”

চার্লস বললো, “আমরা সবাই তোমার জন্যে চিন্তিত বার্টলেট।”

“ওরাতো বললো, এযাত্রা বেঁচে যাবো।”

স্লিং থেকে বার্টের হাতের যে অংশ বেরিয়ে আছে, সে অংশে আঙ্গুল দিয়ে ছুঁয়ে দিলো চার্লস। ছোঁয়ার মাঝে অদ্ভুত ধরনের একট আন্তরিকতা ছিলো । সেই আন্তরিকতা ছুঁয়ে গেলো ডিগবিকেও।

চার্লস বললো, “শুনে ভালো লাগছে বার্ট। তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে উঠো”

“চার্লস, এই হচ্ছে আমার বড় ভাই। আর ডিগবি, এই হলো চার্লস।এয়ারফোর্সে জয়েন করার আগে আমরা একসাথেই ট্রিনিটিতে ছিলাম।”

চার্লস ডিগবির হাত ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললো, “এয়ারফোর্সে জয়েন না করলে অনেক পরীক্ষা দিতে হতো। পরীক্ষা এড়াতেই এয়ারফোর্সে চলে এসেছি। হাহ হা হাহা”

হাসিতে তিনজনই যোগ দিলো। এরপর ডিগবি বললেন, “চার্লস আমি বার্টকে বলেছি যে আমরা যুদ্ধে খুব বেশী বম্বার হারাচ্ছি।আচ্ছা চার্লস, আপনার মতামত কি?”

চার্লস বললো, “আমি বার্টের এই রেইডে ছিলাম না। এখন মনে হচ্ছে আমার ভাগ্য ভালো। অবশ্য শুধু এই রেইড না, আমরা কোন রেইডেই সুবিধা করতে পারছিনা। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় ল্যুফটাফে যেন মেঘের ভেতর দিয়েও আমাদের দেখতে পায়। ওদের এমন কোন যন্ত্র কি আছে যেটা দিয়ে দৃষ্টিগোচর হবার আগেই আমাদের লোকেট করা যায়?”

দুপাশে মাথা নেড়ে ডিগবি বললেন, “শত্রু পক্ষের যেসব বিমান আমরা ধ্বংস করেছি তা আমরা পরে পরীক্ষা করে দেখেছি। কোথাও এরকম কোন যন্ত্র পাওয়া যায়নি। অন্তত আপনি যে ধরনের যন্ত্রের কথা বলছেন। এ যন্ত্র আমরা আবিস্কার করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমাদের শত্রুপক্ষও সেই চেষ্টা করার কথা। আমরা সে জিনিষ আবিস্কারের ধারে কাছেও যেতে পারিনি। শত্রু পক্ষের গবেষনা আমাদের কয়েক ধাপ পেছনে আছে বলেই আমার ধারনা। মূল সমস্যা বোধহয় কোন যন্ত্র নয়।”

“হতে পারে ডিগবি। আমার যা মনে হয় সেটাই বললাম।”

বার্ট বললো, “বোধহয় স্পাই ব্যাটাদেরই কাজ।”

“বিষয়টা ইন্টারেস্টিং।”এই বলে উঠে দাড়ালো ডিগবি। “আমাকে হোয়াইট হলে যেতে হবে। মতামত দেবার জন্যে ধন্যবাদ। আমার কাজে এই মতামতের প্রয়োজন ছিলো।” বার্টের অক্ষত কাঁধে হাত রেখে ডিগবি বললেন, “তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে ওঠ।“

“ডাক্তারেরা বলেছে কয়েক সপ্তাহের মাঝেই বিমানে বসতে পারবো।“
“শুনে খুশি হতে পারছিনা বার্ট।”

ডিগবি হাঁটা শুরু করলেন। পেছন থেকে চার্লস বললো, “একটা প্রশ্ন করতে পারি?”

“অবশ্যই।“

“প্রতি রেইডে আমাদের বম্বিং এ শত্রুপক্ষের যে ক্ষতি হয় তারচেয়ে আমাদের বম্বার বেশি ধ্বংশ হলে আমাদের ক্ষতির পরিমানটাই তো বেশী। তাইনা?”

“অবশ্যই।”

“তাহলে আমরা বম্বিং কেন করি? কি লাভ আমাদের?”

“ঠিক বলেছে চার্লস। আমারও একই প্রশ্ন ডিগবি।" সায় জানালো বার্ট।

ডিগবি বললেন, “এছাড়া আমাদের আর কি করার আছে? নাৎসী বাহিনী ইউরোপ দখল করে আছে। অষ্ট্রিয়া, চেকোস্লাভাকিয়া, হল্যান্ড, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, নরওয়ে সব ওদের দখলে। ইতালি ওদের মিত্রপক্ষ। স্পেনও সেদিকে ঝুঁকে আছে, কিন্তু কোন ঘোষনায় যায়নি। সুইডেন নিরপেক্ষ। তাদের রাশিয়ার সাথে একটা আঁতাত আছে। ঐ এলাকায় আমাদের কোন সামরিক বাহীনি নেই। বম্বিং রেইড ছাড়া যুদ্ধের আর উপায় কি?”

