কাক [শেষ কিস্তি ]

মানিক চন্দ্র দাস এর ছবি
লিখেছেন মানিক চন্দ্র দাস [অতিথি] (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৩/১২/২০১০ - ৪:০৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

[প্রথম কিস্তি]

[দ্বিতীয় কিস্তি]

[তৃতীয় কিস্তি]

[চতুর্থ কিস্তি]

[পঞ্চম কিস্তি]

[ষষ্ঠ কিস্তি]

[সপ্তম কিস্তি]

[অষ্টম কিস্তি]

২৯

বাড়িতে ফিরে নিশিতবাবু একটা নতুন কেইস ফাইল ওপেন করলেন। কাজটা তিনি করছেন দীর্ঘদিন পর। ফাইলে তিনি যা লিখলেন তা হলোঃ
নামঃ আব্দুর রহমান
পেশাঃ চাকুরী (বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, পেশাগত দিক থেকে তিনি একজন সফল মানুষ)
শারিরিক গঠনঃ স্বাস্থ্যবান
বয়সঃ ৪৫(আনুমানিক)
অর্থনৈতিক অবস্থানঃ উচ্চবিত্ত
বৈবাহিক অবস্থাঃ বিবাহিত
সমস্যা (স্ত্রীর ভাষ্যনুযায়ী)

আব্দুর রহমান সাহেবের ধারনা তিনি পাপের শাস্তি পাচ্ছেন। পাপ হচ্ছে তিনি একটি কাক মেরেছেন। সেই কাকের মৃত্যুর কারনে তার পরিবার নিশ্চিনহ হয়ে গেছে(?)। তাই তার শাস্তি হচ্ছে। শাস্তিদাতা কাক। শাস্তিদাতা একটি কাক নয় পুরো কাকগোষ্ঠী।

রহমান সাহেবের বক্তব্য হচ্ছে প্রতিটি কাকের স্বতন্ত্র চেতনা আছে। সেই চেতনা তারা প্রয়োজনে একজন আরেকজনের সাথে যুক্ত করে দিতে পারে। সংযুক্ত চেতনার ক্ষমতা অসাধারন। কাকসংখ্যা যত বেশী হবে চেতনার শক্তি হবে তত বেশী। সংযুক্ত চেতনা মানুষের চেতনার উপর দখল নিতে পারে। কাকদের চেতনা এখন প্রায়ই রহমান সাহেবের চেতনা দখল করে নিচ্ছে। তবে চেতনা দখল পর্যন্তই কাকদের শাস্তি সীমাবদ্ধ থাকবে কিনা তা জানেন না রহমান সাহেব।

• কাকেরা রহমান সাহেবের সাথে কথা বলে।
• মানুষের বোকামিতে তারা হাসাহাসি করে।
• কাক তার অফিসের সমস্যা সমাধান করেছে।

অতীব জরুরি

1. রহমান সাহেবের রুমে মাংস পঁচা গন্ধ ছিলো। কারন কি? কুমকুমের ভাষ্য মতে সে রুমে মরা ইঁদুর দেখেছে। একটা ইঁদুরে এত দুর্গন্ধ হবার কথা না। দুর্গন্ধের কারন কি?

2. মেঝেতে বড় বড় পালক ছিল। এই পালক কিসের? কাকের? পালক আমি সাথে করে নিয়ে এসেছি। কাকের পালক রহমান সাহেবের রুমে আসলো কোত্থেকে?

3. রহমান সাহেব বলেছেন কুকুরের মৃত্যুর জন্য দায়ী কাক। (তারা দুটো কুকুর পুষতেন। নাম রণ্টি-মণ্টি। জাত হচ্ছে অ্যালসেসিয়ান)এর কারন কি? কুকুর দুটোর ভাক্সিন দেয়া ছিল। তারপরে ও তারা কিসে মারা গেল? এদের ডেড বডি কি পাওয়া সম্ভব? বোধহয় সম্ভব না। পাওয়া গেলে পোস্টমর্টেম করানো যেত। কুকুরের ঘরটা দেখতে হবে।

4. বাড়ির চারপাশে কি কাকদের অনেক বাসা আছে? খুঁজে দেখতে হবে। কুমকুম বলেছে সে নিজে কারেণ্টের তারে শতশত কাক বসে থাকতে দেখেছে। বিষয়টাতে কি অস্বাভাবিক কিছু আছে? থাকার কথা না। কাক কারেণ্টের তারে বসে থাকতেই পারে। বাড়ীর চারপাশ ঘুরে দেখতে হবে।

5. শেইভ করতে গিয়ে মানুষের গাল এতোটা কাটে কি করে? সেলাই পর্যন্ত যেতে হয়েছে সেই কাটা সামলাতে। গাল কাটার কারন কি?

6. রহমান সাহেব আগে ডাক্তারের চিকিৎসাধিন ছিলেন। সেই চিকিৎসা কি বিষয়ক? নার্ভ সম্পর্কিত কিছু?(অতীব জরুরি)

7. বর্তমান সমস্যার আগে রহমান সাহেব অফিসের কোন একটি বিষয় নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। সেই সমস্যার সমাধান কাক দিয়েছে। (?) সমাধানের রাস্তাটি কি ছিলো?

8. কুমকুমকে রহমান সাহেবের অফিস সম্পর্কিত কথার ক্ষেত্রে অনীহা প্রকাশ করতে দেখা গেছে। অনীহার কারন কি?

9. কুমকুম ও রহমান সাহেব, দুজনেই শ্যামলা। তাদের বাচ্চারা বেশ ফর্সা (ফ্যামিলি ফটোগ্রাফ তাই বলে)। বাচ্চাদুটোর চেহারার সাথে বাবা-মায়ের চেহারার বিন্দুমাত্র মিল নেই। কারন কি? এমনটা তো হবার কথা না। এতে কি কোন রহস্য আছে, নাকি পুরো বিষয়টি প্রকৃতির খেয়াল?

10. কুমকুম আমার নাম রহমান সাহেবকে বলেনি। আমার নাম রহমান সাহেব কি করে জানলেন? আমার ছেলেবেলার কাক পোষার ঘটনা তিনি কি করে জানলেন? আমার অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাও এই ঘটনা জানেনা। আমি নিজেই প্রায় ভুলে গিয়েছিলাম। এটা কি কোন রহস্য নাকি ব্যাখ্যা আছে? ব্যাখ্যা থাকার কথা।

৩০

রাত এগারোটার দিকে রহমান সাহেবের রুম থেকে ডাক এলো।
“কুমকুম...। দরজা বাইরে থেকে বন্ধ কেন? কুমকুম...এই কুমকুম।”
কুমকুম তার মা আর ছোট ভাই এর সাথে ড্রইংরুমে বসেছিলো। সমস্যা নিয়ে তারা কথা বলছিলো। এই সমস্যায় শুধু নিশিতবাবুর উপরেই ভরসা করা ঠিক হবে কিনা, এই হচ্ছে আলোচনার বিষয়বস্তু।
কুমকুম দৌড়ে গিয়ে দরজা খুললো। রহমান সাহেব পুরোপুরি স্বাভাবিক।
“কি ব্যাপার? দরজা বন্ধ কেন?”
“আমরা কথা বলছিলাম, কথায় যেন তোমার ঘুমে কোন সমস্যা না হয়, এইজন্য দরজা বন্ধ করে রেখেছিলাম।”
“কি যে বলনা! কথায় আবার ঘুমে কি সমস্যা? যত্তোসব আজেবাজে কথা। কেমন আছেন আম্মা? কখন এলেন?”
“এইতো বাবা আছি। ভালো আছি। তুমি কেমন?”
“জ্বী আম্মা ভালো আছি। তো শালাবাবু, কি খবর?”
“ভালো ভাইয়া।”

কুমকুম দূরে দাঁড়িয়ে কথাবার্তা শুনলো। একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো নিজের অজান্তেই। কে বলবে এই মানুষটি দুপুরেই কি অদ্ভুত কাজ কারবার করেছে? রাতের খাবার সবাই একসাথেই খেলো। খাবারের আয়োজন খুবই সামান্য। কুমকুম রান্না করার সময় পায়নি। এই মুহুর্তে রহমান সাহেবের আচরনে কোন অস্বাভাবিকতা নেই। রাতেও তিনি ঘুমুতে গেলেন স্বাভাবিক মানুষের মতোই। রাতে কুমকুমের মা থেকে গেলেন। কুমকুম মায়ের সাথে ঘুমুতে গেলো। আজকের রাতটা মায়ের সাথে ঘুমুতে ইচ্ছে করছে নাকি তার ভয় লাগছে তা অবশ্য বোঝা গেলোনা।

রাতে রহমান সাহেবের স্বপ্নে আবারো কাক দেখা দিলো।

“কেমন আছেন রহমান সাহেব?”

“কেমন আছি, বুঝতে পারছিনা।“

“আপনার যে শাস্তি চলছে, তা আপনি বুঝতে পারছেন?”

“আচ্ছা আমাকে কেন আপনারা শাস্তি দিচ্ছেন? শাস্তি পাবার মতো ভয়াবহ কিছুতো আমি করিনি।“

“করেছেন, অবশ্যই করেছেন। আপনার শাস্তি আরো বাকি আছে। সবে তো শুরু। এতো অস্থির হচ্ছেন কেন?”

“আপনারা অযথা শাস্তি দেবেন আর আমি অস্থির হবোনা?”

“না হবেন না। আপনার প্রাপ্য শাস্তি আপনি পাচ্ছেন অস্থিরতার কি আছে?”

“এরপর আর কি শাস্তি দেবেন?”

“আবারো অস্থির হচ্ছেন। সে যাকগে, সময় হলেই দেখবেন কি শাস্তি দেয়া হবে। সময় হোক। আপনার আসল সমস্যা কোথায় জানেন রহমান সাহেব?”

‘না জানিনা। বলে কৃতার্থ করুন।“

“সমস্যা আপনার দৃষ্টিভঙ্গীতে। আপনার চোখদুটো পাশাপাশি না রেখে ধরুন কপালের দুপাশে নিয়ে গেলে কেমন হয়?”

