খেয়ালি খেলায়ঃ অপরাজেয় চট্টগ্রাম আর প্রত্যাশার ঢাকা

মর্ম এর ছবি
লিখেছেন মর্ম [অতিথি] (তারিখ: শনি, ১৯/০৩/২০১১ - ৩:৩৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কে বলেছে ওয়ালশ- এমব্রোসদের উত্তরসুরী খুঁজে পায়নি ওয়েস্ট ইন্ডিজ?!

পেয়েছে তো! রোচ- রাসেল- বেন- বিশু। আরো কতজন! সে সময় যেমন ‘চিন মিউজিকে’র পতাকা বয়ে চলা এমব্রোস- ওয়ালশ- বিশপদের নিয়েই গড়া ওয়েস্ট ইন্ডিজের লেজ ছেটে দেওয়া ছিল জগতের সহজতম কাজগুলোর মধ্যে একটা, এখনো তাই।

ক্যারিবিয়ান সাগরে অনেক উথাল- পাথাল হয়েছে, কিন্তু ক্যারিবিয়ান লেজ মুড়িয়ে দেওয়া এখনো আগের মতই সহজ। বিশেষজ্ঞ বোলারদেরও খানিকটা ব্যাটিং জানার এই যুগে এখনো ব্যাট হাতে খাবি খেতে দেখার ছবি দেখা যায় কেবল এই মেরুন বসনধারীদের খেলায়।

গেইলের দানবীয় ব্যাটিং-এ কাজ হয় নি, সামি’র ছোট্ট ক্যামিও ২৪৩ রানের সাগর পার করে দিতে পারে নি, বোলিং-এ চমক দেখানোর পর ব্যাটিং-এ হতে হতেও নায়ক হতে পারেন নি রাসেল, শেষ ভরসা হয়ে থাকা সারওয়ান-ও তাঁর দলকে জয় এনে দিতে পারেন নি।

ভারতের চেন্নাইতে ইদানীংকালে ওয়ানডে ক্রিকেটের রোমাঞ্চ জিইয়ে রাখার দায় নেয়া ইংল্যান্ডের কাছে ১৮ রানে হার মেনে সামিদের চেহারায় অবিশ্বাসমাখা হাসি ফুটেছে কেবল, আর আধ ঘণ্টা সময়ের দূরত্ব থেকে ক্যারিবিয়ান বিজয়ের প্রত্যাশায় থাকা বাংলাদেশী লাখো দর্শকের মন ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়েছে আরো একবার।

ড্রয়িংরুমের সোফা নিঃশব্দে ছাড়ার আগে বিশাল দীর্ঘশ্বাস ফেলে মলিন মনকে বুঝিয়ে আসতে হয়েছে, “তাতে কি? এই বার আমরা দক্ষিণ আফ্রিকাকেই দেখে নেবো!”

কে জানে হয়তো আমাদের বাংলাদেশ দল-ও একসাথে বসে এই খেলায় নজর রেখেছে, বসার জায়গাটা ছেড়ে ওঠার আগে হয়তো ওদের মনেও এক-ই কথা নাড়া দিয়ে গেছে, কে জানে হয়তো মিডিয়া সামলানোর সময় ঠোঁটের কোনে ঝুলিয়ে রাখা হাসিটুকু আরেকবার মুখে ফুটিয়ে আমাদের কান্ডারী সাকিব চোখে চোখেই তাঁর সহযোদ্ধাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন- “যা হবার মাঠেই হবে!”

হবে তো? চট্টগ্রামের বাংলাদেশকে হিসেবে রাখলে- “হবে!”

