হরনেট ফ্লাইট- ২

মানিক চন্দ্র দাস এর ছবি
লিখেছেন মানিক চন্দ্র দাস [অতিথি] (তারিখ: সোম, ০৬/১২/২০১০ - ৭:৩৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রাককথন

0১

০২


হার্মিয়া মাউন্ট মন খারাপ করে টেবিলের দিকে তাকিয়ে আছে। টেবিলের উপর খাবারের প্লেট দেয়া হয়েছে। তাতে যে খাবার দেয়া হয়েছে তা দেখেই তার মন খারাপ। সসেজ, আলুর দম আর পুড়ে যাওয়া বাঁধাকপি। এই তাকে এখন খেতে হবে। খেতে একদম ইচ্ছে করছেনা, বাঁচতে হলে খেতে হয়, তাই খাওয়া। কোপেনহেগেনের খাবারের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। কি সব খাবার একসময় পেটে যেতো আর এখন কি সব খেতে হচ্ছে !

হার্মিয়া বড় হয়েছে ডেনমার্কে। তার বাবা ছিলেন কূটনীতিবিদ। ভদ্রলোক তার চাকুরী জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে। কোপেনহেগেনের ব্রিটিশ এমব্যাসি তে সেক্রেটারী হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা হার্মিয়ার আছে। সেক্রেটারী থেকে একসময় প্রোমোশন পেয়ে হার্মিয়া হয়েছিলো ন্যাভাল অ্যাটাশের অ্যাসিষ্টেন্ট। ন্যাভাল অ্যাটাশে ঠিক অ্যাটাশে ছিলেন না। তিনি ছিলেন সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস MI6 এর সাথে। বাবা মারা যাবার পর মা সোজা ব্রিটেন চলে যান কিন্তু হার্মিয়া যায়নি। থেকে গেছে ডেনমার্কে। থাকার প্রথম কারন তার প্রেমিক আরনে ওলুফসেন। আরনে ডেনিশ বিমান বাহিনীর পাইলট। দ্বিতীয় কারন চাকরি।

১৯৪০ সালের ৯ই এপ্রিল। এদিন হিটলার বাহিনী ডেনমার্ক দখল করে। চারদিন, চার রাত চরম অস্থিরতার ভেতর কেটেছে । পঞ্চম দিন বেশ কয়েকজন ব্রিটিশ কূটনীতিবিদ সহ হার্মিয়া বিশেষ ডিপ্লোম্যাটিক ট্রেনে করে প্রথমে পৌঁছে জার্মানী, এরপর নিরপেক্ষ দেশ হল্যান্ডে। সেখান থেকে লন্ডন।
হার্মিয়ার বয়শ এখন তিরিশ। এই বয়সে সে MI6 ডেনমার্ক ডেস্কের ইন্টেলিজেন্স এনালিষ্ট ইন চার্জ। তার অফিস ব্লেচলি পার্কের কাছে বিশাল একটা কান্ট্রি হাউজের ভেতর।

খাবার খাওয়া শুরু করলো হার্মিয়া। স্বাদের কথা ভুলতে সে চোখের সামনে মেলে ধরলো ডেইলি এক্সপ্রেস এর পাতা।
তাতে বলা হচ্ছে,
ক্রিটের মেডিটিরিনিয়ান আইল্যান্ডেও ব্রিটিশ বাহিনী হিটলারের হাতে পর্যদুস্ত ।
হতাশ হলো হার্মিয়া। হিটলার জিতেই চলেছে। সময় কি নিষ্ঠুর ! সময় এতো নিষ্ঠুর কেন হয়?

খবরের পাতা থেকে চোখ তুললো হার্মিয়া। একটা ছোট খাটো মানুষ তার দিকেই এগিয়ে আসছে। লোকটার বয়স হবে তার মতোই। লোকটার হাতে এক কাপ চা। “বসতে পারি?” উত্তরের অপেক্ষা না করেই লোকটা ফাঁকা চেয়ারে বসে পড়লো।

“আমি ডিগবি হোয়ার। আপনার পরিচয় আমি জানি।”
একটা ভ্রু তুলে হার্মিয়া বললো, “বসুন, আরাম করেই বসুন।”
হার্মিয়ার সুরের কাঠিন্যকে একটুও পাত্তা দিলোনা ডিগবি। সে বললো , “থ্যাঙ্কস।”