“দৃষ্টিভঙ্গী কি চোখে থাকে? চোখ দুপাশে নিয়ে কি হবে? বিষয়টা মানসিকতার ব্যাপার, চোখের অবস্থানে না।“

“চোখজোড়া দুপাশে নিলে হয়তো আপনার মানসিকতা বদলাতেও পারে। কে জানে! আসুন আপনার চোখগুলো দুপাশে নিয়ে যাই।“

কাকটা এতোক্ষন রহমান সাহেবের সামনে বসা ছিলো। চোখ দুপাশে নেবার কথা বলে সে নির্বিকারভাবে জায়গা ছেড়ে উঠে এলো। রহমান সাহেব এতোক্ষনে খেয়াল করলেন তার হাত পা চেয়ারের সাথে শক্ত করে বাঁধা। অজানা আশংকায় রহমান সাহেব কেঁপে উঠলেন। সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন হাত-পায়ের বাঁধন ছোটাতে। পারছেন না। কাকটা এসে রহমান সাহেবের চোখের চারপাশে খোঁচাতে শুরু করলো। চোখের পুরোটা সে কোটর থেকে বের করে নেবে। রহমান সাহেব চেষ্টা করছেন বাঁধন ছিঁড়তে, কিছুতেই কিছু হচ্ছেনা। কাকটাও খুব মনোযোগ দিয়ে চঞ্চু দিয়ে খুঁচিয়ে চলেছে। রহমান সাহেব এখন শুধু ব্যাথা অনুভব করছেন। তার সমস্ত অনুভূতি কেন্দ্রীভুত হলো চোখের চারপাশে। ব্যাথা...এই ব্যাথা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে হিলহিলে সর্পিল গতিতে।

ব্যাথায় রহমান সাহেবের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। চোখে অসম্ভব ব্যাথা। চিৎকার করে তিনি কুমকুমকে ডাকলেন। রাতে কুমকুমের চোখে ঘুম ছিলোনা। এক চিৎকার শুনেই সে দৌড়ে এলো বেডরুমে। বাতি জ্বালিয়ে কুমকুম হতভম্ব হয়ে গেলো । রহমান সাহেবের চেহারা রক্তে মাখামাখি। মুখের ব্যান্ডেজ জায়গা মতোই আছে। রক্ত কি ওখান থেকে বেরিয়েছে? ভালো করে খেয়াল করে কুমকুমের বিস্ময়ের পরিমান বাড়লো। রহমান সাহেবের চোখ ফুলে ঢোল। চোখের চারপাশ থেকে রক্ত বেরুচ্ছে। এখান থেকে কেন রক্ত বেরুবে? এসব কি হচ্ছে? সে রাতেই রহমান সাহেবকে আবারো ক্লিনিকে ভর্তি করা হলো।

৩১

রহমান সাহেবের ক্লিনিকে ভর্তি হবার খবর নিশিতবাবু পেলেন অনেক পরে। রাতে তাকে খবর দেয়া হয়নি। সারাদিন তিনি ছিলেন বাড়ির বাইরে। বিকেলে তার রহমান সাহেবের বাড়িতে যাবার কথা। সারাদিন নিশিতবাবু কাটিয়েছেন রহমান সাহেবের অফিসে। রহমান সাহেবের অফিসে ঢুকে নিশিতবাবুর কথা হলো পিয়ন সুলতানের সাথে, কালাম সাহেব এবং জহির সাহেবের সাথে।
জহির সাহেবের সাথে যে কথাবার্তা হলো তা মোটামুটি এইরকমঃ
“জহির সাহেব কেমন আছেন?”

“জ্বী, ভালো আছি। আপনাকে ঠিক চিনতে পারলামনা।“

“আমার নাম নিশিত কান্তি দে। রহমান সাহেব...”

“স্যার অফিসে আসেননি আজ।“

“জানি। আমি আপনার সাথে কথা বলতে এসেছি।“

“বলুন, কি বলবেন।“

“আমার কয়েকটি প্রশ্ন ছিলো। আপনার শুধু প্রশ্ন গুলোর উত্তর দিলেই চলবে।“

“আপনি কে বলুনতো? আপনার পরিচয় কি?”

“আমার না নিশিত কান্তি দে। আমি ক্লিনিক্যাল সাইকিয়াট্রির একজন প্রফেসর এবং আপনার স্যারের শুভাকাঙ্খী। প্রশ্ন গুলোর উত্তর আমার জানা দরকার। আপনার কোন ক্ষতি হবেনা, নিশ্চয়তা দিচ্ছি।“

“স্যার কি অসুস্থ?”

“নাতো। তিনি সুস্থ্যই আছেন।“

“আচ্ছা। আপনার প্রশ্ন করুন।“

“আপনার স্যারের কি ইদানিং কোন সমস্যা হচ্ছিলো?”

“কি ধরনের সমস্যা?”

‘তার আচরনে কোন পরিবর্তন কিংবা সমস্যা?”

“দেখুন, আমি স্যারের পিএ। স্যারের কাজটাজ, এপয়েন্টমেন্ট এইসব ঠিকঠাক রাখা আমার দায়িত্ব। এর বাইরে কিছু দেখ আমার দায়িত্বের এখতিয়ারে পড়েনা।“

“তা অবশ্য ঠিক। তারপরেও আপনার স্যারের আচরনে কি পরিবর্তন খেয়াল করেছিলেন?”

“নাহ, ঠিক খেয়াল করিনি।“

“একটা ফাইল নিয়ে সমস্যা চলছিলো...”

“দেখুন, এটা অফিসের ভেতরের বিষয়। এটা নিয়ে আমি কোন কথা বলতে চাচ্ছিনা।“

“সমস্যার সমাধান কি করে হলো তা জানেন?”

“আমি জানিনা। “

“হুমম। ইদানিং আপনার স্যারের সাথে কাক বিষয়ে কোন কথা হয়েছে?”
“কি বিষয়ে?”

“কাক। এই যেমন ধরুন, কাক কি খায়, কাক কেমন ধরনের পাখি, এইসব আরকি।“

“আপনি কি ফাজলেমি করছেন? স্যার আমার সাথে কাক নিয়ে কেন কথা বলবেন?”

“তা ঠিকই বলেছেন। কিন্তু তারপরেও একটু ভেবে দেখুন। কাক বা অন্য কোন পাখি নিয়ে কথা হয়েছে?”

“নাহ, পাখপাখালি নিয়ে কোন কথা হয়নি। তবে স্যার মোটা মোটা ফাইলের জন্য নতুন ধরনের কিছু ইন্ডিকেটর চেয়েছিলেন। তার জন্যে আমি কাকের পালক নিয়ে গিয়েছিলাম। স্যার প্রথমে রাখলেন তারপর সব ফেলে দিতে বললেন।“

“কিসের পালক? কাকের?”

“জ্বী, কাকের পালক।“

“ঘটনাটা একটু বলবেন?”

এরপর জহির সাহেব পুরো ঘটনা খুলে বললেন। নিশিতবাবু পুরোটা মনোযোগ দিয়ে শোনার পর বললেন, “আচ্ছা ফাইলের সমস্যা কিভাবে সমাধান হলো?”

“নিশিতবাবু, আপনি বরং এই বিষয়টা নিয়ে আমাদের হেড একাউন্টেন্ট সাহেবের সাথে কথা বলুন। এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারবোনা। দুঃখিত।“

এরপর নিশিতবাবু হেড একাউন্টেন্ট কালাম সাহেবের সাথে কথা বলতে গেলেন।

“আচ্ছা, কালাম সাহেব, আপনাদের অফিসে ফাইলের একটা সমস্যা হয়েছিলো। সমস্যাটা কোথায় ছিলো?”

“এই খবর আপনাকে কে দিলো? জহির?”

“জ্বী না। জহির সাহেব আমাকে কিছুই বলেনি।মনে হচ্ছে ভদ্রলোক খুব ফেইথফুল ধরনের মানুষ। আপনাদের স ষ্টাফই কি ফেইথফুল এইরকম? সবাই ফেইথফুল?”

“নিশিতবাবু, হাতের পাঁচ আঙ্গুল কি সমান? সবাই কি একইরকম হয়? হয়না।“

“আপনাদের অফিসে হাতের সেই ছোট আঙ্গুলটি কে? আপনি কি তাকে চেনেন?”

“চিনি। সামাদ সাহেব। তার জন্যেই যতো সমস্যা। ফাইলে ঝামেলা তিনিই পাকিয়েছিলেন।“

“কি সমস্যা?”

“সেটা স্যার জানেন। আপনাকে বলবোনা। সামাদ সাহেব যে এইধরনের মানুষ তা কোনদিন বুঝতেও পারিনি। এতো ভালো একটা মানুষ যে কেন এইরকম কাজ করলেন, কে জানে!”

“কি কাজ একটু বললে ভালো হতো।“

“দুঃখিত। আমি বলতে পারবোনা।“

“আচ্ছা কি ঘটনা বলুন তো? আপনারা কেউ মুখ খুলছেন না কেন? আমি পুলিশের লোক হলে মুখ খুলতেন না?”

“আপনিতো পুলিশের লোক না।“

“এজন্যেই তো আপনাদের মন খুলে কথা বলা উচিৎ। আপনাদের কোন কথাই পরে কোন ঝামেলা পাকাবেনা।“

“নিশিতবাবু, আপনি সামাদ সাহেবের সাথে কথা বলুন। পুরো ঘটনা তার হাত দিয়ে ঘটেছে। তার কাছেই সব শুনে নেবে। অফিসের আইন আমি ভাঙ্গতে পারবোনা।“

“সামাদ সাহেব কোথায়? কোন রুমে বসেন?”

‘উনি পুলিশের কাছে। ফাইলের কারনে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।“

“আচ্ছা,আচ্ছা।“

অফিস থেকে বেরিয়ে নিশিতবাবুর মনে হলো সামাদ সাহেবের সাথে অবশ্যই কথা বলতে হবে। তার মনে হচ্ছে রহমান সাহেবের সমস্যার কিছু সূতো সামাদ সাহেবের হাতে।

সামাদ সাহেবের সস্থে কথা বলার জন্যে নিশিতবাবুকে যথেষ্ট ঝামেলা পোহাতে হলো। শেষমেষ সামাদ সাহেবের সাথে দেখা হলো, কথাও হলো। তাদের মধ্যে যে কথাবার্তা হলো তা মোটামুটি এরকমঃ

“কেমন আছেন সামাদ সাহেব?”

“ভালো আছি। কে আপনি?”

“আমি নিশিত কান্তি দে। সাইকিয়াট্রিষ্ট।“

“আমার মাথায় কোন সমস্যা নেই। এখানে এসেছেন কেন? কে পাঠিয়েছে
আপনাকে? রহমান সাহেব?”

