এক টুকরো শৈশব-৫

মেঘা এর ছবি
লিখেছেন মেঘা [অতিথি] (তারিখ: রবি, ০৩/০৩/২০১৩ - ৬:২৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

[জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে নিজের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আমার এই ছেলেমানুষি লেখা দেবার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আমার নিজের মন ভাল করার জন্যেই আমি বেশির ভাগ সময় লিখি এই শৈশব কথন। অনেকদিন কিছু লিখি না। আজকে একটু লিখতে ইচ্ছে হলো অনেকদিন পর। তাই শৈশব লেখা দিয়েই শুরু করলাম আবার। সবাই ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করছি।]

ট্রেন ভ্রমণ

অজানা কারণে আমি ছোটবেলায় রিক্সা খুব ভয় পেতাম। রিক্সায় চড়লেই আমি ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে আধমরা হয়ে যেতাম। একেবারে যখন ছোট ছিলাম, কথা বলতে পারতাম না, তখন তো আর বলতে পারতাম না যে আমি রিক্সার জন্য ভয় পাই। যখন কথা শিখেছি তখন রিক্সায় চড়লেই কাঁদতাম আর বলতাম ‘মই (মরে) যাবো!’ এটা আমার একেবারে মুদ্রাদোষ ছিল বলা যায়। গভীর দুঃখে, বেদনায় আমি সব সময় বলতাম মই যাবো। যে শুনত সেই বলত ‘বালাই সাঁট মরবে কেন মা?’ আমি বোধ হয় জন্মেই বুঝে গিয়েছিলাম পৃথিবীতে এসেছি মরার জন্য। অভ্যাস এখনো আছে। মন খারাপ হলে, কষ্ট পেলে এখনো বলি মই যাবো! আমার এই ভয়ের কারণে আমাকে নিয়ে কোথাও যাওয়া আব্বু আম্মুর জন্য ছিল ভীষণ যন্ত্রণা।

রাজশাহী থেকে আমাদের নানাবাড়ি ঈশ্বরদী যাতায়াত নিয়মিত ছিল। আম্মু মাঝে মাঝে একাই আমাদের নিয়ে চলে যেত। ট্রেনে করে যাওয়া খুব পছন্দের একটা ব্যাপার ছিল আমার কাছে। ট্রেনে উঠতে আমার খুব ভাল লাগত। একটুও ভয় লাগত না। যেখানে কিনা রিক্সায় উঠে আমি ভয়ে আধমরা হয়ে যেতাম আশপাশ দিয়ে পার হয়ে যাওয়া সব গাড়ি, রিক্সা আমার গায়ে উঠে যাবে চিন্তা করে। আমাদের নিয়ে প্রত্যেকবার এই যাতায়াত ছিল একেকটা কাহিনী! প্রত্যেকবার আমাদের জন্য অবধারিত ভাবে একটাই বাণী আব্বু দিত “এরা কি মানুষ?!” আশ্চর্য ধরণের কথা! মানুষ না তো কি ভূত?!