চট্টগ্রাম তার সবটুকু উত্তাপ নিয়ে অপেক্ষা করছিল বিশ্বকাপের জন্য। দু’দিন আগেই পৌঁছে কোথায় আহলাদে আটখানা হয়ে যাব তা না, একদিন পেরোবার আগেই গলার স্বর প্রায় উধাও আর ফ্যাৎ ফোৎ করতে করতে স্টেডিয়াম আসা-যাওয়ার নিত্য রুটিন।

কেন জানি না, সাথের সবার চোখেই স্টেডিয়াম-টাকে বড়ই ছোট ঠেকছিল। মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামের সাথে যদি তুলনা করি, সোজাসুজি মোটামোটি সমান লাগলেও ইস্টার্ন গ্যালারি থেকে দেখলে স্কয়ারের দিকে মাঠ যথেষ্টই বড়।

কপাল ভাল যে আমরা এখন “এত-ছোট-ব্যাটসম্যান-কীভাবে-অত-বড়-ছক্কা-মেরে দিল!?”- ধাঁচের অবাক হওয়া থেকে বেরিয়ে এসেছি, আর নয় তো ইংল্যান্ডের আদরের রাজহাঁসটিকে যখন আমাদের শফিউল ডিপ মিড অনের উপর দিয়ে ঐ ইস্টার্ন গ্যালারির কাছাকাছি এনে আছড়ে ফেললেন তখন আমরা হয়ত তিড়িং বিড়িং করার বদলে দাঁতে নখ কামড়ে নাক-মুখ কুঁচকে ব্যাটসম্যানের শক্তির উৎস-সন্ধানেই ব্যস্ত হতাম!

তা হই নি- আর হই নি বলেই ইংল্যান্ডের হাতের তালু থেকে কেড়ে নিয়ে ভোঁ দৌড় দেয়া একটা অনন্য সাধারণ জয়ের সাক্ষী হতে পেরেছি আমরা। সবাই। মাঠে ছিলেন যাঁরা, আর যাঁরা টিভির সামনে বসে বেরিয়ে যেতে চাওয়া চোখদুটিকে কোটরেই আটকে রেখে বুকে এক হাত চেপে আর এক হাতের নখের বারোটা বাজিয়েও হৃদযন্ত্রটিকে সামলে রেখে অপেক্ষা করেছেন রিয়াদের এক মন জুড়ানো কভার ড্রাইভে বল সীমানা ছাড়া হওয়ার ইংলিশদের হৃদয় ভেঙ্গে দেয়া দৃশ্যখানি দেখা পর্যন্ত।

খেলার দুই দিন আগে কথা হচ্ছিলো কানাডা’র সাথে প্রস্তুতি ম্যাচের সময় পরিচয় হওয়া আইসিসি’র এক ভদ্রলোকের সাথে। “বাংলাদেশ কেমন করবে চট্টগ্রামে?”- প্রশ্নটা আপনাতেই বেরিয়ে গেল। সদ্য ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে আমাদের বিপর্যয় দেখার স্মৃতি মাথায় ছিল বলেই বোধ হয় তেমন আশার সুর শুনতে পেলাম না কোন- “ইং-ল্যা-ন্ড... দে উন্ট ডু! নেদার- ল্যান্ড... দে শুড!”

তাঁকে কেন জানি না, এরপর বেশ খানিকক্ষণ ধরে না বুঝিয়ে পারলাম না যে এই ইংল্যান্ড-কে হারানো খুবই সম্ভব! হল্যান্ডের সাথে যে দল ২৯২ রান দিয়ে দিতে পারে, যাঁদের অনবরত সীমানায় পাঠিয়ে ৩৩৮ করা চলে, তারা পরের ম্যাচে ১৭১ রান করেও প্রতিপক্ষকে ১৬৪ রানে বেঁধে ফেলেছে এটা যত বড় সত্য তার চেয়ে বড় সত্য ঐ ‘শক্তিশালী’ প্রতিপক্ষের চাপের মুখে ভেঙ্গে পড়ার ঐতিহ্যবাহী দীর্ঘ ইতিহাস!