লোকটাকে এর আগেও বেশ কয়েকবার দেখেছে হার্মিয়া। খোঁড়া কিন্তু প্রানপ্রাচুর্য্যের কোন অভাব নেই। চেহারা খুব সুন্দর কিছু না, স্রেফ চলে। তবে চোখগুলো সুন্দর। নীল।

হার্মিয়া বললো, “আপনি কোন ডিপার্টমেন্টে আছেন?”
“আমি এই লন্ডনেই কাজ করি।” প্রশ্নের উত্তরটা কৌশলে এড়িয়ে গেলো ডিগবি। খাবার প্লেট একপাশে সরিয়ে রাখলো হার্মিয়া।
“কি ব্যাপার? খেতে ভালো লাগছেনা?”
“এই খাবার মুখে তোলা যায়? আপনার ভালো লাগে?”
“একটা কথা বলি। কয়েকদিন আগে কয়েকজন পাইলটের সাথে আমার কথা হয়েছে। ফ্রান্সের পাইলট। ওদের ধারনা, এখানে খাবারের মান যুদ্ধকালীন অবস্থা হিসেবে যথেষ্ট ভালো। আমরা আসলে কৃচ্ছ্যসাধন করছি। যদিও লন্ডনে বসে কৃচ্ছ্যসাধন শব্দটার আসল মানে বোঝা যাবেনা। অনেক দেশে মানুষ তো দূরে থাক, ব্যাঙ পর্যন্ত না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছে। এই খবর জানার পর আমার সব খাবারই খেতে খুব ভালো লাগে। অন্যরকম স্বাদ পাই।”
“বাজে রান্নার কারন কখনও কৃচ্ছ্যসাধন হতে পারেনা।” খসখসে গলায় উত্তর দিলো হার্মিয়া।
“শুনেছি আপনি সবসময় কথার পিঠে কথা বলেন।”
“আর কি কি শুনেছেন ?”
“শুনেছি, আপনি দুটো ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারেন। একটা ইংরেজী আরেকটা ডেনিশ। এ কারনে সম্ভবত আপনাকে ডেনমার্ক ডেস্কের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।”
“না। ঠিক বলেননি। ভাষা জানা কোন বিষয় না। যুদ্ধের আগে MI6 এ কোন নারী, সেক্রেটারী অ্যাসিষ্টেন্টের উপরে উঠতে পারেনি। কারন হিসেবে বলা হতো মেয়েদের এনালাইটিক্যাল ব্রেইনের অভাব। যুদ্ধের কারনে মেয়েদের এনালাইটিক্যাল ব্রেইন খুলে গেছে। আগে যেসব কাজ শুধু পুরুষদের জন্যে প্রযোজ্য ছিলো এখন সেইসব কাজ মেয়েরা নির্দ্বিধায়, সহজেই করছে। যত্তোসব ! ”
হার্মিয়ার এই বক্রোক্তি বেশ সহজভাবেই নিলো ডিগবি। মুচকি হেসে সে বললো, “তাইতো দেখছি। যুদ্ধে বিস্ময়ের কোন অভাব নেই। হা হা হা।”
“আপনি আমাকে নিয়ে পড়েছেন কেন? সমস্যা কি?”
“কারন দুটো। প্রথমত আপনি হচ্ছেন আমার দেখা সবচে সুন্দর নারী।” ডিগবির মুখ থেকে হাসি উধাও হয়ে গেছে। মুখ নির্বিকার।

কথাটায় বেশ একটা ধাক্কা খেলো হার্মিয়া। পুরুষদের কাছ থেকে সরাসরি এরকম কথা শোনার অভ্যাস তার নেই। সুন্দরী শব্দটা বহুবার, বহুভাবে শোনা হয়েছে। ‘স্মার্ট’ শোনা হয়েছে। কখনও কখনও ‘আবেদনময়ী’ শব্দটাও শোনা হয়েছে। কিন্তু ‘আমার দেখা সবচে সুন্দর নারী’ এইরকম কথা শোনা হয়নি। হার্মিয়ার চেহারা ডিম্বাকৃতির। প্রায় নিখুঁত । মাথার চুল কৃষ্ণ কালো। চোখের পাতা দীঘল। নাকটা বেশি বড়। সুন্দরীদের নাক বেশি বড় হবার কথা না। তাই, সে সুন্দর, এই কথাটার উপর সরাসরি বিশ্বাস নেই হার্মিয়ার। সে বললো, “আরেকটা কারন কি ?”