সেইসব ট্রেন ভ্রমণে কেউ না কেউ হয়ে যেত আমাদের মামা না হলে খালা আর বয়স্ক কেউ থাকলে হতো নানা। কেন যেন আমাদের কেউ চাচা, ফুপু অথবা দাদা হতো না! কেন হতো না সেটা এক অদ্ভুত ব্যাপার। আমার নিজের কোন মামা নেই দেখেই হয়ত সবাইকে মামা বানিয়ে দিতাম আমরা। মামারা খুব ভাল হয়, মজার হয় এমন মনে হতো। চাচারা খুব বদ রাগী হয়, খারাপ হয় (নিজের চাচা এমন হয় দেখার কারণেই এমন ধারণা হয়েছিল মনে হয়) তাই পছন্দের কাউকে চাচা বানানো যাবে না। একবার আমরা ঈশ্বরদী থেকে রাজশাহী যাচ্ছি। আপুর মন খুব ভাল কোনো কারণে। সে মনের খুশীতে সবাইকে নাচ দেখাচ্ছে। ‘অ্যাই অ্যাম অ্যা ডিস্কো ডান্সর’ এই গান গেয়ে গেয়ে। নাচ যদিও আপুর খুব বেশি অপছন্দের কোন তালিকা করলে তাতে সবার আগে থাকার কথা তবে ঐ যে বললাম কোন এক বিশেষ কারণে তার মন ভাল তাই নাচ! আপুর নাচ অপছন্দ হয়েছিল আম্মুর জন্যেই বলা যায়। তখন আপুকে নাচ শেখানোর এক প্রাণান্তকর চেষ্টা আম্মু চালিয়ে যাচ্ছিল। নাচ শেখার ঘটনাটা একটু বলে নেই এই ফাঁকে। আপুকে নাচ শেখাতে যে টিচার আসত তার নাম ছিল পান্না। সবাই বলে পান্না স্যার। এই পান্না স্যার ছেলে হলেও আসলে সে মেয়ে! মেয়ে মানে তার কোমর সমান চুল ছিল, হাতে বড় বড় নেইল পলিস দেয়া নখ ছিল (আম্মুর ধারণা হয়ত সে চোখে হাল্কা করে একটু কাজল ও দিতো! টানা টানা চোখ ছিল!)। আপুর এই মেয়ে রূপী স্যারকে ভয়াবহ ভাবে অপছন্দ হলো প্রথম দেখাতেই। বাচ্চা মানুষের সোজা-সরল ব্রেনে একটা ছেলের এই মেয়ের মত সাজ মেনে নিতে পারছিল না দেখেই হয়ত স্যার আসলেই আপু কোন না কোন বাহানা বের করত নাচ না শেখার জন্য। এমনিতে ঘুমোতে না চাইলেও বুধবার দিন দুপুরে জুঁইকে কোন জাদুমন্ত্র জাগিয়ে রাখতে পারবে না! কারণ বুধবার দিকে পান্না স্যার আসে। যখন ওকে নাচতে যেতে হতো বাধ্য হয়ে তখন ও যেয়ে স্যারের সাথে ঝগড়া করত। আম্মু একদিন শোনে আপু স্যার কে ভেঙাচ্ছে একটা গান গেয়ে গেয়ে। ‘আহ! কী দারুণ দেখতে, চোখ দুটো টানা টানা...!!!!’ দুই মিনিট নাচ করেই আম্মুর কাছে যেয়ে কাঁদত ‘আমি আর নাচ করবো না। আমার পা ব্যথা করে।’ বেচারা আম্মুর এতো কিছু করার শখ ছিল জীবনে। বাবা না থাকার কারণে কোনদিন সেই সব শখ পূরণ করতে পারে নি। ভেবেছিল নিজের মেয়েদের দিয়ে করাবে। কিন্তু কিসের কী! পান্না স্যার যখন ওর নাচ হবে না ওকে গানে দিয়ে দেন বলে চলে গেল তখন আব্বু বলল, ‘জংলী বাচ্চা দিয়ে কি আর নাচ-গান হয়?’ আব্বুর কথাই ঠিক। আপুর নাচ, গান কিছুই শেখা হয় নি।

