যোজনগন্ধা

মাসুদা ভাট্টি এর ছবি
লিখেছেন মাসুদা ভাট্টি (তারিখ: রবি, ২৪/০২/২০০৮ - ৮:৪৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মহানগরের পুরাতন নামেই নাম, যদিও তার থেকে বেশ দূরেই বলতে হবে এই বিদ্যাপীঠ। বাস নামিয়ে দেয় গহীন বন কেটে যাওয়া রাস্তার ওপর একটি স্টেশনে, সেখান থেকে হয় হাঁটা পথ, না হয় সাইকেল রিক্সা। এতো বড় বিশ্ববিদ্যালয়, গাড়ি যাতায়াতের পথও আছে, সে অবশ্য অনেকটা দূর দিয়েই। ছেলেমেয়েরা পাবলিক ট্রান্সপোর্টে এলে এখানে নেমেই রিক্সা নিয়ে বন-বনস্থলীর ভেতর দিয়ে যাতায়াত করে। আর কারো হাতে সময় থাকলে, অথবা খুব নীরিবিলি সময় কাটাতে চাইলে তবে বনের ভেতর দিয়ে সরু পথ ধরে হেঁটেই পার করে দেয় রাস্তাটুকু, মাত্র তো ঘন্টা খানেকের পথ!

ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসেই সিঁথির ভালো লেগেছিল এই পথটুকু। যতোদিন ও বাসা থেকে ভার্সিটির বাসে করে যাতায়াত করেছে তখনও এই বাস স্টপে নেমে বনের ভেতর দিয়ে যাওয়া এ পথটুকু হেঁটেই পার করেছে। কাশের তাড়া থাকলেও ওটুকু পরে পুষিয়ে নিয়েছে। কিন্তু যখন হোস্টেলে এসে উঠেছে তার পর থেকে প্রতিদিন সকালে কিংবা বিকেলে যখনই সময়-সুযোগ পেয়েছে এই বন, বনের ভেতর ছোট্ট ছোট্ট ডোবা, বুকের লাল মাটি উগরে দেওয়া নালা সবকিছুর সঙ্গেই ওর শখ্যতাকে ঝালাই করে নিয়েছে। বন্ধুরা ওকে নামই দিয়ে দিয়েছিল বনকন্যা। অবশ্য কেউ কেউ বানরীও বলতে ছাড়েনি, কিন্তু তাতে সিঁথির খুব কিছু এসে যায়নি।
আসলে এখানে ভর্তির পর থেকেই ওকে নিয়ে নানা রকম যল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছিল। সেটা কি কারণে সেটা ও নিজে বলতে পারবে না কিন্তু ওর ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা বলে, সিঁথি অন্যরকম। এই অন্যরকমটা কি রকম সেটা বুঝিয়ে বলা যায় না, ওকে দেখলে কিংবা জানলে হয়তো বলা যেতে পারে, কিন্তু তাতেও হয়তো ফাঁক থেকে যাবে বিস্তার; মানুষকে কি পুরোপুরি কখনও জানা যায়? মিশর তো চেষ্টা করেছিল সিঁথিকে জানতে, পেরেছিল কি?

এই বনের ভেতর হাঁটতে হাঁটতেই মিশরের সঙ্গে সিঁথির পরিচয়। সিঁথি তখন সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। আর মিশর ভর্তি পরীক্ষায় পাশ করে কেবলমাত্র ঢুকেছে। বাস থেকে নেমে বনের ভেতর দিয়ে হেঁটে আসতে গিয়ে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিল, হাঁটছে তো হাঁটছেই, কোথায় কি, কিছুই বুঝতে পারছে না। হঠাৎ করেই পায়ে হাঁটা পথটা যেনো জনশূন্য হয়ে গেছে। কাউকেই দেখতে পাচ্ছে না কাছে-ধারে। হতে পারে কাশ শুরু হয়ে গেছে বলে ছেলেমেয়েরা সবাই তাড়াহুড়ো করে কাশে ঢুকে গেছে, পথে আর কেউ নেই। মিশর হাঁটছে, ভাবছে, কাশটা মিস হবে, কি আর করা। ঠিক তখনই বনের ভেতর সিঁথিকে দেখে চমকে উঠেছিল। চমকাবার মতোই দৃশ্য, নিশি পাওয়া মানুষের মতো সিঁথি হাঁটছে, পরনে সবুজ শাড়ি, চুলগুলো এলোমেলো, হয়তো খোঁপা করা ছিল খুলে গেছে, ছড়িয়ে পড়েছে পিঠে, বেশ লম্বাই বলতে হবে, আর মিসমিসে কালো।

ঃ এক্সকিউজ মি, এটাই কি বিশ্ববিদ্যালয়ের পথ? - মিশর ওর চমক কাটানোর জন্যই বেশ জোরে জিজ্ঞেস করে।
কোনও উত্তর নেই। সিঁথি একমনে হাঁটছে, নাকি থেমে আছে। মিশরের চোখেও কি ধাঁধা লেগেছে? হাত তুলে চোখ না কচলালেও মনে মনে ও চোখ কচলে আবারও সিঁথির দিকে তাকিয়ে বলে, “আমি আপনাকেই বলছি, আমি আসলে নতুন ভর্তি হয়েছি, মনে হয় রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি, অনেকক্ষণ ধরে হাঁটছি, কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। আপনি কি আমাকে একটু সাহায্য করবেন?”

এবার সিঁথি সরাসরি ওর দিকে তাকিয়ে এক সঙ্গে হাজার হাজার পাতা ঝরার মতো শব্দে হেসে ওঠে। “সেটা তোমাকে দেখেই বুঝেছি। হারিয়ে গেছো। হারিয়ে যাওয়াতো ভালো, মানুষ চাইলেই তো হারাতে পারে না, এই যুগে আর সে সুযোগ নেই কিন্তু তুমি পেয়েছো, হারানোর সুখটুকু গ্রহণ করো”।

মিশর মনে মনে বিরক্ত হয়। এখনও তাকে দেখলে স্কুলছাত্রের মতো মনে হয় কি? নাহলে মেয়েটা কেন ওর দিকে প্রায় না তাকিয়েই ওকে তুমি করে বলতে শুরু করেছে? আর এটা কি কথা, হারিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই, হারানোর সুখ, ও বলে, “নাহ্ আমার হারিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে নেই, কাশ আছে, প্রথমেই যদি মিস করি তাহলে কেমন হয় বলেন?”