আশেপাশে তাকালো ডিগবি। পাশের টেবিলে দুই মহিলা বসেছে। তাদের অর্ধেক কান এই টেবিলে। কথাবার্তা তারা শুনছে বেশ আগ্রহ নিয়ে। ডিগবি বললো, “বলবো, বলবো। একটু সময়তো আগে দিন। বাইরে যাবেন নাকি?”
“কি?” আবারও অবাক হলো হার্মিয়া।
“আমার সাথে বাইরে যাবেন ? ”
“অবশ্যই না।”

একমুহূর্তের জন্যে থমকে গেলো ডিগবি। এরপর আবার মুচকি হেসে বললো, “কেন যে অযথা রাগ করেন ! এতো রাগী কেন আপনি? চলুন না।”
হেসে ফেললো হার্মিয়া। লোকটা কি অদ্ভুত বাচ্চাদের মতো কথা বলছে ।
“সিনেমা দেখতে যাওয়া যায় কিংবা মাটন পাবে যাওয়া যায়। ওখানে খাবার দাবার ভালোই পাওয়া যায়। যাবেন নাকি ? ”
“না, যাবোনা। থ্যাংক ইউ।” শক্ত গলায় উত্তর দিলো হার্মিয়া।
“ধুত্তোরি।”
অনেকটা কৈফিয়তের সুরে হার্মিয়া বললো, “আমি এনগেজড। এই যে আংটি।” বাম হাতের অনামিকায় সোনার একটা আংটি ঝকমক করছে। সেটাই দেখিয়ে দিলো হার্মিয়া।
“ও আচ্ছা। খেয়াল করিনি।”
“পুরুষেরা কখনও খেয়াল করেনা।”
“তা, সৌভাগ্যবান পুরুষটি কে ?”
“আরনে। ডেনিশ আর্মির পাইলট।”
“ডেনমার্কেই আছে নিশ্চয়ই।”
“হ্যাঁ। ওর সাথে প্রায় বছরখানেক কথা হয়না। দেখা হয়না।”

পাশের টেবিল থেকে দুই মহিলা উঠে গেলো। মুহুর্তেই ডিগবির আচরন গেলো বদলে। তার চেহারা এখন খুব সিরিয়াস, গলার স্বর নিচু এবং কথার মধ্যে জরুরী বিষয়টা ঢুকে গেছে।

“এই কাগজটা দেখুন।” পকেট থেকে একটা কাগজ বের করলো ডিগবি। তেলতেলে একটা কাগজ। এ ধরনের কাগজ আগেও দেখেছে হার্মিয়া। তার ধারনা এতে শত্রু পক্ষের রেডিও সিগন্যাল ডিক্রিপ্ট অবস্থায় আছে।
ডিগবি বললো, “এই কাগজ কতোটা গোপন তা নিশ্চয়ই আপনাকে বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই।”
“নাহ, নেই।”
“আপনি ডেনিশ ভাষার সাথে জার্মান ভাষাটাও পারেন নিশ্চয়ই।”
নড করলো হার্মিয়া। “ডেনমার্কে সব স্কুলে বাচ্চাদের ইংরেজী, জার্মান এবং ল্যাটিন শেখানো হয়। ” ডিগবির হাত থেকে কাগজ নিয়ে একবার পড়ে নিলো হার্মিয়া।
“ইনফরমেশন ফ্রম ফ্রেয়া? ”
“এই বিষয়টা নিয়েই আমরা বিভ্রান্তিতে পড়ে গেছি। শব্দটা জার্মান না। আমার ধারনা শব্দটা স্ক্যান্ডিনেভিয়ান কোন ভাষা থেকে এসেছে। ”
“ঠিকই ধরেছেন। ফ্রেয়া হচ্ছেন নরওয়ের ভাইকিংদের ভালোবাসার দেবী। দেবী ভেনাস ও বলতে পারেন।”
“তা না হয় বুঝলাম। এতে তো কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাচ্ছেনা। ” ডিগবিকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে।
“ঘটনাটা কি বলুনতো? কি নিয়ে এত্তোসব?”
“ইদানিং আমাদের বিমান বাহিনী খুব বেশী বম্বার হারাচ্ছে।”
“খবরের কাগজে, দিন কয়েক আগে একটা খবর পড়েছি। আমরা নাকি ভয়াবহ বিমান হামলা করেছি। হামলা সফলও হয়েছে। কাগজে তাইতো লিখেছে। তাহলে সমস্যা কোথায় ? ”

