এক টুকরো শৈশব-৩

মেঘা এর ছবি
লিখেছেন মেঘা [অতিথি] (তারিখ: শুক্র, ২২/০৬/২০১২ - ৯:০৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এক টুকরো শৈশব-১

এক টুকরো শৈশব-২

আমার সুপারম্যান বোন

আমার খুব আহ্লাদী অভ্যাস ছিলো। একটু ব্যথা পেলে সেটা কিছুতেই ভুলতাম না। যতদিন মনে থাকতো ততদিন সেটা নিয়ে আমার কান্নাকাটি চলতো। আর কেউ বকা দিলে তো কথাই নাই। বিশেষ করে আব্বু বকা দিলে আমি খুঁজে খুঁজে পুরনো কোন শুকিয়ে যাওয়া কাটা নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে আব্বুর কাছে যেতাম। আব্বুও আবার এমন ভাব করতো যে বুঝতেই পারে নি এটা অনেক আগের ব্যথা পাওয়া। আদর করে ফুঁ দিয়ে একটু ক্রিম লাগিয়ে জিজ্ঞেস করতো ‘ব্যথা কমেছে?’ আমার এইসব আহ্লাদী শুধু আব্বু না আম্মু আর আমার বোনের সাথেও চলতো। যাই হোক না কেন আমার নালিশ দেবার একটা মানুষ সব সময় লাগত। আপুও বড়দের মত সেইসব নালিশ পেয়ে দেয়াল হোক আর দরজাই হোক যার সাথেই আমি ব্যথা পাই না কেন সেটা কে লাঠি দিয়ে পিট্টি দিয়ে আসতো আমাকে থামানোর জন্য।

ছোটবেলায় আমার খুব ভয় ছিলো একা কোথাও আটকা পরে যাবার। তার কারণ হলো আমি একবার রান্নাঘরে একা আটকা পরে গিয়েছিলাম। আমি খুব জিদ করতাম সব কিছু নিয়ে। আমি যেটা বলেছি সেটা আমার মন মত না হয়ে অন্যরকম হলেই আমি কান্নাকাটি করতাম খুব। মানেতেই পারতাম না আমার নিজের আম্মু আমার কথা কীভাবে করে শুনলো না! আব্বু সাইট থেকে খেতে এসেছে তাই আম্মু তখন খাবার দিতে খুব ব্যস্ত ছিলো আর আমি তখন কোলে উঠার জন্য কান্না করছিলাম। আম্মু আমাকে কোলে নেয় নি তাই আমি রাগ করে হাতে একটা কলম ছিলো সেটা রান্নাঘরের দরজার ছিটকানি লাগানোর ফাঁকার মধ্যে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলাম যেন আম্মু আর আসতে না পারে। আমার মাথায় এটা আসে নি যে এতে করে আমি নিজেও আর বের হতে পারবো না! আম্মু আবার যখন রান্নাঘরে কিছু নিতে এসেছে তখন দেখে দরজা ভেতর থেকে বন্ধ আর আমি রান্নাঘরের মধ্যেই আছি। আম্মু তো বাহির থেকে আমাকে বলছিলো বার বার আমি যেন হিটারের কাছে না যাই। ঐ বাসায় ইলেক্ট্রিক হিটারে রান্না করতো। সেই হিটারগুলোর মধ্যে আবার কয়েল ছিলো লাল রঙের। মানে যখন হিটার চলতো তখন লাল হয়ে থাকতো। দেখতেই ভালো লাগত। কিন্তু আম্মু ধরতে দিতো না। হিটারে দুধের পাতিল দেয়া ছিলো আর আম্মুর মনে হয়েছে আমি যেয়ে হিটার ধরবো আর মরে হিটারের সাথে লেগে থাকবো। আম্মু তো ভয়ে কান্নাকাটি আর আমাকে বার বার করে বলছে বাবু হিটারের কাছে যাবে না। আম্মু কান্নাকাটি করছে কিন্তু আমি বের হতে পারছি না দেখে আমি তো আর চুপ করে বসে থাকবো না। আমিও রান্নাঘরের ভেতর থেকে গলা ফাটিয়ে কান্না করছিলাম। আমাদের একটা কাকু সেই সময় ছিলো বাসায়। সে আবার বাড়ির পিছন দিকে যেয়ে দেয়ালের উপর উঠে দেখেছে আমি দরজা কী দিয়ে বন্ধ করেছি। তারপর আব্বু, কাকু আর আশেপাশের আরো মামারা এসে দরজা ভেঙে আমাকে বের করেছিলো। তখন আবার আমার খুব বেশি ভয় পেয়েছি সেটা প্রকাশ পেতো সাথে সাথে গায়ে প্রচন্ড জ্বর উঠে। ভয়ে আর কোনো মানুষের জ্বর আসে কিনা কে জানে!