“নাহ। রহমান সাহেব পাঠাননি। আমি নিজেই এসেছি। তবে কারনটা রহমান সাহেব সংশ্লিষ্ট।“

“কি কারন বলুন?”

“রহমান সাহেবের ইদানিং কিছু সমস্যা হচ্ছে।“

“আপনাকে কুমকুম পাঠিয়েছে। ঠিক না?”

“না, কুমকুম পাঠায়নি। আপনি রহমান সাহেবের স্ত্রীকে চেনেন?”

সামাদ সাহেব চুপ করে রইলেন। তিনি সোজা নিশিতবাবুর দিকে তাকিয়ে রইলেন। নিচের ঠোঁট তিরতির করে কাঁপছে।

নিশিতবাবু বললেন, “রহমান সাহেবের স্ত্রীর নাম নার্গিস আক্তার। ডাক নাম কুমকুম, আপনি ডাক নামটি বলেছেন। আপনার সাথে কি কুমকুমের পরিচয় আছে?”

সামাদ সাহেব প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। তার বদলে তিনি বললেন, “রহমান সাহেবের কি হয়েছে নিশিতবাবু?”

“তার একটু মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। বিষয়টা নিয়ে কুমকুম খুবই চিন্তিত।“

সামাদ সাহেব এখনো নিশিতবাবুর দিকে তাকিয়ে আছেন। তার চোখদুটো এখন জ্বলছে। তিনি বললেন, “কুমকুম কেমন আছে নিশিতবাবু?”

“ভালো না অবশ্যই। স্বামী অসুস্থ্য থাকলে কি স্ত্রী আলাদা করে ভালো থাকে? থাকার কথা না।“

স্লেষের গলায় সামাদ সাহেব বললেন, “রহমান সাহেব কবে সুস্থ্য ছিলেন নিশিতবাবু? কুমকুমই বা কবে ভালো ছিলো?”

“সামাদ সাহেব, এগুলো কি বলছেন?”

“ঠিকই বলছি। হ্যাঁ, কুমকুমকে আমি চিনি। ওর সাথে আমার একসময় একটা সম্পর্ক ছিলো।“

এরপর সামাদ সাহেবের বক্তব্যে নিশিতবাবু ধাক্কার মতো খেলেন। তার সাথে দীর্ঘ সময় কথা হলো। কুমকুমের সাথে এখন আর আলাদা করে কথা বলার প্রয়োজন নেই। রহমান সাহেবের সমস্যা এখন নিশিতবাবুর কাছে পরিস্কার হতে শুরু করেছে। নিশিতবাবু নিজের মনেই রহমান সাহেবের সমস্যার সমাধান সাজানো শুরু করলেন। সামাদ সাহেবের সাথে কথা বলার পর তিনি গেলেন রহমান সাহেবের বাড়িতে। তার আগে তিনি বাড়ির চারপাশে রাস্তায় ঘুরলেন। তারপর ঢুকলেন বাড়িতে।

বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথে সোবহান রহমান সাহেবের খবর জানালো। তাতে নিশিতবাবু একটু অবাক। তারপরেও তিনি বাড়ির ভেতর ঘোরাঘুরি করলেন। কুকুরদের ঘরও একবার দেখতে হলো। বাড়ি ফাঁকা। কুমকুম রহমান সাহেবের সাথে ক্লিনিকে আছে। নিশিতবাবু এবার ক্লিনিকের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন। একদিনে অনেক ঘোরাঘুরি হয়েছে। শরীর ক্লান্ত লাগছে। তারপরেও ক্লিনিকে যেতে হবে। একদিনে রহমান সাহেবের কি এমন হলো যে একেবারে ক্লিনিকে ভর্তি করতে হয়েছে?

ক্লিনিকে ঢুকতেই কুমকুমের সাথে দেখা হলো। সে ক্লিনিকের নিচে রিসেপসন থেকে কোথায় যেন ফোন করছে।

“চাচা, আপনি সারাদিন কোথায় ছিলেন? আমি যে কতবার আপনাকে ফোন দিয়েছি, খোদা মালুম। ফোন বেজেছে ঠিকই, কেউ ধরেনা।“

“সারাদিন বাইরে ছিলাম গো মা। বাড়িতে কেউ নেই। ফোন কে ধরবে?”
“আপনি খবর পেলেন কোথায় চাচা?”

“তোমাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। সোবহান খবর দিলো। রোগীর কি অবস্থা?”

“এখন ঘুমুচ্ছে মড়ার মতো।“

“এরপর কুমকুম নিশিতবাবুকে পুরো ঘটনা খুলে বললো।“

সব শুনে নিশিতবাবুর ভ্রু কুঁচকে গেলো। তিনি বললেন, “চোখের বিষয়ে তোমাকে কিছু বলেছে?”

“বলেছে চাচা। কাক নাকি ওর চোখ উঠিয়ে মাথার দুপাশে বসাতে চেয়েছে।“
“আশ্চর্য্য তো! ওকে এখন দেখা যাবে? ক্লিনিকে এখন ভিজিটিং আওয়ার চলছে না?”

“তা যাবে। কিন্তু ডাক্তার বলেছেন ঘুম ভাঙ্গানো যাবেনা। জেগে থাকলেই খালি উলটো পালটা কথা বলে। ওকে ঘুমের ঔষধ দেয়া হয়েছে।“

“ঘুম ভাঙ্গাবোনা। শুধু চোখের অবস্থাটা দেখবো।“

নিশিতবাবু দীর্ঘসময় রহমান সাহেবের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। চোখের চারপাশে কিছু একটা দিয়ে খোঁচানো হয়েছে। ছোট ছোট কাটা দাগ দেখা যাচ্ছে। দাগগুলো অর্ধচন্দ্রাকৃতির। নখের দাগ কি? রহমান সাহেবের হাতের নখ দেখলেন নিশিতবাবু। রহমান সাহেবের ডান হাতের কনিষ্ঠার নখ বড়। বাকী নখগুলো বেশ সুন্দর গোল করে কাটা। শুধু একটা নখই বড়। বেশ বড়। বঝা যাচ্ছে এই নখ বেশ আয়োজন করে রাখা। বাকী নখগুলোর চেয়ে এই নখ চকচকে। একটা নখ বড় রাখার কোন যুক্তি খুঁজে পেলেন না নিশিতবাবু। সাধারনত টেইলরদের ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুলের নখ বড় রাখার অভ্যাস থাকে। এটা তাদের কাজের সময় কাজে লাগে। কিশোরেরাও মাঝে মাঝে নখ বড় রাখে। যেসব কিশোরের চরিত্রে মেয়েলি ভাব প্রবল, তাদের ক্ষেত্রে এই অভ্যাস বেশী দেখা যায়। বিহারীদের মধ্যেও এই অভ্যাস আছে। রহমান সাহেব এর কোনটার মাঝেই পড়েন না। তার এই নখ বড় রাখার অভ্যাস কেন? কারন যাই হোক, রহমান সাহেবের চোখের ঘটনার একটা ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে। সবশেষে নিশিতবাবু কেবিন থেকে চুপচাপ বেরিয়ে এলেন।

তিনি কুমকুমকে বললেন, “আচ্ছা কুমকুম, রহমান সাহেবের হাতের একটা নখ বড়। তুমি কি কখনো খেয়াল করেছো?”

“জ্বি চাচা দেখেছি। ওটা দিয়ে ও নাকি স্টেপলারের পিন খোলে। কোন মানে হয় বলুনতো? পিন খোলার জন্যে কিছু না থাকলে একটা কথা ছিলো।“

নিশিতবাবু শুধু মাথা নাড়লেন, তারপর বললেন, “আজ তাহলে যাই মা। আমি কাল তোমার স্বামীর সাথে কথা বলবো। দেখি কি করা যায়।“

“ঠিক আছে চাচা।“

নিশিতবাবু ক্লিনিক থেকে বেরিয়ে এলেন। রহমান সাহেবের মতো একজন মানুষ হাতের একটি নখ আয়োজন করে রেখেছেন স্টেপলারের পিন খোলার জন্যে। মানুষের যে কত বিচিত্র খেয়াল থাকে!

৩২

বাড়ি ফিরে নিশিতবাবু রহমান সাহেবের ফাইল খুলে বসলেন। যেখানে তার খটকা ছিলো সেখানে তিনি ব্যাখ্যা লেখা শুরু করলেন।
১। রহমান সাহেবের বাড়ির দুইদিকে বড় বড় ডাষ্টবিন আছে। একটা তার বেডরুমের জানালার উল্টোদিকের রাস্তার পাশে। সেই ডাষ্টবিন নিয়মিত পরিস্কার করা হয়না। তবে পরিস্কার করা হয়। ডাষ্টবিনের পাশে রাস্তা। রাস্তার ওপাশে একটা চায়ের দোকান আছে। চায়ের দোকানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে গত পরশুদিন সকালে অনেকদিন পর ডাষ্টবিন পরিস্কার করা হয়েছে। খুব সম্ভবত ডাষ্টবিনের গন্ধই বাতাসে ভেসে রহমান সাহেবের বেডরুমে গেছে। বেডরুমের জানালা খোলা ছিল। (মড়া ইঁদুর এই ডাষ্টবিন থেকে আসতে পারতো। সেক্ষেত্রে রহমান সাহেবকে নিচে নামতে হতো। তা তিনি নামেননি। নামলেও মড়া ইঁদুর তার কামড়ে নিয়ে বেডরুমের ভেতর নিয়ে যাবার কোন কারন দেখিনা। )

২। জহির নামের ভদ্রলোক রহমান সাহেবের অফিসে কাজ করেন। তাকে রহমান সাহেব ফাইলের ইন্ডিকেটর হিসেবে নতুন ধরনের কিছু আনতে বলেছিলেন। জহির সাহেব এনেছিলেন কাকের পালক (কারন কি জানিনা। জানার খুব বেশী প্রয়োজন ও দেখছিনা।)। সেই পালক ফেলেও দেয়া হয়েছিল। সেখান থেকেই দুটো পালক রহমান সাহেব নিজের অজান্তেই বাসায় নিয়ে এসেছিলেন। কাজটা করেছিলো তার অবচেতন মন। সেই আনা পালকই রহমান সাহেবের রুমের ভেতর পাওয়া গেছে। কিন্তু পালকের পাশে যে রক্তের ফোঁটা পাওয়া গেছে তা কিসের? রহমান সাহেবের ব্যান্ডেজ অক্ষত ছিলো। তাহলে রক্ত কি ইঁদুরের? কুমকুমের ইঁদুর দেখার ঘটনা তাহলে কি সত্যি? সত্যি হতেও পারে। কারন বাড়ির লনে আমি প্রচুর ইঁদুরের গর্ত দেখেছি। সেখানকার ইঁদুর কি তাহলে দোতলার উপরে উঠে এসেছিলো? উঠে আসা অস্বাভাবিক কোন বিষয় না। তাহলেই ইঁদুর কাহিনীর ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।