ঃ বুঝেছি, নতুন তো, তাই কাশ মিস দেওয়া মানে মহা অন্যায় মনে হচ্ছে। কিছুদিন পরে তো কাশ মিস দেওয়াটাই নিয়ম হয়ে যাবে। শুরুটা না হয় আজই হয়ে যাক। চলো, আরও সামনে একটা বড় নদী আছে। এখন শুকিয়ে গেছে যদিও, কিন্তু পুরোপুরি শুকোয়নি। দেখতে যাবে?
মিশর মনে মনে আরও বিরক্ত হয়। বাস থেকে নেমে বনের ভেতর দিয়ে হাঁটতে শুরু করেছিল। সঙ্গে যারা ছিল তারা কেউ পিছিয়ে কেউ এগিয়ে। কি ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তাকিয়ে দেখে সঙ্গে কেউ নেই। তারপর হাঁটতে হাঁটতে পা ব্যাথা হয়ে গেলেও যেখানে যাওয়ার কথা সেখানে পৌঁছুনো হলো না। এরপর এই পাগলীর সঙ্গে দেখা, মিশর খুঁজছে ভার্সিটিতে যাওয়ার পথ আর উনি বলছেন, নদীতে যাওয়ার কথা। অন্য সময় হলে মিশরের খারাপ লাগতো না হয়তো, কিন্তু এখন মনটা খিঁচড়ে আছে। তাই ও বেশ কঠিন করেই বলে, “আপনিই যান, নদী দেখে আসুন গিয়ে। আমি দেখি কাশ খুঁজে পাই কি না”।

ও হাঁটতে শুরু করেছিল। কিন্তু ওর পাশে সিঁথি কখন এসে দাঁড়িয়েছে তাও টের পায়নি মিশর। “ক’টা বাজে?”
মিশর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে, সাড়ে এগারো।
ঃ কাশ ছিল ক’টায়?
ঃ সাড়ে দশটায়।
ঃ তার মানে এক ঘন্টা হয়ে গেছে। এর পরের কাশ ক’টায়?
ঃ পরে আর কোনও কাশ নেই।
ঃ তাহলে চলো।

সিঁথি খপ্ করে মিশরের হাত ধরে টানতে থাকে। এবার মিশরও কিছু না বলে হাঁটতে থাকে। হাতটা ছাড়িয়ে নেয় যদিও। ওর সবকিছুই ঘোরের মতো মনে হয়। এই বন, বনের ভেতর হারিয়ে যাওয়া, সিঁথির সঙ্গে দেখা হওয়া, যদিও তখনও পর্যন্ত মিশর নামটি জানে না। সবচেয়ে বড় কথা, শহরের চেঁচামেচি থেকে মাত্র এতোটুকু দূরেই এরকম বন থাকতে পারে সেটাই ওর কাছে বিস্ময়ের ছিল। বন্ধুদের কাছে শুনেছে এই বনের কথা, কিন্তু সেটা যে এরকম, সেখানে যে হারিয়েও যাওয়া যায়, সেটা ওর মাথায় আসেনি। ভেবেছিল, হবে একটু নিরিবিলি পরিবেশ, একটা বড় পুকুর মতো জায়গায় শীতকালে অতিথি পাখিরা আসে, পত্রপত্রিকায় সংবাদ বের হয়, এসবই শুনেছে, কিন্তু সেটা যে এমন, তা মনে হয়নি। এখন সিঁথির সঙ্গে বনের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মিশরের মন ভালো হয়ে যায়। একটু আগে যেখানে রাগ ছিল, হারিয়ে যাওয়ার মতো বোকামির হতাশা ছিল সেটুকু চলে যায়। ও হেসে বলে, “আমার নাম মিশর, আপনার?”

ঃ আমি সিঁথি। ইংরেজিতে পড়ি। সেকেন্ড ইয়ার। তুমি কি পড়তে এসেছো?
ঃ আমি জুওলজি।
ঃ আহ্ আমার প্রিয় সাবজেক্ট, কিন্তু প্রিয় কিছু নিয়ে আমার ঘাঁটাঘাঁটি ভালো লাগে না। তাই অপ্রিয় সাবজেক্ট ইংরেজি নিয়ে পড়ছি।
মিশর অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। ওর সদ্য কলেজ পেরোনো মানসিকতা দিয়ে ও মেয়েটিকে ধরতে পারে না। ও পাশাপাশি হাঁটতে থাকে।
ঃএইতো আর বেশিরদূর নয়, কিছুক্ষণ পরেই নদী।
ঃ আপনি কি প্রায়ই আসেন এদিকে?
ঃ আসিতো, আমার ঘুরতে ভালো লাগে। যদিও বনটা কেমন পুরোনো হয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। সব চিনে ফেললে, চেনার কিছু না থাকলে কি করবো কে জানে? তুমি সিগারেট খাও?
ঃ নাহ্ খাই না। আপনি খান?

মিশর আবারও অবাক হয়। ও শুনেছে ইউনিভার্সিটির মেয়েরা মদ-গাঁজা-সিগারেট এই সব খায়। ছেলেদের কাঁধে হাত রেখে গল্প করে। কিন্তু সেটা যে এভাবে প্রথম দিনই দেখে ফেলবে সেটা ওর কল্পনাতেও ছিল না। সিঁথি কোথাও থেকে সিগারেট বের করে ধরায়, তারপর টান দিয়ে আহ্ বলে শব্দ করে, মিশর এই শব্দ শুধু ওর সিগারেট খোর বন্ধুদের মুখেই শুনেছে। মেয়েরাও তাহলে সিগারেট টেনে একই রকম শব্দ করে? মেয়েদের সম্পর্কে মিশর কতোটুকুই বা জানে, এইতো মাত্র কিছুদিন আগে ওদের বন্ধু ববিন মেয়েদের সম্পর্কে নতুন তথ্য দিয়েছে, মেয়েদের বুকে একবার হাত দিয়ে ফেলতে পারলেই নাকি ওরা সবকিছু করতে দেয়। ছোট্ট বেলায় গল্পে পড়া দৈত্যের মতো, যার চোখে আঘাত করতে পারলেই সে মারা যায় তেমনই মেয়েরাও নাকি বুকে হাত দিলেই একেবারে দুপুরের গোলাপের মতো এলিয়ে পড়ে। ববিন আবার কবিতা লেখে, ও মাঝে মাঝেই কবিতার ভাষায় কথা বলে, এ জন্য ববিনকে নিয়ে হাসাহাসিও কম হয় না। তারপরও মেয়েদের সম্পর্কে ওর অগাধ জ্ঞান বলে সবাই ওর কথা শুনে তাজ্জব হয়ে গিয়েছিল, যে যার মতো করে ভেবেছিল, কার বুকে হাত দেবে, আর বুকে হাত দিয়ে দুপুরের গোলাপের মতো তাকে এলিয়ে ফেলবে। মিশর মনে মনে লজ্জা পেলো এই চিন্তার জন্য।