আমার এই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কারণে আমার বোনও বন্ধ দরজা খুব ভয় পেতো! শুক্রবার আমরা আম্মুর কাছে গোসল করতাম না। আব্বু আমাদের গোসল করিয়ে দেবে সেটাই নিয়ম ছিলো। আব্বু গোসল করিয়ে আমাদের বলেছে যাও মাকে যেয়ে বলো কাপড় পরিয়ে দিবে। আমার আপু আমাকে নিয়ে রুমে যেয়ে নিজেই কাপড় পরবে চিন্তা করে দরজা চাপিয়ে দিয়েছে। কিছুদিন আগেই আমাদের বাসা থেকে আমাদের ছোট কাকুরা বেড়িয়ে গেছে। কাকুর মেয়ে আপুর বয়েসী। ওর কাছে আমরা তখন দেখেছি কারো সামনে কাপড় পাল্টানো খুব লজ্জার বিষয়! নতুন শেখা জ্ঞান জাহির করার জন্য সে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। জামা কাপড় পরা হবার পর বের হতে যেয়ে আমরা আর বের হতে পারি না! নতুন রঙ করা দরজা বাতাসে খুব জোরে লেগে গিয়েছিলো আর সেটা টেনে খোলার শক্তি আমাদের ছিলো না। যা হোক আমার বোনের মাথাতেও তখন সেই বুদ্ধিটা হয় নি যে দরজাটা রঙে আটকে গেছে। আমি আমার অতীত শিক্ষার ইতিহাস মনে করেই কাঁদতে শুরু করে দিয়েছি তখন। যেহেতু আপু আমার বড় এখন আমাকে বাঁচানোর দায়িত্ব ওর উপর। সে আমাকে বললো, ‘থামো কাঁদো না। আমি খুলছি।’ আমিও ফুঁপাতে ফুঁপাতে ওর কথা বিশ্বাস করে বসে আছি যে ও আমাকে বাঁচাবে। রুমের সাথেই বারান্দা ছিলো আর আমার আম্মু সেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে দেখছিলো আমরা কী করি!! আমাদের এইসব হাস্যকর কান্ড দেখতে আম্মু খুব মজা পেতো কেন কে জানে! যা হোক তারপর আম্মু দেখে আপু বিছানা ঝাঁট দেবার জন্য যে শলার ঝাঁটা ছিলো সেটা নিয়ে দরজার কাছে গেলো তারপর বেদম ভাবে দরজাকে সপাং সপাং করে ঝাঁটা পিটা করলো কিন্তু দরজা নির্লজ্জের মতো বন্ধ হয়েই বসে থাকলো!! আমি সেটা দেখে আরো জোরে কান্না যে আজকে আমাকে আর কেউ বাঁচাতেই পারবে না মনে হয়! আমার বোন মোটেই থেমে যাবার মানুষ না কারণ আমার কাছে ওর তখন সুপারম্যান ইমেজ। বেশ কিছুক্ষণ ভেবে ও যেই জিনিস খুঁজে নিয়ে আসলো দরজা খোলার জন্য সেটা কোন অবস্থাতেই মিস হতে পারে না! সেটা কি? সেটা হলো ক্যাসেট প্লেয়ারের প্লাগ!!! যেই প্লাগ লাগিয়ে দিলে জোরে বিভিন্নরকম গান বাজতে পারে সেটা দিয়ে কী আর দরজা খোলা যাবে না! তাই হয় নাকি? আপু দরজার কাছে যেয়ে কিছুক্ষণ বিভিন্ন জায়গায় প্লাগটা চেপে চেপে ধরলো তারপর দরজা টান দিয়ে দেখলো! আর আমার আম্মুর সাথে তখন আব্বুও বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমাদের এইসব কান্ড দেখে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি। কিন্তু না দরজা তো খোলে নাই! এতো চিচিং ফাঁক, আলু ফাঁক করেও যখন দরজা খুললো না তখন সুপারম্যানও আশা ছেড়ে দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে ভেউ ভেউ করে কান্না শুরু। অবশ্যই তারপর আম্মু এসেই আমাদের বের করেছিলো। নিশ্চয়ই আমি সেদিন বুঝেছিলাম যে মাঝে মাঝে সুপারম্যানরাও হাল ছেড়ে দিতে পারে!