৫৮ রানের মত দুঃস্বপ্নের দিন আসবে না এমন হলফ করে বলা মুশকিল। কিন্তু যদি স্পিনে মাঝে মধ্যেই দিশে হারানো ইংলিশরা একবার যদি দিক হারায় আর ওদিক দিয়ে ওদের বোলাররা হল্যান্ড আর ভারতের বিপক্ষে খেলার মত আর একটা দিন কাটাতে পারে তাহলেই তো হয়। তা ভদ্রলোক তেমন আস্থা পেলেন না বোধ হয় এমন ধারা আজব কথায়, নাক-মুখ কুঁচকে “ওক্কে-লেটস-সি”-ভাব নিয়ে ব্যস্ত হলেন তাঁর কাজে।

খেলা যখন শুরু হয় তখন ওয়েস্টার্ন গ্যালারির পেছনে দর্শক বসার পর যে বিশাল বাড়তি অংশটুকু খালি আছে ওখানে দাঁড়িয়ে রোদে পুড়ছি পুরো গ্যালারির সাথে। ছায়া নাই কোথাও। চার-ছয়ের ব্যানার আর বিনে পয়সার মেলা কাগজের ক্যাপ-ই একমাত্র সম্বল। একদিকে রোদের তান্ডব আবার উল্টোদিকে টসে জিতে বল করতে নামা বাংলাদেশ দলকে দেখে ভারত ম্যাচের স্মৃতি মনে পড়ায় বাড়তি শংকা।

ক’ওভার যেতেই সে শংকা যে কোথায় গেল, কাছের বঙ্গোপসাগরেই হয়ত! শীত না থাকলেও ইংল্যান্ডের দুই ওপেনার তখন কাঁপছেন। রুবেল এক-একটা বল করছেন আর আমরা দেখে নিয়েই আবার বাঁ দিকে ঘাড় ফিরিয়ে ডিসপ্লে স্ক্রিনে আরো একবার দেখে নিয়ে দাঁত বের করে দিচ্ছি খুশিতে- “হি হি কী মজা!” প্রায়র বহু কষ্ট করে বলের লাইনে যাচ্ছেন, আর বল ঠিক ব্যাটের কানা ঘেষে বেরিয়ে যাচ্ছে কিপারের দিকে আর বল চলে যাওয়ার পর স্টাইলিশ ভঙ্গিতে ব্যাটটা সরিয়ে নিয়ে আসছেন তিনি!

উইকেট যে পড়বেই এতে কোন সন্দেহ ছিল না, এবং পড়লো-ও। তবে পড়লো স্পিনার-দের কোপে পড়ে। রাজ্জাকের বোলিং-এ এ বিশ্বকাপে ধার দেখা যাচ্ছিল না তেমন, চট্টগ্রাম সে ধার ফিরিয়ে দিল। মুশফিক-ও ঠিক ঠিক স্ট্যাম্পে লাগিয়ে প্রায়রকে স্ট্যাম্পিং করেই ফেললেন, বল তাঁর হাত ফসকে বেরিয়ে গেল না!

এর এর মধ্যে নাঈম চলে এসেছেন বোলিং-য়ে তার চেপে ধরা অফ-স্পিন নিয়ে আর আশরাফুলের জায়গা নেয়া মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ-ও, সরল সোজা অফ-স্পিন নিয়ে। সতের ওভারের মধ্যেই মনে বেশ খুশি খুশি ভাব- স্কোর বোর্ডে ৫২, তিন তিন জন সাজঘরে ফিরেছেন, এর মধ্যে দুই জন আবার স্পিন ভাল খেলেন বলে সুনাম, বেল আর ভারতের ঘাম ছোটানো অধিনায়ক স্ট্রাউস।

এরপরই পিটারসেনের বদলে দলে আসা আইরিশ মরগান আর দক্ষিন আফ্রিকান ট্রট মিলে ওদের বুকে পানি ফিরিয়ে আনতে শুরু করলেন। কী যন্ত্রনা, উইকেট তো আর পড়ে না। ট্রট তাও একটু সামলে নিয়ে খেলছেন। কিন্তু মরগান? ভয় ডর নাই কোন, দিব্যি খেলে যাচ্ছেন, বল আর রান প্রায় সমান সমান। পার্টনারশীপ পঞ্চাশ পেরিয়ে একশ। মরগান পঞ্চাশ পেরিয়ে ষাটের কোঠায়, ট্রট-ও সাহস ফিরে পেয়েছেন বলে মনে হচ্ছে।

