দেয়াল

মণিকা রশিদ এর ছবি
লিখেছেন মণিকা রশিদ (তারিখ: বিষ্যুদ, ০১/১০/২০০৯ - ৪:০৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

হঠাৎ কিসের শব্দে ঘুম ভেঙে যার রোমানার, ঘুমের মধ্যে উঠে বসে বিছানায়।
অভ্যাসবসেই হাত চলে যায় পাশবালিশে। পাশবালিশের ওপারে ধূ-ধূ মাঠ। মাঠ পেরিয়ে চেনা লোকালয়, চেনা লোকালয়ে নাসিকা গর্জনের আওয়াজ। আধো ঘুমে রোমানা ধূলির প্রান্তর পেরিয়ে কোথাও যেতে চায়। লোকালয়ে সবুজ বনভূমির বসবাস, কূয়াতলার টুং-টাং আওয়াজ, জীবিত নিঃশ্বাসের আনাগোনা। পাশবালিশের অদূরেই তার সূচনা। সেখানে জীবন জেগে জেগে ঘুমায়! সামান্য নড়াচড়ার শব্দ। ঘন নিঃশ্বাসের উষ্ণতা ছিটকে চলে আসে, কিন্ত পেরোনো যায় না সেই পথ! বহু আগে রচিত হওয়া পথের রেখা অব্যবহারজনিত কারণে ক্রমশঃ শুকনো পাতার ঘন আচ্ছাদনে চিকন হয়ে আসে। চাইলেই আর ঘুমন্ত নাগরিককে জাগিয়ে বলা যায় না”এসো,জোছনা স্নানে যাই!”অথবা হাত বাড়ানো যায় না শুকনো পাতা সরাতে। অব্যক্ত বিষন্নতা, অবোধ দূরত্ব অসাবধানতায় গ্রাস সাহ করে নিয়েছে তাদের মিলিত শয্যা।

এখানে এখন নিস্তব্ধতা ঘুমায়, এখানে এখন নিরুৎসাহ ঘুমায়। এখানে এখন রাত জেগে অপ্রয়োজোনীয় গল্প করার কোনো কুয়াশা নেই! মাঝখানে পাশবালিশ থাকে, দু’পারের দুই বাসিন্দা কখনো স্মৃতিতে মগ্ন, কখনো আত্মরচিত অনুর্বর ফ্যান্টাসীতে মগ্ন যা হয়ত কখনো সত্যি হবে না! সত্যি হবে না,কারণ সংসার জড়িয়ে থাকে যত না বেশী মায়ায়, তার থেকে অনেক বেশী কর্তব্যে। হঠাৎ খুব একা লাগে।প্রকাশের অধিক একাকীত্ব, যেন অতিআপন কেউ হারিয়ে গেছে, ফিরে আসবে না আর।বুকের মধ্যে চৈত্রমাসের খা-খা করা হুতাশে বাতাস! এমন কেন হচ্ছে!

রোমানা তার নিজের তলপেটে হাত রাখে, নিজের সাম্প্রতিক জরা পীড়িত বুকে হাত রাখে। রেখাগুলি আঙুলের স্পর্শে পড়া যায়।গল্পগুলো খুব পুরানো নয়।এই শরীরের ভার সরিয়ে এখানে এখন আর নতুন কোনো অনাগত মানুষ ঠাঁই করে নিতে পারবে না, একটু একটু করে সুখের বাড়ার ইঙ্গিত দেবে না। নদীর জল শুকিয়ে গেছে। অনাখাঙ্খিত বাঁধ রচিত হয়ে তার স্রোত নষ্ট হয়ে গেছে। অথচ এই বুকে একদিন শিশু খেলত জীবনের রসদ জোগাড় করতে; এই শরীরে দুজনের মেলা বসত রঙের আর উৎসবের।-নিঃস্বার্থ-নির্বিরোধের মেলা , অর্থাৎ ভালবাসার।

