প্রান্তিক ধ্রুবতা

মণিকা রশিদ এর ছবি
লিখেছেন মণিকা রশিদ (তারিখ: রবি, ১১/১২/২০১১ - ২:৩৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বহুদিন নিস্তব্ধতায় কেটেছে তার নিয়নের রাতগুলি, মেঘের সকাল সমূহ। নিটোল পুকুরের কালো কৈ মাছের ডাঙ্গায় ভ্রমণের ছটফটানিতে তার সারা গোধূলী অস্থির হয়েছে অসংখ্যবার। এই সব অস্থিরতার আড়ালে বেঁচে থাকার আকুলতা কখনো কখনো ফিরে এসেছে, কখনো জীবন্মৃত্যুর জটিলতার ড্রয়ারে তালাবদ্ধ রাখতে হয়েছে সূর্যালোকের প্রেমপ্রার্থী অবান্তর ইচ্ছেগুলোকে। অন্ধকারে একটি উজ্জ্বল ঘরের জন্ম হয়েছে গোপনে গোপনে। কিছু কৌতুহলী ফুল ও তাদের সবুজ পাতারা এভাবেই শুকিয়ে ফ্রেমের শিল্প হয়; বিগত যৌবনের স্মৃতির গল্পে ভরিয়ে রেখে রেখে, অক্ষমতার ঋণ শোধ করে করে বার্ধক্যবরণ! কিন্তু, এ গল্প বেঁচে ওঠা এক প্রজাপতির গল্প।

একদিন রাত্রির অন্ধকারে শিশির এসে তার বন্ধ দরজায় টোকা দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,” আলো প্রবেশ করতে দাও! এই মৃত্যু তোমার জন্যে নয়। তোমার গোপন কাঠে ঘুণ ধরেছে, তাকে এবার কংক্রিটে বাঁধাও। ক্ষয়ে গেলে আর সময় থাকবে না! এখনো সময় আছে!”
গহীন ঘুমের অন্ধকারে কন্ঠস্বর পৌঁছায়, স্পর্শ পৌছায়! প্রজাপতি জেগে ওঠার জন্যে, আবার আঘাতের সহ্য শক্তি অর্জনের জন্যে প্রস্তুত হয়।
এ গল্প ওই দুজনার-মৃত্যুকামী এক প্রজাপতি আর তার স্পর্শদাতা শিশিরের।

শিশির তাকে তীব্র আলিঙ্গনে বেঁধে বেঁধে বসন্তের আলাপ শোনায়। অসহ্য মধুর বিস্তারে তার শ্রবণেন্দ্রিয় অন্ধ করে দিয়ে হঠাৎ বাষ্পের আদরে মিলায়। আবার ফিরে আসে, আবার গল্প বলে, আবার হারায়-কিছু না বলেই। সে কোনো প্রতিবাদ করে না শিশিরের এই দুর্বোধ্য মতিগতির। চিরন্তন শেকলে সে বাঁধা পড়ে যায়। অনাকাংক্ষিত আত্মসমর্পণে সে তার প্রিয়তম শিশিরের ক্রীতদাস হিসেবে নতুন জীবন শুরু করে।

তার দিন চলে একা একা, তাদের রাত্রি আসে দুজনার। কীরকম একা থাকা, কোনভাবে তা দুজনার সে ঠাহর করতে পারে না, ইন্দ্রিয় তাকে কিছু বলে না, হৃদয় ব্যর্থ হয়, তাদের সম্মিলিত উপস্থিতি ঠিক ধরতে পারে না। কখনো রোদের উজ্জ্বলতায় চোখ যায় প্রতিবেশীর দীর্ঘ চুম্বনের দৃশ্যে; কখনো জোর করে পরিস্কার করতে হয় বাগানের অবাঞ্চিত আগাছা, তাদের রূপসী ফুলেদের। সুন্দরকে বিলুপ্ত করতে তার বুকে পেরেক বেঁধার মত ব্যথা অনুভূত হয়। অথচ বাগানের আর সব ফুলেদের তো ছেড়ে দিতে হবে তাদের অধিকার। তাদের পাতাদের জল দেয়া, তাদের কুঁড়িদের ফুটতে দেয়া খুব বড় এক দায়িত্ব। অতএব, তাদের অন্যরকম গল্পে এরাও সামিল হয়- আগাছারা, তাদের দুঃখী ফুলেরা এবং যত্নে কেনা দামী ফুলেদের গাছেরা। এখানে মাটির ভূমিকাও গৌণ নয়। তাদেরও কিনে আনতে হয়। সাধারণ মাটিরা অসাধারণ ফুল ফোটাতে পারেনা। তারা শুধু আগাছা ও ঘাসেদের স্বাস্থ্য বাড়ায়।

অসাধারণ দামী মাটিরা তাকে শাসায়,” এভাবে নয়, অন্যভাবে! সকাল বিকাল জল না দিলে আমিও ওই উষর মাটির মতন নিষ্ফলা হয়ে যাব; আর তখন তোমার উদাসীনতা ধরা পড়ার সমূহ সম্ভাবনা!”