কিন্তু প্রতিদিন কি আর মরগানের হয়? কোন কোন দিন হাসিটা যে বাংলাদেশের জন্যই বরাদ্দ থাকে আজকাল! নাঈমের বলে উড়িয়ে মারতে গিয়ে মরগান প্যাভিলিয়নে ফিরলেন, আর বাংলাদেশ ম্যাচে। এরপর কেবল সময়ের অপেক্ষা। একের পর এক ওভার গেল, উইকেট পড়ল। ইংল্যান্ড করতে পারল ২২৫।

সময়ের ফেরে তখন এসে দাঁড়িয়েছি বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নের নীচে সিঁড়ির গোড়ায়। শফিউল, ইমরুল, নাঈম, রুবেল, ইমরুল মাঠ থেকে বেরিয়ে একে একে পেরিয়ে গেলেন। তামিম বাঊন্ডারির কাছাকাছি দাঁড়ালেন ই এস পি এন- এর ক্যামেরার সামনে।

সবার শেষে বেরিয়ে এলেন সাকিব। অধিনায়ক। গ্র্যান্ড স্ট্যান্ডের সোল্লাস চিৎকার নজরে পড়েছে বলে মনে হলো না, সিঁড়ি বেয়ে সোজা গেলেন প্যাভিলিয়নের দিকে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচের পরে দর্শকদের উপহার দেয়া তিক্ত স্মৃতি মনে করেই কি? হয়ত, হয়ত না।

মাঠে খেলা দেখার সবচেয়ে বড় অসুবিধা হল টিভিতে কি চলছে, কে কি বলছে হসপিটালিটি বক্স বা অমন কোন জায়গায় না বসলে জানার আর কোন উপায় থাকে না। কাজেই হাফ-টাইমে তামিম ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে কি বলছিলেন তা আর জেনে উঠতে পারি নি। মনে হয় ভাল কিছু করার ইচ্ছার কথাই বলেছিলেন। ব্যাটিং দেখে সেরকমই তো মনে হল।

তামিমের বড় ভাই নাফিসের তোপের মুখে পড়ার অভিজ্ঞতা আছে ইংলিশদের। তামিমের সামনে অসহায় হওয়ার স্মৃতি খুব বেশিদিন আগের নয়। ভাঙ্গা আঙ্গুল নিয়ে লর্ডস আর ওল্ড ট্রাফোর্ডে বলে কয়ে সেঞ্চুরি তো এই সেদিনের কথা। তামিম খেলতে শুরু করলে যে তান্ডব নিজ থেকে থামার অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় থাকে না এ ওরা এতোদিনে বুঝতে শিখেছে।

আমাদের অত বোঝার বালাই নেই। তামিমের ইনিংস মানে আমাদের নির্ভেজাল আনন্দ। আর চোখের শান্তিও। কী অবলীলায় বলগুলোকে সীমানায় পাঠাতে পারেন আমাদের এই তামিম। মাঝে মাঝে ক্রিজ ছেড়ে বেরোলে বুনো সৌন্দর্যটুকু চোখে লাগে, আসুরিক শক্তিতে পুল করে কোন ফাস্ট বোলারকে স্কয়ার লেগ বা ডীপ মিড উইকেট বাউন্ডারিতে পৌঁছালেও অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে হয়।

কিন্তু ঐ একই তামিম যখন কভার ড্রাইভে ফিল্ডারদের ছাতা ভেদ করে বল পাঠিয়ে দেন বাউন্ডারির দিকে কি কব্জির মোচড়ে বল ছোটে স্কয়ার লেগ বা ডীপ মিড উইকেটে কি তাঁর ব্যাট ছুঁয়ে বের হওয়া স্ট্রেট ড্রাইভগুলো যখন সাইড স্ক্রিন বা বোর্ডিং-এর কুশল জিজ্ঞেস করে আসতে ছোটে তখন কেবল মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ভাবতে হয়- “এ ছেলেটা আমার দেশের। পুরোপুরি আমাদের!”