তো যা বলছিলাম আর কী! আপু খুব খুশী মনে সবাইকে পান্না স্যারের কাছে (চাপে পরে) শেখা নাচ দেখাচ্ছিল। এমন সময় এক বুড়ো মত লোক আপুকে জিজ্ঞেস করেছে, ‘তুমি তো খুব সুন্দর নাচ করতে পারো! তোমার আব্বু কি করে?’ আমি আর আমার বোন ছোটবেলা থেকেই জড়তা ছাড়া খুব টুকটুক করে কথা বলতাম। সে বলেছে, ‘আমার আব্বু ইঞ্জিন!’ সেই লোক পেয়ে গেছে মজা। সে আপুকে খ্যাপাতে শুরু করেছে তখন, ‘ওহ তোমার আব্বু গাড়ির ইঞ্জিন! তোমার আব্বু তার মানে গাড়ি চালায়?’ এই ধরণের কথা খুব অপছন্দ বাচ্চাদের! আপু ভীষণ বিরক্ত হয়ে বলেছে, ‘না আমার আব্বু ইঞ্জিন, ইঞ্জিন! জানে না কিছু না!’ আম্মু আপুকে উদ্ধার করার জন্য লোকটাকে জানালো আমার আব্বু সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। তারপরের কথা বলে লোকটা আপুর মাথায় একেবারে আগুন ধরিয়ে দিলো। সে আপুকে বলেছে, ‘ওহ! আচ্ছা তোমার আব্বু ইঞ্জিনিয়ার! তোমার আব্বু তো তাহলে চোর! ইঞ্জিনিয়ার তো চোর হয়!’ ছোট হোক আর যাই হোক বাপের নামে এতো বড় অপবাদ শুনে আসার মানুষ আমার বোন না। সে প্রচণ্ড রেগে যেয়ে সেই বুড়ো লোক কে বলেছে, ‘না আমার আব্বু চোর না। আমার আব্বু ভাল। তুমি চোর। তুমি পচা!’ বলেই সে কাঁদতে কাঁদতে আম্মুর কাছে চলে এসেছে। নাচের মুড যা ছিল এই কথার পর তার আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। রাগে দুঃখে লোকটার দিকে তাকাচ্ছে না পর্যন্ত। ট্রেনের অন্য যাত্রীরা উল্টো লোকটাকেই পরে বলছিল, ‘ধুর মিয়া দিলেন তো বাচ্চাটার মনটা খারাপ করে! কী সুন্দর করে নাচ গান করছিল। ভাল সময় যাচ্ছিল। তা না দিলো একটা ফালতু কথা বলে কাঁদিয়ে!’ আমি অনেক মানুষকে দেখেছি ছোট বাচ্চাদের কে তাদের বাবা কে নিয়ে খারাপ কথা বলতে। অনেকেই আছে বলে, ‘তোমার বাবা তো রাতে চুরি করে তুমি ঘুমলে!’ এটা কি ধরণের কথা? একটা ছোট মানুষকে কেন বুঝতে শেখার আগেই আমরা জানিয়ে দেবো পৃথিবীতে কত অসৎ উপায় আছে জীবন ধারণের? তাহলে সেই বাচ্চার মধ্যে সততা, সরলতা আসবে কি করে? ছোট বাচ্চার সাথে কথা বলার সময় অনেক দায়িত্ব নিয়ে কথা বলা প্রয়োজন প্রত্যেকটা সচেতন মানুষের। আমার কাছ থেকে নেতিবাচক কোন কথা যেন কেউ না শেখে এটাই চেষ্টা করা উচিৎ। আমি চাই না কেউ নিজের বাবার প্রতি অবিশ্বাস আর অশ্রদ্ধা নিয়ে বড় হোক। সবার কাছেই বাবা হোক প্রিয় মানুষ, সুপার হিরো!

ঈশ্বরদী থেকে রাজশাহী যেতে সময় লাগে মাত্র আধঘণ্টা! এই আধঘণ্টার মধ্যে আমাদের পিছে টাকা খরচ হয়ে যেত কমপক্ষে দুইশ টাকা! বিশ বছর আগে দুইশ টাকা অনেক টাকা ছিল! বাসায় আমাদের যতই খাওয়ানোর চেষ্টা করা হোক না কেন দেখা যেত বাইরে যাচ্ছি এই উত্তেজনায় আমরা কিছুই খেতাম না। কিন্তু স্টেশন পর্যন্ত যেতে যেতে শুরু হয়ে যেত। আব্বু মিত্তি খাব, বাদাম খাব, কলা খাব, বিক্কুট খাব, আক্কিম খাব, চক্কেট খাব, আরও দুই চোখে যা যা পরবে সব খাব!!!! সে এক মহা কাণ্ড একেবারে। তো আমাদের নিয়ে একবার যাচ্ছে ঈশ্বরদী থেকে রাজশাহী। আমাদের কোন সুযোগ না দিয়েই আব্বু ট্রেনে উঠেই পুরো এক ছড়ি বড় বড় সাগর কলা কিনে নিয়ে এসেছে। আব্বুর অভ্যাস আমাদের জন্য যা কিনে আনে তা এনে আমাদের হাতেই দিবে। দিয়েছে আমাদের কাছে আর বলেছে আধঘণ্টা বসে বসে এই কলা খাও! এটা অবশ্যই সত্যি সত্যি বলে নি। বলার জন্য বলেছে! কিন্তু আমার অতি বুদ্ধিমান বোন মনে করেছে এই কলা শেষ করতে বলেছে আধঘণ্টার মধ্যে! বারোটা কলার মধ্যে একটা নিয়েছে আম্মু আর একটা খালামনি। বাকি দশটা কলা আমাদের কাছে! ট্রেন ছাড়ার সময় হলে আব্বু যখন ট্রেনে উঠেছে তখন আম্মু আব্বুকে জিজ্ঞেস করেছে, কলা খাবে? আমাদের কাছ থেকে কলা নিতে যেয়ে দেখে কোথায় কলা! কিছু নাই! ট্রেন ছাড়ার আগে দশটা কলা আমরা শেষ করে ফেলেছি!! আম্মু এখনো বিশ্বাস করতে পারে না ওই কলা আমরা খেয়েছিলাম কী করে! আমি নিজেও আসলে ঠিক বিশ্বাস করতে পারি না এটা আমাদের পক্ষে সম্ভব কিনা! আমাদের এই কাণ্ড দেখে আব্বু হতবাক হয়ে যেয়ে আম্মুকে বলল, ‘তোমার মেয়েরা কি মানুষ!’ আম্মু সাথে সাথে রেগে যেয়ে বলেছে, ‘না তোমার মেয়েরা রাক্ষস!’ এটা কোন কথা! অন্যায় করলেই তোমার মেয়ে, তোমার মেয়ে, করে ঝগড়া করে দুজন। আর ভাল করলে আমার মেয়ে, আমার মেয়ে! এগুলো কি?

