মরুযাত্রা ৯ম পর্ব : বাদশাহি উপত্যকায় ছদ্মবেশী নারী ফেরাউন

মন মাঝি এর ছবি
লিখেছেন মন মাঝি [অতিথি] (তারিখ: বিষ্যুদ, ০২/০২/২০১২ - ৫:৩৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বাদশাহি উপত্যকা। লুক্সোর।

বাদশাহি উপত্যকা

লুক্সোরে কর্নক মন্দিরের পরে আমার পরবর্তী গন্তব্য হল শহরের পাশ দিয়ে যাওয়া নীলনদের পশ্চিম পারে বিখ্যাত বাদশাহি উপত্যকা, অর্থাৎ ভ্যালি অফ দ্য কিংস এবং তার পার্শ্ববর্তী ভ্যালি অফ দ্য কুইন্স

ব্রিজের ওপর দিয়ে নদী পার হয়ে মাইলের পর মাইল সবুজের চিহ্নহীণ বিশুষ্ক মরুভূমি পেরিয়ে একটা রুক্ষ পাথুরে সৌন্দর্যের পাহাড়ি উপত্যকায় পৌঁছুলাম। এখানে খাজবহুল পাহাড়গুলিই যেন একেকটি বুনো ভাষ্কর্য - প্রকৃতি যার শিল্পী।

এই পাহাড়ের কোলকেই বলা হয় বাদশাহি উপত্যকা। এমন নামকরনের কারন এই উপত্যকার পাদদেশেই প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে - ১৬শ বি.সি. থেকে ১১শ বি.সি. পর্যন্ত পাঁচশ' বছর ধরে গড়ে উঠেছে তৎকালীণ মিশরীয় ফারাও আর অভিজাতদের জন্য অনেকগুলি ভূঃগর্ভস্থ সমাধিমন্দির।

বাদশাহি উপত্যকা বলতে আমি অবশ্য ভ্যালি অফ দ্য কিংস আর তার পাশের ভ্যালি অফ দ্য কুইন্স এবং দের আল-বাহরি উপত্যকাকেও বুঝাচ্ছি, যদিও এরা আসলে আলাদাভাবে নিজস্ব নামেই পরিচিত। তবে এর মধ্যে ভ্যালি অফ দ্য কিংস নামটাই বেশি বিখ্যাত এবং অনেক সময় সুবিধার জন্য এই এক নামেই বাকিগুলিকেও একসাথে বোঝানো হয়।

বাদশাহি উপত্যকা। লুক্সোর।

এই এলাকা, এদেশের অন্যসব ঐতিহাসিক স্থানের মতই, মিশরীয় প্রত্নতাত্ত্বিক দপ্তরের অধীনে সংরক্ষিত ও নিয়ন্ত্রিত। মূল এলাকায় পৌঁছুনোর অনেক আগেই বাইরের পেরিমিটারের গেটে নেমে হেঁটে ঢুকতে হলো। কিন্তু না, পৌঁছুনোর এখানেই শেষ নয়। এরপর একটা টয়-ট্রেন জাতীয় ট্রেনে চেপে অনেকখানি পথ পাড়ি দিয়ে তবেই মূল দ্রষ্টব্য স্থানে পৌঁছুতে হয়। মজাই লাগে।

বাদশাহি উপত্যকা। লুক্সোর।

ভ্যালি অফ দ্য কিংস বাইরে থেকে চট করে বোঝার মত কিছু না। আসলে কিছুই যাতে বোঝা না যায় বাইরে থেকে - সেভাবেই এটা বানানো হয়েছিল সেযুগে। বাইরে থেকে এটা লোকালয় থেকে অনেকদূরে নেহাতই ধূসর, রুক্ষ, নিষ্পত্রপ, পাথুরে, জনমানবহীণ একটা উপত্যকা মাত্র। কিন্তু এই পাথরের তলায় কি অতুলনীয় ধনসম্পদ লুকিয়ে আছে তাতো এর নির্মাতারা জানতেন। প্রবাদের সাত রাজার নয়, বরং আরো অনেক বেশি রাজার ধন। সেজন্যেই এত লুকোচুরি। তাতে অবশ্য খুব একটা লাভ হয়নি - সেই প্রাচীণ কালেই বেশির ভাগ সোনাদানা চুরি ও লুটপাট হয়ে গেছে। মানব ইতিহাসে এখনো টিকে থাকা প্রথম রেকর্ডেড চুরির মামলা এখানকারই এক চুরির ঘটনায় - সেই প্যাপিরাসও পাওয়া গেছে অন্যত্র।

এলাকাটা প্রাচীণকাল থেকেই একটা টুরিস্ট স্পটে পরিণত হয় - বিশেষ করে শেষের দিকের রোমান শাসনামল থেকে। সেসময়ের অনেক গ্রাফিতি (পর্যটকদের স্বাক্ষর ইত্যাদি) এখনো বেঁচে আছে এখানকার পাথরের বুকে। গ্রীক, লাতিন, ফিনিশীয়, সিপ্রিয়ট, লাইসিয়ান, কপ্টিক সহ আরো বেশ কিছু ভাষায় এমন সব গ্রাফিতি পাওয়া যায়।

ভ্যালি অফ দ্য কিংস -এ মোট ৬৩টি ভূঃগর্ভস্থ সমাধিমন্দির এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়েছে। এর মধ্যে স্রেফ এক কক্ষবিশিষ্ট সমাধি যেমন রয়েছে, তেমনি ১২০টি পর্যন্ত কক্ষসম্পন্ন সমাধিমন্দিরও রয়েছে।

গাইডের সাথে আমি এই উপত্যকার ভিতর দিয়ে ঘুরতে লাগলাম। পাহাড়ের আঁকেবাঁকে নীচের ভূঃগর্ভস্থ সমাধিমন্দিরে ঢোকার জন্য এযুগে পাকা করা প্রবেশপথ দেখা যাচ্ছে। ঢুকলামও দুয়েকটির ভিতর।