ডিগবি শুধু তীক্ষ্ণ চোখে হার্মিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো, বললো না কিছুই।

“ও আচ্ছা বুঝেছি। আপনারা কাগজে মিথ্যে বলেছেন।”

ডিগবি এবারও নিশ্চুপ।

“তার মানে ঐ বিমান হামলায় আমরা পুরোপুরি ব্যার্থ হয়েছি।” এবারো ডিগবি চুপ। “ওহ গড, আমাদের কি পরিমান বিমান ধ্বংশ হয়েছে ? কি ব্যাপার, চুপ করে আছেন কেন?”
“ফিফটি পার্সেন্ট।”
“ডিয়ার গড! ” অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো হার্মিয়া। খুব খারাপ লাগছে। নিহত পাইলটদের কারো কারো হয়তো প্রেমিকা ছিলো। পরিবার পরিজন ছিলো। “কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে তো...।”
“ঠিক ধরেছেন।”
হাতের কাগজে আবারো তাকালো হার্মিয়া। “ফ্রেয়া কি কোন স্পাই?”
“সেটা খুঁজে বের করাই হচ্ছে আমার এখনকার কাজ।”
“আমি কি করতে পারি?”
“এই ফ্রেয়া দেবী সম্পর্কে কি জানেন, বলুনতো?”
স্মৃতি হাতড়ানো শুরু করলো হার্মিয়া। নরওয়েজীয় পৌরানিক কাহিনী সেই স্কুলে থাকতে পড়া হয়েছে। অনেক দিন আগের কথা। তারপরেও যতটুকু মনে পড়লো ততটুকুই বললো হার্মিয়া।
“ফ্রেয়া দেবীর একটা স্বর্ণহার আছে। সেই হার খুবই পবিত্র এবং অদ্ভুত ক্ষমতা সম্পন্ন। এই হার দেবীকে দিয়েছিলো চারজন বামন। হার পাহার দেয় স্বর্গের প্রহরী। প্রহরীর নাম খুব সম্ভবত ‘হেইমদাল’।”
“প্রহরী। বোধহয় কিছু একটা পাওয়া যাচ্ছে।”
“ফ্রেয়া হয়তো কোন স্পাই। যে এয়াররেইড সম্পর্কে আগেই তথ্য পেয়ে যায়। ”
“যন্ত্রও হতে পারে। হয়তো এই যন্ত্র দিয়ে দৃষ্টিসীমায় আসার আগেই এয়ারক্রাফট সম্পর্কে সব কিছু জানা যায়। ”
“এ ধরনের যন্ত্রের কথা শুনেছিলাম। কিন্তু কিভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে কোন ধারনা নেই।”
“সম্ভাব্য উপায় হতে পারে তিনটি। ইনফ্রারেড, লিডার (LIDAR) এবং রাডার (RADAR)। ইনফ্রারেড ডিটেক্টর গরম এয়ারক্রাফট ইঞ্জিন থেকে বিকিরিত তাপ সনাক্ত করতে পারে। আর লিডার হচ্ছে অপটিক্যাল পালস নির্ভর একটি প্রযুক্তি। এতে ডিটেকশন এপারেটাস থেকে প্রথমে অপটিক্যাল পালস ছুঁড়ে দেয়া হয়। সেই পালস এয়ারক্রাফটের গা থেকে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসে। প্রতিফলিত পালস সনাক্ত করার আলাদা রিসিভার আছে। রাডারও একই প্রক্রিয়াতে কাজ করে । শুধু এই ক্ষেত্রে অপটিক্যাল পালস এর পরিবর্তে রেডিও পালস ব্যাবহার করা হয়। ”
“আরেকটা কথা মনে পড়লো। হেইমদাল নামের এই প্রহরী দিন হোক, রাত হোক সবসময়ই হাজার মাইল দূরের জিনিস দেখতে পায়। ”
“তাহলে ফ্রেয়া শব্দটি দিয়ে বোধহয় কোন যন্ত্রের কথাই বলা হচ্ছে।”
“আমারও তাই ধারনা।”
ডিগবি চা শেষ করে উঠে দাঁড়ালো। “যদি আপনার আরও কিছু মনে পড়ে, তাহলে কষ্ট করে একটু জানাতে পারবেন? ”
“অবশ্যই। আপনাকে কোথায় পাওয়া যাবে?”
“দশ নম্বর, ডাউনিং ষ্ট্রীট।”
“ওহ ! ” ঠিকানা শুনে একটু অবাক হলো হার্মিয়া।
“গুডবাই।”
“বাই।”