আমাদের হারিয়ে যাওয়া

আমাদের হারিয়ে যাওয়া তো আর নতুন কিছু না! আমরা হাঁটতে শিখেই হারাতে শিখে গিয়েছিলাম। তবে ঈশ্বরদীতে হারিয়ে যাওয়া, রাজশাহীতে হারিয়ে যাওয়া আর ঢাকাতে হারিয়ে যাওয়া কিন্তু এক না! ওখানে আমাদের সবাই চিনতো খুব ভাল করে। আর আমরাও পথ ঘাট সব ভালোই চিনতাম। তাই আম্মুও আমাদের নিয়ে তেমন চিন্তা করতো না। রাজশাহী থেকে আব্বুর পোস্টিং হয়ে গেলো ঢাকায়। আমরাও তল্পিতল্পা ঘুঁটিয়ে ঢাকা চলে এলাম। নতুন একটা শহরে আমাদের নতুন জীবন শুরু হলো। আমাদের প্রথম বাসা নেয়া হয়েছিল খিলক্ষেত নামের এক ধান ক্ষেতের পাশে! মানে আমাদের বাসা থেকে বের হয়ে একটু হাঁটলেই ধানের ক্ষেত ছিল। আমার ধারণাই ছিল ধানের ক্ষেত আছে বলেই নাম খিলক্ষেত। আম্মুকে প্রায় জিজ্ঞেস করতাম ‘ ধানক্ষেত না হয় খিলক্ষেত হলো কেন? খিল কি জিনিস? এটা কিভাবে খায়?’ পুরো ঢাকা শহর বাদ দিয়ে কে ওই ক্ষেতের মধ্যে আব্বুকে বাসা ঠিক করে দিয়েছিল সে আব্বুই ভালো জানে! আমাদের পক্ষে ওখানে দুই মাসের বেশিদিন থাকা সম্ভব হয় নি। আমাদের স্কুলে ভর্তি হতে হবে কিন্তু ওখানে আশেপাশে ভাল কোন স্কুল ছিল না। তাই আমরা বাসা বদলে চলে এলাম মিরপুরে। আমরা যেদিন মিরপুর-১ এর বাসায় গেলাম সেদিন বাসায় পৌঁছোতে রাত হয়ে গিয়েছিল। লোডশেডিং ছিল যতদূর মনে পরে। পুরো বাসা অন্ধকার ছিল। আম্মু হারিকেনের আলোতে রান্না করেছিল। সেদিন কিছুই দেখা হয় নি আমাদের। আম্মু ঘুমের মধ্যে কোন রকমে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিল। পরেরদিন সকাল থেকে আম্মু একা একা ঘরের সব গুছাতে গুছাতে পাগল হয়ে যাবার অবস্থা! আর আমরা তো ছিলামই আম্মুকে সাহায্য করার জন্য! তবে আমাদের এই সাহায্যের পুরষ্কার বেশির ভাগ সময় আম্মুর হাতে মার খাওয়া দিয়ে শেষ হতো! ঢাকায় এসেও তখনও আমাদের বিকেল হলেই সাজুগুজু করে বেড়াতে যেতে হবে এমন ধারণা ছিল। আম্মু আমাদের বিকেলে জামা কাপড় বদলিয়ে সুন্দর করে চুল বেঁধে, পাউডার দিয়ে, জুতা পরিয়ে দিয়ে বলেছে বাইরে যেয়ে ঘুরে আসতে। আপু আমার হাত ধরে বের হয়েছে বেড়ানোর জন্য। রাতের বেলা বাসায় এসেছিলাম। আশেপাশে কেমন, কী আমরা কিছুই জানি না। ভালোই ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম আমরা। বেশ কিছুক্ষণ পর কাউকে খেলার জন্য না পেয়ে আমরা আবার বাসায় ফিরে যাবার চিন্তা করতেই দেখলাম আমরা আর বাসা খুঁজে পাচ্ছি না! ঢাকায় এসেই আম্মুর ধারণা ছিল আমরা যেই পরিমাণ দুষ্টু আমাদের অবশ্যই ছেলে ধরা ধরে নিয়ে যাবে। আব্বু ঢাকায় নিয়ে আসার আগে আম্মুকে বলতো ‘ঢাকায় একা একা বাসায় নিয়ে থাকতে চাও তোমার যেরকম জংলী দুই মেয়ে! দরজার নিচ দিয়ে বের হয়ে দুপুরে কোথায় চলে যাবে তুমি তো টেরও পাবে না আর খুঁজেও পাবে না। ঢাকা ভর্তি ছেলে ধরা!’ আম্মু আমাদের (আসলে নিজেকে আমরা একা একা বের হয়ে যাব এই ভয় থেকে বাঁচানোর জন্য) ছেলে ধরার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য আমাদের শিখিয়েছিল অপরিচিত কারো সাথেই কথা বলা যাবে না, কিছু খেতে দিলে খাওয়া যাবে না। তো আমাদের তো ঢাকা শহর নিয়ে এমনিতেই অনেক ভীতি ছিলো। তার মধ্যে আমরা বেড়াতে বের হয়েই হারিয়ে গেছি। আমাদের তখন ভয়াবহ আতঙ্ক পেয়ে বসলো এবং সাথে সাথে স্বাভাবিক বুদ্ধি বিবেচনা লোপ পেলো। অবশ্য আমার মতো আড়াই কি পৌনে তিন বছরের বাচ্চার কাছ থেকে খুব বেশি বুদ্ধি আশাও করা ঠিক না! তবে আপু খুব সাহসী হয়ে ওঠে সব সময় যখন ও দেখে আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়েছি আর আমার ভয় কমানোর জন্য আব্বু আম্মু কেউ নেই! আমি বাসা খুঁজে পাচ্ছি না বুঝতে পারার সাথে সাথে আপুর দিকে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টিয়ে কেঁদে ফেলার জন্য রেডি হয়ে গেছি! আপু নিজেও ভয়াবহ মাত্রার ভয় পেয়েছে কিন্তু আমাকে কিছুই বুঝতে না দেবার চেষ্টা করে বাসা খুঁজতে শুরু করে দিলো। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি চেষ্টা করে যাচ্ছি কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছি না আমাদের নতুন বাসাটা আসলে কেমন হতে পারে। আমরা যখন বুঝতে পারলাম আমরা হারিয়ে গেছি আসলেই আর আমাদের ফিরে যাবার কোন উপায় নেই তখন বেচারা আপুও হাল ছেড়ে দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে দুইজন এক সাথে ভেউ ভেউ করে কান্না! আপু আমাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে বলল ‘থাক কিছু হবে না আমি তোমাকে দেখে রাখবো!’ কিন্তু আমার কি আর তাতে হয়?! আমার তো আম্মু লাগবে। আমি আম্মু যাবো বলে ভেউ ভেউ করে কেঁদেই যাচ্ছি। তখন একটা ছেলে বয়স হয়ত হবে ২০ বছরের মতো সে আমাদের এই মরা কান্না দেখে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করেছে ‘তোমরা কাঁদো কেন? কি হয়েছে?’ আপু প্রথমে সতর্কতা মূলক চিন্তা থেকে তাকে বলতে চায় নি আসলে কী হয়েছে। কিন্তু আমি আর এই আতঙ্ক সহ্য করতে পারছিলাম না। আমি কাঁদতে কাঁদতে আমাদের দুঃখের ইতিহাস শুনিয়ে দিলাম যে আমরা বাসা থেকে বেড়াতে বের হয়ে হারিয়ে গেছি। সেই ছেলে আমাদের জিজ্ঞেস করে ‘তোমরা বাসা চিনো না?’ আমরা দুইজন এক সাথে মাথা নেড়ে বলেছি ‘না আমরা বাসা চিনি না!’ আমাদের কান্না কিছুতেই থামে না আর! তারপর সেই ছেলেটা আপুকে জিজ্ঞেস করে ‘তোমরা কাল রাতে এসেছো নতুন?’ আপু বলেছে, ‘হ্যাঁ’ তারপর কোন এক বিচিত্র কারণে ছেলেটা দেখি হাসি আটকেই রাখতে পারছে না! কী আজব! আমরা হারিয়ে গেছি, ভয়ে মারা যাচ্ছি, আর সে কিনা আমাদের এই অসহায় অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে মরে যাচ্ছে! আমরা কান্না চোখে নিয়ে রাগ রাগ করে তাকিয়ে আছি দেখে তখন বলে, ‘তোমরা তো হারাও নি! এই যে তোমাদের পিছনেই তোমাদের বাসা!’ বলে হা হা হা করে হাসতে হাসতে শেষ! আর আমরা নিজেদের এতো বড় বেইজ্জতি দেখে রাগে, দুঃখে, লজ্জায় এবং কিঞ্চিৎ ভয়ে দিশেহারা হয়ে বাসায় ঢুকে গেলাম! ঘটনা যেটা হয়েছে সেটা হলো আমরা বাসার গেট দিয়ে বের হয়েই ভেবেছিলাম আমরা হারিয়ে গেছি। আসলে আমরা গেটের সামনে থেকে কোথাও নড়াচড়াই করি নি! গেটের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলাম! রাতের অন্ধকারে বাসায় যাবার কারণে বাসার গেট আমাদের দেখা হয় নি আর। তাই গেটের সামনে দাঁড়িয়ে হারিয়ে যাবার আতঙ্কে কান্নাকাটি করে আমরা শেষ একেবারে! এখন পর্যন্ত এটা আমার জীবনের অন্যতম একটা বেইজ্জতি ঘটনা! ভুলতেই পারি না কিছুতেই! নিজের বাসার গেটের সামনে কেউ হারায়!! কীভাবে সম্ভব!