তুতানখামুনের ভূগর্ভস্থ সমাধিমন্দিরের প্রবেশপথ। বাদশাহি উপত্যকা।

সমাধিমন্দিরগুলির অভ্যন্তরভাগ নানারকম প্রাচীণ পুরাকথার দেয়ালচিত্রে পরিপূর্ণ। একসময় অনেক ধনসম্পত্তি ছিল, এখন আর সেসবের বালাই নেই। বর্তমান যুগে যা পাওয়া গেছে (যেমন তুতানখামুনেরটায়) সেসবও কায়রোতে মিশরীয় যাদুঘরে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। যেসব মমি পাওয়া গেছে সেগুলিও এখন যাদুঘরে, এখানে না। তবে খালি স্যাকোফেগাসগুলি রয়ে গেছে অনেক ক্ষেত্রে। স্যাকোফেগাস হচ্ছে মমির মূল কফিন রাখার জন্য মাটির সাথে আটকানো আরেকটা ঢাকনিঅলা বৃহত্তর ভারি পাথরের তৈরি আধার। এসব সত্ত্বেও এখনো সেসময়ের জৌলুসটা কিন্তু বোঝা যায় অনেক ক্ষেত্রেই। তবে এসবের ছবি তেমন তোলা সম্ভব হয়নি - ভিতরে ছবি তোলা নিষিদ্ধ হওয়ায়।

শূন্য স্যাকোফেগাস। বাদশাহি উপত্যকা।

ভ্যালি অফ দ্য কিংস -এর প্রাচীণ মিশরীয় অফিশিয়াল নাম ছিল - "পশ্চিম থিব্‌সে ফারাও, জীবন, শক্তি, আর স্বাস্থ্যের লক্ষ-লক্ষ বছরের মহান ও রাজকীয় সমাধিপুরী " । হিরোগ্লিফিকে লেখাটা এরকম (সূত্রঃ উইকি) --

ভূঃগর্ভস্থ সমাধিমন্দিরের ভেতরে দেয়ালচিত্র। বাদশাহি উপত্যকা। লুক্সোর।

ভূঃগর্ভস্থ সমাধিমন্দিরের ভেতরে দেয়ালচিত্র। বাদশাহি উপত্যকা।

ভূঃগর্ভস্থ সমাধিমন্দিরের ভেতরে দেয়ালচিত্র। বাদশাহি উপত্যকা।

ভূঃগর্ভস্থ সমাধিমন্দিরের ভেতরে দেয়ালচিত্র। বাদশাহি উপত্যকা।

ভূঃগর্ভস্থ সমাধিমন্দিরের ভেতরে দেয়ালচিত্র। বাদশাহি উপত্যকা।

নিকটস্থ ভ্যালি অফ দ্য কুইন্স -ও মোটামুটি একই রকম। এখানে মূলত রাণী, রাজপুত্র, রাজকন্যা আর বিভিন্ন অভিজাতদের সমাধিস্থ করা হতো। ৭০-টারও বেশি ভূঃগর্ভস্থ সমাধিমন্দির এখানে আছে বলে ধারণা করা হয়। এগুলিও কম জৌলুসপূর্ণ ভাবে অলঙ্কৃত ছিল না। এর মধ্যে রাণী নেফারতারিরটা (১২৯০-১২২৪ বি.সি.) উল্লেখযোগ্য। ইনারটার দেয়ালচিত্র ও রিলিফগুলি এখনো অনেকখানিই অক্ষত রয়ে গেছে।

ভিডিওঃ রাণী নেফারতারির ভূগর্ভস্থ সমাধি মন্দির। বাদশাহি উপত্যকা। এটা দেখার মত!

নারী ফারাও হাৎশেপ্‌সুৎ ও তার দরগাহ

ভ্যালি অফ দ্য কিংস থেকে ঘুরতে ঘুরতে পাহাড়ের ওপাশে প্রতিবেশী দের আল-বাহরি উপত্যকায় ইতিহাসের প্রথম পরাক্রমশালী নারী-নৃপতি ফারাও হাৎশেপ্‌সুতের দরগা'তে চলে আসলাম। এর আদি মিশরীয় নাম 'ড্‌জেসের ড্‌জেসেরু' । নামের মত পরিবেশটাও একদম ঢেঁসেরু এগজটিক।

ফারাও হাৎশেপ্‌সুতের দরগাহ ড্‌জেসের ড্‌জেসেরু। দের আল-বাহরি উপত্যকা। পঃ লুক্সোর।

ফারাও হাৎশেপ্‌সুতের দরগাহ ড্‌জেসের ড্‌জেসেরু। দের আল-বাহরি উপত্যকা। পঃ লুক্সোর।

বিশাল পাথুরে ক্লিফকে পশ্চাৎপটে রেখে এই অবাক নির্জনতায়, দীর্ঘ সমান্তরাল স্তম্ভ সারিতে গাঁথা থাকে-থাকে টেরাসে সাজানো রাজকীয় মন্দিরটাকে দূর থেকে দেখে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। মনে হচ্ছিল ইতিহাস আর ভূগোলের এক সুদূর অপার্থিব সঙ্গমস্থলে কোন গা-ছমছমে অচিনপুরীতে এসে পড়েছি।

মাটি থেকে টেরাসগুলি দীর্ঘ র‍্যাম্প মারফৎ সংযুক্ত। ছবিতে দেখুন যার উপর দিয়ে টুরিস্টরা উঠছেন। এই র‍্যাম্প ও টেরাসগুলি একসময় সুদূর ও রহস্যময় 'পান্ট'-রাজ্য (ল্যান্ড অফ পান্ট্‌) থেকে আমদানি করা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ব্যবহার্য সুগন্ধীর উৎস ফ্র্যাংকিন্সেন্স ও ম্যর্‌ গাছসহ বিভিন্ন দেশি-বিদেশি গাছপালায় আচ্ছন্ন বাগান আর জলাধারে সুশোভিত ছিল। হাল্কা খাকি রঙের ধূ-ধূ নির্জন মরূভূমি আর কঠিন পাথুরে পাহাড়ের মাঝে হঠাৎ করেই যেন একটা অলৌকিক অশ্রুসজল পান্নার ফোঁটা - এক অপ্রত্যাশিত স্বর্গীয় মরুদ্যান! তার মাঝে এই অদ্ভূত মন্দির। এমনটাই কি ভিশন ছিল মূল স্থপতির?