ডিগবির চলে যাওয়া দেখলো হার্মিয়া। লোকটার কথাবার্তা কেমন যেন। ডিগবি অবশ্যই উচ্চপদস্থ একজন। নইলে দশ নম্বর, ডাউনিং ষ্ট্রীটে তার থাকার কথা না। ডিগবির নিজে এসে খোঁজ করা মানে প্রধানমন্ত্রী নিজেও এই বিষয় নিয়ে বেশ চিন্তিত। আচ্ছা, ফ্রেয়া নামটি কি এমনি এমনি ব্যাবহার করা হয়েছে, নাকি স্ক্যান্ডিনেভিয়ান কোন দেশের সাথে এর যোগাযোগ আছে?

টেবিলে আরেকটু সময় বসে উঠে গেলো হার্মিয়া। খাওয়া হলোনা। যেতে যেতে খাবারটুকু পিগ বিনে ফেলে গেলো সে। এরপর সোজা অফিস।

হার্মিয়ার অফিস লাল ইটের তৈরি বিশাল এক ভিক্টোরিয়া বিল্ডিং এর ভেতর। অফিস রুমটা আগে খুব সম্ভবত সার্ভেন্ট কোয়ার্টার ছিলো। উপরের দিকে ছোট্ট একটা জানালা আছে। সেই জানালা দিয়ে আলো তেমন আসেনা। তাই দিনের বেলাতেও বাতি জ্বালিয়ে কাজ করতে হয়। হার্মিয়ার ডেস্কের উপর একটা ফোন আছে। একপাশে একটা টাইপরাইটার। ডেস্কের উপর একটা প্যাকেজ দেখা গেলো। প্যাকেজ এসেছে কোপেনহেগেন থেকে।

হিটলার পোল্যান্ড দখল করার পর হার্মিয়া ডেনমার্কে স্পাইদের একটা ছোট নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। সেই নেটওয়ার্কের নেতা হলো আরনের সহকর্মী এবং বন্ধু পল কির্ক। পল তরুনদের নিয়ে একটা দল তৈরি করেছে। এই দলের সবারই বক্তব্য হচ্ছে তাদের দেশটাকে প্রতিবেশী বিশাল দেশটা দখল করে নিয়েছে। বিশাল প্রতিদ্বন্দীর সাথে সরাসরি লড়াই করা যাবেনা। ব্রিটিশদের সাহায্য করতে হবে। সেটা করলেই দেশ স্বাধীন করার যুদ্ধের কাজ হবে। দলটার নাম পল ঠিক করেছে ‘নাইটওয়াচম্যান’। দলের কেউ স্যাবোটাজ বা মানুষ খুনের মতো সরাসরি সংঘাতে যাবেনা। তারা মিলিটারি ইনফর্মেশন ব্রিটিশদের কাছে পাচার করবে।

দল তৈরীতে পলের পাশাপাশি সবচে বেশী ভূমিকা হার্মিয়ার। একটা মেয়ের পক্ষে একটা গুপ্ত সংগঠন তৈরি করে ফেলা মোটেও সহজ কিছু না। এই কাজের পুরস্কার হিসেবে হার্মিয়াকে ডেনমার্ক ডেস্কের হেড বানিয়ে দেয়া হয়েছে।