৩। কুকুরের মৃত্যুর কারন খুব সম্ভবত র‌্যাবিস। রোগটা কুকুর কিংবা শেয়ালের শরীরে আসে ইঁদুরের কামড় থেকে। রহমান সাহেবের বাড়ির লনে প্রচুর ইঁদুরের গর্ত দেখেছি। ইঁদুরের কামড়ে কুকুরদের শরীরে র‌্যাবিস হয়েছিলো। অবশ্য কুকুরদুটোকে ভ্যাক্সিন দেয়া ছিলো। তাতে কিছু যায় আসেনা। ভ্যাক্সিন এর ফেইলিউর রেট আছে। এই কুকুর গুলোতে ভ্যাক্সিন কাজ করেনি।

৪। বাড়ির দুপাশে ডাষ্টবিন। তাই আশেপাশে কাকের সংখ্যা বেশী হওয়া খুব স্বাভাবিক। তবে আশেপাশে গাছের সংখ্যা খুবই কম। তাই কাকের বাসা খুঁজে পাওয়া যায়নি।

৫। রহমান সাহেব একসময় হাতের ধমনী কেটে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। তখন তিনি ব্যাবহার করেছিলেন ক্ষুর। ক্ষুরের জায়গায় সাধারন ব্লেড ব্যাবহার করলেই চলতো। ক্ষুর ব্যাবহার করে তিনি খুব সম্ভবত পুরো ঘটনাটিকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করেছিলেন। পরে এই ক্ষুরটি তার কাছেই থেকে যায়। যারা একবার আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে তাদের একটা অংশ আত্মহত্যার চেষ্টায় ব্যাবহার করা জিনিষটি নিজের কাছে রেখে দেয়। পরে যদি আবারো প্রয়োজন হয়, এই ভেবে তারা রাখে। রহমান সাহেবও রেখেছেন। ক্ষুর ব্যাবহার না করলে ভোতা হয়ে যায়। তাই তিনি ক্ষুর ব্যাবহার করতেন শেইভের জন্যে। এর জন্যেই গাল বেশী কেটেছে।

৬। রহমান সাহেবের মেডিকেল ফাইল দেখার প্রয়োজন নেই। কারন সমস্যার বিষয় কি ছিলো তা সামাদ সাহেবের কাছ থেকেই জানা গেছে।

৭। ফাইল সমস্যার সমাধান করেছে রহমান সাহেবের অবচেতন মন। মানুষ যখন একটা বিষয় নিয়ে খুব বেশী ভাবে তখন তাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসে অবচেতন মন। অবচেতন মনের কি ক্ষমতা আছে তা আমরা এখনো জানিনা। যাই হোক কাক টাক সব ফালতু কথা।

৮। কুমকুমের রহমান সাহেবের অফিস সম্পর্কিত সমস্ত অনীহার মূল কারন সামাদ সাহেব।

৯। রহমান সাহেবের বাচ্চা দুটো দত্তক সন্তান।

১০। রহমান সাহেব এক্সটেনশন লাইন দিয়ে আমার নাম জেনেছেন। বিষয়টাতে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছিনা।

কিন্তু আমার ছোটবেলার ঘটনা সে কি করে জানলো? তিনি কি থট রিডিং পারেন। সাইকিক ডিজঅর্ডার রোগীদের কখনো কখনো ব্যাখ্যাতীত কিছু ক্ষমতা দেখা যায়। রহমান সাহেবেরও কি তাই হয়েছে?

এরপর নিশিতবাবু দীর্ঘ এক ব্যাখ্যা লিখলেন। রোগী এবং রোগ সম্পর্কিত ব্যাখ্যা। এই ব্যাখ্যাটাই রহমান সাহেবকে বোঝাতে হবে।

৩৩

পরদিন সকালে নিশিতবাবু রহমান সাহেবকে দেখতে গেলেন। অবস্থা ভালো হলে কথাও বলা যাবে।

ক্লিনিকে গিয়ে দেখা গেলো কুমকুম কেবিনেই বসে আছে। রহমান সাহেব বিছানায় আধশোয়া হয়ে আছেন। চোখ দুটো বোজা। মাঝে মাঝে তিনি চোখ খুলে আবার বন্ধ করে রাখছেন। চোখ খুলে রহমান সাহেব যে নির্দিষ্ট কিছু দেখছেন, বিষয়টা তেমন না। তার চোখ অবশ্য খুব একটা বেশী খোলাও যাচ্ছেনা। চোখের ফোলা কমেনি।

নিশিতবাবু ইংগিতে কুমকুমকে রুমের বাইরে যেতে বললেন। তিনি রহমান সাহেবের সাথে একা কথা বলতে চান।

“রহমান সাহেব, কেমন আছেন?”

“আছি। ভালো আছি।”

“আমাকে চিনতে পেরেছেন?”

“জ্বী চিনেছি। না চেনার কি আছে? আপনি কি কোন বিষয় নিয়ে খুব চিন্তিত?”

“হ্যাঁ। আপনার চোখের এই অবস্থা হলো কি করে?”

“রহমান সাহেবকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে।”

“মানেটা বুঝলাম না। আপনি নিজে কেন নিজেকে শাস্তি দিচ্ছেন?”

“রহমান সাহেব নিজে নিজেকে শাস্তি দিচ্ছেন না। আমরা তাকে শাস্তি দিচ্ছি।”

রহমান সাহেবের শ্বাষ-প্রশ্বাষ আগের চেয়ে দ্রুত হয়েছে। তার এক চোখ পুরোটা খোলা। বাকীটা বন্ধ। খোলা চোখটা লালচে কিন্তু জ্বলজ্বল করছে। চোখ জ্বলজ্বল করে সাধারনত যক্ষা রোগীদের। রহমান সাহেবের রক্তের রিপোর্টে তেমন কোন কিছু আসেনি। তাও মানুষটার চোখ জ্বলজ্বলে। নিশিতবাবু খুব মনোযোগ দিয়ে রোগীর পুরো পরিবর্তনটুকু খেয়াল করছেন।

“আমরা মানে কি, রহমান সাহেব?”

“আমরা কাক। সংখ্যায় বেশী বলে বলছি আমরা। আমরা রহমান সাহেবকে শাস্তি দিচ্ছি।”

“একটু আগে আমি আপনাকে রহমান সাহেব বললাম, আপনি উত্তর দিয়েছেন। এখন বলছেন আপনি কাক। কথাটা কেমন হয়ে গেলোনা?”

“শুরুতেই আপনাকে ধাক্কা দিতে ইচ্ছে করলোনা।তাই ঐ সম্বোধনেই সাড়া দিয়েছি। একটু আগেও এই শরীরে রহমান সাহেবের চেতনাই ছিলো। এখন তা আমাদের দখলে।”

“ভালো যুক্তি দিয়েছেন। তবে আমি তাতে বিভ্রান্ত হচ্ছিনা। তো, রহমান সাহেব, আপনি এখন কাক, এইকথা আমাকে বিশ্বাস করতে বলেন?”

“বিশ্বাস-অবিশ্বাস আপনার বিষয় নিশিতবাবু। তাতে আমাদের কিছু যায় আসেনা।”

“রহমান সাহেব, কাকের কোন চেতনা নেই। মানুষের মস্তিষ্কে চেতনার জন্যে, সেই চেতনা নিয়ন্ত্রনের জন্যে আলাদা একটা অংশ আছে। তাই মানুষের চেতনা আছে। সেই আলাদা অংশটুকু আর অন্য কোন প্রানীর মাঝে নেই। কাকেরও নেই। তাই কাকের চেতনা নেই। যার চেতনাই নেই, সে বা তারা কি করে আপনার চেতনা দখল করবে? মানুষের চেতনা দখল করা সম্ভব না। আর যদি তা সম্ভব হয়েই থাকে তাহলে একজন মানুষের চেতনা দখল করা আরেকজন মানুষের পক্ষেই সম্ভব। অন্যকিছুর পক্ষে এই কাজটি করা সম্ভব না।”

“নিশিতবাবু,আপনার ভুল হচ্ছে। তার প্রমান আপনার সামনেই বসা।”

“আমার কোন ভুল হচ্ছেনা। আমি ঠিকই বলছি।ভুল হচ্ছে আপনার।”

“বুঝতে পারছি নিশিতবাবু, আপনি যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়েই এসেছেন। নিজে কিছু ব্যাখ্যাও দাড় করিয়েছেন। কিন্তু নিশিতবাবু, এই পৃথিবীর সবই কি ব্যাখ্যা করা যায়?”

“হ্যাঁ যায়। ঠিক রাস্তাটা ধরতে পারলে সব কিছুরই ব্যাখ্যা করা সম্ভব। যেসব রহস্য এখনো ব্যাখ্যা করা যায়নি, সেসবের জন্য এখনো মানুষ ঠিকঠিক রাস্তাটা খুঁজে পায়নি। তাই ব্যখ্যা হয়নি।হিসেব খুব সহজ। খুব সহজ। আমাদের বিজ্ঞান একসময় সব কিছুরই ব্যাখ্যা দেবে। সেই দিন আর খুব বেশী দূরে নেই। তাই চিন্তারও কিছু নেই।”

“পুরোপুরি ঠিক বলেননি নিশিতবাবু। আপনি যে বিজ্ঞান নিয়ে এতো গর্ব করছেন, তাতেও পরস্পর বিরোধী নানারকম মতবাদ থাকে, তত্ত্ব থাকে। নানারকম দল তৈরী হয়। বিভিন্ন দল বিভিন্ন মতবাদ বিশ্বাস করে। এই বিজ্ঞানও অনেক কিছুর একেবারে নিরেট কোন ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। ব্যাখ্যা দিলেও তাতে অনেক কিছু ধরে নেয়া হয়। কি, ঠিক না?”