ফারাও হাৎশেপ্‌সুতের দরগাহ ড্‌জেসের ড্‌জেসেরু। দের আল-বাহরি উপত্যকা। পঃ লুক্সোর।

টেরাসের স্তম্ভসারির সামনের দিকের প্রতিটি স্তম্ভেই বোধহয় একসময় লাগানো ছিল দেবদেবীর মুর্তি। এখনো কিছু আছে তার। তবে আরো অনেক ছিল - বিশেষ করে দেবতা অসিরিসের দু'টি বিশাল মূর্তি। ছিল কর্নকের মত স্ফিংক্স-সড়ক - সম্ভবত উপত্যকার প্রবেশমুখ থেকে মন্দিরের র‍্যাম্পের গোড়া পর্যন্ত। আর মন্দিরের ভেতরে আছে থিব্‌সের নিজস্ব রীতির সিংহফটক, প্রাঙ্গন, স্তম্ভহল, সূর্যদরবার, প্রার্থনাকক্ষ, বেদি ও বেদিকক্ষ। ছিল রিলিফ আর ম্যুরালে বিধৃত নানান আচার-অনুষ্ঠান আর ইতিহাস ও পুরাকথার চিত্রায়ন - যার কিছু এখনো আছে। ছিল বিভিন্ন ভঙ্গিমায় ফারাও হাৎশেপ্‌সুতের অসংখ্য ভাষ্কর্য - দাঁড়িয়ে, বসে, হাঁটু গেড়ে। তবে এই ভাষ্কর্যগুলির বেশির ভাগই এখন আর নেই। বলা হয় হাৎশেপ্‌সুতের মৃত্যুর পর তার প্রতিহিংসাকাতর সৎছেলে ফারাও ৩য় থুৎমোসের আদেশে এখানে ব্যাপক ধ্বংসসাধন হয়। তাছাড়া বিংশ শতাব্দীর (খৃঃ) শুরুর দিকে এক বিভ্রান্ত সংরক্ষণ ও পূণর্নির্মান কার্যক্রমের ফলে আদি মন্দিরটার স্থাপত্য উল্লেখযোগ্য ভাবে পরিবর্তিত হয়ে যায়।

এই স্মৃতিমন্দির নির্মানের তত্ত্বাবধানে এবং সম্ভবত নকশাও তৈরি করেছিলেন ফারাও হাৎশেপ্‌সুতের উজির, রাজ-স্থপতি ও সম্ভবত তার প্রেমিক - সেনেমুত।

ফারাও হাৎশেপ্‌সুতের দরগাহ ড্‌জেসের ড্‌জেসেরু। দের আল-বাহরি উপত্যকা। পঃ লুক্সোর।

কে এই হাৎশেপ্‌সুত?

ফারাও হাৎশেপ্‌সুত মিশরের ইতিহাসে সফলতম ও দীর্ঘতম রাজত্বকালের (২২ বছর) নারী শাসক। যুদ্ধে, শান্তিতে, বানিজ্যে ও দেশের সামগ্রিক সমৃদ্ধি ও বৈভবে সফলতম ফারাওদের অন্যতম বলে পরিগণিত। তার রাজত্বকালেই মিশরীয় স্থাপত্যরীতির এক ব্যাপক ও গুণগত উন্নতি বা উল্লম্ফন ঘটে - যাকে মিশরের জন্য গ্রেকো-রোমান ক্লাসিকাল স্থাপত্যের পর্যায়ভূক্ত বলা যায়। এই উলম্ফন পরবর্তী এক হাজার বছর পর্যন্ত অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। কোন কোন বিশেষজ্ঞের ধারনা হাৎশেপ্‌সুতের আমলের স্থাপত্যরীতি কিছু কিছু ক্ষেত্রে হাজার বছর পরে গ্রেকো-রোমান স্থাপত্যের আসল পূর্বসূরী।

টয় ট্রেন থেকে ফারাও হাৎশেপ্‌সুতের দরগাহ ড্‌জেসের ড্‌জেসেরু। দের আল-বাহরি উপত্যকা।

হাৎশেপ্‌সুতের রাজত্বের সবচেয়ে বিতর্কিত ও চমকপ্রদ দিকটি হলো প্রাচীন মিশরে নারী শাসক হওয়াটা সহজ বিষয় ছিল না। তার আগে আরো কয়েকজন নারী শাসক থাকলেও তাদের একজন বাদে কেউই মনে হয় পূর্ণাঙ্গ সার্বভৌম ফারাও ছিলেন না। অন্তত ক্ষমতা ও পরাক্রমে হাৎশেপ্‌সুতের ধারে কাছেও না। হাৎশেপ্‌সুত তার শাসনামলের প্রথমদিকে স্বয়ং অনেকগুলি যুদ্ধ জয় করে নিজের বিক্রম প্রতিষ্ঠা করেন। তাছাড়া ধর্মীয় দিক থেকেও ফারাও হওয়াটা কঠিন ছিল, কারন ধর্মীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী ফারাওরা সবসময়ই মর্ত্যধামে মহাদেবতা আমুনের সাক্ষাৎ অবতার এবং পুত্রসন্তান (গড-কিং) -যা কিনা পুরুষরাই হতে পারত। ফারাওত্ব আর পুরুষ পরিচয় প্রায় অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত ছিল। হাৎশেপ্‌সুতই সম্ভবত এর প্রথম জোরালো ব্যতিক্রম - প্রথম পূর্ণাঙ্গ নারী ফারাও - 'রাজার স্ত্রী রানি' বা 'মহান রাজপত্নী' না - নিজেই অপ্রতিদ্বন্দ্বী সার্বভৌম পূর্ণ ফারাও। তিনি নিজের ফারাওত্বকে বৈধতা প্রদানের জন্য এমনকি অন্য পুরুষ ফারাওদের মত তার নিজের ঐশ্বরিক-উৎস সংক্রান্ত সম্পূর্ণ নতুন কিছু ধর্মকাহিনি আবিষ্কার ও প্রচলন করেন।

