মানুষ খুনের প্রশিক্ষণ নিয়ে কি গণতন্ত্র বাঁচানো যায়?

মাসুদা ভাট্টি এর ছবি
লিখেছেন মাসুদা ভাট্টি (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৩/০৮/২০০৭ - ৩:৫১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমরা একটি ভয়ঙ্কর দুঃসময় অতিক্রম করছি। মানুষ হত্যার প্রশিক্ষণ নিয়ে যে গণতন্ত্রের ধারক হওয়া সম্ভব নয় তা আবারও প্রমাণিত। এখন প্রশ্ন হলো, এর শেষটা কি? আমাদের রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞগণ একেকজন একেকরকম মত পোষণ করছেন, আমরাও পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি হাইপো-থিসিস দাঁড় করাতে পারি মাত্র, কিন্তু তাতে ভবিতব্য বদলাবে কি? মনে হয় না।

দেশে বন্যা, মানুষ না খেয়ে মারা যাচ্ছে, গত সাত/আট মাসে দেশে এক দানা শষ্য আমদানী হয়নি, ব্যাবসায়ীদের রাখা হয়েছে ত্রাসের মধ্যে, ফলে দেশ মুখোমুখি হতে যাচ্ছে খাদ্য সংকটের। এরকমটা বুঝতে পেরে সেনা প্রধান ব্যাংকারদের ডেকে কড়কে দিয়েছেন যাতে ব্যবসায়ীদের কিছু না বলা হয়। কিন্তু তাতে কিছু এসে যায় না, ক্ষতি যা হওয়ার হয়েছে। খাদ্য মওজুদ না থাকা, বন্যা,বিশ্ব পূঁজি বাজারে যে ধস নেমেছে তার ছোঁয়া থেকে বাংলাদেশও মুক্ত নয়, দেশের জনপ্রিয় ধারার রাজনীতিকে নষ্ট করে তাদের পছন্দমতো নতুন রাজনৈতিক প্ল্যাটফরম তৈরি করতে গিয়ে যে লেজে-গোবরে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তা বাকি সবগুলো সমস্যাকে ছাড়িয়েছে। এমতাবস্থায় আগামি কয়েক মাস যে সরকারের জন্য ভয়ঙ্কর তা আঁচ করেছেন অনেকেই, আমরা উপদেষ্টা কারো কারো মুখে আগাম শুনেছি ব্যর্থ হওয়ার সতর্কবার্তা। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট্ট ঘটনাকে এরকম বাড়তে দেওয়ার পেছনে এবং এই বাড়াবাড়ি সামাল দিতে আরও কঠোর হওয়ার পরিকল্পনা সত্যি সত্যিই যে একটি বড় ও ভবিষ্যত ছকের অংশ তা মোটামুটি স্পষ্ট। হ্যাঁ সবকিছু হয়তো পরিকল্পনা-মাফিক হয়নি, কিন্তু এর অনেকটাই তারা হতে দিয়েছে এবং পরিণতি সম্পর্কে আগাম ছক কেটে রেখেছে। নইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের হাতে সেনা বাহিনীর সদস্যের নাজেহাল হওয়ার দৃশ্য গণমাধ্যমে প্রচার হতে দেওয়া হতো না। সেনা বাহিনীকে এভাবে দৃশ্যতঃ খাঁটো করার পেছনের চক্রান্তটা কি ধরা যাচ্ছে?

যদি তাতেও বোঝা না যায় তাহলে আরও একটি তথ্য, সেটি হচ্ছে স্বাধীনতার পর এই প্রথম বাংলাদেশে সচিবালয় পর্যন্ত বন্ধ রাখা হচ্ছে। সেনা শাসিত সরকারের আমলে এমন ছোটখাটো বিপ্লব হয়েছে অনেক কিন্তু কখনওই সচিবালয় বন্ধের ঘটনা ঘটেনি। তাহলে এখন এমন কোন্ নিগূঢ় কারণে সচিবালয় বন্ধ রাখা হলো? বোজহ মন, খোঁজো তার সন্ধান।