সিঁথি সিগারেট শেষ করে ওর দিকে তাকিয়ে বলে, “কী ভাবছো অতো? ভয় নেই, আমি তোমাকে খেয়ে ফেলবো না। তোমার চেহারা অমন হয়ে গেছে কেনো? কি ভাবছো, আমি মানুষ না? পেত্নী? এই নাও ছুঁয়ে দেখো আমাকে, ধরো, হাত ধরে দেখো”- সিঁথি ওর ফর্সা, রোদ চিকচিক সোনালী রোম-এর হাতখানা এগিয়ে ধরে মিশরের দিকে। এবার মিশর ভয় পেয়ে যায়। এই হাত ও ধরবে কি করে, কখনও কোনও মেয়ের হাত ধরেনি। ও দাঁড়িয়ে পড়ে, ইচ্ছে করে পেছন দিকে দৌঁড় দেয়। কিন্তু সিঁথিই ওকে ধরে ফেলে, ওর হাতের মুঠিতে নিজের হাত দিয়ে বলে, “ কি আমি ভ’ত না পেত্নী?”

মিশর হেসে ফেলে, সিঁথিও হাসে। বড় বড় গাছ বলে এখানে বাতাস নেই তেমন। বেশ গরমই বলতে হবে। নাকের নীচে সিঁথির ঘাম জমে আছে বিন্দু বিন্দু। ফর্সা মুখ লাল হয়ে আছে রোদে। সবুজ শাড়িটার সঙ্গে লাল মুখখানা দেখে মিশরের কি যেনো মনে হয়, ও এরপর খুব সহজেই সহজ হয়ে যায়। ওরা নদীর কাছে গিয়ে দাঁড়ায়, অনেক খানি শুকনো চর, তারপর একটা ছোট্ট ধারা। সিঁথি বলে, “যাবে জলের কাছে? চলো যাই”- বলেই আর দাঁড়ায় না, পার ধরে নামতে থাকে। পেছন পেছন মিশরও নামে।

বালুর চরে খিরা কিংবা ফুঁটির ক্ষেত। ছোট্ট ছোট্ট গাছে ঝেঁপে ফুল এসেছে, হলুদ আর সাদাটে ফুলে ভরে গেছে জায়গাটা। আশেপাশে কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। মিশরের কেন যেনো খুব ভালো লাগছে। ও ভেবে পাচ্ছে না, এই বিস্ময় ওর জন্য কোথায় লুকোনো ছিল? সিঁথি নদীর পানিতে নেমেছে, স্যান্ডেল খুলে রেখে, শাড়িটা বেশ একটু উঁচুতে তুলে ও পানিতে হাঁটছে। কাঁদা নেই, পা ডেবে যাচ্ছে না, যদিও মিশর ওদিকে তাকাতে পারছে না। লজ্জা লাগছে খুব, এক পলকেই দেখেছে সিঁথির ফর্সা পা, দু’একটা কালো পশম। মনে মনে মিশর কেঁপে উঠেছে। ও তাকিয়ে আছে ফুঁটি ক্ষেতের দিকে। সিঁথি পানিতে নামতে ডাকে, ও বলে, “এখন জুতো খুলতে ইচ্ছে করছে না” - আসলে কথাটা সত্যি নয়, ওরও ইচ্ছে করছে। পায়ের কেডস খুলে ইচ্ছে করছে নেমে যেতে, একেবারে আরও গভীর জলে নামতে, কিন্তু ও দাঁড়িয়ে আছে, একটু নড়ছে না। যেনো ওকে কেউ ওখানেই থামিয়ে দিয়েছে। কিছুক্ষণ পর মিশর ওকে তাড়া দিয়েছে, “চলুন ফিরে যাই, এখান থেকে তো অনেকটা দূর যেতে হবে, তাই না?”

ঃ দাঁড়াও, আর একটু, আহা ইচ্ছে করছে, শাড়ি খুলে রেখে নেয়ে আসি। নাকি শাড়ি ভিজিয়ে ফেলবো?
ঃ না না, আজ নয়। আরেকদিন এসে গোসল করবেন। আজ নয় প্লিজ- মিশর ভয় পাওয়া গলায় বলে।
ঃ আরে, কেন? যেতে যেতোই শুকিয়ে যাবে। কি যাবে না?
ঃ নন্ না শুকোবো না, প্লিজ আজ নয়। আরেকদিন আসবেন, সবাই মিলে।
ঃ সবাই মিলে মানে? তুমি আসবে না? তোমাকে নিয়েই আসবো। বলো আসবে, নইলে এই যে, আমি এুণি পানিতে নেমে গেলাম, বলো, আসবে, আসবে? নাকি ঝাঁপ দেবো।

এবার মনে হয়, সিঁথি সত্যি সত্যি পানিতে নেমে যাচ্ছে। মিশর আরও ভয় পেয়ে যায়, তাড়াতাড়ি বলে, “অবশ্যই আসবো। প্রমিজ আসবো, আপনি উঠে আসুন। আপনি যেদিন বলবেন, যখন বলবেন, আসবো। আজ চলুন”।
মিশরের ইচ্ছে করে ছুটে পালিয়ে যায় এখান থেকে আবার এখান থেকে একটুও নড়ার ক্ষমতা নেই ওর, ওর মনে হয় কে যেনো ওকে আঁঠা দিয়ে এখানে সেঁটে দিয়েছে। সিঁথি জল থেকে উঠে স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে ওর পাশে এসে বলে, “চলো, তুমি কিন্তু কথা দিয়েছো আমাকে এখানে নিয়ে আসবে”। মিশর মনে মনে ভাবে, নিয়ে আসবো মানে? আপনিইতো আমায় নিয়ে এলেন। আমি কি আর আপনাকে নিয়ে আসবো? কিন্তু কিছুই বলে না। সিঁথির সঙ্গে হাঁটতে শুরু করে। ওরা যখন ভার্সিটিতে পৌঁছোয় তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। ক্যাম্পাসটা কেমন নীরব নীরব মনে হয়। কাশ শেষে যারা শহরে থাকে তারা চলে গেছে হয়তো, আর যারা হোস্টেলে থাকে তারা রুমে আছে, বিকেলে আবার বেরুবে। তাও বেশ কিছু ছেলেমেয়ে দেখা যাচ্ছে, এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে।