এমনি এক রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির জন্য উদ্ভাবিত মীথ হচ্ছে - মহাদেবতা আমুন চারিদিক আলো আর সুগন্ধির বন্যা বইয়ে দিতে দিতে এক রাতে তার মা আহমোসের সাথে বাবা ১ম থুৎমোসের রূপধারণ করে মিলিত হন। মিলনের এক পর্যায়ে আমুন তার মায়ের নাকে 'আন্‌খ' বা 'জীবনচাবি' নামে বিখ্যাত মিশরীয় পবিত্র প্রতীকটা ধরলে আহমোস কনসিভ করেন। এরপর মাতৃগর্ভের জন্য কুমোরের চাকায় মাটি দিয়ে মানবশিশুর দেহ নির্মানকারী দেবতা খ্‌নুম -কে নির্দেশ দেয়া হয় হাৎশেপ্‌সুতের জন্য একটা দেহ আর একটা 'কা' অর্থাৎ আত্না তৈরি করতে। জীবন ও উর্বরতার দেবী হেকেৎ এবং দেবতা খ্‌নুম এরপর আহমোসকে একটা সিংহীর বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দেন। এই সিংহীর বিছানাতেই হাৎশেপ্‌সুত ভূমিষ্ঠ হন। এই কাহিনির মোরাল মনে হয় না বুঝা খুব কঠিন - শরীরে ঈশ্বর বাবার রক্ত (যীশুর কথা কেন যেন মনে করিয়ে দেয়), মানবী মায়ের সাথে তার আলো আর সুগন্ধির প্লাবনের মাঝে হলিউডি মিলন, সিংহীর শয্যায় ভূমিষ্ট হওয়া - প্রত্যেকটাই সমকালীণ জনগনকে প্রভাবিত করার জন্য অত্যন্ত জব্বরদস্ত পোটেন্ট চিত্রকল্প!

এই কাহিনির প্রতিটি ধাপ বাদশাহি উপত্যকায় দের আল-বাহরিতে হাৎশেপ্‌সুতের মন্দিরের দেয়ালচিত্রে বিধৃত রয়েছে।

শুধু এসবই না, এমনকি তাকে যাতে নারী ফারাও হিসেবে খাটো করা না যায়, সেজন্যে তার অনেক অফিশিয়াল মূর্তি ও ভাষ্কর্যতেও তাকে পুরুষ ফারাওর বেশে দেখা যায় পূর্ণ পুরুষোচিত রাজকীয় পোষাক সহ - মায় পুরুষ ফারাওদের আনুষ্ঠানিক (রিগালিয়া) নকল দাড়িসমেত! দের আল-বাহরিতে তার দরগাহ / স্মৃতিমন্দির থেকে এমনই একটা মূর্তির ছবি দিলাম এখানে। কোন কোন মুর্তিতে তার স্তন প্রায় অদৃশ্য।

নারী ফারাও হাৎশেপ্‌সুতের দাঁড়িওয়ালা পুরুষরূপী মূর্তি।
ড্‌জেসের ড্‌জেসেরু। দের আল-বাহরি।

নারী ফারাও হাৎশেপ্‌সুতের দাঁড়িওয়ালা পুরুষরূপী মূর্তি।
ড্‌জেসের ড্‌জেসেরু। দের আল-বাহরি।

হাৎশেপ্‌সুতের জীবন তিনজন ফারাও থুৎমোসের সাথে জড়িত। বহুযুদ্ধজয়ী এবং মিশরের অন্যতম সফল ফারাও ১ম থুৎমোস তার বাবা, ২য় থুৎমোস একাধারে তার সৎভাই ও স্বামী, এবং ৩য় থুৎমোস তার সৎছেলে, সৎভাতিজা এবং স্বামীর মৃত্যুর পর ২২ বছর নামকাওয়াস্তে সহশাসক। হাৎশেপ্‌সুতের স্বামী ২য় থুৎমোসের মৃত্যুর পর তার মনোনীত উত্তরাধিকারী ভিন্ন স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তান ৩য় থুৎমোস একান্ত নাবালক বিধায় হাৎশেপ্‌সুতই অন্তর্বর্তীকালীণ তত্ত্বাবধায়ক প্রশাসক (রিজেন্ট) পদে আসীন হন। কিছুদিন পর তিনি তত্ত্বাবধায়ক থেকে সহশাসক হয়ে যান। আর এর স্বল্পকাল বাদেই তিনি নিজেকে পুরোদস্তুর একজন সার্বভৌম গড-কিং ফারাও হিসেবে ঘোষনা দিয়ে বসেন। তবে সৎছেলেকে তিনি একেবারে অস্বীকার করেননি, বরং সে সাবালকত্ব অর্জন করে নিজের যোগ্যতার প্রমান দিলে তাকে সেনাপ্রধানের পদে নিয়োগ দেন। হাৎশেপ্‌সুত প্রবল পরাক্রমে দীর্ঘ ২২ বছর ৯ মাস মিশর শাসন করেন। তার মৃত্যুর পরেই কেবল তার সৎছেলে ৩য় থুৎমোস ফারাও হিসেবে অভিষিক্ত হন।

থ্রিডি দৃশ্যায়নঃ হাৎশেপ্‌সুতের মন্দির

কলোসি অফ মেম্‌নন বা মেম্‌ননের মূর্তি

বাদশাহি উপত্যকা আর হাৎশেপ্‌সুতের মন্দির ঘুরে ফেরার পথেই মনে হয় কলোসি অফ মেম্‌নন দেখতে গিয়েছিলাম। এটা হুইস্পারিং স্ট্যাচু নামেও পরিচিত। ভোর বেলা নাকি এদের একটাকে কাঁদতে শোনা যেত।

কলোসি অফ মেম্‌নন আর কিছুই না - বসা ভঙ্গিতে ফারাও ৩য় আমেনহোটেপের ৩৪০০ বছর পুরনো দু'টি বিশাল দৈত্যাকৃতির কোয়ার্জাইট বেলেপাথরের তৈরি মূর্তি। এখন অবশ্য দু'টো মূর্তিই ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, বিশেষ করে কোমরের উপর থেকে চেহারা আর চেনাই যায় না।

কলোসি অফ মেম্‌নন। লুক্সোর।

কলোসি অফ মেম্‌নন। লুক্সোর।

এই মূর্তি দু'টার আসল কাজ ছিল ফারাও ৩য় আমেনহোটেপের বিশাল স্মৃতিমন্দিরের মূল প্রবেশপথ পাহারা দেয়া। এই মূর্তিদু'টি বাদে আমেনহোটেপের ঐ মন্দিরের এখন আর প্রায় কিছুই অবশিষ্ট নেই, যা কিনা তার নিজস্ব সময়ে মিশরের বৃহত্তম ও সবচেয়ে জৌলুসপূর্ণ মন্দির ছিল।