রোমানা অন্যদিকে ফিরে শোয়। অন্ধকারে পূর্ণ চোখে পাশের মানুষটার দিকে তাকায়। মানুষটা ঘড় ঘড় করে নাক ডাকছে, নিঃশ্বাসের সাথে তার বুক ওঠানামা করছে, ঠোঁটের কোণ্‌ থেকে গড়িয়ে পরা লালার ওপর জানালার পর্দা গলিয়ে আসা আলো উঠে চিক্‌ চিক্‌ করছে! মানুষ যেমন ঘুমার আর কি! ঘুমের মধ্যেও জীবনের স্পন্দন যেমন অনুভব করা যায়, তেমন।একজন মানুষের ঘুমোনো মাত্র। একজন পুরুষের ঘুম আলাদা করে মনে হয় না।

কয়েক বছর আগেও হয়ত এমন ছিলো না। এরকম শান্ত ঘুম দেখলে শরীর স্পর্শ করতে ইচ্ছে করত, শরীর জুড়ে কামবোধ অনুভূত হতো; কিছুতেই ওই পুরুষের খোলা বুকের গভীর জঙ্গল অনধিকৃত রাখতে ইচ্ছে করত না। অথচ আজ রোমানার শুধু দর্শকের চোখে দেখার ইচ্ছে বা একান্তই একাকীত্বের চোখে। নিজের অজান্তেই সে মনে মনে বলে,” তুমি একটু ওঠো, আমাদের উঠানের ঘাসগুলো বড্ড বেড়ে গেছে, ওদের ডগা কাটা দরকার, মেয়ের স্কুলব্যাগে কন্ডম পাওয়া গেছে-সে নিয়ে তোমার সাথে কথা আছে। সময়ে অসময়ে আমার তলপেটে অসহ্য ব্যথা হয়-কথা বলা দরকার!”

রোমানা বিছানায় সম্পূর্ণই উঠে বসে এবার। হাত বাড়িয়ে টেবল ল্যাম্প জ্বালায়।-ঘুমের ওষুধ খায়।-বাতি নেভায়।-শুয়ে পড়ে আবার।কম্বল টানে সারা গায়ে।পাশের ঘুমন্ত মানুষটার খোলা শরীর কম্বলে ঢেকে দিতে ইচ্ছে করে-ঠান্ডা লাগবে! তার হাত সরে না, মায়া নাকি কর্তব্যের অনুপস্থিতি ঠিক বুঝে উঠতে পারে না।তার মাথার মধ্যে কেমন যেন এক অসহনীয় অভিমান বসে থাকে।–মেয়ের স্কুল্ব্যাগে কনডম পাওয়া গেছে-তার মানে সে এখন আর কুমারী নেই। ১৫-১৬ বছর বয়সে রোমানা কি জানত কিছু শরীরের লেনাদেনার বিষয়ে? ভাবত, কিন্তু জানতনা তেমন কিছুই।মা কঠিন ছায়ার তলে তাকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া আসা করত সেই বিশ্ববিদ্যালয় অবধি। বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন এই মানুষটি তার ভেতর বাহির সমস্ত অধিকার করে নিয়ে সামনে এলো, তখনও তারা শরীরের নিরাপদ ব্যবহার জানে না।তখনও তারা অঘটন ঘটায়। অনাকাংখিত মানুষ পৃথিবীতে নিয়ে আসার প্রাক্কালে তাদের চেতনার উদয় হয়।তার নিজের মেয়ে তো সাবধানীই সেই হিসেবে। অথবা সত্যি ই কি সাবধানী? এখনও সে স্কুলে যায় মাত্র; এখনও সে জীবনের ক্লান্তিবোধ, শরীরের ক্লান্তিবোধের কথা কিছুই জানে না! যেদিন জানবে সেদিন কি তারও মনে হবে যে জীবনটাকে আসলে প্ল্যান করে এগিয়ে নেয়া সম্ভব? তার বয়সে তো যুক্তি কাজ করে না!