ঃ ক্ষিদে পায়নি তোমার?
ঃ জি? - সিঁথির আচমকা প্রশ্নে মিশর চমকে তাকায়।
ঃ আরে বাবা ক্ষিদে লাগে নাই নাকি?
ঃ জি, হ্যাঁ, দেখি বন্ধুদের খুঁজে বের করি আগে। তারপর ক্যান্টিনে খেয়ে নেবো কিছু।
ঃ চলো, আমিও যাবো।
ঃ না না আপনি যান, খেয়ে নিন। আমি পরে খেয়ে নেবো।
ঃ পরে কেন? এতোক্ষণ আমার সঙ্গে হেঁটে এখন বুঝি লজ্জা লাগছে? এসো - বলেই আবার সিঁথি মিশরের হাত ধরতে যায়, মিশর ছিটকে সরে বলে, “চলুন, চলুন যাচ্ছি”। ওর ভয় হয় বন্ধুদের কেউ দেখে ফেলবে, সিঁথি ওকে হাত ধরে খেতে নিয়ে যাচ্ছে। তাই তাড়াতাড়ি একটু দূরত্ব রেখে সিঁথির পাশে পাশে হাঁটতে শুরু করে। সিঁথি ওর দিকে তাকিয়ে হেসে দেয়, কি বোঝে কে জানে, বলে, “চলো”।

সেদিন মিশরের ফিরতে ফিরতে রাত হয়েছিল। ভার্সিটি থেকে ছাড়া শেষ বাসে করে শহরে এসে যখন বাসায় পৌঁছেছিল তখনও মনের মধ্যে সারা দিন গুন গুন গলা ভাজছিলো। খেয়েদেয়ে বিছানায় শুয়ে মিশর আবারও ফিরে গিয়েছিল সেই বনে, নদীর পারে। দিনের বেলা যা করেনি, বা যা বলেনি, তাই রাতের বেলা বিছানায় শুয়ে শুয়ে বলেছিল সিঁথিকে।

ঃ সিগারেট খান কেন? মেয়েদের হাতে সিগারেট দেখলে ভালো লাগে না।
ঃ কি বললে? শোভিনিস্টদের মতো কথা বলবে না। মেয়েদের হাতে সিগারেট দেখলে ভালো লাগে না আর ছেলেদের ঠোঁটে সিগারেটের আগুন পৌরুষ বাড়িয়ে দেয়, যত্তোসব আবোল-তাবোল কথা।
ঃ আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন? আচ্ছা ভালো লাগার কথা না হয় বাদ দিলাম। সিগারেট আপনার শরীরের জন্য ক্ষতিকর।
ঃ শোনো সিগারেট শুধু নয়, শরীরের জন্য অনেক কিছুই ক্ষতিকর। কিন্তু আমার যে এসবই ভালো লাগে। আমি গাঁজা খাই, মদ খাই, বন্ধুদের নিয়ে ঘুরে বেড়াই, মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের সঙ্গে আমার মিশতে ভালো লাগে, তাতে তোমার কি? আগ বাড়িয়ে কথা বলতে এসো না।
ঃ আমি আপনাকে রাগানোর জন্য বলিনি, আমার ভালো লেগেছে বলতে, তাই বলেছি। আপনার যেমন এসব করতে বলতে ভালো লাগে, আমার তেমন বলতে ভালো লাগছে। আপনার ভালো লাগাটার মতো আমার ভালো লাগাটাও সত্যি। আপনি আমাকে এভাবে থামিয়ে দিতে পারেন না, আফটার অল ফ্রিডম অব স্পিচ বলে একটা কথা আছে তাই না?
ঃ হা হা হা হা, ফ্রিডম অব স্পিচ, বেড়ে বলেছো তো। তাহলে এই নাও একটা সিগারেট ধরাও, দু’জনে মিলে টানি। দারুণ লাগবে, খেয়ে দেখবে?
ঃ দিন। তবে কাশি বেরুতে পারে, তখন কিছু বলবেন না যেনো।
ঃ বলবোই তো, নাও টানো।
ঃ একি সিগারেটের মধ্যে কি মিশিয়েছেন?
ঃ কি মেশাবো আবার? কিছুই মেশাইনি।
ঃ নাহ্ কিছু একটা মিশিয়েছেন। আমার ঘুম পেয়ে যাচ্ছে খুব।
ঃ শুধুই ঘুম? আর কিছু টের পাচ্ছো না?
ঃ আর কি টের পাবো?
ঃ তাহলে ঘুমিয়ে পড়ো, ওই যে নদী, দেখো বালুর ওপর নয়নজুলি হয়েছে অনেক, মনে হচ্ছে ঘাসের বিছানা। এসো শুয়ে পড়ি পাশাপাশি।
ঃ আসুন শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখি।
ঃ আমি কিন্তু তোমার গায়ে পা তুলে দেবো।
ঃ ইচ্ছে করলে দিন।
ঃ আমি কিন্তু তোমার কানে কানে কথা বলবো।
ঃ বলুন।
ঃ আমি কিন্তু তোমার বুকে হাত বুলিয়ে দেবো।
ঃ দিন।
ঃ তুমি কিছুই করবে না?
ঃ আমি কি করবো?
ঃ তুমি আমাকে চুমু খাবে, আমার ঠোঁট তোমার জিভ দিয়ে চেটে দেবে।
ঃ আপনি যদি কিছু মনে করেন?
ঃ আরে, আমি নিজেই তো বলছি, আবার মনে করবো কেন?
ঃ মাটিতে শুলে আকাশটাকে কেমন বিশাল আর নিজেকে কেমন ছোট মনে হয় তাই না?
ঃ আকাশতো বড়ই। আর আমরাও ক্ষুদ্রই।
ঃ দেখুন, ওই যে, দূরে, ভ’বন চিল।
ঃ তুমি ভ’বন চিল চেনো?
ঃ হ্যাঁ চিনি, আপনি চেনেন না?
ঃ কেউ চেনায়নিতো।
ঃ আসুন আমি চিনিয়ে দেই। আমার দৃষ্টি বরাবর তাকান। ওই যে, উড়ছে, নিশ্চিত, নিঃসঙ্গ।
ঃ নাহ তুমি ভুল করছো, ভূবন চিল আকাশে নয়, এখানে। তাকিয়ে দেখো, ঠিক এখানে।
ঃ ওখানে?
ঃ কান পেতে শোনো, ভূবন চিল পাখা ঝাপটায়।

ভ’বন চিলের পাখা ঝাপটানোর শব্দ শুনতে শুনতে মিশর ঘুমিয়ে পড়ে। সেই ছোট্ট বেলা যখন সারাদিন রূপকথার বই পড়ে রাতে সেই সব স্বপ্নে দেখার অভ্যেস করে ফেলেছিল তেমনই এখনও, আজ সারাদিন যা করেছে, যা করেনি, যা বলেছে, যা বলেনি তাই-ই বিছানায় শুয়ে স্বপ্নের ভেতর টেনে এনে মিশর ঘুমোলো। যদিও অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এই স্বপ্ন আর স্বপ্ন ছিল না, সত্যি হয়ে গিয়েছিল, পুরোপুরি।