সে তখন ধাঁধাঁয় পড়ে যায় তার বিগত ও বর্তমানের জীবন নিয়ে। ভেবে ঠিক করতে পারে না অন্ধকার ভালো ছিলো নাকি আলোর চুম্বন ভালো। শিশিরের প্রতি তার গোপন অভিমান, সুপ্ত অভিযোগগুলো আবার তাকে নিরন্তর অস্থির করে তোলে, অন্যরকম-নতুন অস্থিরতা! সে ঠিক করে বাগান বাড়াবে না, গাছেদের জল দেবে না, জানালা বন্ধ করে রাখবে যাতে প্রতিবেশীর দীর্ঘ চুম্বনের দৃশ্য অবলোকন করতে না হয়! অথচ, বাগান বাড়তে থাকে, পাতাদের কাঁপুনী বাড়তে থাকে; বিষাদিত মানুষদের আকৃষ্ট করতে লোকেদের চুম্বন-আলিঙ্গনের বিজ্ঞাপণ বাড়তেই থাকে। স্বেচ্ছামৃত্যুর গহবরে শিশিরের স্পর্শ পাওয়া দুঃখী প্রজাপতির মধ্যে দুর্দমনীয় জীবন তৃষ্ণা ঘর-বারান্দা-দাওয়া ছাপিয়ে প্লাবনের মতন বাইরে আসতে থাকে। শিশিরের গোপন সঙ্গমে সে উজ্জীবিত হয়, চরম অবহেলায় ভেঙে ভেঙে যায়। বাস্পায়িত শিশিরের স্পর্শের ক্ষতগুলো পরম আদরে ঘষতে ঘষতে প্রজাপতি আবশেষে তার গল্পের শেষাংশে পৌঁছাতে পারে। তার অপমৃত্যু যেমন অস্বাভাবিক ছিলো, তার এই বেঁচে থাকার গল্পও তেমনি স্বাভাবিক নয়, বুঝতে পারে সে।

তবু সেই বোকা প্রজাপতি বেঁচে থাকার ধ্রুবতাকে মেনে নেয়; অবাঞ্চিত আগাছার অবলুপ্তিকে মেনে নেয়, শিশিরের প্রস্থানকেও সে মেনে নিতে পারে। সমস্ত দিনযাপনের আনন্দ এবং বিষন্নতাটুকুকে সে আমন্ত্রণ জানায় নিজের গল্পে প্রবেশের। গল্পের প্রান্তিকে পৌঁছে বুঝতে কোনই কষ্ট হয় না যে এ গল্প তার শুধুই একার গল্প!


মন্তব্য

অন্যকেউ এর ছবি

তার দিন চলে একা একা, তাদের রাত্রি আসে দুজনার। কীরকম একা থাকা, কোনভাবে তা দুজনার সে ঠাহর করতে পারে না...

অপূর্ব! চলুক

_____________________________________________________________________

বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায়।

তারেক অণু এর ছবি

অন্ধকারে একটি উজ্জ্বল ঘরের জন্ম হয়েছে গোপনে গোপনে চলুক

তাপস শর্মা এর ছবি

সুন্দর। ভালো লাগল দিদি।

রফিকুল ইসলাম এর ছবি

আমি নতুন পাঠক আপনার লেখা আমার ভাল লেগেছে । বিষেশ করে আপনার লেখার এবং ভাষার। উত্তম জাঝা! চলুক

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

চমৎকার শব্দচয়ন!

যাযাবর ব্যাকপ্যাকার এর ছবি

ইদানীং আপনি আমার কথাগুলো বলে ফেলছেন শতগুণ বেশি নিপুণ দক্ষতার সাথে!

___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।

আশরাফুল কবীর এর ছবি

#খুব সুন্দর লিখেছেন, খুব ভাল লেগেছে। চলুক

অনিকেত এর ছবি

তবু সেই বোকা প্রজাপতি বেঁচে থাকার ধ্রুবতাকে মেনে নেয়; অবাঞ্চিত আগাছার অবলুপ্তিকে মেনে নেয়, শিশিরের প্রস্থানকেও সে মেনে নিতে পারে। সমস্ত দিনযাপনের আনন্দ এবং বিষন্নতাটুকুকে সে আমন্ত্রণ জানায় নিজের গল্পে প্রবেশের। গল্পের প্রান্তিকে পৌঁছে বুঝতে কোনই কষ্ট হয় না যে এ গল্প তার শুধুই একার গল্প!

--- গুরু গুরু

মোঃ আঃ মোমেন তালুকদার এর ছবি

আশার আলো।
আমাদের জীবনে আনেকেরই আনেক আশা নিয়ে পথ চলতে থাকি,আমরা কি কোন দিন ভেবে দেখেছি আমাদের কথ টুকু আশা সফল হয়েছে।মানব জীবনে আশার কোন শেষ নাই। তাই এক বার ভেবে দেখা উচিত কোথায় ছিলাম কোথয় আসলাম কোথায় আবার চলে যাব ।এই জন্য আমাদে আশার সাথে সাথে আমাদের চরিএটাকে গঠন করে নিতে হবে।আমরা যখন না থাকব লোকে যেন আমাদের কথা স্বরন করে।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

এ গল্প ওই দুজনার-মৃত্যুকামী এক প্রজাপতি আর তার স্পর্শদাতা শিশিরের।

মন খারাপ

বিষন্ন সুন্দর বর্ননা!

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

দুর্দান্ত এর ছবি

ভাল লেগেছে। মূলত পেলব ও নরম এই কথাগুলোর ফাঁকে ফাঁকে নিয়ন, ড্রয়ার, ফ্রেম, কনংক্রীট এর ঠান্ডা তীক্ষণতা অনুভব করেছি।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।