(চলবে)

এক টুকরো শৈশব-১
এক টুকরো শৈশব-২
এক টুকরো শৈশব-৩
এক টুকরো শৈশব-৪


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

হাসতে হাসতে মই গেলাম বেইজ্জতি দেখে!!! মানুষের চরিত্রই এমন, অন্যের বেইজ্জতি দেখলে হাসতে হাসতে মই যায়!!!

মেঘা এর ছবি

হুহ!! খেলবো না এমন করলে মন খারাপ

--------------------------------------------------------
আমি আকাশ থেকে টুপটাপ ঝরে পরা
আলোর আধুলি কুড়াচ্ছি,
নুড়ি-পাথরের স্বপ্নে বিভোর নদীতে
পা-ডোবানো কিশোরের বিকেলকে সাক্ষী রেখে
একগুচ্ছ লাল কলাবতী ফুল নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছি

স্বপ্নখুঁজি এর ছবি

মধুর শৈশব , মজার লেখা

মেঘা এর ছবি

ধন্যবাদ হাসি

--------------------------------------------------------
আমি আকাশ থেকে টুপটাপ ঝরে পরা
আলোর আধুলি কুড়াচ্ছি,
নুড়ি-পাথরের স্বপ্নে বিভোর নদীতে
পা-ডোবানো কিশোরের বিকেলকে সাক্ষী রেখে
একগুচ্ছ লাল কলাবতী ফুল নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছি

অর্ক রায় চৌধুরী এর ছবি

ভালো লাগলো।
চলুক

মেঘা এর ছবি

ধন্যবাদ

--------------------------------------------------------
আমি আকাশ থেকে টুপটাপ ঝরে পরা
আলোর আধুলি কুড়াচ্ছি,
নুড়ি-পাথরের স্বপ্নে বিভোর নদীতে
পা-ডোবানো কিশোরের বিকেলকে সাক্ষী রেখে
একগুচ্ছ লাল কলাবতী ফুল নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছি

শুভায়ন এর ছবি

লেখার ওপরে দেওয়া গৌরচন্দ্রিকা পড়ে এই কবিতা-টার কথা মনে পড়ল - সিলেবাসে ছিল - কবির নাম আর শিরোনাম ভুলে গেছিলুম - অনেক চেষ্টায় খুঁজে পেলুম

In Time of 'The Breaking of Nations'

Only a man harrowing clods
In a slow silent walk
With an old horse that stumbles and nods
Half asleep as they stalk.