মিশর তখন প্রায় পুরোনো হয়ে গেছে ক্যাম্পাসে। হলে তখনও সিট পায়নি, তবে হলে বন্ধুদের সঙ্গে থেকে যেতে কোনও বাঁধা নেই। বাসায় যাওয়া হয় না তেমন একটা। আসলে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নতুন আসা অনেকেরই তো মিশরের মতো অবস্থা। মনে হয়, এ কোথায় এলাম? এতো স্বাধীনতা, এতো মুক্তি, উল্লাস হে উল্লাস। প্রথম প্রথম খুব একটা কাশের চাপও থাকে না। সারাদিন আড্ডা আর আড্ডা, আর এর ওর সম্পর্কে কানকথা। সিঁথি সম্পর্কে কান কথার অন্ত নেই। সবাই ওর সম্পর্কে অনেক কিছুই জানে। এ পর্যন্ত কতো ছেলের মাথা খেয়েছে, রাতে কোথায় গিয়ে থাকে, কেউ কেউ তো বলে সিঁথি নাকি ভাড়া খাটে। তাই হাতে ওর অগাধ টাকা পয়সা। প্রতিদিন নতুন নতুন জামাকাপড় পড়ে। বন্ধুদের দামি ব্রান্ডের সিগারেট কিনে দেয়।

মাঝে মাঝে ওর কাছে গাড়ি করে কে কে যেনো আসে, তাদের সঙ্গে ও কোথাও উধাও হয়ে যায়। আবার ফিরে আসে ক্যাম্পাসে, বনে বাঁদাড়ে ঘুরে বেড়ায়, নদী দেখতে যায়। মিশরের সঙ্গে কখনও দেখা হলে কখনও চেনে কখনও চেনে না। মিশর মনে মনে ভাবে, মেয়েটা সত্যিই পাগল। কিন্তু কেন যেনো সিঁথিকে নিয়ে কানকথাগুলোতে ও কান দেয়নি, ইচ্ছে করেনি। ওর ভেতর সিঁথিকে নিয়ে যে সব কথা আছে, তা ও কাউকে কোনও দিন বলেনি। এমনকি ওর সঙ্গে যে সারাদিন কাটিয়ে এসেছে নদীর পারে সেকথাও নয়। বন্ধুরা কিছু বললে, ও চুপচাপ শোনে। মাঝে মাঝে, দুপুর গড়িয়ে গেলে ও একা একা ক্যাম্পাসের এদিক ওদিক হাঁটে, ঢুকে পড়ে বনের ভেতর, যদি আবার সিঁথির সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। এবার দেখা হলে ও অনেক কথা বলবে, সে রাতে কিংবা তার পর অনেক রাতে সিঁথির সঙ্গে স্বপ্নে যেসব কথা হয়েছে সব বলবে মিশর। মনে মনে ভাবে, কিন্তু সিঁথিকে পাওয়া যায় না। ইচ্ছে করে করিডোরে কিংবা লাইব্রেরিতে সিঁথিকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করতে, “ঘুরতে যাবেন আমার সঙ্গে, সেদিনের মতো?” কিন্তু ঠিক সাহস হয়ে ওঠে না।

সেদিন ধুম বৃষ্টি। ক্যাম্পাসটাকে ভেজা কাকের মতো মনে হচ্ছে। বনের মাঝে ছড়ানো ক্যাম্পাস, বুনো গাছ সব কেটে ফেলে সেখানে ইউক্যালিপটাস কিংবা ওরকম আরও কি কি গাছ যেনো লাগানো হয়েছে। বৃষ্টিতে ভেজা গাছগুলিকে কেমন অচেনা মনে হচ্ছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে এক মনে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে ছিল মিশর। পেছন থেকে কে যেনো ওর পিঠে হাত রাখে এসে। মিশর চমকে যায় খুব, একমনে বৃষ্টি দেখার ফল।
ঃ কি খুব ভয় পেয়েছো?
ঃ নাহ্, কেমন আছেন?

মিশরের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সিঁথি বলে, “ভিজবে? চলো না বনের ভেতরে চলে যাই। জানো তো বৃষ্টি নামলে ঝিলের জল গরম হয়ে যায়। চলো ভিজতে ভিজতে ঝিলের কাছে যাই, চলো চলো” - মিশরের হাত ধরে টেনে বারান্দা থেকে নামিয়ে ফেলে মাঠে। অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে। চারদিকে কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। মিশর ভাবে কেউ দেখে ফেলে কি না আবার। এদিকে অবশ্য হোস্টেল নেই। কাশরুমগুলোর জানালায় কোনও মুখ নেই। সিঁথির অবশ্য এসব নিয়ে ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। ওরা টুক করে ঢুকে পড়ে বনে, একি এখানে বৃষ্টি একেবারেই কম। যদিও ফোঁটাগুলি অনেক বড় বড়। গাছের পাতায় জমা হওয়া বৃষ্টির জল বড় বড় ফোঁটায় মাটিতে পড়ছে। এখনও ভেজেনি মাটি, লাল মাটি ভিজলে আঁঠালো কাঁদা হয়। ওরা দ্রুত হাঁটতে থাকে, ঝিলের দিকে। সিঁথি সামনে, মিশর তো এখনও চেনে না কোন্ দিকে ঝিল।

সিঁথি পরে আছে সাদা স্যালোয়ার কামিজ, লম্বা সুতির ওড়না। ভিজে গেছে জায়গায় জায়গায়। পিঠের ওপর জল পড়ে ভিজেছে অনেক খানি। পাতলা জামা ভিজে শরীরের সঙ্গে লেপ্টে আছে। পেছনে হাঁটতে হাঁটতে মিশর ওর পিঠের ওপর কেটে বসে থাকা সাদা ব্রা দেখতে পায়। হুকের জায়গাটা উঁচু হয়ে আছে। ও চোখ ফিরিয়ে নিয়ে হাঁটে, পেছন পেছন। জঙ্গল যেখানে শেষ হয়েছে ঠিক সেখানেই বিশাল কি যেনো একটা গাছ। মনে হয় কাঠ বাদাম। গাছের শেকড়ে অনেক সময় ছেলেমেয়েরা এসে বসে গল্প করে, বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন জায়গাটা। সিঁথি সেখানে, শেকড়ের ওপর বসে পড়ে, “একটু পরে পানিতে নামি, এখানে বসে বৃষ্টি দেখি এসো।”