তামিমের ছোট কিন্তু দ্রুততালের ইনিংসটা আসলে ঠিক করে দিল আমাদের ইনিংস কোন দিকে ছুটবে। তামিম আউট হওয়ার পরও চলছিল ঠিকই। জুনায়েদ রান আউট হওয়া পর্যন্ত। এর মধ্যে অদ্ভূতুড়ে ডিফেন্সে বোল্ড হয়ে ফিরেছেন রাকিবুল। রান সবে সত্তরের ঘরে, উইকেট নেই তিনটা। গ্র্যান্ড স্ট্যান্ডের ফেন্সিং-এর আড়াল-ও মাঠের সর্বনাশা দৃশ্য থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখতে পারছিল না।

ইস্টার্ন গ্যালারির উপরের সিটগুলোকে মনে হল সর্বশেষ অবলম্বন। বোলারদের লাইন বোঝা যায় পরিস্কার, ফিল্ডাররা কেউই চোখের আড়ালে থাকে না, ব্যাটসম্যানদের শটও বুঝে নিতে ঝামেলা নেই কোন।

সাকিব আর ইমরুল হাল ধরলেন এখানেই। সুন্দর একটা পার্টনারশীপ। এক-দুই করে রান ঠিকই বাড়ছিল। মাঝে মাঝে চার। একটু স্লো হয়ত, কিন্তু পরিকল্পিত। এরপর আবার ছন্দপতন। বাংলাদেশের ইনিংসটাকে ধরে রাখার কাজটা আরো একবার করে যাওয়া ইমরুল রান আউট- ষাটে পৌঁছে। একটু হতাশার। তবু এমন কিছু না, বল আছে অনেক, রান হয়ে যাবে।

কিসের কি?! মুশফিক এলেনই যেন বল ঠেকানোর দায়িত্ব নিয়ে। ওভারের পর ওভার। এক পর্যায়ে মুশফিক ১৮ বলে ১। ততক্ষনে রান বাড়ানোর চাপ সামলাতে গিয়ে সাকিব প্লেইড অন, ৩২ রান করে। পথ তখনো অনেক বাকি।

নিজের খেলা ১৯ নম্বর বলটা কভার বাউন্ডারিতে পাঠালেন মুশফিক, পরের বলেই আউট! রিয়াদ এলেন ব্যাটিং-এ। কিন্তু এসে এসে ফিরে গেলেন নাঈম। রাজ্জাক। হঠাৎ করেই ৮ উইকেট নেই।

রান বাকি আরো পঞ্চাশের বেশি, ওভার আর মাত্র বারোর মত। ব্যাটিং-এ রিয়াদ, একদিকে ঠেকিয়ে চলেছেন। আরেকদিকে শফিউল, কখন তাঁরও ধৈর্যচ্যুতি হবে তারই অপেক্ষা কেবল তখন।

গ্যালারি ফাঁকা হওয়ার পথে। ‘লুসার’, ‘ওরা এমনি করে’, ‘সব ক’টাড় খেলা বন্ধ করে দেয়া উচিৎ’- নানান মুনী গ্যালারিতে, নানান তাঁদের মত।

পেছন থেকে একজনের কথা কানে এলো- “আমি যাই। গেলেই ঠিক হয়ে যাবে! এতোক্ষণ তো উইকেট পড়েনি, আমি আসার পরই এই দশা। এখানে আর থাকা চলবে না!”

কৃতজ্ঞতা তাঁর প্রতি, তিনি জায়গা ছেড়ে গেছেন বলে। কৃতজ্ঞতা সেই নাম না জানা বাংলাদেশ সমর্থকের প্রতি যিনি ঝিমিয়ে পড়া গ্যালারির দর্শকদের কোনমতে বাং-লা-দেশ বাং-লা-দেশ স্লোগানের অংশ করতে না পেরে আঁতে ঘা দিয়ে গেছেন সক্রোধ চিৎকারে- “লজ্জা করে না আপনাদের?! আপনারা চুপচাপ বসে আছেন?!”