Only thin smoke without flame
From the heaps of couch-grass;
Yet this will go onward the same
Though Dynasties pass.

Yonder a maid and her wight
Come whispering by:
War's annals will cloud into night
Ere their story die.

Thomas Hardy

ক্রান্তিলগ্নে-ও মানুষ বাঁচে - তার ছোটখাটো আশা আকাঙ্খা নিয়েই বাঁচে - সে কথা মনে করানোর গুরুত্ব-ও অনেক - বহু আগে গুরুমশাই - [ইংলিশ টিচার] বলেছিলেন - তা কি ভুল হতে পারে?

মেঘা এর ছবি

না ভুল হতে পারে না। মাঝে মাঝে ক্রান্তিলগ্নে তা হয়ত দেয় কিছুটা স্বস্তি। ধন্যবাদ চমৎকার কবিতাটা দেবার জন্য।

--------------------------------------------------------
আমি আকাশ থেকে টুপটাপ ঝরে পরা
আলোর আধুলি কুড়াচ্ছি,
নুড়ি-পাথরের স্বপ্নে বিভোর নদীতে
পা-ডোবানো কিশোরের বিকেলকে সাক্ষী রেখে
একগুচ্ছ লাল কলাবতী ফুল নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছি

কাজি মামুন এর ছবি

খুব সুন্দর করে লিখেছেন টুকরো স্মৃতিগুলো, আর তাই পড়তেও ভাল লেগেছে।
মানুষের যে কত ধরনের ফোবিয়া থাকে। তবে রিকশার মত নিরীহ ও সাদাসিধা যান নিয়েও যে ফোবিয়া থাকতে পারে, তা এই লেখা না পড়লে বিশ্বাস করতাম না। যাই হোক, বেশ মজার লেগেছে ব্যাপারটি ।
অচেনা মানুষ মামাই হয় বেশি বা খালাম্মা। আপনার অবজার্ভেশন সঠিক। এর পেছনে একটা সাইকোলজিক্যাল কারণ কাজ করে বলে আমার মনে হয়। আমরা চাচা-ফুফুদের সাথেই থাকি বেশি, এক সাথে থাকার কারণে অনেক সময়ই তাদেরকে নানারকম আদেশ-নিষেধ (অভিভাবকত্ব বোধ থেকে উদ্ভূত) জারি করতে হয়। অন্যদিকে, কোন এক বিশেষ দিনে, যেমন: ঈদের ছুটিতে বা ফাইনাল পরীক্ষার পর যাওয়া হয় মামাবাড়ি, ক্ষণিক সময়ের উপস্থিতিতে না থাকে কোন বিধি-নিষেধ, না থাকে কোন মানসিক চাপ। মামা-খালার ঐ নিরবচ্ছিন্ন স্নেহ-আদর অভঙ্গুর হিসেবে থেকে যায় মনে, চাচা-ফুফুদের ক্ষেত্রে এমন অবিমিশ্র আনন্দের স্মৃতি খুব কমই জমা হয় মনের কোনে।

মেঘা এর ছবি

মন দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ার জন্য ধন্যবাদ মামুন ভাই। আমার নিজের কোন মামা নেই কিন্তু আম্মুর অনেক কাজিনরা ছিলো সেই মামারা আমাদের এতো আদর করতো যে মামা আমাদের খুব প্রিয়‍! ফোবিয়ার কথা আর কী বলবো! আমি যে কি জিনিসে ভয় পাই আর কিসে যে পাই না সে এক ইতিহাস ইয়ে, মানে... লিখবো নে তাহলে এইবার!

অনেক শুভকামনা।

--------------------------------------------------------
আমি আকাশ থেকে টুপটাপ ঝরে পরা
আলোর আধুলি কুড়াচ্ছি,
নুড়ি-পাথরের স্বপ্নে বিভোর নদীতে
পা-ডোবানো কিশোরের বিকেলকে সাক্ষী রেখে
একগুচ্ছ লাল কলাবতী ফুল নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছি

নীপবন এর ছবি

চলুক

মেঘা এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

--------------------------------------------------------
আমি আকাশ থেকে টুপটাপ ঝরে পরা
আলোর আধুলি কুড়াচ্ছি,
নুড়ি-পাথরের স্বপ্নে বিভোর নদীতে
পা-ডোবানো কিশোরের বিকেলকে সাক্ষী রেখে
একগুচ্ছ লাল কলাবতী ফুল নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।