শিংওয়ালা ভূত

আমি এমনিতে খুব সাহসী বাচ্চা ছিলাম। আমার বীরপুরুষ (!) বোন যা দেখে ভয় পেতো আমি তা দেখেও ভয় পেতাম না তখন। আপু পোকা দেখে খুব ভয় পেতো। পিঁপড়া দেখলেও ভয়ে সেখান থেকে পালাতো আর আমি যা পেতাম তার পিছেই ছুটতাম হাত দিয়ে ধরার জন্য। কেন্নো বলে খুব বাজে চেহারার একটা পোকা আছে। যেটার গায়ে একটু ছোঁয়া লাগলেই গোল হয়ে যায়। সেই পোকা দেখে আম্মু আর আমার আপু দুইজনই খুব ভয় পেতো। সেই বয়েসে আমার মধ্যে ভয় ডর বোধ হয় একটু কম ছিলো আর নাহলে ভয় যে পেতে হয় আমি হয়ত তাই বুঝতাম না। সেই কেন্নো হাতের কাছে পেলেই আমি হাত দিয়ে টান দিয়ে ছিঁড়ে (!) আপুর পিছে পিছে দৌড়াতাম ওকে ভয় দেখানোর জন্য! অথবা অন্ধকারের মধ্যে এক রুম থেকে একা একা হেঁটে আম্মুর কাছে চলে যাওয়া! আমি ভয় পেতাম না কিন্তু আমি একা চলে যেতে পেরেছি দেখে আম্মুই বেশি ভয় পেতো। তখন হয়ত আমাকে বলতো ‘বাবু তুমি একা চলে আসতে পেরেছো! ভয় লাগে নি?’ আমি তখন বুঝতাম এটা ভয়ের ব্যাপার। বুঝতে পেরে চিৎকার দিয়ে কাঁদতাম (কত বড় বেকুব হলে মানুষ কনফার্ম হয়ে ভয় পায় কে জানে!) আম্মু আর আপু ভয় পাওয়া দেখেই মনে হয় আমি দিন দিন ভীতু হয় গেছি। সেই ভয়ের মাত্রা এতোটাই যে আমার ইনসেকটো ফোবিয়া বলে একটা অসুখ হয়ে গেছে!

যা হোক এটা বলা উদ্দেশ্য না। আমার বোনের এই বীরগাঁথার মধ্যে আমারও কিছু কাহিনী বলতে ইচ্ছা করছে আজকে। তবে আমার বীর হবার মতো কোন গল্প নাই। আমার ভীতু হয়ে যাবার গল্প বলি। আমি কিছু কিছু বিষয় নিয়ে আমার বোনকে ভয় দেখাতাম যখন ভয় কী তাই বুঝতাম না তখন। আমি তখন পোকা দেখে ভয় পেতাম না। অন্ধকারে আমার ভয় ছিলো না। তবে নিজেকে বীর ভাবলেই তো আর হয় না! বাস্তব পুরাই অন্য জিনিস।