প্যাকেজের ভেতর বেশ কিছু রিপোর্ট দেখা যাচ্ছে। রিপোর্ট প্রথমে কোড রুমে ডিক্রিপ্ট করা হয়েছে। তারপর এসেছে হার্মিয়ার হাতে। রিপোর্টে ডেনমার্কে জার্মান মিলিটারির বর্তমান অবস্থান, শক্তি সম্পর্কে ধারনা দেয়া হয়েছে। ফিনের সেন্ট্রাল আইল্যান্ডে আর্মি বেইজ বসেছে, কেটিগাট এলাকায় ন্যাভাল ট্রাফিক সম্পর্কেও ধারনা দেয়া হয়েছে। সুইডেন আর ডেনমার্কের মাঝখান দিয়ে কেটিগাট সাগর বয়ে গেছে।

রিপোর্টে বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় জার্মান অফিসারের নাম দেয়া হয়েছে।
প্যাকেজের ভেতর আরও একটা জিনিস পাওয়া গেলো। সেটা হচ্ছে স্থানীয় একতা আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকা। নাম ‘রিয়েলিটি’। ডেনমার্কেও যে নাৎসীদের বিরুদ্ধে জনমত আছে তা এই পত্রিকা না থাকলে বোঝা যেতোনা। পত্রিকাটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিলো হার্মিয়া।

প্যাকেজ ডেনমার্ক থেকে সুইডেন যাবার পথে MI6 এর এজেন্টের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে নাইটওয়াচম্যান গ্রুপের কেউ।

নাইটওয়াচম্যানের কথা আসতেই আরনের কথা মনে পড়ে গেলো হার্মিয়ার। এই দলের কেউ না আরনে। আসলে আরনের চরিত্রটাই অন্যরকম। সবসময় হৈ চৈ, হাসি তামাশা নিয়ে মেতে থাকা একটা চরিত্র আরনে। এই কারনে আরনে কে হার্মিয়ার পছন্দ হয়েছে। মানুষটার কাছে গেলে হালকা লাগে নিজেকে। এ ধরনের হাসিখুশি মানুষ নাইটওয়াচম্যানের কাজ করতে পারবেনা। অবশ্য এসবের সাহসও আরনের আছে কিনা তা হার্মিয়ার জানা নেই। স্কি করার সময় আরনে মারাত্মক সাহসী। নরওয়ের পাহাড়ে লাফালাফি করা আর স্কি করা এক জিনিস আর আন্ডার কভার অপারেশন অন্য জিনিস।

অনেকদিন মানুষটার সাথে কোন যোগাযোগ নেই। একবার মনে হয়েছিলো নাইটওয়াচম্যানদের মাধ্যমে আরনের কাছে খবর পাঠানো যায়। গ্রুপের স্থানীয় দলনেতা পল, এই পল আবার আরনের সহকর্মী। প্রায় প্রতিদিনই তাদের দেখা হবার কথা। তাই খবর নেয়াটা কোন সমস্যা না। কিন্তু মাঝপথে যদি কোন নাইটওয়াচম্যান এর সদস্য ধরা খায় তাহলে আরনের জীবনেও নেমে আসবে ভয়াবহ দূর্যোগ। তাছাড়া এরকম যুদ্ধকালীন খবরের মাঝে ব্যাক্তিগত একটা কাজ , খুব একটা শোভন দেখায় না। তাই আর ওপথ মাড়ায়নি হার্মিয়া।
প্যাকেজের সমস্ত তথ্য টাইপ করলো সে। বেশি গুরুত্বপূর্ন হচ্ছে মিলিটারি ইনফরমেশন। বাকীগুলো তেমন জরুরী না। রিপোর্ট করতে হবে বসের কাছে। এর কপি অন্যান্য ডিপার্টমেন্টেও পাঠাতে হবে।

ঠিক চারটার সময় অফিস থেকে বের হলো হার্মিয়া। কাজ এখনো বাকি আছে, তাই আবারো অফিসে আসতে হবে। এখন বাড়ি যেতে হবে মায়ের সাথে দেখা করতে। হার্মিয়ার মা মার্গারেট মাউন্ট থাকেন চেলসি তে। স্বামীর মৃত্যুর পর মার্গারেট তার এক পুরোনো বান্ধবী খুঁজে পেয়েছেন। বান্ধবীর নাম এলিজাবেথ। তিনি আবার চিরকুমারী। দুই বান্ধবী মিলে একসাথে থাকেন। একজন আরেকজনকে বলেন ম্যাগস আর বেটস। বাল্যকালের সংক্ষিপ্ত নাম অক্ষয় রয়ে গেছে এই বুড়ো বয়সেও। আজ দুজনেরই ব্লেচলিতে আসবার কথা। তারা হার্মিয়ার থাকার জায়গাটা দেখতে ইচ্ছুক।