কিংবদন্তী আছে, ২৭ বি.সি.-তে একটা বড় ভূমিকম্প পূব পাশের মূর্তিটাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে - কোমর থেকে উপরাংশ ভেঙ্গে পড়ে যায় আর নিম্নাংশতেও ফাটল ধরে। এরপর থেকেই নাকি ভাঙা মূর্তিটার রয়ে যাওয়া নিম্নাংশ প্রতিদিন ভোরে কান্নাকাটি করতো। মজার ব্যাপার হলো এটা স্রেফ একটা স্থানীয় গ্রাম্য লোককাহিনি নয়, বরং একাধিক বিশ্ববিখ্যাত গ্রেকো-রোমান ঐতিহাসিকও এই পাথরের মূর্তির কান্নার কথা লিখে গেছেন। এদের মধ্যে আছেন - স্ট্রাবো, পোসানিয়াস, প্লিনি, জুভেনাল। এর মধ্যে স্ট্রাবোর দাবি তিনি নাকি স্বকর্ণে এই কান্না শুনেছেন।

এই "ক্রন্দনশীল মেম্‌নন"-এর কিংবদন্তী, এই কান্নার সৌভাগ্য-আনয়নকারী ক্ষমতার খ্যাতি, এবং মূর্তিটার দৈববানী দেয়ার ক্ষমতা তখনকার জ্ঞাত বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। ফলে এখানে ভক্ত-দর্শনার্থীর কখনই ঘাটতি পড়েনি - যার মধ্যে একাধিক রোমান সম্রাট পর্যন্ত ছিলেন।

......................

রাতে এটিয়েম শামসুজ্জামানের আরবি সংস্করণ আমার তরুণীস্য বৃদ্ধ সিরিয়াল কোয়াড্রোগ্যামিস্ট হোটেল মালিক মশাই জীবনে প্রথমবারের মত 'বাংলাদেশি' দেখার আনন্দে (এবং নতুন ক্লায়েন্টেলের আশায়?) আমাদের একটা রুফটপ ডিনারে আপ্যায়িত করলেন। লুক্সোরের ওভারলুকিং দারুন ভিউ এই রুফটপ থেকে। প্রায় রূপকথার মত। দূরে ফারাওদের সমাধিঅলা পাহাড়ের কোলে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে আড্ডা দিচ্ছিলাম। এখন আর মনে নেই মেন্যু কি ছিল, তবে প্রচুর পরিমানে নানা রকম অভিনব ও সুস্বাদু কাবাব-কোফ্‌তা-মাংস জাতীয় জিনিষ ছিল বলে মনে পড়ছে। সেইসাথে ছিল বিশেষ ভাবে আমার জন্য তার নিজের হাতে বানানো দামি আপেল-ফ্লেভার্‌ড "শীষা"। আমাকে কিউবান সিগার খেতে দেখে আমাকে অভিজাত মিশরীয় "শীষা" দিয়ে ইম্প্রেস করার জন্য মনে হয় নিজের হাতে বানিয়ে দিলেন। কিন্তু হা হাতোম্মি! ভদ্রলোকের প্রানান্ত চেষ্টা সত্ত্বেও তাঁকে ব্যাপক বিব্রত করে এই "শীষা" জিনিষটা টানা কিছুতেই রপ্ত করতে পারলাম না। কাশতে কাশতে জান শেষ!

দারুন মজার এবং রসিক এই বয়স্ক মানুষটি। মিশরের চার শহরে ভদ্রলোকের চার বিবি। নাজায়েজ কিছু তিনি করবেন না, কিন্তু মাত্র চার বিবিতে সন্তুষ্ট থাকার বান্দাও তিনি নন। এখনো নানাদিক থেকে তিনি টগবগে তরুন। সুতরাং, কিছুদিন পরপর নাকি তিনি একটি করে বিবিকে খারিজ করে দিয়ে নতুন আরেকটি বিবি ভর্তি করেন। চারটাই থাকল - ফলে ইশ্বরের ধর্মও থাকলো, অথচ 'পুরুষমানুষের' ধম্মও থাকলো। কিছু খর্চাপাতি হয়, কিন্তু সেটা কোন ব্যাপার না। এজন্যেই বললাম বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যাদের মতই তিনি হলেন - তরুণীস্য বৃদ্ধ সিরিয়াল কোয়াড্রোগ্যামিস্ট

যাহোক, পরের দিন আসওয়ানের পথে রওনা দিব। সেখান থেকে মিশরের দক্ষিন মাথায় সীমান্তবর্তী মরুঘাঁটি আবু সিম্বেলের পথে...

দ্য লস্ট টুম্ব্‌স অফ থিব্‌স


তথ্যসহায়তাঃ অনলাইল, অফ্লাইন, আইলাইন, ইয়ারলাইন, ইত্যাদি।
ছবিসূত্রঃ নেট - হিরোগ্লিফিক ও হাৎশেপ্‌সুতের মূর্তির ২য় ছবি। অন্যসব ছবি - মনমাঝি।
ভিডিও সূত্রঃ ইউটিউব।



মন্তব্য

আশফাক আহমেদ এর ছবি

হাৎশেপ্‌সুত-কি ক্লিওপেট্রা?