আরও একটি বিষয় আমার নিজের মনে হচ্ছে,বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সমর্থন কিংবা চালানো সবই বাংলাদেশ সেনা বাহিনীর জন্য একটি বড় ল্যাব টেস্ট। এই সরকারের পরিণতির ওপর নির্ভর করছে সেনা বাহিনীর ভবিষ্যত। অনেকেই একথা আমরা বলি যে, এই সেনা বাহিনী আর পঁচাত্তরের সেনা বাহিনী এক নয়, কথাটা আংশিক সত্যি। এরা প্রশিক্ষিত হয়েছে পঁচাত্তরের ঘাতকদের দ্বারা, ফলে তারা দু'দু'জন রাষ্ট্রপতিকে হত্যার ধারাবাহিকতা থেকে খুব একটা বেরুতে পেরেছে বলে ভাববার কোনও কারণ নেই। তাদের আচার-আচরণ দেখলেই বোঝা যায়, ক্যান্টনমেন্ট-কেন্দ্রিক রাজনৈতিক দল এবং জনপ্রিয় ধারার রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আচরণের ভিন্নতাও লুকোনো কোনও ব্যাপার নয়, হয়তো এবার তারা কোনও রক্তপাতের ভেতর যাবে না শেষ পর্যন্ত বড় প্রয়োজন না হলে। কিন্তু তারা এটুকু বুঝেছে যে, পঁচাত্তরের আর এখনকার জনগণে পার্থক্য রয়েছে বিস্তর। জনসচেতনতাকে তারা যে ভয় পায় তাও আমরা দেখতে পাচ্ছি। এই সচেতনতাকে যদি তারা অতিক্রম করতে না পারে তাহলে তাদের লাভের গুড় পিঁপড়েয় খাবে। বিশেষ করে বাজেটের, বিদেশি সাহায্যের যে বিশাল অংশ তাদের ভাঁড়াড়ে যায় তা যদি হাতছাড়া হয় তাহলে সেনা বাহিনীতে যাওয়ার উদ্দেশ্যই যে মাটি হয়ে যায়? জনগণ যদি এই সত্যটি জানতে পারে যে, যে প্লেটটিতে করে একজন সেনা কর্মকর্তা ও তার পরিবারের সদস্যরা খাবার খায় সেটিও একজন কৃষকের ঘাম-ঝরানো টাকায় কেনা তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুটবল খেলার সময় ঘটে যাওয়া ঘটনা সারা দেশে বিস্তৃত হবে না - একথা হলপ করে বলা যায় না।
দেশকে রক্ষার ছুঁতোয় দেশকে ক্রমাগত ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাওয়াই যে সেনা বাহিনীর ভূমিকা এটা পঁচাত্তরে বোঝানো যায়নি ঠিকই, কিন্তু এখন সেটা মানুষ পুরোপুরি বুঝতে না পারলেও কিছুটা আন্দাজ করকে। যে কারণে সেনা বাহিনীর পোষ্য ফরহাদ মজহাররা আগে থেকেই সতর্ক করে দিয়েছে সেনা বাহিনীকে, বুঝিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের সেনা বাহিনীর বিরুদ্ধে জনগণ খেপিয়ে দিয়ে কোন্ বিদেশি শক্তির সবচেয়ে বেশি লাভ ইত্যাদি সমীকরণ (নয়া দিগন্তে মাস খানেক আগে প্রকাশিত ফরহাদ মজহারের লেখা দ্রষ্টব্য)। এখন আমরা যারা সেনা বাহিনীর এই জোঁক-ভূমিকাকে ঘৃণা করি তাদের উচিত হবে এই বিষয়টিকেই বার বার স্পষ্ট করে বলা যে, রাষ্ট্র ক্ষমতায় যতোদিন এই প্রশিক্ষিত অস্ত্রধারীদের ভূমিকা থাকবে, যতোদিন গণতন্ত্রকে বাঁচাতে এই মানুষ খুনের প্রশিক্ষণগ্রহণকারীদের এগিয়ে আসার সম্ভাবনা থাকবে ততোদিন বাংলাদেশ এবং বাঙালির মুক্তি নেই, গণতন্ত্রতো দিল্লি দূর অতি অস্ত!
আসুন বিষয়টি নিয়ে ভাবি এবং নিজেদের মধ্যে কথা বলি।


মন্তব্য

সুমন চৌধুরী এর ছবি

ফরহাদ মজহারের গতপরশুদিনের লেখাটাও নির্জলা দালালি। নয়া দিগন্ত পড়ি না এমনিতে। আজ সকালে সামহোয়ারে কার যেন দেওয়া একটা লিঙ্ক ফলো করে দেখলাম লেখাটা। একটা ব্যাপার আমার মনে হয়, মজহার সাহেবকে এক্সপোজ করার ফিকিরে তিনি জনপ্রিয় হতে পারেন। তার প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেলেই ভালো। নয় দিগন্ত এমনিতেও খুব পঠিত পত্রিকা নয়।

মজহারনামা থেকে সরে আসি। এখন আমাদের আসলে খুব বেশী প্রয়োজন সমর,সামরিক বাহিনি এবং সামরিক শাসন প্রসঙ্গে বেশী করে আলোচনা। তত্ত্বীয় এবং অভিজ্ঞতা বিশ্লেষন দুটোই খুব বেশী করে হওয়া প্রয়োজন।
.......................................
ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

Himu এর ছবি

Na kotha bolbo na. Kotha sunbo na. Kotha bujbo na. Onek sunachi. Onek bolechi. Onek bujachi. Ekhon biplober shomoi. Ekhon desha muktow korbar shomoi.