নড করলো চার্লস। “এই হলো আসল কারন?”

“হ্যাঁ, ওটাই আসল কারন। বম্বিং বন্ধ করলেই যুদ্ধ শেষ। হিটলার জিতে যাবে।“

*************************************************


প্রাইম মিনিষ্টার বসে বসে সিনেমা দেখছেন। সিনেমার নাম ‘দ্যা ম্যাল্টেস ফ্যালকন’। এই প্রাইভেট সিনেমা হলটি সাম্প্রতিক সময়েই করা । করা হয়েছে অ্যাডমিরালটি হাউজের ওল্ড কিচেনে। এতে সিটের পরিমান ষাট। চারপাশ লাল মখমলের পর্দা দিয়ে ঘেরা।এখানে সাধারণত বম্বিং রেইডের দৃশ্য খুঁটিয়ে দেখা হয়। তবে আজ এখানে সিনেমা চলছে।

গভীর রাত। সবকাজ সেরে চার্চিল বসেছেন পর্দার সামনে। চেয়ারের সামনের হাতলে বড়সড় ব্র্যান্ডির গ্লাস রাখা। চার্চিল সিনেমা দেখায় খুব একটা মনোযোগী নন। সিনেমার শেষ সময়ে ডিগবি এসে ভেতরে ঢুকলেন। রুমের বাতাস সিগারেটের গন্ধে ভারী হয়ে আছে। চার্চিল ইশারায় ডিগবিকে পাশে বসতে বললেন।

সিনেমা শেষ হলো। চার্চিল তাও পর্দার দিকে তাকিয়ে রইলেন। অন্যান্য সময় তাঁকে বেশ প্রানোচ্ছল দেখায়। আজ তা মনে হচ্ছেনা। বিষন্নতার একটা পর্দা তাঁকে ঘিরে রেখেছে। একসময় প্রাইম মিনিষ্টার চার্চিল বললেন, “তো ডিগবি, RAF কি বলে?”

“স্যার, ওদের কথা হচ্ছে এই রেইডে ব্যার্থতার মূল কারন আমাদের দুর্বল ফর্মেশনের ফ্লাইং। তাদের তত্ব অনুযায়ী যদি বম্বাররা ক্লোজ ফর্মেশনে উড়তো তাহলে তাদের অস্ত্রের রেইঞ্জ পুরো আকাশ কভার করতো। কোন শত্রুপক্ষীয় বিমান দেখামাত্র গুলি করে ফেলে দেয়া যেতো।“

“তোমার কি মত?”

“বাজে কথা স্যার। ফর্মেশনের ফ্লাইং কখনই খুব বেশী কাজের কথা না। প্রতিবারই সমীকরনে নতুন ফ্যাক্টর যোগ হয়।“

“আমারও তাই ধারনা। কিন্তু তাহলে বিষয়টা কি?”

“আমার ভাইয়ের বক্তব্য স্যার কাজটা স্পাইদের। আমরা যেসব স্পাই ধরেছি সবকটাই ছিলো অ্যামেচার ধরনের। অবশ্য অ্যামেচার না হলে ওরা কেউ ধরাও পড়তোনা। হতে পারে ধূর্ত কেউ আমাদের জাল এড়িয়ে গেছে।“

“জার্মানরা হয়তো নতুন কোন যন্ত্র আবিস্কার করেছে।“

“সিক্রেট সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স বলেছে ওরা রাডার ডেভেলপমেন্টে আমাদের চাইতে অনেক পেছনে পড়ে আছে।“

“ওদের কথায় তুমি বিশ্বাস রাখো?”

“না স্যার।“

হলের লাইট জ্বলে উঠলো। চার্চিল ইভনিং ড্রেস পড়ে বসে আছেন। তিনি ওয়েষ্টকোটের পকেট থেকে একটি ভাঁজ করা কাগজ দিলেন ডিগবিকে। বললেন,”এই হচ্ছে সূত্র”।

ডিগবি কাগজটা পড়ে ফেললেন। পড়ে মনে হচ্ছে একটা রেডিও সিগন্যালকে ডিক্রিপ্ট করা হয়েছে। দুই ভাষাতে লেখা, জার্মান ও ইংরেজী। ওতে বলা হচ্ছে,

ল্যুফটাফে যুদ্ধ করার নতুন ষ্ট্রাটেজি বিরাট বিজয় লাভ করেছে। অসাধারন তথ্যের জন্য ফ্রেয়াকে ধন্যবাদ।

ডিগবি কাগজটা দুবার পড়ে নিলেন। ফ্রেয়া শব্দটি কি? এটি জার্মান বা ইংরেজী কোন ভাষারই শব্দ নয়। তিনি বললেন, “স্যার ফ্রেয়া শব্দটির অর্থ কি?”