বাসার সামনের মাঠ আমাদের প্রিয় খেলার জায়গা ছিলো। ঐ এলাকাতে অনেক কম বয়েসী ছেলে মেয়ে ছিলো। তারা সবাই আমাদের মামা না হলে খালামনি। আমরা বাসায় থাকতে চাইতাম না বিকালে তাই আম্মু আমাদের সাজিয়ে গুজিয়ে মাঠে পাঠিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমাদের খেলা দেখতো। আমরা মামাদের পিছে ছুটাছুটি করতাম নাহলে কোন খালামনির কাছে চলে যেতাম। সেদিনও আম্মু আমাদের যথারীতি সাজিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে মাঠে খেলার জন্য। কিন্তু সেদিন আর নিজে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখে নি আমরা কী করছি। কারণ আমার দাদী বেড়াতে এসেছিলো। আম্মু দাদীর সাথে গল্প করছিলো। আমাদের পাঠিয়ে দেবার বেশ অনেকক্ষণ পর আম্মু শোনে একটা বাচ্চার চিৎকার শোনা যাচ্ছে। আম্মু দাদীকে বলেছে আমার মেয়ে কাঁদে (অনেক দূর থেকে কাঁদলেও আম্মু আবার কীভাবে জানি বুঝতে পারত!) দাদী বিশ্বাস করে নাই। আম্মু বারান্দায় যেয়ে দেখে ঠিকই আমি কাঁদছি। আশেপাশে আমার আপুর কোন দেখা নাই। মাঠের মধ্যে আমি একা দাঁড়িয়ে কাঁদছি! আমি এতোই জোরে চিৎকার দিয়ে দিয়ে কাঁদছিলাম যে আম্মুর মনে হয়েছে আমি কিছুক্ষণের মধ্যে হার্ট ফেল করবো। তাই আম্মুও আর দেরী না করে দৌড় দিয়েছে আমাকে নেয়ার জন্য। মাঠে যেয়ে আম্মু দেখে আমি আসমা খালামনিদের ভয়াবহ কালো ছাগলের মুখামুখি দাঁড়িয়ে পাল্লা দিয়ে চিৎকার করছি। আমি বিশাল জোরে চিৎকার দিয়ে কান্না করে একটু থামি তারপর ছাগল চিৎকার দেয়। সেই চিৎকার শুনে আবার আমি চিৎকার দেই। কী যে অবস্থা! আমি আর ছাগল ছাড়া মাঠে কেউ নাই। আমি ছাগলের সামনে চলে গিয়েছিলাম ঘুরতে ঘুরতে বোধ হয় আপুকে খুঁজতেই। ছাগল আমাকে ভয় দেখাতে আসে নাই কারণ ছাগল দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিলো। আমি নিজেই যেয়ে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তারপর আম্মু আমাকে কোলে নিয়েও থামাতে পারে না। যতই বলে এটা ছাগল ভয়ের কিছু নাই ততোই আমি বলি না এটা ভূত, এটা দৈত্য! সেই সময় টিভিতে আলিফ লায়লা আর কী কী জানি সব রুপকথার নাটক দিতো। সেগুলোতে শিংওয়ালা দৈত্য থাকতো। আমি ছাগলটাকে ভেবেছিলাম সেই জিনিস!

আমার এই ভয় পাওয়া দেখে তো আমার দাদী আমাকে লবণ পানি খাওয়ায়, দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে দেয় কিন্তু কিসের কী! আমার মাথায় ঢুকে গেছে ঐটা ভূত। তারপর আম্মু আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে অনেক কষ্টে। ঘুমের মধ্যেই আমি আবার চিৎকার দিয়ে ঘুম থেকে উঠে গেছি। আম্মু এসে দেখে আমার গায়ে অনেক জ্বর আর আমি বার বার জানালা দেখিয়ে দিচ্ছি। আম্মু জিজ্ঞেস করে কি দেখেছো? আমি আম্মুকে বললাম, ‘জানালা দিয়ে ভূত এসে আমার মুখে ফুঁ দিয়ে গেছে!’ আম্মু তো বুঝেছে ঐ ছাগলকে স্বপ্ন দেখেছি তাও শিউর হবার জন্য জিজ্ঞেস করেছে ভূত দেখতে কেমন? আমি বলেছি ভূত কালো, শিংওয়ালা ভূত!

এই ছাগল আমাকে এমন ভয় দেখালো যে আমার ভয় পাওয়া শুরু হলো সেখান থেকেই। আমি কী না কী ভয় পাই এখন। সব কিছু দেখেই আমার ভয় লাগে।

আমাদের এই ভয় পাওয়ার গল্প শুনে আমরা এতো ইনোসেন্ট ছিলাম মনে করার কোন কারণ নাই আসলে। একটা ছোট দুষ্টামীর গল্প দিয়ে আজকে শেষ করি।