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

সুমন চৌধুরীর সাথে একমত।
কিন্তু এ মুহূর্তে দুইটা ষড়যন্ত্রের কথা বাতাসে ভাসছে:

১. সেনাশাসনের দিকে দেশকে ঠেলে দিতে চাইছে একটি গোষ্ঠী। সেটি বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর একটি অংশের সমর্থনে মৌলবাদী একটি দল।

২. সেনাশাসন আসুক সেই গুটি নাড়াচ্ছে প্রতিবেশি দেশ।

এই দুই গুজবের ভিত্তিটা হচ্ছে এই যে, বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে সেনাশাসন অনেকের কাছেই যুক্তিযুক্ত মনে হচ্ছে।
কিন্তু হিসাব বলে সেনাবাহিনী এই অবস্থায় ক্ষমতায় আসতে চাওয়ার কথা না। তাদের সব টেস্ট কেস ফেইল করেছে।

ষড়যন্ত্রের কারণে হোক আর স্বেচ্ছায়ই হোক সেনাবাহিনীর ক্ষমতাদখলে আসার কোনো যৌক্তিকতা নাই। শুধু দেশের চাকাটাকাকে থমকে দেয়া বা পেছনের দিকে চালানো ছাড়া তারা কিছুই করতে পারে না। পারার কথা না।
-----------------------------------------------
সচল থাকুন ---- সচল রাখুন

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

সুমন চৌধুরী এর ছবি

ঠিক একতলীয় জ্যামিতির সরলরেখায় না হলেও ঝুনঝুনওয়ালা-কাপুর-আগারওয়ালদের সাথে সামরিক শাসনের মূল স্পন্সর আর ধর্মীয় ফ্যাসীবাদীরা একই টিউনে অবস্থান করেন। এইবার সরসরি মাশাল ল হইলে বরাবরের মতো সবচাইতে বেশী লাভ জামাতের। গো আ পুত্র লাইম লাইটে আসতে পারে। আর আইসা....
.......................................
ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

জলপাই আসতে থাকবে, জনগণ আবারো বাধ্য হয়ে ফিরে যাবে করাপ্টেড পলিটিশিয়ানদের কাছে। গণতন্ত্রের স্বপ্ন গণতন্ত্রই থাকবে।

বুঝি না, পুরো ব্যাপারটা জনগণের ওপরে ছেড়ে দিলে সমস্যা কি।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

অতিথি এর ছবি

I'm not sure how else the army has to come to power? Don't you think they are running the country since 1/11? I think the most positive side of the incidents over the last three days is that now the mask (Mukhos) of so called "caretaker, civilian govt." will fall off which will pave the way to anti-military rule movement in Bangladesh. This is unfortunate that we run into the same circle every so often. But that's the truth.

মেঘ এর ছবি

মেঘ
এই দুষ্টচক্রের হাত থেকে মুক্তি নেই। সহজ বাংলায় একটা জিনিস বুঝি সেনাবহিনীর পেছনে খরচ না করে এদের সীমিত করে পুলিশের পেচনে টাকা ঢালা দরকার। সেনাবহিনী কোনকালেই আমাদের কোন কাজে আসে নাই আগামীতেও আসবে না। পারলে ট্যাক্স ভ্যাট কিছু দিতাম না। আমার টাকায় আমি আর সেনাবহিনী পুষতে চাই না।

মেঘ

হাসান মোরশেদ এর ছবি

অতিথির মন্তব্যের সাথে পুরো সহমত ।
এই আন্দোলনের সাফল্য এটাই-তথাকথিত ভদ্রলোকদের সরকারের মুখোশ খুলে দেয়া ।

সামরিক সরকার তো সামরিক সরকারই, তার আবার এতো ছলাকলা রংঢং কিসের?

-----------------------------------
'আমি ও অনন্তকাল এইখানে পরস্পর বিস্ময়ে বিঁধে আছি'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।