“অর্থ তুমিই খুঁজে বের করবে।“ চার্চিল উঠে দাড়ালেন। জ্যাকেট পড়তে পড়তে বললেন,” আমার সাথে এসো।“

হল থেকে বেরিয়ে চার্চিল হাঁটা শুরু করলেন। পাশে ডিগবি। কিছুক্ষনের মধ্যেই পেছনে দুজনের হাটার শব্দ পাওয়া গেলো। একজন ইন্সপেক্টর থম্পসন, এসেছেন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে। তিনি চার্চিলের ব্যাক্তিগত দেহরক্ষী। হাঁটতে হাঁটতে তারা প্যারেড গ্রাউন্ডে বেরিয়ে এলেন। লন্ডন শহর অন্ধকার। ব্ল্যাকআউট চলছে। তবে চাঁদের আলোয় পথ দেখা যাচ্ছে। কিছুদূর যাবার পর প্রাইম মিনিষ্টারের থাকার জায়গা ক্যাবিনেট ওয়ার বিল্ডিং চলে এলো। প্রাইম মিনিষ্টারের আসল থাকার জায়গা দশ নম্বর ডাউনিং ষ্ট্রীট। সেটি বোমায় আঘাতপ্রাপ্ত। তাই এই নতুন থাকার জায়গা।

ডিগবি বললেন, “গুড নাইট স্যার।“

চার্চিল বললেন, “এভাবে চলতে পারেনা ডিগবি। এভাবে চললে ক্রিসমাস নাগাদ আমাদের বিমান বাহীনি বলে কিছু থাকবেনা। আমি জানতে চাই এই ফ্রেয়া কে বা কি?”

“আমি দেখছি স্যার।“

“বিষয়টা সর্বোচ্চ জরুরী।“
“ইয়েস স্যার।“

“গুড নাইট ডিগবি।“ ভেতরে ঢুকে গেলেন প্রাইম মিনিষ্টার চার্চিল।


চলবে...


মন্তব্য

তারাপ কোয়াস এর ছবি

চলুক।


love the life you live. live the life you love.

মানিক চন্দ্র দাস এর ছবি

ধন্যবাদ তারাপ ভাই। দোয়া রাইখেন ভাই।

দিগন্ত বাহার [অতিথি] এর ছবি

সুন্দর গাথুনি ! একটানে পড়ে ফেলতে হলো...অপেক্ষায় রইলাম।
দৌড়াক। হাসি

মানিক চন্দ্র দাস এর ছবি

ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

চলুক
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

মানিক চন্দ্র দাস এর ছবি

হেঃ হেঃ চলবে। দোয়া রাইখেন।

বইখাতা এর ছবি

চলুক

মানিক চন্দ্র দাস এর ছবি

ধন্যবাদ বইখাতা।

সাইফ তাহসিন এর ছবি

৫তারা!

ধুর মিয়া এমন জায়গায় শেষ করলেন যে এত্ত বিশাল পর্ব পড়ার পরেও পেট ভরল না। পুরা টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে আপনার অনুবাদে। এক শব্দে 'অনবদ্য', ২-১টা বানান চোখে লাগল।
ডিনঘি = আপনে কি ডিংগি নৌকা বুঝিয়েছেন?

আমার পড়নে লাইফ জ্যাকেট ছিলো
এটা 'পরনে' হবে। পড়া বলতে বই পড়া বুঝায়, অথবা খাট থেকে 'পড়ে' যাওয়া চোখ টিপি

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

মানিক চন্দ্র দাস এর ছবি

সাইফ ভাই,
ধন্যবাদ অনুবাদ পড়ার জন্যে। বাংলা বানান নিয়ে আমার ঝামেলা আছে। পরের বার চেষ্টা করবো যাতে এইরকম দৃষ্টিকটু ভুল গুলো না হয়। ডিনঘি প্যাক এর ইংরেজী বানান হচ্ছে dinghy pack. আপনি যদি একটু দেখে আমাকে জানান, আমি খুশি হবো এবং অবশ্যই উপকৃত হবো। আমি নেট ব্রাউজ করতে পারছিনা স্পীড এর কারনে। শালার জিপি। নইলে আমি নিজেই দেখে আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারতাম। এই যে জবাব লিখছি, তাও যে কবারে যাবে তা আমি জানিনা।
কেমন আছেন? ভালো থাকবেন।
মানিক

আঁকাইন এর ছবি

মানিকদা, পড়া শুরু করে দিলুম। চলুক হাসি

============================
শুধু ভালোবাসা, সংগ্রাম আর শিল্প চাই।

============================
শুধু ভালোবাসা, সংগ্রাম আর শিল্প চাই।

মানিক চন্দ্র দাস এর ছবি

আঁকাইন,
তোমার কথাতে মিয়া আবার অনুবাদ করা শুরু করলাম, তুমি না পড়লে কেমনে হবে? কেমন লাগছে অনুবাদ? জানিও। ভালো থেকো।
মানিক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।