ওরা বসে পড়ে শেকড়ের ওপর। মিশর একটু দূরেই বসে। সিঁথি দূরে ঝিলের ওপাশে, জঙ্গল শেষে বেশ বড় খোলা মাঠের ভেতর দিয়ে যে লাল পথটা অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায় সেদিকে দেখিয়ে বলে, “একদিন আমরা ওই গ্রামে যাবো, ঠিক আছে? শুনেছি ওখানে নাকি অনেক বেলুম্বি পাওয়া যায়। কিনে আনবো গিয়ে আমরা একদিন, নিয়ে যাবে?”
ঃ হ্যাঁ, যাবো, কবে যাবেন।
ঃ তুমি যেদিন নিয়ে যাবে।
ঃ বারে আমি নিয়ে যাবো কি, আপনি যেদিন বলবেন, সেদিনই যাবো।
ঃ নাহ্ তুমি বলবে, তুমি নিয়ে যাবে।
ঃ আচ্ছা তবে, পরের শুক্রবার। সেদিনতো ছুটি থাকবে। আমরা সকাল সকাল বেরিয়ে পড়বো। সারাদিন ঘুরে ফিরে সন্ধ্যের দিকে হলে আসবো। ঠিক আছে?
ঃ যদি না ফিরি? যদি সেই সন্ধ্যায় ফিরতে ইচ্ছে না করে?

এবার মিশর কি বলবে, ভেবে পায় না। ও তাকিয়ে থাকে সিঁথির দিকে। বৃষ্টিতে ভিজে চুলগুলো লেপ্টে আছে। একি সিঁথির চুল ছোট কেন? সেদিন না চুল দেখেছিল পিঠ পর্যন্ত লম্বা। মিশর ওর মনে আসা এই প্রশ্ন লুকোতে পারে না, “আপনি চুল কেটে ফেলেছেন?”
ঃ হ্যাঁ, খারাপ লাগছে?
ঃ নাহ্ সেটা বলিনি, মানে কখন কেটেছেন লক্ষ্য করিনি।
ঃ তুমি আমাকে লক্ষ্য করো নাকি?

এবারও মিশর চুপ করে যায়। বৃষ্টি যেনো আরও ঝেঁপে নামছে। একটানা ঝিঁঝিপোকার মতো শব্দ হচ্ছে চারদিক। কেমন যেনো অন্ধকারও হয়ে আসছে। মিশরের কেমন যেনো লাগছে। শেকড়ের ওপর বসে থাকা সিঁথিকে ওর কপালের ওপর লেপ্টে থাকা চুল, বুকের ওপর ভেজা ওড়না, সব মিলিয়ে অচেনা মনে হচ্ছে খুব। এমনই কি হয়? সময় পরিবেশ কিংবা অন্য কিছু মানুষকে একেবারে বদলে অচেনা করে দেয়? মিশর মনে মনে ভাবে। হঠাৎ লক্ষ্য করে সিঁথি ওর খুব কাছ ঘেঁষে বসে। ওর একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে খেলছে একমনে। মিশর কেঁপে ওঠে আমূল। সবকিছুই যেনো কেমন কাঁপিয়ে তোলার মতো।

সিঁথির একটা হাত ওর ভেজা চুলের মধ্যে বিলি কাটছে, আরেক হাত ওর বুকে, খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে আঙুল বোলায়। তারপর যে হাত চুল বিলি কাটছিলো সেই হাতের আঙুলগুলো ওর চুল টেনে ধরে ধীরে ধীরে ওকে সিঁথির দিকে ঝুঁকিয়ে আনে। মিশর ন্যুয়ে পড়ে সিঁথির মুখের ওপর, সিঁথির ঠান্ডা ঠোঁটের ওপর ওর গরম ঠোঁট চেপে বসে, মিশরকে বসাতে হয় না, ও এমনভাবে মিশরকে টেনে আনে যেনো ওর ঠোঁট আর কোথাও সরে যাওয়ার কোনও সুযোগই ছিল না। বুক আর মুখের ওপর ঘোরাফেরা করা হাতখানা মিশরের আরেকটি হাত নিয়ে এসে সিঁথির বুকের ওপর বসিয়ে দেয়। মিশর টের পায় ওর হাতের পাতার নিচে লক্ষ লক্ষ মোম গলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে গলে যাওয়া মোমের ধারা নেমে যাচ্ছে সিঁথির পেট বেয়ে আরও নীচে, আরও নীচের দিকে।

বৃষ্টি বাড়ে, বাতাস বেড়ে ঝড়ের মতো হয়ে যায়, যদিও বাতাসে তীব্র ওম, শরীর ঝলসে দেওয়ারই মতো প্রায়। অতঃপর ঝড় শেষে যে মুশল ধারার বৃষ্টি তাও ঝিলের জলের চেয়ে উষ্ণ, যদিও টগবগ করে ফোটে না। ওরা শুয়ে থাকে, এই ওম শরীরে জড়িয়ে, গাছের গুড়িতে হেলান দিয়ে। এবার মিশরের বুকের ওপর সিঁথির মাথা, মিশরের হাত সিঁথির ছোট ছোট চুল নিয়ে খেলা করে। অনেকক্ষণ, ততোক্ষণ, যতোক্ষণ না ওরা মনে করে ওদের ফিরতে হবে, ওরা ফিরে আসে। সিঁথির জামায় জমে থাকে কাঁদা, মিশরের জিন্সের হাঁটুতে, কনুইতে, আরও অনেক জায়গায়। মিশর মনে মনে ভাবে, এই কাঁদা ও কখনওই ধোবে না, কোনও দিন না। রেখে দেবে, চিরদিন, যতোদিন রেখে দেওয়া যায়।

“সিঁথির বাচ্চা হবে” - ক্যাম্পাসে সবার মুখে মুখে ফেরে কথাটা। কে এই বাচ্চার বাবা? এ নিয়েও অনেক গবেষণা, অনেক তত্ত্ব। অরুনিমা দেখেছে সিঁথিকে বমি করে ঘর ভাসিয়ে দিতে; রুখসানা লক্ষ্য করেছে সিঁথির নাকি মাসিক বন্ধ হয়ে গেছে। এর আগে সিঁথি প্রায়ই প্যাড কিনতে ভুলে যেতো, বার বারই রুখসানার কাছ থেকে ধার নিতো, গত দু’মাস সিঁথি রুখসানার কাছে প্যাড চায়নি। ওর মুখচোখ একটু ফোলা ফোলা মনে হয় না? ওর হাটার ভঙ্গি একটু ভারি ভারি নয় কি? আরে সেদিনইতো দেখলাম ক্যান্টিনে ফিস কাটলেট নিলো, তারপর ক্ষেতে না পেরে পুরো কাটলেটটা প্লেটে রেখেই উঠে গেলো দুড় দাড়, নিঃশ্চই বমি করতে গিয়েছে। মেয়ে মহল থেকে ছেলে মহল, তারপর সারা ক্যাম্পাস ছড়িয়ে যায়। কোনও কোনও সাংবাদিকও নাকি এসব নিয়ে প্রশ্ন করতে চায় সিঁথিকে, কিন্তু ঠিক সাহসী হয়ে উঠতে পারে না।