মেয়ের জন্য রোমানার একধরণের উদাসীন চিন্তা হয়। চিন্তার মূলে (নিজেকে আশ্চর্য করে দিয়ে) নিহিত থাকে যার জীবন তার জীবন তত্ত্ব। যার ভুল তার ভুল, এবং ভুলের ভেতর দিয়ে শিক্ষালাভ করা বা না করার তত্ত্ব! সে পাশবালিশকে আকর্ষণ করে শোয়। তার খুব ইচ্ছা করে এই অদ্ভুত নির্মোহী ভাবনাগুলোর কথা পাশের ঘুমন্ত মানুষটিকে জানাতে-কিন্তু কিছুতেই আর এতদিন পরে অনভ্যস্ত কন্ঠস্বর কাজ করে না। কোনো অভিযোগ নেই কারো প্রতি। তবু অনেকদিন পর মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে একা জাগার ভয়াল নিস্তব্ধতা তাকে আতঙ্কিত করে। তার কাঁদতে ইচ্ছে করে।অথচ কিছুতেই আর তার চোখে জল আসে না!


মন্তব্য

নাহার মনিকা [অতিথি] এর ছবি

এক চুমুকে পড়লাম। সুললিত লেখা... ভালো লাগলো মণিকা!

মণিকা রশিদ এর ছবি

ধন্যবাদ মনিকা আপা, আপনার ভাল লেগেছে জেনে সবসময় উৎসাহ পাই।
______________________________
আর সব যুদ্ধের মৃত্যুর মুখে হঠাৎ হাসির মতো ফুটে ওঠা পদ্মহাঁস
সে আমার গোপন আরাধ্য অভিলাষ!
--আবুল হাসান

----------------------------------------------
We all have reason
for moving
I move
to keep things whole.
-Mark Strand

স্নিগ্ধা এর ছবি

ভালো লাগলো!

মণিকা রশিদ এর ছবি

ধন্যবাদ,স্নিগ্ধা !

_______________________________
আর সব যুদ্ধের মৃত্যুর মুখে হঠাৎ হাসির মতো ফুটে ওঠা পদ্মহাঁস
সে আমার গোপন আরাধ্য অভিলাষ!
--আবুল হাসান

----------------------------------------------
We all have reason
for moving
I move
to keep things whole.
-Mark Strand

মৃত্তিকা এর ছবি

ভালো লাগলো লেখার ধরণ।

মণিকা রশিদ এর ছবি

ধন্যবাদ, মৃত্তিকা ।

_______________________________
আর সব যুদ্ধের মৃত্যুর মুখে হঠাৎ হাসির মতো ফুটে ওঠা পদ্মহাঁস
সে আমার গোপন আরাধ্য অভিলাষ!
--আবুল হাসান

----------------------------------------------
We all have reason
for moving
I move
to keep things whole.
-Mark Strand

দময়ন্তী এর ছবি

ভাল লাগল৷
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

মণিকা রশিদ এর ছবি

ধন্যবাদ।

_______________________________
আর সব যুদ্ধের মৃত্যুর মুখে হঠাৎ হাসির মতো ফুটে ওঠা পদ্মহাঁস
সে আমার গোপন আরাধ্য অভিলাষ!
--আবুল হাসান

----------------------------------------------
We all have reason
for moving
I move
to keep things whole.
-Mark Strand

অতিথি লেখক এর ছবি

দারুণ লাগলো। কখন শেষ হয়ে গেলো বোঝলাম না।

ধন্যবাদ সুন্দর লেখা উপহার দেয়ার জন্য।

দলছুট।

মণিকা রশিদ এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকে।

_______________________________
আর সব যুদ্ধের মৃত্যুর মুখে হঠাৎ হাসির মতো ফুটে ওঠা পদ্মহাঁস
সে আমার গোপন আরাধ্য অভিলাষ!
--আবুল হাসান

----------------------------------------------
We all have reason
for moving
I move
to keep things whole.
-Mark Strand

রানা মেহের এর ছবি

খুব তাড়াহুড়ো করে লেখা মনে হলো
আরেকটু গোছানো যেতো
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