মিশরের চার শহরে ভদ্রলোকের চার বিবি। নাজায়েজ কিছু তিনি করবেন না, কিন্তু মাত্র চার বিবিতে সন্তুষ্ট থাকার বান্দাও তিনি নন। এখনো নানাদিক থেকে তিনি টগবগে তরুন। সুতরাং, কিছুদিন পরপর নাকি তিনি একটি করে বিবিকে খারিজ করে দিয়ে নতুন আরেকটি বিবি ভর্তি করেন। চারটাই থাকল - ফলে ইশ্বরের ধর্মও থাকলো, অথচ 'পুরুষমানুষের' ধম্মও থাকলো। কিছু খর্চাপাতি হয়, কিন্তু সেটা কোন ব্যাপার না।

গড়াগড়ি দিয়া হাসি =)) গড়াগড়ি দিয়া হাসি

-------------------------------------------------

ক্লাশভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেফ সমস্ত কাগজ !
আমি বাজে ছেলে, আমি লাষ্ট বেঞ্চি, আমি পারবো না !
আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

মন মাঝি এর ছবি

না।

বিখ্যাত রাণী/ফারাও 'ক্লিওপ্যাট্রা' (পুরো নাম- ৭ম ক্লিওপ্যাট্রা ফিলোপ্যাটর) প্রাচীণ মিশরের সর্বশেষ ফারাও। তার রাজত্বকাল ঠিক খৃষ্টজন্মের পূর্ববর্তী শতাব্দী। কিন্তু ক্লিওপ্যাট্রা নেটিভ মিশরীয় ছিলেন না। আলেকজান্ডারের মিশর জয়ের পর তার মৃত্যুর পর থেকে মিশরের শাসন ক্ষমতা একটা গ্রীক রাজবংশ - 'টলেমি রাজবংশ' নামের একটা রাজবংশের হাতে চলে যায়। এরা ৩০৫ বি.সি. থেকে ৩০ বি.সি. পর্যন্ত ২৭৫ বছর স্বাধীন ভাবে মিশর শাসন করে। তবে গ্রীক বংশোদ্ভূত হলেও এরা মিশরীয় রীতিনীতি অনেকাংশে এডপ্ট করে, সেইসাথে মিশরীয়দের 'ফারাও' টাইটেলটাও। এজন্যে এদের ইতিহাসবিদরা মিশরীয় ইতিহাসের অংশ হিসাবেই ক্লাসিফাই করেন। এই বংশেরই শেষ নারী ফারাও - বিখ্যাত 'ক্লিওপ্যাট্রা' (৭ম)। একেই নিয়েই শেক্সপীয়র নাটক লিখেছেন, একে নিয়েই হলিউডের এলিজাবেথ টেলর অভিনীত সেই ছবিটা তৈরি হয়েছে। এর মৃত্যুর পর মিশর সরাসরি রোমান শাসনভুক্ত হয়।

পক্ষান্তরে হাৎশেপ্‌সুত খাঁটি ইন্ডিজিনাস মিশরীয় এবং ক্লিওপ্যাট্রা থেকে প্রায় দেড়-হাজার বছর আগেকার ফারাও (১৫০৮ - ১৪৫৮ বি.সি.। ১৮শ রাজবংশ।)। হাৎশেপ্‌সুত ক্লিওপ্যাট্রা থেকে অনেক অনেক বেশি স্বাধীন, যোগ্যতর, শক্তিশালী ও প্রতিপত্তিশালী শাসক ছিলেন।

****************************************

আশফাক আহমেদ এর ছবি

তথ্যবহুল মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ ভাইয়া হাসি

-------------------------------------------------

ক্লাশভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেফ সমস্ত কাগজ !
আমি বাজে ছেলে, আমি লাষ্ট বেঞ্চি, আমি পারবো না !
আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

মন মাঝি এর ছবি

আপনাকেও পড়ার জন্য আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

****************************************

তারেক অণু এর ছবি

দারুণ। এরপর কালো ফারাওদের নিয়ে লেখুন না!

মন মাঝি এর ছবি

পড়ার জন্য আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

এই সিরিজে আমি নিজে যা দেখেছি তার বাইরে যাওয়া ঠিক হবে না। এই জন্য আরো অনেক ইন্টারেস্টিং জিনিষই বাদ দিচ্ছি। তবে কালো ফারাওদের প্রসঙ্গটা এই সিরিজের বাইরে একটা আলাদা পোস্টের বিষয় হতে পারে বৈকি।

মজার ব্যাপার হল ৮ম পর্ব থেকে আমি যে জায়গা নিয়ে লিখছি, অর্থাৎ - লুক্সোর - সেটা ৭৬০ - ৬৫৬ বি.সি. সময়কালের মধ্যে ২৫তম মিশরীয় রাজবংশের শাসনাধীন ছিল (আরো অনেক অঞ্চলও ছিল)। এরাই সেই কালো ফারাওদের রাজবংশ - যাদের মূল উৎস নুবিয়ার (তখনকার গ্রীকদের ভাষায় ইথিওপিয়ার, কিন্তু আসলে উত্তর সুদানে) 'কুশ' রাজ্যে। ঐখান থেকেই এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা রাজা আক্রমণ চালিয়ে মিশরের একটা বড় অংশ দখল করেন। শুরুর দিকেই ছিল এই লুক্সোর। তবে বাইরে থেকে আসলে কি হবে, এদের শাসনকালকে প্রাচীণ মিশরীয় সভ্যতার ক্ষেত্রে একরকম 'রেনেসাঁ'-র যুগ বলে গন্য করা হয় - কারন এদের হাতেই প্রায় হারিয়ে যাওয়া বা ভাঁটা পড়ে যাওয়া অনেক প্রাচীনতর মিশরীয় মূল্যবোধ, শিল্প, সংস্কৃতি, স্থাপত্য, ধর্মীয় প্রথা ও ঐতিহ্য, মন্দির, ইত্যাদি আবার পূণরুজ্জীবিত হয়। এদের হাতেই বহুকাল পরে প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া পিরামিড নির্মান আবার বিস্তৃত আকারে চালু হয়। এদের খোদাইলিপির বিবরণে প্রভাবিত হয়েই কিনা কে জানে কাছাকাছি সময়ের গ্রীক ঐতিহাসিক হেরোডোটাস এদেরকে পৃথিবীর প্রাচীণতম মানবগোষ্ঠী বলে উল্লেখ করেছিলেন। হেরোডোটাসের আরেকটা মত ছিল - গ্রীক দেবদেবীদের আদি উৎস বা জন্মভূমি এই কালোদের আদি ভূমি ইথিওপিয়া/সুদানেই।