কৃতজ্ঞতা গ্যালারিতে থাকা আরো ক’জন দর্শকের প্রতি যাঁরা চেয়ারে পানির বোতল মেরে তালে তালে জাগিয়ে তুলেছেন গ্যালারি, কৃতজ্ঞতা সকল দর্শকের যারা চোখে অবিশ্বাস, আনন্দ আর টেনশনের ছাপ নিয়েই চিৎকার শুরু করেছেন বাংলাদেশের জন্য, শেষ বলটা পর্যন্ত অবিরাম চেঁচিয়ে গেছেন, খেলোয়ারদের সাহস যুগিয়েছেন আর ইংলিশদের মনে ঢুকিয়ে দিয়েছেন জুজুর ভয়।

এন্ডারসন যে একের পর এক বে-লাইনে বল করে গেলেন, সোয়ানের বল যে হাত থেকে ফসকে পড়ল বারদুয়েক এর পেছনে ‘ডিউ’ এর ভূমিকা স্পষ্ট। কিন্তু দর্শকের চাপ যে তাঁদের খানিকটা এলোমেলো করে দেয়নি তা কে বলতে পারে?!

রিয়াদ খেলে গেছেন এক পরিনত ব্যাটসম্যান হয়ে আর শফিউল দুপুরে শুরু করে যাওয়া লড়াইয়ের শেষ করার দায়িত্ব তুলে নিয়েছেন নিজের কাঁধে। কী অদ্ভূত সুন্দর ইনিংস। কী চমৎকার পার্টনারশিপ। আস্তে আস্তে করে এগিয়ে গেছেন টার্গেটের দিকে।

যখন দরকার ফরোয়ার্ড ডিফেন্স, তাতে স্টেডিয়াম জুড়ে সহর্ষ চিৎকার। যখন সম্ভব এদিক ওদিক ঠেলে দিয়েই একটি কি দুটি রান, তাতেও সবার উল্লাস। আর যখন বল চলে যাচ্ছে সীমানার দিকে, সবার চোখে বিস্ময়- এরপরই বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাস। আবার বলের জন্য অপেক্ষা, আবার চিৎকার। এর মধ্যেই দাঁতে নখ কামড়ে একটু টেনশনে ভুগে নেয়া। কি দেয়নি এই ম্যাচ?

শেষ শটটা এলো শেষ ওভারের আগের ওভারে- রিয়াদের ব্যাটে। সব ফিল্ডার ত্রিশ গজের মধ্যে। কভারে দাঁড়ানো ফিল্ডারদের ফাঁকি দিয়ে বল যখন সীমানার দিকে ছুটছে আমরা তখন সবাই দাঁড়িয়ে- সবাই চেঁচাচ্ছে, কোত্থেকে বিশাল এক পতাকা চলে এসেছে হাতের কাছে, একজনকে দেখলাম পেপসির বোতল বার কয়েক ঝাঁকিয়ে শাম্পেনের মত মুখ খুলে দেয়ার ব্যবস্থা করছেন। আমরা জিতেছি, আমরা পেরেছি। বিশ্বকাপে আমরা টিকে আছি সদর্পে।

যে যাকে পাচ্ছে তার সাথে হাত মিলিয়ে নিচ্ছে, কোলাকুলি করে নিচ্ছে। আনন্দটুকু সবার। কী অসাধারণ সুখ!

খেলার শেষে আইসিসি’র ভদ্রলোকটিকে এসএমএস করলাম- “উই ডিড ইট!” জবাব এল- “লেটস ফিনিশ ইট ইন ফোর্টিন্থ!”

চট্টগ্রাম আমাদের আরো দিয়েছে, আমরা চৌদ্দতেও পেরেছি। এই প্রথমবারের মত আমরা যাদের হারানোর কথা তাঁদের হারাতে পেরেছি। নেদারল্যান্ডস চেষ্টা করেছে, কিন্তু সেটুকুই। আমাদের স্পিন আর সাবধানী ব্যাটিং ওদের জন্য একটু বেশিই ছিল।