আমার আম্মুর হয় চাচা। কিন্তু আম্মুর থেকে বয়েসে ছোট হবার কারণে আম্মুকে ডাকতো ফুপু আর আমরা বলতাম ভাইয়া। কবির ভাইয়া আমাদের অনেক আদর করতো। আমি যখন হয়েছিলাম তখন কবির ভাইয়া আমাকে দেখে আম্মুকে বলেছিলো, ‘তনু ফুপু তোমার মেয়ের ঠোঁট না কাতল মাছের মতো!’ এটা কোন কথা হলো! আমি নাকি কাতল মাছ! আম্মু অবশ্য এই কথার তীব্র প্রতিবাদ করেছিলো। আমরা যখন রাজশাহী ছিলাম তখন কবির ভাইয়া প্রায় সময় আমাদের সাথেই থাকতো। ভাইয়া নাচ শিখতো। এখন খুব ভালো নাচের টিচার হয়ে গেছে। যা হোক রাজশাহীতে থাকতে তো আমাদের পাখা গজিয়ে ছিলো তাই আমরা যা ইচ্ছা তাই করতাম তখন।

শীতের দুপুরে কবির ভাইয়া গোসল করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলো রোদে। আমাকে আর আপুকেও আম্মু তখন গোলস করিয়ে ফেলেছে। আমাদের খাওয়ানোর জন্য তখন খাবার রেডি করতে রান্নাঘরে আম্মু ব্যস্ত ছিলো। কাজ করতে করতেই দেখে আমি আর আপু দুইজন খুব অপমানের কান্না কাঁদতে কাঁদতে আম্মুর কাছে গেছি। আম্মু একটু অবাক হয়েছে দুইজনকে একসাথে কাঁদতে দেখে। কারণ কান্নাকাটির কাজ একা শুধু আমার ছিলো! তো দুইজন কাঁদছি দেখে আম্মু জিজ্ঞেস করেছে, ‘কি হয়েছে কাঁদো কেন?’ লজ্জায় মাথা কাটা যায় এমন ভাব করে আমরা বলেছি ‘কবির ভাইয়া আমাদের মেরেছে!’ সাথে সাথে আমার আম্মুর তো রাগে গা জ্বলে গেছে। কারণ আম্মু আমাদের যত ইচ্ছা মারবে কিন্তু আর কেউ কিছু বলতে পারবে না। এমনি কী আব্বুও না! সাথে সাথে আমাদের নিয়ে গেছে কবির ভাইয়ার কাছে। যেয়ে জিজ্ঞেস করে ‘কিরে কবির তুই কি ওদের মেরেছিস?!’ তখন কবির ভাইয়া বলেছে যে সে আমাদের মেরেছে। আম্মুর তো আরো মেজাজ খারাপ হয়েছে। জিজ্ঞেস করেছে কেন মেরেছে। তখন কবির ভাইয়া বলেছে, ‘মারবো না তো কী করবো বলো! তোমার মেয়েরা খালি এসে টান দিয়ে আমার লুঙ্গী খুলে দিয়েছে!’ আম্মু খুব স্বাভাবিক এই কথা শুনে পুরাই বেকুব হয়ে গেছে। তারপর আমার বোন কে ধরে নিয়ে যেয়ে জিজ্ঞেস করেছে কাহিনী কি সত্যি? আপু সত্যবাদি বলেছে কাহিনী অবশ্যই সত্যি। সেই সাথে কাহিনীর স্ববিস্তার বর্ণনা! কবির ভাইয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলো তাই দেখে আমি আর আপু গিয়েছিলাম তাকে ডাকতে। লুঙ্গী ধরে টান দিয়ে ডাকতে যেয়ে লুঙ্গী খুলে গেছে! কবির ভাইয়া খুব লজ্জা পেয়ে আমাদের এমন করতে না করেছে আর ভাইয়ার চেহারা দেখে আমারা মজা পেয়েছি। মানা করার মানেই আমার আপুর কাছে ছিলো অবশ্যই করতে হবে সেই কাজ। তারপর আপু আমাকে নিয়ে প্ল্যান করলো কীভাবে করে কবির ভাইয়াকে লজ্জা দেয়া যায়। বারান্দায় যাবার দুইটা দরজা ছিলো। একটা আম্মুদের বেডরুমের সাথে আরেকটা ড্রয়িংরুমের সাথে। প্ল্যান হলো দুইজন দুই দরজা দিয়ে যেয়ে একসাথে টান দিবো। যেই কথা সেই কাজ আমরা একবার, দুইবার, তিনবার কবির ভাইয়ার কাছে যেয়ে টান দিয়ে দেই দৌড়। আর ভাইয়া দেয় বকা। তিনবারের বার দিয়েছে মার। আমাদের খুব অপমানে লেগেছিলো কবির ভাইয়া আমাদের মারলো কী করে! কিন্তু আমরা যা করছিলাম সেটা যে কত বড় শয়তানী সেটা নিজেরাও বুঝি নি। তারপর আম্মু আপুকে শিক্ষা দেবার জন্য দিলো মার যাতে জীবনে আর মানুষের কাপড়-চোপড় নিয়ে টানাটানি না করে!! আপুর ছোটবেলায় একটাই কথা ছিলো এই পৃথিবীতে সবচেয়ে খারাপ মানুষ আম্মু। কাজের কোন কদর বুঝে না খালি মারে!