মিশরও শুনেছে। ও বুঝতে পারে না কি করবে, কি করা উচিত ওর। ও কি সরাসরি সিঁথিকে জিজ্ঞেস করবে? আবার ভাবে, সিঁথি নিশ্চয়ই ওকে বলবে, যদি বলার ইচ্ছে হয়। তারপরও সব মিলিয়ে মিশরের কিছুই ভালো লাগে না। পরীক্ষা এসে গেছে, ইয়ার ফাইনাল। লেখাপড়া করতে ইচ্ছে করে না। বই নিয়ে বসলেই সেই ঝড়, বৃষ্টি, কাঠ বাদাম গাছ, ফাঁকা মাঠ, হাতের নিচে সহস্র গলে যাওয়া মোমের উষ্ণতা সব মনে পড়ে, মিশর কেমন যেনো হয়ে যায়। তবে এটা ঠিক, আজকাল সিঁথি রুম থেকে খুব কম বের হয়। গাড়িটাও আসে না, অনেকদিন। কি হলো সিঁথির?
ঃ তোমার সমস্যা কি? বলোতো? এসব কি শুনছি তোমার সম্পর্কে - ফিফথ্ ইয়ারের বাসন্তি, ছাত্রনেতা, সিঁথির বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে ওর চোখে তাকিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করে।

হঠাৎ এই প্রশ্নে সিঁথি খেই হারিয়ে ফেলে। কি ভাবছিলো কে জানে, অনেক কষ্টে নিজেকে সেখান থেকে বের করে এনে বলে, “জি?”
ঃ এসব কি শুনছি তোমার সম্পর্কে? সত্যি হলে বলো, ব্যবস্থা নিতে হবে না? হলের বদনাম হবে তো। তোমাকে তো বেরও করে দিতে পারে।
ঃ কি শুনেছেন? - সিঁথি তখনও ঘোরের মধ্যেই।
ঃ বুঝতে পারছো না কি শুনেছি? তোমার নাকি বাচ্চা হবে?
ঃ হ্যাঁ হবে। তো?
ঃ ওমা এই মেয়ে বলে কি? বাচ্চা হবে মানে? সত্যিই বাচ্চা হবে? - বাসন্তির গলার স্বর বাড়তে থাকে। অন্য মেয়েরাও আশে পাশে ভিড় করে। “শোনো তোমরা এই মেয়ে কি বলছে। এই তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? কে? কে তোমার সর্বনাশ করেছে?”

সিঁথি বাসন্তির মুখে এই ডায়লগ শুনে হেসে ফেলে। পুরোনো বাংলা সিনেমার মা-মাসিদের মুখে বিলাপের মতো শোনায় বাসন্তির শেষ বাক্যটা। হেসে হেসেই সিঁথি বলে, “কেউ আমার সর্বনাশ করেনি। আপনি একে সর্বনাশ বলছেন কেন? আমার সর্বস্ব তো আছে, বিনাশ হয়ে যায়নি, আমি তো বেঁচে আছি”।

বাসন্তির হয়তো ইচ্ছে করে সিঁথির গালে কষে একটা চড় মারতে কিন্তু ও নিজেকে সংযত করে। তারপর বলে, “এখন ঘুমোও, কাল হাউস টিউটরের সঙ্গে আমি এ নিয়ে কথা বলবো। আমি জানি না, কি হবে তারপর। মেয়েরা তোমরা এখন যাও। এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? লেখাপড়া নেই?” যেনো লেখাপড়াটা অত্যন্ত জরুরী কিছু, এই মুহূর্তে সেটা না করলে পৃথিবী উচ্ছন্নে যাবে। সবাই বাসন্তির কথা মেনে নিয়ে ভালো ছাত্রীর মতো যার যার রুমে চলে যায়। কিন্তু রুমে গিয়ে শান্তিতে থাকতে পারে না। এক হোস্টেল থেকে নিমিষে বার্তা চলে যায় আরেক হোস্টেলে। মেয়েদের কাছ থেকে ছেলেদের কাছে, এতোদিন যা গুজব হিসেবে সবার কাছে ফিসফাসের বিষয় ছিল, সেটাই হয়ে যায় ভয়ঙ্কর এক সত্যি। কয়েকটি মেয়ে মিছিল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সেই সন্ধ্যা রাতেই, পোস্টারে ওদের কমিটির নাম 'পাপমোচন ছাত্রী সমাজ'।

অতো তাড়াতাড়ি ওরা পোস্টার পেয়েছিল কোথায় কে জানে? ওদের কি ওরকম কিছু পোস্টার তৈরিই থাকে? কে জানে।

সিঁথিকে বহিষ্কার করতে হবে, তার আগে শরীয়ত মতে তার বিচার হতে হবে। সে রাতে অবশ্য সম্ভব হয়নি, পরের দিন সকালেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিরা সিঁথির কাছে সবকিছু জানতে এসে দেখে ও খুব ভোরে বেরিয়েছে, প্রতিদিন যেমন বের হয় তেমনই। ঘরের মধ্যে সব জিনিসপত্র যেমন ছিল তেমনই আছে, তার মানে ফিরে আসবে। আরে এখনই তো পরিষ্কার হয়েছে, প্রতিদিন কেন বনে হাঁটতে যেতো। নিশ্চয়ই ওখানে কারো সঙ্গে ওইসব করতো। হলে বসেই ছেনালি করতো তাহলে! কয়েকটি উৎসাহি মেয়ে সিঁথির স্যুটকেস খুলে ফেলে। কেউ কেউ খোঁজে ডায়েরী, কেউ বা ওর বিছানার নীচে কোনও চিঠিপত্র আছে কিনা সেসব খোঁজে, আর সাংবাদিকরা দাঁড়িয়ে থাকে হোস্টেলের গেটের সামনে। কখন ফিরবে সিঁথি, তারপর ঝাঁপিয়ে পড়বে প্রশ্ন নিয়ে। টিভি ক্যামেরাও এসেছে মনে হয়। ক্যাম্পাসে তীব্র উত্তেজনা। ওদিকে দুপুর প্রায় হয়ে যাচ্ছে, এখনও সিঁথি ফেরেনি। পালালো নাকি? এরকম প্রশ্নও ধীরে ধীরে উচ্চারিত হয়। কিন্তু জোর দিয়ে নয়।