“আপনি যা বলছেন রহমান সাহেব, তা আংশিক ঠিক। বিজ্ঞান একটা প্রবহমান ধারার মতো। এই ধারা চলমান অবস্থায় নানারকম মতবাদ আসে। রহস্য ব্যাখ্যা কিংবা কোন ঘটনা ব্যাখ্যার জন্য এইসব মতবাদের অবতারনা হয়। এরপর এইসব মতবাদ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। কোনকিছুই আপনার ভাষ্যমতে বিশ্বাস করা হয়না। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর মতবাদ বা ব্যাখ্যা সঠিক কিনা তা বলা হয়। রহমান সাহেব, মানুষ সবসময়ই ব্যাখ্যা চায়। রহস্য কিছু মানুষের পছন্দ কিন্তু বেশিরভাগ মানুষেরই অপছন্দ। তারপরেও বেশিরভাগ মানুষই রহস্যের পেছনে ছোটে। কারন তাতে উত্তেজনা আছে। উত্তেজনা শেষ হবার পর মানুষ তার ব্যাখ্যা চায়। কারন খুব সহজ। কারনটা হচ্ছে মানুষ সবশেষে চায় জ্ঞান। আপনি বলছেন ,আপনি কাক। কথাটা খুবই অবাস্তব। কখনো হতে পারেনা। অবশ্য আপনার নিজেকে কাক মনে করার পেছনে কারনও আছে। এবং তার ব্যাখ্যাও আছে।”

“নিশিতবাবু, আপনিতো সেই ব্যাখ্যা ঠিক করেই এসেছেন, ঠিক না? তবে একটা কথা, আপনার ব্যাখ্যার বাইরেও তো কোন ব্যাখ্যা থাকতে পারে, তাই না? অন্তত আপনার বিজ্ঞানের পথ হিসেবে তো তাই হবার কথা।”

“হ্যাঁ পারে। অন্য ব্যাখ্যা থাকতেই পারে। সম্ভাবনা আমি উড়িয়ে দিচ্ছিনা তবে আপনার আমার ব্যাখ্যাটা শুনতে হবে। সেটা বিশ্বাসও করতে হবে। কাজটা করতে হবে আপনার নিজেরই স্বার্থে।”

“শুনি। বিশ্বাস করতে পারবোনা। সত্যিটা আমি জানি। আপনি জানেন না। যাকগে, আপনার ব্যাখ্যাটা শোনা যাক।“

“রহমান সাহেব, আপনার শারীরিক একটা সমস্যা ছিলো এবং আছে। সেই সমস্যার দায়টুকু অবশ্য আপনার নাও হতে পারে।”

“ঠিকই বলেছেন নিশিতবাবু। রহমান সাহেবের শারীরিক সমস্যা আছে। তার বাবা হবার ক্ষমতা নেই। মাম্পস নামের একটা রোগ আছে। রহমান সাহেব ছেলেবেলায় বেশ কয়েকবার এই রোগে ভুগেছেন।”

“এই সমস্যার কারনে আপনার স্ত্রী, কুমকুম আপনাকে ছেড়ে চলে যেতে চেয়েছিলো। আপনি আপনার স্ত্রীকে খুব ভালোবাসেন এবং হয়তো আরো বাসবেন। কিন্তু তার এই চলে যাবার বিষয়টি আপনি কোনভাবেই মেনে নিতে পারেননি। মাম্পস এর বিষয়টি আপনার কাছে খুব বেশী গুরুত্ব পায়নি। আপনার মনে হয়েছিলো আপনিই কুমকুমকে ধরে রাখতে পারেননি। অক্ষমতার ভাবনা আপনাকে নিজের কাছেই নিজেকে অপরাধী করে তুলেছে। একসময় এই অপরাধবোধ হয়েছে তীব্র। শাস্তি দিয়েছেন নিজেকেই। আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন। পারেননি। তারপর কুমকুম আবারো ফিরে আসে। আপনার তীব্র অপরাধবোধ চলে গেছে আপনার ভেতরের গহীন কোন জায়গায়। কারন আপনার ভালোবাসা ফিরে এসেছে। যে বোধ তীব্র ক্ষমতার তা সবসময় গহীনে থাকেনা। মাঝে মধ্যেই উপরে উঠে আসে। আপনার অপরাধবোধও মাঝে মধ্যেই উঠে আসতো তবে তা আর বিধ্বংসী চেহারায় আসতো না। এরপর একটা সময় আপনি ব্যক্তিগত সাফল্যে সেই অপরাধবোধ কিংবা সেই অপরাধীসত্ত্বাটাকে ঢাকতে চেয়েছেন। সেই পথে আপনি অনেকদূর এগিয়েও গিয়েছিলেন। অফিসে নতুন একটা সমস্যা তৈরী হয়। সমস্যার সমাধান না হলে আপনার ব্যক্তিগত সাফল্যের চাদর পুরোপুরি নিখুঁত হতোনা। কিন্তু অপরাধবোধ ঢাকার জন্যে চাই পুরো নিখুঁত চাদর।আপনি আতংকিত হয়ে গেলেন। তীব্র আতংকে আপনার সময় কাটছিলো। ”

“নিশিতবাবু, ব্যার্থতা ব্যার্থতাই। সাফল্য দিয়ে কি ব্যার্থতার ক্ষত মুছে দেয়া যায়?”

“তা হয়তো পুরোপুরি যায়না। তবে মানুষ সেই চেষ্টা সবসময়ই করে। ব্যার্থতা ঢেকে রাখতে চায়। যাই হোক, আপনার তীব্র আতংকিত থাকার সময়টায় একটা কাকের মৃত্যু হয় আপনার হাতে। আপনার ভেতর তৈরী হয় একটু অপরাধবোধ। ছোট্ট এই ছিদ্র দিয়ে আপনার পুরোনো সেই তীব্র বোধ বেরিয়ে এসেছে। মানুষ আতংকে থাকতে চায়না। আতংকের জায়গায় আপনি এবার আক্রান্ত হলেন অপরাধবোধে। এই বোধ দীর্ঘদিন গহীনে থেকে শক্তি সঞ্চয় করে বেরিয়ে এসেছে। এবার বোধটুকু আপনার ভেতর গোটা একটা সত্বা তৈরী করে ফেললো। এই নতুন সত্বার নাম কাক। এই সত্বা আপনাকে শাস্তি দিতে চায়। সত্বা তৈরীতে অবশ্য আরো কিছু ব্যাপার কাজ করেছে।”

“নিশিতবাবু, আপনার ব্যাখ্যা কি শেষ হয়েছে?”

“নাহ, শেষ হয়নি। অনেকটা বাকী আছে।”

“আচ্ছা নিশিতবাবু, অপরাধবোধ থেকে কাক নামের আলাদা সত্বা কেন তৈরী হবে? অন্য কিছু কি হতে পারতোনা?”

“আতংক তীব্র অবস্থায় যখন পৌঁছেছে তখন আপনি একটা কাক মেরেছেন। প্রানী হত্যার বিষয়টা আপনার চরিত্রের সাথে যায়না। আপনার কুকুরগুলো যখন অসুস্থ ছিলো তখন আপনি নিজে সেই কুকুরদের দেখতে গিয়েছিলেন। প্রানীদের প্রতি ভালোবাসা থেকেই আপনি কাজটা করেছিলেন। তাই বললাম প্রানী হত্যার বিষয়টা আপনার চরিত্রের সাথে যায়না। চরিত্রবিরোধী এই কাজ, কাক মেরে বিষয়টাকে আপনি স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেননি। ভেবেছেন, কাকের যদি ক্ষমতা থাকতো তাহলে সে আপনাকে তার হত্যার শাস্তি দিতো। কিন্তু মৃত কোন কিছুরই কিছু করার ক্ষমতা থাকেনা। তখন আপনি পুরো কাক সম্প্রদায়ের কথা ভেবেছেন। পুরো সম্প্রদায় এখন আপনাকে শাস্তি দিচ্ছে। আর তাছাড়া আপনার নিজের সাংসারিক জীবনটা কাকের জীবনযাত্রার সাথে মেলে। কাক কোকিলের বাচ্চা লালন পালন করে। নিজের বাচ্চার মতো অপরের বাচ্চাকে ভালোবাসে। আপনার নিজের সন্তান নেই। দুটো বাচ্চা আপনি দত্তক নিয়েছেন। আরেকজনের সন্তানকে ভালোবাসছেন নিজের সন্তানের মতো করে। কাকের সাথে এই জায়গায় আপনার নিজের তুলনা এসেছে। এইসব কারনে আপনার নিজেকে কাক মনে হতে পারে।”

“চমৎকার নিশিতবাবু ! সবকিছু কেমন ছকে ফেলা শুরু করেছেন। ছক জিনিষটা আপনার পছন্দ, আমরা জানি। বলতে থাকুন, শুনি। ”

“সামাদ সাহেবের সাথে আপনার স্ত্রীর একটা সম্পর্ক একসময় ছিলো। সেটা বিয়ের আগে। এই সম্পর্ক স্বভাবতই কুমকুমের বাবা-মা মেনে নিতে পারেননি। কুমকুমের বিয়ে আপনার সাথে ঠিক করা হয়। বাবা-মায়ের চাপে আপনাকে কুমকুম বিয়ে করেছে। কিন্তু বিয়ের পর কুমকুম আর দশটা বাঙ্গালী মেয়ের মতোই কাজ করেছে। স্বামীর প্রতি সে বিশ্বস্ত থেকেছে। সামাদ সাহেবকে সে ভুলে যাবার চেষ্টা করেছে। তার সাথে কোন যোগাযোগ সে করেনি। সামাদ সাহেব কিন্তু চেষ্টা করেছিলেন। ভালোবাসা কি এতো দ্রুত ছেড়ে দেয়া যায়? যায়না। কিন্তু কুমকুম তাতে কোন সাড়া দেয়নি। শেষ পর্যন্ত সামাদ সাহেবও পিছিয়ে যান। ”

নিশিতবাবু চুপ করে কিছুক্ষন রহমান সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইলেন। রহমান সাহেবের এক চোখ খোলা। তাতে পলক পড়ছেনা।
“রহমান সাহেব, আপনি আমার কথা শুনছেন তো?”