(চলবে)

মেঘা

সচলায়তনে প্রকাশিত অন্য লেখা

নিঃশব্দ যাপন
তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রনে-১
তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রনে-২


মন্তব্য

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

দাঁড়ান, আপনাদের দুই বোনের কাছে মকসুদরে পাঠায়ে দিতে হবে চোখ টিপি

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

মেঘা এর ছবি

হাহাহাহা দেঁতো হাসি

বন্দনা এর ছবি

এমন ডানপিটে শৈশব না থাকলে জীবনটাই পানসে হয়ে যেত। আপনার লুঙ্গির কাহিনী অনেক কথা মনে করিয়ে দিল। প্রথম প্রথম যখন আমার ছোটভাই লুঙ্গি পরা শুরু করলো, এই কাজটা প্রায়ই করতাম, সে যে কি খেপে যেত। পরে আমার উপর রাগ করে লুঙ্গি পরাই ছেড়ে দিল বেচারা। খাইছে

মেঘা এর ছবি

হাহাহাহাহাহা বন্দনা আপু লুঙ্গি বড়োই আশ্চর্য ড্রেস ছিলো আমার কাছে ছোটবেলায়। কিভাবে পরেছে এই নিয়ে কত কিছু যে করেছি! সে সব আর বলার মত না খাইছে

পড়ার জন্য ধন্যবাদ আপু ।

ক্রেসিডা এর ছবি

ভালো লাগছে আপনার ডায়রি পড়তে দেঁতো হাসি

__________________________
বুক পকেটে খুচরো পয়সার মতো কিছু গোলাপের পাঁপড়ি;

মেঘা এর ছবি

ধন্যবাদ ভাইয়া হাসি

চরম উদাস এর ছবি

চলুক

মেঘা এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

প্রদীপ্তময় সাহা এর ছবি

লেখা ভালো লাগল।
শৈশব সত্যিই অমলিন আর অনাবিল।

মেঘা এর ছবি

ধন্যবাদ ভাইয়া হাসি

সন্দেশ এর ছবি

মেঘা,
আপনার কাছে সচলায়তন থেকে একটি ইমেইল যাবার কথা। স্প্যাম ফ্লোডার সহ চেক করে দেখবেন। ইমেইল না পেলে আমাদের জানাবেন।

কালো কাক এর ছবি

হাততালি হাচল হয়ে গেলেন মনে হয় মেঘা

মেঘা এর ছবি

তাই তো মনে হচ্ছে দেঁতো হাসি অনেক ধন্যবাদ

মেঘা এর ছবি

ধন্যবাদ ইমেইল পেয়েছি দেঁতো হাসি

মর্ম এর ছবি

শুভেচ্ছা আপনাকে, হাচলত্বের আর সুন্দর লেখাটার জন্যে।

শৈশবের আপনাকে বলবেন পরের বার আরো তাড়াতাড়ি ফেরার জন্য!

আমার মনে হল ছোটদের জন্য ভাল লিখবেন আপনি। গল্প লিখে দেখবেন নাকি দুয়েকটা?

~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...