কিন্তু বিকেল তিনটে কি চারটের দিকেও যখন সিঁথি ফিরলো না তখন অনেকের মনেই আর কোনও সন্দেহ রইলো না যে, সিঁথি পালিয়েছে। শুধু মিশরের কেন যেনো মনে হচ্ছিলো কোথাও কোনও একটা কিছু হয়েছে। মিশর চেয়েছিল সকালে সিঁথির সঙ্গে দেখা করবে, কিছু একটা বলবে। কি বলবে সেটা ভাবেনি। কিন্তু বলতে চেয়েছিল। কিন্তু ওদের হোস্টেলের সামনে অনেক ভিড়। একেক জন একেক কথা বলছে। কেউ বলছে ভেতরেই আছে, হাউস টিউটরের বাসায়। কেউ বলছে সকালে একটা গাড়ি এসে নাকি সিঁথিকে নিয়ে গেছে। মিশর বুঝতে পারছিলো না কি করবে। তারপর যখন শুনলো যে, সকালে বেরিয়েছে তখনও ফেরেনি। তখন ওর মনে হয়েছিল, হয়তো সিঁথি ওর জন্য বনের ভেতর কোথাও অপেক্ষা করছে। ও বন্ধুদের কাউকে না বলে একা একাই ঢুকে পড়ে বনের ভেতর। প্রথম দিনের মতো ওর ইচ্ছে করে সবকিছু থেকে হারিয়ে যেতে এবং তারপর সিঁথির সঙ্গে দেখা হলে ওকেও নিয়ে এখান থেকে অনেক দূরে কোথাও চলে যাওয়ার কথা মনে মনে ভাবে মিশর।

হাঁটতে হাঁটতে কতোদূর এসেছে ও বুঝতে পারে না, কোনও দিকও ঠিকঠাক নেই। আসলে ও এই বনে আর একা কখনও হাঁটতে আসেনি, সিঁথিই ওকে এই বনটা চেনাবে, এই ধারণা নিয়েই ছিল ও। ওদের যাওয়া কথা ছিল দূরের সেই গ্রামে, বেলুম্বি আনতে। এখনও যাওয়া হয়নি। আর যাওয়া হবে কি? কী হলো এসব? মিশর ভাবতে ভাবতে হাঁটে, হঠাৎ ওর মনে হয় পাশের ছোট্ট ডোবায় কী যেনো ভাসছে। পানিটা ঘোলা, তার ভেতর হাল্কা লাল কিংবা গোলাপী কিছু একটা, ডোবার পারে কাঁদার ভেতর অনেক জুতোর ছাপ। মিশর সেদিকে না তাকিয়েই প্রচণ্ড চিৎকারে পৃথিবীর সমস্ত মানুষ জড়ো করে ফেলতে চায়। ওর মনে হয়, ওই ডোবার ভেতরেই সিঁথি আছে। ও দৌঁড়–তে থাকে, কোনদিকে ও নিজেও জানে না। মিশরের মনে হয়, আর কোনও দিন এই পথে, এই বনে, এখানে ফিরে আসবে না। কোনও দিন না।

পরের দিন ভোরের কাগজগুলোতে রঙিন ছবি ছিল, সিঁথির পান্ডুর শরীর, অসংখ্য জোঁক ওর শরীরে সেঁটে আছে। কে বা কারা সিঁথিকে ধর্ষণের পর হত্যা করে ওই ডোবায় ফেলে রেখেছে। ঘটনাটি হয়তো সকালেই ঘটেছে কিন্তু এই মেয়ের চরিত্র সম্পর্কে ক্যাম্পাসে নানা রকম খবর, তাই হয়তো রাতেও ঘটতে পারে। সংবাদপত্রগুলোর একেকটিতে একেকরকম খবর, কোনওটির সঙ্গে যেনো কোনওটির মিল নেই।

অনেকদিন এই বনে কেউ হাঁটেনি, পুলিশ হাঁটতে দেয়নি। বলেছে তদন্তকাজ চলছে। কে জানে তদন্ত রিপোর্ট কি ছিল? তবে পথ খুলে যায় আবার, কিছুদিন পরেই, আবার ছেলেমেয়েরা বাস থেকে নেমে এই বনপথ দিয়ে শটকাট মারে। আর এ পথে হাঁটতে গেলেই বছরের এক বিশেষ সময়ে পাওয়া যায় অদ্ভ’ত এক মিষ্টি গন্ধ। যারা এখানে নতুন এসেছে তারা জানতে চায় এই সুগন্ধের উৎস কি আর যারা এখানে ছ’মাস কি এক বছরের পুরোনো তারা এই সুগন্ধর সঙ্গে এক ধরনের ভয় জড়ানো শ্রদ্ধায় স্মরণ করে কাউকে; কিংবা আরও অনেক কিছু মনে পড়ে তাদের। বহুদিন হলো, তবু সুগন্ধ ঠিকই ভাসে, বাতাসে, রোদে কিংবা ছায়ায়।


মন্তব্য

মাসুদা ভাট্টি এর ছবি

লেখাটি বোধ করি দ্যাখা যাচ্ছে না, কেউ কি জানাবেন কেন এমনটা হচ্ছে?

হিমু এর ছবি

আমিও দেখতে পাচ্ছি না। কোন বাগ সম্ভবত। কিছুদিন আগে সবুজ বাঘের পোস্টেও এমন হচ্ছিলো।

বিটিভির মতো বলি, সম্প্রচারে বিঘ্ন ঘটায় আমরা দুঃখিত। অনুগ্রহ করে একটু অপেক্ষা করুন।


হাঁটুপানির জলদস্যু

মাসুদা ভাট্টি এর ছবি

একি পোকা-মাকড়ও বেছে বেছে আমাকেই. .. ..
যাকগে, অপেক্ষা করা হবে, কী আর করা!

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

ঠিক করে দিয়েছি। অনেক বড় লেখাতো এইকারনে লেখার মাঝে মাঝে ব্ল্যাঙ্ক লাইন দিতে হয়। কতগুলো ব্ল্যাংক লাইন দিতেই ঠিক হয়ে গেল।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

সুমন চৌধুরী এর ছবি

এইবার বুঝলাম ঝামেলাসমুহের ইতিকথা



ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

মাসুদা ভাট্টি এর ছবি

ধন্যবাদ মাহবুব, অনেক কষ্ট হলো কি?
নিশ্চয়ই হয়েছে, অবশ্য এটুকু বোধ হয় প্রাপ্য ছিল, কি বলেন?
ভালো থাকুন। শুভেচ্ছা।

rini এর ছবি

bhalo laglo...

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

পড়লাম।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।