“বলুন, সমস্যা নেই। আর একই ভুল বারবার করার কোন অর্থ নেই। আমরা রহমান সাহেব নই।”

“আচ্ছা। বাকীটা শুনুন। প্রতিটি মেয়ের ভেতরেই মা হবার তীব্র বাসনা থাকে। কুমকুমও সেই নিয়মের বাইরে নয়। একসময় আপনারা দুজনে মিলে সেই বাসনা মেটানোর চেষ্টা করলেন। হলোনা কিছুই। ডাক্তারী পরীক্ষায় ধরা পড়লো সমস্যা আপনার। কুমকুমের না। এই বিষয়টা কুমকুম মেনে নিতে পারেনি। জানেনই তো আপনার স্ত্রী একজন আবেগপ্রবন মানুষ। সে তখন বাপের বাড়ী চলে যায়। সামাদ সাহেবের সাথে যোগাযোগ করে। কুমকুমের ইচ্ছে ছিলো আপনাকে ডিভোর্স করে সামাদ সাহেবকে বিয়ে করার। পুরো বিষয়টি অবশ্য সামাদ সাহেব মেনে নিতে পারেননি। সামাদ সাহেবের দৃষ্টিতে ভালোবাসার সংজ্ঞাটি অনেক বিশাল। দীর্ঘদিন পর এমন একজন মানুষের সাথে কথা হলো। যাই হোক, এই সময়টিতে আপনি আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। আপনার ভালোবাসার এই রুপটা কুমকুমকে বোঝায় সামাদ সাহেব। কুমকুম আপনার কাছেই ফিরে আসে। অবশ্য এই তথ্য আপনি অনেক পরে জেনেছেন। কুমকুমই হয়তো আপনাকে বলেছে। তখন আপনার মনে হয়েছে সামাদ সাহেব অনেক মহৎ একজন মানুষ। কতটা মহৎ তা বোধহয় আপনি বুঝতে পারেননি। এই ধরনের মহত্ব দেখাতে মহত্বের পরিমানটি সত্যি সত্যি অনেক বেশী হতে হয়। এই মহত্ব একসময় আপনার কাছে কুমকুমের চেহারায় দেখা দিলো। সে আপনার স্ত্রী। আপনার আশেপাশেই থাকে। তার মানে সামাদ সাহেবের মহত্ব আপনার আশেপাশেই থাকে। আপনার ভেতর তখন তৈরী হলো একধরনের হীনমন্যতা। সামাদ সাহেব একসময় আপনার অফিসে আপনারই অধীনে কাজ করতে আসেন। তখন আপনি নিয়মিত তাকে উপেক্ষা করতে শুরু করেন। সামাদ সাহেবকে আপনি মহত্বের বেদী থেকে নামিয়ে সাধারন মানুষ প্রমান করতে চেয়েছেন। সুযোগ যখন পেয়েছেন তখন তা হাতছাড়া করেননি। তার কাজের জন্য তাকে পুলিশে দিয়েছেন। সামাদ সাহেব নেমে এলো সাধারন মানুষের কাতারে। কিন্তু সমস্যা হলো অন্য জায়গায়। ”

“কিসের সমস্যা নিশিতবাবু?”

“সমস্যা হলো একটা মানুষের চেতনার বিভিন্ন অংশ থাকে। আপনার চেতনার একটা অংশ সামাদ সাহেবের কাছে অসীম কৃতজ্ঞ তার ভালোবাসা ফিরিয়ে দেবার জন্য। আবার আপনারই চেতনার একটা অংশ তা সহ্য করতে পারেনি। সামাদ সাহেবকে সে প্রমান করেছে সাধারন মানুষ হিসেবে। এই বিষয়টা আবার আপনার সেই কৃতজ্ঞ অংশটুকু মেনে নিতে পারেনি। এই অংশটিরই ছিলো অপরাধবোধ। আবার সামাদ সাহেবের পরিণতিতে সে নিজেকে ভাবা শুরু করলো অকৃতজ্ঞ। অপরাধবোধের ছাইচাপা আগুন আর অকৃতজ্ঞতার ছায়া, এই দুই মিলিয়ে সেই অংশটি সিদ্ধান্ত নিলো শাস্তি দেবার। সে কাকের অবয়ব নিলো। রহমান সাহেব, আমার ব্যাখ্যা কি আপনার পছন্দ হচ্ছে?”

“আমাদের পছন্দ অপছন্দে কিছু যায় আসেনা। তবে আপনার কথা শুনতে ভালো লাগছে। সবকিছু কেমন পাজলের মতো মিলিয়ে ফেলছেন।”

“আমার কথা শেষ হয়নি। আপনার স্ত্রীর মাতৃত্বের আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য দুটো দরিদ্র পরিবার থেকে দুটো বাচ্চা আপনি পালক এনেছেন। সেইসব পরিবারের কেউ যাতে বাড়িতে ঢুকতে না পারে তার ব্যাবস্থাও আপনি করেছেন। তাদের নিয়মিত টাকা পাঠানো হতো। সারাদিন বাড়ির গেইটে দাড়োয়ান আর রাতে বাড়ির কম্পাউন্ডে ছেড়ে দেয়া হতো কুকুর। বাড়ি পাহারার কাজটি করেছে আপনার চেতনার অকৃতজ্ঞ অংশটি। কিন্তু কৃতজ্ঞ অংশটি দরিদ্র বাবা-মায়ের দিকটি ঠিকই দেখেছে। পুরো বিষয়টি তার কাছে মনে হয়েছে অন্যায়। কাক যখন কোকিলের বাচ্চা বড় করে তখন কোকিল দূর থেকে বিষয়টি খেয়াল করে। আপনার বাচ্চাদের আসল বাবা-মায়েরাও যে তাদের সন্তানদের দূর থেকে দেখে যায় তা বোধহয় আপনার জানা আছে। এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আপনার নিজেকে কাক মনে করার কারন কি?”

“নিশিতবাবু, আপনার কথা কি শেষ হয়েছে?”

“না, আর অল্পই আছে। এতো অস্থির হচ্ছেন কেন রহমান সাহেব? অস্থির হবার কিছু নেই।”

“নিশিতবাবু, আপনি এক কাজ করুন। বারান্দায় গিয়ে বাইরে কি অবস্থা দেখে আসুন।”

নিশিতবাবু নির্বিকারভাবে উঠে বাইরে গেলেন। এ জাতীয় রোগীদের মনে বিশ্বাস স্থাপনের জন্যে মাঝেমধ্যে তাদের কথা মতো কাজ করতে হয়। বাইরে এসে তিনি খুব অবাক হলেন। ক্লিনিকের চারপাশে সবজায়গায় শুধু কাক আর কাক। সব চুপচাপ বসে আছে। এতো কাক কেন আশেপাশে? একসাথে কি বেশ কিছু কাক মারা গেছে? নইলে তো একজায়গায় এতো কাক বসে থাকার কথা না। এর চুপ করেই বা বসে আছে কেন? সবার মধ্যে কেমন নিশ্চল ধ্যানী ভাব। কাকেরা কি ধ্যান করে? কে জানে?

নিশিতবাবুর খুব কাছাকাছি একটা কাক বসে আছে। সে অবশ্য চুপ করে বসে নেই। মাথা নাড়ছে এদিক ওদিক। কাকটার চোখ নিশিতবাবুর দিকেই। তিনিও কিছুক্ষন কাকটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। কি অদ্ভূত বিষয়! কাকের গলায় সাদা ফুটকি। কাকের গলায় এরকম দাগ থাকে নাকি? কখনো চোখে পড়েনি তো!

রুমের ভেতরে ঢুকলেন নিশিতবাবু। রহমান সাহেব বিছানার উপর দ এর মতো হাঁটু ভেঙ্গে বসে আছেন। হাত দুটো দুপাশে দিয়ে উড়ার মতো ভঙ্গি। মুখ অদ্ভুত উজ্জ্বল। দৃশ্যটা নিশিতবাবুর কাছে অস্বাভাবিক মনে হলো। তিনি বিছানার পাশের চেয়ারে বসলেন।

“কি দেখলেন নিশিতবাবু?”

“তেমন কিছু না। অনেক কাক দেখলাম।”

“অবাক হননি?”

“অবাক হবার কিছু নেই। আশেপাশে কাকটাক মরেছে বোধহয়।”

“আমরা কিন্তু জানতাম বাইরে আপনি কি দেখবেন।”

“বাইরে অনেক কাক, একথা জানতে কাক হবার প্রয়োজন দেখিনা। আপনি আগেই হয়তো কাকেদের ডাকাডাকি শুনেছেন। তাই ধারনা করেছেন বাইরে অনেক কাক।”

“নিশিতবাবু, কাকগুলো কি ডাকাডাকি করছে?”

“না। এই বিষয়টা অদ্ভুত।”

“বাইরের এই কাকেদের চেতনা সংযুক্ত অবস্থায় আছে। তাদের এখন আলাদা কোন চেতনা নেই। সংযুক্ত চেতনা এখন আপনার সাথে কথা বলছে। তাই তারা চুপ। নড়াচড়া বন্ধ। ”

“আপনার ব্যাখ্যা সুন্দর। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু বিষয়টা অসম্ভব, তাই বিশ্বাস করতে পারছিনা। ”

“জানতাম আপনি বিশ্বাস করবেন না। আপনার বিশ্বাসের জন্যে একটা ব্যাবস্থা নেয়া হবে। আমরা রহমান সাহেবকে ছেড়ে খুব অল্প সময়ের জন্যে আপনার চেতনা দখল করবো। যদি সহ্য করতে পারেন তাহলে এই স্মৃতি টুকু থাকবে, নইলে আমরাই মুছে দেবো। ”

“মানুষের স্মৃতি মোছা যায়না রহমান সাহেব।”

“ভুল বললেন নিশিতবাবু। মানুষের স্মৃতিও মোছে। আপনারা একে রোগ হিসেবে আলাদা নামও দিয়েছেন। এমনেশিয়া। তাইনা?”

“হ্যাঁ ঠিক। ওটা রোগ। স্বাভাবিক মানুষের ক্ষেত্রে এই ঘটনা সাধারনত ঘটেনা। এর জন্য মস্তিষ্কের নার্ভ সেলের উপর তীব্র চাপের প্রয়োজন হয়।”

“আপনাকে সেই চাপ দেয়া হবে যদি আপনার সহ্য না হয়।”

“আচ্ছা।”

“আপনার চেতনা দখলে শক্তির প্রয়োজন বেশী। কারন আপনার চেতনায় ঈর্ষা, হিংসা , এই অনুভূতিগুলো কম। সংযুক্ত চেতনার শক্তি বাড়ানোর জন্যে কাক বেশি প্রয়োজন। তাই আশেপাশে প্রচুর কাক এসেছে। রহমান সাহেবের চেতনা দখলে এতো শক্তির প্রয়োজন হয়নি। ওর চেতনা অনেক দূর্বল। আপনি কি বুঝতে পারছেন নিশিতবাবু?”