১৪ মার্চের শেষ বিকেলে আমরা যখন চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ বিভাগীয় স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়ে আসছি তখন সূর্য যাই যাই করছে, কিন্তু শেষ বিকালের আলো যেমন দিনের সবচেয়ে সুন্দর ছবিটা তৈরি করে দিয়ে যায় তেমনি চট্টগ্রাম থেকে সম্ভাব্য সবচেয়ে বেশি সুখটুকু আমরা বয়ে নিতে যাচ্ছি ঢাকায়, পাহাড়ি সৌভাগ্যটুকু ঢাকায়ও যে খুব প্রয়োজন হবে।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ ইংল্যান্ডের সাথে জিতে গেলে আমাদের ভাল হত। তা হয় নি। এবার আমাদের মাঠের খেলাতেই জিততে হবে।

ইংল্যান্ডের সাথে খেলার আগে মনে হচ্ছিল- সম্ভব। দক্ষিণ আফ্রিকা খুবই শক্ত দল, বিশ্বকাপ জেতার সামর্থ রাখে ওরা, ছাড় দেবে না একটুও। তবু কেন মনে হচ্ছে আমরা পারবো, আমরা যাবো কোয়ার্টার ফাইনালে? টাইগার হিলের বাঘেদের ঢাকায় আসতে বলি না, তবে কারওয়ান বাজারের বেড়ালমুখী বাঘের নিঃশব্দ গর্জনও যদি মিরপুর পর্যন্ত পৌঁছে স্প্রিংবকদের খানিকটা ভড়কে দিতে পারে তাতেই বা ক্ষতি কি?

এই দক্ষিণ আফ্রিকা ইংল্যান্ডের কাছে হেরেছে আর আমরা ইংল্যান্ডকে হারিয়েছি।
ওদের হয়ে খেলবে এগারোজন, আমাদের এগারোজন আর স্টেডিয়ামভরা দর্শক।

দেখাই যাক না, কী হয়!?

চার বছর আগে তো আমরাই পেরেছিলাম, আমরা কি আরেকবার পারবো না?


মন্তব্য

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

হুমম। চেষ্টা করতে দোষ কী? মনের বলে বলীয়ান হলে বাংলাদেশ আজ জিততেও পারে।

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

বাংলাদেশ দলের জন্য শুভ কামনা রইল।http://piczasso.com/i/en1u7.gif

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

তিথীডোর এর ছবি

গুড লাক টাইগার্স, গুড লাক বাংলাদেশ! হাসি

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

সাউফ আফ্রিকা একটা পর্যায়ে যেয়ে একাধারে পড়তে থাকবে। সেটা যত তাড়াতাড়ি হয় ততই মঙ্গল।

কুটুমবাড়ি [অতিথি] এর ছবি

আপনার কথাই ঠিক হতে যাচ্ছে মনে হয়। তবে এখনো ক্যালিস আছে।

২৫০+ চেজ করা কঠিন হতে পারে, বিশেষত এইরকম টার্নিং উইকেটে। ২২০-৩০ রানে থামিয়ে দিতে পারলে টাইগাররা ভালোভাবেই জিততে পারবে মনে হচ্ছে।

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

২৫০-২৮০র মধ্যে আটকানো যাবে মনে হচ্ছে হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

ব্যাটসম্যানরা দায়িত্ব নিয়ে খেললে বাংলাদেশের পক্ষে খেলা জেতা সম্ভব...কিন্তু মনে হচ্ছে সাউথ আফ্রিকা ৩০০ এর কাছাকাছি যাবে মন খারাপ

মীর তাজবিনূর শরীফ

অনুপম ত্রিবেদি এর ছবি

বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা তো একটা ব্যাটিং পিচে উইকেট বিলিয়ে দেয়ার খেলায় মেতেছেন আবার। যার যা কর্তব্য সেটা পালন করার দায়িত্ব তার, সেটা যদি কেউ করতে না পারে তবে এদের কি বলে বোঝানো যায়????

আবারো বসে বসে ব্যাটসম্যানদের 'বেক্কেলামি' দেখতে হচ্ছে ... ... রেগে টং

==========================================================
ফ্লিকারফেসবুক500 PX

দ্রোহী এর ছবি

পেরেছি তো! আইজকা ব্যাটিংয়ে সাউথ আফ্রিকারে কোপাইয়ালাইছি। দেঁতো হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।