অফিস থেকে বেরিয়ে দ্রুত হাঁটা দিলো হার্মিয়া। কাছেই একটা রুমে সে ভাড়া থাকে। বাড়ির কাছে পৌঁছাতেই দেখা গেলো মা আর বেটস বাড়ির মালিকের সাথে গল্প করছেন। মায়ের পরনে এমব্যুলেন্স ড্রাইভারের ইউনিফর্ম, ট্রাউজার-ক্যাপ। বেটসের পরনে শর্ট স্লীভস।

মা আর বেটসকে রুমে নিয়ে গেলো হার্মিয়া। ছোট্ট একটা রুম, তাতে একটা সিঙ্গেল বিছানা পাতা। রুম দেখে বেটসের পছন্দ হলোনা। কিন্তু মা তার স্বভাবসুলভ মমতামাখানো গলায় বললেন, “খারাপ না। যুদ্ধের মধ্যে যথেষ্ট ভালো জায়গা পেয়েছিস।”
“এখানে বেশিক্ষন থাকা হয়না মা।” মিথ্যা কথা বললো হার্মিয়া। একাকী দীর্ঘ সন্ধ্যা, রজনীগুলো তাকে এখানেই কাটাতে হয়।

চা বানানোর জন্যে ষ্টোভ জ্বালালো হার্মিয়া। সাথে কেক। মা আসবেন, এই উপলক্ষ্যে আজ কেক কেনা হয়েছে।

মা বললেন, “আরনের সাথে তোর এখন যোগাযোগ নেই, তাই না ?”
“নাহ। চিঠি দিয়েছিলাম। কোন উত্তর পাইনি। চিঠি পৌঁছেছে কিনা তাও জানিনা।”
বেটস বললো, “আরনের সাথে আমার মাঝে মাঝে দেখা করতে ইচ্ছা হয়। কেমন মানুষটা?”

এই প্রশ্নের কি উত্তর দেয়া যায় তা প্রথমে ভেবে পেলোনা হার্মিয়া। অনেক ভেবে সে বললো, “দেখতে একেবারে সিনেমার নায়কের মতো। শরীর এথলেটদের মতো। আইরিশ পুরুষদের পুরো চার্ম ওর ভেতরে আছে। ওর সাথে থাকাটা খুব সহজ। যাই হোক মানুষটা খালি হাসে। আমার মাঝে মধ্যে রাগ উঠে যেতো। আমি রাগলেও ও খালি হাসে। আর বলে, ‘তোমার মতো মেয়ে আমি জীবনেও দেখিনি।’ মানুষটাকে আমি খুব মিস করি। ” খুব কষ্টে চোখের জল আটকে রাখলো হার্মিয়া।

মা বললেন, “অনেক ছেলেকে তোর প্রেমে পড়তে দেখেছি। কিন্তু তোর সাথে কাউকে একেবারে মিশে যেতে দেখিনি। প্রথম সুযোগেই ওর পা দুটো গেঁথে ফেলতে পারলে তোর জন্যে ভালো হতো।” কথাগুলো মা খুব স্বাভাবিক গলাতেই বললেন।

দ্রুত প্রসংগ বদলালো হার্মিয়া। জানতে চাইলো বোমা হামলার সময় তারা কি করে? জানা গেলো বেটস গিয়ে ঢোকে টেবিলের তলায় আর মা বের হন এমব্যুলেন্স নিয়ে। মায়ের যে এতো সাহস তা যুদ্ধের আগে জানা যায়নি। মা আর বেটস চা খেতে খেতে নিজেদের মধ্যে কথা শুরু করলেন। ডিগবির সাথে হওয়া কথা নিয়ে ভাবা শুরু করলো হার্মিয়া।

যদি ফ্রেয়া সত্যি কোন যন্ত্র হয় এবং জার্মান বাহিনী বর্ডার রক্ষার কাজে তা ব্যাবহার করে থাকে, তবে তার অবস্থান কোথায় হওয়া উচিৎ? ডেনমার্কে হবার কথা। ডেনমার্কে কি খোঁজাখুজি করা সম্ভব? ডিগবির ধারনা এই যন্ত্র থেকে কিছু ছুঁড়ে দেয়া হয়। হয় অপটিক্যাল পালস বা রেডিও সিগন্যাল। নয়তো ইনফ্রারেড প্রযুক্তি। এ ধরনের ক্ষেত্রে পালস প্রক্ষেপনের স্থানটি সনাক্ত করা সম্ভব। নাইটওয়াচম্যানরা কি কিছু করতে পারবে? পারবে হয়তো।