“পারছি, কিন্তু বিশ্বাস করছিনা। অবাস্তব জিনিষে বিশ্বাস করার কোন ইচ্ছে আমার নেই।”

“বিশ্বাস করবেন। এক্ষুনি করবেন। কাহ কাহ কাহ...।”

শব্দগুলো নিশিতবাবুর কাছে কেমন অবাস্তব অবাস্তব মনে হলো। এই বিচ্ছিরি শব্দগুলো কিছুতেই এই পৃথিবীর হতে পারেনা। হঠাৎ করেই নিশিতবাবু তীব্র ভয়ে কুঁকড়ে গেলেন। কিসের এই ভয় তা তিনি জানেন না। তার ছুটে পালাতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু বসা থেকে তিনি উঠতে পারছেন না।

কোনরকম পূর্বাভাস ছাড়াই নিশিতবাবুর পৃথিবী অন্ধকার হয়ে গেলো। এই অন্ধকার খুব অল্প সময়ের। অন্ধকার ভরে উঠলো আলোয়। নিশিতবাবু দেখলেন, তিনি অনেক উঁচু থেকে নিচে নেমে আসছেন। শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছে। মাটিতে একটা বাচ্চা ছেলেকে হেঁটে যেতে দেখা যাচ্ছে। ছেলেটার হাতে বিস্কিট। অনেকদিন টাটকা বিস্কিট খাওয়া হয়না। তিনি ছোঁ মেরে বিস্কিটটা বাচ্চাটার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে গিয়ে সামনের গাছের ডালে বসলেন। বাচ্চাটা অবাক হয় তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চেহারায় একই সাথে বিস্কিট হারানোর বেদনা এবং যে কেড়ে নিয়ে গেছে তার প্রতি ঘৃণা পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে।

নিশিতবাবু জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে পড়ে গেলেন। মেঝেতে পড়ার আগে তার মাথা বিছানার কোনায় বাজে ভাবে ঠুকে গেলো।

হঠাৎ রহমান সাহেব আবিস্কার করলেন তিনি বিছানার উপর বসে আছেন। হাত দুটো দুপাশে। আরে, হাত দুটো এরকম দুপাশে দেয়া কেন? ছেলেবেলায় এই ভঙ্গিতে পাখির মতো ওড়ার চেষ্টা করতেন। এই বয়সে এইরকম করার কারন কি? এতো শব্দ কোথা থেকে আসছে? ওমা, মেঝেতে কে পড়ে আছে? এতো রক্ত কেন মেঝেতে? কে এই লোক? এটা কোন জায়গা? কুমকুম কোথায়?

রহমান সাহেব জোরে জোরে ডাকলেন, “কুমকুম, কুমকুম...”

কুমকুম রুমের বাইরেই বসা ছিলো। চিৎকার শুনে সে ভেতরে ঢুকলো। মেঝের উপর নিশিতবাবুকে পড়া দেখে সে অবাক হয়ে গেলো। মেঝেতে এতো রক্ত কেন?

নিশিতবাবুকে ঐ ক্লিনিকেই ভর্তি করা হলো। টানা তিনদিন তিনি সংজ্ঞাহীন রইলেন।

৩৪

নিশিতবাবু ক্লিনিকে ভর্তি হবার পর রহমান সাহেবের অবস্থা আবার আগের মতো হয়ে গেলো। বেসিরভাগ সময় তিনি বসে থাকেন। ক্লিনিক থেকে একদিন পর তাকে নেয়া হলো মানসিক হাসপাতালে। সেখানে নানারকম চিকিৎসার ব্যাবস্থা করা হলো। তাতে শরীর দূর্বল হয়ে যাওয়া ছাড়া তেমন কিছু হলোনা।

দূর্বল শরীর নিয়ে রহমান সাহেব জানালার গ্রীল ধরে ঝুলে থাকেন। কিছুক্ষন পর পর প্রচন্ড জোরে কা কা শব্দ করেন। হাসপাতালের চারপাশে তখন প্রচুর কাক থাকে। এরা বসে থাকে চুপচাপ। মাঝে মাঝে স্বল্প সময়ের জন্যে রহমান সাহেবের অবস্থা স্বাভাবিক হয়। তিনি তখন স্বাভাবিক মানুষের মতো চিৎকার করেন। সেই চিৎকারে কারও কোন ভাবান্তর হয়না। মানসিক রোগীতো চিৎকার করবেই। সেই চিৎকারে গা করলে চলেনা।

হাসপাতালে দ্বিতীয় রাতে একটা ঘটনা ঘটলো। রহমান সাহেব তখন প্রায় স্বাভাবিক মানুষ। শুধু ওষুধের হালকা কেমন একটা ঘোর লাগা ভাব আছে। একটা অশরীরি গলা তার সাথে কথা বলা শুরু করলো।

“কেমন আছেন রহমান সাহেব?”

“কে? কে কথা বলে?”

“আমরা কাক রহমান সাহেব। আমাদের আলাদা কোন নাম নেই। কাক বলেই আমাদের ডাকতে পারেন।”

“আপনারা কোথায়? দেখতে পাচ্ছিনা কেন?”

“আমরা আছি আপনার আশেপাশেই। দেখতে পাওয়াটা কোন জরুরী বিষয় না। কথা তো শুনতে পাচ্ছেন।”

“তাও...।”

“ফোনে যখন কথা বলেন তখন তো বক্তার চেহারা দেখা যায়না। তাতে কি কোন সমস্যা হয়? ”

“তা অবশ্য ঠিক। আপনি কি চান?”

“তেমন কিছুই চাইনা। আপনি কেমন আছেন?”

“ভালোনা। একদম ভালোনা। আমি যে স্বাভাবিক মানুষ তা এরা বিশ্বাসই করতে চায়না। আমাকে ভাবে পাগল। আচ্ছা বলুনতো, আমি কি পাগল? ”

“নাতো, আপনি কেন পাগল হতে যাবেন?”

“তাও এরা আমাকে আটকে রেখেছে।“

“কেমন লাগছে রহমান সাহেব?”

“যন্ত্রনারে ভাই। খুব যন্ত্রনায় আছি।”

“মুক্তি চান?”

“অবশ্যই চাই।”

“আপনার রুমের দরজা খোলা। দরজা খোলার ব্যাবস্থা আমরাই করেছি। আপনি বেরিয়ে যান। বেরিয়ে ডানে সিঁড়ি পাবেন। সোজা উপরে উঠে যাবেন।”

“কেন? উপরে কেন?”

“আপনি যান। গেলেই বলবো।”

রহমান সাহেব দরজার কাছে ছুটে গেলেন। আশ্চর্য্য তো! দরজা আসলেই খোলা। দরজা ধরে কতো টানাটানি, কতো ঝুলোঝুলি। দরজা খোলেনা। আর এখন দরজা খোলা। রহমান সাহেব দরজা খুলে এদিক ওদিক দেখে নিলেন। আশেপাশে কেউ নেই। করিডর ফাঁকা। সিঁড়ি বেয়ে রহমান সাহেব সোজা উপরে উঠে গেলেন।

“এবার রহমান সাহেব, ছাদের দরজা খুলুন।”

“দরজায়তো তালা দেয়া। খুলবে কি করে?”

“সমস্যা নেই। তালা ঠিক মতো লাগেনা। তালা ধরে জোরে টান দিন। খুলে যাবে।”

রহমান সাহেব তালা ধরে টান দিলেন। তালা খুলে এলো। এরপর তিনি সোজা চলে গেলেন ছাদে। আকাশ পরিস্কার। আজ পূর্ণিমা। বিশাল এক চাঁদ আকাশে। আকাশ ভরা তারা। রহমান সাহেব দীর্ঘক্ষন আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
“আকাশ কেমন লাগে রহমান সাহেব?”

“আকাশ? আকাশ আমার খুব পছন্দের।”

“আকাশে উড়বেন? উড়তে আরো ভালো লাগবে। আকাশ দেখে যতো আনন্দ, উড়তে তার চেয়ে আনন্দ বেশী।”

“ওড়া যাবে?”

“কেন যাবেনা? অবশ্যই যাবে। ছাদের দেয়ালে উঠে যান। আপনাকে আমরা উড়তে সাহায্য করছি।”

রহমান সাহেব ছাদের দেয়ালে উঠে দাঁড়ালেন। অন্য কোন ভাবনা তার মাথায় নেই। ছেলেবেলায় কতো পাখির মতো উড়তে ইচ্ছে হয়েছে। কত শখ ছিলো পাখির মতো এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় উড়ে যাবেন।

“এবার রহমান সাহেব, হাত দুটো দুপাশে পাখার মতো ছড়িয়ে দিন। ঝাপটাতে থাকুন। তারপর ছোট্ট একটা লাফ দিন। আপনি উড়তে থাকবেন।”

ঠিক তাই করলেন রহমান সাহেব। আরে তাইতো ! ওড়া যাচ্ছে তো! পৃথিবী কি সুন্দর! অদ্ভুত সুন্দর!

পাঁচ তলার ছাদ থেকে রহমান সাহেব চোখের পলকে শক্ত, বাঁধানো কম্পাউন্ডে আছড়ে পরলেন। মাটিতে আছড়ে পরার ঠিক আগ মুহূর্তে তার কুমকুমের কথা মনে পড়লো। কেমন আছে মেয়েটা? ভালো আছে তো? ইস্ ! ওকে সাথে নিয়ে যদি ওড়া যেতো!

আশপাশ থেকে অনেক ডানা ঝটপটানোর শব্দ পাওয়া গেলো। এলাকা ছেড়ে উড়ে গেলো কয়েকশ কাক। তাদের আর ওখানে থাকার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন শেষ।

৩৫

চতুর্থ দিন বিকেলে নিশিতবাবুর জ্ঞান ফিরলো। পরের দিন বিকেলে তাকে আইসিইউ থেকে কেবিনে নেয়া হলো। তার অবস্থা এখন অনেক ভালো। কুমকুম বিকেল বেলায় নিশিতবাবুকে দেখতে গেলো।

“চাচা, ভালো আছেন?”

“আছি, ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?”