মেঘা এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ মর্ম আপু/ভাইয়া। আচ্ছা এবারের শৈশবকে তাড়াতাড়ি আসতে বলবো হাসি । আমার কেন যেন বাচ্চাদের সাথে খুব খাতির হয়ে যায়। মনে হয় আমার মধ্যে এখনো সেই ছোট মানুষটা বেঁচে আছে তাই। আমি অবশ্যই লেখার চেষ্টা করবো ছোটদের জন্য। একটা লিখতে শুরু করেছি। শীঘ্রিই দিয়ে দেবো।

--------------------------------------------------------
আমি আকাশ থেকে টুপটাপ ঝরে পরা
আলোর আধুলি কুড়াচ্ছি,
নুড়ি-পাথরের স্বপ্নে বিভোর নদীতে
পা-ডোবানো কিশোরের বিকেলকে সাক্ষী রেখে
একগুচ্ছ লাল কলাবতী ফুল নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছি

তাপস শর্মা এর ছবি

দেরী করে পড়লাম। বরাবরের মতোই চরম হৈছে। চলুক

এবং হাচলত্বের অভিনন্দন। হাসি

মেঘা এর ছবি

অসংখ্য ধন্যবাদ তাপসদা। হাসি আমার একটা নিক আছে ভাবতেই মজা লাগছে দেঁতো হাসি

--------------------------------------------------------
আমি আকাশ থেকে টুপটাপ ঝরে পরা
আলোর আধুলি কুড়াচ্ছি,
নুড়ি-পাথরের স্বপ্নে বিভোর নদীতে
পা-ডোবানো কিশোরের বিকেলকে সাক্ষী রেখে
একগুচ্ছ লাল কলাবতী ফুল নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছি

তিথীডোর এর ছবি

হাচলত্বের অভিনন্দন। হাততালি

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

মেঘা এর ছবি

ধন্যবাদ তিথীপু হাসি

--------------------------------------------------------
আমি আকাশ থেকে টুপটাপ ঝরে পরা
আলোর আধুলি কুড়াচ্ছি,
নুড়ি-পাথরের স্বপ্নে বিভোর নদীতে
পা-ডোবানো কিশোরের বিকেলকে সাক্ষী রেখে
একগুচ্ছ লাল কলাবতী ফুল নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছি

আশফাক আহমেদ এর ছবি

পুরোটা মুগ্ধ হয়ে পড়ে গেলাম। আপনার অন্য লেখাগুলোও পড়তে হবে

-------------------------------------------------

ক্লাশভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেফ সমস্ত কাগজ !
আমি বাজে ছেলে, আমি লাষ্ট বেঞ্চি, আমি পারবো না !
আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

মেঘা এর ছবি

অসংখ্য ধন্যবাদ আশফাক ভাইয়া। খুব ভালো লাগবে বাকি লেখাগুলো পড়লে। হাসি আশা করি এই সিরিজের জন্য লেখাগুলোতেও সাথেই থাকবেন হাসি

--------------------------------------------------------
আমি আকাশ থেকে টুপটাপ ঝরে পরা
আলোর আধুলি কুড়াচ্ছি,
নুড়ি-পাথরের স্বপ্নে বিভোর নদীতে
পা-ডোবানো কিশোরের বিকেলকে সাক্ষী রেখে
একগুচ্ছ লাল কলাবতী ফুল নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছি

অর্ণব আর্ক এর ছবি

মহামান্য আবুল মকসুদ কাকার দুইখানা লুঙ্গিপরার সাধ মেটাতে আমার মনে হয় বড় আপুর বিকল্প নাই। এই গল্পটা আবুল মকসুদ সমীপে পেশ করা হোক। হাসি
ছাগল= শিং ওয়ালা ভূত ।। মন্দ কী।
আমি অবিশ্যি কোরবানীর ছাগলের শিং আর মাথার চামড়া একটা লাথির মাথায় গেঁথে বেশ কয়েকজনকে ভয় দেখিয়েছিলাম। তখন পড়তাম ক্লাস টুতে।

মেঘা এর ছবি

ছোটবেলায় সবার কিছু না কিছু মজার ঘটনা থাকেই। আপনিও সময় করে লিখে ফেলুন আপনার ঘটনা ভাইয়া।

পড়ার জন্য ধন্যবাদ হাসি

--------------------------------------------------------
আমি আকাশ থেকে টুপটাপ ঝরে পরা
আলোর আধুলি কুড়াচ্ছি,
নুড়ি-পাথরের স্বপ্নে বিভোর নদীতে
পা-ডোবানো কিশোরের বিকেলকে সাক্ষী রেখে
একগুচ্ছ লাল কলাবতী ফুল নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।