মণিকা রশিদ এর ছবি

ধন্যবাদ। লেখাটাকে নিয়ে ঘষামাজার ইচ্ছে রয়েছে। তবে আমার সমস্যা হচ্ছে নিজে বুঝতে পারিনা কেউ বলে না দিলে অনেকসময়।
_______________________________
আর সব যুদ্ধের মৃত্যুর মুখে হঠাৎ হাসির মতো ফুটে ওঠা পদ্মহাঁস
সে আমার গোপন আরাধ্য অভিলাষ!
--আবুল হাসান

----------------------------------------------
We all have reason
for moving
I move
to keep things whole.
-Mark Strand

তানবীরা এর ছবি

পঞ্চতারা। তোমার বাংলা পড়লে নার্ভাস লাগে তাই সাধু ভাষায় চলে যাই। ভালো থেকো

**************************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

মণিকা রশিদ এর ছবি

ম্যাডাম, লজ্জা দিলেন! তোমার রসবোধে পরিপূর্ণ লেখা যতবার পড়ি, হিংসাই।
_______________________________
আর সব যুদ্ধের মৃত্যুর মুখে হঠাৎ হাসির মতো ফুটে ওঠা পদ্মহাঁস
সে আমার গোপন আরাধ্য অভিলাষ!
--আবুল হাসান

----------------------------------------------
We all have reason
for moving
I move
to keep things whole.
-Mark Strand

বইখাতা এর ছবি

ভালো লাগলো।

মণিকা রশিদ এর ছবি

ধন্যবাদ সবাইকে, পড়ার ও মন্তব্য করার জন্যে।
_______________________________
আর সব যুদ্ধের মৃত্যুর মুখে হঠাৎ হাসির মতো ফুটে ওঠা পদ্মহাঁস
সে আমার গোপন আরাধ্য অভিলাষ!
--আবুল হাসান

----------------------------------------------
We all have reason
for moving
I move
to keep things whole.
-Mark Strand

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

ভালো লাগলো বেশ...

এখানে এখন নিস্তব্ধতা ঘুমায়, এখানে এখন নিরুৎসাহ ঘুমায়। এখানে এখন রাত জেগে অপ্রয়োজোনীয় গল্প করার কোনো কুয়াশা নেই!

এই বাক্যটা বেশি ভালো লাগলো
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

মণিকা রশিদ এর ছবি

পড়েছেন জেনে সত্যি ভাল লাগলো।
_______________________________
আর সব যুদ্ধের মৃত্যুর মুখে হঠাৎ হাসির মতো ফুটে ওঠা পদ্মহাঁস
সে আমার গোপন আরাধ্য অভিলাষ!
--আবুল হাসান

----------------------------------------------
We all have reason
for moving
I move
to keep things whole.
-Mark Strand

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

চমৎকার !! এক্সেলেন্ট একটা প্লট- দারুণ লেগেছে।

---------------------------------------------------------------------------

মধ্যরাতের কী-বোর্ড চালক

মণিকা রশিদ এর ছবি

ধন্যবাদ। আপ্নের লেখাও ভালোপাই।
_______________________________
আর সব যুদ্ধের মৃত্যুর মুখে হঠাৎ হাসির মতো ফুটে ওঠা পদ্মহাঁস
সে আমার গোপন আরাধ্য অভিলাষ!
--আবুল হাসান

----------------------------------------------
We all have reason
for moving
I move
to keep things whole.
-Mark Strand

জি.এম.তানিম এর ছবি

ভালো লেগেছে!
-----------------------------------------------------------------
কাচের জগে, বালতি-মগে, চায়ের কাপে ছাই,
অন্ধকারে ভূতের কোরাস, “মুন্ডু কেটে খাই” ।

-----------------------------------------------------------------
কাচের জগে, বালতি-মগে, চায়ের কাপে ছাই,
অন্ধকারে ভূতের কোরাস, “মুন্ডু কেটে খাই” ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।