“আমি ভালো আছি চাচা। আপনি বোধহয় আমাকে চিনতে পারেননি। আমি কুমকুম। আপনি আমার স্বামীর চিকিৎসা করছিলেন।“

“হুমম। আচ্ছা।“

“আপনার এখনো কিছু মনে পড়েনি চাচা, তাইনা?”

“ঠিক ধরেছেন। আমার কিছুই মনে পড়ছেনা। Iam sorry. আপনার স্বামী কেমন আছেন?”

“ও আর নেই চাচা। গত পরশু রাতে ছাদ থেকে পড়ে মারা গেছে।”
কথাটা বলেই কুমকুম কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।

যে মানুষটিকে মনে নেই, তার মৃত্যুতেও নিশিতবাবুর হৃদয় ভারাক্রান্ত হলো। সান্তনা দেবার কোন ভাষা তার জানা নেই। নিশিতবাবু কুমকুমের মাথায় হাত রেখে মমতা মাখানো গলায় বললেন, "শান্ত হন মা, শান্ত হন।"

এরও দুদিন পর নিশিতবাবু ক্লিনিক থেকে ছাড়া পেলেন। হিসেব অনুযায়ী তিনি এক সপ্তাহ কাটিয়েছেন ক্লিনিকে। এ্যাম্বুলেন্স দিয়ে তাকে বাড়িতে পৌঁছে দেয়া হলো। বাড়ির সবকিছুতে কেমন ধূলো জমেছে। মাত্র এক সপ্তাহে সময় এতো দাগ কাটে? সময় যে কি বিচিত্র জিনিষ তা যদি বোঝা যেতো! বাড়িতে ঢুকেই নিশিতবাবুর খুব ক্লান্ত লাগলো। তিনি সোজা বিছানায় চলে গেলেন।

ধূলো জমেছে বিছানাতেও। ধ্যাত্তেরি! তিনি ধূলো সহ বিছানাতেই শুয়ে পরলেন। বিছানার পাশেই ছোট্ট টুলের উপর একটা ফাইল খোলা। কিসের ফাইল? ফাইলের উপর বিশাল একটা কালো পালক। কিসের পালক? এলো কোত্থেকে? নিশিতবাবু ফাইলটা হাতে নিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়া শুরু করলেন।

আব্দুর রহমান নামের একজনের ফাইল। ইনি কি তার রোগী ছিলেন? এই রোগী কবে দেখা হয়েছে? ফাইলের শেষের ব্যাখ্যাটা তার কেন যেন পছন্দ হচ্ছেনা। এই ব্যাখ্যা কার দেয়া? হাতের লেখাটা তারই। তার মানে ব্যাখ্যাটা তারই দেয়া। নাহ ব্যাখ্যাটা আরো ভালো হতে পারতো।

এই আব্দুর রহমান সাহেব কবে এসেছিলেন তার কাছে? কি যেন নাম মেয়েটার? ও আচ্ছা কুমকুম। আব্দুর রহমান সাহেবই কি কুমকুমের স্বামী? ধুত্তোরী, কিছুই তো মনে নেই। মনে নেই কেন? বয়সের সাথে সাথে কি স্মৃতিটাও ক্ষয়ে যাচ্ছে?

“নিশিতবাবু, ব্যাখ্যাটা কি আপনার পছন্দ হয়েছে?”

“নাহ, ব্যাখ্যাটা অন্যভাবেও হতে পারতো।” কথাটা বলেই নিশিতবাবু চমকে উঠলেন। প্রশ্ন কে করলো? বাড়ীতে প্রশ্ন করার মতো কেউ তো নেই। কিন্তু প্রশ্নটা তিনি পরিস্কার শুনেছেন।

নিশিতবাবু আশেপাশে দেখলেন। কেউ নেই। কারও থাকার কথাও না। বিড়াল অনামিকাকেও দেখা যাচ্ছেনা। শেষে নিশিতবাবুর চোখ পড়লো জানালার গ্রীলে। সেখানে বড়সড় একটা কাক বসে আছে। কাকটার দিকে নিশিতবাবু অনেকক্ষন তাকিয়ে রইলেন। কাকটার গলায় সাদা ফুটকি। হঠাৎ কাকটাকে তার পরিচিত মনে হলো। ধুত্তরি! কাক আবার পরিচিত হবে কেমন করে? ক্লান্ত শরীরে উদ্ভট সব চিন্তা মাথায় আসছে।

নিশিতবাবু উঠে জানালা বন্ধ করতে গেলেন। কাকটা উড়ে গেলো। নিশিতবাবু জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। বিদ্যুতের তারে শত শত কাক বসে আছে। সব স্থির, চুপচাপ। দৃশ্যটি নিশিতবাবুর কাছে খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। খুবই পরিচিত।

সমাপ্ত


মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

আগের না পড়া পর্বগুলো সব একসাথে পড়লাম। বেশ ভালোই লাগল।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

মানিক চন্দ্র দাস এর ছবি

সবটুকু পড়ার জন্যে ধন্যবাদ মুর্শেদ ভাই। ভালো থাকবেন।

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

শেষেরটাও বেশ ভালো লাগলো। সুন্দর সমাপ্তি।

মানিক চন্দ্র দাস এর ছবি

ধন্যবাদ পিপিদা। কেমন আছেন?

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

ভাল লেগেছে!
-----------------------------------
যে মাঠে ফসল নাই তাহার শিয়রে
চুপে দাঁড়ায়েছে চাঁদ — কোনো সাধ নাই তার ফসলের তরে;

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

মানিক চন্দ্র দাস এর ছবি

ধন্যবাদ চৌধুরী সাহেব।

অতিথি লেখক এর ছবি

আগের পর্বগুলো পড়িনি, শেষ থেকে শুরু করলাম।
ভাল লেগেছে। গল্পে হুমায়ূন আহমেদিয় গল্প বলার স্টাইল এবং মিসির আলি টাইপের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ আছে।
আপনার এই ধরণের আরো লেখার অপেক্ষায় রইলাম।
-----------------------
শ্যামল

মানিক চন্দ্র দাস এর ছবি

যাক পড়েছেন তাহলে। কষ্ট করে পড়ার জন্যে ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।

শান্ত [অতিথি] এর ছবি

দীর্ঘ বিরতির পর কাক সিরিজ এলো, তাও আবার শেষ পর্ব!!!! ভালো লেগেছে সমাপ্তিটা।

মানিক চন্দ্র দাস এর ছবি

ধন্যবাদ শান্ত। কাক নিয়ে আর কোন ঝাড়ি আর তোর কাছ থেকে শুনতে হবেনা। ভাবতেই ভালো লাগছে। ভালো থাকিস।

অতিথি লেখক এর ছবি

পড়লাম। একটানেই পড়ে ফেললাম। হাসি যাক, শেষ পর্যন্ত শেষ কিস্তিটা পাওয়া গেল! অষ্টম কিস্তি পর্যন্ত পড়ার পর থেকেই গভীর আগ্রহ নিয়ে বাকীটুকু পড়বার অপেক্ষায় ছিলাম। হাসি
এবার, আমি একজন অতি সাধারণ এবং নাদান পাঠক হিসেবে কিছু মন্তব্য করবো। আশা করছি তা স্বাভাবিক ভাবেই গ্রহণ করবেন। পুরো উপন্যাসটাই এক কথায় বলতে গেলে আমার ভালো লেগেছে। হাসি
সবচেয়ে যা ভালো লেগেছে তা হলো গল্পটি অসম্ভব রকমের প্রাণবন্ত। পাঠক একবার পড়া শুরু করলে তা শেষ না করা পর্যন্ত শান্তি পাবেনা।
উপন্যাসের মূল আকর্ষণ ছিল রহমান সাহেব আর কাকদের কথোপকথন। শেষটাও ভালো লেগেছে। সবমিলিয়ে সুখপাঠ্য। পড়ে আরাম পাওয়া যায়। কাকের সংলাপে অনেক মানবিক ব্যাপারও বেশ সফলভাবে উঠে এসেছে। আর তার সাথে যুক্ত চিরায়ত রহস্যময়তা পাঠকের জন্য বাড়তি প্রাপ্তি। মানব সম্পর্কের জটিল,কুটিল এবং মহৎ অজানা বিষয়গুলোও অত্যন্ত সফলভাবে প্রকাশিত হয়েছে।
লেখায় হুমায়ূনের ছায়ার উপস্থিতি নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। সে সম্পর্কে নতুন করে আর কিছু বলতে চাচ্ছিনা হাসি তবে আমার বিশ্বাস, লেখকের নিজস্ব স্টাইলে লেখার ক্ষমতা অবশ্যই আছে। আর যদি লেখায় অন্য কারও লেখার ছায়া চোখে পড়ে তাতে আমার মতে ,তেমন বড় ধরনের কোন সমস্যা নেই। লিখতে লিখতে একসময় লেখকের নিজস্ব স্বকীয়তা অবশ্যই সৃষ্টি হবে।
সবশেষে প্রিয় মানিকদাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ একটি প্রাণবন্ত উপন্যাস পাঠকদের উপহার দেয়ার জন্য।
--শাহেদ সেলিম

মানিক চন্দ্র দাস এর ছবি

ধন্যবাদ শাহেদ ভাই। কোথাও কোন সমস্যা মনে হলে নির্দ্বিধায় বলতে পারেন। আমি পরে লেখাটা ঠিক করে নেবো। ধন্যবাদ কষ্ট করে পুরোটা পড়ার জন্যে।

অয়ন দত্ত  এর ছবি

মানিক বাবু , আপনার লেখা পড়ে খুবই ভালো লাগলো .প্রথম থেকে শেষ অবদি গল্পটাতে একটা আকর্ষণ করে রাখার ক্ষমতা আছে .আরো লিখুন .শুভেচ্ছা রইলো .
অয়ন দত্ত

মানিক চন্দ্র দাস এর ছবি

অয়ন দা,
বই মেলায় এই বই বেরুলে কিনবেন তো?? আপনার শুভকামনার জন্যে ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন দাদা।
মানিক

মানিক চন্দ্র দাস এর ছবি

অয়ন দা,
বই মেলায় এই বই বেরুলে কিনবেন তো?? আপনার শুভকামনার জন্যে ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন দাদা।
মানিক

মানিক চন্দ্র দাস এর ছবি

অয়ন দা,
বই মেলায় এই বই বেরুলে কিনবেন তো?? আপনার শুভকামনার জন্যে ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন দাদা।
মানিক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।