ভাবনাটা মাথায় আসতেই উত্তেজনা বোধ করলো হার্মিয়া। সবার প্রথমে নাইটওয়াচম্যানদের কাছে একটা ম্যাসেজ পাঠাতে হবে। তার জন্যে আরও তথ্য দরকার। আজ রাতেই কাজ শুরু করতে হবে। সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো হার্মিয়া।


(চলবে...)


মন্তব্য

শান্ত [অতিথি] এর ছবি

দাদা, অসাধারন। রোমাঞ্চপূর্ণ। জানি আপলোড করতে কষ্ট হচ্ছে। থ্যাঙ্কস এমন একটা অনুবাদের জন্য।

মানিক চন্দ্র দাস এর ছবি

ধন্যবাদ শান্ত।

তপু [অতিথি] এর ছবি

এই পর্বটা আগের টা থেকে জলদি দেবার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ। অবশ্য আগের পর্বের ঘটনা বেশী আকর্ষণীয় ছিলো। আশা করি পরের পর্ব শীঘ্রই পাবো।

শঙ্কর [অতিথি] এর ছবি

মানিকভাই,

চেহারা ডিম্বাকৃতির নয়। বোধ হয় আপনি, মুখাবয়ব ডিম্বাকৃতির বলতে চেয়েছেন।

খুব ভালো লাগছে। চালিয়ে যান।

মানিক চন্দ্র দাস এর ছবি

শঙ্কর দা,
ঠিকই বলেছেন। আমারই ভুল। কষ্ট করে অনুবাদ পড়ার জন্যে ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন দাদা।
মানিক

দিগন্ত বাহার [অতিথি] এর ছবি

ভালো লাগছে। পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম...

সাইফ তাহসিন এর ছবি

দারুণ আর সাবলীল অনুবাদ! মনেই হয় না অনুবাদ! একেবারে মগ্ন হয়ে পড়ছিলাম, ধুম করে শেষ হয়ে গেল মন খারাপ , অনুবাদে ৫তারা! একটু তাড়াতাড়ি করেন দাদা!

ব্যাবহার না, ব্যবহার হবে। এটা ছাড়া তেমন কিছু চোখে পড়েনি!
=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

মানিক চন্দ্র দাস এর ছবি

সাইফ ভাই,
আপনার কমেন্টের অপেক্ষায় ছিলাম। আরও কয়েকজন আছেন এই তালিকায়, যাদের কমেন্টের অপেক্ষায় থাকি। যেমন পিপি দা, শুভাশীষ দা। দাদারা বোধহয় খুব ব্যস্ত। তাই কমেন্ট পাচ্ছিনা। এবার শুধু আপনিই কমেন্ট করলেন। ধন্যবাদ ভাই কষ্ট করে পড়ার জন্যে। বানান সম্পর্কিত উপদেশের জন্যে ধন্যবাদ। এটা মাথায় থাকবে। এর আগেরটা কিন্তু ঠিক করে ফেলেছি। হেঃ হেঃ হেঃ দোয়া রাখবেন। তারা দেবার জন্যে...(বলার ভাষা নাই।)ভালো থাকবেন।
মানিক

বইখাতা এর ছবি

ভাল লাগছে। চলুক চলুক

মূলত পাঠক এর ছবি

সময়মতো পড়লেও কমেন্ট করা হয় নি, এখন একটু দেরিতেই করছি। অনুবাদ আপনার হাতে চমৎকার এগোচ্ছে, আগেই বলেছি। তবে চল্লিশের দশকে ইউরোপের মেনুতে আলুর দম দেখে একটু ঘাবড়ে গেলাম। হাসি

মানিক চন্দ্র দাস এর ছবি

smashed potato লেখা মূল বইতে। আমার মাথাতে ঐ আলুর দমই এসেছে। তাই আরকি। ভুল হলে ক্ষমা চাচ্ছি ভাই। ভালো থাকবেন।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।