এই মুহূর্তে আমি কোন কালো ফারাওর নির্মিত প্রত্নতাত্ত্বিক/ঐতিহাসিক নিদর্শনে গিয়েছি বলে মনে পড়ছে না। তবে যাদুঘরে এদের অনেক মূর্তি দেখেছি। তবে সবচেয়ে বড় কথা হল - এদের জীবন্ত ও চলন্ত নিদর্শন তথা বংশধর কালো নুবিয়ানরা লুক্সোর সহ মিশরের এই দক্ষিনাঞ্চল জুড়েই আছেন। উত্তর সুদান ও দক্ষিন মিশরই মোটামুটি এদের হোম টেরিটোরি। এদের বেশির ভাগই এখন এরাবাইজড এবং মুসলিম। মিশরের দক্ষিনাঞ্চলে আমার এই সংক্ষিপ্ত সফরটা আয়োজনের সহায়তাতেও ছিলেন আসওয়ান অঞ্চলের এক কালো নুবিয়ান ভদ্রলোক। মিশরের এই কালো এবং কপ্টিক সম্প্রদায়ই প্রাচীণ মিশরের অনেক চিহ্ন তাদের সংস্কৃতি এমনকি চেহারাতেও ধরে রেখেছেন মনে হয়। ফর্সা আরবদের ক্ষেত্রে ঐ প্রভাবটা অনেক ডিফিউজ্‌ড হয়ে গেছে মনে হয়।

****************************************

মানবমনে আপনি জন্মিয়াছেন এর ছবি

আজ চতুর্দিকে বড় বড় বাজার।(বিভিন্ন সাইট)
অসংখ্য লোকজন চতুর্দিকে।(বিভিন্ন নিকের ছড়াছড়ি)
মানব আজ বড় রাস্তার মাঝ খানে দাঁড়িয়ে পড়েছে___ এবং হেঁটে চলেছে ... চলছে আবারও চলছে...
কিন্তু গর্ব করে সবকিছুকে উপেক্ষা করতে পারছি কই। বড় রাস্তার পাঁচ মাথার মোড়ে দাঁড়ালে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে জনতার স্রোত।
এই কোলাহলের মাঝে আমি নিঃশব্দতাকে খুঁজে বেড়াই,
কিন্তু___
সেই নিঃশব্দ পথ চলতে চলতে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল মন মাঝির সাথে। নিঃশব্দতা ভেঙে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল... এবং মন্তব্য করেই ফেললাম

আপনার ভ্রমণ কাহিনি পড়ে মানব আজ মৌন নয়, সে সরব। কেন জানি না মানব মনকে চিরদিনই তো মিশর টানে, কখনো তা রহস্যময়তার জন্য, কখনো বা, সৌন্দর্য আস্বাদনের জন্য।
সত্য কথা বলতে কি গাছে যে ভুল থাকে মানব হস্ত তা স্পর্শ করতে পারে,
কিন্তু দুরের ফুল (মরুভৃমির/ মিশরের রূপ) স্পর্শ করতে পারেনা,
কিন্তু তা আপনার মত মন মাঝির অপরূপ লাবন্যময় পরিবেশনে আস্বাদন করতে পারি , তা মানব মনে স্পর্শিত হয় এবং বারংবার বহুরণিত হয়।
আপনার এই লেখা একমাত্র আপনাকেই মানায়, এ কাজ আমার নয়,
তাই কবির ভাষায় বলতে চাই__

"মন মাঝি তোর বৈঠা নে রে
আমি আর বাইতে পারলাম না
সারা জীবন বাইলাম তরী
ঘাটের নাগল পাইলাম না
আমি আর বাইতে পারলাম না ।"

ইতি__
মানব

মন মাঝি এর ছবি

জটিলসুন্দর মন্তব্যের জন্য চলুক আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা- অ্যাঁ

****************************************

চরম উদাস এর ছবি

জটিল লাগলো চলুক

মন মাঝি এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

****************************************

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

দারুন কিছু ছবি ও অনেক নাজানা তথ্য জানা গেল আপনার লেখার মাধ্যমে।
ধন্যবাদ। আগামীর শুভেচ্ছা।

মন মাঝি এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

****************************************

রণদীপম বসু এর ছবি

যেমন লেখা তেমন ছবি। আর মিসরিয় নামগুলো উচ্চারণ করতে গিয়ে দাঁতের গোড়ায় রীতিমতো শিনশিন শুরু হয়ে গেছে ! হা হা হা !!

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

মন মাঝি এর ছবি

হা হা হা !! আমারো ! আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

****************************************

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

আমি সবসময়েই আপনার লেখার এবং ছবির ভক্ত। এটাও বরাবরের মতো অসাধারন।

কোন কোন মুর্তিতে তার স্তন প্রায় অদৃশ্য।

আমি বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে গিয়ে কিছু মাস্টারপীস বদের দেখা পেয়েছি। এরা এদিক-ওদিক তাকিয়ে মুর্তিরও স্তনমর্দন করতে ছাড়েনা।

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

মন মাঝি এর ছবি

এইগুলা ভেড়ুয়া গোপন ধর্ষকামী। আসল সময় ফায়ার করতে পারে বলে মনে হয় না - ছবি/পাথরের মূর্তিই ভরসা।

হাৎশেপ্‌সুতের স্তন অবশ্য রাজনৈতিক কারনে অদৃশ্য।

পড়ার জন্য আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

****************************************

কাজি মামুন এর ছবি

লেখাটা অসাধারণ লেগেছে! মনে হল, ইতিহাসের এক দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এলাম। শব্দ, ছবি, তথ্য, আর ভাষার এমন আকর্ষণীয় মিশেল রয়েছে লেখাটিতে, যে কখনই পাঠককে থেমে যেতে হয় না!

মানব ইতিহাসে এখনো টিকে থাকা প্রথম রেকর্ডেড চুরির মামলা এখানকারই এক চুরির ঘটনায় - সেই প্যাপিরাসও পাওয়া গেছে অন্যত্র।

খুব কৌতূহল জাগাচ্ছে এই প্রথম চুরির ঘটনা; একটু সবিস্তারে বলা যায়?

তবে এসবের ছবি তেমন তোলা সম্ভব হয়নি - ভিতরে ছবি তোলা নিষিদ্ধ হওয়ায়।

তাহলে ঠিক পরেই দেয়া ''শূন্য স্যাকোফেগাস'' এর ছবিখানি কি সংগৃহীত?

এই স্মৃতিমন্দির নির্মাণের তত্ত্বাবধানে এবং সম্ভবত নকশাও তৈরি করেছিলেন ফারাও হাৎশেপ্‌সুতের উজির, রাজ-স্থপতি ও সম্ভবত তার প্রেমিক - সেনেমুত।

এর পরের একটি অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ''তার রাজত্বকালেই মিশরীয় স্থাপত্যরীতির এক ব্যাপক ও গুণগত উন্নতি বা উল্লম্ফন ঘটে - যাকে মিশরের জন্য গ্রেকো-রোমান ক্লাসিকাল স্থাপত্যের পর্যায়ভূক্ত বলা যায়।''' প্রশ্ন হচ্ছে, এই কৃতিত্বের দাবীদার কি তাহলে সেনেমুত?

কিংবদন্তী আছে, ২৭ বি.সি.-তে একটা বড় ভূমিকম্প পূব পাশের মূর্তিটাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে - কোমর থেকে উপরাংশ ভেঙ্গে পড়ে যায় আর নিম্নাংশতেও ফাটল ধরে। এরপর থেকেই নাকি ভাঙা মূর্তিটার রয়ে যাওয়া নিম্নাংশ প্রতিদিন ভোরে কান্নাকাটি করতো।

মূর্তিটির উপরাংশ তো এখনো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে; তাহলে কি এটা পরে পুর্ননির্মান করা হয়েছিল? আর যে ঐতিহাসিকদের কান্না শোনার কথা বলা হল, তারা কোন যুগের?

চারটাই থাকল - ফলে ইশ্বরের ধর্মও থাকলো, অথচ 'পুরুষমানুষের' ধম্মও থাকলো।

আপনার লেখার জটিলতম লাইন। হাততালি
পুনশ্চঃ আপনার পরবর্তী লেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি!

মন মাঝি এর ছবি

তবে এসবের ছবি তেমন তোলা সম্ভব হয়নি - ভিতরে ছবি তোলা নিষিদ্ধ হওয়ায়।

তাহলে ঠিক পরেই দেয়া ''শূন্য স্যাকোফেগাস'' এর ছবিখানি কি সংগৃহীত?

না।

শুধু ''শূন্য স্যাকোফেগাস'' না, তার নিচে দেয়া ৫টি দেয়ালচিত্রও ঐ নিষিদ্ধ অঞ্চল থেকেই তোলা! আমারই তোলা। আমার বাক্যটার মধ্যে "তেমন" শব্দটা লক্ষ্য করুন। এর অর্থ বেশি করে বা ইচ্ছামত তুলতে পারিনি, পারিনি আসল আকর্ষনীয় জিনিষগুলির ছবি তুলতে - কোনমতে যট্টুক সম্ভব হয়েছে তট্টুকুই শুধু তুলেছি। ক্যামনে তার ব্যাখ্যা করার কোন দরকার আছে কি ? চোখ টিপি
তবে হিরোগ্লিফিক আর হাৎশেপ্‌সুতের মূর্তির ২য় ছবিটি সংগৃহীত।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই কৃতিত্বের দাবীদার কি তাহলে সেনেমুত?

সেনেমুত ড্‌জেসের ড্‌জেসেরু -র অনুমিত স্থপতি। কিন্তু তিনি ছাড়াও হাৎশেপ্‌সুতের অধীনে আরো রাজ-স্থপতি ছিলেন আর হাৎশেপ্‌সুত ছিলেন সেসময়ের সবচেয়ে নির্মানশীল ফারাওদের একজন - তার নির্দেশে আরো অনেক কিছু নির্মিত হয়েছে - যার সবকিছু সেনেমুত বানাননি। অর্থাৎ সবকিছুর বা পুরো হাৎশেপ্‌সুত-পর্বের স্থাপত্য পরিকল্পনার কৃতিত্ব তার একার নয়। আর সবচেয়ে বড় কথা হল, এইসব নির্মান-প্রকল্প কারো একার কৃতিত্ব নয় পুরোপুরি - এইগুলির পিছনে আরো অনেকের, বিশেষ করে ফারাওদের ব্যাপক নিজস্ব মেধাগত বা ভিশনগত ইনপুট থাকত, অর্থায়ন ছাড়াও।

মূর্তিটির উপরাংশ তো এখনো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে; তাহলে কি এটা পরে পুর্ননির্মান করা হয়েছিল?

হ্যাঁ। মিশরে রোমান শাসনামলের পরের দিকে মূর্তিটার উর্ধাংশ পুনর্নির্মান করা হয়। আনুমানিক ১৯৯ খৃষ্টাব্দে।

আর যে ঐতিহাসিকদের কান্না শোনার কথা বলা হল, তারা কোন যুগের?

স্ট্রাবো (৬৪/৬৩ খৃষ্ট-পূর্বাব্দ - ২৪ খৃষ্টাব্দ), প্লিনি (২৩ খৃষ্টাব্দ - ৭৯ খৃষ্টাব্দ), জুভেনাল (১ম - ২য় খৃষ্টীয় শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়), পোসানিয়াস (খৃঃ ২য় শতাব্দী)।

খুব কৌতূহল জাগাচ্ছে এই প্রথম চুরির ঘটনা; একটু সবিস্তারে বলা যায়?

বিস্তারিত যেখানে পড়েছিলাম সেই বইটি এখন হাতের কাছে নেই। ওখানে ঐ প্যাপিরাসের ছবিও ছিল। উইকিতে সার্চ করলে কিছু তথ্য পেতে পারেন। আর হ্যাঁ, মরুযাত্রার ৬ষ্ঠ পর্বে কাছাকাছি কিছু তথ্য পাবেন - সেইসাথে ঐ পর্বেই দেয়া "পিরামিড ডাকাতির উপর ডিস্কাভারির ভিডিও ক্লিপ" -ক্যাপশনযুক্ত ভিডিও ক্লিপটি দেখলেও অনেক কিছু জানতে ও দেখতে পারবেন।

মনোযোগ দিয়ে পড়া আর চমৎকার মন্তব্যের জন্য আপনাকে অনেক অনেক আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

****************************************

মরুদ্যান এর ছবি

ব্যাপক!! উত্তম জাঝা! কোনদিন কি মিশর যাইতে পারবাম!! মন খারাপ

CannonCarnegy এর ছবি

সুন্দর তথ্যবহুল লেখা। উত্তম জাঝা!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।